#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব: ২৮
#কায়ানাত_আফরিন
৩৬.
সকালের আলো ফুটে ক্ষণে ক্ষণে শোনা যাচ্ছে পাখির মধুর ডাক। বাতাসের দাপটের শীতলতায়ও মৌনি উপভোগ করছে অজানা এক চরম উষ্ণতাকে। চোখটা পিটপিট করে খুলতেই কপাল কুচকে গেলো তার। মাথাটা হালকা উঠিয়ে বুঝলো নিভ্রর কাঁধে মাথা এলিয়েই স্বর্গের ঘুম দিয়েছে সে। মৃদু আলোর দাপটে নিভ্রর ঘুমন্ত মুখখানা অদ্ভুদভাবে বেশ মোহনীয় লাগছে।শুভ্র বর্ণের সুদর্শন এই ছেলেটার ঘুমন্ত মুখ যে কাউকে ঘায়েল করতে বাধ্য। কোনো এক লেখক মনে হয় ঠিকই বলেছিলেন যে , ”সেই নারীই সুখী যে কোনো নরের ঘুমন্ত চেহারা চরম ভাবে উপভোগ করতে পারে।”
মৌনি কাঁপাকাঁপা হাতে নিভ্রর মুখ আলতো করে ছুঁয়ে দিলো।কপাল থেকে নাক তারপর হাতটি এসে থামলো নিভ্রর ঠোঁটের কাছে। গতকাল মৌনি এই ঠোঁটগুলো কামড়ে অবস্থা খারাপ করে দিয়েছে। মৌনি কিছুক্ষণ লোভনীয় দৃষ্টিতে সেই ঠোঁটদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকলো পরবর্তীতে নিজেকে সামলে নেয়। বেশ অবাকও হয় সারারাত নিভ্রর সাথে বারান্দায় থাকার কারণে। আচ্ছা রাত্রি আর রোদেলাও তো ঘরে আছে তবে ওরা কি জানে যে নিভ্র বারান্দায়……………
ভাবতেই গালদুটো আপনা-আপনি লাল হয়ে গেলো লজ্জায়। মৌনি মিহি কন্ঠে তাই নিভ্রকে ডাকতেই নিভ্র উঠে গেলো। একেতো বারান্দায় ঘুমিয়েছে তারওপর মৌনির জ্বালাতনে শরীরটা কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে নিভ্রর। ঘুমুঘুমু কন্ঠে বলে উঠলো ,
–”প্লিজ মৌনি আর ডাকাডাকি করো না। আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে।”
মৌনির একটু গিল্টি ফীল হলো। এই ছেলেটাকে এত জ্বালাতন করে ও তবুও মুখ ফুটে নিভ্র কখনোই কিছু বলেনি। তাই নিভ্রকে বললো ,
–”আপনি গিয়ে খাটে শুয়ে পড়ুন। আমি দেখে আসি রাত্রি-রোদেলা উঠেছে কি-না।”
রাত্রি-রোদেলার নাম শুনতেই তড়িঘড়ি করে উঠলো নিভ্র । নিভ্রর এহেন কাজে মৌনি কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। নিভ্র তাই বললো ,
–”এখন মাত্র সকাল হয়েছে ওদের ডেকো না। আমি ফ্রেস হয়ে বাসায় লম্বা একটা ঘুম দিয় হসপিটালে যাবো। তাছাড়া আমি তোমার সাথে রাতে এখানে ছিলাম এটা কেউই ভালো চোখে দেখবে না। তাই আমি মুখ ধুয়ে এখনই চলে যাবো আর ওদের দুজনকে বলে দিও যে আমি রাত্রের দিকেই চলে গিয়েছি।”
নিভ্রর কথাটা যথেষ্ট যুক্তিসম্পন্ন। এমনভাবে মৌনি ভেবে দেখনি তাই নিভ্রকে প্রতিউত্তরে কিছুই বললোনা।
–”আমার ঠোঁটদুটোর মান ইজ্জত তুমি সব লুটে নিলে। এখন এসব নিয়ে বাইরে যাবো কিভাবে সেটাই ভাবছি।”
নিভ্রর বিদ্রুপ কন্ঠ। মৌনি ইতস্তত করে তাকায় নিভ্রর দিকে। নিভ্র একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে মৌনির দিকে তাকিয়ে আছে। মৌনি কান ধরে বললো,
–”সরি !”
নিভ্র এগিয়ে এলো মৌনির দিকে । তারপর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
–”এবার মাফ করলাম। কিন্ত যখন আমার পাল্লা আসবে ; তখন আর ছাড় দেবো না।”
এটা বলেই নিভ্র তড়িঘড়ি করে মুখ ধুয়ে চলে গেলো বাসা থেকে।নিভ্রর কথাগুলো এখনও যেন মৌনির কানে বেজে চলছে। মুখে ফুটে উঠেছে লজ্জার মিষ্টি আভাস !
৩৭.
সাড়ে ১১ টা বাজে। আশেপাশে তাকালেই দেখা যাচ্ছে হাজারো মানুষের ব্যস্ততা। ফেরিওয়ালা থেকে শুধু করে অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মচারী সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। তবে রিদান না। হসপিটালের পাশে একটা বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে একজন বিশেষ মানুষের অপেক্ষায় মগ্ন। এই ১০ মিনিটে প্রায় ১১০ বার ঘড়ির দিকে তাকালো কিন্ত সেই আগন্তুকের আসার নামগন্ধ নেই।
এরইমধ্যে এসে পড়লো রিদানের অপেক্ষার সেই কাঙ্খিত ব্যক্তিটা।রিদানের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
–”সরি এতক্ষণ ওয়েট করানোর জন্য। চেম্বারে আমার পেশেন্ট ছিলো তাই লেট হয়েছে। আমিই ডক্টর নিভ্র। নাইস টু মিট ইউ মিস্টার রিদান।”
রিদান তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে থাকলো নিভ্রর দিকে। আগে নিভ্রর পুরো বায়োগ্রাফি চেক করে এসেছিলো তাই নিভ্রকে চিনতে অসুবিধে হয়নি। ছেলেটার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ ছেলে যে বুদ্ধির বাহার। নিজের কথাবার্তা দিয়ে সহজেই যে কাউকে আকৃষ্ট করতে পারে। রিদান সবিনয়ে হাত মেলানো ওর সাথে। তারপর বললো ,
–”সিট হেয়ার !”
নিভ্র মুচকি হেসে রিদানের বিপরীত পাশে বসে পড়লো। রিদান নিভ্রর জন্যও একটা জুস অর্ডার দিয়ে কিছুক্ষণ নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নিভ্রর দিকে। কিন্ত নিভ্র নির্বিকার। তাই রিদান বললো ,
–”কি মনে হয় আপনার যে আমি কেনো আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছি?”
–”আপনি মিনস্টার জহির শেখের ছেলে । এন্ড বিজনেসম্যানও। আপনার আর আমার ক্ষেত্র একেবারেই আলাদা।এজ আ্য বিজনেসম্যান হয়ে আপনি কেন আমার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছেন তা আপনিই জানেন।”
–”আমাদের ক্ষেত্র আলাদা হলেও একজনের জন্য আমরা মুখোমুখি হয়ে বসে আছি। এন্ড ইউ নো দেট ভেরি ওয়েল।”
রিদানের ঝাঁঝালো কন্ঠ। তবে নিভ্র নির্বিকারভাবে বললো ,
–”জানি তো। আপনার কল পেয়েই তা আন্দাজ করছি। আমায় খুন করতে চাইলে আপনি কখনোই আমার সাথে কথা বলতে চাইতেন না। ডিরেক্ট আমার বাসায় এসে আমার ইন্নাল ইল্লাহ করে ফেলতেন। এখন বলতে পারেন ; কি জরুরি কথা?”
নিভ্রর স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় রিদান অবাক। কোনো কিছু বলার আগেই নিভ্রর আন্দাজ করার বিষয়টা আসলেই চোখ ধাধানোর মতো । রিদান এবার বলে উঠলো ,
–”মৌনির সাথে আমি কথা বলতে চাই।”
–”তো বলেন কথা। আমাকে ডেকেছেন কেনো?”
–”আমাকে দেখলে মৌনি রিয়্যাক্ট করবে তাই। দ্যাটস হোয়াই আই নিড ইউর হেলপ। আর আমি আপনাদের কথা সব জানি। মৌনির ”সিজোফ্রেনিয়ার” কথাও।”
–”আপনার কাজিন সিস্টার বলেছে। তাই না?”
–”হ্যাঁ।”
–”তাহলে তো এটাও জানার কথা যে আপনি কি করেছেন ওর সাথে। দোষ করেছে আপনার সো কল্ড মিনিস্টার বাবা , তার সাথে যুক্ত ছিলেন আপনিও আর শাস্তি দিলেন কাকে?একজন সাধারন জার্নালিজম স্টুডেন্টকে।”
–”আমি মানছি আমার মিস্টেক ছিলো সেগুলো। বাট আমি তা শুধরে নিতে চাই।”
–”প্রয়োজন নেই। মৌনি সুস্থ হয়ে গিয়েছে প্রায়। প্রতিটা সপ্তাহে চেক আপ হচ্ছে ওর। এখন আমি চাই না আপনার জন্য ওর আবার কোনো ক্ষতি হোক। আপনি নির্দ্বিধায় এখন আসতে পারেন।”
–”আমি জানি আপনি কি বলতে চাচ্ছেন বাট আই নিড ওয়ান চান্স। তারপর আর কখনোই আপনাদের সামনে আসবো না। চলে যাবো এখান থেকে অনেক দূরে। ”
–”মানে?”
নিভ্রর সন্দেহমূলক কন্ঠ। রিদান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো।
–” আমি আমার বাবার কাছে থেকে দূরে চলে যেতে চাই। অনেক দূরে। আমি চাই নতুনভাবে বাঁচতে । শুধুমাত্র মৃধার জন্য।”
–”মৃধা?”
–”হ্যাঁ। আমি হয়তো অনেক কাজ করেছি যা হয়তো ক্ষমার যোগ্য না। কিন্ত আমা এখন এসব ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে চাই মৃধাকে নিয়ে। তাই আমার মৌনির সাথে দেখা করা প্রয়োজন। একবার ভেবে দেখেন প্লিজ।”
নিভ্রর মাথায় খেলা করছে নানা প্রশ্নের খেলা। একে তো রিদানের ব্যবহারে এত পরিবর্তন আবার মৌনির সাথে দেখা করার জন্য নিভ্রকে প্রয়োজন ব্যাপারটা আঢ়লেই আশ্চর্যের। এতদিন নিভ্র শুধু জেনে আসছিলো যে , একজন অগোছালো মানুষকে গোছানোর জন্য প্রকৃতি ঠিকই একজনকে পাঠিয়ে দেয়।” আজ বিষয়টা হারে হারে সে টের পাচ্ছে। রিদান আর মৃধার জীবনবৃতান্ত দেখে।
৩৮.
সন্ধ্যে নেমেছে অনেকক্ষণ হলো। আশেপাশের প্রকৃতি নীরব। এটাই হয়তো বৃষ্টির পূর্বাভাস। রাত্রি বাসায় নেই। কোথায় গিয়েছে মৌনি জানেনা। আর সবেমাত্রই রোদেলা নিচের ফ্ল্যাটে গেলো শিমু চাচীর মেয়েকে পড়াতে। তাই সোফায় বসে একটা উপন্যাস পড়ছে মৌনি। আবহাওয়াটা ঠান্ডা। এসময়ে এক কাপ চা খেলে মন্দ হয়না। তাই যেই না রান্নাঘরে চা বানাতে যাবে অমনি বেজে উঠলো কলিংবেল।
রোদেলা এসেছে ভেবেই মৌনি তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দেয়। কিন্ত অবাক হয়ে মৌনি দেখলো নিভ্র দাঁড়িয়ে আছে।
–”একি ! এ অসময়ে আপনি? ”
–”একজন দেখা করবে তোমার সাথে।”
–”কে?”
নিভ্রর পেছনে মৌনি যা দেখলো তা দেখে পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেলো। রিদান আর মৃধা দাঁড়িয়ে আছে। মৌনি এখন যেনো অনুভূতিশূণ্য হয়ে পড়েছে। তাই আস্তে করে দু’পা পিছিয়ে গেলো। চোখে জল টলমল করছে। অনেকটা ভীত হয়ে গিয়েছে। নিভ্রর সাথে রিদানকে দেখে পরিস্থিতিটা একটা বিশাল প্রহেলিকার মায়াজালের মতো মনে হলো মৌনির। কেমন যেন দম বদ্ধকর পরিস্থিত। কাঁপাকাঁপা গলায় তাই বললো ,
–”র-র-রিদান?আপনি?”
.
.
.
~চলবে