#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_৩৫
—” কেন এসেছ তুমি এইখানে? তোমার হবু বউ যদি শুনে তাহলে রাগ করবে।”
—” আমার হবু বউ রাগ করবে বাট আমার সন্তানের মা রাগ করবে না?”
—” আমি কারো সন্তানের মা নই। এই সন্তান শুধুই আমার।”
সাধনা চোখের পানি আড়াল করার জন্য উল্টো ঘুরল। মুগ্ধ খুব ভালোই টের পাচ্ছে সাধনা যে কান্না করছে। সাধনার সামনে গিয়ে কানে হাত দিয়ে বলল…..
—-” সরি বউ প্লিজ ক্ষমা করে দেও। জানি অনেক ভুল করেছি আর তোমাকেও ইউজ করেছি কিন্তু তুমি জানো না আমি যে তোমাকে কতো ভালোবাসি। তোমাকে আর আমাদের সন্তান ছাড়া আমার এই জীবন অসম্পূর্ণ। তুমি তো জানোই তোমার বর সাইকো তুমি তো এই সাইকো দেখেই ভালোবেসেছিলে তাহলে কেন দূরে সরে যাচ্ছো। আমাদের বাচ্চার কথা ভেবে কি এই খারাপ স্বামীকে ক্ষমা করতে পারবে না?”
সাধনা মুগ্ধর প্রতি দূর্বল। প্রিয় মানুষের চোখের পানি দেখলে বুকের ভেতর হাহাকার শুরু হয়। তবুও মনটাকে শক্ত করে বলল…..
—” তুমি নতুন বউ নিয়ে সুখে থাকো এইটাই চাই আমি। চিন্তা করো না তোমার সন্তান খুব ভালোই থাকবে। স্পন্দন ভাইয়া তোমার ব্যাপারে সব জানা সত্বেও তোমার স্ত্রী ও সন্তানকে কষ্ট দেয় নাই। আমি জানি আজ আমার জায়গায় যদি আপু থাকতো আর ও যদি তোমার বাড়িতে যেতো স্পন্দন ভাইয়ার সন্তান নিয়ে তাহলে তুমি কখনোই আপুকে জায়গা দিতে দিতে না।”
—” আমাকে এত খারাপ ভাবো তুমি ?”
—-” ভালো ভাবার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। আচ্ছা এখন বলো তুমি জানলে কিভাবে আমি এইখানে এসেছি?”
—” হসপিটালে থেকে তোমার অনেক খুঁজ নিয়েছি। তোমার বাসায় খুঁজ নিয়ে জানলাম তোমার আব্বু জায়গা দেয় নাই তখন বুঝে নিলাম তুমি স্পন্দনের বাড়িতে আছো।”
—-” আমি নিজ ইচ্ছায় আসিনি। স্পন্দন ভাইয়া নিয়ে এসেছে।”
—” তার খবরও আমার কাছে আছে। ফুফি বলেছে আমাকে।”
—” ফুফি কে ?”
মুগ্ধ থেমে যায় এখন। কি বলতে কি বলে ফেলেছে সে। এই কথা সাধনাকে জানানো একদম ঠিক হয় নি। সাধনা বার বার জিজ্ঞাসা করছে কিন্তু মুগ্ধ চুপ।
—-” বলবে না?”
—-” সময় হলে বলবো। ওষুধ খাচ্ছ ঠিক মত?”
—-” হুম। শরীর এখন কেমন তোমার?”
—-” যা অবস্থা করে এসেছো মরতে মরতে বেঁচে গেছি। কেন করলে এমন আমার সাথে যদি মরে যেতাম?”
—-” আমাকে মারার সময় মনে ছিল না যদি আমি মরে যেতাম তখন।”
—-” সাধনা এমন বাজে কথা আর বলবে না। তোমার কিছু হবে না।”
—-” কাকে বিয়ে করছো? ছবি আছে বউয়ের?”
—” হুম আছে।”
—” দেখাবে আমার সতিনকে?”
মুগ্ধ দুষ্টুমি করলো সাধনার সাথে। ফোন বের করে সাধনা ও মুগ্ধের বিয়ের আগের ঘুরতে যাওয়ার সময় যা যা পিক তুলেছিল তার থেকে একটি পিক দেখালো…….
—-” এই দেখো তোমার সতীন?”
সাধনা ছবি দেখে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। মুগ্ধ ঠোঁট কামড়ে হাসি দিয়ে বলল…..
—-” খুব সুন্দর তাই না?”
—-” এইটা কি ধরনের মজা?”
মুগ্ধ দরজার দিকে উকি দিয়ে দেখলো কেউ নেই। সাধনার হাত দুটি ধরে বলল……
—” ক্ষমা করেছো আমাকে? দেখো তোমাকে আমি যেমন শাস্তি দিয়েছি তুমিও কিন্তু আমাকে শাস্তি দিয়েছো। তোমার দেওয়া ঘুমের ওষুধের পানি খেয়ে যদি আমার মারা যেতাম কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারতে? দেখো এইদিক দিয়ে তোমাকে কিন্তু আমি বাঁচিয়ে দিয়েছি।”
—” মুখে এত বাজে কথা কিভাবে আসে?”
—-” বাস্তব বলছি। এখন সত্যি করে বলো তুমি আমায় ভালোবাসো না। সন্তান পেটে নিয়ে মিথ্যা বলবে না জানি আমি।”
সাধনা কাঁদতে শুরু করলো। কান্নার মানে মুগ্ধ খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে। সাধনার চোখের পানি মুছে দিয়ে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করল সাধনাকে।
_________________________
মিসেস সাবিনা বেগম বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে ড্রয়িং রুমে একটি ছেলেকে দেখতে পেয়ে তার পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এত বছর পর নিজের গর্ভে ধারণ করা সন্তানকে সামনে থেকে দেখে সব ভুলে গিয়েছেন উনি। স্পন্দন ও সন্ধ্যার মুখে মা ডাক শুনলেও অনেক বছর ধরে মুগ্ধের মুখে মা ডাক শুনেন নি উনি। কতবার ফোন দিয়েছে তার হিসাব নেই। সন্তানের মুখে মা ডাক শোনার জন্য অনেক চেষ্টায় করেছেন উনি কিন্তু মুগ্ধ কথা বলে নাই।
এতগুলো বছর পর আজ মুগ্ধ তার বাড়িতে এসেছে ভাবতেই আনন্দে তার কান্না পাচ্ছে। স্পন্দনের বাবার সাথে বিয়েতে মিসেস সাবিনা বেগম প্রথম রাজি ছিলেন না। কিন্তু শ্বশুড় বাড়ির জোরাজোরি-তে তিনি এই বিয়ে করতে রাজি হোন। মিসেস সাবিনা বেগমের আগের স্বামীর মৃত্যুর সাত বছর পর তিনি দ্বিতীয় বিয়েতে আবদ্ধ হোন। মুগ্ধর বয়স তখন নয় ছিল। মায়ের বিয়ে মুগ্ধ মানতে নারাজ ছিল এই জন্য এতগুলো বছর সে তার মায়ের সাথে কথা বলেনি। মিসেস সাবিনা বেগমের ননদ অর্থাৎ মুগ্ধের ফুফুর সাথে মিসেস সাবিনা বেগমের প্রায় কথা হতো। মিস্টার আজম মুগ্ধকে তার বাড়িতে আসার কথা বলেছিল কিন্তু মুগ্ধ রাজি হয় নাই। ছোট থেকেই মনের মাঝে রাগ পোষণ করে মুগ্ধ। সে শুনেছিল তার মার যেখানে বিয়ে হয়েছে সেখানে একটি ছেলে আছে তার মা সেই ছেলেকে খুব ভালোবাসে। মুগ্ধ নিজে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয় তার দোষারোপ করে স্পন্দনের উপর। এই জন্য স্পন্দন মুগ্ধকে চিনে না। স্পন্দনের সাথে মুগ্ধের শত্রুতা করার কারণ এইটাই ছিল।
মিষ্টার আজব তার স্ত্রীর চোখে পানি দেখে জিজ্ঞাসা করল……
—” কি হয়েছে কান্না করছো কেন?”
মিসেস সাবিনা বেগম বলে দিলেন মুগ্ধ এই বাড়িতে আসার কথা। মিষ্টার আজম খুশি হয়ে বললেন…..
—-” ভালোই তো হলো। যাও নিজের বড় ছেলের সাথে কথা বলো। সন্ধ্যা ও স্পন্দনকে তাদের বড় ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেও। ছেলেটা এতদিন পর এসেছে তুমি তার সাথে কথা বলবে কিন্তু তা না করে বসে বসে কান্না করছো।”
—-” মুগ্ধের নাম শুনে তোমার রাগ হলো না?”
—” কেন রাগ হবে? তুমি যদি আমার ছেলেকে এত ভালোবাসতে পারো তার এত খুঁজ নিতে পারো মায়ের আদর দিতে পারো আমি কেন পারবো না মুগ্ধকে বাবার আদর দিতে?”
সাবিনা বেগম চোখের পানি মুছে বললেন……
—-” সাধনার স্বামী মুগ্ধ।”
এই কথাটা শুনে মিস্টার আজম বেশ চমকে উঠলেন। মিসেস সাবিনা বেগম লুকিয়ে থেকে যা শুনেছেন সব বললেন। মিষ্টার আজম খুশি হয়ে বললেন……
—” শুভ্রতা আর সাধনা দুই বোন আমার ঘর আলো করার জন্য এসেছে। এতদিন স্পন্দন আমার সাথে কথা বলে নাই কিন্তু আজ সকালে আমার পা ধরে ক্ষমা চেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিল। কতদিন পর নিজের সন্তানের মুখে বাবা ডাক শুনলাম। দুই বোন আমার ঘরের ভাঙ্গা সম্পর্কগুলো জোড়া করতে শুরু করে দিয়েছে।”
মিসেস সাবিনা বেগম হাসলেন।
—-” স্পন্দন কি মুগ্ধর কথা শুনে রাগ করবে? তাছাড়া মুগ্ধ তো আমাকে দেখতে আসে নাই। সে তো তার সন্তান ও বউয়ের জন্য এসেছে।”
—-” একবার যেহেতু এসেছে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
—-” হুম।”
________________________
শুভ্রতা সাধনার রুমের কাছে এসে বলল……
—-” আসবো?”
সাধনা হেসে উত্তর দিলো…..
—-” আয় আপু।”
—-” সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে তো?”
মুগ্ধ চুলে হাত বুলিয়ে বলল……
—-” জ্বি আপু ঠিক হয়ে গেছে।”
শুভ্রতা মুগ্ধর সামনে দাঁড়িয়ে বলল……
—-” সরি তোমাকে ওই সময় এইভাবে চড় মারার জন্য। তুমি আমার থেকে অনেক বড় হবে তোমাকে এইভাবে চড় মারা ঠিক হয় নি আমার।”
—” আপু আপনি চড় মেরে অনেক ভালো কাজ করেছেন। নিজের রাগ মনে পুষিয়ে রাখা ঠিক না।”
স্পন্দন রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল…..
—” তাহলে আমার প্রতি কি এত রাগ তোমার যার জন্য এত ক্ষতি করতে চাইছ আমার?”
এই প্রথম স্পন্দনকে দেখে মুগ্ধর রাগ হলো না। কি একটা কারণে সে চুপ করে আছে। কিন্তু মনের ভেতর মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে কিছুটা রাগ হচ্ছে স্পন্দনের প্রতি।
শুভ্রতা বলল…..
—” নাস্তা সেরে পরে সব কিছু জানবো। এখন সবাই আসো । ”
মুগ্ধ,স্পন্দন ও সাধনা একত্রে বলল……
—” হুম।”
_______________________
খাবার টেবিলে মিসেস সাবিনা বেগম ও মিস্টার আজম বসে আছে। অন্যদিকে সন্ধ্যা বসে বসে নুডলস খাচ্ছে। মুগ্ধ তার মাকে দেখে থমকে গেল। পরিবেশটা বেশ শান্ত হয়ে গেলো। মিসেস সাবিনা বেগম সন্তানকে দেখে আনন্দের কান্না সাগরে পরিণত করে দিলেন……….
চলবে……..
বানান ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।