স্বপ্নময় ভালোবাসা পর্ব-১৮

0
5020

স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
পর্ব-১৮

চৈত্রের শেষ বিকেল।সারাদিনের উত্তপ্ত রোদের ঝাঁঝ এখন কিছুটা কমে যেয়ে চারদিকে স্নিগ্ধ বাতাস বইছে।স্নিগ্ধ বাতাসে জানলার দামী দামী সাদা পর্দাগুলো কিছুক্ষণ পর পর নড়ে উঠছে।আমি সেদিকে খানিক তাকিয়ে সোফায় আরেকটু আয়েশ করে বসতে নিলেই এরইমাঝে আধা বয়সী এক ভদ্রলোক আসেন।ভদ্রলোককে চেনতে অবশ্য আমার বেগ পেতে হয় নি।ইনি নিশ্চয়ই গার্ডিয়ান হবেন।ভদ্রলোক কিছুটা ধাতস্থ বোধ করে উত্তেজিত গলায় বলেন,

“আই’ম এক্সট্রিমলি স্যরি!অনেকটা দেরী হয়ে গেছে!আসলে বাচ্চাগুলোকে নাস্তা সার্ভ…!”
“ইট’স ওকে নো প্রবলেম।আই ক্যান সি।”
“থ্যাংক ইউ।”
লোকটি কিছুটা স্বস্তি বোধ করে আমাদের সামনের সিটটায় বসে পড়েন।জিহ্বা দিয়ে গলা ভিঁজিয়ে গলার স্বর কিছুটা নরম করে তারপর বলেন,

“তা তোমাদের মাঝে কে পড়াবে আমার মেয়ে দুটোকে?”
সেখানে আমার সাথে টোয়াও ছিল।আমি গলা উঁচিয়ে বললাম,
“জ্বী,আঙ্কেল আমি।”
“ওহ আচ্ছা!অনার্স ত কম্প্লিট,তাই না?”
“জ্বী।”
“বাসা কোথায় তোমার?”
“কোটবাড়ি। ”
“কোটবাড়ি থেকে বিশ্বরোড…!আচ্ছা আসতে এমনিতে প্রবলেম হবে নাতো?”
“জ্বী না।”
“ওকে।তা আগে কোথাও টিউশনি করিয়েছ?আই মিন অভিজ্ঞতা কেমন? ”

একথার ফোঁড়ে আমি খানিকটা ধাতস্থতা হই।কারণ এর আগে আমি কখনো টিউশনি করাই নি যদিও ভালোমতো পড়ানোর সেই ক্যাপাবিলিটি আমার আছে। তাছাড়া,এখানে আসার আগ দিয়ে টোয়া আমাকে সতর্ক করে দিলো,
“দোস,চাকরি অথবা টিউশনির কথা যাই বলিস সবগুলোই এক একটা ইন্টারভিউ।গার্ডিয়ানের ঠোঁটের কোণায় যেই কথাটি সর্বপ্রথম ঝুঁলে থাকবে তা হলো এক্সপেরিয়েন্স কেমন?আগে কোথাও টিউশনি করিয়েছেন?তা কখনোই স্বীকার যাবি না যে আগে কোথাও করাস নি,নাহলে সাথে সাথেই বাতিল।আমি ত টিউশনি করাই আমি জানি!”

টোয়ার কথাটি মাথা রেখেই মিথ্যে বলে দিলাম,
“জ্বী,করিয়েছি।”
“এখনো করাচ্ছো?”

আবারো ধাতস্থতা বোধ করে টোয়ার দিকে তাঁকাই।টোয়া চোখ দিয়ে ইশারা করে “হ্যা” বলতে।আমি হ্যাঁ বলে দিই।ভদ্রলোক খুশি হয়ে সাথে সাথে দাঁত বের করে হেঁসে দেন।বলেন,
“গুড!তা এবার এমাউন্টের কথায় আসা যাক!আমি তোমার কাছে আমার দুটো মেয়েকে পড়াতে দিব।একটা ক্লাস থ্রীতে, আরেকটা ক্লাস এইটে।সময় আড়াই ঘন্টা। এমাউন্ট পাঁচ হাজার!কী হবে?”

ভদ্রলোকের কথায় আমার চোখমুখে বিস্ময় রেখা স্ফুটিত হয়।এমাউন্টের পরিমাণটা খুবই কম।এত কম এমাউন্টে যে কেউ পড়াতে সহজে রাজি হবে না।আমার বিস্ময়ের ফোঁড়ন কেঁটে পাশ থেকে টোয়া বলে উঠলো,

“জ্বী,আঙ্কেল এমাউন্টটা যদি আরেকটু বাড়াতে পারতেন তাহলে ভালো হত আর কি!”
“দেখুন,আমি আগেও পড়িয়েছি পাঁচ হাজার দিয়ে।সমস্যা আগের টিচারের ঢাকায় জব হওয়াতে সে ঢাকায় চলে গেছে!

কম দেওয়ার ধান্দায় লোকটি যদিও বানিয়ে মিথ্যে বললো তবে আমার উপায় ছিল না।বাসা ভাড়া,খাবার খরচ,জবের বই কেনা,জব এপ্লিকেশন ফর্ম কেনা এরজন্যে অনেক অনেক টাকার দরকার!তাই অফারটা আর রিজেক্ট করি নি।রাজি হয়ে যাই পড়াতে।।

ওই বাসা থেকে বেরুনোর পর এতক্ষণে টোয়া ঠোঁটের কোণায় চেপে রাখা কথাগুলো গ্যাসের মতো বুদবুদ করে ছাড়তে থাকে।
” ব্যাঁটা,খচ্চর!এত টাকার মালিক অথচ একজন গৃহ শিক্ষককে মূল্যায়ন করে মাত্র পাঁচ হাজার দিয়ে!তাও সময় টা দেখছিস তুই?ওই হাঁদারাম নসির গন্ডারকে গিয়ে পিডামু!এত কম বাজেটে ওই বাসায় পাঠাইলো ক্যান!”

“আহা,এত খেঁপছিস ক্যান?নসিরের কী দোষ?ও কি জানে ওই লোক যে এতটাকা দেবে?যাইহোক,অসময়ে একটা কম টাকার টিউশনেরও অনেক দাম!জানিস ত আমার বর্তমান অবস্থা! ”

“টেনশন নিস না,সানা।এখন এটা কর।আমি তোর জন্যে আরো টিউশন দেখবো।”

আমি টোয়ার কথায় অনেকটা খুশি হয়ে তারপর আমরা বাসার দিকে পা চালাতে থাকি।বাসায় আসার পরই তরহর চুলায় রান্না ছড়িয়ে দিই।দিনে পাতিলে কিছুটা ভাত ছিল।তাই আর রান্না করতে যাইনি,তা দিয়েই দিনে কোনমতে চলে গিয়েছে।ভাতটা শেষ হয়ে আসলে তরকারি কী রান্না করবো কী রান্না করবো ভেবে তরকারির র্যাক টুকতে থাকি।দুই তিনটা গোল আলু ছাড়া আর কিছুই পাইনি!মনটা ক্ষান্ত হয়ে যায়!
তারপরও আলু যেহেতু আছে তা দিয়ে আলুভর্তা করে নিব।ভাতের মাড় টা আর ফেল দিব না।ভাত,মাড়,আলু ভর্তা দিয়ে রাতটা কোনমতে কাভার করবো।

ভেবে নিয়ে চুলোর দিকে এগিয়ে যেতেই দরজা করাঘাত পড়ে।আলু গুলো টেবিলের উপর রেখে দরজা খুলে দেখি পাশের বাসার রহিমা কাকী এসছেন।বললাম,

“কাকী, তুমি?”
উনি হেসে দিয়ে বলেন,
“হ।তোকে দেখতে আসছি।টোয়া কই?বাড়ি গেছে?”
“হু।কিছুক্ষণ পর আবার চলে আসবো।”
“ওহ।কিছু রান্না করছিস আজ?”
“এইতো করতেছি।”
“কী রান্না করছিস?”

আমি খানিক হেসে দিয়ে বললাম,
“এইতো ভাত আর আলুভর্তা ।সমস্যা নেই আজ এগুলো দিয়েই খেতে পারবো।”
বলেই আবারো হাসার চেষ্টা করি।
উনি কপালের অংশটা তীব্র ভাঁজ করে বলেন,
“থাক ।আমি আসছি।”

বলেই হর্ণপায়ে মুহূর্তে অন্ধকারে মিলিয়ে যান।আমি আবার আমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।কিছুক্ষণ কাঁটার পর রহিম কাকী আবারো হাজির হোন।তাকিয়ে উনার হাতে দু’টা বাটী।প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতেই বললেন,

“আজ আমার ননদী আসছে আর আমি গরুর গোস্ত রান্না করছি।মুগ ডাল রান্না করছি।আর করলা ভাঁজি করছি।তার থেকে তোরজন্যেও নিয়া আসছি।ধর বাটী গুলা রাখ। ”

“কী দরকার ছিল কাকী এত কষ্ট করার!আরেহ আমি ত রান্না করতেছি।”
“বেশি কথা বলিস না তো মেয়ে! নিতে বলছি না।এত ক্যানক্যান আমার ভাল্লাগে না।”

আমি আর কাকীর সাথে কথা বাড়াই নি। আলতো হাতে বাটীগুলো উনার হাত থেকে নিই।বাটীগুলো আলমারিতে রেখে পেছন ফিরতে কাকী আবার বলেন,

“শোন,মা?আমি তোর আপন কাকী না হলেও প্রতিবেশী কাকী।তোর মা নাই।খালামণি ছিল এখন ওই জানোয়ার টাও নাই।এখন পৃথিবীতে বলতে ওই উপরওয়ালাই আছেন।তাই বলি কি তোর যখন যেটা মন চাইবে খেতে সোঁজা আমার কাছে চলে আসিস।লজ্জা পাস না।আমি তোর মার সমান!বুঝলি?”

খানিক থেমে তারপর আবার বলেন,
“লোকে আমারে খারাপ বলতে পারে,কিন্তু আমার মনটা ওত খারাপ নারে,সানা।”

আমার দু’চোখ ছলছল করে উঠে। এলাকার লোকজন উনাকে নিয়ে প্রায়ই হিংসুক,খেচ্চর,পানি দিয়া চিয়া ভিঁজে না ইত্যাদি নানান কুৎসা কথা বলে।কিন্তু উপর থেকে সবাই উনাকে যতটা খারাপ ভাবে,উনি সত্যিই ততটা খারাপ না!অসময়েই বোঝা যা বাস্তবে কে কেমন।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুখে হাসি এনে বললাম,
“কাকী যে যাই বলুক আমিতো জানি আপনি কেমন এবং আপনিও আপনার মনের কথা জানেন।লোকের কথায় কান দেওয়ার কোনো দরকার নেই কাকী।

কাকী খুশিমনে মাথা নাড়েন।তারপর কাকীর সাথে অনেকক্ষণ কথা হয়।কাকীকে বিদায় দিয়ে টোয়া এখনো আসে নি ভেবে তাকে কল করতে যাবো এমন সময় আকাশ কল করে।আমি রিসিভ করে হ্যালো বলতেই বললো,

” তোদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে! দরজা খোল।”

আমি আকস্মিক অবচেতন মনে খুশি হয়ে যাই।মা গতের সেই রাতে যে গেলো।আজ সাতদিন পর আসলো!আল্লাহ!ভেবেই মাথাটা হালকা ঝাঁকি দিয়ে তরহর দরজা খুলে দিই।খুলেই চেঁচিয়ে বললাম,

” আজ আসার সময় হলো তোর?কতদিন পর আসছিস বল ত?”
“চেঁচাবি নাকি ভেতরে ঢুকতে দিবি?”
আমি ধাতস্থতা হয়ে সামনে থেকে সরে দাঁড়াই।আকাশ ভেতরে ঢোকে ডাইনিং এ গিয়ে বসে।তারপর হাসি দিয়ে বললো,
“মাত্র সাতদিন পর আসলাম।”
“মাত্র!এই সাতদিন তোর মাত্র মনে হলো?”
“আচ্ছা, স্যরি বাবা স্যরি।এখন যে আসছি একেবারে একমাসের জন্যে কুমিল্লায় থেকে যাবো।”
“তোর হাসপাতাল?”
“সেটা কুমিল্লায় চলে এসেছে।”
বলেই আকাশ হেসে দেয়।

“কুমিল্লায় মানে?”
“আরেহ বোকা! একমাসের জন্যে কুমিল্লা মডার্ন হাসপাতালে শিফট হয়েছি।তাও খুব কষ্টে।কর্তৃপক্ষ ত চেয়েছিলেন দুই সপ্তাহের জন্যে দিবেন।তোর কথা ভেবেই সময়টা বাড়িয়ে নিয়েছি।”
“আচ্ছা। বেশ।তো বস এখানে।হঠাৎ যে আসলি কি খাওয়াবো তোকে…!”

“কিছু খাবো না।পেট ভরা।বাড়িতে আবার যাবো।মা অপেক্ষা করছেন!আর এই যে ধর এইটা নে….।”
বলেই আকাশ আমার দিকে ভারী একটা পাটের ব্যাগ এগিয়ে দেয়।বললাম,
“কী এটাতে?”
“আমি গেলে খুলে দেখিস।”
“য়ু-হু।এখন দেখবো। ”

বলেই তরতর ব্যাগের মুখটা খুলে ফেলি।তাকিয়ে অবাক!কিছু জাঙ্কফুড খাবার আর ফল!প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললাম,

“এসব আনার কী দরকার ছিল তোর?তোকে আমি বলেছি এসব আনতে?”
“আরেহ,এরকম করছিস কেন?আস্তে কথা বল।আশপাশের মানুষ শুনবে ত!”
“তো শুনলে?”
“তোকে পীড়া দিবে।”বলেই হাসলো আকাশ।”
“তারপরও।কেন খামোখা এতটাকা খরচা করলি!”
“এসব কী বলছিস!হু?একেবারে কানের নিচে যে দিব….!আমি তোর অপরিচিত কেউ? যে এভাবে কথা বলছিস?”

আমি মুখ গোমড়া করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।আকাশ তা ইগনোর করে শার্টের হাতা কিঞ্চিৎ উঠিয়ে বাম হাতের কালো ব্রান্ডেড ঘড়িটার দিকে বললো,

“রাত তো অনেক হয়েছে।টোয়া এখনো এলো না।কল দিয়েছিস ওকে?”

শেষ কথাটা আমার দিকে ফিরে বললো।বললাম,
“দিই নি।দিব।”
“দিই নি মানে?রাত ন’টা বাঁজতে চলেছে।তাড়াতাড়ি কল দে।তুই না দিলে আমি দিচ্ছি।”
“নাহ নাহ আমিই দিচ্ছি।”
বলেই ব্যাগটা নিচে রেখে বিছানা থেকে ফোনটা নিই।টোয়ার সাথে কথা শেষ করে ফোনটা রাখতেই আকাশ আবার বললো,

“কী বললো ও?”
“রান্না করতেছে।তাই আসতে একটু দেরী হচ্ছে। ”
“আচ্ছা,তাহলে আমি ততক্ষণে বসি।ও আসার আগ পর্যন্ত।”
বলেই আকাশ বিছানায় শরীরটা হালকা এলিয়ে দেয়।মুহূর্তে আমার ভেতরে আবেগে আপ্লুত এক অন্যরকম সুখানুভূতি হয়।খুবই অন্যরক সুখানুভূতি !এরা দুজন এত ভালো কেন?হ্যাঁ?আমার এত খেয়াল নেয়!

ভাবনার মাঝেই আকাশের দু’চোখের পাতা বুঁজে যায়।দেখেই বুঝা গেল সারাদিনের জার্নিতে আকাশ খুবই ক্লান্ত।নাকের ঢগায়,ঠোঁটের নিচের অংশে,কপালের অংশে বিন্দু বিন্দু ঘাম লেঁপে আছে।ব্যাপারটা অদ্ভুত চমৎকার।
আমি কিঞ্চিৎ হেসে ব্যাগটা নিয়ে বাইরে চলে আসি।

চলবে…..