অনুর উপাখ্যান পর্ব : ৪

0
1812

গল্প : অনুর উপাখ্যান
পর্ব : ৪

বুয়ার কথা শুনে কেমন যেনো এক চিন্তা গ্রাস করল আমাকে । এরা আমার কি সর্বনাশ করবে ? মাথায় এখন মারুফের চিন্তা ।এখন যদি মারুফের এরকম কোনো অতীত বের হয়, তবে এর চেয়ে বড় সর্বনাশ আর কী হতে পারে আমার ? মারুফের বিষয়ে সত্য জানতে যেমন ইচ্ছে করছে তেমনি ভয় ও করছে । এই দু’মাসে এটা বুঝেছি যে এরা মানুষ হিসেবে সত্যি খারাপ অনেক । বীভ্ৎস্য রকমের সত্য বের হয়ে আসাও অসম্ভব কিছু না । কিন্তু, আমাকে তো ভয় পেলে চলবেনা । সব সত্যের মুখোমুখি হতে হবে । অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে ।

— বুয়া, কিন্তু আমি তো সহ্য করতে পারছি না । চিন্তা করেন কত বড় পিশাচ হলে এতটুকু একটা মেয়েকে রেপ করতে গেছে ! এখন যদি আমি সব জেনেও চুপ থাকি, আল্লাহ্ আমাকে মোটেও মাফ করবেন না । শোনেন, যে অন্যায় করে আর যে অন্যায় দেখেও চুপ থাকে, তারা দু’জনই সমান গুনাহগার । আপনার ও উচিত সবাইকে সত্য বলা ।

— মাফ চাই ভাবি । সত্য কইলে আমারে এই এলাকায়ই থাকতেই দিব না । এরা কেমন মানুষ বুঝবেন পরে ।

ধুর ! শুধু শুধু বুয়ার সাথে তর্ক করছি । সত্যিই তো, যদি বুয়াকে এলাকা ছাড়া করে, তো কই যাবেন উনি ? ভাতের অভাবে এ দেশে এসেছেন পরিবার নিয়ে । যা করার আমিই করব । যে আমি ছোটবেলা থেকে সত্য বলে এসেছি, সেই আমি আজ এত বড় সত্য গোপন করব ? আমার পক্ষে তা সম্ভব না । মারুফকে অবশ্যই জানাব আমি । দেখি সে কী বলে ?

চাচির দাফন শেষ করে সবাই বাসায় ফিরে এসেছে । মারুফ আর বের হয় নি আজকে । সুযোগ বুঝে মারুফকে বললাম পিশাচ মুন্নার কুকর্মের কথা ।কিন্তু, মারুফের মুখে আমি এক ঝলক হাসি দেখলাম । হাসি দেখে এতটা অবাক হলাম যে, কিছুক্ষন কথা বলতে ভুলে গেলাম !

— আপনি এভাবে হাসলেন কেনো ? এটা কোনো খুশির কথা ? এত জঘন্য ঘটনা শুনে কোথায় আপনি রাগ করবেন, মুন্নার বিচার করবেন ; তা না করে হাসছেন ?

— আমি কি কইছি বিচার করমু না ? কুত্তায় এত ছোড মাইয়ারে ইয়ে করতে গেছে ক্যা ?

— তার মানে, মেয়েটা যদি বড় হতো তবে দোষ হতো না ? এত খারাপ কেনো আপনারা ? ঠিক আছে বাদ দিন এসব । এখন বলেন মুন্নার কি বিচার করবেন ? ওর শাস্তি হওয়া উচিত । মেয়েটা কীভাবে যে কাঁদছিল ! ওরে শাস্তি না দিলে আবারও একই অন্যায় করবে ।

— মার কাছে কইয়া দেহি, মায় কি কয় ।

— আচ্ছা চলেন, গিয়ে সব ঘটনা বলি মাকে ।

শাশুড়ি মা, লীমা, সীমা , সবাই বসে চাচির কথাই আলোচনা করছে । মার ঘরে গিয়ে আমরা ও বসলাম । মারুফ কথাটা তুলল । আমি পুরো ঘটনাটা বর্ণণা করলাম । কথা শুনে সবার মুখ যেনো কালো হয়ে গেল । শাশুড়ি মা তো মনে হলো পারলে আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবেন । আমি কেনো এ ঘটনার সাক্ষী হলাম ?এটাই যেনো আমার দোষ ! আর ওদের দুই বোনের মুখের দিকে তো তাকানোই যায় না । সীমা শুধু বলল : এত খারাপ কাজ কেমনে করল মুন্না ? ব্যাস বিচার শেষ ! কেউ আর কিছুই বলল না । কি বলব আমি ? ভাষা নেই কোনো । এদের কাছে ভালো কিছু আশা করাটাই আমার ভুল হয়েছে । ঘুমের দোহায় দিয়ে মারুফ আমাকে তাড়াতাড়ি করে নিয়ে ঘরে চলে আসল ।

— রাইত বেশি হইছে ঘুমাও এখন । জরুরী কাম আছে কাইলকা সকাল সকাল বাইরামু ।

এত রাগ লাগছে এই লোকটার উপর । এরকম লোকের বউ হওয়ার চেয়ে সারাজীবন কুমারী থাকা ভালো । মানুষ এত খারাপ হয় কেনো ? এদেরকে আমি মানুষই বা বলছি কেনো ! এরা হচ্ছে মানুষ রুপী অমানুষ । ইস, কি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে সে । আর আমি এই অসুস্হ শরীর নিয়ে ঘুমাতে পারছি না । আমার বিবেক আমাকে বার বার মেয়েটির কান্না মনে করিয়ে দিচ্ছে । আচ্ছা, যদি আমার মেয়ে হয় ? তবে তো আমার মেয়ে ও এ বাড়িতে নিরাপদ না । বড় ভাবির তো আরও দুই ছেলে আছে । নিপা ভাবির একমাত্র মেয়ে । নিপার সাথে যদি কেউ এই কাজ করত তখন কি করত ওরা ? ননাস ঝুমা আপার ও একটা মেয়ে আছে নিঝুম, ছয় বছর বয়স । যদি নিঝুম কে কেউ রেপ করত তখন ওরা কি করত ? এভাবে কি কেউ একটু চিন্তা করতে পারে না ? একটা বাড়ির সবাই একই রকম কীভাবে হয় ! তবে ঝুমা আপা যতদিন ছিলেন আমাকে আদর করেছেন । এখন উনি থাকলে একটু ভালো লাগতো । মেজো ভাবি ও ভালো করে কথা বলেন । কিন্তু, সমস্যা হলো উনার সাথে আমাকে কথা বলতে দেন না শাশুড়ি মা । ইস, আর কত চিন্তা করব আমি ? আমার টেনশন ফ্রি থাকা দরকার অথচ সেটাই পারছি না ।

মারুফ আজকে একটু তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেল । বিছানা থেকে উঠতেই মন চাচ্ছে না অনুর । মনে হয় কেউ যদি একটু খাবার এনে দিতো ! কাকে বলব ? আমার জন্য কেউ নেই এই বাসায় ! আচ্ছা আজ যদি সীমার বাচ্চা পেটে হতো ? তখন শাশুড়ি মা কি পারতেন এমন করতে ? এই যে আমি প্রায় সময়ই খেতে পারছি না খাবার গন্ধ লাগে বলে । তখন তিনি নিশ্চই মেয়েকে জিজ্ঞেস করতেন : কী খেতে মন চায় ? আমার আম্মু হলেও তাই করতেন । যত্ন করে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন । আমি না হয় সীমা নই,কিন্তু একজন মেয়ে তো ? আমার শরীরে তো তার ছেলেরই সন্তান । এটা মনে করে ও কি আমাকে একটু আদর করা যায় না ? একবার জিজ্ঞেস করা যায় না : বউ কি খেতে মন চায় বলো ? এই সহজ কষ্টটা কেউ কেনো বুঝেনা ? কেনো বুঝেনা নিজের মেয়ের মতো করে পরের মেয়েরও একই রকম কষ্ট হয় । অনেক কষ্ট হয় শাশুড়ি মা, অনেক কষ্ট ।

— ঐ অনু, কই তুই ঘর তন বাইরা । বড় ভাবির উঁচু গলায় ডাকছেন ।

— ভাবি, আমার শরীরটা অনেক খারাপ, উঠতে পারছি না । আপনি ঘরের ভিতরে আসেন । আপনার দেবর নেই, চলে গেছে সে ।

— তুই মুন্নার নামে কি কইছস ক দেহি ।

— আপনি তো সব শুনেছেন মুন্না কত বড় অন্যায় করেছে !

— কী ! তোর এত বড় কইলজা ! তুই আমার পোলার নামে কতা কছ । কোন সাহসে তুই এই কতা কইলি ।

— ভাবি, আমি তো কোনো মিথ্যে বলিনি । যা সত্য তাই তো বলছি । আর আপনি ওরে শাসন না করে উল্টা আমাকেই বকছেন ?

— ঐ তুই কিসের বড়াই করছ রে ? কিসের এত অহংকার তোর ? তোর সাদা চামড়ার এত দেমাগ ?

— ভাবি, কি বলেন এগুলো ! আমি কি বড়াই করলাম ? কি অহংকার করলাম ? আর দেমাগই বা কই দেখালাম ? নিজে চোখে যা দেখেছি তাই বলেছি । সত্য বলাও কি দোষ ?

— তুই আমার পোলার দোষ বাইর করছ ? ও তুই বহুত সত্যবাদি অইছস ? তা তোর জামাই কেমন, সেই সত্য জানবি না তুই ? হোন : ছোডবেলাত তন কাজের ছেমরিগো লগে হুইয়া বড় অইছে মারুফ । আরও সত্য হুনবি ? হুন, নিচতলার ভারাইট্টা এক বিয়াত্তা মাগীর লগে প্রেম তার । হারাদিন ঐ বেডিরে লইয়া হুইয়া থাইক্কা প্যাট বাজাইছিল । বেডির জামাই বিদেশ থাহে । এলাকার সবতেই জানে এই ঘটনা ।এহোনো ঐ বেডিরে ছাড়ে নাই সে । কোন মুহে মারুফ আমার পোলার বিচার করব ? আর তুই আইছোস আমার পোলার দোষ গাইতে ! নিজের গরো গু রাইখ্খা অন্যের গর পরিস্কার করন লাগতো না তোর । যা আগে নিজের গর সামলা ।পরে মাইনষের পিছে লাগিস ।

ও আল্লাহ্ এ আমি কি শুনলাম ! এ জন্যই সবাই বলছিল মারুফের সাথে আমার কেমনে বিয়ে হলো । এলাকার কারো অজানা না তার চরিত্র সম্পর্কে । ছি: এত জঘন্য লোক আমার স্বামী ! না জানি কত মেয়েকে সে স্পর্শ করেছে । আবার সেই মানুষ আমাকে ও স্পর্শ করে ! ওয়াক থু । অনেক বমি বমি লাগছে । অনেক কষ্টে রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় বমি করল অনু । বাড়ির কেউ ফিরে ও তাকালো না । কাজের মেয়ে রিনা পানি এনে দিলো ।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি । কিন্তু, তবুও চোখের পানি পড়ছেই । এতবড় সত্য হজম করার মতো শক্তি আমার নেই । আমার সন্তানের কী হবে ? কীভাবে মারুফের সাথে এক বিছানায় ঘুমাবো ? আমি এ ভাবে ঠকলাম ? কোন দিক থেকে আমার শান্তি আছে ? এত চিন্তা আর করতে পারছি না । এরই মধ্যে দু’বার বমি হয়েছে । পেট একদম খালি । কি খাব ? ভাত খেতে ইচ্ছে করছে । শুকনা মরিচ ভেজে পেঁয়াজ আর সরিষার তেল দিয়ে মেখে ভর্তা করে ভাত দিয়ে খেতে মন চাচ্ছে । কিন্তু, কে দিবে আমাকে মরিচ ভর্তা বানিয়ে ? মেজো ভাবি ! হ্যাঁ, বললে নিশ্চই দিবেন ।

— রিনা ? এদিকে আসো তো ।

— জি,মামি কন ।

— কয়টা শুকনা মরিচ আর পেঁয়াজ নিয়ে মেজো ভাবিকে বলো আমাকে একটু সরিষার তেল দিয়ে ভর্তা বানিয়ে দিতে । যাও, তাড়াতাড়ি যাও । খুব খিদে পেয়েছে ।

ইসস ! ভর্তা দেখেই লোভ লাগছে । পেট ভরে খাব এখন । ভাত মাখিয়ে এক লোকমা মুখে দিতেই কেরোসিনের গন্ধ ! পেট গুলিয়ে বমি চলে আসল । ভাত তো খাওয়া হলোই না উল্টো বমি থামে না । রিনা কপাল ধরে আছে । বমি থামলে আমাকে ধর বিছানায় শুইয়ে দিলো ।

— রিনা ? ভর্তাটা শুকে দেখোতো কেরোসিনের গন্ধ কিনা ?

— হ মামি কেরোসিনের গন্দ আহে অনেক ।

— বুয়াকে ডাকো । বুয়া ? এদিকে আসেন তো একটু ।

— জি ভাবি বলেন ।

— এই ভর্তা টা মুখে দিয়ে দেখেন তো কেমন লাগে ?

— ওয়াক থু । ভাবি কেরোসিন তেলের গন্দ । ক্যারা বানাইছে এইডা ?

— কেউ না । আপনি জান বুয়া ।

— রিনা ? মেজো ভাবি কেরোসিন তেল দিয়ে ভর্তা বানালো আর তুমি কিছু বললে না ?

— মামি, মেজো মামি তো ভালো কইরা বানাই দিছিল । কিন্তু, কেরোসিন তেল তো সে মিশায় নাই । অন্য জন মিশায়ছে ।

— কী ! তবে কে মিশালো কেরোসিন ?

চলবে…..

✍?নায়না দিনা