#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১
আমাকে আজ বিয়ের পিড়িতে বসতে হলো; শুধুমাত্র নিজের বোনের স্বামীর জন্য। আমার সাজানো স্বপ্নটা হঠাৎ যেন কালবৈশাখী ঝড়ের দাপটে মুহূর্তেই তছনছ হয়ে গেলো। জীবনে প্রথমবারের মতো নিজের কাছে হেরে গেলাম। স্বপ্নগুলোকে দুমড়েমুচড়ে নষ্ট করে দিলাম শুধু একজন মায়ের কথা রাখার জন্য!
আমরা দু’বোন হলাম বাবা-মায়ের জমজ সন্তান। জন্মলগ্নের পার্থক্য দু-মিনিটের। তবে কে বড় আর কে ছোট সেটা আজ অবধি একটা রহস্য হিসেবেই রয়ে গিয়েছে। অর্নি আর আমার চেহারায় প্রচন্ড মিল। কিন্তু অর্নি ছিলো আবেগী, আর আমি বাস্তববাদী। কখনো কারো কাছ থেকে কিছুই লুকাইনি আমরা। সবকিছু শেয়ার করতাম একে অপরকে। তখন আমার বোন কিশোরী বয়সের আবেগে পুরোপুরিভাবেই ডুবে গেছে। ঘটনার শুরু সেখান থেকেই। কলেজে উঠার পরপরই আমাদের দুই ক্লাস সিনিয়র এক ভাইয়ের প্রতি অর্নি প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়লো। সেই বয়সটাতে ওর কল্পনার আকাশজুড়ে হাজার রঙের রঙধনুরা ভেসে উঠতো। সেই হাজার রঙের ভিড়ে একটা মুখের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলেই অর্নি লজ্জায় লাল-নীল হয়ে যেতো। সেই মানুষটা ছিলো সাঈদুল ফাইয়াজ ধূসর। আমি সবসময় ওকে বুঝাতাম, কিন্তু সে এতোটাই ধূসর ভাইয়ের রোগে আক্রান্ত যে সেখান থেকে ওকে বের করে আনা গেলোনা। খাওয়াদাওয়া, পড়ালেখা সবকিছুতেই ধূসর থাকবেই। আমি ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড বাস্তববাদী, তাই আবেগকে পশ্রয় দিইনি কখনো। আমরা দুজন ছিলাম বাবা-মায়ের আদরের সন্তান। আমাদের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা ছিলো অফুরান। এই বিষয়টি ফ্যামিলিতে জানাতেই ওরাও অনেক বোঝালো অর্নিকে, কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। ধূসরকে তার চাই-ই চাই।
প্রেম শব্দটার মানে তখনো আমি বুঝিনা, আমি অর্নির কান্ডকারখানা দেখে ওর প্রতি বিরক্ত হতাম। মেয়ের এই অবস্থা দেখে আব্বু-আম্মুর মনক্ষুন্ন হলো। কিন্তু আদরের দুলালি হওয়ায় শাসন করতে পারলেননা। যাইহোক, এভাবেই দিনগুলো চলতে লাগলো। ইতিমধ্যেই পুরো কলেজে রটে গিয়েছিলো অর্নির এই পাগলামোর খবর। ধূসর-অর্নি নামটা সবার মুখে মুখে। অথচ ওদের মধ্যে তখনো কোনো রিলেশন হয়নি। ফার্স্ট ইয়ারের শেষদিকে একদিন আমি ক্লাসে বসে নোট কালেক্ট করছিলাম, অর্নি মাঠে ছিলো। হঠাৎই এসে আমাকে জাপটে ধরলো। আনন্দে কাঁদছিলো। আমি ভড়কে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কাঁদছিস কেন?’
-ও আমায় প্রপোজ করেছে।
-কে?
-ধূসর!
-সত্যি?
-হুঁ।
আমি এতো অবাক হলাম যে বেশ কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলামনা। এও সম্ভব? লম্বা-ফর্সা, এটিটিউডওয়ালা সেইসাথে ব্রিলিয়ান্ট ধূসর ভাই আমার বোনটিকে প্রপোজ করেছে সে যেন এক বিরল ঘটনা। অবশ্য আমার বোন-ই বা কম কীসে? তারপর থেকে চলতে লাগলো ওদের রিলেশন। সবাই জানে, এককথায় ওপেন সিক্রেট হয়ে গিয়েছিলো ব্যাপারটা। আমার খুব বিরক্ত লাগতো এসব। সবসময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। তবে মাঝেমধ্যে ধূসর ভাইয়া আমাদের দুবোনকে গুলিয়ে ফেলতো। সেবার এক বৃষ্টিমাখা দিন। কলেজের ক্যান্টিন থেকে বেরুবার সময় ওনি হঠাৎই আমার হাত ধরে ফেললেন। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রক্তচক্ষু নিয়ে বললেন, ‘ফোন ধরোনা কেন? বেশি সাহস বেড়েছে? চড়াইয়া দাঁত ফালাবো তোমার।’
আমি আমতাআমতা করে বললাম, ‘কীসের ফোন?’
-কীসের ফোন মানে? তোমাকে কাল সারাদিন ফোন দিলাম, কাটলা কেন?
-আমিতো ফোন কাটিনি আর না আমার মোবাইলে কোনো কল আসছে।
ওনি ধমক দিয়ে আমার হাত মুচড়ে ধরে বললেন, ‘রিলেশনের চক্করে তোমার পড়ালেখা লাটে উঠছে। শোনো আগে পড়াশোনা তারপর বাকিসব। আর আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তাতেও এনোনা, তাহলে আগে তোমাকে খুন করে পরে নিজে মরবো বুঝলা?’
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তখন অর্নির কথা মাথায় আসতেই বুঝলাম ওনি আমাদের দুজনকে গুলিয়ে ফেলেছেন। আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার আগেই ওনি বললেন, ‘এখন ক্লাসে যাও৷ আর আমার কথাটা মাথায় রেখো। উল্টাপাল্টা কাজকর্ম করলে কি করবো নিজেও বুঝতে পারবানা।’
হুমকি ধমকি দিয়ে ওনি চলে গেলেন। আমি খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ক্লাসে এসে অর্নিকে কিছু জানালাম না। বাড়ি ফেরার পথে ঘটনাটা বলতেই ও হেসে কুটিকুটি। দুদিন যাবৎ ওদের ঝগড়া হচ্ছিলো। অর্নি ধূসর ভাইয়ের ফোন রিসিভ করছিলোনা আর মজার ছলে ব্রেকাপ করে দিয়েছিল। কিন্তু সে যে এটা এতো সিরিয়াসলি নেবে তা ভাবেনি।
তারপরের ঘটনা আমার আর জানা হলোনা। ওদের মিলমিশ হয়েই গিয়েছিলো হয়তো। তবে মাঝেমধ্যে এমন ভুল প্রায়ই হতো। আমি কিছু মনে করতামনা। যাইহোক, এভাবেই কাটতে লাগলো দিনগুলো। ওদের প্রণয় যেন আরও গভীর হচ্ছে। এতো ভালোবাসতে আমি কাউকে দেখিনি। দুই পরিবারেরই সম্মতি ছিলো সবকিছুতে। তাই কোনো বাধা ছাড়াই ধুমধামে ওদের বিয়ে দেওয়া হয়। সম্পর্কটাকে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে জুড়ে দেওয়া হয়। দুজনেই নিজেদের ভালোবাসাকে পেয়ে দারুণ খুশি ছিলো। বন্ধুমহলে ‘বেস্ট কাপল’ হিসেবে ওদের বেশ নামডাক ছিলো। বোনের সুখ দেখে আমিও খুব খুশি হয়েছিলাম। নিজের পড়াশোনায় উন্নতি, একটা চাকরি আমার সারাজীবনের স্বপ্ন ছিলো। তাই বাবা-মা দুবোনের বিয়ে একসাথে দিতে চাইলেও আমি রাজি ছিলাম না। তার বড় কারণ ছেলেদেরকে আমার একটুও বিশ্বাস হয়না। উপরে উপরে যতোই ভালোবাসা দেখাক, ভেতরে ততোটাই পশুর বাস মনে করতাম। এমনকি ধূসর ভাইয়ের প্রতিও আমার এই মনোভাব ছিলো। কেন জানিনা ওই একটা কারণেই বিয়ে নামক সম্পর্কতে আমার আস্থা নেই।
আমি আরুণী। সবাই আরু বলেই ডাকে। এবার অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। আর যার সাথে একটু আগে আমার বিয়ে হলো সে আমার বোনের স্বামী ধূসর। ওদের বিয়ে হয়েছে দু’মাসও হয়নি। ভালোবাসায় বাঁধা ওদের সেই সংসারে কোনোকিছুরই কমতি ছিলোনা। হাসি-আনন্দে কেটে যাচ্ছিলো দিন। কিন্তু ক্ষণস্থায়ী সেই সুখের কাছে পরাজিত হলো আমার বোনের ভালোবাসা। বিয়ে পরবর্তী সময়ে ঘুরতে গিয়েছিলো বান্দরবানে এক বন্ধুর বাসায়। সেখান থেকে ফেরার সময় একটা কার এক্সিডেন্টে আমার বোন অর্নি স্পট ডেড, আর গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার ফলে বেঁচে যান ধূসর ভাইয়া।
যখন এই খবর ওনাকে দেওয়া হলো মুহূর্তেই জ্ঞান হারান তিনি। দুদিন পর সেন্স এলে পাগলের মতো আচরণ করতে থাকেন। অর্নিকে তার চাই-ই চাই। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর সারাদিন দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন, নেশায় বুঁদ হয়ে রাতে বাড়ি ফিরেন। একমাত্র ছেলের এই দুর্দশা ওনার বাবা-মা মানতে পারছিলেন না। আর কোনো উপায় না পেয়ে আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো। আমার আব্বু-আম্মু চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা হারিয়েছে, মেয়েকে হারিয়ে তারা নিঃস্ব। আমি নিজের পাশাপাশি ওদেরকেও সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। যখন ধূসর ভাইয়ের বাবা-মা এই প্রস্তাব নিয়ে এলো আব্বু পুরো বিষয়টাই আমার মতামতের উপর ছেড়ে দেন।
আমি এই প্রস্তাব কিছুতেই মানতে পারলামনা। যতটুকু বুঝি অর্নিকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন ওনি। আর সেই ভালোবাসার ভাগ নিতে আমি কখনোই পারবোনা। তার উপর ওনাকে বিয়ে, প্রশ্নই ওঠেনা। আমি এই কথা ওনার বাবা-মাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ধূসর ভাইয়ের মা নিকিতা আন্টি আমার ঘরে এসে অনেক অনুরোধ করলেন। কান্নায় ভেঙে পড়লেন, এককথায় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
-আমার ছেলেটাকে একমাত্র তুমিই বাঁচাতে পারো মা।
-আমি কী করে আন্টি?
-তোমার আর অর্নির মধ্যে কত মিল, তুমিই ওর মতো ভালোবাসতে পারবে।
-এটা হয়না আন্টি। আমার বোনের ভালোবাসায় ভাগ বসাতে পারিনা আমি।
-আমার ছেলেটা নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। কাল রাতেও এক্সিডেন্ট হয়েছে একটা। এমনিতেই শরীরের কি অবস্থা এখন তো মনে হচ্ছে আর ওকে বাঁচানোই যাবেনা।
আমি ওনার কথা শুনে আঁৎকে উঠলাম। আন্টি কাঁদছেন, আর আংকেল অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। অর্নির কথা চিন্তা করে আমি নিজেকে সামলালাম, আম্মুও এই কথায় বললেন। আমি কোনদিকে যাবো দিশা পাচ্ছিলামনা। অবশেষে বিয়েতে রাজি হতেই হলো। একটা সাইকোকে এখন আমার সুস্থ করে তুলতে হবে! ভালোবাসার একি পরিণতি। অর্নি সত্যিই খুব ভাগ্যবতী ছিলো। আজকাল এরকম ভালোবাসা চোখেই পড়েনা।
ওদের কথা চিন্তা করে আমি রাজি হলেও ধূসর ভাই এই বিয়েতে রাজি হলোনা। নিকিতা আন্টি গলায় ফাঁস দিতে গেলেন, আংকেল নিরুদ্দেশ হওয়ার উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। এককথায় চাপে পড়ে আমার সাথে বিয়েতে ওনাকে রাজি হতেই হলো। দুদিন পর ঘরোয়াভাবে আমাদের বিয়েও হয়ে গেলো। সেইরাতটা আমাদের বাড়িতেই থাকতে বলা হলো। কিন্তু আন্টি রাজি হলেন না। ওনি পুত্রবধূ নিয়েই ঘরে ফিরতে চান। অগত্যা আমাকে সেদিনই শ্বশুরবাড়ি আসতে হলো। আমি বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই ধূসর ভাই আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। কিছু রিচুয়ালস পালন করে নিজের ঘরে চলে গেলো। নিকিতা আন্টি বেশ খুশি, কেঁদেই দিলো একসময়। আমি সান্ত্বনাসূচক কিছু কথাবার্তা বলে ওনাকে শান্ত করলাম। “মা” ডাকার জন্য অনুরোধ করলো আমায়৷ কিছু খাইয়েদাইয়ে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। সাজগোজ সব উঠিয়ে নিলাম। গোসল শেষে একটা হলদে রঙের সুতির শাড়ি পরতে দেওয়া হলো আমায়। আমার চুল ছিলো বেশ লম্বা। ভিজে চুলগুলো নিয়ে আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, শ্বাশুড়িমা রান্নাঘরে গিয়েছেন রাতের খাবার আনতে। সেই মুহূর্তে হঠাৎ আমার চুলে কে যেন জোরে একটা টান দিলো, আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে দেখলাম ধূসর। অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকাতেই ওনি আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বললেন, ‘তুমি অর্নি? আবার ফিরে এসেছো তাইনা? কিন্তু তোমার চোখে চশমা কেন? খুলো এটা…’
আমার চশমাটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেললেন। আমি হতভম্ব হয়ে ওনাকে দেখে যাচ্ছি। ওনার গলার স্বরে মাদকতা মিশে আছে। আমি বুঝতে পারলাম তিনি নেশাগ্রস্ত। আচমকাই ওনি আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে গাঢ় করে ঠোঁটে চুমু খেলেন। দুর্গন্ধে আমার বমি আসার উপক্রম। আমি একরাশ বিস্ময় নিয়ে ওনাকে ধাক্কা দিয়ে খাটের উপর ফেলে দিয়ে হাঁপাতে লাগলাম। ঠোঁট মুছতে গিয়ে দেখি রক্ত বেরুচ্ছে, কামড় দিয়ে কেটেই ফেলেছে একদম!
ওনি বিছানায় শুয়ে থেকেই হু হা করে হেসে বললেন, ‘আসো আমার কাছে অর্নি, আজ আর পালাতে পারবেনা…’
এতো দেখি পুরাই পাগল হয়ে গিয়েছে। এই সাইকো আমাকেই সাইকো বানিয়ে দেবে, একে আমি কীভাবে ঠিক করবো! অর্নির বিরহে বেচারা এতোটাই মেন্টালি সিক যে আমাকেই চিনতে পারছেনা? অদ্ভুত! ভাবনার মাঝেই উঠে এলেন ওনি। আমার চুলে হাত দেওয়ার আগেই আমি পেছনে সরে গেলাম। ওনি হঠাৎ আমার আঁচল টেনে ধরলেন। ধীরে ধীরে আমার দিকে এগুতে লাগলেন…..
চলবে