#সিনিয়র_লাভ_বার্ড
#পর্ব-২৪[অন্তীম পর্ব]
#এমএ_তাহিনা
সময় বয়ে গেছে, কেটে গেছে চার বছর। পূরবি ও কল্পের বিয়ে হয়েছে দুইবছর হয়ে গেছে। রূপক ও রুশার বিয়ের আড়াই বছর পূর্ণ হয়েছে। রাইসুরকে চার বছরের জেল দিয়েছে সরকার। আজ তার মুক্ত হওয়ার দিন। শানকে জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। বাদলের দশবছরের কারাদণ্ড হয়েছে। রামিম হাওলাদার ও আজাদ হোসাইনের যাবত জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। সূর্য আজও জেসিকে পটাতে পারেনি। বন্ধুরা বিয়ে করে কয়েকদিন পরে বাচ্চার বাবা হয়ে যাবে। অথচ সে এখনো বিয়ে করতে পারলো না। এটা নিয়ে আফসোসের শেষ নেই সূর্যের।
-পূরবি হলো তোমার?
পূরবিকে উপরোক্ত কথাটা বলতে বলতে রুমে ঢুকে কল্প। পূরবি আয়নার সামনে দাড়িয়ে শাড়িতে সেপটিপিন লাগাচ্ছিলো, কল্পের প্রশ্নে সেফটিপিন সেট করে হাসি মুখে ফিরে তাকায়। কালো শাড়ি সাদা ব্লাউজ, হাঁটু সমান চুল গুলো ছেড়ে দেওয়া। অপূর্ব লাগছে দেখতে পূরবিকে। কল্প পূরবিকে জড়িয়ে ধরে বলে- আল্লাহ! এটা আমার বউ? সিরিয়াসলি এটা আমার বউ? আমার সিনিয়র। কতো সুন্দর লাগছে। কিউটের ডিব্বা তুমি দিনদিন এতো সুন্দর হয়ে যাচ্ছো কেন, আমার তো বাসা থেকে আর বের হতে ইচ্ছে করবে না এমন হলে।
পূরবি মুচকি হেসে কল্পের গলা জড়িয়ে ধরে বলে- বের হতে হবেনা, বউ আগে না কাজ আগে?
কল্প ভাব নিয়ে বলে- অফকোর্স বউ আগে। বলে কল্প কিছু একটা ভেবে বললো- চুল ছেড়ে বাহিরে যাওয়া যাবেনা, চুল বাধো। না দাঁড়াও আমি বেধে দিচ্ছি।
পূরবিকে আয়নার সামনে চেয়ারে বসালো কল্প, সুন্দর করে বেনি করে দিলো। কল্প মাঝে মধ্যেই পূরবি ও আনিকা খানকে বেনি করে দেয়।
ডোয়িং রুম থেকে আনিকা খানের ডাকে কল্প পূরবিকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বের হয়। গাড়িতে উঠে রওনা দেয় কাঙ্ক্ষিত জায়গায়। একঘন্টা পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌছায় তারা। আগে থেকেই রূপক, রুশা, রাকিব হাওলাদার, রাহেলা বেগম, সূর্য, জেসি উপস্থিত ছিলো। নিয়াজের বউ প্রেগন্যান্ট তাই সে বউকে ছেড়ে আসতে পারবেনা দায়িত্বশীল স্বামী কি না। সিয়াম নতুন বিয়ে করে হানিমুনে গেছে ছুটিতে আছে সে। সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো পূরবিরা। আধাঘন্টার কাছাকাছি সময় শেষ হওয়ার পরে রাইসুরকে বের করা হলো, আগের থেকে শুকিয়ে গেছে। শুকনো মুখেও মুচকি হাসি লেগে আছে। রাইসুর প্রথমেই রাহেলা বেগমকে জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষণ পরে রাকিব হাওলাদারকে জড়িয়ে ধরে। তারপর দুইভাইয়ের কুশল বিনিময় হয়। সবার সাথে টুকটাক কথা বলে রূপকদের গাড়িতে উঠে রাইসুর পাড়ি দেয় তার নতুন জীবনে। মা বাবা ভাইকে নিয়ে সুখের ঠিকানায়।
কল্প পূরবিকে নিয়ে ক্যাফেতে যাবে, পূরবি ফুচকা খাবে বলে বায়না ধরেছে। সূর্যও সুযোগ পেয়ে জেসিকে বললো- আপনিও চলুন না ম্যাম। ওরা কাঁপল আমি সিঙ্গেল, আপনি থাকলে দুজনে গল্প করতে পারবো আমার একা ফিল হবেনা।
জেসি ভ্রু কুঁচকে বলে- অন্য কাউকে বলছেন না কেনো?
সূর্য আশে পাশে তাকিয়ে বলে- অন্য কেউ তো নেই এখানে, মানে আছে বাট তাদের তো আমি চিনিনা।
জেসি সোজাসাপ্টা বলে-, আমাকে কি আপনি চিনেন? কতোটুকু চিনেন? আপনাকে বলেছি না আমার পিছনে পড়বেন না। আমার পিছু ছেড়ে দিন তাতে আপনার ভালো হবে। শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন।
সূর্য এবার বেশ রেগে গেলো, – আমি কার পিছু ধরবো আর কার পিছু ধরবো না তা আপনাকে ভাবতে হবেনা।
জেসিও রেগে বলে- ভাবতে হবে, কারণ আপনি আমার পিছু ছুটছেন। আপনি আমার সম্পর্কে কি জানেন? আমি গোয়েন্দা ইনভেস্টিগেটর অফিসার তাই তো? আমার অতীত জানেন আপনি?
সূর্য বলে- আপনার অতীত আমি জানতে চাইনা, আমি আপনার বর্তমান নিয়েই থাকতে চাই। শুধু আপনি রাজি হলেই হবে।
জেসি তাছিল্য হেসে বলে- বর্তমান জেনে ভালোবাসবেন, কিন্তু অতীত জানলে তো সব ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবে আপনার।
সূর্য ভ্রু কুচকে বলে- কি এমন অতীত আপনার যা শুনলে আমার ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবে? বলুন আপনার অতীত শুনতে চাই আমি।
জেসি কিছু না বলে ক্যাফের দিকে হাঁটা ধরে, সূর্য ও পিছু পিছু গিয়ে একটা টেবিলে বসে। জেসি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে-, আমার আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো মিস্টার সূর্য। তখন আমি সবে অনার্স ফাস্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট ছিলাম। সবকিছু ভালোই চলছিলো৷ আমার স্বামী খুবই ভালো একজন মানুষ ছিলেন, তিনি তার কাজের সময় ছাড়া বাকি সবসময় আমাকে সঙ্গ দিতেন। আমার কি পছন্দ কি অপছন্দ সব কিছু তিনি জানতেন। কখনো আমাকে অবহেলা করেন নি। স্বামী হিসেবে যেকোনো মেয়ের জন্য পারফেক্ট পার্সন তিনি। লোকে বলেনা ‘ভালো মানুষ বেশিদিন বাঁচে না। সেটাই হয়েছিলো, আমার স্বামী রায়ান বেশি দিন বাঁচতে পারেন নি। হৃদরোগে আক্রান্ত হোন, যেই বয়সে প্রিয় মানুষ নিয়ে সব উপভোগ করার সময় সেই বয়সে তিনি মরণঘাতী রোগে কাতরিয়েছেন। অনেক চেষ্টা করেছি আমরা, কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি। তিনি আমাকে অবশ্য বলে গেছিলেন ‘সত্যি কারের কোনো ভালোবাসা পেলে একটা সুযোগ দিও, আর আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমাকে মাঝরাস্তায় একা ছেড়ে যাচ্ছি।
-তারপর?
কৌতুহলি সূর্যের প্রশ্নে চোখের পানি মুছে হাসলো জেসি, তারপর বলে- এরপর কিছু না, আমি তাকে স্বামী হিসেবে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও ভালোবেসেছিলাম। তাকে ভুলা সহজ ছিলোনা, ইনফেক্ট তাকে আমি এখনো ভুলিনি, মনে পরে আজও। লোকটার একটা অদ্ভুত গুণ ছিলো জানেন? মানুষকে মূহুর্তে মায়ার জড়িয়ে ফেলতো। তার চেহারা কেমন মায়া মায়া ছিলো, যে কেউ দেখলেই মায়ায় পরে যাবে। তার মৃত্যুর পরে আমি ভেঙে পড়িনি, কারণ আমি সবসময় স্ট্রং ছিলাম। রাত জেগে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছি কিন্তু দিনের বেলা স্বাভাবিক থাকতাম কাউকে কিছু বুঝতে দেইনি। আস্তে আস্তে পড়াশোনা কন্টিনিউ করি। তারপর গোয়েন্দা ইনভেস্টিগেটর হিসেবে জয়েন করি। তো এখন বলুন আপনার ইচ্ছে কি? নিশ্চয়ই এখন আমাকে আর বিয়ে করতে চাইবেন না? জানতাম এমনই হবে। ব্যাপার না, মা বাবার ইচ্ছেতে বিয়ে করুন সুখী হোন দোয়া করি।
সেদিন জেসি চলে গিয়েছিলো, কিন্তু সূর্যের চোখের কোণের জল দেখতে পারেনি। কল্প ও পূরবির সাথে প্লেন করে সূর্য তার মা বাবাকে নিয়ে জেসির বাসায় যায়। একমুহূর্তের জন্য বিস্মিত ছিলো জেসি। সে ভাবতেই পারেনি সূর্য থাকে এতো ভালোবাসে। নিয়ম অনুয়ায়ী বিয়ে ঠিক হয়। কাঙ্ক্ষিত দিনে বিয়েও হয়ে যায়। সুখী হোক সবাই।
ভালোবাসাতে সিনিয়র জুনিয়র ফেক্ট না। ভালোবাসা খারাপ নয়। তবে খারাপ মানুষকে ভালোবাসা খারাপ। আপনি ভালোবাসুন! তবে ভালোবাসার মানুষকে। যে আপনি যতোটুকু ভালোবাসবেন তার দ্বিগুণ আপনাতে বাসতে পারবে। তাকেই কেবল ভালোবাসুন। সার্থপর হোন, নিজের জন্য। নিজের ভালোর জন্য। নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন। যে নিজেকে ভালোবাসতে জানেনা সে কখনো অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারেনা। সবার আগে নিজেকে মূল্য দিন তারপর অন্য সবাইকে। আপনি আপনাকে ভালো না বাসলে কেউ আপনাকে ভালোবাসবে না মনে রাখবেন। নিঃস্বার্থ হওয়া ভালো, তবে সব ক্ষেত্রে না। সম্পর্কে ভালোবাসা থাকলে সিনিয়র জুনিয়র কোনো সমস্যা না, তাই কখনো সিনিয়র বা জুনিয়র বলে ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসতে পিছু পা হবেন না। ভালোবাসেন, ভালো রাখেন, ভালো থাকেন। এর কোনো শেষ নেই, কখনো শেষ হবেও না। দিনশেষে কল্পের মতো আপনারও যদি সিনিয়র বউ থাকে তো তাকে ‘সিনিয়র বউ’ বলে ক্ষেপান, সিনিয়র বিয়ে করার মজাই তো এটা তাই না?
কল্প – পূরবি, সূর্য – জেসি, রূপক – রুশা। তিনজন জুনিয়র ছেলের তিনজন সিনিয়র বউ। “সিনিয়র লাভ বার্ড”! ভালোবাসেন আপনার তাকে।
(সমাপ্ত)