সম্পর্কের মায়াজাল পর্ব-১৯

0
3503

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_১৯

শুভ্রতা ঘুমের মাঝে খুব অস্বস্তি বোধ করছে। অস্বস্তি বোধটা খুব বেশি লাগছে তার কাছে। ঘুম থেকে উঠে পানি খুঁজতে গিয়ে স্পন্দনকে দেখে চমকে গেলো। স্পন্দন তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। শুভ্রতা স্বপ্ন দেখছে না-কি বাস্তব বুঝতে পারছে না। এত রাতে স্পন্দন তার কাছে তাও আবার তার বাবার বাড়িতে। শুভ্রতা স্বপ্ন ভেবেই নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বলল…..

—” এই স্যার নামক মানুষটি আমার সব জ্ঞান কেরে নিয়েছে। কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব সব অভিজ্ঞতা এখন পানিতে মিশে গিয়েছে। যেখানেই থাকাই শুধু এই মানুষটিকে দেখতে পাই। পাগল হয়ে যাবো আমি পাগল হয়ে যাবো।”

—-” পাগল হবে না পাগল হয়ে গেছো অলরেডি। এত রাতেও বকবক করছো।”

শুভ্রতা চমকে উঠে বলে উঠলো…..

—স্বপ্নের স্যারের কথাগুলোও বাস্তবের স্যারের মতো। বাস্তবেও নিরামিষ স্বপ্নেও নিরামিষ একটা লোক।মাঝে মাঝে মন চায় টয়লেট ঝাড়ু দিয়ে উনার নিরামিষ গিরি বন্ধ করি।”

—” আরেকবার কথা বললে তোমাকে এক্ষুনি তোমাদের টয়লেটের ঝাড়ু দিয়ে মেরে মাথা থেকে ভুত সরাবো মাইন্ড ইট।”

শুভ্রতা এতক্ষণে বুঝ-লো এতক্ষণ যেগুলো সে স্বপ্ন ভেবে এসেছে সেগুলো স্বপ্ন নয়। অতি বাস্তব ও অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ঘটনা।ভয় কে জয় করে চোখ বন্ধ করে শুভ্রতা তার মনের ভিতরের প্রশ্ন স্পন্দনকে ছুড়ে মারলো…..

—” স্যার, আপনি এত রাতে এইখানে কি করছেন? খুন করতে আসেন নি তো?”

—” আমি আমার শ্বশুরের বাসায় এসেছি। নিজের বউয়ের কাছে এসেছি। বউয়ের কাছে আসতে কি রাত দিন মিলিয়ে আসতে হয়? ‘খুন ‘ তো তোমাকে করবই আমি। খুন করার আগে অবশ্য বলে করবো না!”

—” আমার রুমে কিভাবে এসেছেন? বাসায় যদি আম্মু আব্বু টের পেত কি হতো একবার ভেবেছেন?”

—” আজব তো! নিজের বউয়ের কাছে এসেছি এইখানে কে কি ভাববে তা ভেবে সময় নষ্ট করবো কেন? আমি তো তোমার বয়ফ্রেন্ড না যে ভয় পাবো আমি তো তোমার স্বামী।”

—” সকালে যদি আপনাকে কেউ দেখে এইখানে ছিঃ কি লজ্জা। কি ভাববে উনারা?”

—” উনারা তো আমাকে দেখেছেন। এখানে ভাবা ভাবির কি আছে?”

—” দেখেছে মানে?”

—” তোমাদের বাসায় আসছি আর উনারা জানবে না এইটা কেমন কথা? তাছাড়া তুমি যেভাবে ঘুমাচ্ছিলে দরজা কে খুল-তো? ”

—” মানে আম্মু বা আব্বু দরজা খুলে দিয়েছে?”

শুভ্রতা স্পন্দনের কথা শুনে ধম করে বসে পরে। স্পন্দন বিছানা থেকে উঠে বালিশ পেটের কাছে নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসলো…..

—” আজ শাশুড়ি মা যে খাবার আমাকে খাইয়েছে দেখো একদিনেই ভুরি হয়ে গেছে।”

—” কখন এসেছেন আপনি?”

—” কখন এসেছি এইটা বড় কথা নয় বড় কথা হলো বউ ছেড়ে থাকা যাবে না।”

—” ডিভোর্সের পর কি করবেন?”

—” তখন মেনে নিবো যে আমার বউ নেই। এখন যেহেতু আছে তাহলে একা কেন ঘুমাবো?”

—-” তাহলে আপাতত আমাদের এই সম্পর্কের নাম কি?”

—” স্বামী স্ত্রী। কেন জানো না বিয়ের পর কি নাম হয় ?”

—” জানবো না কেন? কিন্তু কোনো বিয়েতে তো বিয়ের প্রথম রাতেই ডিভোর্সের কথা বলা হয় না।আমাদের বিয়ে তো সত্যি কারের বিয়ে নয়। আমরা অন্য কোনো দম্পত্তির মত নই। তাহলে কেন আপনি সব সময় আমাকে বউ বউ করে ডাকবেন। আপনার সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর যখন আমার অন্য কোনো জায়গায় বিয়ে হবে তখন তো আমার নিউ স্বামীকে মানতে আমার কষ্ট হবে। তার থেকে ভালো না আগে থেকেই দূরে সরে যাই।”

—-” যা বলেছে আজকেই বলেছো দ্বিতীয় বার এমন কথা আর বলবে না। হ্যাঁ প্রথম থেকেই বলে এসেছি তোমাকে ডিভোর্স দিবো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোমাকে ডিভোর্স দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।”

—” কেন সম্ভব না?”

—-” জানি না। শুধু জানি তোমাকে ডিভোর্স দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। এখন ভালো মেয়ের মত শুয়ে পর।”

স্পন্দন শুয়ে পড়ে। শুভ্রতা ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসি হেসে মনে মনে বলল…..

—-” চান্দু আমাকে যে তুমি ভালোবাসো আমি জানি । ইগো শব্দটির জন্য মুখ ফুটে বলতে চাও না কিন্তু কি তাতে এই শুভ্রতা ঠিক আদায় করে নিবে তার পাওয়া ভালোবাসা।”

মানবিক অনুভূতি এবং আবেগকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা দ্বারা বুঝা যায় ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তবুও ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে শোনার জন্য বুঝেও না বুঝার ভান করতে হয়।

ভালোবাসা হলো নরম তুলোর মত আবেগ,বিশ্বাসে মোড়ানো,যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না বা প্রকাশ করতে পারে না। ভালোবাসার নেই কোনো ঘ্রাণ,রূপ, রঙ, আকার আকৃতি, শব্দ শুধু আছে তীব্র অনুভুতির এক অদ্ভুদ ক্ষমতা। ভালোবাসার শক্তি এতটাই মুগ্ধ ও আকর্ষনীয় হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও ভালোবাসার মানুষকে ভুলে থাকা যায় না। মন থেকে বার বার একটি শব্দই বের হয়, ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি।।

অন্যদিকে……

—” তাজরীন আপু কি বলছ তুমি এইসব? ভাইয়া ভাবীকে পেয়ে আমায় এখন ভালোবাসে না। তাই এত রাতে ভাইয়া ভাবির কাছে চলে গেছে?”

—” হুম। তোকে আগেই বলেছিলাম না তোর ভাইয়া তার রুমে নাই। বউয়ের পিছন পিছন সেও চলে গিয়েছে। এই জন্যই তো এত রাতে তোকে ফোন দিলাম।”

—” হ্যাঁ আপু আমি দেখে এসেছি ভাইয়ার রুমে ভাইয়া নেই। বাদ দেও আপু,আমি জানি ভাইয়া আমায় খুব ভালোবাসে।”

—” ছাই বাসে। তোর ভাবী আসার পর থেকে তোর ভাই এখন তোর সাথে বেশি কথা বলে? এমনকি তোর জন্মদিনের শুভেচ্ছা টুকুও জানালো না। জানিয়েছে তোর ভাই তোকে বার্থডে উইশ?”

সন্ধ্যা ফোনে কথা বলার পাশাপাশি মাথা এদিক সেদিক ঘুরাতে লাগল…….

—-” ভাইয়া উইশ করে নাই এমনকি গিফট পর্যন্ত দেই নাই।”

—-” কি বলেছি আমি দেখেছিস? বিয়ের পর তোর ভাই চেঞ্জ হয়ে গেছে। এখন আর তোকে ভালোবাসবে না। এমনিতে সৎ বোনকে আর কেউই বা ভালোবাসে তার উপর প্রতিবন্ধী সৎ বোন। তুই তো ওর উপরে এমনিই বোঝা হয়ে আছিস।”

সন্ধ্যা তাজরীনের কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ও স্পন্দনকে কোনোদিন সৎ ভাই মানতে পারবে না। ও ছোট থেকেই স্পন্দনকে বড় ভাই হিসেবে মেনে এসেছে।

ভাই হলো বাবার পরের আসনটি তার। মাথার উপরে ছায়া ময় একটি স্থান। যখন রাস্তায় বিপদে পড়ে পথ খুঁজবে তখন বোনকে সাহায্য করার জন্য যে হাতটি এগিয়ে আসবে তার নাম ভাই। ভাই আপন আর সৎ হোক ভাই তো ভাই। ভাই বোনের ভালোবাসা হলো খুনসুটি এক ভালোবাসা। সারাদিন ঝগড়ার পর ঠিকই একসাথে বসে আড্ডা দেওয়া। একদিন কেউ বাসায় না থাকলে সারাদিন ছটপট করা। খুনসুটি , ভালোবাসা ও ঝগড়ার আরেকটি নাম ভাই-বোন।

সন্ধ্যা নিজের ভাইকে খুব ভালোবেসে। ছোট থাকতে স্পন্দনের মা মারা যায় স্পন্দনের বয়স তখন ১০ বছর। তখন স্পন্দনের বাবা মিস্টার আজম সন্ধ্যার মাকে বিয়ে করেন। মিসেস সাবিনা বেগম কোনোদিন স্পন্দনকে বুঝতে দেন নি তিনি যে স্পন্দনের সৎ মা। নিজের সন্তানের মত বড় করেছেন স্পন্দনকে। সন্ধ্যা যখন মিসেস সাবিনা বেগমের গর্ভে তখন স্পন্দন খুব খুশি হয়েছিল। সন্ধ্যা পৃথিবীতে আসার আগেই স্পন্দন নাম ঠিক করে রাখে। কিন্তু আজ সেই ভাই সম্পর্কে এমন নেগেটিভ কথা শুনে সন্ধ্যা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্ধ্যা বুঝতে পারছে না কি করা উচিত তার। কেঁদে কেঁদে তাজরীন-কে জিজ্ঞাসা করলো…..

—-” আমি আমার ভাইয়াকে চাই চাই। আমার ভাইয়াকে দিবো না কাওকে।”

—” তাহলে শোন,তুই এখন থেকে শুভ্রতাকে কষ্ট দিবি। মানে ওকে সব সময় জ্বালিয়ে মারবি। শুভ্রতা বিরক্ত হয়ে যখন কিছু বলবে তখন কান্না কাটি করে স্পন্দনের কাছে বিচার দিবি তাহলেই হবে।”

—” কিভাবে জ্বালাবো আমি ভাবীকে?”

এই রকম প্রশ্ন শুনে তাজরীন রেগে আগুন। এই কাজটুকু কি তার বলতে হবে? তবুও নিজের স্বার্থের জন্য রাগটা কমিয়ে বলল…..

—” ওর সাথে সব সময় লেগে থাকবি। ও যখন যা করে তখন বিরক্ত করবি। ওর কাজের সময় বিরক্ত করবি। খাবার নিয়ে বিরক্ত করবি। বিরক্ত কিভাবে করতে হয় তোকে কি শিখাতে হবে এখন?”

—” বুঝছি আপু। আচ্ছা আপু গুড নাইট ঘুমাবো।”

—” গুড নাইট।”

সন্ধ্যা শুয়ে পড়লো। ও ঘুমিয়ে পড়েছিল কিন্তু তাজরীনের ফোন পেয়ে ঘুম থেকে উঠে। তাজরীন তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে স্পন্দনের রুমের দিকে পাঠায় যে দেখতে স্পন্দন আছে কি-না? কিন্তু যখন দেখলো স্পন্দন নেই তখন সন্ধ্যার কানে বিষ মন্ত্র পড়ে তাজরীন। বোকা সন্ধ্যা তাই বুঝ-লো।

।।

।।

।।

সকালে…….

আজ সকালে সাধনা অনেক বড় একটা বাজে কাজ করে ফেলেছে। মুগ্ধ ঘুমিয়ে পড়ায় সকাল সকাল উঠে নিজেই রান্না করতে থাকে মুগ্ধের জন্য। রান্না করাটা বাজে বলার কারণ, মুগ্ধের কাছে এই অবস্থায় কোনো কাজ করবে না সাধনা। কাজ করতে গিয়ে যদি অজান্তেই হাত কেটে ফেলে বা পানিয়ে পিছল খেয়ে পড়ে যায় বা জামা কাপড়ে আগুন লাগে। সব টেনশন নিয়ে থাকতে পারবে না মুগ্ধ। এই জন্য সাধনার সব কাজ নিষেধ। মুগ্ধ নিজেই রান্না করে। কিন্তু আজ সাধনা লুকিয়ে রান্না করতে লাগলো।

—-” নিজের রান্নার ঘ্রাণ পেয়ে নিজেই আহত হচ্ছি প্রিয় স্বামী তো আহত-র আহত হবেই। আমি আবার আম্মু আর আপুর মতো রান্না পারি না। আমাকে তো উনারা কেউ রান্না করতেই দিতো না। কত করে বলতাম বিয়ের পর তো রাঁধতে হবে এখন না শিখলে বিয়ের পর শশুর বাড়িতে কথা শুনতে হবে। তবুও কেউ শুন-তো না কথা।ভালোই হলো মুগ্ধও ওদের দলে আমায় রান্না করতে দেয় না।”

সাধনা রান্না শেষ করে মুগ্ধকে ডাকতে যায়…..

—” এই শুনছো?”

মুগ্ধ চোখ মেলে তাকাল দেখলো তার সামনে একদম পাক্কা গৃহিণী দাঁড়িয়ে আছে। সাধনার কোমরে আঁচল বাঁধা। সাধনাকে এই অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি করে উঠে বসলো মুগ্ধ…..

—” তুমি এইভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ”

—” ফ্রেশ হয়ে আসো তোমার জন্য রান্না করেছি।”

—” তোমাকে বলে-ছিনা না তুমি কোনো কাজ করবে না।”

—” প্লিজ বকো না আজকেই তো করেছি রান্না। প্লিজ তোমার ছোট্ট বাবুর কথা ভেবে কিছু বলো না।”

বাচ্চার কথা শুনে মুগ্ধ থেমে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার টেবিলে বসে। সাধনা খুশিতে মুগ্ধের সামনে খাবার রাখে। মুগ্ধ প্রথম খাবার টুকু খেয়ে গপাগপ সব খেতে শুরু করে।

—” এই আমার জন্য রাখো একা একা খেয়ে ফেলবে না-কি সব?”

—” এত ভালো রান্না কিভাবে শিখেছো? তোমাকে আমি রান্না করে খাওয়াবো এখন তুমি যা রান্না করেছো ওই খাবার আমি একাই খাবো।”

মুগ্ধ খেয়েই যাচ্ছে। সাধনা বাঁধা দিতে গিয়েও দিলো না। ওর রান্না যে মুগ্ধ এত আনন্দ নিয়ে খাবে কোনোদিন ভাবতে পারে নাই। সাধনা ভাবছে এখন থেকে রোজ ও মুগ্ধের জন্য রান্না করবে।

মুগ্ধের হাত থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে নিজের মুখে পুড়ে দিলো সাধনা…….

চলবে……