স্মৃতির দেয়াল পর্ব-৪০

0
2464

স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৪০
Writer -Afnan Lara
.
সূর্যের আলো চুরি করে জানালার ফাঁক দিয়ে আস্তে আস্তে গোটা বিছানাটাকে কাবু করে নিতে চাইছে
বিছানার শেষ প্রান্তে নীলের বুকটাকে আকড়ে ধরে ঘুমাচ্ছে মুন
নীল জেগে আছে,,সে মুনের পিঠ থেকে চুল সরিয়ে দিচ্ছে,কারণ রোদের আলোয় গরমের তাপ বাড়ছে আস্তে আস্তে
পিঠের উপর চুল পড়ে থাকলে গরম লাগবে বেশি
কাল রাতের অনুভূতিটা নীল কখনওই ভুলবে না
মুনকে কাল সে আপন করে নিয়েছিলো,,মুনের চোখে সুখ দেখতে পেয়ে সে যেন তার সম্পূর্ন অতীতটাকে ভুলে যেতে পেরেছে,,
এই নিয়ে তিনবার হলো ফোন বাজছে,এ সময়ে পরিবারের কেউ ফোন করবে না তা জানা আছে নীলের
তবে কে ফোন করছে তাহলে
সকাল আটটা বাজে,অফিসের কেউ তো হবে না
তাহলে কি হিয়া?
কিন্তু হিয়া কেন ফোন করবে,ওর তো ফোন করার কথা না
.
হাতটা একটু প্রসারিত করে টেবিলের উপর থেকে ফোন নিতে গিয়েই টের পেলো নীল যে মুন জেগে গেছে
নীলের বুক থেকে সরে আরেকপাশ হয়ে শুয়ে পড়েছে আবার
নীল ফোন হাতে নিয়ে দেখলো হিয়ার ছোট বোনের নাম্বার
কিছুটা অবাক হলো নীল,হিয়ার ছোট বোন ওকে এসময়ে ফোন কেন করলো
জনমে তো ওর সাথে তেমন কথা হয়নি তাহলে হঠাৎ??
ভাবতে ভাবতেই নীল রিসিভ করলো কলটা
ওপাশ থেকে হিমু কাঁদো কাঁদো গলায় বললো”নীল ভাইয়া প্লিস হসপিটালে চলে আসো,তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আপন লাগছে না”
হসপিটালের নাম বলে সে লাইনটা কেটে দিয়েছে
.
নীলের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছে,,কি এমন হলো যে হিমু হসপিটালে আসতে বললো,ওর মায়ের অসুখ না তো?
হিয়ার কিছু হয়নি তো?না ওর কেন হবে,ওর হলে তো সাকিব ফোন করতো আমায়
নীল হাত বাড়িয়ে মুনকে জাগাতে গিয়ে থমকে গেলো
কাল রাতে করা প্রমিসটা মাথায় আসলো তার
সে বলেছিল তার অতীতটা আর কখনও সামনে আনবে না
থার্ড পারসন বলে কিছু থাকবে না
কিন্তু হসপিটালে যাওয়া জরুরি,আবার মুনকে এখানে একা রেখে যাওয়াটাও ঠিক না
ওকে জানানো জরুরি
.
তাহা?
.
হু!
.
উঠো,কথা আছে
.
ঘুমাতে দিন না
.
প্লিস উঠো
.
মুন চোখ ঘষতে ঘষতে উঠে বসে বললো”আবার কি হলো?কার ফোন ছিলো,এবার বলবেন না যে অফিসে কাজ পড়ে গেছে”
.
না আসলে কলটা হিয়ার ছোট বোন হিমুর ছিলো
.
মুনের চোখমুখ থেকে যেন ঘুমটাই উড়ে গেছে,,ঠিক ঠাক হয়ে বসে সে বললো”হিয়ার জায়গায় হিমু ফোন দিলো কেন আবার?”
.
আমাকে হসপিটালে যেতে বললো,কার অসুখ,কি হয়েছে কিছুই বললো না
.
হিয়াপু কে কল করেন,বা সাকিব ভাইয়াকে
.
সাকিবকে কল করলাম ধরছে না
.
তাহলে চলুন যাই হসপিটালে,দেখে আসি
.
যাবে?
.
হুম,,কারও বিপদ হলে তো দেখতে যাওয়া উচিত,আর যেখানে ওরা আপনাকে কল করে বললো যেতে তাহলে তো ম্যাটার সিরিয়াস
বাট আমার মাথায় ঢুকছে না,সাকিব ভাইয়া থাকতে আপনাকে যেতে বললো কেন,উনার কিছু হলো না তো?
.
সেটাই বুঝছি না,আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে নাও
.
মুন চুলে খোঁপা করতে করতে ওয়াসরুমের দিকে ছুটলো,আর ভাবতে থাকলো সাকিবের কিছু হলে হিয়ার দায়িত্ব গিয়ে নীলের ঘাড়ে পড়বে
আল্লাহ!!!সব দিক রক্ষা করো তুমি
.
রিসোর্ট ছেড়ে নীল আর মুন হসপিটালে আসলো যে হসপিটালের এড্রেস হিমু দিয়েছিলো,হসপিটালের কেবিন নং খুঁজে করিডোর পর্যন্ত এসেই দেখলো হিমু আর হিয়ার মা সিটে বসে আছে
একজন আরেকজনকে ধরে কাঁদছে
.
নীল এগিয়ে এসে বললো”কি হয়েছে আন্টি?কার কি হয়েছে?হিয়া আর সাকিব কোথায়?”
.
হিয়ার মা উঠে দাঁড়িয়ে নীলকে ধরে কেঁদে ফেললেন,মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারছেন না তিনি
মুন দূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে,তার মানে সাকিব বা হিয়ার কিছু হইছে,,কিন্তু কি হয়েছে?
.
সাকিব ভেতরের রুম থেকে বেরিয়ে নীলকে দেখে চমকালো তারপর মুখটা ফ্যাকাসে করে বললো”নীল এসেছো?”
.
সাকিব?কার কি হয়েছে?
.
আসলে হিয়ার একটা প্রব্লেম দেখা দিয়েছে
.
হিয়ার কি হয়েছে?কিসের প্রব্লেম?
.
সাকিবের চোখ দিয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো,সেও কিছু বলতে পারছে না,চোখের পানি লুকাতে নীলকে পাশ কাটিয়ে সেও চলে গেলো হাতের রিপোর্টটা নিয়ে
মুন সাকিবের চলে যাওয়া দেখছে
তার মানে হিয়ার কিছু একটা হয়েছে
.
নীল দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো,,হিয়া রুমটার ছাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো বেডে শুয়ে
নীলকে দেখে মুচকি হেসে বললো”এত জলদি আসলে”
.
নীল এক পা এক পা করে এগোতে এগোতে বললো”কি হয়েছে তোমার?কেউ আমাকে কিছু বলবে?”
.
হিমু পিছনে থেকে বললো”ডাক্তার বললো আপুর ক্যান্সার”
.
নীল চোখ বড় করে হিমুর দিকে তাকালো,,বুকের ভেতর থেকে মনে হলো কি যেন চলে গেলো,খালি খালি লাগছে,নিজের অজান্তেই নীল বুকে হাত দিয়ে ফেললো,,নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়েই যাচ্ছিলো সে
হুট করে এমন সংবাদে মস্তিষ্ক কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছিলো তার
মুন নীলকে ধরে পাশেই একটা সোফায় বসালো,সে নিজেও অবাক হলো এই খবর শুনে
কান্নার কোলাহলে কেমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে
হিয়া শুধু হাসছে,যার রোগ তার মুখে হাসি
তার এই হাসি সবার কান্না আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে
সাকিব করিডোর পর্যন্ত এসে ভেতরে ঢোকার আর সাহস পেলো না
চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তার
নীল মাথায় হাত দিয়ে কাঁপছে
মুন পানি এক গ্লাস এনে বললো”নিজেকে সামলান,নাহলে সবাইকে সামলাবেন কি করে”
.
নীল কথা বলাই যেন ভুলে গেছে,,হিয়া হেসে বললো”আরে নীল এরকম কেন করছো,অসুখটা কিন্তু আমার হয়েছে,তোমার না,তাহলে তুমি কেন এরকম সিক হয়ে যাচ্ছো?মুনতাহা নীলকে এখান থেকে বাহিরে নিয়ে যাও,ওকে বলো আমি ঠিক হয়ে যাব”
.
মুন নীলের কাঁধে হাত রাখলো
নীল মাথা তুলে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে
কাল রাতে সব চাইতে সুখের অনুভূতি পেয়ে তার পরেরদিন সকালে এরকম একটা নিউজ শুনবে তা ভাবনার বাহিরে ছিলো
হিয়া মুখটা আরেকদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো”তোমরা সবাই যাও এখন,আমাকে একা থাকতে দাও,প্লিস!”
.
মুন নীলের হাত ধরে টানলো,নীল উঠে দাঁড়িয়ে রোবটের মতন হেঁটে বেরিয়ে গেলো,করিডোরেও থামলো না
সোজা হাঁটছে সে
মুনের চেখেও পানি,হিয়াকে সে দেখতে পারতো না ঠিক কিন্তু আজ এই সংবাদ শুনে তার নিজেরও খারাপ লাগছে
সব চাইতে বেশি খারাপ লাগছে নীলকে নিয়ে
যাকে সব চাইতে ভালোবাসতো মানুষটা তার এত বড় রোগের কথা জেনে ঠিক থাকা অসম্ভব ব্যাপার
নীলের চোখের সামনের হিয়ার হাসিটা ভাসছে,মনে হচ্ছে শূন্যের উপর হাঁটছে সে
হিয়ার থেকে দূরে থেকে ওকে ভুলে থাকা এক কথা ছিলো
কিন্তু ও চিরজীবনের জন্য চলে গিয়ে ভুলে থাকতে চাইবে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা
হিয়া এভাবে চলে যেতে পারে না,কিছুতেই না
.
নীল মাথায় হাত দিয়ে আবারও পড়ে যাওয়া ধরতেই মুন ওকে দরে ফেললো
কেঁদে বললো”আপনি এভাবে অচল হয়ে পড়লে কি করে হবে?”
.
তাহা আমি বাড়ি ফিরতে চাই,আমি আর এক মিনিট এখানে থাকলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবো,তুমি ক্যাব ডেকে আমাকে বাসায় নিয়ে যাও,আমি আর এখানে থাকতে পারছি না তাহা,প্লিস!
.
নীলের কথা মতন মুন ওকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসলো
সামিরের কাছ থেকে হিয়ার কথা নিপা শুনে সবাইকে জানিয়েছে
সবাই এক দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু,নীল কোনোমতে নিজের রুমে গিয়ে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো
মুনের কষ্ট হচ্ছে নীলের এই হাল দেখে,,হিয়ার এমন অবস্থা কখনওই চায়নি মুন,এরকম না হলেও হতো
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মুন চোখ মুছে চলে গেলো,,মিনিট পাঁচেক পরে হিয়ার কল আসলো নীলের ফোনে
নীল কথা বলার অবস্থায় নেই,তাও কলটা রিসিভ করলো সে
ওপাশ থেকে হিয়ার মলিন আওয়াজ ভেসে আসলো
হিয়া বললো”নীল?তুমি যে এমন বিহেভ করছো মুনতাহা কি ভাবছে বলোতো?নিজেকে ঠিক রাখো,আমি সাকিবকে সামলাবো নাকি তোমায়??তুমি অন্তত নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করো নীল,আমার শরীর খারাপের দিকে যাচ্ছে এর মাঝে এখন এক এক করে সবাইকে শান্ত্বনা দিতে হচ্ছে
আসলে জানো নীল! অসুখটা আমাকে আরও আগেই চেপে ধরেছিলো
ভেবেছুলাম নিয়ম করে খাওয়া দাওয়া করিনা বলে সিকনেস বেড়ে যাচ্ছে,কাল তো মাথা ঘুরেই পরে গিয়েছিলাম,পরে হসপিটালে এসে জানলাম আমার সঙ্গী এখন একটা মরণব্যাধি
কিন্তু নীল,তুমি তো বলো আমি অনেক স্ট্রং
তাহলে?আমি ঠিক এই অসুখ থেকে সেরে উঠবো দেখো!ভরসা রাখো,আমাকে কথা দাও তুমি নিজেকে নরমাল রাখবে,কারণ এখন মুন ও তোমার সাথে জড়িয়ে আছে
আমি চাই না আমার কারণে তোমাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হোক,ধরে নাও আমার ইচ্ছা এটা,আমার ইচ্ছার মান রাখবে না নীল?
কি হলে কিছু বলছো না যে?
.
নীল নিঃশব্দে লাইনটা কেটে দিলো,,এরপর উচ্চস্বরে মুনকে ডাকলো দুবার
মুন যেন ওর ডাকার অপেক্ষায় ছিলো,এক ছুটে চলে আসলো সে
নিচু হয়ে নীলের পাশে বসে নীলের হাতে হাত রেখে বললো”কি হয়েছে?পানি খাবেন??শরীর খারাপ করছে?মা বললো আপনার হাই প্রেসার”
.
হু
.
প্রেসার মাপবেন?
.
নাহ
.
না বলেই নীল মুনের কোলে মাথা রেখে গুটিশুটি দিয়ে শুয়ে পড়লো
মুন চমকে গেলো ওর এমন কাজে,ওর মাথায় হাত রেখে বললো”সব ঠিক হয়ে যাবে”
.
তাহা বিশ্বাস করো,আমি ওকে ভুলে গিয়েছিলাম অলমোস্ট
কিন্তু ওর রোগের কথা শুনে আমার কি হলো বুঝলাম না
মনে হচ্ছে সব খালি খালি লাগছে
.
আমিও মানতে পারলাম না বিষয়টা,,হুট করে এমন দিন দেখতে হবে আমাদের কারোরই জানা ছিলো না সেটা
হিয়া আপুর সাথে পরিচয় অল্প কয়েকদিনের,কিন্তু তাও আমার মনে হলো আমার নিজের বোনের সাথে এমনটা হয়েছে,,আমারও অনেক খারাপ লাগছে
আচ্ছা ক্যান্সার থেকে কি সেরে ওঠা যায় না?
.
সেটা হলে এটাকে মরণব্যাধি বলা হতো না
.
হিয়া আপির কাছে যাবেন?কথা বলবেন না?
.
ও আমাকে বলে দিয়েছে এখন যেন ওর সামনে না যাই
আসলে ও এতকিছুর মাঝে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করছে,আমিও চাই না ওর সামনে যেতে,আমার কষ্ট হচ্ছে অনেক,দূরে থেকেই কষ্টটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছি,,আগে নিজেকে সামলাই তারপর নাহয় যাব সাকিবকে ঠিক করতে
না জানি ওর কি হাল হচ্ছে
.
হুম দেখলাম তো উনার মুখের অবস্থা,,হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেলো,হিয়া আপুর সাথেই কেন এমনটা হতে গেলো
.
নীল মুনের আঁচল দিয়ে মুখটা লুকিয়ে চুপ করে থাকলো,,আর কিছু বললো না
মুন নীলের চুলে হাত ডুবিয়ে বারান্দার দিকে চেয়ে ভাবলো আজ সাকিব যে পরিস্থিতি দিয়ে যাচ্ছে,হিয়ার সাথে নীলের বিয়ে হলে হয়ত নীলের ও এমন হাল হতোত
অবশ্য বিয়ে না হয়েও কি হলো,নীল ঠিক একই কষ্ট পাচ্ছে যতটা সাকিব ভাইয়া পাচ্ছেন,,বরং আরেকটু বেশি কষ্ট পাচ্ছেন নীল
হিয়া আপুর মনের অবস্থাও তো খারাপ,,সাকিব ভাইয়াকে এ কদিন হলো মেনে নিলেন আর এখনই এমন দূর্দিন তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো
কাল রাতটা আমার আর নীলের জন্য অনেক স্মরণীয় একটা রাত ছিলো,ভেবেছিলাম আজকে আরও ভালো দিন কাটাবো,খুশি হয়েছিলাম নীল যখন বলেছিলো সে তার অতীতকে ভুলে গিয়েছে
কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এ কেমন পথে দাঁড়িয়ে আছি আমি,এখন আমি নিজেই নীলকে বাধ্য করছি তার অতীতকে আগলে রাখতে
আমিও চাই হিয়া আপু বেঁচে থাকুক,কিন্তু আমার চাওয়া না চাওয়াতে কিছু যায় আসবে না
চলবে♥