সাহেব_বিবি_গোলাম পর্ব-১৫

0
1205

#সাহেব_বিবি_গোলাম
#নুশরাত_জেরিন
#পর্ব:১৫

,
,
রাগে আমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে তারচেয়েও বেশি হচ্ছে অনু সুচনা। কেনো আমি শুভকে চিনলাম না,কেনো তাকে কষ্ট দিলাম?
মেসেন্জারে কথা বলার কিছুদিন পর থেকেই যখন তার ভেতর পরিবর্তন লক্ষ করছিলাম তখন কেনো বুঝতে পারলাম না?
নিজের মাথায় নিজের বারি মারতে ইচ্ছে হলো।এমন গাধা কেনো আমি?
তবে শুভই আমার সেই মানুষটা ভাবতেই ভিতরে অজানা এক শীতলতা বইতে লাগলো।
প্রিতম গালে হাত দিয়ে রক্ত চক্ষু করে তাকালো।দাঁতে দাঁত রেখে বললো,

—এটা তুমি একদম ঠিক করলে না পিহু,একদম ঠিক করলে না!

আমি আরেকটা গালেও আমার শক্তির প্রয়োগ করলাম।
ততক্ষণে ক্লাবের সবার নজর আমাদের দিকে পরেছে।ক্লাবের মাঝখানে কোন ছেলে একটা মেয়ের হাতে পটাপট চড় খাচ্ছে এমন দৃশ্য সচরাচর কোথায়ই বা দেখা যায়?
প্রিতম আরেক গালেও হাত রেখে দাড়ালো।মুখে তার রাগি ভাব।অথচ এখানে রাগার কথা একমাত্র আমার!সে কোন সাহসে রাগ করবে?কার উপর রাগ করবে?ঠকিয়েছে তো সেই!
আমি চিৎকার করে কলার চেপে ধরলাম।

—তোর জন্য আমি কি না করেছি,আর তুই আমাকে এভাবে বোকা বানালি?আমার জিবন নিয়ে খেললি?তোকে তো আমি…

শুভ এতক্ষণ নিরব দর্শকের মতো দাড়িয়ে ছিলো।এতো দ্রুত ঘটনাগুলে ঘটায় সে হয়তো কিছু বুঝে উঠতে পারছিলোনা।তবে এতক্ষণে তার হুশ ফিরলো।
চটজলদি পেছন থেকে আমায় জাপটে ধরে প্রিতমের কাছ থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।বললো,

—কি করছো পিহু,ছাড়ো ওকে।

—না ছাড়বো না আমি, এই শয়তানটাকে তো কিছুতেই ছাড়বো না।
ওর জন্য আমি আজ সব ছেড়ে বাড়ি থেকে পর্যন্ত পালিয়ে এসেছি,আর ও কিনা?

আমার কথায় শুভ থমকে দাড়ালো।আমিও চুপ হয়ে গেলাম।পালিয়ে আসার কথাটা বলাটা হয়তো ঠিক হয়নি।আঁড়চোখে শুভর দিকে তাকিয়ে দেখি তার মুখটা থমথমে।
এরমাঝেই প্রিতম ছাড়া পেয়ে কিছুক্ষণ খুকখুক করে কেশে উঠলো।
আমাকে পাশ কাটিয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,

—কাজটা ভালো করলে না তোমরা,দেখে নেবো তোমাদের!

আমি মুখ সরিয়ে নিলাম।ইচ্ছে করছিলো ওর মুখের ওপর থুতু ছিটাই।
শুভর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও চুপ হয়ে গেছে।
কথাবার্তা কিছুই বলছেনা।
আমি আমতাআমতা করলাম।কি বলবো বুঝতে পারছিনা।এখন মনে হচ্ছে সত্যিই আমার এভাবে বাড়ি থেকে চলে আসাটা উচিৎ হয়নি।
কিন্তু এখন ভেবে আর কি লাভ?যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
শুভ আমার ভাবনার মাঝেই হনহন করে হেটে ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেলো।
আশেপাশে একবার তাকানো তো দুর আমার কথাও একবার বললো না।আরে আমাকে না নিয়েই যাবে নাকি?আমি বাড়ি যাবোনা?আমি তাড়াতাড়ি পিছু পিছু দৌড়ালাম।
দৌড়ে গাড়ির দরজা খুলে সিটে বসে সিট বেল্ট বাধলাম।
শুভ আমার দিকে তাকালো না পর্যন্ত।
নিঃশব্দে গাড়ি স্টার্ট দিলো।আমি মুখ ফুলালাম।
না হয় একটু ভুলই করেছি,তাই বলে এমন করবে?কথাই বলবে না?
আমি উশখুশ করতে করতে বললাম,

—আপনারও কিন্তু কম দোষ নেই,সব দোষের ভাগীদার আমিই কেনো হবো?

শুভর দিকে তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করেও কোন লাভ হলোনা,সে আমার কথা শুনেছে কিনা তা ই বুঝতে পারলাম না।তার দৃষ্টি সামনে।
আমি আবার বললাম,

—আপনি নিজেও তো আমায় বলতে পারতেন নাকি?যে আপনি আমার সাথে কথা বলতেন,প্রিতম আপনার আইডি হ্যাক করেছিলো?আমি যাকে আমার ভালবাসা ভেবেছি সে আসলে সঠিক মানুষটা নয়?
কেনো বলেননি আপনি?

শুভ সামনে চোখ রেখেই গম্ভীর গলায় বললো,

—আমি বললেই বিশ্বাস করতে?ঠক ভাবতে না?

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।সত্যিই আগে এসব বললে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না,উল্টো ঠক বলে অপমান করতাম।নিজের কানে না শুনলে কখনো সত্যিটা সামনে আসতো কিনা কে জানে?হঠাৎ খুব করে কান্না পেলো আমার।
নিজের উপর রাগে দুঃখে ভেতরটা বারবার ক্ষত বিক্ষত হতে লাগলো।
কেনো যেনো পাশে বসা গম্ভীর মুখের মানুষটার বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো।
কিন্তু পাশের মানুষটা তো রেগে আছে।রেগে বুম হয়ে আছে আমার উপর।
এখানে আমার দোষটাই বা কোথায়?সবতো প্রিতমের দোষ!

,,,,

বাড়ি ফিরেই শুভ নিজের রুমে ঢুকে গেলো।আমি ধীরপায়ে হেটে ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসলাম।ক্লান্ত লাগছে খুব।শরীরের ক্লান্তির চেয়ে মনের ক্লান্তিটা বেশি লাগছে।
এতোদিনের ভেবে আসা বিষয়গুলো হুট করে এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। প্রিতমকে আরও কয়েকটা চড় মারার অদম্য ইচ্ছা মনে চাড়া দিয়ে উঠছে।কিন্তু সবচেয়ে আগে আমায় শুভর রাগ ভাঙাতে হবে।
কিকরে যে ভাঙাবো সেটাই আমার মাথায় আসছেনা।আমি কখনো কারও রাগ ভাঙাই নি।এ সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই নেই।
হঠাৎ পেছন থেকে আপা বলে উঠলো,

—কোথায় গিয়েছিলি পিহু?এতোরাতে দুজন একসাথে ফিরলি নাকি?কোন বিপদ আপদ হয়নি তো?
একবার বলে বেরোলে কি হতো?আমি তোকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি।

তিনি কথার মাঝে মাঝে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে হাঁপিয়ে গেছেন। নিশ্চয়ই সারাবাড়ি আমায় খুজে খুজে হাঁপিয়ে উঠেছেন।
আমার ভাবতেই কষ্ট হলো খুব!আমি কিনা ওই বিশ্বাসঘাতক ঠক লোকটার জন্য এমন ভালো মানুষগুলোকে কষ্ট দিলাম?তাদের চিন্তায় ফেললাম?
আমি আপার হাত ধরে টেনে ছোফায় বসিয়ে দিলাম।
কোলে ফটাফট মাথা রেখে শুয়ে পরলাম।হাত টেনে মাথায় বুলিয়ে দিতে ইশারা করে বললাম,

—এমন ভুল আর কক্ষনো করবোনা আপা,এখন থেকে তোমায় না বলে কোথাও যাবোনা।

আপা মৃদু হাসলেন।মাথায় যত্ন করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।

–তা হ্যা রে,তোরা গিয়েছিলি কোথায়?শুভকে দেখলাম রাগে বোম হয়ে ঘরে ঢুকলো?কি করেছিস টা কি?

আমি আদুরে গলায় উত্তর দিলাম,

—বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছি আপা,কি করবো বলো তো!

—কি আবার করবি?স্বামীর মান ভাঙাবি!

—কিভাবে?

—সেটা তুই জানিস!সব কথা কি আমি বলে দেবো নাকি?তুই নিজে বুঝে নে!

বলেই চোখ টিপলেন তিনি।

আমি চমকে তাকালাম।পরক্ষনেই হেসে উঠলাম।আপা পারে ও বটে।তবে আইডিয়াটা কিন্তু মন্দ না!
মুখে না বললেও ইশারায় যে আইডিয়া দিলেন সেটা প্রয়োগ করে দেখিই না।কাজে লাগতেও তো পারে!
,

,

,চলবে…..