হৃদয়ের সুখ আপনি পর্ব-০৩+০৪

0
310

#হৃদয়ের সুখ আপনি
#পর্ব-০৩+০৪
#Nishi_khatun

লাশ দেখতে এসে বিপদের পড়েছে রিমশা! কারণ সে যতোটা উৎসাহ নিয়ে লাশ দেখতে এসেছিল সে উৎসাহ সামনের উপস্থিত মানুষটা কে দেখে চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেছে।

তাদের সামনে দাইয়ান দাঁড়িয়ে আছে। এমন ভীরের মধ্যেও নিজের বাড়ির মহিলাদের চিনতে তার একটু দেড়ি হয়নি।

দাইয়ান কে দেখে ঝর্ণা ইলমা কে উদ্দেশ্য করে বলে,”ইলমা আফা! আপনার ভাই না তার নতুন বউ কোলে নিয়ে ঘুমেকাতুর ছিলো। তাহলে আমাদের আগে হেতি এইহানে আইলো কেমনে?”

ইলমা বিরক্তির সাথে বলে,

-“বেশি ডং করে কথা বলতে যাবি না। তাছাড়া ঝর্ণা তুই হয়তো ভুলে গেছিস ভাইয়ার বাইক আছে। তার বাইকে আসতে সময় লাগে না। যে হাওয়ার গতিতে বাইক চালিয়ে বেড়ায়। কেন যে রাস্তায় ঐ বাইকটা উল্টায় পড়ে না একদিন। তাহলে বুঝবে স্টাইলিশ বাইক চালানোর সাজা।”

ঝর্না বলে,

-“আফা আর এমন কথা বলেন না! আগে ভাইয়ের এক বউ ছিলো, এখন তার দুই বৌ! তার কিছু হলে বউ দুইটার কি হবে? তাছাড়া নতুন বউটার সাথে তার রোমান্স করা হইলো না ঠিকমত। ”

ইলমা বলে,”ঐ ইফা ডায়নীর কি হবে জানি না। ওদের রোমান্সের মুখেছাই! তবে হ্যা আমার কলিজার টুকরো ভাবীর জন্য আমি আছি। দরকার হয় আমি বিয়ে করে আমার জামাই এর সাথে রিমশা ভাবীর বিয়ে দিয়ে আমার সতীন বানায় রাখবো।”

ঝর্ণা দ্রুত ইলমার মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরে বলে,

-“আফা ভুলেও এমন কথা বলেন না আর। এক সতীনের জ্বালায় ভাবী সারারাত ঘুমাই না! তার উপর আপনার মনের এমন কূচিন্তা সম্পর্কে জানলে তো খবর আছে।”

ইলমা ঝর্ণা কে ফুসফুসিয়ে বলে,

-“ঝর্ণা রে! ভাবী আর ভাই সামনাসামনি এখন এখানে কী হবে তোর মনে হয়?”

ঝর্ণা বলে,”ঝড়ের সামনে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করতে নেই। নয়তো সে ঝড়ে আমরা হারিয়ে যেতে পারি। তা-ই যতোটা সম্ভব নিজেদের আড়ালে রাখি।”

এরপর দু জনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আসলে ওরা তিন জন বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছিল। রিমশা ওদের দু জনের সামনে ছিল। আর ওরা দুজন রিমশা’র থেকে একটু দূরত্ব রেখে পেছনে হাটছিল।
তা-ই রিমশা ওদের দু জনের ভেতরের আলোচনা সম্পর্কে অবগত নয়।

দাইয়ান রিমশা কে দেখে কঠোর আওয়াজে বলে,

-“তুমি এতো ভিরের মধ্যে এখানে কেন এসেছো? এখানে আসার অনুমিত দিয়েছে কে তোমাকে?”

রিমশা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,

-“এখানে উৎসুক জনতার মতো আমিও মরা দেখতে এসেছি। আর বাকিরাও হয়তো কারো থেকে লাশ দেখার অনুমিত নিয়ে আসে নাই? তা-ই না!”

দাইয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলে,

“আমি বাকিদের কথা জানতে চাইনি।
তুমি চেয়ারম্যান বাড়ির বউ হয়ে এখানে আশার সাহস কর কী করে?”

রিমশা বিরক্তির সাথে বলে,

-“আমার উপর অধিকার বোধ দেখাতে আসবেন না। আপনার যত খেজুরে আলাপ আছে সেসব না হয় আপনি আপনার বউ ইফার সাথে করবেন। আমার সাথে কোনরকমের কথাবার্তা না বললে খুশি হব।কারণ দ্বিতীয় বিয়ে করে আপনি স্বামীর অধিকার হারিয়ে ফেলেছেন।”

দাইয়ান বলে,”ছেলেদের চারটা বিয়ের অনুমিত আছে। আমি তো মাত্র দুইটা করেছি।”

রিমশা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,”ইসলামে চার বিয়ের অনুমতি দিয়েছে। তবে সেগুলো কিছু শর্তের সাথে। আপনি সে শর্তভঙ্গ করেছেন। আমার বিনা অনুমতিতে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। আমাকে স্ত্রীর অধিকার না দিয়ে দ্বিতীয় জনকে ভালোবাসর পরম সুখ অনুভব করাচ্ছেন। সেখানে আপনার সাথে কথা বলতেও ঘৃণায় আমার গা গুলিয়ে আসছে।

তারপর এক্সকিউজ মি বলে কঠোর অ্যাটিটিউডের সাথে দাইয়ান কে এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায় রিমশা। লাশের পাশে উপস্থিত পুলিশ কে সে প্রশ্ন করে,

-“স্যার লোকটা কিভাবে মারা গেছে সে সম্পর্কে কিছু জানতে পারলেন?”

লাশের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কেস ইনভেস্টিগেশন অফিসার রিমশা’র দিকে তৃক্ষণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জবাব দেয়,

-“পুরুষাঙ্গ কেটে খুন করা হয়েছে।”

রিমশা উদ্বিগ্নচিত্তের সহিত বলে,

-“এর আগেও আমাদের গ্রামের খালপাড় থেকে এমন পুরুষাঙ্গ কাটা দুইটা লাশ পাওয়া গেছিলো। তাহলে এই লোকটাও তাদের মতো খুন হল। এই তিনটা খুন কি কোনভাবে একজনের করা?”

ঠিক সে সময় দাইয়ান রিমশা’র হাত ধরে বলে,

“মেয়েমানুষের এতো গোয়েন্দাগিরি করার দরকার নেই। খুনের তদন্ত করার জন্য পুলিশ আছে। তুমি দ্রুত স্থান ত্যাগ করো।”

রিমশা দাইয়ানের হাত থেকে নিজের হাত ঝামটা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

“আমিও গ্রামের একজন সদস্য।
তা-ই আমারও সব কিছু জানার পূর্ণ অধিকার আছে।”

রিমশা আবারো পুলিশ কে প্রশ্ন করে,

“আচ্ছা অফিসার লাশটা কার সে সম্পর্কে কিছু জানতে পারলেন? ”

অফিসার বলে,

-“হ্যা! লোকটার নাম রতন শেখ! আপনাদের পাশের গ্রামের গার্লস স্কুলের টিচার উনি।”

এমন সময় ঝর্ণা এসে বলে,

-“যে রতন শেখ রে খুন করছে ভালোই করেছে। বেডা এক নাম্বারের লুইচ্চা ছিলো। মেয়েদের শরীরে স্পর্শ কাতর স্থানে স্পর্শ করতে একটু লজ্জা পেত না। জানো ভাবী আমি কিন্তু এইবার পরিক্ষা দেয়নি এই স্যারের জন্য। তোমাকে যে স্যারের কথা বলেছিলাম এইটা সেই স্যার! ”

পুলিশ তখন বলে,”আমাদের মনে হচ্ছে কোন ঠাণ্ডা মাথার সিরিয়াল কিলারের কাজ এগুলো। সে বেছে বেছে মেয়েদের সাথে অন্যায় করা লোকদের শাস্তি দিচ্ছে।”

রিমশা বলে,”যে এসব কাজ করছে ভালোই করছে। এদের লাশ দেখে বাকিদের উচিৎ নিজেদের চরিত্র ঠিক করে নেওয়া। নয়তো বলা যায় না চতুর্থ লাশটা আবার কার পড়ে থাকে এখানে।”

দাইয়ান তখন ইলমা আর ঝর্ণার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তা দেখে ইলমা আমতাআমতা করে বলে,

-“ভাবী চলো আমাদের রতন স্যারের বাড়িতে যেতে হবে। তার বাড়ির সদস্যদের শান্তনা দিতে হবে।”

রিমশা বলে,”শান্তনা দিতে যেতে হবে সে কথা কে বলেছে?”

ইলমা – একটু আগে বড় ভাবী কল করেছিল। সে বলেছে আমরা যেখানে-ই থাকি দ্রুত যেনো বাড়িতে ফিরে যায়। কারণ বাড়ির সবাই রতন শেখের বাড়িতে যাবে। আব্বা আমাদের কেও সঙ্গে যেতে বলেছে।

রিমশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”আচ্ছা আব্বা যখন বলেছে তখন তো যেতেই হবে।
কি আর করার খালপাড়ে রতন শেখের লাশের তামাশা মন ভরে দেখা আর হলো না এই আরকি।”

এরপর তিনজন সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করে।

তখন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার বলে,

-“কি জানেন তো মিস্টার দাইয়ান। আপনাদের গ্রামে এটা দিয়ে তৃতীয় খুন হলো। তিনজনের পুরুষাঙ্গ কেটেছে। আর একই স্থান একিভাবে লাশ ফেলে রেখেছে। খোঁজ খবর নিতে গেলেই জানা যায়!
তাদের চরিত্রের সমস্যা ছিলো। আচ্ছা আপনার কি মনে হয়? কেউ একজন ইচ্ছা করে বেছে বেছে এই খারাপ লোকদের খুন করছে? দেখুন না। আজ আপনাদের পাশের গ্রামের রতন শেখ খুন হলো। তার আগের দু জন আপনাদের গ্রামের মানুষ ছিলো। আর সেই লাশ দেখতে আর কেউ না আসলেও আপনার পরিবারের মেয়েরা ঠিকি আসে। আচ্ছা কোন ভাবে আপনার পরিবারের কেউ জড়িত নেই তো এঘটনার পিছনে? বলাত যায়না তাদের কেউ একজন হয়তো সিরিয়াল কিলারের সাথে সম্পর্কিত!”

দাইয়ান এবার রাগী দৃষ্টিতে অফিসারের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

-“দেখুন অফিসার! অযথা মিথ্যাচার করে আমার পরিবারের মানসম্মান নষ্ট করার চেষ্টা করবেন না। তাহলে আপনাদের জন্য এটা খুব ভালো হবে না। নিজেদের কাজ ঠিকমতো করতে পারেন না, আবার এসেছেন আমার পরিবারের দিকে আঙ্গুল তুলতে। আপনাদের আগের দুইটা কেস এখনো অমীমাংসিত সেগুলোর আসামি কে ধরুন। আমার পরিবারের সদস্যদের মিথ্যাচার করে আসামি বানাতে আসবেন না।”

অফিসার মুচকি হাসি দিয়ে বলে,

-“কি যে বলেন মিস্টার দাইয়ান সাহেব। আপনি নিজে একজন ল’য়ার হয়েও এভাবে আইনের লোকদের সাথে কথা বলছেন? আমাদের কাজ সবাইকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দেখা আমরা সে কাজ করছি। এখানে আপনার মোটেই এভাবে রাগারাগি করাটা উচিৎ নয়।”

দাইয়ান ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলে,

“হ্যা! আপনাদের নিজেদের কাজ ভালোমতো করলেই খুশি হব। আর আমার পরিবারের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিপাত না করলেই খুশি হব।”

অফিসার বলে,

”কী করব বলেন, খুনের তদস্থলে সবাইকে সন্দেহের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা আমাদের একমাত্র কাজ। তা-ই আমাদের কাজটা কে কটূক্তি না করলেই ভাল।”

দাইয়ান বলে,

“আপনারা আপনাদের কাজ করেন।
কোন সমস্যা হলে বলবেন সাহায্য করতে এগিয়ে আসব। তাছাড়া গ্রামের লোকজনদের সাহায্য করার জন্য আমি গ্রামে বসবাস করছি।”

তখন লোকজনের ভিরের মধ্যে কেউ একজন বলে ওঠে,

-“ভাইজান দুই বিয়ে করেছেন গ্রামের লোকদের কোন সাহায্যদানের জন্য জানতে পারি!”

দাইয়ান ভ্রু কুঁচকে আশেপাশে একবার দৃষ্টিপাত করে দেখে নেই। তারপর দাইয়ান মনে মনে বলতে থাকে,

-“কার কলিজায় এতো সাহস, সে ভীরের মধ্যে লুকিয়ে থেকে দাইয়ান কর পারসোনাল প্রশ্ন করে? হাতের কাছে পেলে বেডারে কেটে কুঁচিকুচি করে এই খালের পাড়ে পুঁতে রেখে দিব। শয়তান বেডা একবার খালি সামনে এসে দাইয়ানের মুখোমুখি হও।”

যে এই উক্তি করেছে, সে খুব ভালো করে জানে। এই দাইয়ান যদি জানতে পারে কে এমন মন্তব্য করেছে তাহলে তাকে আস্তা গিলে খাবে। কি দরকার যেচে বাঘের সামনে যেয়ে বলার,
–“নাও আমাকে তোমার দুপুরবেলার লাঞ্চ বানাও? ”

অফিসারের থেকে বিদায় নিয়ে দাইয়ান ফিরে আসে। আসার পথে তার বাড়ির তিন রমণীর সাথে দেখা হয়।

#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-০৪
#Nishi_khatun

আসার সময় পথিমধ্যে তাদের দেখা হয়ে ছিল। তবে রিমশা তার আত্মসম্মান বজায় রাখতে দাইয়ানের সাথে কোন প্রকার কথা বলে নাই।

এদিকে বাড়িতে এসে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হতে-ই,
দূর থেকে ইফাকে রান্নাঘরে দেখে রিমশা’র বুকের মাঝে ছ্যাঁত করে ওঠে। এতোদিন যে রান্নাঘর তার পদচারনায় মুখোরিত ছিলো। আজ সেখানে তার কোন অস্তিত্ব নেই। বিয়েরপর থেকে স্বামীর ঘরে তার কখনো ঠায় হয়-নি। তাতে বিন্দু মাত্র আফসোস ছিলোনা। এবাড়ির প্রতিটা মানুষ অল্প কিছুদিনেই তাকে আপন করে নিয়েছিল। তা-ই স্বামীর ভালোবাসা না পেলেও মনের আক্ষেপটা একটু হলেও কম ছিল। একদিন হয়তো পরিস্থিতি তার অনুকূলে আসবে। সারাদিন শাশুড়ি আর বড় জা’র সাথে রান্নার সময় ছাড়াও এমনিতে খুঁনশুটিতে সময় কাটত। তবে আজ সে বাড়ির সকলে কি সুন্দর তার স্থানে অন্য কাউকে বসিয়ে দিলো? কেউ তার মনের পোড়া ঘাঁয়ের কথা চিন্তা করছে না। এসব ভাবতেই রিমশা’র চোখ দিয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।

পেছনে থেকে ইলমা রিমশা’র কাঁধে হাত রাখাতে-ই চোখেরজল আড়ালে মুছে ফেলে।

ইলমা বলে,”ভাবী আমি আম্মার সাথে কথা বলে দেখছি।”

রিমশা থমথমে গলায় বলে,
“আমার জন্য তোমার কারো সাথে কথা বলার দরকার নেয়।” তারপর সে ঝর্ণার হাত ধরে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।

এমন সময় ইফা দৌড়ে এসে রিমশা’র পথ আটকে বলে,

-“এই তুই কোথায় যাচ্ছিস! চল আমার সাথে রান্নাঘরে যাবি। তুই ভালো করে-ই জানিস আমি রান্নার কাজে পারদর্শী না। তবুও কেউ যদি সাহায্য করে তাও এক কথা ছিল। একা এতো লোকের রান্না আমি কিভাবে করবো?”

রিমশা বিরক্তির সাথে বলে,”তোর সংসার তুই ভালো জানিস। আমাকে কেনো এসব কথা শোনাতে এসেছিস? স্বামীর সাথে প্রেমে যে ভাবে মশগুল আছিস, সংসারের কাজ গুলে সেভাবে কর।”

ইফা বলে,”আরে বাহ, তুই আমার সতীন তো! আমি জামাই নিয়ে ঘুরাঘুরি করবো। আর তুই আমার সন্তান আর সংসারটা সামলাবি। ”

রিমশা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,”আমাকে দেখে কি কাজের বেডি রহিমা মনে হয়? না কি আমি আত্মসম্মানহীন কোন নারী? স্বামীর দেওয়া এতোবড় ধোঁকা মুখ বুজে সহ্য করে নিবো?
এমন স্বামীর অনুগত হয়ে অবলা জীবের মতো তার সংসারে সারাজীবন পড়ে থাকবো?”

ইফা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,”এখনো আছিস তো সেই স্বামীর বাড়িতেই। ”

রিমশা এবার বিদ্রূপের সাথে বলে ওঠে,

“ওহে মূর্খ নারী এটা তোর স্বামী বাড়ি না, তার বাবার বাড়ি। আমার শ্বশর মশাই যদি তার সম্পত্তিতে দাইয়ান কে অংশীদার না করেন তাহলে তোদের দু জন কে পথে যেয়ে দাঁড়াতে হবে। আর তোর স্বামী উকিল মানুষ হলেও বেকার। বাবার বাড়িতে থেকে বাপের পয়সাতে ফুটানি করে। বাপের টাকার গরম দেখাতে শুধু শুধু ওকালতি পড়েছিল।”

রিমশা’র এই সমস্ত কথা জেনো ইফার গায়ে কাঁচের মতো বিঁধতে থাকে।

ইলমা শুধু একবার ভাবী ডেকে চুপচাপ থাকে।

রিমশা বলে,
“ইফা তুই চিন্তা করিশ না। আমি তোর কোন সাহায্য করতে না পারলেও অপকার করবোনা। তবে হ্যা আমার সাথে হওয়া অন্যায়টা যে মুখ বুজে সহ্য করব এমন টা কিন্তু মোটেই হবে না। জানিস তো ছোট বেলা থেকে আমি আমার সাথে করা অন্যায় কারীকে কখনে মাফ করি না।”

ইফা কাঁপাকাঁপা গলায় বলল-,” তু-ই কি খু-ন কর-বি?”

রিমশা বলে,
“দরকার হলে তা-ই করবো।”

বলে সে স্থান থেকে দ্রুত প্রস্থান করে।
*
*

এভাবে কয়েকদিন পার হয়েগেছে। রিমশা নিজেকে একপ্রকার গুটিয়ে নিয়েছে। রুমের বাহিরে গেলে দেখে তার স্বামী দ্বিতীয় বউ নিয়ে কতো ঠাট্টাতামাসা করছে। দুজনের রুম থেকে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে আসে। আবার দিন শেষে সুন্দর মত বউয়ের হাত ধরে হাসতে হাসতে রুমের প্রবেশ করে দরজাতে খিল দেয়।
আর রিমশা বাড়ির একটা কোণায় সারাদিন আগাছার মতো পড়ে থাকে।

রিমশা রুমের বাহিরের এসব দৃশ্য দেখে!
আজ বিষণ্ণবদন নিয়ে জানালার পাশে থাকা কেদারাতে বসে পড়ে। নিরবতা পালন করতে থাকে। একদৃষ্টিতে বাহিরের ঐ মেঘলা আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে। হয়তো কিছু সময়ের মধ্যে চৈত্র মাসের শেষটা ঝড় বৃষ্টিপাত দিয়ে হবে। বৈশাখের আগমনী বার্তা নিয়ে ঐ নীল স্বচ্ছ আকাশটা কালো আঁধারে ছেয়ে গেছে। কিছু সময়ের মধ্যে অসময়ের ঝড় বৃষ্টি শুরু হবে। ঝড়োমেঘ আকাশের এদিকে ওদিকে উড়ে চলেছে।
ঘরের ভেতরে তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

অসময় ঝড়োমেঘ এসে পুরো আকাশটা কে গ্রাশ করে নিয়েছে। কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ হঠাৎ করে অশান্ত হতে শুরু করেছে। বাড়ির বউ মেয়েরা খুব ব্যস্ত বাহিরে শুখনো কাপড় গোছাতে, কেউ বা রান্নার শুখনো খড়ি গুছিয়ে মাচাতে রাখতে, আবার কেউ ধূলিকণা থেকে রুমের আসবাবপত্র বাঁচাতে দরজাকবাট সুন্দর করে বন্ধ করে দিচ্ছে।

এদিকে হঠাৎ করে অসময়ের বৃষ্টিপাত শুরু হয়েগেছে।
টিনের চালের উপর টুংটাং আওয়াজ করে বৃষ্টি পড়ছে।
বৃষ্টির দিনের মজাই আলাদা। গ্রামের বাড়িতে টিনের চালে বৃষ্টির মোটামোটা ফোটা পড়তেই প্রকৃতির এক সুন্দর মোহনিয় গান শোনা যায়।

হঠাৎ করে এলোমেলো শাড়িতে রুমের বাহিরে ছুটে বেড়িয়ে আসে রিমশা। সোজা বাড়ির উঠানের মাঝে এসে ভিজতে শুরু করে দেয়।

রেহেনা বেগমের দৃষ্টির সামনে তার বাড়ির বউ এমন ছন্নছাড়া হয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। তার ইশারাতে ঝর্ণার মা চেয়ারম্যান বাড়ির সদরদরজা দ্রুত বন্ধ করে দেয়। যেনো বাহিরের কেউ অন্দরমহলের খবর জানতে না পারে।

এদিকে রিমশা কে এমন ভাবে ভিজতে দেখে ইলমা দৌড়ে ভাবীর সাথে উঠানের মধ্যে এসে ভিজতে শুরু করে। ঝর্ণা তার মায়ের কাছ থেকে অনুমিত নিয়ে দুজনের সাথে যোগদান করে।

তখন বাড়ির বড় বউ ভয়ে ভয়ে শাশুড়ির কাছে এসে বলে,”আম্মা!”

রেহেনা গম্ভীরতার সাথে বলে,”কিছু বলবে?”

বড় বউ বলে,
“আম্মা আমিও ওদের সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে যাব?”

রেহেনা সাথে সাথে জোড়ে ধমক দিয়ে বলে ওঠে,

-“ছয় মাসের ভরা পেট নিয়ে উনি আসছেন অসময়ের বৃষ্টিতে গোছল করতে। তা বলি কি এই প্রথমবার মা হচ্ছ না তুমি। আগেরটা থাকলে এতোদিনে শাশুড়ি হয়ে যেতে। তাও এখানো জ্ঞান বুদ্ধি হলো না? তা শুনি তোমার আক্কেল জ্ঞান হবে কবে? যাও ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো। বৃষ্টিতে বাচ্চাকে কোলে করে সামনে বছর ভিজিও। তারপর হাসপাতালে কিছুদিন বিশ্রাম করে আসবে।”

বড় বউটা বিষণ্ণ মনে নিজের রুমের দিকে প্রস্থান করে।
শাশুড়ি মা কথা বলার সময় এতোটা ব্যস্ত ছিলো যে, সে এক অভাগী মা কে তার মৃত সন্তানের খোঁটা দিয়েছে তা বুঝতে পারেন না। গর্ভবতী মা সে, যে তার আগে এক সন্তানহারা জনম দুখিনী অভাগিনী। কেউ কি বুঝবে তার মনের ভেতরে চলা ঝড়ের খবর?

রেহেনা বেগম ঝর্ণার মা’কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“রিমশা’র পা বেশি লম্বা হয়ে গেছে। বিনা অনুমিততে হুটহাট যে কোন কাজ করে সে। এই যে, মেয়ে মানুষ হয়ে খোলা আকাশের নিচে ড্যাং ড্যাং করে ভিজতে শুরু করে দিয়েছে। চক্ষু লজ্জা বিষর্জন দিলো না কি মেয়েটা? আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে অবগত না হয়ে, সে কোন কারণে উঠানে ভিজতে গেছে?
তার দেখাদেখি আরও দুইটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। আজ এদের তিনটের ভালোমতো খবর নিবো দেখে নিও। শাশুড়ি ভালো ব্যবহার করে বলে বউ গুলো আমার মাথায় হাড়ি ভাঙ্গছে।”

ঝর্ণার মা বলে,
“ভাবী মেয়েটার মনের খবর তো আর কেউ জানি না।
সামনের উপর স্বামী যখন অন্য মেয়েকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করে, তখন মেয়েটার না জানি বুকের ভেতরে কতোটা রক্তক্ষরণ হয়। ঐ দিকে সে ডায়নী ঠিকি মনের সুখে স্বামী নিয়ে শান্তিমত ঘুমাচ্ছে। রিমশা’র চোখেরজল আর ঘুমের খবর আমরা কেউ রাখি না।”

রেহেনা বেগম এসব কথার বিপরীতে কোন জবাব দিলো না।

এদিকে রিমশা’র সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হঠাৎ করে ইলমার বারান্দাতে থাকা তার মায়ের সাথে চোখে চোখাচোখি হতেই ভয়ের নিজেকে ভাবীর পিছনে গুটিয়ে নেয়।

মায়ের ঐ রক্তিম চক্ষু দেখে ইলমার বুঝতে বাকি রইলো না আজ নির্ঘাত মা তার পিঠে লাঠি ভাঙ্গবে।

রেহেনা বেগম বারান্দা থেকে প্রস্থান করতেই যে যার রুমে চলে যায়। নয়তো ভেজা কাপড়ে বেশি সময় থাকলে ওদের তিনজনের সমস্যা হতে পারে।

এদিকে রান্নাঘর থেকে ইফা সব কিছুই পর্যবেক্ষণ করছিল। আহা কোথায় সে স্বামীর সাথে নানারকম প্রেমের মূহুত্ব কাটাবে।সে করবে এসব কাজ আর কি করছে সে। সেই সকালে রুম থেকে বেড়িয়ে তাকে রান্নাঘরে প্রবেশ করতে হয়। সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করে, ঐ চুলাতে দুপুরবেলার রান্নাবাড়া করতে হয়। আবার দুপুরবেলা রান্না খাওয়া শেষ হতে না হতেই রাতের রান্নার যোগার শুরু করে দেয়। সে সবের মাঝে আবার শ্বশুরের সাথে কেউ দেখা করতে আসলে তাদের নাস্তার যোগার করা। চেয়ারম্যান বাড়িতে প্রতিদিন বাহিরের লোকদের আনাগোনা ভালোই। পরিবারের সদস্য ছাড়াও বাহিরের মেহমান দের জন্য রোজ অতিরিক্ত রান্নাকরা লাগে। এদিকে বলদের মতো সারাদিন খাটুনি খাটবার পর রাতে স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে ভালোই লাগছে। তবে এই ভালোলাগা কতোদিন পর্যন্ত থাকবে তা নিয়ে এখন ইফার দুষ্চিন্তা শুরু হয়েছে।
এভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে দাইয়ানের সাথে তার সম্পর্কে অবনতি হতে বেশি দেড়ি হবে না।

চলবে……