অনুর উপাখ্যান পর্ব : ৩

0
2264

গল্প : অনুর উপাখ্যান
পর্ব : ৩

এ আমার কেমন জীবন ! এর নাম স্বামী ? না, এ শুধুই পুরুষ । শরীর খেকো পুরুষ । তার কোনো স্পর্শতে ভালোবাসা নেই, তা তো মেনেই নিয়েছি । তাই বলে একটু মায়া ও থাকবে না ! চোখ দুটো আর বাঁধ মানছে না । কেঁদেই চলছে নিরবে । মারুফের সেদিকে নজর নেই । সে এখন নেশায় বিভোর । আমার চোখের পানি দেখার সময় তার নেই ।প্রতিদিনের মতো আজও সে তার মেডিসিন নিয়ে ঐ পাশ ফিরে ঘুম । ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে । এত কষ্ট কেনো এক জীবনে ? আর কেনোই বা মানুষ এই শরীর খেলায় মেতে উঠে ? কিসের সুখ পায় তাতে ? কই আমি তো কোনো সুখের খোঁজ পাই না ! তাতে কি ? তাই তো,তাতে মারুফের কি ? তার তো কিছুই যায় আসে না ।

এ কয়দিনেই বাসার কারো কানে খবর পৌঁছাতে বাকি নেই যে আমি প্রেগন্যান্ট ! ইউরিন রিপোর্টে প্রেগন্যান্সি পজিটিভ এসেছে । শাশুড়ি মা ভালো মন্দ কিছুই বলেন না এ বিষয়ে । তবে এ বাড়ির কেউ যে খুশি না এটা বুঝা যায় । হঠাৎ সবার এমন চুপসে যাওয়াটা কেমন অস্বাভাবিক লাগছে । আহারে একটা মানুষ যদি পেতাম একটু মন খুলে কথা বলার জন্য ! অবশেষে মানুষ পেলাম একজন । বড় ভাবি এসে বিছানায় পা তুলে বসলেন । ভাবলাম ভাবি নিশ্চই আমাকে একটু শান্তনা দিতে এসেছেন । কিন্তু, উনার চেহারায় মেঘের আভাস । কি বলতে এসেছেন আল্লাহ্ই জানেন ।

— কিরে অনু, তুই এই কামডা কেমনে করলি ? তোর কি একটু লজ্জা শরম নাই ?

— জি ভাবি, কি করলাম আমি ? এ কথা কেনো বলছেন বুঝতে পারলাম না !

— এই যে,এক মাসেই যে তুই প্যাট বাজাইলি, এক বারও কি চিন্তা করলি না মাইনষে কি কইবো !

— ছি: ভাবি ! এ গুলো কেমন ভাষা ! আর বাচ্চা কি আমি ইচ্ছে করে নিয়েছি ? আপনার দেবর কে বলেন এসব । আমার দোষ কোথায় ? সে ব্যবস্হা না নিলে আমি কি করব ?

— হ বুঝছি, তো অহনও রাখছোস কেন ? ফালাই দে বাচ্চা । আমার দেওর এর কি কোনো শখ আহলাদ নাই ? সে ফুর্তি করব কেমনে তোর যদি প্যাট থাহে ?

— ভাবি ! এগুলো বলবেন না আর । আমার সন্তান আমি কোনো দিন ও মারবো না । আমি কোনো পাপ করি নি যে, বাচ্চা নষ্ট করতে হবে আমার ।

— তোর ভালোর লাইগ্গা কইছিলাম। হুন, বেডা মানুষ মুখ ফিরতে কত্খন ! বুঝবি পরে ।

অসহ্য লাগছিল ভাবির কথা গুলো ।মানুষের রুচি বোধ এতটা নোংরা হয় ? সে নিজে একজন মেয়ে হয়ে জানে না যে, স্বামীর ইচ্ছের কাছে মেয়েদের কিছুই করার থাকে না । ও আল্লাহ আপনি আমাকে সাহায্য করুন । এ যন্ত্রনা আমি আর সহ্য করতে পারছিনা ! মারুফের মনে আপনি রহম দিন। সে যেনো আমার কথা মেনে নেয় । আমি কোনো ভাবেই পারব না এ অন্যায় করতে । ঘৃনা, ভয় সব মিলিয়ে একটু পর পর কেমন যেনো গা গুলিয়ে আসছে ।এত অশান্তি আর সহ্য করতে পারছি না ।

আজ সকালে অনুর শরীরটা একটু বেশি খারাপ লাগছে । পেটে ক্ষিদে কিন্তু খেতে পারছে না । বাসায় এত লোক, তবু একটু খাবার বিছানায় এনে দেয়ার কেউ নেই । আম্মু থাকলে নিশ্চই এখন মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন । হঠাৎ শাশুড়ি মা প্লেটে করে আনারস নিয়ে আসলেন অনুর জন্য । এত কিছু থাকতে খালি পেটে আনারস খাওয়ানোর কথা কেনো মনে হলো শাশুড়ি মায়ের ? কারণ বুঝতে পেরে ভয় লাগছে অনেক । মানুষ এতটা ভয়ংকর হতে পারে !

— বউ উইডা বহো । লও আনারস খাও ।

— মা, আমার খারাপ লাগছে এখন আমি আনারস খাব না ।

— ক্যান খাইবা না ? লও আমার সামনে এহন ই খাও ।

— মা, আমি আনারস খাব না ।

— তোমার কত্ত সাহস ! আমার মুহে মুহে কতা কও । ক্যান খাইবানা তুমি ? মারুফ কই তুমি ? দ্যাহো ছোডো বউ এর কত্ত সাহস ! আমার কতা হুনেনা ।

— কি ? কি অইছে ? মায়ে কি কয় তোমারে ? কতা হুননা ক্যান ? লও এহনি খাইবা তুমি আনারস ।

— না, আমি খাব না । আমার আম্মু নিষেধ করেছেন আনারস খেতে । আমি কোনো ভাবেই খাব না ।

— ক্যা ? আনারস খাইলে কি অইবো ?

— আনারস খেলে আমার বাচ্চা মরে যাবে । তাই আমি খাব না, কোনো ভাবেই না । আমাকে জোড় করবেন না প্লিজ ।

এ কথা শুনে মারুফ যেনো একটু থমকে গেলো । মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল :

— আমনে জানেন না যে আনারস খাইলে বাচ্চা নষ্ট হয় ?

— কে কইছে ? আজাইরা কতা । কিছু অয় না । আমরা খাইছি না ?

— থাউক, অনুর খাওন লাগতো না । জোড় কইরেন না ।

মুখ কালো করে এক গাদা কথা শুনিয়ে শাশুড়ি মা চলে গেলেন । মারুফের মুখের দিকে তাকানো যায় না ! মনে হয় আমাকে মেরেই ফেলবে আজ ।

— হুনো, তোমার কতা যদি মিথ্যা অয়, আমার মার নামে যদি মিথ্যা কইয়া থাকো, তো বুইঝো তোমার কপালে কি আছে ।

— আপনি বিশ্বাস না করলে ডাক্তার ভাই কে জিজ্ঞেস করেন । আমার আম্মু কি আমার খারাপ চাবেন ? সব মায়েরাই এ গুলো জানেন । এ সময় আনারস, পেঁপে , কালোজিরা খেতে হয় না ।

আপাতত মারুফের রাগ একটু কমলো । ইসস ! এত যন্ত্রনা ভালো লাগে না ! এমনিতেই শরীর কেমন লাগে তার উপর মানসিক অত্যাচার ! এভাবে কাঁদলে শরীর কতদিন ভালো থাকবে ? একটা জিনিস অবাক লাগছে, মারুফ তাকে আনারস খেতে বাধ্য করে নি কেনো ? সে নিজেই তো চায় বাচ্চা নষ্ট করতে । হাজার হোক সন্তানের বাবা তো, হয়ত এখন মায়া লাগছে তার । আল্লাহ, যেনো তাই হয় । আপনি তার মনে রহম দিন আমার সন্তানের জন্য ।

আজ মারুফ রাতে বাসায় এসে কি যে বলবে সে চিন্তায় অস্হির আমি । হঠাৎ আমার সব চিন্তায় ভাটা পড়ল ছোট চাচি শাশুড়ির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ! ঢাকা থেকে ফোন এসেছিল । চাচির লাশ কাল সকালে গ্রামের বাড়ি আনা হবে । অনুর মনটা খারাপ লাগছে খুব । বৌভাতের দিন চাচির সাথে কত কথা হলো ! চেহারা টা মনে পড়ছে বার বার । কাল সকালে সবাই গ্রামের বাড়ি যাবে । চাচিকে সেখানেই দাফন করা হবে । আমিও যেতে চাইলাম চাচিকে শেষ দেখা দেখতে । কিন্তু, শাশুড়ি মা না করে দিলেন । কারণ পোয়াতি মাইনষের নাকি মৃত বাড়ি যাওন লাগে না । আশ্চর্য না ? পোয়াতিকে জেনে শুনে আনারস খাইয়ে বাচ্চা মেরে ফেলা যায় । অথচ, আপন জন মারা গেলে সেই বাচ্চার দোহায় দিয়েই আটকে রাখা হয় । কত মায়া তাদের আমার বাচ্চার জন্য ! আসলে কি এটা মায়া ? না, এটা আমাকে সবার কাছ থেকে দূরে রাখা । সেখানে সব আত্মীয় স্বজন থাকবে । এদের ভয়, যদি আমি তাদের কাছে সব সত্য প্রকাশ করে দেই ?

বাড়িতে এখন শুধু আমি আর কাজের বুয়া । প্রায় দুই মাস হয়ে গেছে আমি বাসার নিচে নামি না ! শাশুড়ি মায়ের করা হুকুম যেনো নিচে না যাই ।দুপুরে খেয়ে সামনের বারান্দায় গিয়ে বসলাম । বুয়া আমার চুল আচরে দিচ্ছেন। এ বাড়িতে বুয়া এবং একটা কাজের মেয়ে আছে , নাম রিনা । এরা দুজনেই আমাকে খুব পছন্দ করে । রিনা আমাকে মামি বলে ডাকে আর বুয়া ভাবি ডাকেন । বুয়ার বাড়ি হলো রংপুর । বুয়ার কথা গুলো শুনতে ভালোই লাগে । এই প্রথম বুয়ার সাথে মন খুলে একটু কথা বলতে পারছি ।হঠাৎ কান্নার শব্দে আমি, বুয়া আমরা দুজনেই নিচের দিকে তাকালাম । দেখি সাত/ আট বছরের একটা মেয়ে তলপেটে হাত চেপে ধরে মাগো,বাবাগো বলে কাঁদছে । তার গায়ের জামা অর্ধেক ছেঁড়া ।ওর অবস্হা দেখে স্হীর থাকা সম্ভব হলো না ।

— এ্যাই মেয়ে শোনো, কি হয়েছে তোমার ? কান্না করছো কেনো ? কে মেরেছে তোমাকে ?

— তুঙ্গো বাড়ির এক বেডা আমারে ..মাগো ও বাবাগো ।

আমাদের বাড়ির ? বুয়া, আমাদের বাড়ির তো কেউ নেই ! মেয়েটা কি বলে ? চলেন তো নিচে যাই ।

— এ্যাই তুমি দাঁড়াও, আমি আসছি ।

বুয়াকে নিয়ে নিচে গিয়ে মেয়েটাকে আদর করে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে বলো তো ।

— তুঙ্গো বাড়ির ঐ বেডা আমারে চাইল দিবো,টেকা দিবো কইয়া আমারে গরো নিছে । হ্যাসে আমার প্যান্ট খুইল্লা এইহানে দুক্কু দিছে । বুহে কামর মারছে । আমি চিক্কর দিছি হ্যাসে আমারে ছাইরা দিছে ।

— ও আল্লাহ ! এটা কি শুনলাম ! এটুকু মেয়েকে কে রেপ করতে চেয়েছে ?

আচ্ছা তুমি আস তো কোন বাড়ির বেডা দেখাও আমারে । মেয়েটি আমাদের সোজা আমার বড় ভাসুরের বাসার সামনে নিয়ে গেলো । সেখানে বারান্দায় চাল ছিটানো । আমার আর বুঝতে বাকি নেই ভাবির বড় ছেলে মুন্নারই কাজ এটা । মেয়েটা এরই মধ্যে কখন চলে গেছে খেয়াল করিনি । বুয়া আমাকে জোড় করে টেনে উপরে নিয়ে আসলেন ।

— বুয়া, আপনি কেনো এমন করলেন ? কেনো মুন্নাকে ধরতে দিলেন না ?

— ভাবি, মুন্নাকে বাথরুমে দেখছি । সে আমারে হাতজোড় করে কইছে যেনো আপনারে না বলি সে বাথরুমে ।

— আপনি কাজটা ঠিক করেন নি বুয়া । এত বড় পাপ যে করেছে তাকে কিছু বলব না ?

— ভাবি গো, আপনার হাতে ধরি, আপনে এই কাজ কইরেন না । এরা মানুষ খুব খারাপ । আপনারে এইহানে টিকতে দিব না । আমার মতো আপনে ও চুপ থাকেন ভাবি । কাউরে কিচ্ছু কইয়েন না । আপনে জানেন না মুন্নার মা কি যে খারাপ মানুষ । আপনার সর্বনাশ কইরা ছাড়বো ।

চলবে….

✍? নায়না দিনা