সেই তুমি পর্ব-২৩

0
3567

#সেই তুমি
#সানজিদা সন্ধি
#পর্ব ২৩

জাফনার সাথে আজ ক্লাস না থাকলেও আহনাফ অন্য টিচারের পরিবর্তে জাফনার ক্লাসে গেলো। আহনাফকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে জাফনার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। আর অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরা ভীষণ খুশি হলো। আহনাফ ইতিমধ্যে তার পড়ানোর ভঙ্গি দিয়ে সব ছাত্র ছাত্রীদের প্রিয় হয়ে গিয়েছে। তবে এখনো সে আগের মতোই গম্ভীর।

আজ ক্লাসে ঢুকে আহনাফ বললো, “আজকে গল্প করবো, পড়াশোনা থেকে ছুটি আজ। ”

আহনাফের কথা শুনে সব ছেলেমেয়ে খুশিতে চিৎকার করে উঠলো। আহনাফ বকাঝকাও করলো না। আজকে তার মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।

চট করে অদিতির স্মৃতি তাকে ঘায়েল করার জন্য মনের আঙিনায় দ্রুতপদে চলাচল করতে লাগলো। আহনাফ মনে মনে বলতে লাগলো, অদিতি “সেই তুমি” ছিলে এমন একটা মেয়ে যে আমাকে বুঝতো, আগলে রাখতো। হুট করেই “সেই তুমিটাই” আমার অচেনা হয়ে গেলে। “সেই তুমি” অদিতি, শুধুমাত্র “সেই তুমি”। যার জন্য আমি প্রকৃতঅর্থে ভালো থাকতাম। যে তুমি আমার ভালো থাকার কারণ “সেই তুমিই” আমার সমস্ত ভালো থাকা কেড়ে নিয়ে হারিয়ে গেলে। এখন তো এমন স্থানে আছো যেখানে গিয়ে তোমাকে একটিবার দেখে নিজের মনের খোঁড়াক মেটানোর ক্ষমতাও নেই আমার।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অদিতির চিন্তা মাথা থেকে একপ্রকার জোর করেই সরিয়ে দিলো আহনাফ। তারপর ছাত্র ছাত্রীদের দিকে মনযোগ দিলো।

আহনাফের মন ভালো হওয়ার পিছনে আজকের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব জাফনার। জাফনা যেদিন আহনাফকে প্রপোজ করেছিলো সেদিনই জাফনার চোখের দিকে তাকিয়ে আহনাফ খুব ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছিলো এই বাচ্চা মেয়েটা সুন্দর মন থেকে শুদ্ধতম অনুভুতি তার কাছে প্রকাশ করতে এসেছে।

কিন্তু আহনাফ তো আর কোনো মায়ার বাঁধনে জড়াতে রাজি নয়। কোনোভাবেই নয়। একবার যেই দহন যন্ত্রণা সে ভোগ করেছে সেই যন্ত্রণা পুনরায় ভোগ করতে সে কিছুতেই রাজি নয়। তাছাড়া আহনাফের মনে হয় অদিতিকে ছাড়া অন্য কাউকে সে মন থেকে ভালোবাসতে পারবে না। তাই জাফনার সাথে নিজের জীবন জড়িয়ে তাকে প্রকৃত ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করার মানেই হয়না। আহনাফ সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাফনাকে সবসময় ধমকের উপর রাখবে। আর সে যে জাফনার অনুভুতি বুঝেছে এটা তাকে কিছুতেই বুঝতে দেবে না। একটু সুযোগ পেলেই জাফনা পাগলামি করবে। আরো দূর্বল হয়ে পড়বে। বয়সটাই তো এরকম।

আহনাফকে হাসিখুশি দেখে জাফনা ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করতে লাগলো। এই গম্ভীর মানুষটা আবার হাসতে জানে না কি? কোনো কুমতলব নেই তো আজ! তাকে কোনো ভাবে শাস্তি দিবে না তো? জাফনা যখন আকাশ পাতাল কল্পনা করছিলো ঠিক তখনই আহনাফ তাকে দাঁড়াতে বললো। আর জাফনার গলা শুকিয়ে এলো অজানা আতঙ্কে। তবে জাফনার আতঙ্ক কেটে গেলো আহনাফের কথা শুনে। আহনাফ হাস্যোজ্জল চেহারা নিয়ে জাফনাকে গান গাইতে বললো৷ আতঙ্ক কেটে গেলেও জাফনার চেহারায় ভর করলো একরাশ অস্বস্তি। নরম গলায় সে বললো, ” সরি স্যার। আমি গান গাইতে পারি না। ”

জাফনাকে খোঁচাতে ভীষণ ভালো লাগে আহনাফের। কেমন যেন একটা আত্মতৃপ্তি কাজ করে তার মধ্যে। খোঁচা দিয়েই বললো, ” আমি জানি তুমি ভীষণ ভালো গান করো। তাহলে এখন কী আমার সামনে গান গাইতে ভয় পাচ্ছো? আফটারঅল তোমার সামনে তোমার বস দাঁড়িয়ে। ”

বিষয়টা কিছু না বুঝে জাফনা বললো, ” আপনাকে ভয় পেতে যাবো কেন? আর বস বলতে? ”

আহনাফ বললো, ” কী বলো তো তোমার চেয়ে ভালো গান করি তো আমি তাই ভাবছিলাম ভয় পেলে না কি। ”

জাফনা কটমট করে বললো, ” আপনি যে গান পারেন এটা আমি কীভাবে জানবো। আর আমি মোটেও আপনাকে ভয় পাচ্ছি না। ”

আহনাফ ক্লাসের প্রতিটি স্টুডেন্টের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে। যদিও গম্ভীরতা বজায় রেখে। তাই আহনাফ আর জাফনার এরূপ কথোপকথকে কেউ অন্য ভাবে দেখলো না। তবে ক্লাসের কিছু মেয়ে ফিসফাস করতে লাগলো, ” জাফনা তো ক্লাসেই আসেনা স্যারের। আর আগে যখন আসতো তখন তো স্যার ওকে সহ্যই করতে পারতো না। তাহলে এখন কী করে এতটা ফ্রি হলো তারা?”

আহনাফ নিজের কর্মজীবন নিয়ে সচেতন খুব। তাই ব্যাক্তি জীবনের প্রভাব কর্মজীবনে পড়তে দেয়নি। অদিতির মৃত্যুর পরেও স্বাভাবিক আচরণই করেছে সবার সাথে।

আহনাফ গান গাইতে পারে এই বিষয়টা জানার পরে সবাই জাফনার গান শোনার থেকে আহনাফের গান শুনতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠলো। সবাই সমস্বরে বললো, ” স্যার প্লিজ আপনি একটা গান করেন। ” কিন্তু আহনাফ তার সিদ্ধান্তে অনড়। সে জাফনার গানই আগে শুনবে। তাই সবাইকে বললো আজ নাহয় জাফনার গান শুনি আমরা। অন্য দিন আমি গান গেয়ে শোনাবো। আহনাফের সিদ্ধান্তে কেউ খুশি হতে পারলোনা। পেছন থেকে কেউ একজন সাহস করে বলে উঠলো, ” স্যার আপনি আর জাফনা নাহয় ডুয়েট করুন। তাহলে আপনার ইচ্ছেও পুরন হয় আর আমাদেরও।”

যে কথাটা বলেছে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে জাফনা কটমট চোখে তাকালো। কিন্তু সে ভয় পেলো না। কারণ সে জানে জাফনার যতই পাওয়ার থাক না কেন সে তার ক্লাসমেটদের সাথে কখনো খারাপ আচরণ করে না। এবং বাবার পাওয়ার খুব প্রয়োজন না হলে ইউজও করে না।

পেছনের ছেলেটার প্রস্তাব মনে ধরলো আহনাফের। সে জাফনাকে সামনে আসতে বললো।

আহনাফের ক্লাসরুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো মালিহা। এই পিরিয়ডটা তার ফাঁকাই থাকে। যেদিন কোনো টিচার অনুপস্থিত থাকে সেদিন এডজাস্ট ক্লাস নেয় সে। তাই বলা চলে এই সময়ে সে মোটামুটি ফ্রি। মালিহার জানামতে আহনাফ যখন ক্লাস নেয় তখন কোনো স্টুডেন্ট টু শব্দটি করার সাহস পায়না। অথচ আজ ক্লাসে গোলমাল চলছে। আহনাফ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলো৷ আহনাফ বিরক্ত হয়ে গেলো। এই সময়ে আবার মালিহা কেন? কিন্তু সবাই আছে ভেবে ভালো ভাবেই মালিহাকে ভেতরে আসতে বললো আহনাফ। মালিহা জানালো সে এই পিরিয়ডটা এখানেই কাটাতে চায়। মালিহাও স্টুডেন্টদের প্রিয়। দুজন প্রিয় শিক্ষককে একসাথে পেয়ে বাচ্চারাও খুশি হয়ে গেলো।

আহনাফ আর কথা বাড়াতে চাইলো না। জাফনাকে গান গাইতে বললো। জাফনা তার মাতাল করা কন্ঠে রবী ঠাকুরের গান গেয়ে উঠলো। ” আমারো পরানো যাহা চায়। তুমি তাই, তুমি তাই গো, আমারো পরানো যাহা চায়।”

আহনাফের মনে হলো জাফনা তার সমস্ত সুর, গানের কথা যেন গভীর আবেগে আহনাফের চরণে নিবেদন করেছে।

আহনাফও পরের কলি গেয়ে উঠলো। গান চলাকালীন সময়ে পুরো ক্লাস জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিলো। সবাই গানে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলো। গানের রেশ কাটতে না কাটতেই পুরো ক্লাস হাত তালিতে মুখরিত হয়ে গেলো।

আহনাফ আর জাফনা একবারের জন্য দৃষ্টিবিনিময় করে নিলো। জাফনা কখনো চিন্তাও করেনি গোমড়ামুখো আহনাফ এতো সুন্দর গান গাইতে পারে।

আহনাফ কলেজে জয়েন করার পর থেকেই জাফনার অসংখ্য প্রসংশা শুনেছিলো। এর মধ্যে জাফনার গানের গলার প্রশংসা প্রায় টিচারদের মুখেমুখে। আজ নিজে শোনার পরে আহনাফের মনে হলো সে ভীষণ তৃপ্তি পেয়েছে। সাথে আরেকটা অদ্ভুত অনুভূতিও হলো তার। যেটা হতো অদিতির গান শোনার পরে। জাফনা যখন গাইছিলো তখন কিছু কিছু যায়গায় অদিতির গলা খুঁজে পেয়েছে আহনাফ।

এদিকে মালিহা বিষয়টা সহজভাবে নিতে পারলো না। আহনাফকে পাওয়ার নেশা এখন এতোটাই তাকে গ্রাস করেছে যে আহনাফের পাশে কোনো মেয়েকেই সহ্য হচ্ছে না তার। আর জাফনা এবং আহনাফের ডুয়েট গান গাওয়া টা একদমই পছন্দ হলো না তার। সে সবাইকে বিদায় জানিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো। এদিকে আহনাফও ক্লাস শেষ করে চলে গেলো।

সবার কাছে সব ঠিকঠাক লাগলেও জাফনার মনের ভেতরের তোলপাড়টা ভীষণ রকম বেড়ে গেলো। আহনাফের প্রতি ভালোবাসাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো জাফনার এখন দিশেহারা লাগছে।

চলবে,,,