#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৩
আমি বুঝে উঠার আগেই বাবা আমার রুমে এসে জোরে জোরে কেঁদে বলল-
– ওরা কালকে তোকে আংটি পড়িয়ে দিয়ে যাবে। তোকে নাকি ওদের অনেক পছন্দ হয়েছে তাই বিয়ের কাজ দেড়ি করতে চায় না। অবশেষে আমার মেয়েটাও শ্বশুড় বাড়ি যাবে।
বাবার কথা শুনে বিশ্বাসেই করতে পারছিলাম না যে, কেউ আমাকে বিয়ে করার জন্য এত তারাহুরা করছে।আমি কোন কথা বলতে পারছিলাম না। বাবার মত আমিও কাঁদতে লাগলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল-
– থাক মা কাঁদিস না। আমি যাই বাজার সদাই করতে হবে। কালকে তোকে আংটি পড়িয়ে যাবে। একটু ভালো মন্দ তো ওদের খাওয়াতে হবে। মা রে এতদিন বিয়ের জন্য শুধু মন খারাপ হত এটা ভেবে যে, কবে তোর বিয়ে হবে। আজকে মন খারাপ হচ্ছে এটা ভেবে যে তুই আমাদের ছেড়ে চলে গেলে এ ঘরটা যে শূন্য হয়ে যাবে মা।
এ বলে বাবা হুহু করে কেঁদে দিল। বাবার কথা শুনে বাবাকে ছেড়ে থাকতে হবে এটা মনে করে আমিও হুহু করে কাঁদতে লাগলাম। বাবা আমার চোখ মুছতে মুছতে বলল-
– তুই থাক। আমি বাজারে গেলাম। তোর কিছু লাগলে বল।
– না বাবা কিছু লাগবে না। তুমি তোমার মত করে যা ইচ্ছা নিয়ে আসো।
বাবা পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে বলল-
– এ টাকা কয়টা দিয়ে একটা ভালো শাড়ি কিনিস। ওদের সামনে গেলে তো একটু গুছিয়ে যেতে হবে।আমার মা টা কে পরীর মত লাগতে হবে।
আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললাম-
– নাহ বাবা তোমার মেয়ে কালো, পরী কেন হবে তোমার মেয়ে তো পেত্নী।
বাবা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল
– তুই জন্ম নেওয়ার পর থেকে আমি তোর গায়ের রঙ নিয়ে কখনো অসন্তোষ প্রকাশ করি নি । আমার কাছে তুই সবসময় পরীর মত সুন্দরী ছিলি এখনো আছিস।তুই যে আমার রাজকন্যা মা।
আমি বাবার কথা শুনে হেসে দিলাম। সত্যি বলতে একমাত্র এ লোকটা আমাকে কোনোদিন গায়ের রঙ নিয়ে কিছু বলে নি। এ লোকটা সবসময় আমাকে ভালোবাসার চাঁদরে ঢেকে রেখেছে। আমি বাবাকে হাসি মুখে বললাম-
– রাজা সাহেব এবার আপনি বাজারে যান। নাহয় আপনার রানীসাহেবা যদি দেখে এখনো আমার সাথে বসে আছেন বাড়ি মাথায় করে তুলবে চিল্লাতে চিল্লাতে।
– আমি গেলাম তাহলে।
বলেই বাবা হাসতে হাসতে বের হয়ে গেল। আর আমি আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী তোরাকে কল দিয়ে আসতে বললাম। তোরার বিয়ে হয়েছে দুই বছর আগে।ওর স্বামী প্রবাসে থাকে। তোরাও স্বামীর সাথেই থাকত।তবে কিছুদিনের জন্য দেশে একাই ঘুরতে এসেছে।কারণ ভাইয়া ছুটি পাই নি। কল দিয়ে খবরটা বলার পর তোরা বলল-
– অবশেষে আমার বান্ধবীর বিয়ে হচ্ছে।সবসময় দোআ করতাম তুই যেন একটা ভালো বর পাস।আমি দুপুরেই আসতেছি।কি যে খুশি লাগছে নিরু।
তোরার খুশি দেখে হাসতে হাসতে বললাম
– আরে হয়েছে হয়েছে এত খুশি হতে হবে না।এত খুশি হলে খুশির চুটে অক্কা পাবি।তাড়াতাড়ি আয় তোকে নিয়ে শাড়ি কিনতে যাব।
এ বলে কলটা কেটে বসে বসে তুর্জের কথা ভাবতে লাগলাম।এর মধ্যে মা ডাক দিতে লাগল-
-নিরা কই তুই?হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে আয়।খাবার নিয়ে বসে আছি।তোর খাওয়া শেষ হলে বাকি কাজ করব।
মায়ের ডাক পেয়ে আমি ওয়াশরুমে হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে খেতে বসলাম।মা আমাকে পরোটা দিয়ে বলল-
– এগুলা সব সবজি দিয়ে খাবি। এ কয়দিন সবজি খাবি তাহলে স্কিন সুন্দর হবে। দেখতে সুন্দর লাগবে।
অট্ট হেসে বললাম
– কি যে বলো না মা। যে কালো তাকে ঝামা দিয়ে ঘষলেও ফর্সা হবে না।এটা ফেয়ার এন্ড লাভলির এড না যে সাতদিন মেখে ফর্সা হয়ে যাব।
বিরক্ত গলায় মা জবাব দিল
– তুই এত কথা বলিস কেন?খেতে বলেছি খা।
মায়ের বিরক্ত মুখটা দেখে হালকা হেসে বললাম
– খাচ্ছিতো। মা দুপুরদিকে তোরা আসবে। বাবা আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে শাড়ি কিনার জন্য।ও আসলে দুপুরের দিকে বের হব।
মা রাগী গলায় বলল-
– বের হওয়ার কি আর সময় পেলি না।এ ভর দুপুরে বের হলে এমনেই কালো আরও কালো হয়ে যাবি।দুপুরে বের হওয়ার কোন দরকার নেই।
-তুমি পারও বটে।এত রাগ দেখাতে হবে না।তোরা আসলে বিকেলে বের হব এবার ঠিক আছে।আজকে তুমি একটু বেশিই আল্লাদ আর বকবক করছো।
মা আমার বিলাপ জুড়ে দিয়ে বলল
– আমি যাই করি তা শুনেই তো তোর গায়ে লাগে।আমার কথা তো তোর ভালো লাগে না।
জন্মের পর থেকে মায়ের এ বিলাপ শুনে বড় হয়েছি।বাবা তো মনে হয় বিয়ের পর থেকেই শুনেছে। আমি মাকে কিছু বলতো যাব এমন সময় কলিং বেল এর আওয়াজ আসলো কানে। মা দৌঁড়ে দরজা খুলল।দরজা খুলার সাথে সাথ তোরা কথা শুনতে পেলাম।তোরার কথা শুনে আমি দৌঁড়ে গিয়ে তোরাকে জড়িয়ে ধরে বললাম-
– তোর না দুপুরে আসার কথা।এত তাড়তাড়ি চলে আসলি যে।
– তাড়াতাড়ি চলে এসে সমস্যায় ফেলে দিলাম মনে হয়।
– আরে ধুর কি যে বলিস না।তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
-তোর বিয়ের কথা শুনে আমার ঘরে আর মন টিকল না।তাই চলে আসলাম
পাশ থেকে মা বলে উঠল-
– এসেছিস ভালো করেছিস।এখন বিয়ের আগ পর্যন্ত থেকে যাবি।
তোরা তার হাতটা পেটে ধরে মাকে বলল
– আন্টি আগে আমাকে কিছু খেতে দাও।তোমার হাতের রান্না খাব বলে না খেয়েই চলে এসেছি।
– এই দেখ তোকে খেতে না দিয়েই বকবক করছি।তাড়াতাড়ি আয় পরোটা আছে খেয়ে নে।
তারপর তোরার নাস্তা শেষে দুজন রুমে গিয়ে শুয়ে দুনিয়ার যত আজাইরা গল্প আছে করতে লাগলাম।কথায় আছে
“দুজন মেয়ে মানুষ যদি এক হয় আর তারা যদি বেস্ট ফ্রেন্ড হয়।তাহলে তাদের কথা কোন সুস্থ মানুষ শুনলেও পাগল হয়ে যাবে।”
আমাদের অবস্থাও ঠিক এমন কত কি যে বলছি হিসাব নেই। মোটকথা মুখের নিস্তার নেই। কখন যে সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেল সেই হিসাব নেই। মায়ের ডাকে আমাদের আড্ডার ঘোর কাটল। মা ডাকতে ডাকতে বলল-
– কিরে আর কত কথা বলবি?এদিকে যে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে সে খেয়াল আছে নাকি।কখন খাবি কখন শপিংয়ে যাবি ।
মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে বললাম
– আসছি মা। চিন্তা করো না। চটপট খাওয়া শেষ করে চলে যাব।
তারপর আমি আর তোরা খওয়া শেষ করে শপিং গেলাম। মার্কেট ঘেটে একটা লাল শাড়ি কিনলাম। তবে আমার চোখ,মন পড়েছিল কালো শাড়িতে। জন্মের পর থেকে কালো হওয়ার জন্য কালো কিছু কখনও পড়তে পারি নি।
যাইহোক টুকিটাকি আরও কিছু জিনিস কিনে বাসায় ফিরলাম দুজন। তোরা যেতে চাইলেও তোরাকে জোর করে রেখে দিলাম। সারারাত রাত তোরার সাথে কথা বলতে বলতে পার করলাম। সকালে উঠেই টানা দুই ঘন্টা তোরা আর মা মিলে আমার উপর রুপচর্চার যত টিপস আছে সব প্রয়োগ করল। একটু পরেই পাত্র পক্ষ আসবে আমাকে আংকটি পড়াতে। ভেবেই যেন আমি আনমনা হয়ে গেলাম। তোরা আমার আনমনা হতে দেখে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল-
– কিরে এখনেই এ হাল বিয়ের পর কী করবি কি জানি।
-আরে কী যে বলিস না।
এ বলে বেশ লজ্জা পাচ্ছিলাম তোরা আমার লজ্জা মাখা মুখ দেখে বলল-
– আরে আরে আমার বান্ধবী দেখা যায় লজ্জাও পায়।
– থামবি তুই।
– আচ্ছা থেমে গেলাম।
এ বলে তোরা হুট করে নাক শুকে একটা টান দিয়ে বলল
– ও আন্টি মনে হয় মেজবানি রান্না করতেছে। কি সুঘ্রাণ বের হচ্ছে।আজকে তো আমি কব্জি ডুবিয়ে খাব।আমি যাই আন্টিকে একটু সাহায্য করি।
এবলে তোরা মাকে সাহায্য করতে চলে গেল।আর আমি এদিকে আনমনা হয়ে তার কথা ভাবতে লাগলাম। তাকে ভাবতে ভাবতে ভাবনার জগৎ এ হারিয়ে গেলাম।হঠাৎ তোরার আচমকা আওয়াজে ভয়ে ওওও… করে উঠলাম।বুকে থুথু দিয়ে বললাম-
– কি হয়েছে এভাবে চেঁচিয়ে উঠলি কেন?
তোরা মাথা নাড়তে নাড়তে রহস্যময় মুখ করে বলল-
– তোর নায়ক তো এসে পড়েছে।
একথাটা শুনে যে কি ভালো লাগছে বলে বুঝাতে পারব না।বিয়ের আগে যে মেয়েরা এত আনমনা হয়ে যায় নিজেকে না দেখলে বুঝতাম না।আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম।
এমন সময় মা এসে তোরাকে বলল-
– তোরা… নিরাকে পাঠা, ওদের সামনে যেতে হবে।
তোরা আমার হাতে একটা শরবরতের ট্রে ধরিয়ে বলল
– যা এ শরবত দিয়ে জাদু করে আয়।
– -তুই আমার সাথে চল।
– না রে নিরু এক মেয়েকে দেখতে আসলে অন্য মেয়েদের যেতে নেই, মুরব্বিরা না করে তুই একাই যা।
আমি কোন কথা না বলে শরবতের ট্রে টা হাতে নিয়ে পাত্র পক্ষের সামনে গেলাম।
পাত্র পক্ষের সামনে গিয়ে প্রথমেই আমার….
চলবে