স্বপ্নময় ভালোবাসা পর্ব-২০

0
5765

স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
পর্ব-২০

সন্ধের পর এক কাপ চা খেয়ে পড়ার টেবিলে বসি।আকাশের দেওয়া জব প্রিপারেশন বইগুলো এক এক করে হাতে নিয়ে খানিক উল্টেপাল্টে দেখতে থাকি।কিন্তু তাতে যতই চোখ যায় ততই আমার চোখ উল্টে আসে!মাথাটা পুরাই উন্মাদ!কেমন কঠিন কঠিন শব্দ লেখা।একেবারে দাঁত ভাঙ্গা অবস্থা!এর একটা অক্ষরও মাথায় ঢুকে নি!তারউপর গাদাগাদা পড়া!বিরক্ত হয়ে বইয়ের সাটার বন্ধ করে তা আবার একপাশে রেখে দিয়ে কপাল চাপড়াতে থাকি!
আচ্ছা,এই যে কিরিবিরি লেখা কিছুই বুঝতেছি না।কীভাবে শুরু করে কীভাবে পড়বো এর কোনো থিউরি মাথায় আসছে না তাহলে আমি কি খুব বোকা?একেবারেই বোকা!?

“হুম,তুই বোকা।এক কথায় হাঁদারাম।হাঁদারাম ত বুঝিস তাই না?”

কারো কন্ঠস্বর শুনে পাশ ফিরে তাঁকাই। আকাশ চোখ কুঁচকে রেখে আলমারি টা বরাবর সুঠাম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমি ওর দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতেই ও এদিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,

“কালিসাঁজে বাসা একলা একটা মেয়ে এভাবে দরজা খোলা রাখে?”
“বুঝলাম না?”
“দরজা খোলা রেখে পড়তে বসেছিস কেন?আমি দরজায় করাঘাত করতেই দরজা খুলে গেল!”
“কী দরজা খোলা ছিল?বন্ধ করিনি?”
“তা তুই ই ভালো জানিস!”

চোখমুখ কুঁচকে এনে জোরে একটা জিভ কাঁটি।ইস বেখেয়ালে আজ দরজাটাই বন্ধ করতে ভুলে গেলাম।এমন মনভোলা স্বভাব কবে যে হলো?দিনেক দিন খেয়ালি হব, তা না।উল্টো অঘামগা হচ্ছি!ভাবনার মাঝেই আকাশ আবার বললো,

“এরকম আর কখনো করবি না! ঠিক আছে?”

আমি অপরাধ ভঙ্গিতে আলতো মাথা নাড়ি।তারপর বললাম,
“আর যে বইগুলো দিলি আমার ত দাঁত ভাঙ্গা অবস্থা! কিছুই বুঝতেছি না!”
আকাশ টেবিলের সামনে থেকে একটা চেয়ার টেনে সেখানটায় বসতে বসতে বললো,
“সেজন্যেই ত আসলাম।ওপাশে বস।আর কম্পিটিটিভ বইটা দ্রুত বের কর!”

আমি সড়াৎ করে চেয়ারে ধপসে বসে যেয়ে তরহর বইটা আকাশের দিকে এগিয়ে দিই।আকাশ বইটা হাতে কিছুক্ষণ বিচক্ষণ চোখে ঘাটাঘাটি করে নিয়ে ফের আমার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় এবং শান্ত গলায় বললো,
“এত পড়া দেখে ভয় পেয়েছিস, তাই তো?”
“হু।”
“সব পড়তে হবে না।”
“কেন?”
“সবগুলো থেকে প্রশ্ন আসে না কিছু স্পেসিফিক টপিকস ছাড়া।এখন সেগুলোই তোকে দাঁগিয়ে দিব।”

এভাবে আকাশ আমায় আরো দুই তিনটা বইয়ের ইম্পর্ট্যান্ট টপিকগুলো দাঁগিয়ে দেয় আর তারসাথে সেগুলোর ব্যাসিক বুঁঝিয়ে দেয়!আমি মনস্থির এবং মনোযোগ সহকারে সবটা শুনে নিই।তবে,একসাথে সবগুলো বিষয় শুধু আমার নয়,যেকোনো বিজ্ঞ ব্যক্তিরও মাথায় লোড হবে না এটা স্বাভাবিক!তা আকাশ বুঝলো।তাই বললো,

“চাপ নিস না।আমিতো আছি।দরকার হলে লাগাতর কয়েকদিন এসে তোকে বিষয়গুলো পূর্ণ ধারাবাহিকতায় বুঝিয়ে দিয়ে যাবো।ঠিক আছে?”
আমি হেসে ফেলি।বললাম,
“তুই সত্যিই খুব ভালো রে!”

তারপর থেকে আকাশ আমায় লাগাতর সন্ধের পর সময় দিতে থাকে।দিনে আসতো কিন্তু এতে অনেকে তা খারাপ চোখে দেখবে ভেবে আকাশ রাতের বেলায়ই সতর্কতা অবলম্বন করে আসে,যাতে কেউ না দেখে।আর টোয়া ত আমার সাথে থাকেই।

আজও আসে পড়াতে।আমি আকাশকে চেয়ারে বসতে বলে কিচেনে আসি চা বানাতে।অবশ্য আকাশের জন্যে চা’টা প্রতিদিন টোয়াই বানায়।কিন্তু আজকে টোয়ার বাসা কী একটা ঝামেলা হওয়ার কারণে সে আর সন্ধে আসতে পারে নি।
তাড়াহুড়ো করে পাতিলে পানি নিয়ে তাতে চিনি মিক্সড করে চুলায় বসিয়ে দিই।এরইমাঝে একদল মহিলা-পুরুষ আমার বাসার দিকে ছুটে এসে দরজায় প্রবলভাবে করাঘাত করতে থাকে।আমি কেঁপে উঠি।বার কয়েক বুক ধরে নিঃশ্বাস নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

“ক-কে এখানে?”
“আমরা! দরজা খোল!”

আমি বার কয়েক ঢোঁক গিলি।আবারো দরজায় প্রবল জোরে ঝাঁকি পড়ে।ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,
“বললাম না?মাগি দরজা খুলবো না?ভিতরে পরপুরুষ আছে পরপুরুষ সেইজন্যে!”

কথাটা শুনামাত্র আমি আঁতকে উঠি!কন্ঠটা হাজেরা দাদীর কন্ঠের মতো লাগছে।কিন্তু হাজেরা দাদী আমাকে এসব কথা কেন বলছে?

“ওই মাইয়া দরজা খোল বলছি!নাহলে খারাপ হবে বলে দিলাম!”
আমি এবার সত্যিই ভয় পেয়ে যাই।হঠাৎ এলাকার লোকজনের এত হুলস্থূল!তবে কী উনারা আমাকে এবং আকাশকে নিয়ে সন্দেহ করেছে ব্যাপারটা এটা নয়তো?ইয়া মাবুদ!নাহ ব্যাপারটা উনারা যাই ভাবুক আমার উচিত উনাদের বুঝানোর!চুপ মেরে থাকলে,দরজা না খুললে তিলকে তৈল বানাবে।ভেবেই তরহর দরজা খুলে কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনারা ভেতরে ঢুকে পড়ে আর দ্রুতপদে ডাইনিং এ যেয়ে আকাশের সামনে দাঁড়ায়।আকাশ প্রচন্ড অবাক হয়ে যায় হঠাৎ এখানে এতগুলো মানুষের আগমণে!তবে কী জন্যে?
আকাশের মনে এমন প্রশ্নবাণের উসখুস লেগে যায়।এলাকার একজন বয়স্ক লোক বলে উঠেন,

“এই ছেলে,এই মাইয়ার সাথে তোমার আজ ক’দিন ধরে এসব চলছে?”
“মানে?”
“পরপুরুষ সাথে অন্য মাইয়া রাত কাঁটলে তাকে কি কয়? তা খুলে বলা লাগবো?”
আকাশ এবার অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়!তরহর চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে বললো,

“চাচা,আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।আমরা দু’জন বন্ধু।ওর চাকরি চলছে।তাই আমি ওকে জাস্ট বন্ধু হিসেবে কিছু পড়া দেখাতে এসছি!”
হাজেরা দাদী বলে উঠলো,
“এই ছ্যামড়া মিথ্যায় কয়!রোজ রাতে এই ছ্যামড়া এই মেয়ের কাছে আসে। আমি নিজ চোখে দেখেছি!”

আমার দু’চোখ দিয়ে টলটল পানি পড়তে থাকে।কান্না মিশ্রিত গলায় বললাম,

“নাহ, দাদী নাহ!সেরকম কিছু না।প্লিজ দাদী আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিবেন না!”
“এই মাগি,চুপ কর তুই!তাই তো বলি কারণ ছাড়া ত কারোরে এমনি এমনি কেউ দোষ দেয় না!কারণ ত অবশ্যই থাকে।ওর চরিত্রে যে দোষ আছে একজন্যে ওর আগের স্বামী ওরে তালাক দিয়েছে!”

হাজেরা দাদীর সাথে অন্যরা সবাইও একাগ্রতা প্রকাশ করে জোর আওয়াজ তুলতে থাকে।ঘটনার আকস্মিকতায় আকাশ হতবিহবল!সে কি বলে এদেরকে থামাবে নিজেই বুঝেছে না।আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে শুধুই কাঁদছি।শরগোলের মাঝে আবার আরেকজন সবাইকে হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“সবাই শুনেন,সবাই শুনেন?”

সবাই মুহূর্তে থেমে যেয়ে আগ্রহ চোখে লোকটির দিকে তাকায়।
“এরা দু’জন যেহেতু এমন কুকর্ম করে ফেলছে তাহলে এর একটা ফয়সালা করতে হবে!”
“কেমন ফয়সালা?”
“এটা আমাদের এলাকা।আমাদের এলাকার একটা ইজ্জত আছে এবং আমাদের নিজেদেরও।তাছাড়া,এর বয়সী এলাকায় আরো অনেকগুলো মেয়ে এখনো অবিবাহিত আছে!ওদেরও বিয়ে দেওয়া লাগবে।এই মেয়ে যে কাজ করছে এর জন্যে উপর্যুক্ত শাস্তি!”
“কী?”
“এদের দুজনকে বিয়ে দিয়ে এই এলাকা ছাড়া করা!যাতে ভবিষ্যৎতেও যদি কেউ আমাদের এলাকা নিয়ে কথা তুলে তখন বলতে পারবো ওরা স্বামী-স্ত্রী!”
“কেরামত সাহেব আপনার মতামতটা যুক্তিযুক্ত! একদম সঠিক একটা মতামত দিয়েছেন।আর দেরী না করে এখনই কাজী ডেকে এদের বিয়ে পড়িয়ে দাও।”

সাথে সাথে সবাই “হ্যাঁ হ্যাঁ” বলে উঠলো!
“যান এখনই কাজী ডেকে এনে এদের দুজনেকে বিয়ে পড়িয়ে দিয়ে এখান থেকে বিতাড়িত করে দেন!”

কথাটি শুনামাত্রই আমি ব্যথিত চোখে আকাশের দিকে তাকাই।আকাশ হতভম্ব চোখে আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে। দু’পাশে মাথা নেড়ে আকাশকে বলতে চেয়েছি,
“আকাশ,না!ওদের থামা!”

কিন্তু আর বলা হলো না।কিছুক্ষণ বাদেই কাজী চলে এলো।সবার যাতাকলে পড়ে বিয়েটা হয়ে গেলো!!!!

বিয়ের কাজ শেষ হওয়া মাত্রই টোয়া চলে এলো!এসেই দেখলো এই কান্ড!আমি টোয়াকে জড়িয়ে ধরে জোরে কেঁদে দিই!টোয়াও আমাকে জড়িয়ে ধরে তার মুখটা আমার কানের কাছে এনে বললো,
“এতদিনে গ্রামবাসীরা একটা ভালো কাজ করলো!যাক গ্রামবাসীদের অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

আমি মুহূর্তে টোয়ার উপর রেগে যাই।টোয়া শব্দ করে হেসে দেয়!!!

চলবে….