#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
দশম পর্ব
বাবা মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছে। আমি বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বাবা বুঝেছে আমি কিছু বলতে চাই।
“কি বলবে, মামুনি?”
“বাবা, আসলে…”
এক পায়ের আঙ্গুল দিয়ে আরেক পায়ের আঙ্গুল সমানে খুঁ°চিয়ে যাচ্ছি। আপু বাবার হাতে শরবতের গ্লাস দিয়ে বলল,
“ভণিতা করতেছে৷ পরীক্ষা শেষ, এখন বলবে আমি ঘুরতে যাবো। এখানো যাবো, ওখানে যাবো। আর কি?”
“তানিমা।”
বাবা একটু ক°ড়া ভাষায় আপুর নাম নিতেই আপু চুপ করে গেল। আমার দিকে তাকালে আমি বললাম,
“আমি ঘুরতে যাবো।”
আপু ঘাড় নে°ড়ে বলল,
“বলেছিলাম আমি।”
আপুর কথায় বাবা তেমন গুরুত্ব না দিয়ে বলল,
“যাবে, ভালো কথা। আজকের পরীক্ষা কেমন হলো?”
“খুব ভালো।”
“তা কোথায় যেতে যাও? আমার তো ছুটি হবে না।”
“অয়ন ভাই নিয়ে যাবে। এদিক সেদিনই।”
আপু কাশতে কাশতে চলে গেল। বাবা সেদিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“এদিক সেদিক মানে?”
“মানে ঢাকার আশেপাশেই, সাথে মানহা যাবে আর মানহার আন্টি যাবে।”
“তানিমাকেও নিয়ে যাবা।”
মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
“আপু?”
“হ্যাঁ, তানিমাও যাবে তোমাদের সাথে৷ তানিমারও তো সেমিস্টার শেষ হলো, তো সেও যেতে পারে।”
আপু দরজার কাছে এসে বলল,
“অবশ্যই যেতে পারি।”
অ°গ°ত্যা রাজি হলাম,
“ওকে।”
কালকে আমরা যাবো, এখন ব্যাগ গুছাবো। যেহেতু ঘুরাঘুরির ব্যাপার তাই কিছু খরচ তো আছেই। বাবাকে এসব বুঝিয়ে দুইহাজার টাকা নিয়ে রুমে আসলাম।
আপ্লুত হয়ে অয়নকে কল দিলাম, কিন্তু নাম্বার বিজি দেখাচ্ছে। আপু হনহনিয়ে এসে বলে,
“অয়ন ভাইয়ের সাথে কোথায় যাবি?”
“বললামই তো আশেপাশে।”
“আশেপাশে মানে কোথায়?”
বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে বললাম,
“ডিস্টার্ব করো না, ঘুমাবো।”
আপু খোঁ°চা দিয়ে বলে,
“এখন কিসের ঘুম? বল না কোথায় যাবি?”
চোখ খুলে হাতের উপর ভর দিয়ে উঠে বললাম,
“সিলেট।”
“সি..” বলে চেঁচিয়ে উঠতেই আপুর মুখ চেপে ধরলাম। আপু আমার হাত সরিয়ে বলল,
“আব্বুকে এতোবড় মিথ্যা কথা কেমনে বলতে পারলি?”
আমি সরে বসে বললাম,
“যা বলেছি, বলে ফেলেছি। এখন তুমি চুপ থাকবা।”
“না থাকলে?”
চুলগুলো খোঁপা করতে করতে বললাম,
“দেখো, সিলেট ঘুরাঘুরি শুধু আমার না তোমারও হবে। বলে দিলে আমিও যাবো না আর তুমিও না। সো, এখন ভেবে দেখো।”
মোটামুটি আপুর ব্রেইন ও°য়াশের জন্য এইটুকু যথেষ্ট। সে রাজি হয়ে গেল।
আপু হয়তো কিছু বলতো কিন্তু আমার ফোন বেজে উঠায় চুপ করে গেল। আমার আগেই ছোঁ মে°রে ফোনটা নিয়ে বলল,
“অয়ন ভাই কল করেছে।”
“দাও, আমিই কল দিয়েছিলাম। তখন রিসিভ করেনি তাই এখন কল দিয়েছে।”
আপু ফোনটা দিতে দিতে বলল,
“তুমিই বেশি খারাপ, ফা°জি°ল মাইয়া।”
ফোন রিসিভ করে বারান্দায় চলে গেলাম। দরজা চাপিয়ে বললাম,
“বলো।”
“কল তো তুই দিয়েছিলি?”
“হ্যাঁ, কেন যে দিয়েছিলাম তা তো ভুলে গেছি।”
“মানে?”
“ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়ছে। আব্বুকে বলেছি, আব্বু রাজি আছে। আমাকে যেতে বলেছে কিন্তু সাথে আবার আপুকেও জুড়ে দিয়েছে।”
অয়ন শব্দ করে হেসে বলল,
“আমি জানি।”
“কিভাবে জানলে? কে বলল?”
“আংকেল বলেছে, কল করেছিলাম।”
“কোথায় যাচ্ছি বলেছো?”
“হ্যাঁ।”
অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
“কিছু বলেনি?”
“না।”
“সত্যি?”
“হুম, আচ্ছা এখন রাখছি। তুই রেডি থাকিস।”
রাতটুকু খুব এক্সাইটেড ছিলাম, ঘুমই হয়নি বলা যায়। সকালে উঠে নাস্তা না করেই রেডি হয়ে নিলাম। হালকা বেগুনী তাঁতের শাড়ি পড়লাম। শাড়ি পড়েই কেন যেতে হবে, আম্মুর এমন একটা অবজেকশন থাকলেও একটু বুঝানোতেই রাজি হলো।
সেজেগুজে বাসা থেকে বেরিয়েই চরম একটা ধা°ক্কা খেলাম। কারণ অয়ন অকপটে জানিয়ে দিয়েছে আমরা সিলেট যাচ্ছি না। আমরা কুমিল্লা যাচ্ছি।
তানিমা আপু আর মানহা হেসে কু°টি°কু°টি হচ্ছে। হা হা হো হো করা এমন হাসিতে আমার গা জ্ব°লছে।
অয়নের সাথে রাগ দেখিয়ে বললাম,
“আমি কোথাও যাচ্ছি না। তোমরা গেলে যাও।”
অয়ন আপুকে বলল,
“তানিমা তুই চল আমরা ঘুরে আসি।”
“ওকে, ভাইয়া।”
অয়ন বাইকে উঠতেই তানিমা আপুকে ধা°ক্কা দিয়ে আমি গিয়ে উঠে পড়লাম। সোজাসাপটা ওদেরকে বললাম,
“বাসায় চলে যাও।”
আমরা ফিরে আসা পর্যন্ত আপু মানহার বাসায় থাকবে। আব্বু-আম্মু জানবে না আমি আর অয়ন একা ঘুরতে গিয়েছি।
এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আপু ও মানহা বিদায় নিলো। আমরাও চললাম আমাদের গন্তব্যে।
মেঘনা টোল পেরিয়ে ব্রিজে উঠতেই আমার মনের রঙিন পিঞ্জরের দুষ্টু পাখিটা উড়াল দিলো। মনের সুখে গান ধরলাম,
“সুরে সুরে গুণগুণিয়ে কত কথা যায় শুনিয়ে
চুপটি করে দখিনা বাতাস,
নীল রঙেরই শাড়ি অপরূপ আজ সেজেছে
দেখোনা ওই নীল আকাশ।
যা দেখি লাগে ভালো,
স্বপ্ন আজ মেলেছে ডানা।
চঞ্চল ইচ্ছেরা,
কিছুতেই আমার আজ মানে না মন মানা।”
হঠাৎ বাইক থামতেই আমি গান থামিয়ে দিলাম। অয়ন পেছনে না তাকিয়েই বলল,
“তোর গানের জন্য আমি ড্রাইভ করতে পারছি না।”
“আমি আবার কি করলাম?”
“তুই না তোর গান করছে। আমাকে এলোমেলো করছে, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
অয়নের কথায় হেসে বললাম,
“ওকে, সরি।”
হয়তো অয়ন অন্যকোনো উত্তর আশা করেছিল। তবুও কোনো প্রতিবাদ না করে বাইক স্টার্ট দিলো।
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট গিয়ে নাস্তা করতে রেস্টুরেন্টে গেলাম। একই টেবিলে মুখোমুখি বসে আছি। অয়ন খাবার অর্ডার দিলো, ভেজ রোল আর কফি। বারবার অয়নের দিকে তাকাচ্ছি। সে হয়তো বুঝতে পেরেছে কিছু বলতে চাইছি।
“কিরে তনুশ্রী, কি বলবি?”
“বলবো বাট ভাবছি বলা ঠিক হবে কিনা।”
অয়ন হেসে বলল,
“বলে ফেল, আমার সাথে এতো ভ°ণিতা লাগবে না।”
“তোমার চোখে কোনো সমস্যা আছে?”
“না।”
“তবে চশমা পড়ো যে মাঝেমধ্যে?”
“তোর মতো আমি অলটাইম চাশমিশ না, মাঝেমাঝে লাগে তাই পড়ি।”
অলটাইম চাশমিশ, কথাটা একটু ইগোতে লাগলো। অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
“আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক হচ্ছে অয়ন।”
অয়ন ফোন বের করছিল, আমার কথায় চমকে বলল,
“এখনো সম্পর্ক হয়নি?”
“আমার মনে হয়না।”
টেবিলে শব্দ করে ফোন রেখে কিছু বলার আগেই খাবার চলে আসলো। ওয়েটার চলে গেলে অয়ন বলল,
“কেন? সব বিষয় চিৎকার করে বলাটা জরুরি?”
আমার থুতনি ধরে মুখটা ওর দিকে ফিরিয়ে বলল,
“চিৎকার করাটা সবসময় সল্যুশন হয় না। মাঝেমাঝে চুপও থাকা লাগে। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হয়।”
শক্ত হয়ে থাকা অয়নের হাতটা ধীরে ধীরে ছেড়ে দিলো। আমি ওর হাতটা ধরে বললাম,
“কষ্ট পেয়েছো আমার কথায়?”
অয়ন হেসে বলল,
“না, তবে তোর বুদ্ধি কম আছে এটা শিউর হয়েছি।”
খেতে খেতে আর কোনো কথা হয়নি। শুধুই বারবার ওকে দেখছি। সকালের রাগ, একটু আগের রাগ, আমার অসময়ের রাগ সব ভুলে যাচ্ছি। আমার ভালো থাকার জন্য ওকেই লাগবে। শুধু ইচ্ছা পূরণ করলেই ভালোবাসা হয়না, ভালোবাসার ভালোটা পূরণ করাও দরকার।
কুমিল্লার আশেপাশের পাহাড়ি অঞ্চলে নিয়ে গেল আমাকে। কুমিল্লা শহর আমার অনেক দেখা হয়েছে, ক্যান্টমেন্ট ঘুরাঘুরিও হয়েছে। তবে কুমিল্লায় যে এতো সুন্দর সুন্দর পাহাড় আছে তা আমি জানতামই না।
রাস্তার পাশে বাইক থামিয়ে অয়ন বলল,
“লালমাই পাহাড় গিয়েছিস সেটা জানি, এখানে যে কোনো আসিস নাই সেটাও জানি।”
আনন্দে উৎফুল্ল আমি অয়নকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“থ্যাংক ইউ অয়ন।”
“আমাদের মাঝে থ্যাংকস আসা উচিত না। সো ইঞ্জয় দিস ভিউ।”
একটু সরে এসে বললাম,
“পাহাড়ে উঠতে পারবো।”
“পড়ে গিয়ে পা ভা°ঙ°লে কি হবে?”
“কিচ্ছু না।”
পাহাড়ের আশপাশ ভালোই দেখা হলো। ছোট একটা পাহাড়েও উঠলাম। আশেপাশে কোনো বড় পাহাড় নেই। পরে অয়ন জানালো এগুলো পাহাড় নয়, এগুলোকে টিলা বলে।
পাহাড়ি ঢালে একটা গাছের গুড়ির উপর দুজনে বসে পড়লাম। দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত হয়ে আছি। অয়নের কোলে মাথা রেখে আধশোয়া হয়ে রইলাম।
“টায়ার্ড?”
“হুম।”
হঠাৎ করে উঠে বসে বললাম,
“আজকে তোমার কোনো কাজ ছিল না?”
“ছিল তো, টিউশন ছিল। শুক্রবারে পড়াবো বলেছি।”
“কয়টা টিউশন করো?”
“চারটা।”
আশেপাশে তাকিয়ে বললাম,
“এখানে মানুষ নেই কেন?”
অয়ন হেসে হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,
“বসত বাড়ি ওদিকে রেখে এসেছি আমরা।”
আমি উঠে দাঁড়িয়ে একটা একটা করে গাছ দেখছি। অয়নও আমার সাথে সাথে হাঁটছে।
“আমি পড়বো না, এতো ভেবো না।”
কথাটা বলতে নিয়েই ধ°পাস করে পড়ে যেতে নিলাম, অয়ন ধরে বলল,
“ভাব কম নেন, ম্যাডাম। এলোমেলো তনুশ্রী আমার।”
স্বপ্নের মতো কাটানো দিন দ্রুত চলে যায়। পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি দুজনে, উদ্দেশ্যে সূর্যাস্ত দেখবো। যদিও অয়ন চায়নি, আমিই জে°দ ধরেছি।
সূর্য চলে যাচ্ছে। আকাশ ছাড়িয়ে, পাহাড়ের গহীনে লুকাচ্ছে আজও। দুহাতে অয়নের হাত জড়িয়ে বললাম,
“আজকের সূর্যাস্তটা বেশি সুন্দর লাগছে, তাই না?”
অয়ন আমার দিকে তাকালো। লাল আভায় তার মুখটাও লাল হয়ে উঠেছে, উজ্জ্বল লাল। অয়ন আমাকে আরেকটু কাছে টেনে বলল,
“ওই সূর্য, এই পাহাড়, র°ক্তি°ম আকাশ সব সৌন্দর্য ছাড়িয়ে তুমি আমার চোখে অধরা হয়ে ধরা দিয়েছো। মনে হচ্ছে আর ফিরে না গিয়ে এখানেই থাকি।”
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম,
“গুড আইডিয়া।”
“ভেরি ব্যা°ড আইডিয়া। এক্ষুণি অন্ধকার হয়ে যাবে। চল এখন।”
সূর্য ততক্ষণে ডুবে গেছে। অন্ধকারে নেমে আসতেও কষ্ট হচ্ছে। অয়নের হাত টেনে বললাম,
“অথৈ আপুর মেহেন্দির সন্ধ্যার মতো আজও আমাকে কোলে নিয়ে চলো না অয়ন।”
অয়ন থমকে দাঁড়ালো। তারপরই কোলে তুলে নিলো আমাকে। আজ আবারো শুনছি তার বুকের বাম পাঁ°জরে বাজতে থাকা ডিপডিপ শব্দ। সন্ধ্যার পাখিদের কলধ্বনি ছাড়িয়ে ওর হৃদপিণ্ডের শব্দটা আমাকে ব°ড্ড জ্বা°লা°তন করছে। সেদিনের সন্ধ্যা আর আজকের সন্ধ্যার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছি না। সেদিন রাতেও আমি ঘুমাতে পারিনি আজও পারবো না। ও আমাকে ঘুমাতে দিবে না। সেদিনের মতো আজও আসবে আমার স্বপ্নে, রাজকুমার হয়ে তার রাজকুমারীকে নিয়ে যেতে।
হঠাৎ আমাকে নামিয়ে দিতেই ছাইপাঁশ চিন্তা থেকে বাস্তবে আসলাম আমি।
“বাইকে উঠ, জায়গা ভালো না দ্রুত যেতে হবে।”
“আমি ঢাকা যাবো না অয়ন।”
আমার কথায় অয়ন হেলমেট পড়তে নিয়েও পড়লো না। ধমকের সুরে বলল,
“থা°প্প°ড় খাবি একটা, চুপ করে বস।”
এতোটা রেগে যাবে বুঝতেই পারিনি। আর কথা বাড়ালাম না। আমি উঠতে বসতেই বাইক চালালো অয়ন। একটু জোরে চালাচ্ছে, একটু না অনেক জোরে।
এবারে আমার ভ°য় ধরে গেছে। অয়নের শার্ট ধরে বললাম,
“অয়ন ধীরে চালাও, আমার ভ°য় করছে।”
আমার কথা কি অয়ন শুনছে না? কোনো রেসপন্স করছে না কেন? ততক্ষণে আমরা শহরে চলে এসেছি।
“অয়ন।”
আরেকবার ডাক দিতেই বাইক থামলো। অয়নের পিঠে মাথা ধা°ক্কা খেয়ে আবারো সরে বসলাম।
অয়ন নেমে দাঁড়িয়ে বলল,
“কি সমস্যা? চেঁ°চামেচি করছিস কেন?”
“অনেক জোরে চালাচ্ছিলে তাই।”
ভ°য়ে কা°চু°মা°চু আমার অবস্থা। অয়ন হেসে আমার গাল টেনে বলল,
“দুপুরে কিছুই খাওয়া হয়নি, চল খেয়ে নিই।”
“হুম, ওকে।”
খাওয়া শেষ করে বাইরে আসলাম দুজনে। আমি এখনো চুপচাপ বসেই রইলাম। অয়ন এককাপ কফি এনে আমার হাতে দিয়ে বলল,
“নে।”
কফিটা হাতে নিয়ে গরম ছ্যাঁ°কায় হাত থেকে ফেলে দিলাম। অন্যমনস্ক ছিলাম, অ°প°রা°ধ দৃষ্টিতে অয়নের দিকে তাকিয়ে আছি।
অয়ন আলতো হেসে বলে,
“আরেকটা আনছি।”
অয়নকে যেতে না দিয়ে ওর হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে চুমুক দিলাম। সে এখনো আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।
“এককাপে খেতে কি খুব অসুবিধা হবে?”
আমার প্রশ্নে অয়ন হাসলো। হাত বাড়িয়ে আমার ঠোঁট মুছে দিয়ে বলল,
“কৃতার্থ হলাম ম্যাডাম।”
অয়নের হাত ধরে বললাম,
“ওক্কে মাই স্যার, মাই স্টার।”
কফি শেষে অয়ন বাইকে উঠে বলল,
“চল।”
একটা ঢোক গিলে বললাম,
“অয়ন, ঢাকায় না গেলে হয় না?”
অয়ন কিছু বলতে যাবে তার আগেই আপুর কল। অয়ন রিসিভ করলো,
“তানিমা, আমরা রওনা দিচ্ছি।”
অপরপাশের কথা আমি শুনিনি। তবে জানার আগ্রহ আছে।
অয়ন আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তনুশ্রী, দুষ্টুমি করিস না। উঠে বস।”
“আমি যাবো না। প্লিজ অয়ন, আর একদিন থাকবো।”
“দিনের জন্য রাতও থাকা লাগবে।”
অয়নের ইচ্ছা নেই বুঝতে পেরে বাইকে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম আমরা ঢাকা যাচ্ছি না, কোথায় যাচ্ছি সেটা বোঝার চেষ্টা করেও বুঝলাম না।
একটা রিসোর্টের সামনে এসে থামলাম। অয়ন নেমে কাউকে কল দিলো,
“ভাই, কোথায় আছেন? (একটু থেমে অপরপাশের ব্যক্তির কথা শুনলো) আচ্ছা, আমরা গেইটের কাছে আছি।”
ফোন রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর জন্য আমাকে কত বড় মিথ্যা বলতে হইছে জানোস?”
“আমি আবার কি করলাম?”
অয়ন মাথা নেড়ে অন্যদিকে তাকালো। একজন ছেলে এসে অয়নের সাথে হাত মিলালো। তারপর আমাদের নিয়ে গেল রিসোর্টের একটা রুমে।
কুমিল্লা ম্যাজিক প্যারাডাইসের কাছের এই রিসোর্টটি আমাকে চমকে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হলো। আরো চমক পেলাম অয়নের এই কাজে।
পুরো রুমে চোখ বুলাচ্ছি তখনই দরজার কাছে দাঁড়ানো অয়নের কন্ঠ শুনলাম,
“তোমার ভাবিকে নিয়ে এসেছি। এখন রাতে ঢাকার দিকে যেতেও ভ°য় করছে তাই চলে আসলাম। আমি একা থাকলে চলেই যেতাম, ও একটু ভী°তু তাই গেলাম না।”
ভাবি মানে? অয়ন আমাকে তার স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়ে দিলো। তারমানে এইরুমে আজকে অয়নের সাথেই থাকতে হবে? ইশ, কি লজ্জা লাগছে।
“ভালো করছেন ভাই। ভাবি কিন্তু সেই সুন্দরী, আপনাদের হেব্বি মানাইছে।”
“থ্যাংক ইউ।”
হাসতে হাসতে অয়ন ভিতরে আসলো। দরজা লাগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসে ফোন বের করলো। আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কিরে, কি দেখিস?”
“দেখতেছি তুমি কেমনে পাল্টি খাও।”
হেসে ফোন কানে দিয়ে বলতে থাকে,
“তানিমা, একটা প্রবলেম হইছে রাস্তায়। দাউদকান্দির কাছে ডা°কা°তির ঘটনা ঘটছে, আবার ভূমি°দ°স্যু°র ভয় আছে। তাই তনুকে নিয়ে ফিরে আসতে পারবো না আজকে।(একটু থেমে) আজকের রাতটা ম্যানেজ কর, কালকে দুপুরের মধ্যে চলে আসবো।…. কিছু বলে বুঝিয়ে দে।”
ফোন রেখে আমাকে বলল,
“তানিমাকে জানিয়ে দিয়েছি আমরা আজ ফিরবো না।”
আমি ওর পাশে বসে বললাম,
“আমাকে ওয়াইফ বললে যে?”
অয়ন আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“পরিবেশ এখনো বুঝিস নি। ওয়াইফ না বললে ভাববে আমরা জাস্ট নাইট স্পে°ন্ড…”
ওর কথার মাঝেই মুখ চেপে ধরলাম। হাতের উপর নিশ্বাস পড়তেই ছেড়ে উঠে গেলাম। ড্রেসিং টেবিলের গোল আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে অয়নের দিকে তাকিয়ে রইলাম। অয়নের দৃষ্টিও আমার দিকে।
“আমি বাসায় যাবো, অয়ন।”
অয়ন হেসে দিলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“এখন কিন্তু তুই পালটি খাচ্ছিস।”
“অয়ন, আমি.. আমি এভাবে থাকতে পারবো না। মানে.. এই শাড়ি পড়ে ঘুমাতে পারবো না।”
আমতাআমতা করছি আমি। আমি কি অয়নকে ভ°য় পাচ্ছি?
অয়ন শার্টের হাতা গু°টাতে গু°টাতে বলল,
“ঘুমাবো কে বলেছে?”
চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
“কি বলতেছো ঘুমাবো না?”
“জাস্ট কুল। সারারাত গল্প করবো, দেখি আজ তুই কতো কথা বলতে পারিস।”
অয়ন উঠে এসে আমার নাক টেনে বলল,
“আমি এমন ছেলে না যে হাসব্যান্ড বলেছি বলেই অধিকার চাইবো। ফ্রেশ হয়ে নে।”
আমি দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেলাম। এখানে আসাটাই এখন ভুল লাগছে। ভ°য় না, লজ্জা পরিরা ঘিরে ধরেছে আমাকে। অয়নের দিকে তাকাতেই পারছি না। কেন আজকে থাকার জে°দ ধরেছিলাম।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসলাম। খাটের সাথে হেলাম দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে অয়ন। ভালো করে দেখে বুঝলাম চোখ বন্ধ।
“কি দেখিস?”
আয়হায়, এই লোক কি চোখ বন্ধ থাকলেও দেখে নাকি? কিভাবে বুঝলো আমি তাকে দেখছি। সরে যেতে নিলে অয়ন হাত টেনে ধরে উঠে দাঁড়ায়।
“সরি, অয়ন।”
“সরি কেন?”
“এমনিই।”
হাত ছাড়িয়ে আমি চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললাম,
“আমার আবদার তো শেষ পর্যন্ত রাখতেই হলো।”
“আবদারের জন্য না, সেভটির কথা ভাবছি।”
“তারমানে আমার আবদারের কোনো দাম নেই, তাই তো?”
অয়ন হাসলো। চিরুনিটা শব্দ করে রেখে চুলগুলো খোঁপা করতে থাকলাম। গাল ফুলিয়ে রেখেছি। আমার আবদার ইচ্ছার দাম নেই কেন? অবশ্যই থাকতে হবে।
অয়ন আমার কোমড় জড়িয়ে কাছে নিয়ে এলো। খোঁপাটা আর করা হলো না, হাতের মুঠো থেকে চুলগুলো ছুটে গেল সমস্ত পিঠে। দুহাতে অয়নের শার্ট খা°মচে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
আমার গালে হাত দিয়ে মুখটা উপরে তুলে কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিলো। চোখ তুলে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। তার চোখে নারী নে°শা নেই, কোনো লো°ভ নেই, বরং একসমুদ্র সমান ভালোবাসা দেখছি আমি। আমার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে গেল দুফোঁটা সুখের বৃষ্টি।
আমার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“ভ°য় পাস না তনুশ্রী, বৈ°ধ না করে তোকে আমার করবো না।”
চলবে……….
#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
একাদশ পর্ব
সকালে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে নরম বিছানায় আবিষ্কার করলাম। সাদা কম্ফোর্টার দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে শুয়ে আছি। একটু নড়ে অয়নকে খুঁজতে খুঁজতে পাশের সোফায় ওকে শুয়ে থাকতে দেখলাম।
উঠে বসে ফোন হাতে নিয়ে দেখি সকাল সাতটা। রাতে ঠিক কয়টায় ঘুমিয়েছি তার খেয়াল নেই। ফ্লোরে বসে অনেকক্ষণ ধরে গল্প মজেছিলাম দুজনে। দুজনের এমন কোনো ঘটনা বোধহয় আর বলার বাকি রাখা হয়নি। ছোট থেকে এখন পর্যন্ত সবকিছুই বলা হয়ে গেছে, শুধু অনুভূতিটুকুই অব্যক্ত রইলো। বারবার বলতে চেয়েও থেমে গেছি। আমি আগে বলবো না, সে আমাকে প্রপোজ করবে আর আমি ফিল্মি স্টাইলে রাজি হবো।
রাতের কথা ভাবছি আর আপন মনে হাসছি। তারপর আবারো নজর গেল অয়নের দিকে৷ ধীরে ধীরে উঠে ওর কাছে গেলাম। কাল থেকে তো কম ধ°ক°ল যায়নি মানুষটার উপর দিয়ে। শুধু কাল কেন আমার সাথে দেখা হওয়ার দিন থেকেই মানুষটাকে ব্যস্ত করে দিয়েছি আমি।আমার এই অসময়ের প্রেমটুকু তাকে ব্যস্ত করেছে।
উপন্যাসের মেয়েদের নাকি ঘুমালে সুন্দর লাগে আর আমার জীবনের গল্পে ঘুমন্ত অয়নের নিষ্পাপ চেহারা সবচেয়ে সুন্দর। অয়নের গালে হাত দিয়ে কপালে চুম্বন করলাম। তারপর উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি অয়ন জেগে গেছে। আমি মুখ মুছতে মুছতে বলি,
“তাহলে ঘুম ভাঙলো?”
অয়ন উঠে এসে আমার কানের কাছে বলল,
“এতো সুন্দরভাবে ঘুম ভাঙবে আশা করিনি।”
আর কোনো কথা না সে ফ্রেশ হতে গেল। আমি তো লজ্জায় ম°রছি। তার ঘুম যে এতো হালকা জানতামই না। দূরে থাকতে হবে ওর থেকে, নাহলে ভুল হয়ে যাবে। কিন্তু আদৌ কি পারবো দূরে থাকতে?
দরজায় নক পড়লো। অয়ন তড়িঘড়ি করে এসে দরজা খুলে বলল,
“এইতো আমরা প্রায় রেডি।”
দরজা লাগিয়ে আমাকে বলল,
“চেঞ্জ করে রেডি হয়ে নে।”
“এতো জলদি চলে যেতে হবে? রুমটা ভালো লেগেছে, আরেকটু থাকি।”
অয়ন প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে একটু হেলে বলল,
“রুমটা লি°গে°লি বুক করিনি, সো এখন না গেলে একটু পরে ঘা°ড় ধরে বের করবে।”
কথা শুনে আমি তো তাড়াহুড়ো শুরু করেছি। ব্যাগ হাতে নিয়েই বললাম,
“সিলেট যাবো না শুনে তো কাপড়ের ব্যাগ আপুর কাছেই দিয়ে দিয়েছি। আর কোনো ড্রেস তো নেই, আমি কি পড়বো?”
অয়ন অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলার আগেই ফোন বেজে উঠে। অয়ন রিসিভ করে গিয়ে সোফায় বসে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ ওর মুখের ভঙ্গি বদলে গেছে। শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, আমরা আসছি।”
ফোন রাখতেই চঞ্চল ভঙ্গিতে বললাম,
“কি হয়েছে?”
“ঢাকায় যাবো।”
“এখনই কেন?”
“ইমা°র্জে°ন্সি।”
বুকটা কেঁপে উঠেছে। ভ°য়ে আ°ত্মা°টাও বের হয়ে আসবে মনে হলো। ঢাকা আসা পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকলো আমার। অয়ন কোনো কথাই বলছে না। সেও কি ভয় পাচ্ছে?
বাসার সামনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে দশটা বাজলো। গেইটের কাছে আপু বা মানহা কাউকেই দেখলাম না।
“আপুকে কল করো অয়ন।”
অয়ন একবার শুধু তাকালো, কিছুই বলল না।
“বাসায় জানে আপুর সাথে গিয়েছিলাম, একা ফিরলে বাসায় কি বলবো?”
আমার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। ফ্ল্যাটে গিয়ে দরজা খোলা দেখে একমুহূর্তের জন্য মনে হলো কোনো বি°প°দ হয়েছে, কিন্তু তারপরই বুঝলাম সব শেষ।
ড্রইংরুমে সোফায় বসে আছে আব্বু, আম্মু ফ্লোরে বসে আছে, আপু আর মানহা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই কাঁদছে। আমি অয়নের দিকে তাকালাম।
আব্বু ক°ড়া ভাষায় বলল,
“মানহা যাচ্ছে, মানহার আন্টি যাচ্ছে, এদিকসেদিকই যাবো। আমাকে এভাবে বোকা বানাতে লজ্জা করলো না তোমার তন্বী?”
মা অথবা মামুনি ছাড়া বাবা কোনোদিন আমাকে নাম নিয়ে ডাকেনি। হঠাৎ এমন ডাকে ঘা°বড়ে গেলাম।
আব্বু ধ°মক দিয়ে উঠলো,
“কি হলো জবাব দেও? আর অয়ন, তোমাকে নিজের ছেলের মতো স্নেহ করতাম। এভাবে আমাকে না ঠ°কালেও তো পারতে?”
আমি বলবো কিছুই বুঝছি না। দুচোখ দিয়ে একাধারে স্রোত বইছে। আব্বু হঠাৎ চেঁ°চিয়ে উঠে বলে,
“আদরের প্রতিদান এটাই দিলে যে একটা ছেলের সাথে সারারাত বাইরে কা°টিয়ে আসলে?”
আমি ভয়ে দুইপা পিছিয়ে গেলাম। অয়নের দিকে তাকিয়ে দেখি চোখ বন্ধ করে দাঁত নিচের ঠোঁট কা°মড়ে ধরেছে। আচমকা এমন ঘটনায় সেও স্ত°ব্ধ।
আপু আমাকে ধরে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“আব্বু, ও ছোট মানুষ, বুঝতে পারেনি।”
“ছোট মানুষ? এতোই ছোট যে আমার সাথে মিথ্যা বলতে পারে আর (একটু থেমে) তানিমা, তোর আ°স্কা°রায় আরো বেশি বেড়েছে। তুই তো সবটা জেনেও আমাকে কিছুই বলিসনি।”
আব্বু অয়নের দিকে তাকাতেই অয়ন মাথানিচু করে ফেলে। আব্বু একটু ক°ড়া করেই বলে,
“এমন কাজ কেন করো যাতে চোখ মেলাতে আর না পারো। তন্বী বড় হয়েছে এটা ও না বুঝলেও তোমার তো বোঝা উচিত ছিল। তোমাকে তো ভালো, ভদ্র ছেলে ভাবতাম। কিন্তু এখন..”
বাবা আর কথা বাড়ায় না। নিজের রুমে চলে গেল। আম্মু অনবরত কাঁদতে কাঁদতে বাবার পিছুপিছু চলে গেল।
অয়ন আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মুছতে ইশারা করে সেও চলে গেল। আমি ফ্লোরে বসে বললাম,
“অয়ন ওরকম ছেলে না আপু। ও খারাপ না আপু, বাবাকে বোঝাও তুমি ও খারাপ না।”
আম্মু হ°ন্ত°দ°ন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে বলল,
“অয়নের নামটাও যদি এখানে আর উচ্চারিত হয় তবে মেরেই ফেলবো তোকে। তোদের জন্য সারাজীবন কষ্ট করে এখন তোদের জন্যই লোকটা শান্তি পাচ্ছে না। বাবা হয় তোদের, না থাকলে বুঝবি কেমন লাগে।”
বলে আম্মু আবারো রুমে চলে গেল। আমি চেয়ে রইলাম তার যাওয়ার দিকে।
আপু মানহাকে চলে যাওয়ার জন্য বলে। মানহা যেতে যেতে আমার দিকেই চেয়ে রইলো। আমি বুঝতে পারছি আমাকে ছেড়ে যেতে ওর ইচ্ছা করছে না, কিন্তু নিরুপায় মানহার যেতে হয়।
রুমে এসে বিছানায় বসে পড়লাম। একটা ভুল, শুধু একটা ভুল আমাকে আর অয়নকে যোজন যোজন দূরে ঠেলে দিলো। বিশাল এক প্রাচীর তুলে দিলো আমাদের মাঝে। বাবাকে কষ্ট দেয়া সম্ভব নয়, অয়নকে ছাড়াও থাকতে পারবো না। দুজনে আমার দুই কূলের ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে আর আমি মাঝ দরিয়ায় ভা°সছি।
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছি। দুপুরের দিকে আপু এসে ডাকলো। চোখ খুলে খাবারের প্লেট হাতে আপুকে দেখে উঠে বসলাম। প্লেটটা বিছানায় রেখে একটা ক্লিপ এনে আমার চুলগুলো আটকে দিয়ে বলল,
“খেয়ে নে, অয়ন ভাই জানালো ফোন পেয়ে সকালে না খেয়েই চলে এসেছিস।”
ভাত মেখে মুখের সামনে ধরলেও আমি মুখে না নিয়ে বললাম,
“অয়ন কল দিয়েছে?”
“হুম, তবে তুই কিছুদিন ফোন চালানো অফ রাখ। আমি.. ”
আপুর কথার মাঝেই বললাম,
“বাবা আমার ফোন নিয়ে গেছে, তাই তো?”
কথাটা বলতে আপুর ই°ত°স্ত°ত বোধ হচ্ছে। আমি ভাত খেতে লাগলাম। খাওয়ার সময় আবারো চোখ ভিজে গেল। আপু নিজের ওরনার কোণা দিয়ে চোখ মুছে বলল,
“চিন্তা করিস না, আমি জানি অয়ন ভাই কেমন আর আমার বোন কেমন। আব্বুকে আমি বুঝাবো। তুই কাঁদিস না প্লিজ।”
“আমি কেন কালকে ফিরে আসলাম না?”
“রাস্তায় বি°পদ হতো বলেই অয়ন ভাই তোকে নিয়ে আসেনি। রাস্তা ভালো না ওখানের।”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললাম,
“আমি কেন ঘুরতে যাওয়ার বায়না করলাম? কেন আমার জন্য বাবাকে কষ্ট পেতে হলো? কেন আমার জন্য অয়নকে অ°প°মানিত হতে হলো? আমার জন্য আম্মু আর জাহানারা আন্টির সম্পর্ক নষ্ট হবে। আমিই সবকিছুই জন্য দায়ী।”
আপু আর কিছুই বলল না, কাঁদতেও বারণ করলো না, চোখ মুছেও দিলো না৷ ফ্যা°লফ্যা°ল করে চেয়ে রইলো আমার দিকে।
“এমনটা কিভাবে হলো আপু?”
“মানহার আন্টির কাজ এটা। মানহার আম্মু কালকে বাসায় ছিল না, মানহা আর আমি একা ছিলাম।”
আপু একটু থামলো। আমি চুপচাপ চেয়ে রইলাম। একটা দী°র্ঘশ্বা°স ফেলে বলল,
“মানহার আন্টি রাতে বাসায় এসে আমাকে দেখে। আর উনার সাথে আম্মুর ভালো সম্পর্ক তা তো জানিসই, উনিই আম্মুকে বলেছে আর তারপর…”
আপু থেমে গেল। সে আর বলতে চায় না, আমিও আর শুনতে চাই না।
পরদিন সকালে আমি জানতে পারলাম বাসা থেকে বের হওয়ায় নি°ষে°ধা°জ্ঞা পড়েছে আমার। তবুও বিষয়টা নিয়ে তেমন ভাবাবেগ হলো না। কাল থেকে বাবা আর কোনো কথা বলেনি আমার সাথে, বাবার এই নিরবতা আমার হৃদয়ে র°ক্ত°ক্ষ°র°ণ করাচ্ছে।
ভালো দিন খুব জলদি যায় আর খারাপ দিনগুলো যেন নড়তে চায় না। আমি পড়াশুনায় মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম, ভার্সিটিতে এডমিশন টেষ্ট দিবো এমন উদ্দেশ্যে৷ কিন্তু আমার চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে। পড়াশুনা করার বা মনে রাখার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। মনের বি°রু°দ্ধে জোর করে শুরু করলাম যু°দ্ধ।
সময় চলছে, রাত্রিদিন কেটে যাচ্ছে একের পর এক। ডিসেম্বর শেষ হয়ে জানুয়ারি চলে আসলো। কনকনে না হলেও মোটামুটি শীত পড়ে গেল।
মানহার সাথে খুব কম কথা হচ্ছে। সেও আমার বাসায় খুব একটা আসে না। মাঝেমাঝে আসলেও দ্রুত চলে যায়। কারণটা আমার আম্মু, সে আম্মুকে খুবই ভয় পাচ্ছে আজকাল।
বাবার সাথে দূরত্বটা বেড়েই যাচ্ছে। এতোটা বেড়ে গেল যে বাবা যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ আমি রুম থেকে বেরই হই না। আম্মু মাঝেমাঝে কথা বললেও হু কিনবা ওকে ছাড়া আর কোনো জবাব দেয়া হয় না।
আজ শীতটা বেশ ঝেঁ°কে বসেছে। কম্বল মুড়িয়ে আরামে ঘুমাচ্ছিলাম। আপু এসে আলতো করে ডাকলো,
“তন্বী, ওই তনু।”
ঘুম ঘুম চোখে বললাম,
“কি আপু?”
“উঠ।”
উঠে বসে মুখের উপরের চুলগুলো সরাচ্ছি। আপু বলে,
“অয়ন ভাই এসেছে।”
অয়ন এসেছে? বাবা জানলে সত্যিই মে°রে ফেলবে। কিছু বলার আগেই আপু মুখ চেপে ধরে বলল,
“ছাদে যা।”
জ্যাকেট পড়ে দ্রুত ছাদে চলে গেলাম। ছাদের রেলিং ঘে°ষে অয়ন দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে পিছনে দাঁড়ালাম। অয়ন হয়তো আমার উপস্থিতি অনুভব করেছে।
ফিরে তাকিয়ে বলল,
“সরি, তনুশ্রী।”
আবেগহীনভাবে বললাম,
“আমাদের মধ্যে সরি বা থ্যাংকস থাকবে না, তুমিই তো বলেছিলে।”
অয়ন হেসে অন্যদিকে তাকালো। তার চেহারায় কেমন যেন একটা ছ°ন্ন°ছাড়া ভাব। ঘন দাঁড়ি, এলোমেলো চুল, মুখটাও কেমন শুকনো শুকনো।
অয়নের গালে হাত দিতেই চমকে তাকালো। জোর করে হেসে বললাম,
“কি অবস্থা হয়েছে তোমার?”
“তোর চেয়ে ভালো আছি তো। আমি তোর সুন্দর পরিবারে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছি।”
নিজেকে আর এক মুহূর্তের জন্যও নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। অয়নের বুকে কপাল হেলিয়ে হা°উমা°উ করে কান্না করে দিলাম। এ দূরত্ব আর সহ্য হচ্ছে না। অয়ন দুহাতে আমাকে জড়িয়ে নিলো, যতটা শক্ত করে সম্ভব জড়িয়ে রাখলো আমাকে। অয়নের জ্যাকেটের কলার খা°মচে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্য°র্থ হলাম।
কিছুক্ষণ পর অয়ন বলল,
“তনুশ্রী, বাসায় চলে যা। আংকেল জানতে পারলে আবারো রা°গারা°গি করবেন। এই বয়সে এতো রাগ উনার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না।”
একটু সরে এসে নাক ঝে°ড়ে বললাম,
“আন্টি কি কিছু জানে এ ব্যাপারে?”
“না, আম্মুকে কেউই কিছু জানায়নি। তাই আমিও বলিনি। তাদের ফ্রেন্ডদের সম্পর্ক ভালো থাকুক।”
“সবাই ভালো থাকুক, সবাই ভালো থাকুক।”
বলে অয়নকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে বাসায় চলে আসলাম। রুমে এসে চুপ করে বসে আছি।
আপু টেবিলে কিছু পড়ছে। আমাকে দেখে বলল,
“অয়ন ভাই, কি বলল?”
“কিছু না।”
“কিছুই না?”
অবাক হয়ে প্রশ্নটা করে আমার সামনে এসে বসলো আপু।
আমি কম্বল গায়ে দিয়ে বসে রইলাম। আপু মাথা নেড়ে বলল,
“মাঝরাতে এসে ছাদে বসে আছে, তাও এই শীতের মধ্যে। রাতে সিকিউরিটি গার্ডদের চোখ ফাঁ°কি দিয়ে কিভাবে ছাদে এসেছে কে জানে। এসে আমাকে কল দিলো, তুই ঘুমাচ্ছিস শুনে জাগাতে নি°ষে°ধ করলো।”
কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠার জোগাড়, মানুষটা কি পাগল?
দৌঁড়ে উঠে বারান্দায় গেলাম। নিচে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বাই বললো অয়ন। আজ আবারো কান্না পাচ্ছে আমার। প্রচুর কান্না পাচ্ছে।
সন্ধ্যায় আম্মু ফোনে আপুকে একটা ছেলের ছবি দেখাচ্ছে। ছেলেটার জীবনের কোনো অংশ বাকি রাখছে বলে মনে হচ্ছে না।
আপুর হাতে ফোন দিয়ে বেরিয়ে যেতেই ছোঁ মে°রে ফোনটা নিয়ে বললাম,
“কে এটা আপু?”
আপু মৃদু হেসে বলল,
“দেখতেই তো পাচ্ছিস?”
ভ্রু উঁচিয়ে আপুর চেহারা দেখছি। বেচারি এতো লজ্জা পাচ্ছে কেন বুঝতে চেয়েও বুঝলাম না।
ছবির সাথে একটা সিভির পিডিএফ আছে। সিভি ওপেন করে নাম দেখলাম রুম্মান ফয়সাল, পেশা লেখা আছে একটা প্রাইভেট কোম্পানির সিএফও। নিশ্চয়ই আপুর সাথে বিয়ের কথা চলছে, অথচ ঘরে থাকা আমি তা জানিই না।
বেল বেজে উঠলো। আম্মু দরজা খুলে দিলো, নিশ্চয়ই বাবা এসেছে। ফোনটা আপুর হাতে দিয়ে চেয়ার টেনে পড়তে বসে গেলাম।
“তন্বু মা, কোথায় আছো?”
আব্বু ডাকছে আমাকে। কতদিন পর এভাবে ডাকলো। চমকে উঠে আপুর দিকে তাকালাম। আপু হাসছে, উৎফুল্ল হাসিটা দেখে আমিও ছুটে গেলাম ড্রইংরুমে।
বাবাকে দেখে কান্না করতে করতে জড়িয়ে ধরলাম। বাবাও মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কি হয়েছে, কেন হয়েছে জানতে চাই না। আমি এখন শুধুই আমার আগের বাবাকে চাই।
বাবা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“যা হওয়ার হয়ে গেছে, বলবো সবটা ভুলে যাও। তোমার আপুর জন্য ছেলে দেখেছি। ছেলের ফ্যামিলি তানিমাকে পছন্দ করেছে।”
আমি মাথা তুলে আপুর দিকে আড়চোখে একবার তাকালাম। আপু নিজের রুমের দরজার ওপারে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে।
হাসিমুখে বাবার দিকে তাকাতেই বলেন,
“তানিমা চলে গেলে তুমিই তো থাকবে আমাদের সাথে। তোমাকে নিয়ে তো অনেক স্বপ্ন, আমাদের স্বপ্নটা ভে°ঙ্গে দিও না।”
হাসিটা মুছে গেল, মাথানিচু করে ফেলতেই বাবা আবারো বলেন,
“কালকে ছেলে তার ফ্যামিলির সাথে আসবে। পাকাপাকি কথা হবে কালকে। সব দায়িত্ব তোমার। তানিমা এতোদিন তোমাকে সামলেছে আর এখন তুমি তানিমাকে সামলে নেও।”
“জি ঠিক আছে।”
“রুমে যাও।”
রুমে এসেই একটা লাফ দিয়ে আপুর গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
“আমার আপুটাও বিয়ে করবে। ইশ, ইশ, তোমাকে সুন্দর করে সাজাবো আমি। ওয়াও, ফিলিংস গ্রেট।”
শুরু হয়ে গেল আমার আরেকটা যু°দ্ধ। সকলের সামনে হাসিমুখে থাকার যু°দ্ধ। নিজের কষ্টটা লুকিয়ে রেখে হাসতে থাকা, একি সবাই বুঝে নাকি?
সকাল থেকেই ঘর গুছানো আর রান্না সামলানো দুটোতেই হাত লাগাতে হচ্ছে। যদিও ভোরে আমার ছোট খালা চলে এসেছে, তবুও উনার হাতে হাতে এটাওটা করে দিতেই হচ্ছে। দুপুরের আগেই মেঝো ফুপ্পি চলে এলেন।
বাবা এসে ডাইনিং এ বসলেন। আমি এখন আম্মুর শখের শোকেস থেকে প্লেট, গ্লাস আর বাটি নামাচ্ছি।
“মামুনি?”
“জি বাবা।”
“আমার রুমে এসে তোমার ফোনটা নিয়ে যেও।”
প্লেটগুলো টেবিলে রেখে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম বাবার দিকে। হঠাৎ ফোন ফেরত দিচ্ছে? মানে বাবা আমাকে বিশ্বাস করছে। আর আমি কিনা সেই বিশ্বাস ভে°ঙ্গে গত ভোরে অয়নের সাথে দেখা করেছি?
বাবা আমাকে রুমে যেতে বলে চলে গেলেন। আমি একটু দাঁড়িয়ে থেকে বাবার পিছুপিছু রুমে গেলাম।
“আসবো, বাবা?”
“আসো।”
বাবা তার পাশে আমাকে বসতে ইশারা করলে আমি তাই করলাম। আমার ফোনটা হাতে দিয়ে বললেন,
“আমার বিশ্বাসটুকু রাখবে আশা করি। এমন কোনো কাজ আর করো না যাতে আমাদের মাথানিচু হয়।”
বুকের ভেতর জোরদার সাহস সঞ্চয় করে বললাম,
“বাবা, অয়ন কিন্তু…”
কথা শেষ করার আগেই বাবা বলেন,
“যাও, কাজে করছিলে।”
যা বুঝলাম অয়নকে নিয়ে কিছু শুনতে ইচ্ছুক নয় বাবা। কথা না বাড়িয়ে চলে আসি। রুমে এসে ফোনটা আপুর সামনে রেখে বললাম,
“তোমার বিয়েটা আমার জন্যও সুসংবাদ হয়ে এসেছে।”
ফোনের দিকে তাকিয়ে আপু হেসে দিলো। আমিও আবার কাজে চলে গেলাম।
বিকালে আপুকে সাজাতে থাকলাম। মানহাও এসেছে। দুজনে খুব হালকা সাজে সজ্জিত করলাম আপুকে যাতে তাকে সাধারণ লাগে। ট্রেলারে কখনো পুরো মুভি দেখাবে নাকি?
নিজেকে আয়নায় দেখলাম। এলোমেলো লাগছে, সাজতে ইচ্ছা না থাকলেও বাবার জন্য সাজলাম। আমাকে দেখতে খারাপ লাগলে বাবা হয়তো ক°ষ্ট পেতে পারে।
মানহা আমার একটা ছবি তুলে বলল,
“অয়ন ভাই দেখলে নি°র্ঘা°ত ফিদা হয়ে যাবে।”
চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললাম,
“অয়নকে আমার কোনো ছবি পাঠাবি না, আমি বাবার বিশ্বাস ভা°ঙতে পারবো না। বাবাকে আর কোনো ক°ষ্ট দেয়া সম্ভব না।”
মানহা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। মুখ ভা°র করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। অয়নের সাথে ততদিন আর কোনো যোগাযোগ করবো না, যতদিন না বাবা মেনে নেয়। তবে অয়ন যদি সামনে চলে আসে, আমি কি করে নিজেকে সামলে নিবো?
মেহমানরা চলে এসেছে। শরবত নিয়ে ড্রইংরুমে এসে একটা বড়সড় ধা°ক্কা খেলাম। পাত্র রুম্মানের সাথে অয়নের চাচাতো ভাই ইত্তাজা। ইত্তাজা আর রুম্মান ফয়সাল ফ্রেন্ড নাকি এরা দুই ভাই? প্রশ্নগুলো চ°ঞ্চ°ল গতিতে ছুটে বেড়াচ্ছে আমার মনে।
প্রশ্নের পাহাড়ের মাঝে ইত্তাজা আরেকটা প্রশ্ন ছুঁ°ড়ে দিয়ে বলল,
“আরে তন্বী যে, কেমন আছো?”
চলবে……….