#সেই তুমি
#সানজিদা সন্ধি
#পর্ব ২১
অদিতি কাঁদতে কাঁদতে সেখানেই জ্ঞান হারালো। জ্ঞান ফিরে পেয়ে নিজেকে আবিস্কার করলো জারিফের বুকে। জারিফ তার বাহুডোরে আবদ্ধ করে রেখেছে অদিতিকে। বাহুডোর খুলে আস্তে করে উঠে সে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। আজ তার ভীষণ ইচ্ছে করছে ছাঁদে যেতে। ছাঁদে বিভিন্ন ফুলের গাছ আছে। সেগুলোর সুবাস যেন নিমন্ত্রণ করছে অদিতিকে তাদের কাছে যেতে। জারিফ ঘুমাচ্ছে ভেবে অদিতি আর ডাকলো না তাকে। রুম থেকে বেরিয়ে একপা দুপা করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো সে। সাততলায় পৌঁছেই তার শরীর ক্লান্ত হয়ে এলো। বাসাটা দশ তলা। ছাদের চাবি অদিতির কাছে আছে। ভারী শরীরটা নিয়ে আটতলায় উঠেই সে পড়ে গেলো সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে। মুহূর্তেই সব অন্ধকার হয়ে এলো। পেটের বাচ্চাটার কথা ভেবে পেটে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে ডুকরে উঠলো সে। অদিতি অনুভব করলো সে বোধহয় বাঁচবে না আর। এরপর একপর্যায়ে জ্ঞান হারালো।
জারিফের চোখটা একটু লেগে এসেছিলো। বুকের উপর অদিতিকে না দেখতে পেরে ডাক দিলো। কিন্তু অদিতির কোনো সাড়াশব্দ নেই। জারিফের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। সে সবগুলো রুম খুঁজলো তন্নতন্ন করে। কিন্তু অদিতি কোথাও নেই। জারিফ একবার ভাবলো সে ছাঁদে গিয়েছে আরেকবার ভাবলো নিচে। কিন্তু তার মাথায় এটাই আসছে না অদিতি কেন কোথাও যাবে। শুরুতে সে ছাঁদের দিকেই গেলো। আটতলায় উঠেই থমকে গেলো সে। অদিতি পড়ে আছে মেঝেতে। রক্তে ভেসে গেছে পুরো ফ্লোর। জারিফ তড়িৎগতিতে আটতলার একটা দরজায় নক করলো। রাত বারোটা শহরে সন্ধ্যার মতো। দরজায় নকের শব্দ পেতেই সবাই ছুটে এলো। তারপর অদিতিকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো। তাদের ঘরে উচ্চস্বরে টিভি চলায় কোনোকিছুর শব্দ পায়নি তারা। সবাই জারিফের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। আগে কখনো তাকে দেখেনি তাই। অদিতি বিবাহিত এটা কমবেশি সবাই জানে। ভীষণ মিশুক মেয়ে সে। তবে তার স্বামীর ব্যাপারে কিছু বলতো না। জারিফ কোনো কথা না বলে অদিতিকে তাদের সাহায্যে হসপিটালে নিয়ে গেলো। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গিয়েছে। অদিতির বাচ্চা মারা গিয়েছে পেটের মধ্যেই আর অদিতির শারীরিক অবস্থাও ভীষণ বাজে। জারিফ কিছু বুঝতে না পেরে আহনাফকেই ফোন দিলো। আহনাফ ছুটে চলে আসলো। তার ভীষন অসহায় লাগছে। অদিতির সাথে তার যাই হোক না কেন সে তো ভালোবাসে অদিতিকে। অদিতির ভালো থাকাতেই সুখ খুঁজতে চেয়েছে। তবে কেন আল্লাহ আবার তার সুখ কেঁড়ে নিতে উদ্যত হয়েছে। অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে পায়চারি করছে আহনাফ আর জারিফ। জারিফ বহু সাহস জুগিয়ে তার পরিবারকে শর্ট করে সবটা জানিয়েছে। তারা ভীষণ রেগে আছে জারিফের উপর।
জাফনা আজ অনেক চেষ্টা করেছে তার বাবাকে আহনাফের বিষয় বলার কিন্তু সাজ্জাদ খান আজকে সময়ই পায়নি। ভালো লাগছিলো না বিধায় জাহিনের কাছে এসে থাকার প্ল্যান করছিলো জাফনা। বাট ফ্ল্যাটে ঢুকেই অবাক হয় সে। সবার মুখ থমথমে। পুরো বিষয়টা শুনে সেও যেতে চায়।
সবাই একসাথে হসপিটালে। এখানে এসে আহনাফকে দেখবে বিষয়টা ভাবেনি জাফনা। সাথে আহনাফের চোখমুখের ধরণও ভালো ঠেকলো না তার কাছে । কেমন যেন উদভ্রান্তের ন্যায়। বন্ধুর বউয়ের জন্য চেহারার এই হাল হয় না কি কারো। মনের খচখচানি দূর করতে সবার আড়ালে জাহিনকে ডেকে নিলো জাফনা। জাফনা জানে জাহিন সবকিছু সম্পর্কে অবগত। জাহিন জাফনার প্রশ্নের উত্তরে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সবটা বললো। জাহিন তার বোন সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পোষণ করে। সে জানে যতক্ষণ না সে জাফনাকে সবটা বলবে ততক্ষণ জাফনা তাকে এই বিষয়টা নিয়ে বিরক্ত করা ছাড়বে না। আর এই মুহূর্তে জাফনার কাহিনি সহ্য করার মতো মানসিকতা জাহিনের নেই।
জাহিনের মুখে পুরোটা শুনে জাফনার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সে বুঝতে পেরেছে অদিতির সাথে আর আহনাফের কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই কিন্তু তারপরেও সে যেন বিষয়টা মেনে নিতে পারলোনা। তার চোখের কোণে অশ্রু চলে এলো।
জারিফ এখন তার পরিবারের মুখোমুখি। কোনো উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই সে।একদিকে অনাগত সন্তানের মৃত্যু আর অন্য দিকে স্ত্রীর জীবন এখন সংকটাপন্ন। সেখানে সে কী করে কিছু বলবে। জারিফের মা বাবাও ছেলের অবস্থা ভেবে সব অভিযোগ তুলে নিলো। সবার এখন একটাই প্রত্যাশা। অদিতি যেন সুস্থ থাকে।
জারিফের মা বাবা অদিতিকে কখনো দেখেনি। তারপরেও তারা অদিতির জন্য একপ্রকার টান অনুভব করলেন৷
সারা রাত পার হলো উৎকন্ঠার মধ্যে দিয়ে। কারো চোখে ঘুম নেই। আহনাফকে বাড়িতে না পেয়ে আতিয়া চৌধুরী তাকে বারবার ফোন করেন তারপর আহনাফের মুখে যা শুনতে পান তাতে তার পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়ার মতো অবস্থা। অদিতির সাথে কয়েকবছর ধরে যোগাযোগ নেই তার। কিন্তু একসময় অদিতিকে মেয়ের মতো ভালোবাসতেন তিনি। এখনো ভালোবাসেন। মেয়েটাও তাকে ভালোবাসতো। তার এমন অবস্থা আতিয়া চৌধুরীকে ব্যাথিত করলো। সৃষ্টিকর্তার কী অদ্ভুত লিলা! মানুষকে এমন সময়ে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি করেন তিনি যেই পরিস্থিতির জন্য সে কখনো প্রস্তুত ছিলোনা।
আতিয়া চৌধুরী আর আবির চৌধুরী খবর পেয়েই ছুটে আসেন। সবাই এখন অদিতির অপেক্ষায়।
বেলা দশটা নাগাদ অদিতির জ্ঞান ফিরলো। তার অবস্থা ভীষণ শোচনীয়। ডক্টর তার কাছে ভীড় করতে সবাইকে নিষেধ করলেও অদিতি সবাইকে দেখতে চাইলো। জারিফ অদিতির কাছে এসে দাঁড়াতেই অদিতি কান্নায় ভেঙে পড়লো। অদিতি অনুভব করেছে তার বাচ্চাটা পৃথিবীর আলো দেখার আগেই জান্নাতের বাসিন্দা হয়েছে। কান্নাভেজা বারবার সরি বললো। তার শ্বশুরবাড়ির সবাইকে দেখে কিছু বলার ভাষা পেলো না। ভীষণ কষ্টে হাত উঠিয়ে জাহিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। জাহিন তার প্রিয় ভাবীর এমন অবস্থা দেখে পাগলপারা। অদিতি ভীষণ ভালোবাসে জাহিন কে। আতিয়া,আবির,আহনাফ সবাইকে দেখে অদিতি যতটা অবাক হয়েছে তাও চেয়েও যেন বেশি অনুশোচনায় মৃতপ্রায়। এমন পরিস্থিতিতে কেন তাদের সাথে দেখা হতে হলো। আম্মু আব্বু বলে ডুকরে কাঁদতে আরম্ভ করলো। আর বারবার ক্ষমা চাইতে লাগলো। সবাই বললো যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এসব নিয়ে পড়ে কথা বলা যাবে। অদিতি এমন পরিস্থিতিতে তার বাবা মাকে ভীষণ মিস করছে। একবার যদি দেখতো পেতো তাদের। অদিতি ভেতর থেকে অনুভব করছে সে হয়তো কিছুক্ষণের বাসিন্দা এ পৃথীবির। সবাই এখন বাকরুদ্ধ। মিনিট কয়েক এভাবে যাওয়ার পরে অদিতি চুপ হয়ে গেলো। তার আর সাড়াশব্দ নেই। সবাই যা বোঝার বুঝে গিয়েছে।
আজকের আবহাওয়া রৌদ্রজ্বল।
আহনাফের কাঁধে অদিতির খাটিয়া। আহনাফের ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে অদিতিকে বলতে, ” অদিতি! এই অদিতি! তুমি যেখানেই থাকো না কেন, যার সাথেই থাকো না কেন তবুও তুমি থাকো। এই পৃথিবীর বুকেই থাকো। তবুও আমি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারবো আমরা দুজনেই একই পৃথিবীতে আছি। তোমাকে তো আমি শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম অদিতি। সেই কথা শুনেই কী তুমি অভিমান করে আমার থেকে দূরে চলে গেলে? এই শুনো! প্রমিস তো! কক্ষনও জ্বালাবো না তোমায়৷ তবুও একবার কথা বলো না প্লিজ। ”
জারিফ আজ নিঃস্ব। কত কী ভেবে রেখেছিলো সে। পেটের বাচ্চাটা পৃথিবীর আলো দেখবে। ছোট ছোট হাত দিয়ে তাকে স্পর্শ করবে। বাচ্চার কান্নায় মুখোরিত হবে পুরো ঘর৷ অদিতি আর সে মুগ্ধ হয়ে দেখবে। কিন্তু সেসব আর কই হলো। জারিফের মনে একটা প্রশ্ন বারবার দানা বাঁধলো, ” অদিতি এতো স্বার্থপর কেন? নিজে তো বাচ্চাটার সাথে চলে গেলো। জারিফকে কেন নিলো না? কেন? কেন?”
অদিতির দাফন কার্জ সম্পন্ন হলো। তার বাবা মাও মৃত মেয়ের মুখ দেখতে এসেছে। সবাই আজ প্রিয়জন হারানোর শোকে কাতর। জারিফ তো পুরোপুরিভাবে শেষ। আহনাফের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে অদিতিকে ওই অন্ধকার ঘরে ভেবে। মেয়েটা মরে গিয়ে সব পাপ মোচন করে গেলো। শাস্তি পেলো পেটের সন্তান হারিয়ে। জারিফ আহনাফের শাস্তিও আজ কম হয়নি। আপনজন হারাবার চেয়ে বড় শাস্তি আর কী আছে।
চলবে,,,