হঠাৎ প্রণয় পর্ব-০৯

0
198

#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

নবম পর্ব

সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে। অয়ন নিয়ম করে আমাকে পড়াতে আসছে, গা°দা°গা°দা পড়া দিচ্ছে, পড়া নিচ্ছে, পড়া না পারলে ব°কাঝকা করছে, পরীক্ষার পর পরীক্ষা নিচ্ছে, পরীক্ষার নাম্বার আব্বুকে দেখাচ্ছে। এক কথায় ছোটখাটো অ°ত্যা°চার চালাচ্ছে সে। পারলে বু°ল°ডো°জার দিয়ে পি°শে দিবে এমন অবস্থা।

আমার বান্ধুবীরা তিন সাবজেক্ট পরীক্ষা দিবে বলে চিল করছে আর আমি পড়াশোনার জ্বা°লায় চোখে সরষেফুল দেখছি।

অয়ন আশে-যায় ঠিকই কিন্তু পড়া ছাড়া তার দিকে একমুহূর্ত তাকানোও মানা। ফ্লার্টিং ভুলে পাক্কা টিচার হয়ে গেছে।

আজকেও আমাকে জ্ঞান দিতে এসেছে, থুরি পড়াতে এসেছে। এসেই অরগানিক কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়া ধরা শুরু। একগাদা হোমওয়ার্ক চেক করছে আর একের পর এক প্রশ্ন করছে। উত্তর দানকারীর দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূ°ক্ষেপ নেই।

একপর্যায়ে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
“অয়ন, আমি যে পড়তে পড়তে ম°রে যাচ্ছি সে খবর কি আছে?”
“পড়তে হবে।”
“এতো পড়ে কি হবে? একদিন তো ম°রেই যাবো।”

অয়ন বই থেকে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো। একটু কড়া গলায় বলল,
“গ্রেজুয়েট একজন ছেলে কখনো টুয়েলভ ফে°ল মেয়েকে বিয়ে করতে দেখেছিস?”
“হ্যাঁ, গ্রামে দেখেছি।”

কথা মিথ্যা না, এমন ঘটনা আমাদের গ্রামে সত্যিই ঘটেছে। অয়ন কিছুটা হতাশ হয়ে বলল,
“মা যদি টুয়েলভ ফে°ল হয় বা টেনেটুনে পাশ হয় তবে বাচ্চাদের কি অবস্থা হবে?”

মাথা নেড়ে বললাম,
“আরো খারাপ হবে।”
“তাই আমার বাচ্চা মাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে, ভার্সিটিতে পড়তে হবে, গ্রেজুয়েট হতে হবে।”

চোখ ছোট করে বললাম,
“বাচ্চা পড়াতে গ্রেজুয়েট? তাইলে তো সংসার করতে পিএইচডি লাগবে।”

অয়ন হেসে বলে,
“হ্যাঁ, গ্রেজুয়েট হতে হবে।”

দুগালে হাত দিয়ে বললাম,
“তারমানে আমাকে বিয়া করবা, এটা একপ্রকার শিউর?”

অয়ন আমার গাল টেনে ধরে বলে,
“থা°ব°ড়ে গাল লাল করে দিবো। চুপচাপ পড়, এইসব আজাইরা প্যাঁ°চাল পরীক্ষার পর করা যাবে।”

মুখ থেকে তার হাত সরিয়ে বললাম,
“তারমানে পরীক্ষার পর আমার প্যাঁ°চাল শুনবা?”
“হ্যাঁ।”
“তখন ধমক দিবা এমনে?”
“একদম না, এখন পড়।”

আহ্লাদী কন্ঠে বললাম,
“আরেকটা প্রশ্ন করেই পড়বো আবার, প্রমিস।”
“কি?”
“পরীক্ষার পর ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে ঢাকার বাইরে কোথাও। তাও সেটা বাইকে করে, নিয়ে যাবা?”
“গেলাম।”
“সত্যি?”

অয়ন চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমার মুখের সামনে মুখ এনে বলল,
“আরেকটা কথা বললে চারতলা থেকে নিচে ফেলে দিবো।”
“কিন্তু আমরা তো দোতলায় থাকি।”

অয়ন আমাকে ভ°য় দেখাতে না পেরে হতাশ হয়ে সরে গেল। বোকা বোকা লাগছে মুখটা। আবারো বই নিয়ে বলল,
“পড়াশোনা না করলে কোথাও নিয়ে যাবো না।”
“ওকে, পড়া ধরো। বলছি, বলছি, সব শিখেছি।”

পড়া শেষে অয়ন স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে গেল। আমি বই গোছাচ্ছি, আমি জানি অয়ন আবারো ফিরে আসবে। ঠিকই এসে আমার গাল টেনে দিয়ে চলে গেল। প্রতিদিন এটা আমার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। সে প্রতিদিন যাওয়ার সময় ফিরে আসবে।

আপু রুমে এসে বলল,
“আজকে অয়ন ভাই এতোক্ষণ পড়ালো।”
“অস্বাভাবিক নাকি?”
“না, তাও তিনঘন্টা অনেক সময়।”
“আমার সামনে এক্সাম, তাই পড়াইছে।”

আপু আর কিছু না বলে চলে গেল। আমিও বইখাতা নিয়ে আবারো পড়তে বসলাম। অয়ন যতই পড়ার অ°ত্যা°চার করুক, আমাকে তো পড়তে হবে। ওর যোগ্য হতে হবে তো আমাকে।

সন্ধ্যার দিকে মানহা এসে হাজির হলো৷ ব্যাগ ভর্তি বই নিয়ে এসেছে। আম্মুর সামনে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভদ্রতা দেখিয়ে আমার রুমে আসলো।

দরজা বন্ধ করে ব্যাগটা খাটে ছুঁ°ড়ে ফেলে বলল,
“ফ্রেন্ডরা কেন ব্রেকাপ করায় জানিস? এর জন্যই করায়। আমিও তোর ব্রেকাপ করাবো। মানে একটা বে°ডা পাইলি কি পাইলি না আমাকে বেমালুম ভুলে মেরে দিলি। তোকে আর তোর ওই বে°ডাকে কি করি শুধু দেখ।”

ও শুধু কথা বলছে না বিভিন্ন আকার ইঙ্গিত দেখিয়ে এককথায় নৃত্য করছে।

গালে হাত দিয়ে বললাম,
“নাইচ ডান্স।”

মানহা আমার মুখের সামনে এসে তুড়ি বাজিয়ে বলে,
“একদম ভণিতা না।”
“আমি কোনো ভণিতা করছিও না। ভণিতা তুই করছিস।”

মানহা ব্যাগ থেকে নোটখাতা বের করে বলল,
“বাদ দে, আমার কষ্ট তুই কি বুঝবি? এখন আমাকে সাজেশন দে।”
“কিসের সাজেশন?”

আমার সাধারণ কথায় মানহা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“থা°প্প°ড় খাবি? অয়ন ভাই যা যা সাজেশন দিছে সব দে।”
“ওহ আচ্ছা, সেটা বল। আমি তো ভাবলাম বে°ডা পাওয়ার সাজেশন চাইছিস।”

মানহা কিছু বলল না, শুধু চোখ পা°কিয়ে তাকিয়ে রইলো। পারলে এখনই আমাকে খেয়ে ফেলবে।

সাজেশন যা যা দিয়েছে সবই মানহাকে সাপ্লাই করলাম। যাওয়ার সময় আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“একটা অয়ন ভাই থাকলে আমিও তোকে ভুলে যেতাম।”

আমি ওর দিকে তাকাতেই মানহা চোখের ইশারায় বারান্দার দিকে দেখিয়ে বলল,
“অয়ন ভাই ওয়েট করছে, যাও।”
“বেলকনিতে?”
“না গাধা, নিচে।”

আমি বারান্দায় গিয়ে দেখি ঠিকই অয়ন নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে হাত নেড়ে নিচে আসতে ইঙ্গিত করলো।

আম্মুকে মানহার সাথে বাইরে যাচ্ছি বলে নিচে নেমে আসলাম। অয়ন বাইকে উঠে আমাকে বলল,
“উঠ।”
“কোথায় যাবো?”
“ম°রতে।”

“ইনজয় দিস ডাই।”
দাঁত কেলিয়ে কথাটা বলে মানহা চলে গেল।

আমি কোনো প্রতিবাদ না করে বাইক উঠে বসলাম। অয়ন একটু দূরে এনেই বাইক থামালো।

“দুই মিনিটের রাস্তা বাইকে এনে কি বোঝাতে চাইলে?”
“আমি বাসায় যাইনি, এখানেই ছিলাম বিকাল থেকে।”
“মানে?”
চমকে উঠে কথাটা বললাম।

অয়ন বাইক থেকে নেমে আমার দিকে ঝুঁকে বলল,
“মানে তো অনেক কিছুই, সব বোঝানোর ক্ষমতা এই অক্ষমের নেই।”
“এতো এতো পড়া দিয়ে আসছো। না পড়লে ঠিকই তো ব°কা দিবা।”

অয়ন আমার নাকে নাক ঘ°ষে দিয়ে বলল,
“হুশ, চুপ থাক। একদম চুপ। পড়া পড়ার সময় হবে, এখন না।”
“এখন কি..”

অয়ন আমার ঠোঁটে আঙ্গুল দিলো, এখনো তার কপাল আমার কপালে ঠেকে আছে।

আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। অয়নের শার্টের কলার খা°ম°চে ধরে রেখেছি। হুট করে অয়ন সরে গেল। অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, আমি তার মুখ খানা দেখার অপেক্ষায় আছি।

সৌভাগ্য হলো, অয়ন ফিরে তাকিয়ে হেসে দিলো। আমিও হেসে বললাম,
“এমন পাগলামির কোনো মানে আমি পাই না।”
“একদিন সবকিছুরই এক্সপ্লেনেশন আসবে।”

কথাটা আমার ছোট মস্তিষ্কে ঠিক আটলো না, একটু ভারি পড়লো। তারপর আর তেমন কোনো কথা হলো না, আমি বাসায় চলে আসলাম। হুটহাট অয়নের এধরণের কথা আমাকে একটু ভাবিয়ে তুললেও বিচলিত হওয়া যাবে না। শান্ত আছি, শান্তই থাকবো আর আমার ভাবনা আমার মনে থাকবে।

রাতটুকু অন্য রাতের মতোই পার হলো। সকালে ১০ টায় অয়ন পড়াতে এসেছে, বিকালে সে বিজি থাকবে তাই সকালে এসেছে আর আমি তো কলেজে যাই ই না।

রুমে বসে মনের সুখে গান গাচ্ছি,
“নি°শা লাগিল রে, বাঁকা দুই নয়নে নি°শা লাগিলো রে।”

“এতো নে°শা লাগলে এক্সাম দিবি কিভাবে?”

অয়নের কথায় ফিরে দেখি দরজার সামনে সে দাঁড়িয়ে। আজকের গেটআপ পুরোই ফরমাল। সাদা শার্ট, ফরমাল প্যান্ট, হাতে কালো ঘড়ি, দাঁড়িগুলোও বেশ সুন্দর করে এসেছে। মুখে কিছু লাগিয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না, তবে বেশ কিউট লাগছে।

আমাকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে দরজা চাপিয়ে ভিতরে এসে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে থাকিস না, আমার লজ্জা করে।”

ধমক দিয়ে বললাম,
“করুক, আজ তুমি লাজুক আর আমি বে°হায়া।”

সে হেসে হেয়ালি করে বলে,
“সে তো তুই প্রতিদিনই বে°হায়া, নির্লজ্জ।”

চোখ ছোট করে তাকাতেই সে ঠোঁট বাকিয়ে হাসতে থাকে। তাকে দেখতে দেখতেই দুইঘন্টা পার হয়ে গেল। পড়া সব মাথার দুই কিলোমিটার উপর দিয়ে চলে গেছে।

পড়া শেষে আমাকে হোমওয়ার্ক দিচ্ছে। এমনসময় আমি প্রশ্ন করলাম,
“নায়ক-নায়িকার বিয়ে হলে সিনেমা শেষ হয়ে যায় কেন?”

আমার কথায় অয়ন বই থেকে চোখ তুলে বলল,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“আহা, বলো না।”
“আগে পড়া লিখ, তারপর বলবো।”

রাগ দেখিয়ে বললাম,
“নো, আগে বলবা।”

আমার জে°দে হার মেনে অয়ন মুচকি হেসে বলল,
“কারণ বিয়ের পরের কাহিনী তো শুরু হলে আর শেষই হবে না, তাই শুরুই করে না।”
“মানে?”
“এন্সার চেয়েছিলি দিয়েছি, আর কোনো মানে টানে না।”
ধমক খেয়ে আবারো পড়া শুরু করলাম।

দেখতে দেখতেই দিনগুলো পেরিয়ে গেল। আমার পরীক্ষা চলে এলো, তিন সাবজেক্ট ও মোট ছয় পত্রের পরীক্ষা হলো। ২০২১ সাল, করোনা পরবর্তী সময়ে নামমাত্র এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষা যা দিয়েছি মোটামুটি নাম্বারও আন্দাজ করে ফেলেছি।

আজ শেষ পরীক্ষা উচ্চতর গণিত দ্বিতীয় পত্র দিলাম। কেন্দ্রের বাইরে বের হয়ে আম্মুকে খুঁজে পাচ্ছি না। ছুটি এখন হবে জেনেও আম্মু কোথায় যেতে পারে তাই ভাবছি।

হঠাৎ হাতে টান পড়ায় ফিরে দেখি অয়ন দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কিরে আন্টির নে°কু পো°ষ্য, আন্টিকে খুঁজছিস?”
“কি বললে আমাকে?”

কিছু না বলে একটা হাসি দিয়ে হাত ধরে একটু এগিয়ে গিয়ে রিকশা নিলো। রিকশায় বসেও আমার শান্তি হলো না।

অয়নের হাতে একটা ঝাঁ°কুনি দিয়ে বললাম,
“আম্মু কোথায়?”
“আন্টি বাসায় আর তার পো°ষ্যকে নিতে আমি এলাম।”
“বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু অয়ন ভাই।”

অয়ন চমকে তাকালো, আমিও ভাব নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে হাসছি।

“কি বললি আমার বল তো।”
“অয়ন ভাই, নো নো অয়ন ভা°ই°রা°স।”
“মা°ইর খাবি যেকোনো দিন।”

তার হাতে একটা খা°ম°চি দিয়ে বললাম,
“তুমি খাবে, আমি দিবো।”
“আস্তে, শি°য়ালের মতো বিহেভ করিস না।”
“কি আমি শি°য়াল? তুমি কি খ্যা°পা হুলো, আস্ত মিয়াও।”

ঝগড়া করতে করতেই বাসায় চলে এলাম। বাসায় এসে আম্মুর সাথে দেখা হলো।

“পরীক্ষা কেমন হলো?”

আম্মুর প্রশ্নে খুব একটা হেলদুল না করে বললাম,
“ভালো।”

আম্মু আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে অয়নকে বলল,
“বসো অয়ন। জাহানারা কি ঢাকায় আসবে না?”
“আম্মুকে তো জানেন আন্টি। খুব একটা বের হয় না, তারপরও দেখি আসে কিনা।”
“বাসায় নিয়ে এসো একদিন।”
“জি।”

আম্মু আমাকে বলল,
“তোমার কাকা কিছু জিনিসপত্র পাঠিয়ে। ওগুলো কুরিয়ার থেকে আনতে যাচ্ছি। আবার আমার কিছু ওষুধ কিনতে হবে। রান্না হয়েছে, আপুকে বলো রেডি করতে। (অয়নকে বলল) অয়ন, আজকে দুপুরে লাঞ্চ করে যেও।”
“জি।”
অয়ন জবাব দিলেও আমি শুধু ঘাড় বাঁ°কিয়ে সম্মতি জানালাম।

আম্মু চলে গেলে আমি রুমে যেতে যেতে ব্য°ঙ্গ করে বললাম,
“ভাবখানা এমন যেন বিনয়ের অ°ব°তার। ভদ্রতা একদম উপচে উপচে পড়ছে।”

“ওই” বলে অয়ন উঠতেই আমি দৌঁড়ে রুমে চলে আসি। অয়নও আমার পিছুপিছু এসেছে। দরজা একটু চাপিয়ে আমাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে বলল,
“কিসব বলিস এগুলা?”
“রাস্তায় তো খুব ঝগড়া করছিলা, এখন আমার রং বদলাইছো কেন?”
“রং বদলে গেছে?”

বলেই আমার একদম কাছে চলে এসেছে। এতোটাই কাছে যেন দুজনের নিঃশ্বাস মিলে এক হয়ে যাচ্ছে।

“অয়ন, ভুল হচ্ছে খুব।”
“অনেক বড় ভুল।”

তার ফিসফিস কন্ঠে হৃদপিণ্ড ব°ন্ধ হওয়ার জোগাড় হচ্ছে আমার। যেন এই আমি শেষ হয়ে যাবো। তাকে সরানোর শক্তি নেই নাকি ইচ্ছা নেই তা আমি জানিনা, তবে সময়টুকু একেবারেই অন্যরকম।

“তন্বী, তোর পরীক্ষা কেমন হলো?”

দরজা ঠেলে আপুর প্রবেশ। অপ্রীতিকর মুহূর্ত, আমি-অয়ন সরে গেলেও আপুর হয়তো কিছুই বোঝার বাকি নেই। আমি ভয়ে একবার অয়নের দিকে তাকিয়ে আপুর দিকে আড়চোখে চেয়ে তার অ°গ্নি°রূপ দেখে মাথানিচু করে ফেললাম। তিনজন মানুষ ঘরে থাকলেও ঘরটাকে বেশ শুনশান মনে হচ্ছে।

নিরবতা অয়নই ছিন্ন করলো,
“তানিমা, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। ইটস.. ইটস নাথিং সিরিয়াস। একচুয়ালি…”

অয়নের কথায় প্যাঁচ লেগে গেছে। আপু একটা কাশি দিয়ে বলল,
“অয়ন ভাই, ডোন্ট মাইন্ড। তন্বী এখনো ছোট, অন্তত আমাদের মাঝে ছোট। আমি জানি আবেগ অনুভূতি হতেই পারে। তবুও এখন বিষয়টা গোপন রাখো আর (একটু থেমে) আর তোমরা একটু দূরে থেকো।”

অয়ন কিছুই বলল না। আপুর আস্কারা পেয়ে আমি কান্না করে দিয়েছি। এতোক্ষণ কান্না না পেলেও এখন পাচ্ছে। আপু বলল,
“ফ্রেশ হয়ে নে। খাবার দিচ্ছি।”
“হুম।”

আপুর আগেই অয়ন বেরিয়ে গেল। শুধু রুম থেকে নয় বাসা থেকেই বেরিয়ে গেল সে। আমার দিকে তাকালো না পর্যন্ত। কিছুটা রাগ হলো। কিন্তু কার উপর? অয়নের উপর নাকি আপুর উপর নাকি আমার নিজের উপর?

ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ এসে চুপচাপ খেতে বসে পড়লাম। আপু নিজের ভাতের প্লেট নিয়ে আমার পাশে এসে বসে বলল,
“কবে থেকে?”
“কি কবে থেকে?”

আপু ব্য°ঙ্গসুরে বলে,
“ন্যাকা, যেন কিছুই বুঝে না। অয়ন ভাইয়ের সাথে এসব চলছে কবে থেকে?”

নিজের ভাব বজায় রাখতে সম্পূর্ণ দো°ষ আপুর ঘা°ড়ে চাপিয়ে দিলাম,
“তুমিই তো অয়ন ভাইকে আমার টিচার করে দিয়েছো, তো আমার কি দোষ?”
“টিচার করেছি, জামাই না।”
“আমি তো তাই ভাবছিলাম।”

বলেই হেসে দিলাম। আপু রেগে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

“অথৈ আপুর বিয়ে থেকে নয় তো এসব।”

চমকে উঠলাম আমি। অয়নের দেয়া সেই চুড়ি, চোখে আইলাইনার দিয়ে দেয়া, যত্ন করে মলম লাগানো৷ সবকিছু যেন স্পষ্ট হয়ে গেল।

“আমি কি ঠিক?”

আপু যখন বলেছে তখন শিউর হয়েই বলেছে। লুকানোর অবকাশ নেই, তবুও লুকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টাটুকু করলাম,
“না, কিছু ফিল করলেও তাকে জানাইনি কিছুই আর সেও কিছুই বলেনি।”

আপু ভাত রেখে হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“এরজন্যই ইন্টারের পর মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। কি হলো না হলো, এখন থেকেই তাকে, সে ডাকা শুরু। আল্লাহ, এই দিনও আমার দেখার ছিল।”
“আরে আপু, কি করতেছো?”
“তো কি করবো? আমি এখনো আ°বি°য়া°ত্তা আর আমার ছুডু বইন এখনই ওগো, হ্যাঁগো করতেছে।”

আপুকে টেনে বসিয়ে বললাম,
“আগে খাও, তারপর কথা হবে।”

খাওয়া শেষ করে টেবিল গুছিয়ে রাখছি এমনসময় আম্মু আসলো। আমাদের দুজনকে বলল,
“অয়ন চলে গেছে?”

আপু আমার দিকে তাকিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।
আমি হকচকিয়ে বললাম,
“কিছু কাজ আছে বলল আর চলে গেল।”
“খায়নি?”
“না।”

আম্মু ব্যাগগুলো রেখে রুমে যেতে যেতে বলতে থাকে,
“মেয়ে দুইটা বড় হইছে, আ°ক্কে°ল কম আছে। ছেলেটা নিজের কাজ ফেলে কলেজ থেকে তোকে দিয়ে আসলো, কিন্তু না খেয়ে গেল।”
“তোমার ছেলে নাকি?”

আমার ঝা°রিতে আম্মু রুমে চলে গেল। আপু এসে প্লেটগুলো রাখতে রাখতে বলে,
“না, উনার মেয়ের জামাই।”

কপাল চা°প°ড়ে বি°লা°প করতে মন চাইতেছে৷ এই আপু নিজে গোপন রাখতে বলল, অথচ নিজেই ফাঁ°স করবে মনে হচ্ছে।

সন্ধ্যায় অয়ন কল দিলো। আমি রিসিভ করলাম, কিন্তু কোনো কথা বলছি না।

“তনুশ্রী। হ্যালো, হেই, তনু।”

সারাশব্দ না পেয়ে কেটে আবারো কল দিলো।

“রাগ করেছিস? কেন রাগ বল আমাকে?”
“রাগের কারণই বোঝো না, তাহলে আর কিসের ভালোবাসো?”
“ঠিকই তো, ঠিকই তো। একটু ভাবতে দে।”

কিছুক্ষণ “হুম, হুম” শব্দ করে বলল,
“আজ কথা না বলে চলে এসেছি বলে?”
“না।”
“তবে কি ঝগড়া করেছি বলে?”
“না।”

একটু থেমে শব্দ করে গলা ঝেড়ে বলল,
“এতোটা কাছে এনেছিলাম বলে।”

সমস্ত শরীরে তড়িৎ খেলে গেল। দুপুরের সেই ঘটনা মনে হতেই বুকের ধুকধুকটাও দ্বিগুণ হলো। ঠোঁটদুটো অবিশ্বাস্যভাবে কাঁপছে, কথা বলতে চেয়েও পারছে না।

“তনুশ্রী।”

নিজের অস্বাভাবিক অবস্থা তাকে বুঝতে না দিয়ে বললাম,
“না মানে, আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তো।”
“ও, সেই কথা। ঠিক আছে, তুই বাসায় কথা বল আমি তো রেডিই আছি। যখন বলবি তখনই হাজির।”
“আমি সিলেট যাবো।”
“কি?”
অয়ন চেঁচিয়ে উঠলো।

“হ্যাঁ, আমি সিলেট যাবো।”
“জি না, বড়োজোর কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার যেতে পারবেন। এর বেশি একদম না।”
“মানে ঢাকার আশেপাশে?”
“হ্যাঁ। একদিনেই ফিরে আসতে হবে।”
“তাইলে লাগবে না, ওসব আমার দেখা হয়েছে।”

অয়ন কিছুই বলছে না। আমি রাগ দেখিয়ে বললাম,
“আমাকে নিয়ে একটু যাওয়ার কথা হলো অমনি তুমি বেঁ°কে বসছো।”
“এমন করে না তনুশ্রী আমার, কিউটি আমার। ওতো দূরে একটা ছেলের সাথে যেতে নেই।”
“মানে?”
“মানে দুপুরের ঘটনা মনে করেন, বুঝে যাবেন আশা করি।”

কিছু না বলে ফোন কেটে দিলাম। লজ্জা লাগছে, প্রচুর লজ্জা। এখন আয়নায় মুখ দেখলে নিশ্চয়ই মুখে লাল আভা দেখতাম। অয়ন কি বলতো আমাকে এভাবে দেখলে? বলতো আজ আমাকে রঙ্গিলা লালশির পাখি, মুনিয়া, মাছরাঙা লাগছে।

চলবে……..