#সেদিন_মুষুলধারে_বৃষ্টি_ছিল
Last part (প্রথম খন্ড)
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
মুহিব ক্ষত স্থানে হাত দিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে আছে সেজুতির পানে। তার কপালের রগ, মুখের পেশি ও চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। চোখে বিষ্ময়তা! যেন সে আকষ্মিক ঘটনার কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি৷
এক দন্ড থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে সে সেজুতি কে দেখে গেল এরপর মাথা কাত করে আশেপাশে চোখ বুলালো।
সেজুতির ফোন চার্জে লাগানো। সে দ্রুত টেবিলে রাখা ফোনের দিকে ছুটলো। এরপর চার্জার থেকে ফোন খুলে নিয়ে সজোরে মেঝেতে ফোনটা আছাড় মারে। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটার স্ক্রিন ভেঙে যায়৷
এতোক্ষনে সেজুতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে।সে অদ্ভুত নয়নে মুহিবের দিকে তাকিয়ে রইল। হতবাক সে। মুখ দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে৷ মাথা ভোভো করছে তার৷
যখনই মুহিব পা দিয়ে ফোনটা ভাংতে লাগে সেজুতি চেচিয়ে উঠে দাড়ালো এবং বলল, কি করছো তুমি? আমার ফোন কেন ভেঙে ফেলছো?
— যেন কারো সঙ্গে কন্ট্রাক করতে না পারিস।
সেজুতি ভয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। কান থেকে ধোয়া বের হতে লাগে। গলা শুকিয়ে গেল৷ মূহুর্তের মধ্যে হাত-পা হীম ঠান্ডা হতে লাগলো।
মুহিব ভাঙ্গা ফোনটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে গমগম সুরে বলে,
“সেজুতি আমি কিন্তু অনেক খারাপ! আগে মনের মধ্যে সরলতা, স্নিগ্ধতা থাকলেও এখন তার ছিটেফোঁটা ও নেই! মনের মধ্যে এখন কালশিটে দাগ বসে গেছে। তুমি শুধু আমার ভালোবাসা নও বরং জেদ! আম্মার সঙ্গে জেদ করে তোমাকে বিয়ে করেছি।”
সেজুতি ভ্রু কুচকে তাকালো। মুহিবের কোন কথাই সে বুঝতে পারছে না৷ আম্মার সঙ্গে জেদ করে তাকে বিয়ে করেছে এর মানে?
মুহিব পুনরায় বলতে লাগলো,
“অনেক আগে তোমাকে হয়তোবা ভালোবেসে ছিলাম ! এরপর তোমাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিলাম। ভেবেছি ভুলিনি তোমায় কিন্তু আজকে উপলব্ধি করলাম তোমাকে কোন দিন ভালোই বাসি নি! সব ভ্রম ছিলো সেজুতি। বহু আগে তোমার রুপের মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম। মায়া বড় কঠিন জিনিস সেজুতি! এইজন্য বারবার তোমাকে কাছে পেতে চাইতাম। যখনি তোমাকে কাছ থেকে ছুয়ে দিলাম, নিবিড় ভাবে জয় করলাম তোমাকে, বিশ্বাস করো এখন আমি সেই মায়াজাল থেকে ছিন্ন হতে পেরেছি। এই মূহুর্তে আমি দোটানায় ভুগছি। এটাই বুঝে উঠতে পারছি না, যে আমি তোমাকে ভালোবাসি নাকি বাসি না! কিন্তু আবার তুমি এখান থেকে চলে যেতে চাইলেও রাগ উঠে — এটা কি ভালোবাসার নমুনা?”
সেজুতি আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে ফ্লোরে নখ ঘষতে ঘষতে বলে,তোমার মুখে ভালোবাসা মানায়না। তোমার মতো অপবিত্র কারো মুখে ভালোবাসা র মতো পবিত্র অনুভূতিও কালো হয়ে যাচ্ছে।
আমাকে যেতে দাও মুহিব। জোর করে আর যাই করো না কেন আমার ভালোবাসা তুমি পাবেনা৷
— ভালোবাসা তো চাই না আর না চাই তোমার সঙ্গ!
— তাহলে কি চাও? কেন এভাবে যন্ত্রণা দিচ্ছো?
— আমার জানা নেই। শুধু এতটুকুই জানি আমি ভুল গন্তব্যে ছুটে যাচ্ছি। কিন্তু আমার হাতে কিছু নেই। কারণ জীবন আর ট্রেন ভুল গন্তব্যে ছুটে গেলেও আর পেছনে ফিরে ইউ টার্ণ নিতে পারেনা। আমার ও ফেরার পথ নেই। এই ভুল গন্তব্যেই ছুটে যেতে হবে।
সেজুতি মাথা তুলে তাকালো। এখন মুহিবকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। কিন্তু তারপরও চোখ দুটো থেকে লালচে ভাব দূর হয়নি।
মুহিব রুম থেকে বের হয়ে, রুমের দরজা লাগাতে লাগাতে বলে, দুঃখিত সেজুতি। তোমাকে আপাতত বন্দী হয়ে থাকতে হবে।
দরজা বাহির থেকে লক করে দিতেই সেজুতি রুমের ভেতর থেকে দরজার উপর হামলে পড়ে। দরজা ধাক্কা দিতে লাগে এবং জোর গলায় বলে, মুহিব দরজা খুলো। তুমি যা করছো এগুলো কিন্তু অমানবিক!
— আমি মানুষটাই অমানুষ কাজেই অমানবিক আচরণ তো করব তাই না?
সেজুতি দরজা সমানে ধাক্কাতে লাগলো কিন্তু বাহির থেকে কারো আওয়াজ এলো না৷ রুমে কোন ঘড়ি নেই। এমনকি দেয়াল ঘড়িও নেই।। ফোনও মুহিব ভেঙে ফেলেছে। কারো সঙ্গে যোগাযোগের উপায় নেই। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। আপা থাকলে নিশ্চয়ই এই দিন দেখা লাগতো না। আচ্ছা ওরা কি আপার সঙ্গে ও এমন অত্যাচার করত? তার বুক থেকে ধুকপুক শব্দ হচ্ছে। ঘাম ছুটছে তার গা থেকে। সম্পূর্ণ পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল সে। শুধু কানে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ার আওয়াজ আসছে। আজকে এতো বৃষ্টি হচ্ছে কেন? থামার নাম-গন্ধ নেই। সারাটা দিন ধরে বাইরে প্রচুন্ড জোরে বৃষ্টি পড়ছে৷ পৃথিবী ভেসে যাবে তো আর কিছুক্ষণ এমনই ভাবে বৃষ্টি হলে?
দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে ক্লান্ত হয়ে চুপচাপ রুমে বসে রইল সেজুতি। তার মাথায় হাজারো প্রশ্ন কিন্তু একটার উত্তর জানা নেই।
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। সেই সকাল থেকে এই চার দেয়ালে বন্দী সে। রুমে এক গ্লাস পানিও নেই। সকালে ঠিকমতো নাস্তাও করেনি। এই মূহুর্তে সেজুতির প্রচুন্ড ক্ষুধা লেগেছে। পিপাসায় চৌচির গলা।
মুহিব কি তার কথা ভুলে গেলো? সেজুতি নিরুপায় হয়ে জানালার পাশে দাড়ালো। বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু আকাশে মেঘ জমে আছে। মানে কি? আবারো বৃষ্টি নামবে?
হুহু করে বাতাস বইছে। শীতল হাওয়া গায়ে লাগতেই বড্ড আরাম লাগলো সেজুতির।
★★★
মুহিব দুইজন কাজের লোক নিয়ে তিনতলায় উঠছে। সাত-আট জনের খাবার নিয়ে এসেছে বাহির থেকে ।আম্মা নাকি ওদের জন্য বাসায় রাধতে বারং করেছে।
মুহিব আজকে সারা দিন বাসায় ছিলোনা।এখন রাত আটটা বাজতে চললো। মাত্র ফিরেছে। ফিরতেই আম্মা বলল, ওদেরকে খাবার দিয়ে আসতে। নিজে যেন যায়। অন্য কেউ যেন এই দৃশ্য না দেখে।
নানান কাজে বাইরে থাকতে হয়েছে। পেপারে যেই সাংবাদিক খবর ছাপিয়েছে, তাকে চা-নাস্তা দিয়ে মুখ বন্ধ করানো হয়েছে। আপাতত সব আন্ডার কন্ট্রোলে। এইজন্য মেজাজ ফুরফুরে আছে।
তিন তলার কলিডোরে একটা ব্রেঞ্চ আছে।
সে ব্রেঞ্চের উপর খাবার গুলো রাখতে বলে, কাজের লোকদের কে নিচে নেমে যেতে বলে। তারা চলে যেতেই মুহিব তিনতলার বাম পাশের স্টোর রুমটা খুললো। দরজা ভেজানো ছিলো। আসলে এটা স্টোর রুম না। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে সবাই এই রুমটাকে স্টোর রুম বলেই চেনে।
রুমের মধ্যে তিন জন মেয়ে বসে আছে। তাদের খাবার দিয়ে সে বেরিয়ে আসলো। আরো চারজন আছে পাশের রুমে। সে পাশের রুমের দরজা খুলতেই দেখলো, একজন নেই। তিন জন আছে। কিন্তু হিসাবমতে থাকার কথা চারজন। একজন গেল কই?
খাবারের প্যাকেট নিচে রেখে মুহিব ভ্রু কুচকে বলে, চম্পা কোথায়?
একটা মেয়ে মুহিবের মুখে চম্পার নাম শুনে হেসে কুটিকুটি। মেয়েটার সঙ্গে অন্যরাও তাল মেলালো।
ওদের মধ্যে একজন বলে উঠে, কেন সাহেব? চম্পা রে মনে ধরছে?
মুহিবের মেজাজ খারাপ হলো। আম্মা কেন যে এই মেয়েগুলো কে বাসায় এনে তুলেছে। অসহ্য!
সে বেরিয়ে এলো। এরপর নিচে হাটা ধরলো। তখনই তার মাথায় আসলো সেজুতিকে তো সে ঘরে আটকে রেখেছে। মেয়েটা সারা দিন ধরে ওই রুমে বন্দী।
সে বিড়বিড় করে বলে, ওহ শীট!
এরপর দ্রুত নিচে নেমে সুমিকে ডাকতে লাগলো। তাদের বাসায় রাত করে সুমিই থাকে। বাকি সবাই কাজ শেষ করে বিকাল নাগাদ চলে যায়।
সুমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চলে এলো। মুহিব বলে উঠে, আমার রুমে এক প্লেট ভাত নিয়ে যাও সেজুতির জন্য।
— আচ্ছা ভাই।
— এই যে রুমের চাবি। দরজা ভেতর থেকে লক করা। খাবার দিয়েই রুমের দরজা লক করে আমাকে চাবি দিবে।
সুমি ভয়ে আর কোন প্রশ্ন করলো না৷ শুধু মাথা নাড়ালো।
মুহিব হনহন করে একতলায় চলে গেল।
একতলায় ও তিনটা রুম আছে। এরমধ্যে একটা অফিস কক্ষ। অফিসের বিভিন্ন ফাইল পত্র ঠেসা থাকে সেখানে। তার পাশেই একটা গেস্ট রুম। মুহিব গেস্ট রুমে ঢুকল। গেস্টরুমের সঙ্গে লাগানো বাথরুম আছে৷ সে মূলত বাথরুমে যাবে৷ দোতলায় চারটে বেড রুম। আম্মা, ইমা, ভাই-ভাবী আর তার বেডরুম। রুমের সঙ্গে লাগানো বাথরুম। কাজেই বাথরুম ব্যবহার করতে হলে অন্যদের রুমে প্রবেশ করতে হবে এইজন্য নিচে এসেছে সে ফ্রেস হতে৷
বাথরুমে ঢুকে মুখে চোখে পানি দিতে লাগলো। ঘামে জুবুথুবু তার গায়ের শার্ট। গোসল করতে মন চাচ্ছে।গোসল করলে স্বস্তি পেত।
তার উপর বৃষ্টি হলে মুহিবের কাছে সবকিছু অপরিচ্ছন্ন লাগে! আজকেও থেমে থেমে অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টি হয়েছে৷ এখন অবশ্য থেমে গেছে। তাও ঘর-বাড়ি নোংরা নোংরা লাগছে বৃষ্টি হওয়ার জন্য।
সে মুখ ধুয়ে পরনের শার্ট খুলে ফেলে বাথরুমের মেঝেতে ফেলে দিলো। পরনে এখন তার একটা পাতলা স্যান্ডো গেঞ্জি।
প্যান্টে কাদা ও লেগে আছে। সে ঝুকে প্যাটের কাদা পরিষ্কার করতে লাগলো। এমন সময় বাথরুমের বাহির থেকে ঘুটঘুট শব্দ হতে লাগলো।
সে ভ্রু কুচকে ফেললো। এই সময় রুমে কে? সে যত দূর জানে ইমা বাসায় নেই বান্ধবীর বাসায় আজকে রাতে থাকবে, আর আম্মা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে। সেজুতির আসার কথা না৷ তাহলে কে এলো?
চটজলদি সে বাথরুম থেকে বের হলো। সঙ্গে সঙ্গে চোখজোড়ায় একটা মুখশ্রী ভেসে ওঠে।
মুহিবের চোয়াল পুনরায় শক্ত হয়ে উঠে। সে কটমট করে বলে, তোমাদেরকে আম্মা বলে দেয় নি, এদিকে আসা নিষেধ। তোমরা তিনতলায় থাকবে। যাও৷
চম্পার মধ্যে মুহিবের কড়া গলায় বলা কথায় কোন হেলদোল হলোনা। সে মিটমিট করে হাসলো। এরপর এক পা এগিয়ে দিয়ে বলে, স্যার শুনলাম আপনি নাকি আমাকে খুজছিলেন?
— না৷
— জিতু বললো আপনি নাকি আমার খোজে এসেছিলেন?
মুহিবের গা রিরি করে উঠে। এটা কেমন কথা? এই মেয়ের খোজ নিতে সে কেন যাবে? আর এরা এতো মিথ্যুক কেন?
সে বলে, মিথ্যা কথা৷
চম্পা এক পা দুই পা করে মুহিবের দিকে আগালো। মুহিব ঢোক গিললো।
চম্পা হচ্ছে সবচেয়ে হাই ডিমান্ডের কর্মী। সব কাস্টমার চম্পা বলতে পাগল। এই চম্পার জন্য তাদের বিন্ডিংয়ের গলি পরিচিত।অনেক কাস্টমার তো তাদের বিল্ডিংয়ের গলিকে চম্পা গলি বলে। আম্মার খুব পছন্দ এই চম্পাকে। কিন্তু মুহিব একে একদম সহ্য করতে পারেনা। চম্পা খুব বেয়াদব। মুহিবকে সবাই সমিহ করে চলে কিন্তু এই মেয়ে মুহিবকে একদমই ভয় পায় না।
একবার কি গন্ডগোল হলো, চম্পা অনেক পুরাতন এক কাস্টমারকে চড় মেরে দিলো। এই ঘটনার জন্য মুহিব খুব করে চাচ্ছিলো চম্পাকে ছাটাই করা হোক। কিন্তু আম্মার আবার চম্পা ছাড়া চলে না। এই মেয়েকে আম্মা এতো আস্কারা দেয় জন্য সাহস হয়েছে তার কাছে এসে আজেবাজে বকার! গালে একটা চড় পড়লেই সব বদমায়েশি ঠিক হয়ে যাবে।
আচমকা চম্পা তার মুখের সামনে এসে দাড়ালো এবং দুই হাত দিয়ে মুহিবের কাধ জড়িয়ে ধরলো। নিজের পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে খানিকটা উচু হয়ে চম্পা মুহিবের মুখোমুখি হলো।
মুহিব ভীষণ হতভম্ব হলো। নড়ার শক্তি লোপ পেল তার। এতো কাছ থেকে চম্পাকে দেখে তার শিরা-উপশিরায় কি যেন বয়ে গেল।
এই মূহুর্তে চম্পার সঙ্গে সেজুতির চেহারার অসম্ভব মিল পাচ্ছে সে। কোথায় মিল? চম্পার সঙ্গে সেজুতির মিল থাকলে জুইয়ের সঙ্গে ও মিল থাকা উচিত! কি আশ্চর্য! সে এসব কি ভাবছে আবোলতাবোল? মাথা খারাপ হলো নাকি তার?
চম্পা মৃদ্যু গলায় বলে উঠে, স্যার! আপনার বউটা খুব সুন্দর!
–হু।
চম্পা আরো একটু আগালো। মুহিব চুপ আছে জন্যই সে সাহসটা পাচ্ছে। স্যার খুব বদরাগী। ক্যাটক্যাট করে সারা দিন। আজকে এতো চুপ কেন?
মুহিব খানিক কদম পিছিয়ে এলো। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছেনা। সবকিছু এলোমেলো লাগছে তার৷ অস্পষ্ট দেখছে সবকিছু সে।
চম্পা তার আরো কাছে এসে দাঁড়ালো।কোন আড়ষ্টতা না করে মুহিবের ঠোঁটে ঠোঁট ছুয়ালো৷
সঙ্গে সঙ্গে মুহিবের শরীরে ক্যারেন্ট বয়ে গেল। সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। শ্বাস আটকে আসছে তার। উষ্ণ স্পর্শ পেতেই তার সারা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শীতল শিহরণ বয়ে গেল। মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। বুকে ভার লাগতে শুরু হলো।
আচমকা সে চম্পার কোমড় চেপে ধরে।
★★★
এদিকে সুমি খাবার নিয়ে সেজুতির কাছে যাচ্ছিলো তখনই অভিক তার লেচ ধরে হাটা ধরলো।
সুমি হেসে বলে উঠে, ব্যাগ কাধে নিয়ে কি করো বাবু?
প্রতিত্তোরে অভিক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। তা দেখে সুমি বলল, তুমি তো আবার ইংরেজি বাচ্চা। আসো ভাবীর কাছে যাই। যাবা ভাবীর কাছে?
অভিক কি বুঝলো কে জানে কিন্তু সজোরে মাথা ঝাকালো।
অগত্য অভিককে নিয়েই সুমি সেজুতির কাছে গেল।
রুমের দরজা খুলতেই সেজুতি বিছানা থেকে
এক প্রকার লাফ মেরে উঠে দাড়ালো।
সুমিকে প্রশ্ন করে, তোমার ভাই কই?
— ভাই একতলায়।
সেজুতি আর কিছু না শুনে রুম থেকে বের হতে গেলে সুমি বলে উঠে,ভাবী আপনার জন্য রাতের খাবার এনেছি,,,,,,
সে পেছনে ঘুরে দেখে খাবারের সঙ্গে পানি ও আছে। দ্রুত সেখান থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। এরপর রুমের বাইরে পা বাড়ালো।
সুমি টেবিলে খাবার রেখে বলে, এখানে থাকবা বাবু?
সুমি ভুলেই গিয়েছে মুহিব তাকে বলে দিয়েছে সেজুতি কে রুম থেকে বের না হতে দিতে।
অভিক ততোক্ষনে বিছানায় উঠে বসে নিজের হাতে থাকা একটা খেলনা নিয়ে খেলা শুরু করে দিয়েছে। সুমি আর তাকে ঘাটালো না। বেরিয়ে এলো রুম থেকে। রুম থেকে বের হতেই মনে পড়লো ভাই সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে খাবার দিয়েই রুম লাগিয়ে দিতে। সুমির চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ভয়ে রক্ত পানি হয়ে গেল।
অপর দিকে, সেজুতি ড্রয়িং রুমে আসতেই উপর তলা থেকে মেয়েদের হাসাহাসির আওয়াজ পেল৷ তার মাথায় প্রশ্ন জাগে মেয়েগুলো কে? কারা এরা? কেন এসেছে এখানে?
সে আর কিছু না ভেবে উপরে উঠে যায়। উপরে উঠতেই কলিডোরে চারটা মেয়েকে কি নিয়ে হাসাহাসি করতে দেখলো সে।
সামনে এগিয়ে যেতেই একটা মেয়ে তাকে দেখে বলে উঠে, আরে নতুন বৌ যে!
সেজুতি সোজাসাপটা প্রশ্ন করে, আপনারা এখানে কেন এসেছেন? পরিচয় কি আপনাদের?
একটা মেয়ে পান খেতে খেতে জবান দেয়, আমরাও বৌ। তবে একজনের না।অনেকজনের হিহিহি।
মেয়েটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাকিরাও হাসিতে সামিল হলো।
সেজুতি ভ্রু কুচকে বলে, এইসব কোন ধরনের অসভ্যতা?
— আমরা তো অসভ্যই!
সেজুতি মেয়ে চারটার দিকে তাকালো। সবার মধ্যে বেশ কিছু মিল আছে তাহলো চারজনই কপালে টিপ পড়েছে। কানে দুল, হাতে চুড়ি,
সবাই শাড়ি পড়ে আছে।
সে প্রশ্ন করে, ঘুরিয়ে পেচিয়ে উত্তর না দিয়ে বল কে তোমরা?
— আমরা মানুষ।
— রসিকতা করবে না।
— হাহা।রাগ করলেন নতুন বৌ? আপনিও তো দেখি সাহেবের মতো খালি খালি রাগ করেন৷
— মুহিবের কথা বলছো?
— জি৷
–ওকে কিভাবে চিনো তুমি?
— বারে চিনব না কেন?
সেজুতি ঝাঝালো কন্ঠে বলে, যা বলার ক্লিয়ারলি বল। মুহিব তোমাদের এখানে কেন এনেছে?
এবারে অন্য একটা মেয়ে সামনে এগিয়ে এলো। এই মেয়েটার চেহারায় একটা সরল ভাব আছে। বয়স নিশ্চয়ই কম। শাড়ি আর টিপ পড়ায় বয়স বেশি লাগছে৷
মেয়েটা কাদো কাদো সুরে বলে, আপু আমাকে বাঁচান।আমি আর এখানে থাকতে চাই না।
সেজুতি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে, মানে?
মেয়েটা হড়বড় করে বলে, খুব অভাবে ছিলাম আপা। একটা টাকা ছিলো না হাতে৷ আমার আম্মা খুব অসুস্থ ছিলো। ছোট এক ভাই।খাবার জন্য সাদা পানি ছাড়া কিছু ই ছিলো না৷ কেউ ছিলো না পাশে। তখন মনোয়ারা খালাম্মা আমাকে এই পেশায় ঢুকায় দেয়। অভাবে স্বভাব নষ্ট হইছিলো আপা। বিশ্বাস করেন আমি খারাপ না। আমাকে মাফ করেন। আমি বাসায় যাব। আম্মার কাছে যাব। বলে হুহু করে কাদতে লাগে৷
এতোক্ষন যেই মেয়েটা সেজুতির সঙ্গে কথা বলছিলো সে বলে, ওই মাইয়া চুপ কর তোর প্যানপ্যানানি! যত্তোসব ঢং তোর! মনোয়ারা খালাম্মা হলো গিয়ে দেবী।
মেয়েটা দমে গেল। তাও হিচকি তুলে কান্না করতে লাগে৷
সেজুতি অনেক কিছু আন্দাজ করে ফেলে। সে এনজিও তে অনেককে বলতে শুনেছে, তাদের এলাকায় নাকি এমন অসহায় মেয়েদের নিয়ে নোংরামি ব্যবসা করানো হয়।যারা এইসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের ক্ষমতা অনেক জন্য কেউ কিছু বলে না । তাহলে কি,,,, সে আর ভাবতে পারলো না৷
সেজুতি সরাসরি মেয়েটাকে প্রশ্ন করে, তোমরা কে? আর কোন পেশার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে আম্মা তোমাকে?
কাদতে কাদতে সরল চেহারার মেয়েটা সব সত্য বলে দিলো।
সেজুতির পা থেকে মাটি সরে গেল। নিজেকে ভারসাম্য হীন মনে হতে লাগলো। কপালে হাত দিয়ে ঘাম মুছে সে দেয়াল ঠেকে দাড়ালো।
মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছেনা তার। চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে।
প্রথমে কথা বলা মেয়েটা বলে উঠে, আপনি হলেন নতুন বৌ আর আমরা হলাম পুরাতন বৌ।
সেজুতি রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো৷
মেয়ে হোহো করে হাসতে লাগে। হাসতে হাসতে মুখের ভেতর থেকে পানের পিকের রস গড়িয়ে পড়তে লাগে।
সে হাসি থামিয়ে দিয়ে বলে, মুহিব সাব প্রায় রাতে আমার কাছে আসে। আমার বুক ওনার খুব পছন্দ,,,,,
— চুপ৷ একদম চুপ।
মেয়েটা আবারো অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। এবং হাতে তালি দিতে দিতে বলে, আপনি জিজ্ঞেস করলেন না আমরা কে হই? আমরা হলাম গিয়ে আপনার সতিন! হাহাহা!
সেজুতির কান, নাক থেকে গরম ধোয়া বের হতে লাগে। সে কাদতে কাদতে এক ছুটে নিচে নেমে যায়। অসহ্য বেদনায় সারা শরীর কাতরাচ্ছে তার। কি জঘন্য!
মাথা চক্কর দিয়ে উঠে সেজুতির। সে একেবারে একতলায় চলে আসে। তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। কিছু তেই সে উপর তলার মেয়েগুলোর কথা বিশ্বাস করেনা। সব ভুল। সব মিথ্যা।
সে অসার হয়ে যাওয়া পা নিয়ে এক তলায় চলে আসে। মুহিব কোথায়?
মুহিবের খোজে সে নিচ তলার অফিস কক্ষে গেল। এই রুমে কেউ নেই। তাহলে নিশ্চয়ই পাশের রুমে হবে৷ কিন্তু ওই রুমে কি করছে মুহিব?।
সে পা বাড়ালো গেস্ট রুমের দিকে৷ গেস্ট রুমের দরজা ভিজানো।
সে আস্তে করে দরজা খুলতেই মুহিবকে অপরিচিত একটা শাড়ি পরিহিতা মেয়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকতে দেখে ফেলে।
মুখ দিয়ে আনমনে শব্দ বেরিয়ে যায়,” মুহিব”
কারো কন্ঠস্বর শুনে মুহিব চম্পাকে ছিটকে ফেলে দিলো নিজের কাছ থেকে।
সেজুতি কে দেখে মুহিব পিলে চমকে উঠে। সেজুতি কিভাবে এখানে এলো?
চলবে৷