হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব-২১+২২

0
299

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২১]

পরেরদিন খুব ভোরে প্রচন্ড কোলাহলে সিদাতের ঘুম ভেঙে যায়। শান্তির ঘুম নষ্ট হওয়ায় সিদাতের কপালে কতশত ভাঁজ দেখা গেলো। ঘুম চোখে নিয়েই সে উঠে বসলো। পাশে মিরাজ কানে বালিশ চেপে ঘুমোচ্ছে। সিদাত আযানের ধ্বনি খুব কাছ থেকে শুনতে পেলো। যেন কাছাকাছি-ই মসজিদ।

সিদাত আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দরজায় কড়াঘাত শুনতে পেলো। হাত দিয়ে কোনো রকমে এলোমেলো চুল ঠিক করে সদাত গিয়ে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই একজন শ্যামবর্ণ, বেশ স্বাস্থ্যবান এক মধ্যবয়সী লোককে দেখতে পেলো। লোকটার মুখ জুড়ে অল্প অল্প দাঁড়ি এবং গাম্ভীর্য ভাব।

লোকটি একপলক সিদাতকে দেখে তার পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে গেলো। সিদাত এতক্ষণে লক্ষ্য করলো লোকটির হাতে চিকন লাঠি।মিরাজের কাছাকাছি গিয়ে তার গায়ে এটা দিয়ে চট করে মেরে দিলো। মিরাজ উপুড় হয়ে শুয়ছিলো। এজন্য বারিটা জায়গা মতো গিয়ে লেগেছে। মিরাজ আর্তনাদ করে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। বসলোও না ঠিক। বসার জায়গাতে গিয়েই লাঠির বারি লেগেছে। তরীর খালু কপট রেগে বললো,
–“বিয়াদব ছেলে! আযান দিচ্ছে আর তুই এভাবে মরার মতো ঘুমোচ্ছিস! কতবার বলেছি নামাজের সময় এভাবে পরে পরে ঘুমাবি না। ওঠ! এক্ষুনি আমার সাথে মসজিদে যাবি!”

মিরাজ সিদাতের সামনে ভীষণ লজ্জায় জর্জরিত হলো। মুখ ভার করে গলা দিয়ে উফফ, আঃ করতে করতে বললো,
–“সেটা তো সুন্দর করে বলে ওঠালেই চলতো। তাই বলে তুমি আমাকে লাঠি দিয়ে মারবে বাবা? তাও আরেকজনের সামনে!? এত বড়ো হয়ে গেলাম অথচ প্রাপ্ত সম্মানটুকু পেলাম না!”

তরীর খালু আবার লাঠি উঠাতেই মিরাজ সিদাতের থেকে মুখ লুকিয়ে পালালো। সিদাতের পাশ কাটিয়ে মধ্যবয়সী লোকটি যাওয়ার সময় বললো,
–“তোমাকে আমি সেভাবে চিনি না। তবে উঠে যেহেতু গিয়েছো, মসজিদে এসে নামাজটা পড়ে যাও!”

বলেই থমথমে মুখে বেরিয়ে গেলো। ভদ্রলোকের কথায় সিদাত আপত্তি করলো না। গায়ের টি-শার্ট চেঞ্জ করে বাইরে এসে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নিলো। অতঃপর সে দো’তলা থেকে নেমে বেরিয়ে গেলো। বেরিয়ে আসতেই দেখলো তার থেকে কিছুটা দূরে আকবর সাহেব মসজিদের দিকে যাচ্ছে। সিদাত তার পিছু পিছু গেলো। কারণ সে মসজিদের পথ চিনে না।

ফজরের নামাজ পড়ে আকবর সাহেব বেরিয়ে এসে জুতা পরার মুহূর্তে সিদাতকে দেখতে পায়। সঙ্গে দেখতে পায় তরীর খালু এবং মিরাজকেও। তাদের সকলকে দেখে আকবর সাহেব ভীষণ খুশি হলেন। সিদাত আকবর সাহেবকে দেখে ইতঃস্তত হয়ে পরলো। আকবর সাহেব তরীর খালুকে নিয়ে আগে আগে হাঁটতে শুরু করে।

সিদাত এবং মিরাজ পাশাপাশি হাঁটছে। মিরাজ অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
–“তখন যা দেখেছো সব ভুলে যাও।”

সিদাত বুঝলো মিরাজ কী বোঝাতে চেষ্টা করছে। সিদাত চাপক হাসলো। বললো,
–“আশপাশটা ঘুরে দেখাও, তারপর ভুলে যাবো!”

অগত্যা মিরাজ সিদাতকে নিয়ে বাড়ি না ফিরে আশপাশটা ঘুরাতে লাগলো। কিন্তু বেশিক্ষণ ঘুরাতে পারলো না। এর মাঝেই রাজিবের কল আসে। এখনই মিরাজকে ফিরতে হবে। মিরাজের সাথে সিদাতও ফিরে এলো।

———-
নাস্তার পরপর তরী, সাবিয়া, মৌসুমী সহ সব বোনেরা একসাথে ছাদে বসেছে। ছাদে ডেকোরেশনের কাজ চলছে। তরী এবং সাবিয়া মুখে মাস্ক পরে, মাথায় ঘোমটা টেনে বসে আছে। এ নিয়ে কয়েকজন কাজিন হাসি-ঠাট্টা করছে। একজন তো বেফাঁস বলেই ফেললো,
–“তরী এবং সাবিয়ার করোনা হইছে। সবাই ওদের থেকে দূরে দূরে থাকো।”

এতে সবাই যেন হাসিতে ফেটে পরলো। শুধু হাসলো না মৌসুমী সহ আরও দুই বোন। সাবিয়া তরীর হাত শক্ত করে চেপে বসে রইলো। আরেকজন বললো,
–“আরে না, না। আমাদের এই দুই বোন অনেক সুন্দরী তো! এজন্যে মুখ দেখাতে লজ্জা পায়।”

তরী তীক্ষ্ণ নজরে ছাদের ওপাশে কাজ করা লোকগুলোর দিকে তাকালো। ওরা কাজের ফাঁকে এদিকে তাকাচ্ছে। তরী হেসে বললো,
–“লজ্জা কেন পাবো বলো তো আপা? আমরা নিজেকে মূল্যবান মনে করি দেখেই নিজেদের পর্দার আড়ালে রাখি!”

এর বেশি কিছু বললো না তরী। এর বেশি বলা তার মানা। তরীর এ-কথায় সেই বোনের কেমন গা জ্বলে উঠলো। কিন্তু কিছু বললো না। তাদের মধ্যে আগে থেকেই নীরব যুদ্ধ চলছে। তবে তার ঠাট্টা নামক খোঁটার পরিবর্তে তরীও কিছু বলবে সেটা আশা করেনি।

তরীর মামা বাড়ি সহ বেশ আত্নীয়-স্বজন তাদের পরিবারের মতো না। তাদের তরী বা তার পরিবার কিছু বলে না। আকবর সাহেব আগেই বলে দিয়েছে, ওরা যা ইচ্ছা করুক সেই ব্যাপারে ওরা স্বাধীন। তাদের ব্যাপারে নাক গলিয়ে কিছু বলতে গেলে নিজের নাক কাটা যাবে। এজন্যে যে যেমনই হোক, খুব নম্রতার সাথে মিশতে বলেছে। শুধু তোমাকে নিজের জায়গায় ঠিক থাকলেই চলবে। তরী এবং সাবিয়া তার বাবার কথা রাখতেই তাদের সাথে নম্রতার সাথে মিশছে। তবে মৌসুমী জানে তার ফুপি, ফুপা, বোনগুলো কেমন। এজন্যে মৌসুমী ওই বোনকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়। যেহেতু বোনেদের মধ্যে মৌসুমী সবার বড়ো, সেহেতু মৌসুমীর কথায় তরীকে আর কিছু বললো না। মৌসুমীর হবু বরকে নিয়ে নানান আলাপ করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। এর মাঝেই ওদের মধ্যে একজন বলে ওঠে,
–“চা খেতে ইচ্ছে করছে। তরী, যা তো চা করে আন আমাদের জন্যে। তোর হাতের চা খেতে ইচ্ছে করছে।”

তরী সম্মতি জানিয়ে সাবিয়াকে সাথে নিয়ে নিচে নামলো। নিচে আসতেই মৌসুমীর খালাকে দেখতে পায় সে। সেই মহিলা পান চিবুতে চিবুতে সাবিয়া এবং তরীকে দেখছে। ঠেস মেরে বললো,
–“ঘরের মধ্যে এমন মুখ ঢেকে চলাফেরা করতেছো কেন? কোনো সমস্যা হইছে?”

তরী নেতিবাচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
–“না, কোনো সমস্যা নেই!”

মহিলা এবার তরীর মাথা থেকে পা অবধি দেখলো। মুখ কিছুটা কুচকে ফেললো সে।
–“বিয়ে বাড়িতে মেয়েরা এরকম বেশভূষায় থাকে নাকি? সুন্দর সাজগোছ, শাড়ি, জামা পরে ঘুরবা তা না!”

সিদাত তাদের পিছে দিয়েই যাচ্ছিলো তখনই মহিলার কথাগুলো শুনতে পায় সে। এক মুহূর্তের জন্যে থেমে যায় সে। একপলক তরীর দিকে তাকালো। তরী শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিদাত ভারী অবাক হলো। তরী যেভাবে চলাচল করছে তা খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু এই মহিলার কথায় এত তাচ্ছিল্য কেন? ভেবে পেলো না সিদাত।

তবে সে তরীকে বিব্রত করতে চায় না। সে চটজলদি পা চালিয়ে চলে গেলো। রান্নাঘর থেকে তৎক্ষণাৎ তরীর মামী ছুটে এলো। তার বড়ো বোন কে সামলে বললো,
–“থামো আপা। কাকে কী বলছো? ওরা আমাদের কামরুন আপার মেয়ে।”

মহিলা বুঝতে পারলেন। কিছু অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
–“ওহ!”

বলেই মহিলা চলে গেলো। মামী অমায়িক হাসি দিয়ে বললো,
–“আমার আপার কথা কিছু মনে নিও না। সে একটু অন্যরকম। তোমরা বলো, কিছু লাগবে?”

তরী বললো,
–“আমি চা বানাতে চাই মামী। আপুরা সবাই খেতে চাইলো!”
–“আমি-ই তো কত চা বানালাম, আলাদা করে আবার বানানোর কী দরকার? তোমরা উপরে যাও। আমি চা পাঠাচ্ছি!”

তরী কিছু বললো না। ছাদে না গিয়ে সাবিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আশেপাশে ঘুরবে দুই বোন।

দুপুরের দিকটায় তরী রাজিবদের পুকুরের সামনে এসে দাঁড়ালো। পুকুরের অন্য পাশে ছেলেরা একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ভীষণ গরম। এই গরমে সব কাজের ভাড় রাজিব তাদেরকেই দিয়েছে। ওদের মাঝে মিরাজ এবং সিদাতকেও দেখা যাচ্ছে। তরী, সাবিয়ার পিছু পিছু মেয়েরাও এসে পরেছিলো। মেয়েদের দেখতে গিয়ে তরীর এক কাজিন তার পাশের ছেলেটাকে ধাক্কা দেয়। যার ফলে সে গিয়ে দুম করে পুকুরে পরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ হলো। অতঃপর হাসিতে ফেটে পরলো সকলে। তরীও হাসলো। দিই পাড়ে হাসির রোল পরে গেলো।

এভাবে আরও কয়েকজন পরলো। হাসির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। মিরাজ সাহস করে সিদাতকে ধাক্কা দিলে সিদাত মিরাজের হাত ধরে ফেলে। যার ফলে মিরাজকে নিয়েই সে পুকুরে পরলো। সিদাতের পুকুরের পানিতে জুবুথুবু অবস্থা। সাবিয়া এই দৃশ্য দেখে আরও বেশি হাসিতে ফেটে পরলো। মেয়েরা হাসতে হাসতে বলছে,
–“দেখ, দেখ! এই আরজেও পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। মিরাজ বেচারা অন্যকে ফেলতে গেলে নিজেও পরে গেলো। হায়রে কপাল!”

যোহর অবধি তাদের হাসা-হাসি মজা-ঠাট্টা চলছে। যোহরের আযানের আগেই মেয়েরা ভেতরে চলে গেলো। আর ছেলেরা যোহর অবধি পুকুরে ডুব দিয়ে গোসল সেরে নেয়।

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২২]

দিয়ার সামনের সোফায় তার দুজন কাজিন বোন বসে আছে। দুজন অবাক চোখে নজর বুলাচ্ছে চারপাশে। বাড়ীর প্রতিটি কোণে কোণে যেন সৌখিনতা জ্বলজ্বল করছে। লিপি বলে উঠলো,
–“তোর কী ভাগ্য রে দিয়া। এত বড়ো শ্বশুরবাড়ি!”

দিয়া ওদের দিকে শূন্য নজরে চেয়ে রইলো। থমথমে সুরে বললো,
–“যদি সিদাতের জন্যে তোমরা এসে থাকো তাহলে তোমাদের লাক আসলেই খারাপ। সিদাত সচরাচর বাড়ি থাকে না। আজও নেই!”

লিপির পাশে বসা সুমির মুখখানা ভার হয়ে গেলো এ-কথা শুনে। লিপি হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
–“কে বলেছে আমরা সিদাতের জন্যে এসেছি? ওর তো শুনেছি গার্লফ্রেন্ড আছে। নিজের মুখেই বলেছিলো। আমরা এসেছি আমাদের বোনের সাথে দেখা করতে। নাম্বার কেন বন্ধ করেছিস?”

দিয়া বিরক্ত হলো। ওদের এসব মধু ভরা কথা দিয়ার গায়ে বিঁধছে। এজন্য দিয়া বেশি কথা বাড়ালো না। খুবই নরম গলায় বললো,
–“আমি এখন ভার্সিটি যাবো। তোমরা আসতে পারো!”

লিপি দিয়ার এ-কথা শুনে চরম অপমানবোধ করলো। রেগে-মেগে উঠে দাঁড়ালো। সুমিকে টেনে দাঁড় করিয়ে বললো,
–“চল তো সুমি! বড়োলোক বর পেয়ে তার অহংকার বেড়ে গেছে। এর সাথে দেখা করতে আসাটাই ভুল হয়েছে!”
–“কিন্তু আপু সিদা..”

লিপি সঙ্গে সঙ্গে চোখ রাঙানি দিলো বোনকে। সুমি দমে গেলো। দিয়া বাঁকা হেসে বললো,
–“আমার ভাব বরাবরই একটু বেশি আপা। তা কী তুমি ভুলে যাও? আমার আম্মু-আব্বুর সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করার দরকার নেই। আল্লাহ্ হাফেজ!”

ওরা চলে গেলো দিয়াকে গা* দিতে দিতে। ওরা চলে যেতেই দিয়া দারোয়ানকে কল দিয়ে বললো, ওদের দেখলে যেন ভেতরে ঢুকতে দেওয়া না হয়। দিয়া অনেক সহ্য করেছে। এরা যে কখনো ভালো হবার নয় তা দিয়া হারে হারে বুঝেছে। মা-বাবাকেও নিষেধ করে দেয় যাতে ওরা কেউ দিয়ার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা চাইতে আসলে যেন তাদের ঠিকানা না দেয়। বাবা-মা নরম মানুষ। ভুলভাল বুঝিয়ে তাদের মানিয়ে নিলেও দিয়া এত নরম নয়। আপনজনরা যে ঘা এখনো দিয়ে যাচ্ছে সেটা দিয়া নীরবে গিললেও সহ্য করবে না।

ফিরোজা খাতুন আসলো হাতে নাস্তা নিয়ে। সোফা খালি দেখে ভারী অবাক হলো। দিয়ার উদ্দেশ্যে অবাক সুরে বললো,
–“একি! মেহমান কোথায়?”

দিয়া হাসার চেষ্টা করলো। আর যাইহোক তাদের এই নিচু রূপ শ্বাশুড়িকে বলাটা অস্বস্থি জনক। এজন্য দিয়া সত্যটা চেপে বললো,
–“হঠাৎ-ই জরুরি কাজ পরে যাওয়ায় ওদের যেতে হয়েছে!”

ফিরোজা তার বানানো পায়েশ এবং নুডুলসের দিকে তাকালো। দিয়া সব বুঝতে পেরে ফিরোজার কাছ থেকে খাবারের টলিটা নিজের কাছে নিয়ে বললো,

–“চলুন ছোটো মা, আজ দুই মা এবং এক মেয়ে মিলে এগুলো খেতে খেতে আড্ডা দিবো!”

–“কিন্তু তোমার ভার্সিটি?”

–“আজ যেতে ইচ্ছে করছে না। আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে। আপনি-ই বলুন, আমার ভাগ্য কত ভালো। আমি একসঙ্গে দুই মা পেয়েছি!”

ফিরোজা সন্তুষ্টির সাথে হাসি দিলো। আসলেই বড়ো ছেলের বউ হিসেবে দিয়া পারফেক্ট। বড়ো বউয়ের মতোই তার কথা-বার্তা, সকলকে আগলে নেওয়ার মতো দারুণ ক্ষমতা আছে তার। এটা ফিরোজা অস্বীকার করতে পারবে না। তবে দিয়া এখনো নতুন। সে জানে দিয়া আপ্রাণ চেষ্টা করছে তাদের সাথে মানিয়ে চলার।

——————-
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পরপর সকল মেয়েরা সাজগোছে ব্যস্ত হয়ে পরে। আজ মেহেদী অনুষ্ঠান। রাজিব তার মেয়ের বিয়ের আয়োজনে কোনো কমতি রাখছে না। এজন্যে মেহেদী অনুষ্ঠানের ব্যাপারটাও সে হাসি-মুখে মেনে নিয়েছে। সাবিয়া তার মায়ের পাশে ঘুমোচ্ছে। কামরুন নাহার একটু চোখ বুজে শুয়ে আছে তাদের নির্ধারিত রুমে। আর আকবর সাহেব রাজিবের কাজে টুকটাক সাহায্য করছে।

সকলের চোখে ফাঁকি দিয়ে তরী পুকুর পাড়ে আসে। ওড়নায় আড়াল থেকে স্কেচবুক, ইরেজার এবং দুটি পেন্সিল বের করলো। চারপাশে তাকিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এখানে বিয়ে বাড়ির গ্যাঞ্জাম নেই। তাই একাকী এই পরিবেশের সাথে সময় কাটানোই যায়। সাজ গোছে কোনো কালেই তরীর আগ্রহ ছিলো না। এজন্য সে এভাবেই সময় কাটাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া অনেকদিন যাবৎ স্কেচটাও করা হয় না। প্রিয় সখ অনেকদিন না করলে হাসফাস লাগে, অস্থির অনুভব হয়।

তরী তার সম্মুখে থাকা পুকুরপাড় এবং তার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো গাছগুলোর স্কেচ করতে লাগলো। তরীর অধরে মুচকি হাসি। খুবই ফুরফুরে মেজাজে সে স্কেচ করছে।

একে তো ভিন্ন পরিবেশ, গরম-ঠান্ডা আবহাওয়া, তার ওপর আজ পুকুরে গোসল করেছে। এতসব সিদাতের শরীর মানতে পারেনি। তার ঠান্ডা লেগে যায় এসবের কারণে।

মিরাজ ওকে মেডিসিন এনে দিয়েছে। মেডিসিন বলতে জাতীয় ওষুধ, নাপা এক্সটিন। দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পরপরই একটা ট্যাবলেট খেয়ে নিয়েছিলো সে। কিন্তু তাও নাক সুঁড়সুঁড় করছে, কাশিটাও অল্প-স্বল্প থেকে গেছে। মিরাজ রুমে নেই। সে নিচে কাজে ব্যস্ত।

সিদাত রুমে থাকা বড়ো জানালাটার সামনে এসে দাঁড়ালো। দো’তলা থেকে গাছ-গাছালি দেখা যাচ্ছে। পুকুরের এক অংশও দেখা যায়। পুকুরে চোখ যেতেই সিদাত জাম গাছের নিচে কাউকে অস্পষ্ট দেখলো বোধহয়।

গায়ের জামাটার রঙ দেখেই বুঝতে পারলো এটা তরী। কিন্তু এই ভর দুপুরে তরী পুকুরপাড়ে কী করছে? মন কেমন খচখচ করছে। অস্থির অনুভবও হচ্ছে। সিদাত সেখানে না দাঁড়িয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। তরীর থেকে দূরে থাকাটাই শ্রেয়। তরীকে ভুলতে সে বাসায় কল লাগালো। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে তেমন নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য নিরুপায় সিদাত মোবাইল বিছানার একপাশে ফেলে ধপ করে শুয়ে পরলো। সিলিং ফ্যান ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। আর মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হচ্ছে তরীময় কল্পনা, ভাবনা।

রাতের বেলা ছাদে উচ্চস্বরে গান বাজছে। সাবিয়া মুখ ঘুচে বসে আছে রুমে। তরী তাকে নিজ হাতে মাস্ক পরিয়ে দিচ্ছে। সাবিয়া মৃদু গলায় বললো,

–“না গেলে হয় না আপু? আমার গান-বাজনায় অস্বস্থি হচ্ছে। আবার যদি আমাদের কেউ ব্যঙ্গ করে? আমার ভালো লাগে না তাদের কথা শুনতে। খুব গায়ে লাগে।”

তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো,
–“উপায় নেই। যেতেই হবে। তুই গান-বাজনা শুনেও না শোনার ভান করে থাকিস। আব্বার মত, আমরা কিছুতেই তাদের আনন্দে হস্তক্ষেপ করতে পারি না। আর কেউ কিছু বললেই বা কী? কারো কথাতেও কান দেওয়ার দরকার নেই। ওদের মুখ আছে, বলবেই।”

সাবিয়া চুপ করে গেলো। হয়তো তরীর কথাগুলো নিয়ে বারবার ভাবছে। তরী আরেকবার নিজেকে আয়নায় পরখ করে বললো,
–“চল। মৌসুমী আপা বোধহয় অপেক্ষা করছে!”

তরী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নিচে তাকাতেই দেখলো তরীর ফুপি, ফুপা, শাওন, সানিয়া এসেছে। ওদের দেহে তরীর চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠলো। ওরাও যে আসবে তরী তো ভাবতেই পারেনি। তরী ডাকলো শাওনকে। শাওন এবং সানিয়া তরীকে দেখতে পেলে ওরা খুশিতে ওই অবস্থাতেই উপরে এলো। সানিয়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তরীকে। সানিয়া কলেজের জন্যে হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করছে। এজন্য সে বাসায় সেরকম থাকে না। তরীকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই সানিয়া আহ্লাদী গলায় বললো,

–“কতদিন হলো তোমাকে দেখি না আপু। কেমন আছ?”

তরী মুচকি হেসে বললো,
–“ভালো। চল। উপরে যাই আমরা!”

শাওন ভ্রু কুচকে সাবিয়ার দিকে চেয়ে আছে। সাবিয়া শাওনকে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে,
–“কেমন আছো ভাইয়া?”
–“ভালো আছি। তবে তোর এই বেশভূষা অবাক করছে!”

সানিয়া তৎক্ষণাৎ শাওনের পিঠে দুম করে মা*লো। বয়সের তুলনায় শাওন সানিয়ার থেকে কিছুটা লম্বা হয়ে গিয়েছে। এজন্যে চুল টানার বদলে পিঠে-ই মা*লো। চোখ রাঙিয়ে বললো,
–“আজেবাজে কথা বললে আম্মার কাছে বিচার দিবো কিন্তু। সবসময় সাবিয়াকে খ্যাপাশ কেন?”

শাওন দাঁত কেলিয়ে হাসলো। সাবিয়া মাস্কের মধ্যেই গাল ফুলালো। শাওনটা আসলেই বেশি বেশি।

তরীর ফুপির সাথে রাজিবদের সম্পর্ক ভালো। এজন্যে রাজিব ওদেরকেও দাওয়াত দিয়েছে। এবং খুব করে অনুরোধ করেছে যেন বিয়ের প্রত্যেক অনুষ্ঠানেই তারা উপস্থিত থাকে। এজন্যে তারাও বারণ করেনি। ভাবলো কয়েকদিন এখানেই বেড়ানো যাক।

ছাদে আসতেই উচ্চস্বরে গান-বাজনায় তরীর মাথা ধরে গেলো। শাওনকে দিয়ে মিরাজকে ডেকে এনে গানের স্বর কিছুটা কমাতে বললো। মিরাজ তরীর সমস্যা বুঝতে পেরে গানের শব্দ কমানোর জন্য চলে গেলো। মিরাজ তরীর থেকে দুই বছরের বড়ো। মাস্টার্স প্রথম বর্ষে আছে সে।

সিদাত হেসে হেসে কথা বলছিলো। এমন সময় গেটের দিকে চোখ যেতেই সে কিছু থমকালো। বাহারী আলোয় তরীর চোখ জোড়া খুব সুন্দর লাগছে। তরীর চোখ নিভু নিভু, ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকানো। এতেই সিদাতের কাছে তরীকে অনবদ্য লাগছে। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নজর ফিরিয়ে নিলো। ঠিক তখনই সাবিয়া তরীকে খোঁচা দেয়। তরী ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো সাবিয়ার দিকে। সাবিয়া দূরে ইশারা করে মিনমিনে কন্ঠে বললো,

–“ওইযে দেখো আপু। সিদাত ভাই। এতক্ষণ তোমার দিকেই তাকিয়ে ছিলো!”

এ-কথা শুনে তরী কিছুটা চমকালো। সাবিয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে কিছুটা দূরে তাকাতেই সিদাতকে দেখতে পেলো। তরীর কিছু ভাইদের সাথে বেশ হাসি-মুখেই কুশল বিনিময় করছে। গায়ে তার বাদামী পাঞ্জাবি জড়ানো। সানিয়া হঠাৎ পাশ থেকে বলে ওঠে,

–“আরে ওটা আরজে সিদাত মনে হচ্ছে না? হায় আল্লাহ্! আমি কী স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তব? এই শাওন, আমাকে একটা চিমটি কাট তো!”

সাবিয়া চাপা হাসি দিলো। তার অবচেতন মনে আলাদা প্রশান্তি কাজ করছে। সানিয়া সিদাতকে সরাসরি দেখেই কুপোকাত। অথচ সাবিয়া এবং তরী তাকে প্রতিনিয়ত দেখেই চলেছে। মনের ভেতর নিজেদের বিশেষ মনে হলো।

শাওন সানিয়ার হাতে চিমটি না কেটে সিদাতের দিকে আগালো। সানিয়াও ঘোরের মধ্যে শাওনের পিছু পিছু চলতে শুরু করে। সানিয়ার জন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়ে তরী এবং সাবিয়াও তাদের পিছু নিলো। শাওন সিদাতের সামনে দাঁড়িয়ে না থেমে গড়গড় করে বলতে লাগলো,

–“হ্যালো ভাইয়া, আমি শাওন। মনে আছে আমাকে? আমার বোন আপনার উপর ইম্প্রেসড, আপনার নাম্বার চাইছে।”

সানিয়া কাছাকাছি-ই ছিলো। শাওনের শেষ কথাগুলো কানে প্রবেশ করতেই সানিয়া স্তব্ধ, হতবাক হয়ে পরলো। হুঁশ এলো তার। হা করে চেয়ে রইলো শাওনের দিকে। সে আবার এ-কথা কখন বললো? একেই বোধহয় বলে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা!

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]