#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_৩০
সাধনা চলে যাওয়ার পরেই শুভ্রতা আর স্পন্দন খাবার খেয়ে নিল। শুভ্রতা সব কিছু ঠিক করে উপরে যেতে নিলে স্পন্দন আচমকাই কোলে তুলে নিলো শুভ্রতা-কে…….
—” এই কি করছেন ছাড়েন বলছি। যাকে এত ঘৃনা করেন তাকে কোলে নিতে লজ্জা করে না?”
—” লজ্জা করলে কি আর কোলে নিতাম। তাছাড়া আমার লজ্জা শরম খুব কম।”
ড্রেসিং টেবিলের টুলে বসিয়ে শুভ্রতার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো স্পন্দন।
—” কি দেখছেন এইভাবে?”
—” কান্না করে তো একদম পেত্নী সেজে বসে আছো। তোমাকে দেখে ভাবছি সনি আটে ভুতের অ্যাক্টিং করাবো এই জন্য তাকিয়ে আছি।”
শুভ্রতা রেগে গিয়ে বললো…..
—” আপনি কখন কি মুডে আসেন বুঝতে পারি না আজব লোক আপনি। আজবের পাশাপাশি অসভ্যও অনেক।”
স্পন্দন ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে মেয়েদের সাজের জিনিসগুলো বের করল। শুভ্রতা বার বার জিজ্ঞাসা করছে কি করবে বাট স্পন্দন কিছু না বলে শুভ্রতা-কে সাজাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল…..
—” আমাকে পেত্নী বানানোর জন্য তো উঠে পড়ে লেগেছেন। আমি কিন্তু ভীষণ রেগে যাচ্ছি।”
—” চুপ করো তো সেই কখন থেকে পাশের দেশ নোয়াখালী জেলার মানুষদের মত বকবক করে যাচ্ছো দেখছো না আমি পার্লার থেকে এসেছি তোমাকে সাজাতে।”
—” বাব্বাহ কি আমার পার্লারের লোক গো। কোন দেশ থেকে শিখে এসেছেন? পাশের দেশ নোয়াখালী না-কি বরিশাল?”
—” পাশের দেশ কিশোরগঞ্জ থেকে শিখেছি এখন চুপ থাকো।”
শুভ্রতা কিশোরগঞ্জ জেলার নাম শুনে রাগে আগুন হয়ে আছে । নিজের জন্মভুমি নিয়ে ঠাট্টা করা সে মোটেও পছন্দ করে নাই কিন্তু ভয়ে কিছু বলছে না পরে যদি তাকে ভুত সাজিয়ে ফেসবুকে পিক আপলোড দেয় সবাই কি বলবে।
স্পন্দন শুভ্রতার চোখে কাজল,আইলেন দিয়ে আর্ট করে কপালে টিপ পড়িয়ে দিল। ঠোঁটে লিপস্টিক আর ঠোঁটে বানানো তিল। শুভ্রতা-কে সাজিয়ে স্পন্দন বলল…..
—” আয়নায় একবার দেখো তো তাকিয়ে আমার সাজানোর হাত কেমন?”
আয়নায় নিজেকে তাকিয়ে দেখলো স্পন্দন তাকে খারাপ ভাবে সাজায় নি। এত ভালো না হলেও সাজটা মন্দ না। খুশি হয়ে বলল…..
—” আপনি তো দেখছি সত্যিই খুব সুন্দর করে সাজাতে পারেন। কিশোরগঞ্জ দেশের ট্রেনিং কিন্তু খুব ভালো দেখছি।”
—” নিজের এলাকার পাদও খুব ভালো। যতই বিশ্রী গন্ধ হোক নিজের দেশের পাদ তো।”
—” ছিঃ অসভ্য লোক একটা।”
স্পন্দন হেসে দিয়ে আলমারির দিকে যেতে লাগলো। আলমারি থেকে ডিভোর্স পেপারটা এনে শুভ্রতার সামনে রাখলো। ডিভোর্স পেপারটা দেখে শুভ্রতার বুক কেঁপে উঠলো। এখন তো এক বছর হয় নি তাহলে হটাৎ স্পন্দন ডিভোর্স পেপার আনলো কেন? না-কি তাকে এক বছর হওয়ার আগেই ডিভোর্স দিতে চায়? এই জন্যই কি তাকে সুন্দর করে নিজের হাতে সাজিয়েছে স্পন্দন? হাজারো চিন্তা ভাবনা মনে ধারণ করলো শুভ্রতা।
—” ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ডিভোর্স পেপারটা মনে হয় আমাদের জীবনে কোনো দরকার নেই।”
—” আপনি আমায় ডিভোর্স দিবেন না?”
—“কেন তোমার কি ডিভোর্স পেতে ইচ্ছা করছে?”
—” সব সময় উল্টো কথা বলেন? আচ্ছা আপনার জন্ম কি উল্টো ভাবে হয়েছে?”
—” হ্যাঁ আমার আচার আচরণ সব উল্টো। শুভ্রতা একটা কথা বলবো?”
—” হুম।”
—” আমি যদি তোমার কাছ থেকে কিছু চাই তুমি কি না করবে?”
—” কি চাই আপনার?”
—” আমাকে একটা চাঁদ দিতে পারবে? আকাশের চাঁদ যেমন রাতে সমস্ত পৃথিবীকে তার আলো দিয়ে থাকে ঠিক আমার ঘরেও আমাকে সারা রাতদিন একটি চাঁদ আলো দিবে। যার ছোট ছোট আঙ্গুল গুলো ধরে আমি তাকে হাঁটা শিখাব। আমি অফিস থেকে আসলেই দৌঁড়ে এসে কেউ আমাকে আব্বু আব্বু বলে আমার কোলে উঠবে। আদু আদু গলায় বলবে…. আব্বু আমার জন্য চকোলেট, আইসক্রিম, খেলনা এনেছো? তখন আমি প্রথম না বলবো তখন সেই চাঁদের আলো মাখা মুখ অন্ধকার করে ফেলবে আমি তখন খেলনা মজা তার সামনে ধরে বলবো এই যে আমার চাঁদের জন্য আমি কি কিনে এনেছি। তখন আমার চাঁদ খুশি হয়ে আমার গলা জড়িয়ে চুমু খাবে। দিবে কি সেই চাঁদ আমাকে এনে?”
শুভ্রতা ভীষণ ভাবে লজ্জা পেল। লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে রাখল। স্পন্দন শুভ্রতার মুখ উপরে তুলে জিজ্ঞাসা করলো…..
—” আমার কথায় রাগ করেছো তুমি?”
—“উহু।”
স্পন্দন শুভ্রতার কথা শুনে শুভ্রতার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। বিয়ের এতদিন পর তারা আজ একে অন্যর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করলো।
অন্যদিকে……
সাধনা হাটু মুড়ে কপাল হাঁটুর কাছে রেখে বসলো। মুগ্ধর চিন্তায় তার চোখে ঘুম নেই। বাড়িতে তারা দুজন ব্যাধিত তৃতীয় কোনো ব্যাক্তি থাকতো না । মুগ্ধর কিছু হয়ে গেলে কেউ বলতেও পারবে না যদি সে মারা যায় তাহলে শরীর দাফন করার মতোও কেউ থাকবে না। এইগুলো ভেবে অজরে কান্না করছে সাধনা। এত অত্যাচার সহ্য করার পরেও সে কেন যেন মুগ্ধর কিছু হোক মানতে পারছে না।
সকালে……
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের পানি মুছতে লাগলো শুভ্রতা। রাতের কথাগুলো ভাবতে বড্ড লজ্জা করছে তার। কোনোদিন ভাবিনি স্পন্দন তার স্বামী হবে আর এমন একটি রাত তারও আসবে। স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। নিষ্পাপ বাচ্চার মত ঘুমিয়ে আছে সে। শুভ্রতা দুষ্টুমি করে স্পন্দনের গায়ে চুলের পানি ছিটিয়ে দিল। স্পন্দন চোখ মেলে শুভ্রতা-কে দেখে হাত ধরে টেনে তার বুকের কাছে মিশিয়ে বলল…..
—” গুড মর্নিং প্রিয় চাঁদের আম্মু।”
—” গুড মর্নিং চাঁদের আব্বু। আচ্ছা চাঁদ কি ছেলে না-কি মেয়ে?”
—” দুটোই। আমাদের ছেলে হলেও চাঁদ মেয়ে হলেও চাঁদ। এখন যেই আসে আমাদের ঘরে।”
—” কবে আসবে তার খবর নেই আগেই নাম ঠিক করে রেখে দিয়েছে। এখন যদি চাঁদ আসার আগেই চাঁদের আম্মু চাঁদের কাছে আই মিন আকাশে চলে যায় তখন কিভাবে আসবে?”
—” সকাল সকাল মুড নষ্ট করার কোনো দরকার কি ছিল? আজ সারাদিন খারাপ যাবে আমার।”
—” মজা করছি তো।”
—” আমি এইসব মজা পছন্দ করি না ওকে।”
—” সরি।”
—” এক শর্তে ক্ষমা করবো।”
—” কি শর্ত?”
—” একটা পাপ্পি দেও তাহলে ক্ষমা করবো।”
—” এহহহ বয়ে গেছে আমার।”
—” তাহলে কিন্তু রেগে যাবো আবারো,,, প্লিজ!”
বাচ্চাদের মত বলাতে শুভ্রতা আর না করলো না। স্পন্দনের পাওনা দাবি দিয়ে দিল।
অন্যদিকে সমুদ্রের সারা রাত ঘুম নেই। সন্ধ্যার চিন্তায় মগ্ন সে। নাদিয়াকে সন্ধ্যার কথা বলাতে প্রথমে সে খুব বকে কিন্তু যখন সমুদ্র সব বুঝিয়ে বলে তখন নাদিয়া বুঝতে পারে। নাদিয়া সমুদ্রকে দুষ্টু একটি আইডিয়া দিল। আইডিয়া হলো নাদিয়া আসার আগে সন্ধ্যার ফোন নম্বর নিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা যেহেতু বাচ্চা মেয়েদের মতো আচরণ করে তাই তাকে পটাতে কষ্ট পোহাতে হবে না। সমুদ্রকে বলেছে তার নাম চাদর বলতে তাহলে সন্ধ্যা এই নাম শুনে খুব হাসবে কিন্তু বুঝতে পারবে না এই অদ্ভুদ নাম কারো হয় না। নাদিয়ার প্ল্যান অনুযায়ী সমুদ্র ফোন দিল…….
—” আসসালামু আলাইকুম মিস।”
—” ওলাই-কুম আসসালাম। কে আপনি?”
—” আমি তোমার সাথেই পড়াশোনা করি। কোন ক্লাসে পড় তুমি?”
—” ক্লাস ফাইভে আপনি?”
—” ফাইভে পড়ি আমিও।”
সন্ধ্যা নিজে পড়াশোনা করেছে। বাসায় টিচার রেখে তাকে পড়ানো হয়েছে বাট সে এখনও নিজেকে ক্লাস ফাইভে পড়ার বাচ্চা ভাবে।
অনেক্ষণ কথা হয় তাদের সন্ধ্যা যখন সমুদ্রর নাম জানতে চায় তখন সমুদ্র তার নাম চাদর বলে। সন্ধ্যা হেসে কুটি কুটি।
—” এই রকম নাম কেউ রাখে হাহাহা। চাদর কারো নাম হয়?”
—” হুম হয় তো এই যে আমার নাম। আচ্ছা সন্ধ্যা তোমাকে কিছু প্রশ্ন করি?”
—” হুম করো।”
—” বলোতো নামাজের কয় ফরজ?”
—” জানি না তো।”
সমুদ্র নামাজ বিষয়ে অনেক কিছু বলল। ছোট বাচ্চাদের ছোট থেকেই আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস, জাহান্নামের ভয়, জান্নাত পাওয়ার আশা শিখানো উচিত। সন্ধ্যা যেহেতু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী তার মন এখন বাচ্চা সুলভ। সমুদ্র প্রথম তাকে নামাজ, কুরআন, ইমাম সম্পর্কে জ্ঞান দিতে চাচ্ছে । যদি এইসব বুঝতে পারে তাহলে ধীরে ধীরে আরো সামনে আগানো যাবে।
সমুদ্রর কথা শুনে সন্ধ্যা তার মা ও ভাবির কাছ থেকে নামাজ সম্পর্কে অনেক কিছু শিখে সে এখন নামাজ পড়ে। সন্ধ্যার মা একজন মহিলা হাফেজ রেখে কুরআন শিখাচ্ছে তাকে।
এক মাস পর……
সন্ধ্যা এখন বেশি চকোলেট খায় না। সাধনা মনে মনে মুগ্ধকে নিয়ে চিন্তা করে। সাধনা ভেবে রেখেছে মুগ্ধ আর নেই। স্পন্দন আর শুভ্রতার প্রেম ভালোবাসা জমে ক্ষীর। যতদিন যাচ্ছে তাদের ভালোবাসা ততই বেড়ে চলছে। সন্ধ্যার চকোলেট গুলো পরীক্ষা করে কোনো সন্দেহ জনক কিছু পাওয়া গেল না। শুভ্রতার সন্দেহ এখন সন্ধ্যা ড্রাগস দেওয়া চকোলেট প্রকাশ্য রাখে না। শুভ্রতা এখন সন্ধ্যার সেই আপুকে খুঁজতে ব্যাস্ত। কেননা, এই প্ল্যান ওই আপু ছাড়া আর কেউ সন্ধ্যাকে বলবে না।
চলবে……
বানান ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।