#সেই তুমি
#সানজিদা সন্ধি
#পর্ব ২৪
বাসায় ফিরে অস্থির চিত্তে সারাবাড়িতে পায়চারি করতে লাগলো জাফনা। তার মন প্রাণ সবকিছু এখন আহনাফের কাছে পড়ে আছে। অবাধ্য মনটা ভীষণ করে আহনাফের ভালোবাসা পেতে চাইছে। জাফনা আজ অদ্ভুত একটা সিদ্ধান্ত নিলো। এই রাতের বেলাতে আহনাফের বাসায় যাবে। আহনাফের বাসার ঠিকানা জানে সে। জিন্স আর হুডি পরে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাসা থেকে বের হলো জাফনা।
জাফনাকে বের হতে দেখে গেটম্যানও কিছু বললো না। জাফনা এরকম হুটহাট স্বভাবের সেটা সবাই জানে আর সাজ্জাদ খানও সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন জাফনা যেটাই করুক না কেন সেখানে কেউ যেন বাঁধা না দেয়।
বিষয়টা নিয়ে জাফনার মা ভীষণ রাগারাগি করেন। তার নিত্যদিনের ডায়লগ হয়ে গিয়েছে, “মেয়েকে আশকারা দিয়ে দিয়ে খারাপ বানিয়ে ফেলছো তুমি। কোনদিন কোন অঘটন ঘটে যায়। আমার কথা তো কেউ শুনবে না। কেই-বা আমি এই সংসারের। ” সাজ্জাদ খান বা জাফনা কারোরই কর্ণগোচর হয়না কথাগুলো। তারা নিজেদের মতো যা ভালো লাগে তাই করতে থাকে। জাফনার মা রাগে চোখের জল ফেলেন। মাঝে মাঝে অসহায় অনুভব করেন। বাবা মেয়ে কেউ তো তার কথা শুনতে পারে। সংসারে এমন অনাদৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে কারই বা ভালো লাগে।
অদিতির মৃত্যুর পরে আহনাফ আর আতিয়া চৌধুরীর সম্পর্ক অনেকখানি ঠিকঠাক হয়ে গেছে। মা ছেলে আগের মতো। তবে আদিলাকে হারানোর যন্ত্রণা কুঁড়ে কুঁড়ে খায় আহনাফকে। এখনো আদিলার মৃত্যুর জন্য আহনাফ আতিয়া চৌধুরীকেই দ্বায়ী করেন। আহনাফ কলেজ থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে তার মায়ের রুমে গেলো। আতিয়া চৌধুরী ছেলেকে কাছে ডাকলেন। দেয়ালের সাথে আতিয়া চৌধুরীর বিছানাটা লাগানো। আহনাফ বিছানায় দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে রইল। তারপর ভাবলো আতিয়া চৌধুরীকে জাফনা আর মালিহার বিষয়টা জানাবে সে।
জাফনার বাবা যেহেতু আবির চৌধুরীর বন্ধু তাহলে নিশ্চয়ই আতিয়া চৌধুরীর সাথেও সাজ্জাদ খানের পরিচয় আছে। আর হয়তোবা জাফনার মায়ের সঙ্গেও৷ জাফনার আবেগে এখনই বাঁধ দেওয়া দরকার। নয়তো বাচ্চা মেয়ে ভুল কিছু করতেও পারে।
আহনাফ নরম গলায় বললো, ” মা তোমাকে কিছু বলার আছে। ”
আতিয়া চৌধুরী উৎসাহ নিয়ে ছেলের কথা শোনার জন্য মুখিয়ে রইলো।
আহনাফ বললো, ” আমি কলেজে জয়েন করার পর থেকেই জাফনা নামের একটা মেয়ের সাথে আমার ঝামেলা হয়। সে আমার স্টুডেন্ট। পলিটিক্যাল লিডার সাজ্জাদ খানের মেয়ে আর সাজ্জাদ খান বাবার বন্ধু। আমাদের ঝামেলাটা দিনদিন নানান কারণে বাড়তে থাকে। তবে একপর্যায়ে জাফনার মধ্যে ঝামেলা বাড়ানোর সমস্ত ইচ্ছে চলে যায়। এবং সে আমাকে প্রপোজ করে। ” এটুকু বলতেই আহনাফের কন্ঠস্বর নিচু হয়ে আসে। কেমন কেমন লাগছে যেন তার। খানিকটা অস্বস্তি হচ্ছে।
আহনাফের মুখে এটুকু শুনেই আতিয়া চৌধুরী একপ্রকার বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে ওঠেন। তারপর হাসিহাসি মুখে বলেন আরে আমি চিনি জাফনাকে। সে তো অদিতির ননদ। অদিতির নাম চলে আসতেই চারপাশের পরিবেশ খানিকটা গুমোট ভাব ধারণ করলেও আহনাফ বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে বললো। হ্যাঁ অদিতির ননদ।
আতিয়া চৌধুরী অতি উৎসাহী হয়ে বললেন, ” তা বাবা জাফনাকে পছন্দ হয়েছে তোর? বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো ওর বাসায়? কিন্তু সে তো এখনো অনেক ছোট। তবে সমস্যা হবে না। শুধু প্রস্তাব দিয়ে রাখবো। তোর বাবা এলেই আমি জানাচ্ছি তাকে। আল্লাহ আমার মনের কথা শুনলেন তবে।”
আতিয়া চৌধুরীর উৎসাহ আর হাসিমাখা মুখটা নষ্ট করতে ইচ্ছে হলোনা আহনাফের। কিন্তু সে ভীষণ প্র্যাক্টিকাল। সরাসরি বললো, ” এতো উৎসাহের কিছু নেই মামনি। জাফনার কথাটা তোমাকে যে কারণে জানালাম। জাফনা এখনো অনেক বাচ্চা একটা মেয়ে। ভালো মন্দের জ্ঞান এখনো খুব বেশি হয়নি৷ সে আবেগে ভাসছে এখন। এই আবেগ কাটাতে হবে । তুমি তার পরিবারকে জানিয়ে দিবে তার দিকে খেয়াল রাখতে। তাকে চোখে চোখে রাখতে। এতটুকু হেল্প করিও আমার। আমি চাইলেই জারিফকে বিষয়টা জানাতে পারতাম। তবে আমার মনে হয়েছে বিষয়টা তুমি বা বাবা জানালে ভালো হবে।
আরেকটা কথা, আমি জানিনা মালিহাকে তোমার মনে আছে কি না। আমার ক্লাসমেট ছিলো। আমাদের বাসায় এসেছিলো কয়েকবার। সে আমাদের কলেজে জয়েন করেছে। আগে থেকেই আমাকে পছন্দ করতো সে। ইদানীং আবার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। বিষয়টা আমার একদম পছন্দ হয়নি। তাকে আমি কেন যেন পছন্দই করতে পারিনা। তাই তার বাসা থেকে কোনোরকম প্রস্তাব এলে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় যেন না দেওয়া হয়। আমি আশা রাখি তুমি আমার কথা রাখবে।
আতিয়া চৌধুরী আহনাফের কথা শুনে ভেবেছিলেন হয় মালিহা নয় জাফনাকে পুত্রবধূ করে আনবেন। কিন্তু আহনাফের কথা শুনে তার সমস্ত উৎসাহ কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে গেলো। ভেতর থেকে হতাশা অনুভব করলেন তিনি। মা ছেলের কথোপকথনের মধ্যেই কলিংবেল বেজে উঠলো। আজ দরজা খোলার মতো কেউ নেই। তারা খালার শরীর খারাপ করায় সে আগেই শুয়ে পড়েছে। অগত্যা আতিয়া চৌধুরীকেই যেতে হলো দরজা খুলতে। আহনাফও মায়ের পিছুপিছু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
দরজা খুলে আতিয়া চৌধুরী বিস্মৃত হলেন। আর যাই হোক এই সময়ে জাফনাকে তিনি এখানে আশা করেননি। বিষয়টা অপ্রত্যাশিত হলেও ভীষণ খুশি হলেন আতিয়া চৌধুরী। টিভির রিমোট হাতে কেবলই খেলার চ্যানেলটা দিয়ে সোফায় বসেছিলো আহনাফ। কিন্তু দরজার ওপাশের ব্যাক্তিটাকে দেখে সে থমকে গেলো। আতিয়া চৌধুরীর মতো আহনাফের কাছেও জাফনার আগমনটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। আহনাফকে দেখে জাফনা মিষ্টি করে সালাম দিলো। আহনাফের মনটা হুট করে কু ডেকে উঠলো। তার মনে হলো আজ কোনো একটা অঘটন ঘটতে চলছে বোধহয়।
আতিয়া চৌধুরী জাফনার খাতির যত্নে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। জাফনা আহনাফের কাছে গিয়ে ঠিক তার পাশেই আহনাফের গা ঘেঁষে সোফায় বসলো। এরকম মুহুর্তে কী রিয়্যাক্ট করা উচিৎ বুঝলোনা আহনাফ। তবে সে নিজে থেকেই সরে অন্য খানে বসলো। জাফনাও তার সাথে সাথে আহনাফের কাছে গেলো। এবার আহনাফ ধমকে উঠে বললো ব্যাপার কী? এরকম অসভ্যতামী কেন করছো?
আহনাফের ধমককে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে জাফনা বললো, “বাপরে! হবু স্বামীরই তো পাশে বসছি। অন্য কারো তো নয়। আহনাফ এবার বিষম খেলো। তারপর রাগী গলায় বললো, ” তোমার ভেতরে ভয়ডর কিচ্ছু নেই? আমার বাসায় এসে আমাকে এই ধরনের কথা বলার সাহসটা পাও কী করে? ”
জাফনা নিজেও জানে না তারমধ্য এতো সাহস আসছে টা কী করে। সে আসলে ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ভয়ে আছে। কখন না জানি আহনাফ থাকে ঠাস করে একটা গালে বসিয়ে দেয়।
আবির চৌধুরী উপরে নিজের ঘরে কাজ করছিলেন। নিচে এসে আহনাফ আর জাফনাকে কাছাকাছি বসে থাকতে দেখে তিনি বিব্রত হন। জাফনা বসা থেকে উঠে তাকে সালাম দেয়। আবির চৌধুরী কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে, “বাবা তুমি এ সময়ে এখানে? কোনো সমস্যা হয়েছে? হলে আঙ্কেলকে জানাতে পারতে। আমি সলভ করে দিতাম। আর তোমার বাবা মা জানেন কি? তুমি এখানে এসেছো?
” শ্বশুরবাড়িতে আসতে বুঝি কারণ লাগে বাবা?” নিঃসংকোচে কথা।
উপস্থিত সবাই ভরকে গেলেন। জাফনা মনে মনে শুধু সৃষ্টিকর্তার নাম নিচ্ছিলো। কোনো মেয়ে এরকম অঘটন ঘটাতে পারে না কি তার জানা নেই। তবে সে ঘটিয়েছে। কারণ এরকম না হলে হয়তো আহনাফকে পাওয়া হবে না তার। আর নিজের ভালোবাসা হারাতে সে কিছুতেই রাজি নয়।
আবির চৌধুরী আহনাফের দিকে একবার আড়চোখে তাকালেন। আহনাফের চোখমুখ দেখে তিনি বুঝলেন আহনাফ এসবের কিছুই জানেনা। রাগে লাল হয়ে গিয়েছে সে। আবির চৌধুরী বললেন, ” মামনি কিছু বুঝতে পারছি না আমরা তুমি কী বুঝিয়ে বলবে একটু?”
ততক্ষণে আতিয়া চৌধুরীও সবার মাঝে চলে এসেছে। জাফনা বলতে লাগলো,,
চলবে,,,