হৃদয়সিন্ধুর পাড়ে পর্ব-১৫

0
3058

#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব ১৫ [থ্রিলার+রোম্যান্টিক]
#কায়ানাত_আফরিন
.
২৩.সকালের এই সময়টা মৌনির কাছে লাগছে অনেক বিষাক্ত। সময়ের প্রবাহ যেন কোনো ক্রমেই কেটে উঠছে না। মৌনি কাচুমাচু করে সোফায় বসে আছে আর পাশে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে নিভ্র। মৌনির ঠিক সামনের সোফাতেই মুখোমুখি হয়ে বসে আছে ওর বাবা আশরাফ হাসান। চোখের দৃষ্টি বরাবরের মতোই তীক্ষ্ণ। আশরাফ হাসান মেয়ে মৌনিকে অনেক আদর করলেও মৌনি তাকে অনেক ভয় পায়। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে বলে কথা।
এদিকে মা পরী বানু আর বোন নিধাও বসার ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। মৌনির সাথে একটা ছেলেকে দেখে সবার মনেই বেশ প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আর এটাই স্বাভাবিক। নীরবতা কাটিয়ে আশরাফ হাসান মৌনিকে বললো,
.
—ছেলেটা কে মৌনি?
মৌনি নীরব। আসার আগে নিভ্র ওকে বলে দিয়েছিলো কোনো কিছুর উত্তর না দিতে। নিভ্র কিছু একটা ভেবে রেখেছে আর পরিস্থিতি সামলানোর জন্য নিভ্রই সব কিছু ম্যানেজ করবে। নিভ্র প্রচন্ড তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। কোন পরিস্থিতিতে ঠিক কি কথা বলতে হবে এ জ্ঞানটা নিভ্রর বেশ ভালো আছে। আর তাই মৌনি নিভ্রর ওপর আস্থা ছেড়ে দিয়ে নীরবে বসে থাকলো।
—আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি মৌনি? হঠাৎ করে তুমি এলে সাথে একজন ছেলেকে নিয়ে। কে ছেলেটা?
এবার ধমকের স্বরে বলে ওঠলেন আশরাফ সাহেব। মৌনি একটু ভয় পেয়ে গিয়েছে বাবার এমন ক্ষীপ্ত কন্ঠ শুনে। এবার নিভ্র বলে ওঠলো………
—আমি সামনেই বসে আছি আঙ্কেল। আমাকেই জিজ্ঞেস করতে পারেন।মৌনি ভয় পেয়ে যাচ্ছে আপনার ধমকের কারনে।
.
আশরাফ সাহেব বিস্ময়ের চোখে একবার মৌনির দিকে তাকালো তো একবার সামনে বসে থাকা সুদর্শন আর মার্জিত এই ছেলেটার দিকে। মৌনির ব্যবহারে হঠাৎ পরিবর্তনে তিনি যেমন হয়েছেন অবাক ঠিক তেমনি ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গিতে চোখে-মুখে ফুটিয়ে তুলেছেন বিস্ময়। ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গি আসলেই খুব সুন্দর। খুব সহজেই এমন তীব্র কন্ঠ দ্বারা পরিবেশ সামলে নেওয়ার ক্ষমতা আছে ছেলেটার মধ্যে যা আশরাফ সাহেব কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন। কিছুটা শান্ত হলেন তিনি। গম্ভীর কন্ঠে নিভ্রকে বললেন………..
—কে তুমি?
—আমি নিভ্র আহমেদ। পেশায় একজন সাইক্রেটিস্ট আর কিছুদিন হলো মেডিক্যাল কলেজে একজন লেকচারার হিসেবে জয়েন হয়েছি। আর আমি জানি যে আপনি আপনার পরিচয় জানতে চাননি। আপনি মূলত জানতে চেয়েছেন যে মৌনির সাথে আমার সম্পর্ক কি যা আপনি না বলা সত্ত্বেও আমি বুঝতে পেরেছি। সম্পর্ক এখনও আমাদের হয়নি তবে আমি মৌনিকে ভালোবাসি।
.
নিভ্রর নিঃসংকোচ কন্ঠ। আশরাফ সাহেব এবার অবাক । প্রচন্ড রকমের অবাক। এতটাই অবাক যে তিনি ফ্যালফ্যাল করে নিভ্রর দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি কখনও কোনো ছেলেকে এতটা আত্নবিশ্বাসের সাথে কথা বলতে দেখেননি। তাও আবার ভালোবাসার ব্যাপারে। মৌনির মা পরী বানু আর নিধাও এ দৃশ্য দেখে হতভম্ব। মৌনি মাথা নিচু করে বসে আছে।নিভ্র আসলে কি করতে চাচ্ছে কিছুই ওর মাথায় আসছে না। আশরাফ সাহেব এবার আরও গম্ভীর হলেন। নিভ্রকে প্রতিউত্তরে কি বলা উচিত এটা উনার মাথায় আসছেনা।তবুও কন্ঠস্বর কিছুটা ভারী রেখে নিভ্রকে বললেন………..
.
—তোমার সাহস আছে বলতে হবে। এভাবে খোলামেলাভাবে কখনও কোনো ছেলে আমার মেয়ের জন্য আমায় এ ব্যাপারে বলেনি। বেশিরভাগ সময়ে ছেলেরা তার প্রেমিকার বাবার সামনে এসে নার্ভাস হয়ে পড়ে। তবে তুমি ভিন্ন।
.
বিনিময়ে নিভ্র একটা সৌজন্যমূলক হাসি হাসে। আশরাফ সাহেব কিছুটা ইমপ্রেসড হয়েছেন নিভ্রর ওপর। ছেলেটার কথাবার্তা শুনেই বোঝা যাচ্ছে বেশ মার্জিত আর তীক্ষ্ণ বিচক্ষণতাসম্পন্ন মানুষ। মনে মনে নিজের মেয়ের জন্য এমন একটা ছেলেকেই তিনি চাইতেন। কিন্ত মৌনির ব্যবহারে কিছুটা হতাশ তিনি। বিগত চার মাস আগেও মৌনি ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলো। কিন্ত তখনকার মৌনি আর এখনকার মৌনির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। আশরাফ সাহেব ঠিক অনুমান করতে পারছেন না মৌনির সমস্যাটা কোথায়। নিভ্র উনার সব বিষয়ই পর্যবেক্ষণ করছিলো। হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে তার সমস্যাটা। তাই নীরবতা কাটিয়ে নিভ্র এবার বললো………
.
—আপনার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাচ্ছি আঙ্কেল ! সুযোগটা কি পাওয়া যাবে?
—অবশ্যই। আমার সাথে ছাদে এসো।
.
.
.
———————————————
আজ আকাশটা বেশ মেঘলা। সকালের এই সময়টা রৌদ্দুরের রশ্নিতে উত্যপ্ত হওয়ার কথা। কিন্ত মেঘের হাতছানিতে সেই উষ্ণতাটি এখন শীতলতায় রূপ নিয়েছে।বর্ষার মৌসুম বিধায় আশপাশ থেকে ধেয়ে আসছে বনফুলের আবছা ঘ্রাণ। মৌনির বাড়িটা আসলেই চমৎকার। একপাশে রয়েছে সুবিশাল দিঘি আর অপরপাশে গ্রামীন মেঠো পথ। সেই পথটা শেষে সুবিশাল প্রান্তরের সাথে মিশে যায়। ছাদেও বেশ কয়েকটা ফুলের গাছ রয়েছে। নিভ্রর ধারনা এগুলো সম্ভবত মৌনির স্কুল পড়ুয়া বোনটাই দেখাশুনা করে।
.
—কি বলতে চাও তুমি?
আশরাফ সাহেবের কথায় নিভ্রর তার দিকে মনোনিবেশ করে। উনি তাকিয়ে আছেন নিভ্রর দিকে। চেহারায় মোটামুটি বার্ধক্যের ছাপ পড়লেও প্রচুর কর্মঠ বিধায় একচুল পরিমাণও নুয়ে পড়েননি তিনি। নিভ্রর বিষয়টা ভালোলাগলো।
—মৌনির ব্যাপারে কথা বলতে চাই? (নিভ্র)
—মৌনির ব্যাপারে? কি কথা? (আশরাফ হাসান)
.
নিভ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো……………….
—মৌনি সুস্থ না আঙ্কেল। ও মেন্টালি ডিপ্রসড হয়ে আছে একটা রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারনে। এটাকে Disorder ও বলা যেতে পারে।
আশরাফ হাসান এবার হতভম্ব। যেনো নিভ্রর কথা তিনি বিশ্বা করতে পারছেন না। তবে কিছুক্ষণ ধরে পরিচিত এই ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছেনা যে সে অবিশ্বাসের পাত্র। কিছুটা ভাঙ্গা গলায় নিভ্রকে বলতে চেষ্টা করলেন,
—এসব………..কি ব-বলছো তুমি?
—আমি যা বলছি সবই সত্য আঙ্কেল। এই দেখুন রিপোর্ট।
নিভ্র নিজের সাথে থাকা ব্যাগের থেকে একটা রিপোর্ট এগিয়ে দিতেই আশরাফ হাসান কাঁপাকাঁপা হাতে সেই রিপোর্টটি নিয়ে নেন। রিপোর্ট পড়ে তিনি স্তব্ধ। নিজের মেয়ের এমন ভয়াবহ অসুস্থতা ক’জন বাবাই বা সহ্য করতে পারবে? আশরাফ সাহেব এবার ছাদে থাকা চেয়ারটিতে কিছুটা দুর্বল হয়ে বসে পড়েন।নিভ্র বরাবরের মতোই শান্ত।
—মৌনি জানে এ ব্যাপারে?
—জানে। তবে পুরো সত্য জানে না।
—মানে?
নিভ্র কিছুক্ষণ নীরব থাকলো। তারপর মিহি কন্ঠে বললো……….
—তিন মাস সময় আছে ওর কাছে। যদি ঠিকঠাকমতো চিকিৎসা না করা যায় তবে ওর মেমোরি লস হওয়ার চরম সম্ভাবনা আছে। শুধু তাই না ; যদি ও প্রেশার না নিতে পারে তবে লাইফ রিস্কও আছে।
.
টুপ করে আশরাফ সাহেবের চোখ দিয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। মেয়েটার জন্য বুক হাহাকার করে উঠছে তার। নিভ্রর কিছুই করার নেই। কিন্ত এসময় সান্তনা দেয়ার বদলে শক্ত থাকা প্রয়োজন। শুধুমাত্র মৌনির জন্য।
—আমি তাই মৌনিকে আপনাদের কাছে নিয়ে এসেছি যাতে ও কিছুটা হলেও টেনশন মুক্ত থাকতে পারে।
—মৌনির Disorder এর কারন কি?
—হঠাৎ এ প্রশ্ন?
—আমি জানি যে কোনো মানিসিক রোগ শনাক্ত হয় কোনো পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে। তাছাড়া আমি কখনও আমার মেয়েকে এতটা টেনশনে দেখিনি। ওকে সেরকম চাপের মধ্যেও বড় করিনি। তাছাড়া ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ও যে বিভাগে পড়ছে সে বিভাগটাও ওর রোগের সাথে সংযুক্ত না। তবে?
—ডেঙ্গু, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগের যেমন এন্টিভাইরাস থাকে ঠিক তেমনি ভাইরাসের ডোজও থাকে। কিছু অসৎ মানুষ তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষের ওপর এসব ভাইরাস প্রয়োগ করে। মৌনির এই Disorder এর জন্য ওর অজান্তেই এরকম একটা ডোজ দেওয়া হয়েছিলো।
—কিন্ত কেন? কে আমার মেয়ের ক্ষতি করতে চাইবে?
—সাংবাদিকতা এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে ঝুঁকি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। একটা বড় গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে মৌনির কাছে কিছু এভিডেন্স ছিলো। আর ঘটনাটি ছিলো সেটাকে কেন্দ্র করেই…………
এরপর একে একে মৌনির সব ঘটনা নিভ্র আশরাফ হাসানকে বলে। মৌনির পায়ে গুলি হওয়া থেকে শুরু করে ওর অস্বাভাবিক কাজকর্ম , হুট করে নিভ্রকে আক্রমণ , মৌনির কিডন্যাপ সবকিছু। মেয়েটার জীবনে এতকিছু হয়ে গিয়েছিলো যা আশরাফ সাহেব জানতেন না বিধায় একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। মেয়ে তো আর ভুল পথে যায়নি। বাবার ইচ্ছে পূরণের জন্যই মৌনি সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশুনা বেছে নিয়েছিলো। তবে কি এই ক্ষেত্রটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো মেয়েটার জীবনে?
—চিন্তা করবেন না আঙ্কেল ! আমি থাকতে মৌনির কিছুই হবে না। আমি ওর ট্রিটমেন্ট করবো। তবে এখন ওর ঢাকা যাওয়া কিছুটা রিস্কি। তাই এখানেই রেখে গেলাম। ওই জহির আর রিদান শেখকে আমি দেখে নিবো।
নিভ্রর কন্ঠে একরাশ তীক্ষ্ণতা আছে। যার জন্য কিছুটা হলেও আশরাফ সাহেব আশ্বস্ত হলেন। নিভ্র ছেলেটাকে তার ভালোলেগেছে। নিভ্রর আচার-আচরণ , বাচনভঙ্গি আর পরিবেশ সামলে নেওয়ার মতো ক্ষমতাগুলো সবাইকেই আকৃষ্ট করে তুলবে। মৌনির এই অগোছালো জীবনটাকে গুছিয়ে তুলতে নিভ্রর মতো একজন ছেলেই প্রয়োজন। তিনি কখনও ভাবতে পারেননি যে তার মেয়ের জন্যও এমন কোনো প্রেমিক থাকবে যে নিজের সর্বস্ব দিয়ে তাকে আগলে রাখলেন। নিভ্রর কাধেঁ একটা চাপড় দিয়ে মুচকি হেসে আশরাফ সাহেব চলে গেলেন নিচে।
নিভ্র তখনও সেখানে ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা অনুভূতিতে জর্জরিত হয়ে। মৌনিকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসলেও মনে একটা ভয় আছে। মৌনিকে হারানোর ভয়। হয়তো মৌনি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে কিন্ত নিভ্র জানে ও স্বাভাবিক না।
সময়টাও কেমন যেন বহমান। বৃষ্টির ছোট ছোট কণা নিভ্রর গায়ের ওপর পড়লেও নিভ্রর সেদিকে হুসঁ নেই। আনমনে নিভ্র বলে ওঠলো………..
.
—তোমার প্রতি প্রেমটা আমার তীব্র মৌনি। এতটাই তীব্র যে আমি চাইলেও যেই তীব্রতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো না। হয়তো আমাদের সম্পর্কের সূচনাটি বেশ অদ্ভুদভাবে হয়েছিলো। কিন্ত আমি চাই তোমায় আজীবন আঁকড়ে ধরে বাঁচতে।চাই অন্তিমে একে অপরের হৃদয়সিদ্ধুর পাড় হয়ে থাকতে।❤
.
.
.
~চলবে