হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব-৭+৮

0
266

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব৭ (বোনাস পার্ট)
#রাউফুন

‘যদি আপনাকে স্বসম্মানে কেউ নিজের করতে চাই? আপনার এবং আপনার বোনের দায়িত্ব নিতে চাই তবে কি আপনি তাকে গ্রহণ করবেন? কোনো দয়া নয়! আমি আপনাকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করতে চাই যদি আপনি চান!’

মাইজিন শান্ত কন্ঠে দৃঢ়তার সঙ্গে বললো! হঠাৎ মাইজিনের এমন কথায় পরিবেশ হয়ে উঠে নিস্তব্ধ, থমথমে। সবার অবিশ্বাস্য চাহনি মাইজিনের উপর। তুলিকার এলোমেলো চুল কান্নারত অবস্থায় মুখে আষ্টেপৃষ্টে লেগে আছে। সে আলু থালু পায়ে এগিয়ে এলো মাইজিনের নিকট! ম্লান হেসে বললো,

‘আপনিও আমার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিতে চাইছেন মাইজিন?’

‘নাহ একদম। আপনার এটাই মনে হচ্ছে আমার কথা শুনে?’

‘আমার এই অবস্থায় আপনি আমার উপর সিমপ্যাথাইজার হয়ে এইসব কথা বলছেন এটাই মনে হচ্ছে!’

‘আর যদি বলি অন্য কিছু! আজ না হয় কাল এটা হতোই! হতেই হতো তবে? আমি আপনাকে বিয়ে করতামই তাহলে? হ্যাঁ হতে পারে এখন পরিস্থিতি টা অন্য। আপনার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তবে আই স্যোয়ার আমি আপনাকেই বিয়ে করতাম। তখন হইতো পরিস্থিতি এমন থাকতো না। হইতো রমরমা হতো পরিবেশটা। কিন্তু আপনাকে কথা দিচ্ছি আমি একদিন ঠিক সেইদিন আসবে।’

‘চুপ! চুপ! চুপ করুন। এখন সবাই আমাকে শুধু দয়া করতে আসছেন। আমার কারোর দয়া চাই না।’

‘তুলিকা,তুলিকা লিসেন, আমি শুধু আপনার সঙ্গে একবার আলাদা করে কথা বলতে চাই। প্লিজ না করবেন না।’

সবাই এই কথা শুনে তাদের একা ছাড়লো। যার যার মতো চলে গেলো আশফি মিষ্টিকে ধরে নিজের কাছে রাখলো। সবাই যেতেই স্বস্তি পেলো মাইজিন!

‘দেখুন তুলিকা, আমার পাশে থাকাটা যদি আপনার কাছে দয়া মনে হয় তবে আপনি আপনার মতো ভেবে নিতে পারেন। আর একটা কথা, যাকে পছন্দ করি, তার দুরবস্থার সময় যদি তার পাশেই না দাঁড়াতে পারি তবে সেটা কিসের ভালো লাগা! জানিনা সেটা কি, আমার আপনার প্রতি হওয়া অনুভূতি টা কি! আপনার প্রতি টান টা কেন হয় তাও জানি না। তবে এই মুহুর্তে আমি শুধু একটা কথায় জানি আপনার পাশে আমাকে দাঁড়াতেই হবে।’

‘আমি বিশ্বাস করি না এসব। ক’দিন পর সব ভুলে যাবেন। আপনারা বড়লোক মানুষ এসব ভুলতে সময় লাগে না। এই কথা গুলো যে দুদিন পর ভুলে যাবেন না তার কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই।’

‘আমি জানি এই মুহুর্তে আপনার পক্ষে কাউকে বিশ্বাস করা অসম্ভব! তবে আমি আপনাকে একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি এবং আপনাকে এই ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারি, বিয়ের পর আপনার অনুমতি ব্যাতিত আমি আপনাকে কখনোই স্পর্শ করবো না। আই প্রমিস। শুধু আপনাকে রাজি হতে হবে। আমি আপনাকে এই অবস্থায় একা ছাড়তে পারবো না বিশ্বাস করুন আমাকে। আপনার হাত ধরার কথা বলেছি যখন তখন সেই হাত আমৃ’ত্যু ধরে রাখবো।’

অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো তুলিকা মাইজিনের দিকে। তার গভীর চোখ দেখে তো মনে হচ্ছে না মানুষ টা মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে তাকে! সে কি বিশ্বাস করবে মানুষটাকে? মাইজিন দু ঠোঁট ভিজিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,

‘আমি যদি এমনি এমনি আপনার দায়িত্ব নিতে চাইতাম তাহলে আপনার কিন্তু আরও মনে হতো আপনাকে আমি দয়া দেখাচ্ছি। তাছাড়াও এখানকার সবাই আপনাকে খারাপ চোখে দেখতো, নানান জন নানান কথা বলতো। আপনার অসম্মান হোক এমন কাজ আমি কখনোই করবো না। আমাদের একটা পবিত্র সম্পর্ক হলে কারোর কিছু বলার থাকবে না। এমন কি আপনার আমার প্রতি অধিকার থাকবে, আর আমার আপনার প্রতি! একটা হালাল দায়িত্ব, কর্তব্য, ভালোবাসা সব কিছুই থাকবে শুধুই আপনার প্রতি! আপনি শুধু বিশ্বাস করুন আমাকে আর বিয়েতে হ্যাঁ বলুন! প্লিজ!আজই আপনাকে আমি বিয়ে করতে চাই!’

তুলিকা নিরব ভূমিকা পালন করছে। নিরবতাই সম্মতির লক্ষ্যন বলে ধরে নিলো মাইজিন। তারপরও ভয় হচ্ছে মাইজিনের। যদি রাজি না হয় তুলিকা? বেকে বসে তখন? মাইজিনকে পাশ কা’টি’য়ে আশফির কাছে গেলো তুলিকা। সে আশফির কাছে গিয়ে নিজের মতামত জানালো। তার এখন নিজের কথা ভাবলে চলবে না শুধু। মিষ্টির কথাও ভাবতে হবে। মিষ্টির দায়িত্ব নিতে চেয়েছে মাইজিন। মাইজিনকে তো কোনো ভাবেই বা’জে মনে হয়নি। তার কথাও মিথ্যা মনে হয়নি। সে না হয় ছোট বোনের জন্য একটু খানি আত্মস্থ হলো। নিজের আত্মসম্মান একটু খোয়ালো। তাতে ক্ষতি কি?

একেবারে গ্রাম নয় আবার শহর ও নয় আশফির বাড়ি। এখানে যেমন একাধারে তিন চার তলা বিশিষ্ট পাকা দালান আছে তেমনই টিনের চালা দিয়ে ফ্লোর করা, মাটিরচাপ দিয়ে পেইড় করা ঘরও রয়েছে। আশফির বাড়ি মেইন রাস্তায়। রাস্তা অভার করে দশ মিনিট গেলেই তুলিকার বাড়িটা ছিলো। এক কি দুই কাঠা জমিতে তুলিকাদের ছোট্ট টিনের চালায় উঠানো এক রুম বিশিষ্ট ঘরটা আজ আর নেই। যদিও সেটা তাদের নিজেদের ছিলো না। এক বৃদ্ধ মানুষের ছিলো। যাকে তুলিকা বুড়ো দাদু বলে ডাকতো। দাদুর নাতী-নাতনী, ছেলে-মেয়ে কেউ-ই ছিলোনা। তাই তিনি নিজের ঘরে এই দুটো মেয়েকে থাকতে দিয়েছিলেন ভালোবেসে!

তুলিকা তখন সবে সবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে। রেজাল্টের পর অনার্সে ভর্তি হয়েছে সে সময় তার জীবনে নেমে আসে দুর্যোগ! মিষ্টির বয়স তখন আট-নয়। ক্লাস ফোর এ পড়ছে। তার বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। হুট করেই একদিন তার বাবার হার্ট অ্যাটাক করে হার্ট ব্লক করে মা’রা যান। বাবার পেনশনের টাকা মায়ের নামে আসতে থাকে বাবার মৃ’ত্যু’র পর। তার বাবার জমিজমা বলতে তেমন কিছুই ছিলো না। এদিকে লাখ দেড়েক ঋণ মাথার উপর ছিলো। ভিটেমাটি বিক্রি করে মা আসলেন মামাদের বাড়ি এই গ্রামে। মোটামুটি ভালোই চলছিলো তাদের তিনজনের সংসার। বাবার পেনশনের টাকা আসছে বলেই হইতো মামা-মামিরা তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। অনার্স ফাইনাল এক্সাম পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি আসে তুলিকা। সময়টা গ্রীষ্মের শেষ দিকে। বাবার শোকে মা শয্যাশায়ী ততদিনে৷ মায়ের শিয়রে বসে তুলিকা।মেয়ে তার পাশে বসেছে মা বুঝতে পেরেই বলেন,

‘আমার আর সময় নেইরে মা। আমার মিষ্টিকে দেখে রাখিস। আমি বেঁচে থাকতে তোদের কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারলাম না রে। আমার শরীর তো আর ভালো যাচ্ছে না। আমায় যে তোর বাবা ডাকছে রে!’

শেষ তার মায়ের নিঃশ্বাস সেদিন রাতেই ফুরিয়েছিলো। মা যেনো বুঝতে পেরেছিলেন তার আর সময় নেই। মামা মামিরা বুঝেছিলেন মা বাবা ছাড়া তো পেনশনের টাকা আসবে না তাই তাদের আসল রুপ ও বেরিয়ে এলো। আর তাদের বাড়ি থেকে দূর দূর করে বের করে দিলো। তারা এতোই অভাগী যে মহাবিশ্বে তার আর আপন কেউ-ই রইলোনা। এদিকে তারা দুই বোন বাবা-মা হারিয়ে নিঃস্ব-এতিম, কোণঠাসা হয়ে গেলো একদম! আশফি ছিলো তার স্কুল ফ্রেন্ড। যেহেতু পাশাপাশি গ্রামেই তাদের বাড়ি ছিলো। তাই সেইম স্কুল, কলেজ, সেইম ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে। আশফির কথা মতোই তারা এখানে আসে। বুড়ো দাদুর বাড়িটাই ঠাঁই হলো তাদের। দাদুর সেবা যত্নের অভাব রাখেনি তুলিকা। কিন্তু বুড়ো দাদুও তাদের একলা করে চলে গেলেন। বছর খানেক আগে বুড়ো দাদু গত হয়েছেন। সেদিন খুব পরিমাণে ভেঙে পরেছিলো সে। তাদের ভালোবাসার মতো যে সত্যিই আর কেউ-ই রইলো না। গ্রামে আসার পরই দুটো প্রাইভেট পড়াতে শুরু করছিলো তুলিকা। দু-বাড়ি থেকে পাঁচশো পাঁচশো করে এক হাজার টাকা পেতো। তাও তারা মাস গেলে ঠিক মতো টাকা দিতে চাইতেন না। গড়িমসি করতেন টাকা দিতে৷ একটা কোচিং পড়াতো তুলিকা। সেখান থেকে আসতো দু হাজার টাকা। তিন হাজার টাকায় তো তাদের চলতোই কোনো রকমে কিন্তু এখন? বাস-স্থানও রইলো না। নিঃসঙ্গতার আরো এক ধাপ বারলো।

খুব ধুমধামে না হোক। রাতের মধ্যেই মাইজিন আর তুলিকার বিয়েটা হয়ে গেলো। আশফি ভীষণ খুশি এবং কৃতজ্ঞ স্বীকার করে মাইজিনের কাছে। সে ভেতর থেকে দগ্ধ হচ্ছিলো তার বেস্টফ্রেন্ড এর এই অবস্থা দেখে। মাইজিন আশফিদের থেকে বিদায় নিয়ে রাতেই একটা বড় বাড়িতে গিয়ে বাসা ভাড়া নিলো। কারণ তুলিকা কোনো ভাবেই আশফিদের বাড়ি থাকবে না এটা সে জানে। এই বাসাটা তার বন্ধুর বাসা তাই সহজেই ভাড়া পেয়ে গেছে। আর আসার সময় সবাইকে বলে এসেছে যাতে তাদের বিয়ের ব্যাপারে এখনই তার বাড়িতে না জানানো হয়। সময় সাপেক্ষে, রয়েসয়ে মাইজিন নিজেই বাড়িতে জানাবে। এখন জানালে বাড়িতে কে কি রকম রিয়্যাক্ট করতে পারে সেটা তো তার জানা নেই। যদি কেউ-ই বাজে বিহেভিয়ার করে এতে তুলিকার খারাপ লাগবে! কষ্ট পাবে তাদের ব্যবহারে। তাই সে কাউকে জানালো না তাদের বিয়ের ব্যাপারে!তুলিকাকে এখন এখানেই রাখবে কিছুদিন তারপর জানাবে সবটা!

#চলবে

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব৮
#রাউফুন

আপাতত রুমে কোনো আসবাবপত্রই নেই। রাতটা কিভাবে কা’টা’বে সেটাই ভাবছে মাইজিন। এখন রাত এগারোটা বাজে। পে’টে কিছুই পরেনি কারোরই। মাইজিন তুলিকাকে অনেক্ষন থেকেই পরখ করে চলেছে। মেয়েটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। মুখ শুকিয়ে কেমন পাংশুটে হয়ে গেছে। মাইজিন তুলিকার একটু কাছে আসতেই চট করে সরে দাঁড়ালো।

‘উম এতোটা অশান্ত কেন হচ্ছেন আপনি? এতো বিচলিত হবেন না প্লিজ! আমি একটু বাইরে যাচ্ছি আপনি মিষ্টির খেয়াল রাখবেন। তারাতাড়ি ফিরবো!’

তুলিকা আলতো করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাই। মাইজিন যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। এই মুহুর্তে সে খুব করে চাইছিলো একা থাকতে। অস্বস্তি হচ্ছিলো মাইজিনের উপস্থিতিতে। তাদের বিয়েটা যেভাবে হয়েছে তাতে কি এতো সহজেই সবটা ঠিক হবে? সব কিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। মাইজিন তো তখন বলেছে তার অনুমতি ব্যাতিত স্পর্শ করবে না। তবুও এখন সে তার বিবাহিত স্ত্রী৷ সম্পুর্ন অধিকার আছে মাইজিনের তার উপর! যদি বিয়ের আগের দেওয়া কথা ভুলে যায়। পুরুষ মানুষ তো, বলা যায় না।

এর মধ্যে তুলিকা আর মিষ্টি মিলে পুরো রুম গুলো সুন্দর করে মুছে ফেলেছে। তিনটা রুম, দুটো বেড রুম, মাঝখানে ড্রয়িংরুম আর রান্না ঘর রয়েছে। দুটো রুমেই আলাদা আলাদা ওয়াশরুম আছে। রান্না ঘর সহ তিনটা রুম পরিষ্কার করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। একটু জিরিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিলো তারা দুই বোন। অন্যদিন হলে হইতো মিষ্টি জেগে থাকতো না। কিন্তু আজকের নির্মম ঘটনা মন সাপটে গেঁথে রয়েছে তার মনে। আজকের ঘটনা কিছুতেই ভুলে উঠতে পারছে না দুজনের কেউ-ই। দু চোখের ঘুম কে’রে’ছে এই অগ্নি’কাণ্ড! রাত এক টা বেজে গেছে এখনো মাইজিন আসছে না ভেবে চিন্তা হচ্ছে তুলিকার। সে কি আর ফিরবে না? এখনো কেন আসছে না? বললো তো তারাতাড়ি ফিরবে? তাহলে এতো দেরি কেন হচ্ছে? দুই বোন ভয়ে গুটিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে। ভয় করছে এই মুহুর্তে খুব। তার তো একটা ফোনও নেই যে কল করবে। যদি তাদের এখানে একা ফেলে মাইজিন চলে যায় কি হবে তাদের? মনের মধ্যে নানান আজেবাজে চিন্তা ভর করছে তার। দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে তার এসব ভেবেই। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে কেমন যেনো!

মাইজিন যখন ফিরলো তখন রাত দেরটা বেজে গেছে। এতো রাতে কোনো দোকানই তেমন খোলা ছিলো না। আপাতত সে রাতের খাবার কিনে এনেছে। দুটো জাজিম (তোশক), চারটে বালিশ, বিছানার চাদর! আর কিছু হাড়ি-পাতিল! মাইজিনের কাছে আলাদা চাবি ছিলো সেটা দিয়েই ভেতরে এসেছে। তম্বন্ধে মাইজিনকে দেখতে পেয়ে তুলিকার জানে পানি এলো। সে তার মস্তিষ্কের সকল আজেবাজে চিন্তা ফোস করে উড়িয়ে দিলো বাতাসের সঙ্গে! কি না কি ভাবছিলো সে এতক্ষণ!

মাইজিন একটু হাসলো তুলিকার স্বস্তির শ্বাস ফেলা দেখে। সে জিনিস পত্র সব ঘর আনতে আনতে বলল,

‘ভয় পেয়ে গেছিলেন আপনি, আমার আসতে দেরি হচ্ছে বলে? কি ভেবেছিলেন আর আসবো না?’

‘ন-না আসলে এতো রাত হয়ে গেছে আপনি আসছিলেন না তাই চিন্তা হচ্ছিলো একটু!’

‘আসলে বাইরে যাওয়ার পর আমার মনে হলো ঘুমাবো কোথায় আমরা? তারপর এসব টুকটাক জিনিস কিনে ফেললাম। রাতে যা কিছু দরকার হবে সেগুলোই আর কি!’

তুলিকা “ঘুমাবো কোথায় আমরা!’’এই কথাতে আটকে আছে। মাইজিন আমরা বলতে কি তাদের দুজনকে বোঝালো না-কি? সে চুপ থাকলো। মাইজিন কিছু বললো না শুধু মুচকি হাসলো! সব কিছু আনা শেষ হলে ফ্রেশ হয়ে নিলো।

‘তুলিকা মিষ্টিকে নিয়ে আসুন খেয়ে নেবেন!’

মাইজিন, তুলিকা, মিষ্টি খেয়ে নিলো। আসার সময় গ্লাস, জগ, এক সেট মেলামাইন প্লেটও কিনে এনেছিলো। খেতে খেতে নিমজ্জিত হয়ে তুলিকা মাইজিনকে প্রশ্ন করে,’এএতো কিছু কিনলেন, নিশ্চয়ই অনেক গুলো টাকা লাগলো!’

‘এতো হেজিটেড কেন করছেন? আপনার বরের ধন-সম্পদের অভাব নেই, এটা একদমই সামান্য খরচ! তাছাড়া সংসার টা আপনার। আমার এবং এই সংসারের ব্যাপারে সবকিছু জানার অধিকার আপনার আছে। আজকে প্রয়োজনীয় সব জিনিস তো কিনতে পারিনি। কালকে সবকিছু পেয়ে যাবেন। আপনি একটা কাজ করবেন তো, আমাকে লিষ্ট করে দেবেন। না মানে আমি এসব ব্যাপারে ভীষণ অপটু!’

‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার থেকেও ভালো জানেন এসব ব্যাপারে। কত কিছু কিনে এনেছেন। এসব তো আমার মাথাতেই আসেনি।’

‘আপনার মাইন্ড এখন ডিস্টার্বড হয়ে আছে তাই এসব মাথায় আসেনি। খাওয়া শেষ করে শুতে আসুন!’

”শুতে আসুন!” কথাটাই আবার আটকে যায় তুলিকা। অদ্ভুত ঠেকছে তার সবকিছু। খাওয়া দাওয়া শেষ করে তুলিকা বিছানা করলো। দুটো রুমে দুটো জাজিম, চাদর বিছিয়ে বালিশ পেতে ঠিকঠাক করলো।

‘স্যরি তুলিকা। আজকের রাতটা একটু কষ্ট করে থাকতে হবে। কাল খাট কিনে দেবো। আমাকে ক্ষমা করবেন আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস দিতে পারলাম না। ক’ষ্ট পেতে দেবো না বলেও সে কথা রাখতে পারলাম না।’

‘না না কষ্ট কিসের। আপনি এভাবে বলবেন না! এর চেয়েও অনেক বেশি কষ্ট করেছি আমি আমার জীবনে। আমার কাছে এসব কিছুই না। আপনি এতো ভাববেন না আমাকে নিয়ে।’

‘আচ্ছা আপনি মিষ্টির সঙ্গে শুয়ে পরুন পাশের রুমে। আমি ওই রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পরছি!’

মাইজিন শুতে চলে গেলো৷ আর তুলিকা ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। কি অকপটে সবকিছু বললো মাইজিন। অথচ সে কি সব যা-তা ভাবছিলো। মানুষটা কি সত্যিই এতোটাই ভালো? কতটা নিদারুণ চাহনি মাইজিনের। তার গভীর কালো চোখ, কি পবিত্র চাহনী, যেনো রাজ্যের স্বপ্ন বোনা সেই দু-চোখে! কালো শার্টে তার লাল ফর্সা শরীর যেনো আরও কিছুটা লাল লাগছিলো তার কাছে। তার কথা কতটা মাধুর্যযুক্ত! তার আচার ব্যবহার, কথা-বার্তা শুনেই বোঝা যাচ্ছে সে কতটা সম্ভ্রান্ত ফ্যামিলির মানুষ! মাইজিনের মা তো তাকে পছন্দই করে না তিনি কি এই বিয়েটা মানবেন? যদি কোনো দিনও না মানেন তাদেরকে?সেদিনই তো তাকে কীভাবে চোর প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন মহিলা। এমন একজন ভালো মানুষের ওরকম মা হয় বুঝি? মাইজিনের বাবা আশফির বিয়েতে আসেন! মাইজিন কি তার বাবার মতো হয়েছে?

ভোর বেলায় তুলিকা উঠে বসে আছে। সকালে কি রান্না করবে? কিছুই তো নেই। এতক্ষণ দুটো মেয়ে গুটি শুটি মে’রে বসে আছে। খিদেতে পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো মিষ্টির।

‘এই বুবুজান খিদে লাগছে যে!’

‘চুপ করবি। নতুন বাসা কিভাবে কি করবো বুঝিস না? এরকম তো কতই অনাহারে থেকেছিস তবে আজকে কেন পারছিস না?’

মাইজিনের ঘুম ভাঙলো বারোটাই। ঝাপিয়ে উঠে মাইজিন। আল্লাহ! সে এতোটা কেয়ারলেস হলো কি করে? বাড়িতে দুটো মেয়ে আছে এটা সে কিভাবে ভুলে গেলো? দেরিতে ঘুম থেকে উঠা যে তার রোজকার অভ্যাস সেটা কিন্তু একদমই নয়। এমনিতে সে খুবই পাংচুয়াল! কিন্তু কাল রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে ভোর চারটে বাজে ঘুমিয়েছিলো। এই জন্য এখন এতো বেলা করে ঘুম ভেঙেছে। সে পাশের রুমে গিয়ে গলা পরিষ্কার করে তার উপস্তিতির জানান দিলো। তুলিকা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো মাইজিনকে! মুচকি হাসে তুলিকা। বিনিময়ে মাইজিন ও হাসে। সে লজ্জায় মাথা নত করে বলে,

‘আ’ম স্যরি এতো বেলা হয়ে গেছে। আপনাকে আবারও কষ্ট দিয়ে ফেললাম তুলিকা। আপনার বর একটা অপদার্থ ছেলে। কোনো দায়িত্বজ্ঞান নেই।’

‘আরে আপনি এতো ভাবছেন কেন?’

‘আমার খুব খিদে পেয়েছে মাইজিন ভাইয়া!’ বললো মিষ্টি।

তুলিকা মিষ্টির দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালে দমে গেলো মিষ্টি। মিষ্টির কথায় মাইজিনের খারাপ লাগা যেনো আকাশ ছুঁই ছুঁই। সে ম্লানমুখে বলে,

‘আসলে এতো বেলা অব্দি ঘুমোই না আমি। সকালে অফিস থাকে আমার। কিন্তু আজ কিভাবে যে**!’

‘সমস্যা নেই। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন! আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনার ঘুম হয়নি রাতে।’

‘আমি এতোটা নির্বোধের মতো কাজ করলাম কিভাবে? আপনি আমাকে একটু যদি ডেকে দিতেন।’

‘আমি ভেবেছিলাম আপনি বেলা অব্দিই ঘুমান তাই ডাকিনি।’

‘আমি একটু বাইরে যাচ্ছি আপনি প্লিজ একটু অপেক্ষা করুন।’

তুলিকা মাথা নাড়লো। মাইজিনের ভীষণ খারাপ লাগছে তুলিকা আর মিষ্টির শুকনো মুখ দেখে। নিশ্চয়ই অনেক খিদে পেয়েছে মেয়ে দুটোর। এখনো পর্যন্ত একদিন হয়েছে অথচ সে নিজের দায়িত্বে অপারগ! ছিঃ ছিঃ নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে সে । তুলিকার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলো না এই রকম একটা ভুলের জন্য।

‘তুই একটা দায়িত্বজ্ঞান হীন পুরুষ মাইজিন। দুটো মানুষের দায়িত্ব নিতে পারিস না আবার বড় বড় গল্প করিস! তুই একটা গা’ধা! ইররেস্পন্সিবল তুই মাইজিন সুলতান!’

যেতে যেতে নিজেকে হাজার টা বকা দিলো মাইজিন৷ সকালের খাবার খেয়ে মার্কেটে যেতে হবে। তুলিকা আর মিষ্টিকেও সঙ্গে নেবে। ওঁদের প্রয়োজনীয় সব জিনিস কিনে দিতে হবে!

#চলবে