#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১২
পাত্র পক্ষের সামনে গিয়ে আমার প্রথমেই চোখ গেল পাত্রের দিকে। পাত্রকে দেখে আমি ভেবেই নিয়েছি এ জায়গায় আমার বিয়ে হবে না। কারণ পাত্র দেখতে অনেক সুন্দর ছিল। আর এত সুন্দর ছেলে আমাকে বিয়ে করবে সেটা সম্ভব না। শরবতটা টেবিলে রেখে আমি পাশেই দাঁড়ালাম। পাত্রের পাশে থাকা মহিলাটা আমাকে বলল-
– তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? এখানে বসো।
আমি মহিলার কথা শুনে আমার পাশেই খালি সোফাটায় বসলাম। আমি বসার পর ভদ্র মহিলাটা আমাকে ভালো করে দেখে জিজ্ঞেস করল-
– তোমার নাম কি?
– সাবিহা জান্নাত নিরা।
– তোমার ভাইবোন কয়জন?
– আমি একাই।
– তোমার বাবা কি করে?
– ছোটখাটো ব্যবস্যা করে।
– তেমার চাচা ফুফুরা কতজন?
– দুই চাচা,এক ফুপি।
– চাচা বড় নাকি ফুপি বড়?
– আমার চাচা বড় ফুপি ছোট।
– তোমার মামা খালারা কতজন?
মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলাম উনার এরকম প্রশ্নে। মনে হচ্ছে আমার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়বে এ মহিলা।আমি বিরক্তিটা ভিতরে ভিতরে রেখে বললাম-
– মামা সবার বড় তারপর আমার মা তারপর আমার ছোট খালা।
– কিসে পড়তেছ?
– সাইকোলজিতে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি.।
– ঘরের সব কাজ পার?
– হ্যাঁ।
– রান্না পার?
– হ্যাঁ।
তারপর ভদ্র মহিলা আমার বাবাকে বললেন-
– আমার যা জানার জেনে নিয়েছি। একটু ছেলে মেয়েকে আলাদা করে কথা বলতে দিন।
আমার বাবা হাসতে হাসতে বলল-
– হ্যাঁ তা তো অবশ্যই।
তারপর আমাকে আর আগত পাত্রকে একটা রুমে নেওয়া হলো। আর আমি মনে মনে অপমানিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে প্রথম বলল-
– এত পড়াশুনা করে বসে আছেন যে, চাকুরি করবেন না।
আমি মাথা নীচু করে ছেলেকে জবাব দিলাম
– সত্যি বলতে ঐরকম মনমতো চাকুরি গায়ের রঙ এর জন্য পাই নি।
– ভবিষ্যতে কি করার ইচ্ছা আছে?
বিনয়ের সুরে উত্তর দিলাম
– আপাতত বিয়ে হলে মন দিয়ে সংসার করার ইচ্ছা আছে।আর চাকুরি হলে পাশাপাশি চাকুরি করব।
এরপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে পাত্র আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
– আপনার পা টা কি দেখা যাবে।যদি কিছু মনে না করেন?
– কেন দেখানো যাবে না অবশ্যই দেখানো যাবে।ভাবছেন আমি আরও কালো? (হাসতে হাসতে)
মাথা নীচু করে পাত্র বললেন
– নাহ মানে ঠিক তা না। মুরব্বিদের কাছে শুনেছি মেয়ে দেখতে গেলে পা দেখতে হয় তাই আর কী। আপনি না দেখাতে চাইলে সমস্যা নেই।
আমি লোকটার কথা শুনে একটু জোরেই হাসি দিয়ে ফেললাম।আর লোকটা আমার হাসি শুনে বেশ লজ্জা পেয়ে জিজ্ঞেস করল-
– আমি কি ভুল কিছু বলেছি? আমার নানীমা আসার সময় আমাকে একথা বলে দিয়েছে তাই আপনাকে বলা।
আমি হাসতে হাসতে আমার পা দুখানি বের করে লোকটার সামনে গিয়ে বললাম-
– এই যে আমার পা। আমার পা ও মুখের মত কালো।
মুখে কোন ঘষা মাজা করি নি। পা আর মুখ এক ররম ভালো করে মিলিয়ে নিন।
আগত পাত্র মুখটা গোমড়া করে জবাব দিলেন
-হুম আপনি একটু কালোই।
পাত্রের মুখ দেখেই বুঝে ফেলেছিলাম পাত্রের আমাকে পছন্দ হয় নি। তাই চুপ করে বসে রইলাম।ইতিমধ্যে পাত্র বের হয়ে ড্রইং রুমে চলে গেল।
এরপর তারা কোন মতামত না জানিয়েই চলে গেল।আজকের ছেলেটাকে আমার মনে মনে অনেক পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু আমি জানি এ বিয়েটাও ভেঙ্গে যাবে।চুপচাপ শাড়ি না খুলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম মনে মনে ভাবতে লাগলাম আকাশের মত বিশাল কী কারও মন হতে পারে না। কেউ কী এমন নেই যে, আমার চেহারা না দেখে মন দেখবে। একটু মুচকি হেসে মনে মনে বললাম এমন মানুষ দুনিয়াতে হয়তো নেই। থাকলেও সে মানুষটার সাথে আমার দেখা মিলবে না। আকাশের বিশালতায় মাঝে মাঝে হারিয়ে যেতে মন চায়। বিশাল আকাশটা যেমন শূন্যতায় ভুগছে তেমনি আমার মনের আকাশটা এত বিশাল হওয়ার পরও ধুুধু মরভূমির মত খাঁ খাঁ করছে। নিজের গায়ের রঙ নিয়ে কত যে অপমানতি হয়েছি সেটা ভেবে যাচ্ছিলাম। আর মনের অজান্তেই কখন যে কেঁদে ফেললাম খেয়াল নেই।
পরক্ষণেই আমার মা হাঁপাতে হাঁপাতে আমার রুমে আসলো। কান্নার ব্যপারটা আড়াল করার জন্য আমি মাকে দেখেই আমার চোখের জল মুছে ফেললাম।হাঁপাতে হাঁপাতে আমার রুমে এসেই আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম মা কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু বারবার মায়ের মুখে কথাটা আটকে যাচ্ছে। আমি মায়ের বাহু দুটো ধরে মাকে বললাম-
– কী হয়েছে মা? পানি দিব খেতে?
মা কথা বলতে পারছিল না। হাত দিয়ে শুধু ইশারা করে না করল যে পানি লাগবে না। আমি মাকে ধরে বললাম-
– কী হয়েছে বলবে তো?
মা দম নিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিল কতক্ষণ তারপর বলল-
– তোর যে সম্বন্ধ এসেছিল…
মায়ের কথাটা কেড়ে নিয়ে বললাম-
– ভেঙ্গে গিয়েছে তাই তো। কতবার বলেছি মা। এসব ছেলেরা আমাকে পছন্দ করবে না। শুধু শুধু এমন করো।
উচ্চ স্বরে মা বলল-
– আরে তুই চুপ করবি আমাকে বলতে দে।
– কী বলবে বলো।
মা আমার হাতটা ধরে বলল-
– ওদের নাকি তোকে খুব পছন্দ হয়েছে। ছেলেও নাকি বিয়ে করতে রাজি।
মায়ের কথাটা শুনে মিনিট খানিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম।মুহুর্তের মধ্যে কোন জগতে চলে গিয়েছিলাম জানি না।কথায় আছে
“অতি আবেগে মানুষ একদম স্তবির হয়ে যায়। সেই স্তবিরতা মানুষকে কিছুক্ষণ স্থির করে রাখে। পরক্ষণে আবার অস্থির করে তুলে তখন সে উচ্ছাসে ভেঙ্গে পড়ে”
আমিও অতি আবেগে স্তবির হয়ে গয়েছিলাম। যখন আমার স্তবিরতা কেটে গেল আমিও অস্থির হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে সজোরে একটা কান্না করে উচ্ছাস প্রকাশ করলাম। মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম-
– তুমি কী মশকরা করতেছ নাকি? এত সুন্দর ছেলে পছন্দ করেছে মানতে পারছি না।
– তোর সাথে কী আমার মশকরার সম্পর্ক নাকি যে মশকরা করব।সত্যিই একটু আগে পাত্র পক্ষ তোর বাবাকে ফোন দিল।তোর বাবা কল টা পেয়ে আমাকে বলল-
– কি গো নিরার মা কলটা কি ধরব? আমার তো মনে হচ্ছে না নিরাকে তারা পছন্দ করেছে। কলটা ধরে না শব্দটা শুনতে ইচ্ছা করছে না। তুমি কি বলো কলটা ধরব?
আমিও হতাশ গলায় বললাম-
– আমারও মনে হয় না এত সুন্দর ছেলের জন্য তারা নিরাকে পছন্দ করবে। কিন্তু ভদ্রতা বলেও একটা কথা আছে । তুমি কলটা ধরে ভালো মন্দ বলে রেখে দাও।
তোর বাবা আমার কথা শুনে কলটা ধরল। কলটা ধরে কথা বলার পর তোর বাবা কলটা কেটে কাঁদতে লাগল।আমি তো ভেবেছিলার তারা না করে দিয়েছে, তাই তোর বাবা কাঁদতেছে। তাই তোর বাবাকে শাত্ত্বণা দেওয়ার জন্য তোর বাবার কাছে গিয় বললাম-
– যা হবার তা তো হয়েছে তা নিয়ে এত কান্না করার কিছু নেই।নিরার কপালে যা আছে তাই হবে।।কেউ না কেউ নিরাকে পছন্দ করবে দেখো। তুমি মন খারাপ করো না।
তোর বাবা আমার হাতটা ধরে বলল-
– জানো রাবেয়া আজকের কান্নাটা কষ্টের না। আজকের কান্নাটা সুখের। আমাদের নিরাকে পাত্র পক্ষ পছন্দ করেছে।
তোর বাবা যখন একথা বলল আমিও ঠিক কি করব, খুশিতে বুঝে উঠতে পারি নি।দৌঁড়ে তোর রুমে আসলাম-
এ বলে মা আমাকে জড়িয়ে ধরে পুনরায় বলল-
– আল্লাহ তোর একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছে এতটা খুশি লাগছে বলার ভাষা নাইরে নিরা।
এ বলে মা চলে গেল। আমি আকাশের দিকে তাকালাম আবার। তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম তাহলে কি সে ছেলেটার সন্ধান আমি পেয়েছি। নাকি আমি কোন দিবাস্বপ্ন দেখছি। দেখিতো হাতে একটু চিমটি কেটে। এ বলে নিজের হাতে নিজে চিমটি কাটলাম আর আঃ! করে উঠলাম। নাহ সত্যিই তো ঘটনা। তাহলে কি আমার স্বপ্নের পুরুষকে আমি পেতে যাচ্ছি। ভেবেই যেন গায়ে ভালোলাগার শিহরণ দিয়ে উঠল। দিন পেরিয়ে রাত হয়ে গেল। আর আমার চোখে শুধু যেদিকে তাকাচ্ছিলাম উানাকেই দেখছিলাম। সারারাত না ঘুমাতে ঘুমাতে সকালে হালকা ঘুম হলো। কিন্তু সকালে মায়ের চেঁচামেঁচিতে ভয় পেয়ে ঘুম থেকে উঠি। মা যেভাবে চেঁচাচ্ছিল মনে হচ্ছে কিনা কি হয়েছে। আমার মনে হলো তাহলে কি আমার বিয়ে ভেঙে গেল আর এজন্য কী মা চেঁচাচ্ছে?
চলবে।