#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব৬
#রাউফুন
‘হায় হায় রে বিয়ে বাড়িতে যাওয়াই বুঝি কাল হোলো মেয়ে দুটোর। এখন কি হবে গো আল্লাহ্! বাপ মা ছাড়া মেয়ে দুটোর শেষ সম্বল ও থাকলো না। পুঁড়ে ছাঁই হয়ে গেলো।এই তুলি এখনও দাঁড়িয়ে আছিস!গিয়ে দেখ তোর কত্তো বড় সব্বনাশ হয়ে গেছে!তোর বাড়ি যে আর নেই রে!’
মাইজিন চলে যাওয়ার পর তুলিকা সবে সবে নিজের বাড়ির দিকে যাবে সে সময়ই তাকে দেখে একজন এই তী’ড় ছোড়া বাক্য উচ্চারণ করলেন। মুহুর্তের মধ্যে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। রাস্তা পার করে মিষ্টি দৌঁড়ে এলো তুলিকার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে কিছু বলতে চেয়েও পারলো না সে। দু চোখ ভর্তি নোনাজল। বোনের এই অবস্থা দেখে, আর ওই মহিলার ওমন হাহুতাশ শুনে তুলিকাও দৌঁড়ে গেলো সেদিকে। মিষ্টিও তার নিশ্চল পা নিয়ে ছুটলো তার বোনের পিছনে পিছনে! যখন তুলিকা নিজের বাড়ির কাছে গেলো স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। ধপ করে বসে পরলো তুলিকা। নেই তার ছোট্ট কুঠির নেই। পুড়ে ছাঁই হয়ে গেছে। কে করলো তার এই সর্বনাশ? মানুষের ভীড় হলো তাদের দেখতে পেয়েই। ভীড় থেকে কেউ একজন দুঃখ প্রকাশ করে বললেন,
‘কোথায় যাবে এখন মেয়ে দুটো, খাবে কী? কি করবে? সব তো শেষ হয়ে গেলো!আহারে!’
বুড়ো দাদুর শেষ স্মৃতি টুকুও সে ধরে রাখতো পারলো না ভেবেই কান্নায় ভেঙে পরলো তুলিকা।দগদগে আ’গু’ন মুহুর্তে ছড়িয়ে পরে ছাই করে দিয়েছে তার ছোট্ট বাড়িটা। গ্রামের লোকজন আ’গু’ন নেভাতে ব্যস্ত থাকলেও বের করতে পারেননি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো। মেয়েটির থাকার ঘরটি পুড়ে গেছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই আর রইলো না। সর্বস্ব হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে আছে তুলিকা আর মিষ্টি। দুই বোন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে। চোখের পানি বাঁধ মানছে না। সব হারিয়ে আজ তারা নিঃস্ব! এক লহমায় সকল কিছু শেষ হয়ে গেলো। তার জীবন টা এমন কেন হলো? কেন? একের পর এক আকষ্মিক ঘটনা ঘটার ফলে তুলিকার মাথা শূণ্য লাগছে। আশফি খবর পেয়ে ছুটে এলো তুলিকার কাছে। আশফিকে দেখতেই হামলে কান্না করে দিলো তুলিকা। আহ কি হৃদয় বিদারক আর্তনাদ দুটি মেয়ের। তুলিকা ছুটে যেতে চাইলো নিজের শেষ সম্বল পুড়ে যাওয়া আ’গু’ন সমের ছাই মারিয়ে। আশফি তাকে শক্ত করে ধরে আটকে রাখলো। তুলিকা ছুটার চেষ্টা করছে আর কেঁদে কেঁদে কপাল চাপড়ে বলছে,
‘আল্লাহ তুমি এটা কি করলে?আমাদের নিঃস্ব করে দিলে এভাবে?কপালের মতোই এবারে বাড়িটাও পুড়লো। সব শ্যাইষ হয়ে গেছে। এই আশু তুই তো জানিস, আমার -আমার মা-বাবার একটা ছবি বাঁধানো ছিলো, বুড়ো দাদুর ছবি, আমার মিষ্টির বই, আমার মিষ্টির ছোট বেলার জামা কাপড় সব শেষ হয়ে গেলো। আমার যত্ন করে আগলে রাখা সকল কিছু এভাবে শেষ হয়ে গেলো রে। কি করবো আমি এখন? তোর শশুর বাড়ি যাওয়াটাই বোধহয় আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কাল হয়ে গেলো রে আশু। আমার সব প্রিয় জিনিস গুলো এনে দে না রে? আমি যাবো ওখানে। আমাকে ছা’ড়। আমি-আমি খুঁজে দেখবো ওখানে গিয়ে!’
‘শান্ত হো বোন আমার। শান্ত হো। আমি আছি তো। আমি আছি তোর পাশে। আল্লাহ তায়ালা কেন এমন করলে? কেন করলে?’
আশফির পরিবার সহ, নীরব, মাইজিন, উপস্থিত সবার চক্ষু চড়কগাছ। এসব কি করে হলো? আশফির শশুর বাড়িতে আশফির বাবা-মা যাওয়ার আগেও তো বাড়ি একদম ভালো ছিলো তবে হঠাৎই এরকম নির্মম ঘটনা ঘটালো কে?
সবাই এসেছে এখানে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া দুঃখ দেখতে। তার নির্মমতা দেখতে। কই এতো দিন তো তার বাড়ির আশেপাশেও কেউ আসে নি? আজ যখন বাড়িটাই নেই তখন কেন এসেছে এই মানুষজন। তুলিকা চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে বলে,
‘আজ কেন এসেছেন আপনারা? আমার ধ্বংস হওয়া দেখতে? শান্তি পেয়েছেন আপনারা? আমি যখন নিঃস্ব হয়ে এখানে এসেছিলাম তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? আজ যখন ধ্বংস সব শেষ হয়ে গেছে, ঘর বাড়ি হারিয়ে পথে বসেছি তখন সে-সব দেখে মজা নিতে এসেছেন? যান এখান থেকে যান। আপনাদের প্রয়োজোন নেই আমার। প্রয়োজন নেই।’
একে একে সবাই মুখ বেকিয়ে এটা সেটা বলে চলে গেলো। কেউ কেউ তুলিকার মাথা খারাপ হয়ে গেছে এসব ও বললো। এই অবস্থাতেও মানুষের মুখের কথা সরে নি। তাদের আর কি তাদের তো আর ঘর পুড়ে নি। শিপনকে যখন নিজের চোখের সামনে দেখলো তুলিকা তখন হিংস্র বাঘিনীর মতো ছুটে গিয়ে তার গলা চেপে ধরে। তুলিকার আচানক কাজে ভড়কে যায় শিপন।
‘এই তুই করেছিস এটা তাই না? কেন করলি এটা? কি ক্ষতি করেছি আমি তোর? সেই প্রথম থেকেই তুই আমার সঙ্গে এরকম করে যাচ্ছিস! কেন করলি এটা? আমার এই ছোট্ট বাড়িটা এভাবে পুঁড়ালি তুই? তোকে আমি ছাড়বো না। জা’নে মে’রে দেবো তোকে। তোর মতো জানু’য়া’রের বেঁচে থাকার অধিকার নাই। তোকে আমি আজকে শেষ করে দেবো।’
‘কারা এমন কাজ করেছে সেটা কেউ’ই সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না। তাহলে তুই কিভাবে আমার দোষ দিচ্ছিস!’ শিপন এক ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিলো তুলিকাকে।
‘দোষ দিচ্ছি? তোকে দোষ দিচ্ছি না। আমি শিওর তুই করেছিস। কারণ আমি তো তোর দুচোখের বি’ষ।’
আশফি তুলিকাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘দেখ তুলি আমি মানছি ভাইয়া তোকে সহ্য করতে পারেনা তাই বলে এরকম জঘন্যতম কাজ করবে? এটা কি মানা যায়?’
‘তুই বিশ্বাস করছিস না আমাকে? তবে শোন তোর ভাইয়া আমায় দেখতে পারে না কারণ আমি গরীব! আমি গরীব শুধু এটাই না। তার বউ আছে, এক বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। তাদের রেখে, অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে দেখা করা, তাদের ডেট করা, একদিন আমি সব জানতে পারি৷ কখন কিভাবে জানতে পেরেছি সেসব না হয় না বলি। এসব তোকে আমি নুরী ভাবির কথা ভেবে বলতে পারিনি। আমি তার সব নোংরা কাজের ব্যাপারে জানতে পারি, সে আমাকে সব সময় শ্বাসাতো। তোর বিয়ের দিনও আমাকে ছাড় দেইনি এই লোক।’
তারপর তুলিকা কাঁদতে কাঁদতে সবটা বলে শিপনের বিয়ের দিনে করা বা’জে কাজের কথা। বজ্রপাত হলেও বোধহয় এতটা চমকায় না যতটা আশফির পরিবার এসব ঘটনা শুনে চমকেছে। তাদের ছেলে এতোটাই নিকৃষ্ট?
‘তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না তাইতো? এবারে দেখো আমি কি করে প্রমাণ করি।’
তুলিকা আশেপাশে শক্তপোক্ত একটা লাঠি খুঁজে এনে বলা নেই কওয়া নেই ধুপধাপ করে পে’টা’তে লাগলো শিপনকে।
‘বল কে করেছে এসব? বল? না হলে আজ তোকে জ্যাঁ’ন্ত ছাড়বো না আমি।’
তার আকষ্মিক কান্ডে হকচকিয়ে যায় সবাই। তুলিকাকে যে আটকাতে আসছে তাকেই পে’টা’চ্ছে। কেউ সাহস করে আগাতে পারছে না। তুলিকাকে এখন হিংস্র বাঘিনী লাগছে। তার সামনে গেলেই মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে ভস্ম করে দেবে।
মা’রে’র প্রকোপ সহ্য না করতে পেরে শিপন গড়গড় করে সব স্বীকার করে। সে শুধু মাত্র তুলিকাকে সহ্য করতে পারতো না বলেই এসব করেছে। তারপর কালকের ঘটনাই সে ক্ষুব্ধ হয়ে, রাগের বশবর্তী হয়ে আ’গু’ন লাগিয়ে দিয়েছে এই ঘরে।কারণ তুলিকা তার পাঞ্জাবীতে আ’গু’ন লাগিয়ে দিয়েছিলো কাল।গ্রামের দিকে সাধারণত সবাই দুপুরে খেয়ে ভাত ঘুম দিয়ে থাকে। সবাই যখন ঘুমিয়ে ছিলো তখন শিপন তার লোক দিয়ে এই একাজ করিয়েছে।এই কথা শুনে মনের আঁশ না মেটা পর্যন্ত তুলিকা থামলো না। শিপনের গা’য়ে আ’ঘা’তের পর আ’ঘা’ত করলো।
মাইজিন এক কদম এগিয়ে আসলো। ইতিমধ্যে তুলিকার চোখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে জেনো গাছে ফোটা সদ্য কৃষ্ণচূড়ার ন্যায়। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ঠিক এই চোখটার প্রশংসা করা যাচ্ছে না কারণ এই চোখটাই হিংস্রতা সৃষ্টি হয়েছে মাথার উপর ছাদ টুকু হারিয়ে। এমনটাও বুঝি হয়? মা’র’তে মা’র’তে ক্লান্ত তুলিকার শক্তি ফুরিয়ে গেছে। সে ধপ করে আবার বসে বসে পরে মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে।হাউমাউ করে কাঁদছে তুলিকা আর মিষ্টি। আশফি ঠিক কোন বাক্য প্রদান করে তুলিকাকে স্বান্তনা দেবে বুঝতে পারলো না। শিপনের বাবা হাশেম রাগে দপদপ করে পা ফেলে ছেলের কাছে গিয়ে জুতো খুলে সপাটে বা’রি দিলেন কতগুলো।
‘কুলাঙ্গার জন্ম দিসি আমি। তোর মতো পোলার দরকার নাই আমার। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা তুই। আমার মেয়ের শশুর বাড়ি, গ্রামের কারোর কাছে আমার মুখ রাখলি না তুই। কু**র বা’**! আমার সামনে থেকে যা না হলে আজ বাঁচবি না আমার হাত থেকে। আমার বাড়িতে তোর ঠাই নাই। আর জীবনে তোর এই মুখ আমারে দেখাবি না।’
আশফি, আশফির মা, নীরব, মাইজিন হতবাক। কিছুই বলার নেই এখানে তাদের। আশফি ভাইয়ের এহেন কাণ্ডে ভেঙে পরেছে খুবই। তার চেয়ে বড় কথা হলো তার বেস্টফ্রেন্ড এর এই গতি সে মানতে পারছে না! কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। বুকের ভেতর হওয়া হাহাকার ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ তার ভাই এরকম নোং’রা লোক? সামান্য প্রতিশোধ নিতে চেয়ে দুজন মেয়েকে এভাবে রাস্তায় নামিয়ে দিলো? কিভাবে পারলো এটা? আশফি তুলিকাকে দু হাতে আগলে ধরে মাটি থেকে উঠালো,
‘আজ থেকে তুই আমাদের বাড়িতে থাকবি। যেহেতু এই নোং’রা কাজ আমার ভাই করেছে সেহেতু তোর দায়িত্ব নিতে বাধ্য আমার পরিবার।’
ছিটকে সরে গেলো তুলিকা, ‘ ছাড় আমাকে। ওই পাপিষ্ঠদের বাড়িতে আমি যাবো? তোর পরিবারের সবাই পাপী। সুযোগটা পেলে আমাকে কম কথা শুনতে হয়নি তোর পরিবারের মুখে। তোর মা আর তোর জন্য আমি ওই বাড়িতে যেতাম। কিন্তু আজকের পর থেকে আমার দ্বারা সম্ভব নয় তোদের বাড়িতে যাওয়া। আমাকে দয়া দেখাতে আসিস না আশফি।’
আশফি ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো তুলিকার পানে। সে তুলিকাকে দয়া দেখাচ্ছে? অবশ্য এখন মেয়েটার যা অবস্থা এরকম রিয়েক্ট করাটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু বন্ধু হিসেবে তো তার দায়িত্ব আছে।সে শেষ নিঃশ্বাস অব্দি সে দায়িত্ব পালন করে যাবে সেটা তুলিকা না চাইলেও।
#চলবে