#সেদিন_মুষুলধারে_বৃষ্টি_ছিল
part–17
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
— আমাকে ভুলেও স্পর্শ করবেন না মুহিব।
আমি আর একদন্ড এই বাসায় থাকছি না। আমাকে যেতে দিন। (কাঠ কাঠ গলায় কথাগুলো বলে ফেলে সেজুতি)
মুহিবের মধ্যে কোন ভাবান্তর হলোনা। সে চোখ ছোট করে সেজুতির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা আসলেই বড্ড জেদী!
— আমি একবার যা বলি, দুনিয়া উল্টে গেলেও তাই করি। ( সেজুতি)
মুহিব বলে, ভাল তো। এক কথার মানুষ হওয়া খুব ভালো।
— মজা করছেন আমার সাথে?
এবারে মুহিব সেজুতির নিকটে এসে বলে, না। মজা কেন করব? মজা করা আমার স্বভাব না।
— আপনার তো বৌ পিটানো অশিক্ষিত স্বভাব।
— বড্ড বেশি কথা বলা শিখে গেছো দেখছি।
সেজুতি রাগী চোখে মুহিবের দিকে তাকালো। সত্য বলতে রাগ দেখিয়ে বর্তমানে তার কোন লাভ নেই। মুহিব আর রাগকে ভয় পায় না। বরং সে-ই মুহিবকে ভয় পাচ্ছে।মুহিবের ভেতরকার জানোয়ার কে সে ভয় পায়! কালকে রাতের কথা মনে পড়তেই তার শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে যাচ্ছে৷ কি দুর্বিষহ ছিলো!
এখন সকাল। সূর্য উঠে গেছে অনেক আগেই। রাতে তার জ্বর ছিল। ভাগ্যিস সুমি জলপট্টি দিয়েছিল। নাহলে মাথা উঠাতে পারত না সে৷ মাথাটা এখনো ভারী লাগছে। জ্বর ছাড়েনি গা থেকে এখনো। এরমধ্যেই মুহিব রুমে এসে দাঁড়িয়েছে। এবং সেজুতি কে অসুস্থ দেখে তার নিকটে এসে যেই না তাকে ছুতে যাবে সেই মুহূর্তে সেজুতি কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠে, আমাকে ভুলেও স্পর্শ করবেন না, মুহিব৷
একথাটা শোনার পর থেকে মুহিব শটাং করে দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে সেজুতির ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যে আছে সেই থেকে। সরে চলে যাওয়ার নাম নেই।
সেজুতি অবশ্য মাথা নিচু করে বসে আছে৷ একবার ও এই জানোয়ার রুপী মানুষ টাকে দেখছে না সে।মুহিবকে দেখলেই তার গা ঘৃণায় রিরি করে উঠছে।
তার পাশেই অভিক গভীর ঘুমে। পৃথিবীর অশুভ কোনকিছুই তাকে ছুয়ে যেতে পারছেনা। অভিককে দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যেন তাকে পরম যত্নে আগলে রেখেছে!
সে চোখ সরিয়ে অভিকের দিকেই দৃষ্টিস্থির করে।
তখনি মুহিব তার মুখোমুখি বসে পড়ে বিছানায়৷
সে বিছানায় বসতেই সেজুতি উঠে দাড়াতে চাইলে, মুহিব সুযোগ বুঝে তাকে জোর করে বসিয়ে দেয়। জোর করতে গিয়ে হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে। এতে সেজুতি কুকিয়ে উঠে।
মুহিব বিষ্ময় ভরা চোখে হাতের দিকে তাকালে দেখতে পায়, তার হাতের রগের পাশ ঘেঁষে অনেকখানি কেটে আছে। রক্ত জমাট বাধা কিন্তু ড্রেসিং বা ব্যান্ডেজ নাই। এতো জোরে ব্যথা পাওয়ার পরও কিভাবে ব্যান্ডেজ ছাড়া কাটা জায়গা উম্মুক্ত রেখেছে সে?
মুহিবের বুক ছ্যাত করে উঠে। সে প্রশ্নবোধক চাউনিতে সেজুতির দিকে তাকালো।
সেজুতি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, এগুলো সব তোমার দেয়া আঘাত!
মুহিব কিছু বললোনা। শুধু চোখের চাউনি নরম করলো এবং বলল, ব্যান্ডেজ লাগাও নি কেন?
— কয়টা আঘাতে ব্যান্ডেজ লাগাব?
— যত গুলো আঘাত লেগেছে৷
— তারচেয়ে বরং আঘাতকারীকে ধ্বংস করে দিই।
মুহিব এবারে সেজুতির দিকে তেড়ে এসে আলতো করে কপালে চুমু খেয়ে বলে, তুমি বা তোমার বাবা কেউ আমাদের ক্ষতি করতে পারবেনা।
সেজুতি ধাক্কা দিয়ে মুহিবকে সরিয়ে দিয়ে প্রায় চেচিয়ে উঠে বলে, বললাম না আমাকে ছুবেন না!
মুহিব সরে এসে বসে পড়লো, এবং নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, চিৎকার করোনা! চেচামেচি করে খামোখা এর্নাজি নষ্ট করছো।
— আমার চোখের সামনে থেকে সরো।
— সরব না৷ এক কাজ করো, ফাস্ট এইড বক্স আনছি। ব্যান্ডেজ করো।
— আপনার করুণা, দয়া কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই আমার। আর ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সুস্থ হয়ে লাভ কি? আবার পশুর মতো মারবেন তাই না?
— অযথা তুমি কালকে রাতের কথা মনে রেখে বসে আছো। সব ভুলে যাও।
সেজুতি মুহিবের দিকে তাকালো। তার চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকা বের হচ্ছে।
আচমকা সে হেসে উঠে। যা দেখে মুহিবের অন্তর কেপে উঠল। হাসিটাতে কি যেন একটা ছিলো!
সেজুতি বলল, আরেকবার আমার গায়ে হাত তুলে দেখান, আপনার হাত কেটে আমি গঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসব।
মুহিব শব্দ করে হেসে উঠে, তারপর মৃদ্যু গলায় বলে, বাংলাদেশে তো গঙ্গা নেই
বুড়িগঙ্গা আছে! তুমি বুড়িগঙ্গায় গিয়ে আমার হাত ভাসিয়ে দিতে পারো! কিন্তু দিনাজপুর থেকে বুড়িগঙ্গার তীর তো অনেক দূরে,,,,
সেজুতি ক্ষীপ্ত বাঘিনীর ন্যায় তাকালো।
মুহিব সেই দৃষ্টি পরোয়া না করে তাকে শুইয়ে দিয়ে বলে, আমি আসছি।
মুহিব বেরিয়ে যেতেই সেজুতি কেদে ফেলে। তার সবকিছু অসহ্য লাগছে। অসহ্য বিষ ব্যথায় গা পুড়ে যাচ্ছে, এদিকে মনটাও দাবানলে পুড়ে ছারখার!
সে চোখ বুজে শুয়ে রইল। কতক্ষন সেভাবে শুয়ে ছিলো জানা নেই তার। তবে, তার নিদ্রা ভাব ছুটে গেল যখন কেউ তার ঠোঁটে পরম যত্নে স্যাভলন লাগাতে লাগলো।
সেজুতির ওই সময় খুব ঘুম পাচ্ছিলো। হুট করে তার ঠোঁট কারো উষ্ণ স্পর্শ পেতেই তড়িৎ গতিতে সে ছিটকে পড়ে অন্যদিকে।
চোখ খুলে নজর দিতেই দেখলো মুহিব বিছানার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। সেজুতি রাগে থরথর করে কাপছে।
সে এতোটাই রেগে গেছে যে কথা অব্দি মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।
মুহিব হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। তারপর একদন্ড থেমে বলে, তুমি ঠিক আছো সেজুতি?
— আপনাকে না বারং করেছিলাম তারপর ও কেন আমাকে স্পর্শ করছেন?
— আজকেই তো প্রথম না,,,,
— চুপ করেন।
মুহিব হতবাক হয়েই বলে, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে সেজুতি।
— আমার সামনে থেকে সরুন বলেই ফাস্ট এইড বক্সটা সজোরে ফেলে দেয় সে।
মুহিবের প্রচুন্ড রাগ উঠলো কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো এবং উঠে দাঁড়িয়ে রুম থেকে চলে যায়। সেজুতির সঙ্গে কথা বাড়ানোই এখন মূল্যহীন৷
মুহিব বেরিয়ে যেতেই সেজুতি রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো।
★★★
মনোয়ারা আক্তার পান চিবুচ্ছেন এবং সুপারি কাটছেন বাগানে বসে। তিনি মুহিবকে দশ মিনিট আগে এখানে আসতে বলেছেন। অথচ দশ মিনিট হয়ে গেলেও মুহিব আসছেনা। ছেলেটা তো আগে এমন ছিলোনা। কি বাধ্য, অনুগত ছেলে তার। ঐ মেয়েটাকে বিয়ে করার পর থেকে মুহিব বদলে গেছে। কোন কিছু তে তার ছেলের মন নেই। তারই ভুল হয়েছে। মুহিবের প্রস্তাবে রাজি হওয়া উচিত হয়নি।
এই মেয়ে জাদু জানে। নিশ্চয়ই তার ছেলেকে কালোজাদু করছে। তাবিজ করছে নাতো!
মনোয়ারা আক্তার পানের পিক ফেললেন। তখনি উদয় হয় মুহিব।
তাকে সালাম দিয়ে বলে, আম্মা ডেকেছেন?
— হুম। বসো। কথা আছে তোমার সাথে।
মুহিব চেয়ারে বসে পড়লো। কালকে ঝড় হওয়ায় পরিবেশ ঠান্ডা। শীতল দমকা বাতাস এসে লাগছে। বাতাস লাগলেই গায়ে কাটা ফুটছে যেন!
মনোয়ারা আক্তার সাবলীল ভাবে বলে, আমার নাতী কি করছে?
মুহিব অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আম্মা ব্যাপার টা খুব স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছেন। কোন হৈচৈ করছেন না। যেন ছেলের প্রথম পক্ষের সন্তান নিয়ে হাজির হওয়া খুব স্বাভাবিক!
— কি হলো উত্তর দিচ্ছো না কেন আব্বা?
— ঘুমাচ্ছে ও।
— নাম টা যেন কি আমার নাতীর?
— অভিক।
— ওই বিদেশি মেয়েটা কিভাবে মারা গেল?
মুহিব ব্যথা জর্জড়িত গলায় বলে, জানি না আম্মা।
মনোয়ারা আক্তার এক দন্ডের জন্য চুপ রইলেন যেন কি বলবেন বুঝে পাচ্ছেন না তিনি।
এদিকে মুহিবের অস্থির লাগছে। আচ্ছা ভাইয়াকে সে কোন দিন আম্মার সঙ্গে নারী ব্যবসার কাজে কথা বলতে শুনেনি না কোন দিন ওইদিকে দেখেও নি। ভাইয়া গাড়ির পার্টসের ব্যবসা আর পেট্রোলের স্টেশন নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এতোদিন এই চিন্তা মাথায় আসেনি কেন? আম্মাকে কি জিজ্ঞেস করবে?
এবারে তিনি মুখ খুলে বললেন, আজকের পেপার পড়েছো?
— না।
উনি আজকের দিনের খবরের কাগজ মুহিবকে দিলো।
প্রথম পেজে হেডলাইন দেওয়া, এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই পুলিশ তদন্ত শুরু করে দিয়েছে৷
মুহিব চমকে উঠে। তাদের ওই বিল্ডিংয়ের সামনে তোলা এই ছবি। তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। কেমনে কি হলো? কি বললে এখন সে আম্মাকে? তাক্ব দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ব্যাপার টা ধামাচাপা দেয়ার জন্য। এখন কি করবে সে?
আম্মা ফোন দিয়ে জানানোর পরপরই এয়ারপোর্ট থেকে কল আসে। এরপর মূহুর্তের মধ্যে সব পালটে যায়। মেয়েটার কথা মাথাতেই ছিলো না মুহিবের! দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল মুহিব।
মনোয়ারা আক্তার বলেন, একটা দায়িত্ব দিয়েছিলাম তোমাকে, সেটাও ঠিকমতো করতে পারলে না?
— আম্মা আসলে,,,,,,,
— তোমার কি মনে হয়, পুলিশ সত্যটা জানে না! ঠিকই জানে। সবাই সব জেনে যাচ্ছে।
— জানলে তো আম্মা খবরটা নিউজে আসত। আমাদের সব ফাস করে দিত। এমন কিছু তো পেপারে আসলোনা।
মনোয়ারা আক্তার মুখে তিক্ততা এনে বলে, আমার দুই ছেলেই গাধা।
মুহিব একথা শুনে অপমানিত বোধ করছে।
তিনি বলতে লাগলো, পুলিশ সবার আগে আমাদের বিল্ডিং এ তদন্ত শুরু করলে, সব ফাস হয়ে যাবে। বিল্ডিং এ দশ জন মেয়ে আছে। কাস্টমার ছয় জন। সবাই ভেতরে আছে। কাস্টমার দের বেরুতে দেইনি। পরিস্থিতি কিন্তু প্রতিকূলে। আমাদের অবস্থা কিন্তু আগের মতো নেই। পুলিশ, মিনিস্টার, বিরোধী দল সবাই একজোট হয়ে আমাদের হারাতে চায়। তোমাকে পইপই করে বললাম সামাল দাও। কিন্তু তুমি হাত গুটিয়ে বসে ছিলে। ওদিকে বড়টা গাধার মতো বৌ নিয়ে বিদেশে বিদেশে ঘুরে।
মুহিব কিছু বললোনা। চুপ রইল।
মনোয়ারা আক্তার বলল, নতুন ডিসি কোন এক কারনে আমকে পছন্দ করেনা। এই লোকই সবকিছুর গোড়া। নাহলে আমাদের নিয়ে এমন খবর আসত না।সাহস পেত না। মুহিব আব্বা এক কাজ করো, তুমি বিল্ডিংয়ে যাও আর কাস্টমারদের বের করে সব কর্মীকে বাসায় আনো।
মুহিব যেন অবাক হলো। সে বলে উঠে, কি বলছো এসব আম্মা? বাসায় কেন আনব?
— যা বলছি শোন।
— বিল্ডিং ফাকা থাকলে তো সন্দেহ করবে পুলিশ।
–ফাকা থাকলে সন্দেহ করবে আর কাস্টমার সহ দেখলে জেলে ঢুকাবে। তোমাকে যা করতে বলছি তাই করো। বিল্ডিং ফাকা থাকবেনা। ওখানে গোডাউন বানাবো। যাও। সময় নষ্ট না করে ওদিকে যাও।
মুহিব উঠে দাড়ালো। এই মূহুর্তে তার ওদিকে যাওয়ার ইচ্ছে নেই৷ কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই। আম্মা তাকে এই কাজের সঙ্গে এমন ভাবে জড়িয়ে রেখেছে, কিছু একটা লিক হলে তাকেও জেলে যেতে হবে৷ জেলে কে-ই বা যেতে চায়!
রুমে এসে শার্ট চেঞ্জ করে সে আয়নার দিকে তাকালো। নিজেকে বিধ্বস্ত লাগছে। চোখে মুখে পানি দিতে পারলে ভালো লাগত!
সে পা বাড়ালো। ড্রয়িং রুমে সেজুতির মুখোমুখি হলো সে। কেউ কোন কথা বললো না।
সেজুতিকে দেখতেই মুহিব এমন ভাবে আতকে উঠলো যেন চোর ধরা পড়েছে।
সেজুতির হাতে নাস্তার প্লেট। সে অভিক আর তার জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে। পাউরুটি আর ওমলেট। নাস্তা সেরেই সে বাসায় চলে যাবে। থাকবে না আর এই বাসায়।
অভিকের রুমে আসতেই সে দেখতে পেল অভিক তার ছোট্ট হ্যারি পটারের ব্যাগের চেইন খুলে বসে আছে৷ তার মধ্যে দ্বিধা।
সেজুতি নরম গলায় ইংরেজিতে বলে,অভিক খেতে আসো।
অভিক সেজুতির দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যাগ থেকে একটা খামে বন্দি লেটার বের করলো। এরপর সেজুতির কাছে গিয়ে বলে, মাম্মা বড় ঘুম ঘুমুতে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল ভ্যাকেশনে গিয়ে যেই মেয়েটাকে মাম্মার মতো দেখতে মনে হবে, তাকে যেন এই লেটারটা দিই। তুমি আমার মাম্মার মতো দেখতে। তাই তোমাকে এটা দিচ্ছি। মাম্মা এটা তোমাকে দিয়েছে৷
সেজুতি হতভম্ব হয়ে হলুদ খামটা হাতে নিয়ে বলে, এসো আগে খেয়ে নিই। বেলা অনেক হয়েছে৷
অভিক গুটিগুটি পায়ে সেজুতির কাছে গিয়ে বসলো।
সে প্রশ্ন করে, তুমি নিজে নিজে খেতে পারো না?
— না।
এরপর আর কি করার! এক প্রকার বাধ্য হয়ে সে খাইয়ে দিলো। সেজুতি নিজে কিছুই খেতে পারলোনা।কেমন যেন অস্থির লাগছে তার।
খাওয়া শেষ করেই লেটারটার খাম খুললো। সাদা এ ফোর সাইজে লেখা চিঠি। সুন্দর অক্ষরে বাংলায় লেখা। সে পড়তে লাগে,
প্রিয় সেজুতি,
কেমন আছো তুমি? এই চিঠি টা যখন তোমার হাতে পৌছাবে তখন আমি হয়তোবা থাকব না। এজন্য খুব করে চাই যেন এই চিঠি তোমার হাতে না যায়!
তুমি আমাকে চেনো না। কিন্তু আমি তোমার নারি-নক্ষত্র সব জানি। তোমার প্রিয় রঙ হালকা বেগুনি। প্রিয় খাবার লুচি-আলুর দম। ইয়ার রিং পড়তে ভালোবাসো খুব। রান্না-বান্নায় আগ্রহী। অবাক হচ্ছো? এতোসব কিভাবে জানি? এইসব তথ্য আমাকে মুহিব দিয়েছে। মুহিব কিন্তু তোমাকে ভালোবাসে৷ সবার ভালোবাসা এক রকম হবে না। কেউ কেউ আছে যারা ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেনা মুহিব ও তেমনি কেউ একজন। আমি সম্ভবত তোমার সতীন হবো। বাঙ্গালীরা নারীরা তাদের সতীনকে ঘৃণা করে তাই না? মারামারি চলে তাদের মধ্যে। আমি তো আর বাঙ্গালী নই কাজেই তোমাকে ঘৃণা করিনা। আমি জানি তোমার সাথে মুহিবের বিয়ে হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই আমাকে স্বার্থপর ভাবছো তাই না? কথা সত্য। আসলেই আমি স্বার্থপর। বরং প্রতিটা মা-ই স্বার্থপর! একটা মাকে যদি তার সন্তানের ভবিষ্যৎ লেখার ক্ষমতা ঈশ্বর দিত , তবে পৃথিবীর কোন মানুষ ই কাদত না৷ তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, এটা সত্য আমি মুহিবকে ভালোবাসি। কিন্তু মুহিব কোন দিন হয়তোবা আমাকে ভালোবাসেনি। তোমাকে ভোলার জন্য সে আমার কাছে আসে। সে আসত না যদি কিনা আমি তাকে আসতে না দিতাম। আমি সুযোগ দিয়েছিলাম, কারন তাকে আমি ভালোবাসি৷ আমাদের সম্পর্ক যখন সুন্দর ভাবে চলছিলো, সেইসব দিন আমার জন্য স্বপ্নের মতো।
মাস চারেক যাওয়ার পর বুঝলাম আমি ভুল করেছি। মুহিব আমার জন্য নয়। মুহিবের মনে আমি নেই। তখনি অভিক হওয়ার খবর পাই। কিন্তু ওই যে আমি স্বেচ্ছাচারী, স্বাধীনচেতা একজন নারী। হীনমন্যতায় ভোগা শুরু করি। এক পলকে সব বিষ লাগা শুরু করে দেয়৷প্রতিটা মূহুর্ত স্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্ন লাগতে শুরু হলো। আমাদের এখানে চাদের রঙ পছন্দ নাহলে ই ডিভোর্স ঘটে যায়। কথার কথা বলছি।সেখানে আমি মুহিবের মনে কোথাও নেই। ঈশ্বরের কাছে দোয়া করতাম মুহিব যেন আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু তা হয় নি।বলে রাখি আমি খ্রিস্টান। এমনও দিন গেছে রাতে পাশাপাশি বসে আমাদের মধ্যে তোমাকে নিয়ে গল্প হত। তোমাকে নিয়ে কথা উঠলেই মুহিবকে খুশি দেখাত৷ কাজেই কন্সিভ করার পর আমি এর্বোশন করার সিদ্ধান্ত নিলাম কেননা আমি বুঝে গেছি আমাদের সম্পর্কের কোন নাম নেই।
মুহিব রাজি না হলেও আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড়। ব্রেকাপ করে ওয়াশিংটন চলে যাই। মুহিব জানত আমি বাচ্চা নষ্ট করে মুভ অন করেছি। তাই সেও দেশে ফিরে যায়। এমনটাই হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলোনা। আমার ব্রেইন টিউমার ধরা পড়ে। ডক্টর জানালো এর্বোশন আমার শরীরের ক্ষতি করবে। আমার বডি এর্বোশনটা সইতে পারবে না। সব মিলিয়ে আমি ভেঙে পড়ি। এরপর সিদ্ধান্ত নিই, মুহিবকে কিছু জানাব না। বেবি জন্ম দিয়ে কোন আশ্রমে রেখে আসব। কিন্তু যখন ছোট্ট অভিক আমার কোল জুড়ে এলো। আমার সব এলোমেলো হয়ে গেল। আমার দুনিয়া বদলে গেল। আমার নিজ সত্তা টাও বদলে গেল। বুঝলাম কত বড় ভুল করতে বসেছিলাম। আমার ছেলেই আমার সব। ঈশ্বর স্বয়ং আমাকে পাপ করতে বাধা দিয়েছিলো সেদিন। ছেলেকে নিয়ে শুরু হলো আমার সুখের সংসার।ডক্টর জানানো, আমার কন্ডিশন যথেষ্ট ভালো। আই উইল সুন রিকোভার। একটা অপারেশন হলো। আমি সুস্থ হলাম। সব আগের মতো। অভিককে নিয়ে আমার জীবন। যে জীবনে মুহিব নেই৷ কিন্তু ওই যে নিষ্পাপ একটা শিশুকে মারতে চেয়েছিলাম, পাপী আমি, তাই ঈশ্বর শাস্তি দিল। রোগটা আবার ফিরে এলো। ভয়াবহ আকার নিয়ে। এবার সারভাইভাল এর চান্স কম। তবুও ট্রিটমেন্টে কোন কমতি রাখছিনা। আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার বাবার বিশাল সম্পত্তি। সেই সম্পত্তি তে শকুনের নজর আছে। আমি সেই নজর প্রতিরোধ করে চলতাম। অসুস্থ হওয়ার পর আমার সব সম্পত্তি-টাকা অভিকের নামে উইল করা আছে। কিন্তু আমার ছেলের কোন নিরাপত্তা নেই এখানে। আমার অবর্তমানে দেখা গেল, টাকার লালসায় আমার ছেলেকে ওরা মেরে ফেললো, এই ভয়ে আমি অভিককে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিলাম।শক্রুর ভাবনার বাইরে পাঠিয়ে দিলাম আমার জানকে।
মুহিবের মুখে তোমার কথা শুনে বুঝেছি, তুমি খুব মায়াবী। তোমার মন দয়ার সাগর। সেই সাগর থেকে এক চিমটি দয়া কি আমার ছেলে পেতে পারেনা সেজুতি?
জানো সেজুতি, পৃথিবীতে সঠিক বলে কিছু নেই। যেমন ধরো, আমি অভিককে জন্মের আগে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম এটা ভুল, আমার ওকে জন্ম দিলাম সেটাও তো ভুল! মুহিব আমার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করলো সেটা ভুল আবার তোমাকে বিয়ে করলো সেটাও ভুল! তাহলে সঠিক কি? আসলে সঠিক বলে কিছু নেই। বরং যে ভুল সুধরানো যায় সেটাই সঠিক!
ভালো থেকো। অনেক দূরে থাকা এই ভীনদেশী মেয়েটা তোমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার খুব ইচ্ছা ছিলো তোমাদের দেশে গিয়ে একটা লাল শাড়ি পড়ে তোমার কাছে উপস্থিত হব। এবং তোমায় চমকে দিব। এরপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুলব। তোমার পরনেও লাল শাড়ি থাকা চাই।
ইতি
জুই।
চিঠি টা পড়া শেষ হতেই সেজুতির মনে কালো মেঘ জমা হলো। কি যেন একটা আছে চিঠি টাতে! কেমন বিষাদ ময় লেখাগুলো। নাকি মেয়েটা আর নেই জন্য লেখাগুলো বিষাদময়?
সে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে। তখনি নিচে একটা কালো মাইক্রো এসে থামলো।
মাইক্রো থেকে ছয়-সাত টা মেয়ে বের হচ্ছে। কি আশ্চর্য এতোগুলা মেয়ে বাসার সামনে এলো কেন? আশ্চর্য! দারোয়ান দরজা খুলে তাদের ভেতরে ঢুকতে দিলো।
চলবে।