#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_৩৩
রাত দুইটায় সাধনা আর শুভ্রতা বসে সন্ধ্যার রুমে। সন্ধ্যা স্পন্দনের জন্য ওয়েট করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে। চকোলেট না খাওয়ার কারণে শরীর কিছুটা খারাপ হয়েছিল সন্ধ্যার কিন্তু ভাইয়ের কাছে প্রমিজ রক্ষা করার জন্য সে খেতে চেয়েও খায় নি। শুভ্রতা সাধনাকে অনেক বলেছে ঘুমিয়ে পড়তে কিন্তু সাধনা রাজি হলো না।
—” আপু একটা কথা বলবো?”
—” হুম বল?”
—” আপু মুগ্ধ কি বেঁচে আছে?”
সাধনার কথা শুনে শুভ্রতা সাধনার দিকে তাকালো। সাধনার কথা ঠিক বুঝতে পারলো না শুভ্রতা। শুভ্রতার কৌতূহল মুখ দেখে সাধনা বলল……
—” তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম আপু। আমি মুগ্ধর কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি। জানিস ও একটা সাইকো। আর আমি পালিয়ে আসার সময় ওর পানিতে অনেক গুলো ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়ে এসেছি। আমরা যে বাড়িতে থাকতাম সেই বাড়িতে আমরা দুইজন ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যাক্তি ছিল না। এখন যদি ওর কিছু হয়ে যায় কেউ জানতেই পারবে না।”
কথাগুলো বলে সাধনা কান্না করতে শুরু করলো। মুগ্ধকে সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
স্বামী ও স্ত্রীর বন্ধন নাকি সাত জন্মের। মানুষের জন্ম বার বার হয় না এইটা ঠিক তবুও মানুষরা তাদের ভালোবাসার মানুষের কাছে সাত জন্ম একসাথে থাকবে বলে ওয়াদা করে। একজন স্বামীর যেমন তার স্ত্রীর উপর অনেক দায়িত্ব থাকে। তেমনি স্ত্রী এর ও অনেক দায়িত্ব থাকে তার স্বামীর প্রতি। মুগ্ধ তার দায়িত্ব ঠিকই পালন করেছে হোক তার স্বার্থ রক্ষার জন্য। রাগের বশে সে সাধনাকে মেরেছে কিন্তু সাধনার কষ্ট হবে এমন কাজ রাগ ছাড়া সে করেনি। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটি শুধুমাত্র দায় বা দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ভালোবাসার সম্পর্ক মায়ার সম্পর্ক এই জন্যই হয়তো সাধনা মুগ্ধর মায়া ভুলতে পারছে না। মুগ্ধকে ছেড়ে এসেও সে বার বার মুগ্ধের কথা ভাবছে। স্বামী স্ত্রীর এই সম্পর্ক শুধু মানুষের কথা নয়। ধর্ম ও বিজ্ঞান উভয়ই এর সমর্থন করে।
অনেকেই মনে করে ইসলাম ধর্মে ভালবাসা বলতে কোন বিষয় নেই এবং এটি সম্পুর্ন নিষিদ্ধ। কিন্ত না মহানবী বলেছেন “তোমরা ঐ পর্যন্ত জান্নাতে যেতে পারবেনা যতক্ষণ না পর্যন্ত মুমিন হও, আর ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবেনা যতক্ষণ না পর্যন্ত একে অপরকে ভালো না বাসো।” স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক সামাজিক ও ধর্মীয় উভয় দিক থেকে পবিত্র সম্পর্ক।
শুভ্রতার চিন্তা এখন আরো বাড়তে শুরু করলো। স্পন্দনের ফোন অফ এখন আবার ছোট বোনের স্বামীর চিন্তা। সাধনা কিভাবে এত গুলো ভুল করতে পারলো ভাবতেই তার কষ্ট হচ্ছে। স্পন্দনের সাথে এতদিন থেকে সে বুঝতে পেরেছে ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়া কতটা কষ্টকর হবে। শুভ্রতা এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতে পারে না ও স্পন্দনের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে।
—” মুগ্ধর নাম্বার আছে তোর কাছে?”
—” অনেক বার ফোন দিয়েছি কিন্তু ওর ফোন অফ।”
শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল…..
—” চিন্তা করিস না যা হবে ভালোই হবে। আমাদের হাতে এখন আর কিছুই নেই। অতীতের কথা গুলো আপাতত ভুলে যাওয়াই বুদ্ধি মানের কাজ হবে।”
ঘড়ির কাঁটা চলতে চলতে তিনটার কাঁটার দিকে চলে আসলো। সাধনা সন্ধ্যার রুমেই ঘুমিয়ে পড়ল। শুভ্রতা সন্ধ্যার রুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমের ডাইনিং টেবিলে এক হাত মাথায় দিয়ে হেলিয়ে শুয়ে রইলো। তিনটা বেজে বিশ মিনিট কলিং বেল বাজতে শুরু করলো শুভ্রতা দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে স্পন্দনকে দেখে আচমকাই জড়িয়ে ধরলো। স্পন্দন এক হাতে শুভ্রতা-কে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো…..
—” সরি সুইটহার্ট ফোনে চার্জ ছিল না। জানি তুমি অনেক ফোন দিয়েছ তাই আগেই সরি বলছি। আর সকালের কথাগুলোর জন্য আমি সত্যিই খুব দুঃখিত জানেমান। রাগের বশে খুব বাজে কথা বলে ফেলেছি প্লিজ ক্ষমা করে দিও।”
শুভ্রতা স্পন্দনের বুক থেকে উঠে চোখের পানি মুছে বলল……
—” ভিতরে আসুন। পরে শুনবো কথা।”
স্পন্দন বাসায় ঢুকে অনেক কিছু বলতে লাগলো কিন্তু শুভ্রতার কানে কোনো কথাই যাচ্ছে না। সে মনে মনে মহান আল্লাহ তায়ালাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিচ্ছে ও শুকরিয়া আদায় করছে। স্পন্দন শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বললো…..
—” ডক্টর এসেছিল?”
—” হুম।”
—” কি বলেছে ডক্টর?”
—” সাধনার অবস্থা মোটামুটি ভালো আছে। ডক্টর সাধনাকে চিন্তা মুক্ত থাকতে বলেছে তাহলেই হবে। সন্ধার অবস্থাও এখন অনেক ভালো তবে যখন ড্রাগস নেওয়ার জন্য ছটপট করবে তখন তাকে কন্ট্রোল করতে হবে। তাছাড়া মেডিসিন দিয়ে গিয়েছে।”
—” আম্মু কোথায়?”
—” আব্বু আম্মু আপনার জন্য অপেক্ষা করে ঘুমিয়ে পড়েছে। উনাদের শরীর তো এখন আর ভালো নেই। আব্বুর না-কি এখন চোখের সমস্যাটা বেড়েছে। আর আম্মুর বুক ব্যাথা। ”
—” সারাদিন খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে বই আর পান নিয়ে পরে থাকলে অসুখ হবে না? কতবার করে বলেছি সময় মতো ওষুধ খেতে কিন্তু খাচ্ছে না।”
—” এখন এইসব বাদ দিন। আমরা সকালে এই নিয়ে কথা বলবো। এখন আপনি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হোন আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
—” ওকে।”
স্পন্দন সারাদিন কি করেছে তা জানার জন্য শুভ্রতার মন ছটপট করছে। দ্রুত গতিতে খাবার বেড়ে ট্রে তে করে রুমে নিয়ে গেল।
স্পন্দন এখনও ওয়াশ রুমে শুভ্রতা খাটের উপর পা দুলে বসে আছে। আগের থেকে শীত অনেক কমে গিয়েছে। আজ স্পন্দনের পছন্দের টাকি মাছের ভর্তা করেছে শুভ্রতা। স্পন্দন রুমে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে বলা শুরু করল……
—” তাবরীন-কে জেলে পাঠিয়ে পরে এসেছি। জানো কি চালাক মেয়ে। আমি ওর কাছে পৌঁছানোর আগেই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল সেই জন্যই তো এত দেরি। আজ মেয়ে মানুষ না হলে গায়ে হাত তুলতাম। কি ফাজি মেয়ে। মানছি আমার মন পাথরের মত শক্ত ছিল তাই বলে ও আমার বোনকে মারার প্ল্যান করবে। এখন থাক জেলের ভিতর।”
—” পাথরের মন তাহলে এখন তুলোর মত হলো কিভাবে?”
—” শুভ্রতার স্বচ্ছ ভালোবাসা পেয়ে শক্ত পাথরের মন তুলোর মত নরম ও সাদা হয়ে গেছে।”
শুভ্রতা এক প্লেটে খাবার বেড়ে স্পন্দন আর তার মাঝে রাখলো। এক প্লেটে খাবার খাওয়া সুন্নত। শুভ্রতা নিজের হাতে স্পন্দনকে খাইয়ে দিয়ে সেও খেল। খাবার শেষ করে দশ মিনিট হেঁটে দুইজন শুয়ে পড়লো। খাবার খেয়ে সাথে সাথে শুয়ে পড়লে পেটের মেদ বেড়ে যায় তাই খাবার খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ঘুমানো উচিৎ। এখন রাত অনেক তাই স্পন্দন আর শুভ্রতা শুয়ে পড়লো।
শুভ্রতা স্পন্দনের বুকে মাথা রাখলো। স্পন্দন শুভ্রতার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। শুভ্রতা বুকে মাথা রেখেই বলল….
—” একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?”
—” হুম বলো?”
—” আপনার বাবার সাথে কি এমন ঘটেছিল যার জন্য আপনার বাবাকে ঘৃনা করেন? যতদূর জেনেছি আপনার মা আপনার আপন মা না । আচ্ছা আপনার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করায় তার জন্য কি আপনার এত রাগ আপনার বাবার উপর।”
—” আব্বুর দ্বিতীয় বিয়েতে যদি আমার রাগ হতো তাহলে অবশ্যই আমি আমার দ্বিতীয় মাকে মানতে পারতাম না তাই না?”
—” হুম তাহলে কিসের এত রাগ আপনার উনার প্রতি?”
—” জানো যখন আমার মা মারা যায় তখন আমার বয়স সাত কি আট। আম্মু মারা যাওয়ার দুই বা আড়াই বছর পর আব্বু দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আমি এতগুলো দিন মা ছাড়া থেকে খুব কষ্টই পেয়েছিলাম কিন্তু যখন নতুন মা আসে তিনি খুব আদর ভালোবাসা মমতা দিয়েই আমার দেখা শোনা করেছেন এমনকি এখনও করেন। আমাদের তিনজনের ছোট্ট পরিবার খুব ভালো ভাবেই চলছিল। আমাদের এই ছোট্ট পরিবারে তখন আরেকটি সদস্য যোগ হয় সে হলো আমার তারা অর্থাৎ সন্ধ্যা তারা। সন্ধ্যা তারা আসার পর আমাদের ভালোবাসার মুহূর্ত আর দিন দিন বাড়তে শুরু করলো। জানো সন্ধ্যা ছোট থাকতে স্বাভাবিক ছিল। একদিন আব্বু সন্ধ্যাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় তখন সন্ধ্যার বয়স পাঁচ। সন্ধ্যাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে আব্বু সন্ধ্যার জন্য আইস ক্রিম কিনতে যায় আর ছোট্ট সন্ধ্যা আব্বুর পিছনে দৌড় দিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করে। ডক্টর তো বলেই দিয়েছিল সন্ধ্যা আর বাঁচবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা বেঁচে যায় তবে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হিসেবে। সেদিনের পর থেকে আব্বুর প্রতি আমার রাগ সৃষ্টি হয়। আজ সন্ধ্যার এই অবস্থার এক মাত্র কারণ উনি। আজ উনার জন্যই আমার সন্ধ্যা তারা অসুস্থ। কোনোদিন ক্ষমা করবো না উনাকে।”
—” সম্পূর্ণ ভুল একটা কথা বললেন আপনি। আচ্ছা আব্বু যদি জানতো ওইদিন এমন একটি ঘটনা ঘটবে তাহলে কি উনি কোনোদিন সন্ধ্যাকে এইভাবে একা রেখে যেতে পারতো? হুম এইটা ঠিক আব্বু সেদিন সন্ধ্যাকে একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাখা ঠিক হয় নি উনার উচিৎ ছিল সন্ধ্যাকে সাথে করে নিয়ে আইস ক্রিম কিনতে। জানেন নিয়তি বলে একটি কথা আছে সেই নিয়তির লেখন কেউ খন্ডাতে পারে না। এই যেমন মানুষ কখন কিভাবে মারা যাবে কেউ বলতে পারে না। মহান আল্লাহ তায়ালা যার আয়ু বা দুনিয়াতে যত দিনের জন্য পাঠিয়েছেন সে তত দিনই বেঁচে থাকবে। একদিন কম বা বেশি হবে না এমনকি এক সেকেন্ডও না। তেমনি ভাবে ধরে নিন সেদিন সন্ধ্যার নিয়তিতে এমন একটি অঘটন লিখা ছিল সেই জন্য ঘটেছে এই ঘটনা। ”
স্পন্দন শুভ্রতার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো। এই প্রথম শুভ্রতার বুঝানোর স্টাইল আর কথা খুব ভালো লাগতে শুরু করলো স্পন্দনের।
—-” মানুষের ভাগ্য তার জন্মের পূর্বেই নির্ধারিত হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ আবু আবদুর রহমান আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম, যিনি সত্যায়নকৃত সত্যবাদী ছিলেন, তিনি আমাদের বলেছেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের প্রত্যেক মানুষের সৃষ্টি তার মায়ের পেটে চল্লিশ দিন শুক্র-রূপে জমা হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়, অতপঃর চল্লিশ দিন জমাট বাঁধা রক্ত-পিণ্ডে পরিণত হয়, তারপর চল্লিশ দিন মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়। অতঃপর তার কাছে ফেরেশতা প্রেরিত হয়। তিনি (ফেরেশতা) তার ভেতর রুহ ফুঁকে দেন। তাঁকে চারটি বিষয় লিখে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, জীবিকা, বয়স, আমল ও তার সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২০৮)
ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক ভাগ্যে বিশ্বাস করা ঈমানের অংশ।”
সারারাত স্পন্দন শুভ্রতার কথা গুলো ভাবতে লাগলো। এতদিনের রাগ অভিমানের পাল্লা যেন শুভ্রতার এক কথাতেই শেষ হয়ে গেল। ভোরের সূর্য উঠার সাথে সাথে সবার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সুচনা শুরু হবে এই আশা নিয়েই রাত কাটিয়ে সকালের জন্য তৈরি হলো সবাই।
চলবে…..
ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।