হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব-২৩+২৪

0
297

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২৩]

মুহূর্তে-ই সিদাতের আশেপাশে থাকা ছেলেরা অর্থাৎ মৌসুমীর ভাইয়েরা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। সিদাত হতভম্ভ এরকম কথা শুনে। তরী বেশ চমকে তাকালো শাওনের দিকে। শক্ত গলায় শুধালো,
–“সানিয়া মোটেও এরকম কিছু বলেনি। কেউ হাসবেন না। শাওন মজা করছে।”

তরী থেমে গিয়ে গলায় আরও কিছুটা কাঠিন্য ফুটিয়ে শাওনের উদ্দেশ্যে বললো,
–“বোনকে সম্মান করতে না পারো, অন্তত মানুষের কাছে তাকে হাসি পাত্রী বানিও না!”

সানিয়া লজ্জায় সটান মে*রে দাঁড়িয়ে ছিলো। তরী সানিয়ার হাত ধরে অন্যদিকে চলে গেলো। তরীর কথাগুলো শাওনের কানে পৌঁছাতেই তার মুখ ভার হয়ে গেলো। সে তো শুধু মজা নিচ্ছিলো। তাই বলে তরী তাকে এত কঠিন কথা বলে গেলো?

তরী সানিয়ার মন ভালো করতে মৌসুমীর কাছে নিয়ে গেলো। মৌসুমীর আশেপাশে মেহেদী পরানোর জন্যে মেয়েরা রয়েছে। তাদের মধ্যে একজনকে তরী বললো যাতে সানিয়াকে মেহেদী পড়িয়ে দেয়। রাজি হলো সেই মেয়েটি। মুহূর্তে-ই সানিয়ার অধর জোড়া প্রসারিত হলো। তা দেখে তরীও হাসলো।

মৌসুমীকেও ভীষণ খুশি দেখা যাচ্ছে। মৌসুমীর খুশি দেখে তরী একটু শান্তি পেলো। মৌসুমী হাত দিয়ে তরীকে কাছে ডাকলে তার দিকে এগিয়ে গেলো তরী। মৌসুমী বললো,

–“জানিস, ঢাকা থেকে আমার ননদ, আর কিছু দেবর’রা আসছে। আমার দারুণ অনুভূতি হচ্ছে রে তরী! শুনেছি ওরা আমার বেনারসি, অলংকার, নানান প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব একসাথে আজ-ই নিয়ে আসছে!”

মৌসুমীর পাশে বসা মৌসুমীর সেই খালার মেয়ে আনিকা বললো,
–“কিছু ভাগ আমাকেও দিও আপু। না জানি কোন মার্কেট তুলে আনছে!”

মৌসুমী সে-কথা শুনে হেসে উড়িয়ে দিলো। এমন সময় সেই মেয়েটি-ই আবার বললো,
–“ওরা আসলে আমরা কিন্তু সবাই মিলে নাচবো! ঠিকাছে তরী?”

তরীর চোখ কপালে উঠে যায় এ-কথা শুনে। অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো আনিকার দিকে। নিজেকে ধাতস্থ করে হাসার চেষ্টা করলো। বললো,
–“আরে ধুর। কী সব বলছো?”

তরী সাবিয়াকে খোঁজার বাহানায় সেখান থেকে চলে এলো। গা ঘিনঘিন করছে তার। তরী যেতেই মৌসুমী ধমকালো আনিকাকে। বললো,

–“তরীকে নিয়ে সমস্যা কী তোদের? ওর পিছে কেন লাগিস? জানিস না ও ব্যতিক্রমধর্মী? কেন নিচু কথা বলে ওকে অস্বস্থিতে ফেলিশ?”

আনিকা হাসলো। পৈশাচিক হাসি। মৌসুমীর কথা গায়ে না মেখে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,

–“কাকে কী বলছো আপু? এই মেয়ে পর্দাশীল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী? আমার তো এগুলা কল্পকথা ছাড়া কিছুই মনে হয় না। এত প্রেক্টিসিং মুসলিম হলে কখনোই এত গান-বাজনা দিয়ে ঘুরে বেড়াত না। এগুলা হুদাই ঢং করে মানুষদের দেখানোর জন্যে। যাতে সবার নজর, আকর্ষণ অর দিকে যায়। শহুরে মেয়ের মতলব বুঝি না ভাবছো? হাহ্!”

মৌসুমী আবার ধমকালো। আনিকা শুনলো না। সে নিজের মতো বলেই যাচ্ছে। এসব বলে সে ভেতরটা নরম করতে চাইছে। যেন তার মন জুড়ে তরীর জন্যে নীরব ক্ষোভ পুষে রেখেছে। যা প্রকাশ করার মোক্ষম সুযোগ সে পেয়েছে। মৌসুমীর অপর পাশে বসা সানিয়া আনিকার দু’একটা অস্পষ্ট তিক্ত বাণী শুনতে পেলো। কিন্তু সে কিছু বললো না। মূর্খদের সাথে তর্কে জড়াতে নেই।

এশার আযানের ঠিক পরপর-ই মৌসুমীর শ্বশুরবাড়ি থেকে লোকজন এলো। তরী এবং সাবিয়া তখন নামাজ পড়তে নিচে চলে গেছে। আযানের সময় থেকে গান-বাজনা বন্ধ। রাজিব সাহেবের কড়া নির্দেশ, নামাজের সময় শেষ না হওয়া অবধি গান বাজানো যাবে না।

সিদাত দেখেছে আযানের সময় তরীকে হন্তদন্ত হয়ে নিচে চলে যেতে। কেন যাচ্ছিলো তা বোধহয় সিদাত ধারণা করতে পেরেছে। এজন্যে দু’একটা হাঁচি দিয়ে শাওনকে নিয়ে সেও মসজিদের উদ্দেশ্যে চলে গেলো। শাওন তো সেই খুশি। তার পছন্দের আরজে তাকে নিয়ে মসজিদে যাবে, একসাথে নামাজ পড়বে। এমন হলে শাওন বারবার মসজিদে যেতে রাজি।

তরী সালাম ফিরিয়ে খাটের দিকে তাকাতেই কিছুটা চমকে গেলো। খাটে বসে একটি অল্প বয়সী মেয়ে তরীদের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। তরী অপ্রস্তুত হয়ে নজর ফিরালো। মেয়েটি তরীর সম্পূর্ণ অপরিচিত। তরী চোখ বুজে মোনাজাত শেষ করে আবার খাটে তাকাতেই দেখলো মেয়েটি আগে মতোই চেয়ে আছে।

তরী জায়নামাজ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তার কিছুক্ষণ বাদে সাবিয়াও জায়নামাজ নিয়ে দাঁড়ালো। তরী মেয়েটিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারে মেয়েটি হয়তো সানিয়ার বয়সী। সাবিয়া মেয়েটির দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছে। অস্ফুট স্বরে বললো,

–“তোমাকে তো চিনতে পারলাম না!”

মেয়েটা হাসলো। বললো,
–“আমি সাদিয়া। মৌসুমী ভাবীর একমাত্র ননদ। তোমরা?”

তরী এবার চিনতে পারলো। আলতো হেসে বললো,
–“মৌসুমী আপু আমাদের মামাতো বোন!”

মেয়েটার চোখ-মুখ চকচক করে উঠলো। খুশি মনে আওড়ালো,
–“লম্বা জার্নি করে আমি ভীষণ ক্লান্ত। বলা বাহুল্য একটু অসুস্থ হয়ে পরেছি। বিশ্রামের জন্যে আমাকে এই ঘরে পাঠানো হলো। আমি রুমে এসে দেখি তোমরা দু’জন নামাজ পড়ছো। দেখতে কী যে ভালো লেগেছে। মনে হচ্ছে ক্লান্তি সব ধুঁয়ে মুছে সাফ!”

তরী আবারও হাসলো। সাদিয়ার সাথে ওরা দুজন পরিচিত হয়ে নিলো। সাদিয়া খুশি-মনে ওদেরকে নিজের সঙ্গী করে ফেললো।

ছাদে আসতেই আবারও গান-বাজনা শুরু হলো। সাদিয়ারা ঘন্টা দুয়েক থেকে আবারও রওনা দেয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। সাদিয়ার সাথে আসা ছেলেগুলো বড্ড উশৃঙ্খল ছিলো। তরীর তো ওদের মোটেও ভালো লাগেনি। তবে তরীর বোনে’রা হাসি-তামাশা করছিলো খুব।

সিদাত সারাদিন কোনোরকমে থাকলেও বাইরের ঠান্ডা বাতাসে তার গায়ে জ্বর বাঁধলো। ছাদে তখনো হৈচৈ চলছে। সিদাতের শরীর খারাপ লাগায় সে নিচে চলে এসেছে। বিছানা গা এলিয়ে দিতেই আর মাথা তুলে বসার মতো অবস্থা হলো না তার। কোনোরকমে পাঞ্জাবি বদলে একটি টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলো। উপরের সিলিং ফ্যানটা বন্ধ।

গান-বাজনায় আর থাকতে পারছিলো না তরী। মাথা অসম্ভব ব্যথা করছে তার। এজন্যে সাবিয়াকে মায়ের কাছে রেখে মৌসুমীর ঘরের দিকে যাচ্ছিলো পেইন কিলারের জন্যে। মৌসুমী জানিয়েছে তার ঘরে পেইন কিলার আছে। হঠাৎ সিদাতের ঘরে চোখ যেতেই দেখলো সিদস্ত কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ। চেহারাটাও কেমন শুকিয়ে আছে।

এর মাঝে সিদাত একবার হাঁচি দিলো, খুঁক খুঁক শব্দে কাশলো। তরী চেয়েও সিদাতকে এড়িয়ে যেতে পারলো না। সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে নীরবে পর্যবেক্ষণ করলো সিদাতকে। তবে তরী রুমের ভেতরেও প্রবেশ করলো না।

সানিয়া শাওনকে এড়িয়ে চলছে। বড্ড অভিমান জমেছে তার মনে। ছোটো ভাইটা এভাবে বেফাঁস কথা বলে তাকে এভাবে লজ্জায় ফেলবে বুঝতে পারেনি। এজন্য সানিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাওনকে এড়িয়ে চলবে। তবে শাওনের মোটেও এই ব্যবহার পছন্দ হচ্ছে না। বারংবার বোনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে সে।

–“এই আপু। শোন না!”

সানিয়া শাওনের ডাকে দাঁড়ালেও জবাব দিলো না। শাওন থেমে আবার বললো,
–“স্যরি আপু। আমি বুঝতে পারিনি আমার মজাটা এরকম হয়ে যাবে। আর কখনো করবো না এরকম মজা। প্লিজ কথা বল।”

সানিয়া ভারী গলায় বললো,
–“ব্যস্ত আছি। অন্য হাতের মেহেদী ওঠাতে হবে। পরে কথা বল!”

সানিয়া চলে গেলো। শাওন হতাশ নজরে সানিয়ার যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো। এমন সময় তরী চাপা স্বরে শাওনকে ডাকলো। বললো,
–“জলদি আসো। তোমার সাথে আমার কাজ আছে!”

তরী শাওনকে নিয়ে সিদাতের রুমের দরজায় দাঁড়ালো। শাওন ভেতরে গিয়ে সিদাতের গালে, কপালে হাত রাখলো। মুহূর্তে-ই সে চমকালো। অস্ফুট স্বরে তরীর দিকে তাকিয়ে বললো,
–“সিদাত ভাইয়ার যে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তরী আপু!”

তরী নামটা সিদাতের কান দিয়ে প্রবেশ করলো। কোনোরকমে চোখ মেলে চাইলো সে। নিভু নিভু নজরে এপাশ ওপাশ চেয়ে শেষে দরজায় তার নজর আটকালো। অস্পষ্ট গলায় শুধালো,
–“নিকাব রাণী!”

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২৪]

সিদাতের অসুস্থতায় সবচেয়ে বেশি অস্থির দেখালো রাজিব সাহেবকে। বড়ো মুখ করে সাঈদ সাহেবকে দাওয়াত দিয়ে এসেছে সে। সেখানে সিদাত এসেই এরকম অসুস্থ হয়ে পরবে তা বুঝতে পারেননি। বলা বাহুল্য, তিনি এ ব্যাপারে ভীষণ রকম দুশ্চিন্তায় ভুগছে। বারবার মনে হচ্ছে সে ঠিকমতো সিদাতের যত্ন নিতে পারেনি বিধায় সিদাত এতটা অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। নিজেকে নিজে কতক্ষণ দোষারোপ করলো। মৌসুমীর মামাতো এবার ডাক্তারি পড়ছে। তাই তাকে দিয়েই সিদাতের চিকিৎসা করিয়ে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। মিরাজ, শাওনের এই রাতটা মোটামুটি নির্ঘুম কাটলো। আকবর সাহেব এক দু’বার এসে খবর নিয়ে গেছে।

তরী শাওনকে সিদাতের দায়িত্ব দিয়ে আর এ-মুখো হয়নি। হওয়ার চেষ্টাও করেনি। শাওন সময়ের ফাঁকে ফাঁকে তাকে গিয়ে সিদাতের আপডেট দিয়েছে এই যা! ফজরের নামাজে তরী নিজের অজান্তেই মাবুদের কাছে বললো যাতে সিদাত সুস্থ হয়ে যায়। সিদাত যেমনই হোক, সে তো মানুষ। মানুষ, মানুষের জন্যে দোয়া করবে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অন্তত এই সুন্দর দিনগুলোতে কেউ সুস্থতা নামক নেয়ামত থেকে বঞ্চিত না হোক!

আকাশ মেঘলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পরছে। অদূর থেকে অস্পষ্ট বাজ পরার শব্দ আসছে। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টির অসম্ভব তীব্রতা ছিলো। মিনিট দুয়েক হলো বৃষ্টি কমে এসেছে। শীতল হাওয়ায় ডাল-পালা একে অপরের উপর আলতো ভাবে আছড়ে পরছে। দেখতে সুন্দর লাগছে। এই সুন্দরতম একটি সকালে রাজিব সাহেবের বাড়িতে চাপা, নীরব যুদ্ধ চলছে। ভোর সাতটা বাজছে। এখনো অনেক মেহমান ওঠেনি।

রাজিব সাহেবের চোখ-মুখ জুড়ে তীব্র রাগের আভাস। রাগে রীতিমতো থরথর করে কাঁপছেন তিনি। তার সামনে ভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তার বড়ো ছেলে আবির এবং আবিরের পাশে একজন অচেনা মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটির বেশভূষায় বোঝাই যাচ্ছে এই মেয়েটি-ই আবিরের বউ। যার জন্যে আবির তার পরিবারকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে মাস ছয়েক আগে পালিয়ে গেছে। একবারও চিন্তা করেনি তার বাবা-মা, পরিবারকে কোন অবস্থায় রেখে যাচ্ছে। রাজিব সাহেব নিজের ক্রো*ধ বহু কষ্টে সংবরণ করে চাপা হুংকার দিয়ে বললো,

–“বাড়িতে কেউ কিছু জানার আগে তুমি বেরিয়ে যাও। তোমার সাথে আমাদের কারো কোনো সম্পর্ক নেই। এই সম্পর্ক তুমি বহু পূর্বেই ইতি টেনে গিয়েছো! তাই ভালোয় ভালোয় বলছি ফিরে যাও!”

আবির কাতর স্বরে বললো,
–“ফিরে যেতে তো আসিনি আব্বা। আমি আমার পরিবারে নতুন সদস্য নিয়ে ফিরেছি। আমি সম্পর্কে ইতি টানিনি আব্বা। তবে কেন বারবার দূরে সরিয়ে দিচ্ছো? আমি তো পরিস্থিতির স্বীকার ছিলাম!”

রাজিব সাহেব কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন না।।হুট করেই যেন হাসি-খুশি মানুষটা খুব কঠিন হয়ে গিয়েছেন। ছেলের আকুতি, কাতর প্রবণতা কিছুই তার কান, মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারছে না। অদূরে আবিরের মা এতদিন পর বড়ো ছেলেকে দেখে নিজের আবেগ সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছে। চোখের বাঁধ ভেঙে গাল বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে তার। আবির তাও হাল না ছেড়ে রাজিব সাহেবকে মানাতে লাগলো। রাজিব সাহেবের সহ্য সীমা অতিক্রম করলে সে হুংকার ছাড়ে। সেই হুংকার শুনে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে উপস্থিত বড়ো’রা ঘটনাস্থলে আসে। সকলেই আবিরকে দেখে ভীষণ চমকিয়েছে।

ঘটনা হাতের বাইরে যাওয়ার আগে আকবর সাহেব ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় বসতে বললো। অতঃপর বৈঠকঘরে আলোচনা বসলো। রাজিব সাহেব একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই আলোচনায় উপস্থিত হয়েছে। আকবর সাহেব সর্বপ্রথম প্রশ্ন করলো আবিরকে। আবির প্রথম থেকে ধীরে-সুস্থে সবটা খুলে বললো। সে কোন অবস্থায় পালিয়েছে, এবং এতগুলো মাস কীভাবে কাটিয়েছে সবটা।

আবির মাস্টার্সের শুরুতে তার পাশে থাকা মেয়েটির প্রেমে পড়ছিলো। মেয়েটি তখন ছিলো সবে অনার্স ২য় বর্ষে। এরপর চলে দীর্ঘদিন প্রেম। আবির জামালপুরে চাকরি করলেও তাদের লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ সেভাবেই চলতে লাগলো। একসময় হুট করে জুঁইকে জুঁইয়ের পরিবার তার চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্যে উঠে পরে লাগে। এর কারণ জুঁইয়ের পরিবার জেনে গিয়েছিলো সে কারো সাথে সম্পর্কে জড়িত। আবিরের মধ্যে তেমন কোনো খাদ ছিলো না যার জন্যে কোনো মেয়ের পরিবার তাকে মেনে নিবে না। আবির যথেষ্ট সুশীল, সুপুরুষ। স্ত্রীর ভরণপোষণের জন্যে তার ভালো বেতনের চাকরিও ছিলো। কিন্তু জুঁইয়ের পরিবার সেসব দেখে, বুঝেও সম্মতি দেয়নি। এমনকি আবিরকে তার পরিবারকে নিয়ে আসার সুযোগও দেওয়া হয়নি। দু’দিনের মধ্যে বিয়ে।

আবির একপ্রকার অস্থির, ব্যাকুল হয়ে সেদিন রাতেই ঢাকায় চলে গেলো। পরেরদিন-ই ছিলো জুঁইয়ের বিয়ে। জুঁই বিয়ের কয়েক ঘন্টা আগেই পালিয়ে আসে সেই অবস্থা থেকে। আবির, জুঁইকে বিয়ে করে জামালপুরেই আসছিলো। কিন্তু পথিমধ্যে দু’জনের-ই ছোট-খাটো রোড এক্সিডেন্ট হয়। তবে জুঁই বেশি আহত হয়। তার বাম পা ভেঙে যায়। এজন্যে সে আর ঢাকা ছেড়ে আসতে পারেনি। আবিরের হাতের মোবাইলটাও রাস্তায় পরে ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। এজন্যে বাবা বা কারো সাথেই সে যোগাযোগ করতে পারেনি। আবির সেই সময়গুলো খুব কষ্টের সাথে কাটিয়েছে। জমানো যা টাকা ছিলো সেসব দিয়ে ছোটো-খাটো ঘর ভাড়ায় জুঁইকে নিয়ে থেকেছে। আবিরের এক বন্ধু এই বিপদের দিনগুলাতে পাশে থেকেছে। বন্ধুর ফোন থেকে বাবাকে ফোন দিতে গিয়েও পারেনি আবির, তার ভীষণ ভয় করছিলো বাবাকে বিয়ের কথা জানাতে। দুই মাস পর সাহস করে বাবাকে কল দিলেও বাবা কল ধরেনি। একবার রিসিভ করে শুধু বলেছিলো
–” আর কখনোই আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। আমাদের ছেলের কোনো অস্তিত্ব এই জগতে নেই।”
এরপর প্রায় প্রতিদিন বাবাকে কল দিয়ে তার অবস্থা বোঝানোর চেষ্টা করতো কিন্তু রাজিব কখনোই তার কল তুলেনি। এজন্য সে জুঁইয়ের সুস্থ হবার অপেক্ষা করতে থাকে।

সব শুনে উপস্থিত সকলে থ। আবির মাথা নিচু করে আছে। সে থমথমে গলায় বললো,
–“সে সময় বোধহয় বাবার জায়গায় বাবা ঠিক ছিলো, আর আমার জায়গায় আমি ঠিক!”

এ কথায় সম্পূর্ণ অস্বীকার করলো মিরাজের বাবা। সে খুব গম্ভীর গলায় বললো,
–“তুমি ঠিক ছিলে না। কঠিন মুহূর্তে বাবা-মাই বিপদে সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়। কিন্তু তুমি পালিয়ে তো গেছোই, বাবা-মাকে একবার সাহস করে বলোনি তোমার অবস্থান! তোমার বাবাকে আরেকজনের থেকে শুনতে হয়েছে তুমি এক মেয়েকে নিয়ে ভেগেছো। তুকি ফোন ধরোনি দেখে তোমার বাবা হাসপাতাল অবধি চক্কর দিয়ে এসেছে। এসব শুধুমাত্র তোমার ছোটো ভুলের জন্যেই হয়েছে!”

আবিরের থুঁতনি গলার সাথে মিশে যেতে চাইলো। চরম অনুশোচনা, অপরাধবোধ তাকে জর্জরিত করছে। সে তার এই অপরাধের শাস্তি এই কয়েক মাসে যথেষ্ট পেয়েছে। যতক্ষণ না বাবা তাকে ক্ষমা না করছে ততক্ষণ অবধি সে এই অপরাধবোধ হতে নিস্তার পাবে না।

এই অবস্থায় জুঁই হুট করে ঢুঁকরে কেঁদে ওঠে। সে আবিরের পাশ থেকে উঠে সোজা রাজিব সাহেবের পায়ের কাছে গিয়ে বসলো। খুবই আহত গলায় বললো,
–“আমি এখানকার দোষী। আমার জন্যে আপনি আপনার ছেলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন না বাবা। আমাকে যা শাস্তি দেওয়ার দিন। আমি ভুল করেছি, বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে পালিয়েছি। আপনার ছেলে পালায়নি, আপনার কাছে ফিরতে চেয়েছে। কিন্তু রবের ইচ্ছে অন্যকিছু-ই ছিলো। পরেরদিন-ই পা ভেঙে বিছানায় পরে গেলাম। দয়া করে সন্তানের এই অপরাধ ধরে তাকে দূরে সরিয়ে দিবেন না। নয়তো আমি বড়োই গুনাহগার হয়ে যাবো। দয়া করুন। আমাদের ক্ষমা করে দিন বাবা!”

মেয়েটির মুখ জুড়ে কী যেন এক মায়া ছিলো। এই মলিন মুখশ্রীর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতেই তার রাগ-ক্ষোভ কোথায় যেন উবে গেলো। গভীর চিন্তায় বিভোর হয়ে একসময় বললো,
–“উঠে দাঁড়াও। আবির, তোর বউকে নিয়ে তোর ঘরে যা।”

উপস্থিত সকলে রাজিব সাহেবের এমন ব্যবহারে যেমন অবাক হলো তেমন ভাবেই খুশি হলো। বিয়েটা যেমন করেই হোক, বিয়ে তো বিয়েই। এটাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। রাজিব সাহেব জানালো, আবির এবং জুঁইয়ের ব্যাপারটা মৌসুমীর বিয়ের পরেই বোঝা যাবে। এই মুহূর্তের জন্যে এসব আলোচনা মাটিচাপা দিতে বললেন তিনি। সকলেই সম্মতি জানালো এতে। আকবর সাহেব জুঁইয়ের মাথায় স্নেহের সাথে হাত বুলিয়ে চাপা গলায় বললো,

–“অতীতে যা ভুল ক্রয়ার করেছো, এখন তওবা করে আল্লাহ্ তা’য়ালার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিও। পারলে বাবা-মায়ের কাছেও ক্ষমা চাও। কোনো বাবা-মাই মেয়ের পালানোতে ঠিক থাকতে পারে না। তাদের প্রতিকূলতা বোঝার সাধ্যি তোমার নেই। তবে আশা রাখছি একসময় সব বুঝে যাবে!”

উৎসবমুখর পরিবেশ আরও উজ্জ্বল হলো। আবির তার নতুন বউ নিয়ে ফিরেছে, সাথে রাজিব সাহেবও তাদের মেনে নিয়েছে। এটা উৎসবের চাইতে কম কিসের? সিদাত রুমে বসেই টুকিটাকি শুনেছে। এক রাতের মধ্যেই সিদাতের জ্বর বেশ অনেকটা সেরেছে। এখন শুধু কিছুটা খাবারে অনিহা এবং খুঁক খুঁক কাশিটাই রয়ে গেছে। এগুলো যেন জ্বরের চিহ্ন। সিদাত সুস্থ-সবল অবস্থাতেই বেরুলো। মিরাজকে খুঁজে বের করে তার সাথে এলাকা ঘুরে বেড়ালো। সিদাতের মন বলছে এখন সে যথেষ্ট সুস্থতা অনুভব করছে। প্রকৃতির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সাধ্যি কার-ই বা আছে?

বাড়ি ফিরতেই কাকতালীয় ভাবে তরীর মুখোমুখি হয়ে যায় সিদাত। নিষ্পলক চেয়ে ছিলো তরীর চোখ জোড়ার দিকে। এতে তরী অস্বস্থিবোধ করে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এতে সিদাতের নিজের অজান্তেই অভিমান হলো। আনমনে বললো,

–“বড্ড পাষাণ তোমার হৃদয় নিকাব রাণী! একবারও অসুস্থ মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলে না সে কেমনে আছে? কেন এমন হতে হলো তোমাকে, বলো তো?”

পরমুহূর্তেই নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হলো সিদাত। সঙ্গে কিছুটা বিরক্তও হলো। জ্বরের সাথে সাথে তার মাথাটাও গেছে। এছাড়া চব্বিশ ঘন্টা তরী সিদাতের আশেপাশে ঘুরঘুর করলে সিদাত ঠিক থাকবেই বা কী করে? ইচ্ছে তো করছে এখনই ছুটে পালাতে এই বাড়ি ছেড়ে। কিন্তু সে আর কত পালিয়ে বেড়াবে?

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]