অনেক সাধনার পরে পর্ব-২১+২২+২৩

0
393

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[২১]

নিঝুম রাত্রীর পথম প্রহর। রাস্তাঘাট একদকম নির্জন। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। চাঁদের আলোতে ধরনী মৃদু আলোকিত। সোডিয়ামের কৃতিম লাইট থাকার কারণে তেমন বেগ পেতে হয়নি। অংকুর বাইক চালাচ্ছে আপন গতিতে। সম্পূর্ণ মনোযোগ যখন বাইক চালানোতে তখুনি রিংটোন বাজলো ফোনে। বাইক এক পাশে পার্ক করে রেখে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। স্কিনে তাকিয়ে দেখলো ‘তুলতুল!’ ঠোঁটে ফুটে এলো তার প্রাপ্তির হাসি। কল রিসিভ করে একটু ভাব নিলো। রাগ রাগ গলায় বললো, ‘কল দিলে কেন?’

‘যা বাবা! কল দিলেও দোষ; না দিলেও দোষ? এ কেমন মহাবিপদ।’

মিতালীর রশিকতা শুনে আলতো ভাবে হেসে উঠলো অংকুর। তার হাসির ধ্বনিতে মিতালীও মৃদু হাসলো।

অংকুর বললো, ‘তুমি কি আমার রাগ ভাঙ্গাতে কল দিয়েছো?’

মিতালী ঠোঁট টিপে হাসলো। তারপর অবাক হয়ে বললো , ‘আমি কখন বললাম?’

‘তাহলে কিসের জন্য?’

‘ভুলে কল এসেছে। কেটে দেওয়ার আগেই রিসিভ করে ফেলেছেন।’

মিতালীর রঙ্গরসিকতায় বলা কথাটা অংকুর সিরিয়াসলি নিলো। হাস্যউজ্জল চেহারা মলিন হয়ে এলো তার। মন খারাপ করে কণ্ঠস্বর নিচু করে বললো, ‘ঠিক আছে। তাহলে রাখছি।’

হতবাক হয়ে গেলো মিতালী। তার রশিকতা অংকুর সিরিয়াস ভাবে নিবে সে ভুলেও ভাবে নি। এই ছেলে আসলেই অনেক অদ্ভুত। হাসি পেলো তার। কিন্তু হাসলো না। তাৎক্ষনাৎ বলে উঠলো, ‘আরেহ আশ্চর্য কল কেটে দিবেন কেন?’

অংকুর মলিন কন্ঠে উত্তরে বললো, ‘কি আর করবো। তুমি তো ভুলে কল দিয়েছো। আমার সাথে কথা বলার জন্য না। আমি তো তোমার কেউ না। তাই আমার কথা কখনো ভাবো না। কল কিংবা ম্যাসেজ কিছুই দাও না। সবসময় আমি নিজে থেকে তোমাকে দেই। এখন আমার নিজেকে ছ্যাঁচড়া লাগছে।’

‘আমি তো মজা করছিলাম। এতো সিরিয়াস কেন আপনি?’

নিশ্চুপ রইলো অংকুর। বাইক থেকে নেমে রাস্তার এক পাশে বসলো। আকাশটা আজ স্বচ্ছ। থোকায়-থোকায় সাদা মেঘ ভাসছে। মৃদু বাতাস প্রভাহমান। জনমানবহীন কোলাহলমুক্ত পরিবেশ। আকাশের দিকে এক মনে তাকিয়ে রইলো অংকুর। মিতালী বুঝলো অংকুর হয়তো রাগ করেছে। কিংবা অভিমান পুষেছে মনে। কিভাবে কি করবে সে? ভাবতে লাগলো। কেন জানি অংকুরের নিশ্চুপ থাকা ওর ভালো লাগছে না। তার মন চাইছে অংকুর প্রথমের ন্যায় বকবক করুক। যা খুশি বলুক। কিন্তু এমন ইচ্ছাপোষন করছে কেন তার মন? নিজেক আর প্রশ্ন করলো না। বরঞ্চ অংকুরের রাগ ভাঙ্গাতে বললো, ‘কাল সকালে এক কাপ চা হয়ে যাবে?’

‘উহুম! এক কাপে আমার হয় না। আর যদি সেটা তোমার হাতে হয় তো কখনোই না।’

অংকুরের মৃদু প্রতিত্তুর শুনে প্রসন্ন হলো মিতালী। প্রাপ্তির হাসি দিলো। এখন সে বারান্দার মেঝেতে বসে জ্যোৎস্না বিলাশ করছে। মৃদু বাতাসে খোলা চুল গুলো উড়ছে। দুজনই প্রসন্ন। মান অভিমানের পালা চুকিয়ে মুগ্ধতা আসলো। ভালোলাগা তৈরি হলো আবারো। নতুন করে অবাধ্য মন প্রেমে পরলো। নিস্থব্ধ রাত্রীর খোলা আকাশের নিচে বসে দুইজনই জ্যোৎস্না বিলাশ করতে লাগলো। সুন্দর রাত্রী টাকে আরো সুন্দর করতে গানের আবদার করলো মিতালী। প্রথমে অংকুর নাঃকোচ করলেও রাজি হলো। কোনো প্রকার বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গাইতে লাগলো।

‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা
হৃদয়ে সুখের দোলা।
তুমি মোর জীবনের ভাবনা
হৃদয়ে সুখের দোলা।
নিজেকে আমি ভুলতে পারি
তোমাকে যাবে না ভোলা।
তুমি মোর জীবনের ভাবনা
হৃদয়ে সুখের দোলা।
হাজার তারের বীণা তুমি
তুমি সুরের ঝংকার।
তুমি আমার আষাঢ়-শ্রাবণ
তুমি বসন্ত বাহার।
রাগ-রাগিনীর ফুল-কলিতে
কন্ঠে পড়াবো মালা।
.

বাহিরে সূর্যের তীব্র তাপে পরিবেশ উপতপ্ত হয়ে থাকলেও বাসার ভিতরের পরিবেশ নির্জন। সকলের চেহারায় মৌনাবলম্বী ভাস্যমান। আমেনা চুপচাপ নাস্তা তৈরি করে টেবিলে সাজালো। তারপর তার কর্তব্য অনুযায়ী সবাইকে নাস্তা করার জন্য ডাকলো। জুলফিকার এসে টেবিলের এক পাশে বসে নিরবে নাস্তা শুরু করেছে। চেহারায় তার গম্ভীর ভাব স্পষ্ট। জুলেখা দূর থেকে ছেলের চেহারা দেখলো। কিছুটা ক্ষুন্ন হলো মন। নিঃশব্দে এগিয়ে এসে নিজের চেয়ার টেনে বসলো। কিন্তু নাস্তায় হাত দিলো না। মিতালী এসে দেখলো পরিবেশ শীতল। সবার চেহারায় গম্ভীর ও হতাশার ভাব। সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে দেখলো সবাইকে। নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিলে বসলো। হাত বাড়িয়ে একটা রুটি, সবজি তরকারি ও ডিম ভাজি প্লেটে নিলো। জুলেখা খেয়াল করলো ব্যাপারটা। মিতালী তুলনামূলক খুব কম খাবারই খায়। আগে যাও খেতো এখন তার থেকেও কম। একটা বাচ্চার চাহিদাও বোধহয় এর থেকে বেশি থাকে। কম খাবে না কেন? সে তো আর কম কথা শুনায়নি খাবার নিয়ে। তারই জন্য খাবার কমিয়ে দিয়েছে তার নাতনী। কষ্ট লাগলো। এই প্রথম অপরাধবোধ কাজ করলো মনে।

বেশকিছু সময় পর শেফালী ব্যাগ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো। বাহিরে যাবার জন্য তৈরি সে। টেবিলের কাছে সবাইকে দেখে কিছুটা ধাতস্থ হলো। দাদীর দিকে তাকিয়ে দেখলো দাদীর মুখ মলিন। মন খারাপ হলো তার। যতোই হোক সে তো তার দাদী হয়। কাল রাগে ওমন উগ্র ব্যবহার করলেও ভিতরে ভিতরে প্রচুর খারাপ লেগেছে শেফালী। যদিও তার মতে সে ভুল করেনি। এমন ব্যবহার তার দাদীর প্রাপ্য। চোখ ফিরিয়ে নিলো সে।

আমেনা তাকে সম্পূর্ণ তৈরি দেখে বললো, ‘বাহিরে যাচ্ছিস? নাস্তা করতে বস তাহলে।’

‘না আমি বাহিরে খাবো।’

‘বাহিরে খাবি মানে? নাস্তা তো তৈরি খেয়ে যা। বেশি সময় লাগবে না।’

‘না আম্মু জোড় করবে না। এখন খাবো না। যাই আমি।’

শেফালী দাঁড়ালো না আর। দ্রুত পা চালিয়ে বেড়িয়ে গেলো বাসা থেকে। গতকালকের ঘটনার পর এখন বড়দের সামনে থাকতে বেশ ইতস্ততবোধ করছে সে। বাসার বাহিরে এসে যেন হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচলো শেফালী। ফুঁশ করে স্বস্থির নিশ্বাস ছুঁড়লো একটা।

মিতালী এখনো নিশ্চুপ থেকে নিজের নাস্তা খেয়ে নিলো। তারপর মাকে বিদায় দিয়ে বেড়িয়ে আসলো বাসা থেকে। কালকের পর শেফালীর সাথে আর কথা হয়নি তার। ভেবেছিল বাহিরে এসে শেফালীকে পাবে। কিন্তু না! শেফালী চলে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তাকে নিয়ে সৃষ্টি হওয়া অশান্তি ভালো লাগছে না। সে না থাকলেই বোধহয় সবাই শান্তিত থাকতো। নিজেকে অপায়া লাগছে তার। ভাবলো না আর। হাত উঠিয়ে রিকশা ডাকলো একটা।

নাস্তা শেষে জুলফিকারও বেড়িয়ে গেলো। এঁটো প্লেট গুলো আমেনা ধোঁয়ার জন্য রান্না ঘরে নিয়ে গেলো। স্বব্ধ হয়ে বসে আছে জুলেখা বেগম। ভাবান্তর এলো তার মাঝে। বিবেকে বাধলো সব। অপরাধবোধ আঁকড়ে ধরল তাকে। নিজের ছেলে ও ছেলের বউয়ের এমন উপেক্ষা, দুই নাতনীর তার প্রতি অসন্তুষ্ট। সব মিলিয়ে কাল রাত থেকে বেশ চিন্তিত। ইদানীং শরির টা তেমন ভালো যাচ্ছে না। তার উপর আবার এইসব চিন্তায় মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরছে উনি। চোখ ঝাপসা হলো তার। খেলো না কিছু। উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন। দরজা খুললেন না। আমেনা এসে বেশ কয়েকবার ডেকে গেছে তাও দরজা খুললো না।
.

পুরোটা দিন মনমরা কেটেছে মিতালীর। আর্ট কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে ভার্সিটি শেষ করে বাসায় ফিরলো সে। চেহারায় তার স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। মলিন তার মুখশ্রী। উদাস মুখে বাসায় এসে প্রথমেই গোসল শেষ করে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ফুল স্প্রিডে ফ্যান ছেড়ে ভেঁজা চুল গুলো ছড়িয়ে বিছানায় বসলো। দমকা ফ্যানের হাওয়ায় চুল উড়ছে তার। মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুকে গেলো। পেইন্টিং নিয়ে বড়ো একটা গ্রুপ আছে। সেখানে তিন মাস পর পর পেইন্টিং’এর প্রতিযোগিতা হয়। মিতালী এই প্রতিযোগিতায় তার একটা ক্যালিগ্রাফি দিয়ে অংশগ্রহণ করেছে। ভালোই সারা পেল সে। ফলাফল দেওয়া হবে সামনের মাসের পাঁচ তারিখ। অর্থাৎ আর মাত্র সাত দিন বাকি। পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে যখন নিজের পেইন্টিং এর কমেন্ট বক্স দেখতে ব্যস্ত তখুনি তার রুমে আসলেন জুলেখা বেগম। দাদীকে রুমে দেখে মোবাইল রেখে দিলো মিতালী। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দাদীর পানে।

জুলেখা এসে তার সামনে বসলেন। শব্দ করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘জানোছ? তুই যখন আমেনার পেটে আছিলি তখন ভাবছিলাম একটা পোলা হইবো। অনেক খুশি হইছিলাম। কিন্তু হইলো মাইয়া। মানতে পারি নাই। ভাবছি আমার মাইয়ার মতোই এই মাইয়া হইবো।’

এতটুকু বলে থামলেন জুলেখা। মিতালী নিশ্চুপ থেকে দাদীর কথা শুনছে। তাকে দেখতে না পারার কারণ আজ ধরতে পারলো। সবাই কেন ছেলে আবদার করে খোদার কাছে? মেয়েরা কি দোষ করেছে? কষ্ট হলো তার। কিন্তু উপরে স্বাভাবিক রইলো। জুলেখা আবারো নিজের মতো করে বলতে লাগলেন, ‘তোর জুমা ফুফু কথা তো জানস ওই। ওই মাইয়া হইলো কলঙ্কিনী। আমার মুখে চুনকালি মাইখা আরেক পোলার লগে ভাইজ্ঞা গেছে। নিজের মাইয়া ডারে তো কষ্ট কইরা বড় করছি। কিন্তু শেষে কি করলো? সমাজে আমারে আর তোর দাদারে ছোট করলো। এই কষ্ট সহ্য করতে না পাইরা তোর দাদা স্টোক করছে। এর পরেই প্যালাইসিস হইয়া গেছে। জুলফিকার দেশের বাইরে আছিলো। কত কষ্টে পার করছি ওই দিন গুলা। তুই হওয়ার পর আমার মনে হইছিলো তুইও জুমার মতো আকাম করবি। এর লাগি তোর লগে এমন ব্যবহার করতাম। কিন্তু বিশ্বাস কর, মন থেইকা কিছু কই না আমি। আমিও তো চাই তুই সংসার কর। সুখে থাক। মাইনষে তোরে অপছন্দ কইরা না কইরা দেই। রাগ হইতো আমার। এর লাগি তরে কথা শুনাইতাম।’

বলেই কেঁদে দিলেন জুলেখা। সম্পূর্ণ কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো মিতালী। দাদীকে কান্না করতে দেখে কি করবে বুঝতে পারলো না। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো দাদীর দিকে।

‘নিজের মেয়ের জন্য নাতনীকে এভাবে কথা শুনাতেন আপনি? সিরিয়াসলি দাদী?’ শেফালীর কন্ঠ শুনে দরজার দিকে তাকালো জুলেখা ও মিতালী। শেফালী চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে দাদীর দিকে। ভিতরে এসে আবারো বলে উঠলো, ‘হুয়াট দাদী? গাছের আম পাকলে সব আমে পোকা ধরে না। আপনি অনেক বড়। জ্ঞানী একজন মানুষ তার পরেও এমন লেইম একটা এক্সকিউজ কিভাবে দেখাচ্ছেন? আমি তো আশ্চর্য হয়ে গেছি শুনে। আচ্ছা মানলাম প্রথমে আপনার এমন ধারনা ছিল। কিন্তু এতোদিনে তো বুবুর স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে অবগত হয়েছেন তারপরেও কেন এমন আচরন করতেন? আল্লাহ যদি বুবুকে এভাবে সৃষ্টি করে এতে কি বুবুর দোষ? আর অতিরিক্ত মোটা কোথায়? একটা স্বাস্থ্যবান মানুষের দৈহিক যতোটুকু স্বাস্থ্য থাকা উচিত ঠিক তেমনি বুবুর আছে। আজকালকার মেয়েদের সাথে তুলনা দিবেন কেন? আপনি জানেন মেয়েরা ইচ্ছে করে ডায়েট করে বডি স্লিম রাখে?’

থামলো শেফালী। একটানা এতোগুলো কথা বলে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে সে। জুড়ে জুড়ে নিশ্বাস নিতে লাগলো। বাকরুদ্ধ হয়ে রইলেন জুলেখা। নিজের ভুল বুঝতে পারলেন তিনি। শেফালীর এবারো এরূপ ব্যবহারে ক্ষিপ্ত হলো মিতালী। কন্ঠস্বরে রুক্ষতা এনে বললো, ‘তুই আবারো এভাবে কথা বলছিস কেন? চুপচাপ শোন দাদী কি বলে।’

শেফালী নিশ্চুপ হয়ে গেলো একদম। রাগ রাগ লাগছে তার। কপাল কুঁচকে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো কেবল। জুলেখা কিছুসময় স্বব্ধ হয়ে বসে রইলেন। বেশকিছু সময় চুপচাপ থেকে কিছু ভাবলেন। অতঃপর আড়ষ্ট কন্ঠে বললেন, ‘তোরা যে এতো কষ্ট পাবি আগে জানতাম না। আমি যা বলতাম তা মুখে মুখেই। অন্তর থেইকা কিছুই বলি নাই। তোরা তো আমার নাতনী। কলিজা। তোরা কষ্ট পাইলে আমি কই যামু? দাদীর উপরে আর রাগ করে থাকিস না। মাফ কইরা দে।’

মিতালী প্রতিত্তুরে অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো, ‘দাদী। আমরা কিছু মনে করিনি। শুধু শুধু তুমি এমন মন খারাপ করছো। মাফ চাইতে হবে না।’

বলেই জুলেখাকে জড়িয়ে ধরলো। সুপ্রসন্ন হলো জুলেখা। মিতালীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর শেফালীকে এক হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো। শেফালীও ঠোঁট উল্টালো। এগিয়ে এসে দাদীর অপর পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘সরি দাদী।’

প্রতিত্তুরে জুলেখা মুচকি হাসলেন শুধু। আমেনা মিতালীর রুমে ডাক দিতে এসে দাদী-নাতনীর এই অবস্থা দেখে প্রশান্তির হাসি দিলেন। যাক অবশেষে তাদের মান অভিমান, ভুল বুঝাবুঝি ভাঙ্গলো বলে।

চলমান..

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[২২]

মনিরার বিয়ের আর মাত্র তিন দিন বাকি। সেই সুবাধে শেফালী তুমুল রুপে ব্যস্ত। শপিং থেকে শুরু করে একদম রুপচর্চা পর্যন্ত। বিকেল চারটা পনেরো। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরেই শপিংমলে আসলো শেফালী। মিতালীকে জোড় করেছিলো আসার জন্য কিন্তু সে আসে নি। কারণ তার ইচ্ছে ছিলো মায়ের হলুদ লাল সংমিশ্রনের শাড়িটা পরে যাবে। তাই বেহুদা কিছু কেনাকাটা করতে চায়নি। বিশালবহুল শপিংমলের চারপাশ কোলাহলপূর্ণ। বাহিরে তীব্র হর্ণের ধ্বনিতে মুখরিত পরিবেশ। ঠিক তেমনি শপিংমলের ভিতরের পরিবেশও কোলাহলে ভরপুর। শেফালী কয়েকটা শপে ঘুড়ে ঘুড়ে একটা সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস লেহেঙ্গা নিলো। সাথে ম্যাচ করে কিছু অর্নামেন্ট কিনলো। এক হাতে তার কোকাকোলার বোতল। অপর হাতে শপিং ব্যাগ। চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। হঠাৎ খেয়াল করলো পাশের সিঁড়ি তে পরিচিত কেউ উপরে উঠছে। চোখ ছানা বড়া হয়ে গেলো। এখানে এই লোকটা কেন? উফফ বিরক্তিকর। এই উটকো ঝামেলায় নতুন করে আর পরতে চায়না সে। তাই ঘুরে দাঁড়ালো যেন তাকে দেখতে না পায়।

শেফালীকে এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো রাকিব। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার আগেই শেফালীকে সে খেয়াল করেছে। কিন্তু পাশে তার চাচি অর্থাৎ অংকুরের মা সুপ্তি থাকায় নিশ্চুপ থেকেছে শুধু। ভেবেছিল কথা বলবে না আজ। যেভাবে এসেছে সে ভাবেই চলে যাবে। কিন্তু এখন শেফালীর এরূপ ব্যবহারে তাকে একটু টাইট তো দিতেই হয়। নাহলে চলবে না। মনে মনে শয়তানী হাসি দিলো একটা। শেফালীকে না দেখার ভান করে থাকলো।

শেফালী সেকেন্ড ফ্লোরে নেমে তাড়াতাড়ি করে রাকিবের চোখের আড়াল হওয়ার চেষ্টা করলো। দূরে এসে বুকে হাত গুঁজে স্বস্থির নিশ্বাস ছুঁড়লো একটা। তার ধরনা রাকিব তাকে দেখতে পায়নি। এবারের যাত্রায় বেঁচে গেছে ভেবেই হাসি দিলো একটা। ঘড়ির দোকানে যাবার জন্য পিছু ঘুরতেই দেখলো রাকিব তার পিছনে। ভড়কে গেলো শেফালী । আশ্চর্য হয়ে একবার তৃতীয় ফ্লোরে তাকালো। তারপর রাকিবের দিকে তাকালো। অবাক হলো সে। এই মাত্র না উপরে উঠতে দেখলো? তাহলে দ্বিতীয় ফ্লোরে আসলো কখন? চেহারায় বিস্ময় রেখে প্রশ্ন করলো, ‘আপনি না থার্ড ফ্লোরে ছিলেন?’

‘হুম!’ রাকিব পকেটে দুই হাত গুঁজে ছোট করে উত্তর দিলো। শেফালী আবারো তৃতীয় তলায় তাকিয়ে রাকিবের দিকে তাকালো। বললো, ‘এখানে এসেছেন কেন?’

রাকিব আগের মতোই দাঁড়িয়ে থেকে বললো, ‘এটা কি তোমার বাপের সম্পত্তি? এখানে আসতে মানা?’

ভ্যাবাচেকা খেলো শেফালী। কন্ঠস্বর হালকা করে বললো, ‘না। আমি তা বলতে চাইনি।’

রাকিব ঠোঁট দুটো গোল করে টান দিয়ে বলো, ‘ওহহ আচ্ছা! তাহলে কি বলতে চাইছো?’

বিরক্ত হলো শেফালী। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো। বললো, ‘আমার কাছে এসেছেন কেন?’

রাকিব প্রথমের মতোই বললো, ‘তোমার কাছে কখন আসলাম? তোমার আর আমার মাঝে কতো খানি দূরত্ব দেখেছো? হুদাই আমার মতো কিউট ভদ্র একটা ছেলের উপর মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছো কেন?’

শেফালীর সহ্য হলো না আর। অধৈর্য হয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো। রুক্ষভাষী কন্ঠে বলে উঠলো, ‘তাহলে আর এখানে আছি কেন? আমি যাচ্ছি। পিছু আসবেন না একদম।’

গটগট পায়ের কদম ফেলে সামনে এগুতে লাগলো শেফালী। রাগে শরির রিনরিন করছে তার। দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড় করছে। কেন যে সেদিন এই ছেলের হাতে কাপ টা ধরাতে গেলো। এর থেকে বোধহয় হাজার গুণ বেশি ভালো ছিলো নিজেই ছয়শো টাকা জরিমানা দিয়ে দিতো। বিরক্ত হলো নিজের উপর।

পিছন থেকে রাকিব তার চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ঠোঁটে তার মৃদু বাঁকা হাসি। এক হাতে নাক হাল্কা চুলকে পিছু নিলো শেফালী। দ্রুত পা চালিয়ে শেফালীর পাশে আসলো। দ্বিতীয় তলা থেকে এখন তারা নিচ তলায় আছে। রাকিব শেফালীর পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠলো, ‘আমার সাড়ে আটশো টাকা?’

দাঁড়িয়ে পরলো শেফালী। অবাক চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘আপনি তো দেখছি আস্তো বেহায়া একটা লোক।’

‘ও হ্যালো? হাদিসে আছে পাওয়াদারের টাকা চাওয়ার অধিকার আছে। তাই আমি আমার টাকা চাচ্ছি।’

শেফালী ব্যঙ্গ্য করে বলে উঠলো, ‘তাই ছয়শো টাকাকে সুদে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাড়ে আটশো করতে হাদিসে বলেছে তাই না?’

ফুঁশ করে নিশ্বাস ছুঁড়লো রাকিব। এই মেয়ের সাথে কথা বলে পারা যায় না। বিয়ের পর তো মাথার চুলও থাকবে না। চোখের চাহনী দেখেই অর্ধেক ম:রে যেতে ইচ্ছে করে। এরে বিয়ে করলে তো জীবন তেজপাতা। স্বেচ্ছায় নিজের জীবনে বাশঁ বাগান করছি। মনে মনে ওইসব কথা আওড়াচ্ছে রাকিব। মনে হাসলেও উপরে বুঝালো না। বরঞ্চ বললো, ‘আমি একটা কথা ভাবছি। জানো সেটা কি?’

শেফালী বিরক্তি নিয়ে বললো , ‘আমি কি আপনার মনের ভিতরে গিয়ে বসে আছি নাকি যে জানবো।’

‘উফফ প্রতিবার তোমার ত্যাড়া ত্যাড়া উত্তর। তোমার ফিউচার হাসবেন্ডের কপাল আসলেই পুড়া।’

‘আমার জামাইকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।’

শেফালী কন্ঠে রুক্ষতা এনে বলে উঠলো। রাকিব মনে মনে হাসলো। মেয়েটা কে রাগাতে তার বেশ লাগছে। অপরদিকে শেফালী তো মহা বিরক্ত। এই ছেলে এতো ছ্যাঁচড়া হবে ভাবতে পারেনি সে। এমন উটকো ঝামেলা কই থেকে আসলো তার কপালে? হঠাৎ রাকিবের পিছনে খেয়াল করলো তার বাবা জুলফিকার তারই দিকে এগিয়ে আসছে। প্রচন্ড রকমের বিস্মিত হলো শেফালী। কারণ এমন সময় জুলফিকারের এখানে আসার কোনো কারণ নেই। রাকিব শেফালীর দৃষ্টি অনুসরন করে পিছনে ফিরে তাকালো। এক ভদ্র লোককে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকালো। এই লোক কে?

জুলফিকার তাদের দুজনের সামনে এসে দাঁড়ালো। রাকিবের আপাতমস্তষ্ক একবার ভালো করে প্রখর করে শেফালীকে প্রশ্ন করলো, ‘তোমার কেনাকাটা করার কথা ছিলো? শেষ হয়েছে?’

শেফালী ভীতিগ্রস্ত হলো। তার বাবা প্রচুর রাগি মানুষ। তাকে একজন ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে যদি রেগে যায়? আর রাগবেই বা কেন? এই লোক তো বাবার বন্ধুর ছেলে। সুতরাং পরিচিত যেহেতু রাগবে না। স্বস্থির নিশ্বাস ছুঁড়লো শেফালী। স্বাভাবিক ভাবে বললো , ‘হ্যাঁ আব্বু। আমার শেষ। তুমি এখানে কি করছো?’

‘তোমার আম্মু আমাকে বলেছে যেহেতু এইদিক দিয়েই বাসায় ফিরছি তাই যেন তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাই। তোমার নাম্বারে কল দিয়েছি ধরো নি।’

বাবার কথা শুনে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখলো সাইলেন্ট করা। জিভ দাঁত দিয়ে কাটলো সে। ঠোঁটে বোকা বোকা দিয়ে বললো, ‘সরি আব্বু। সাইলেন্ট ছিল।’

‘ঠিক আছে।’

রাকিব এতোক্ষণ নিরব দর্শকের মতো চুপচাপ শুনছিল সব কথা। তার মানে এই ভদ্রলোক শেফালীর বাবা?চেহারাও দেখতে এক রকম। কিন্তু চিন্তিত হলো অন্য কথা ভেবে। এখন যদি জেনে যায় সে তার বাবার বন্ধুর ছেলে নয়? মিথ্যে বলেছে এতোদিন? তাহলে? এই মেয়ে একদম ধানিলঙ্কা। এখানে চেঁচামেচি করে ইজ্জতের ফালুদাও বানিয়ে দিতে পারে। এই মেয়েকে বিশ্বাস নেই। এক হাত মুষ্ঠি বদ্ধ করে গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করলো। তারপর জুলফিকারের দিকে হাত বাড়িয়ে কুষলবিনীময় করলো, ‘আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। কেমন আছেন?’

জুলফিকার নিরবে মুখে সৌজন্যমূলক হাসি রেখে হাত মিলিয়ে উত্তর দিলো, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। কিন্তু তোমাকে তো ঠিক..’

কথা সম্পূর্ণ করার আগেই রাকিব হেসে বলে উঠলো, ‘আরে আঙ্কেল আমি রাকিব ওয়াজিদ। কিছুদিন আগে না আমাদের দেখা হলো? ভুলে গেলেন নিশ্চয়।’

কানফিউজড হয়ে গেলেন জুলফিকার। কপালে পরলো তার সূক্ষ্ম চিন্তার ভাজ। মনে করতে লাগলেন ঠিক কবে দেখা হলো। বললেন, ‘আসলেই দেখা হয়েছিলো? আমার তো মনে হচ্ছে না। তোমার পরিচয় কি?’

বাবার কথা শুনে বড়োসড়ো একখান শক খেলো শেফালী। বিস্মিত চোখে ছানাবড়া করে তাকালো রাকিবের দিকে। তার এমন চাহনীতে রাকিব পরলো বিপাকে। এবার কি হবে? ঠোঁট কামড়ে ভাবলো কিভাবে কি বলবে। তার আগেই শেফালী তার বাবাকে প্রশ্ন করে বসলো, ‘আব্বু তুমি উনাকে চিনো না?’

জুলফিকার স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলেন, ‘না। আজই প্রথম দেখা হলো।’ তারপর রাকিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাবা তোমার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।’

রাকিব এবার বেশ অস্বস্তিতে পরলো। ঠোঁট কামড়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। শেফালী দাঁতে দাঁত পিষে কটমট চোখে রাকিবের দিকে তাকালো। রাগে তার গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। এতোদিন তাকে এভাবে বোকা বানিয়েছে? কি মিথ্যুক এই ছেলে। বাবার বন্ধুর ছেলে বলে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে তাকে। এই মুহূর্ত বাবা পাশে না থাকলে এই চেলের মাথার একটা চুলও জীবিত রাখতাম না। মনে মনে ফুঁশছে শেফালী।

এতো দূর পর্যন্ত এসে এভাবে ধরা খাবে বুঝতে পারেনি রাকিব। যদিও একদিন সব সত্যি সে শেফালী কে বলতো। কিন্তু বলার আগে চেয়েছিল দুজনের মাঝে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে। এমনিতেই যেভাবে ঝগড়া হয় দুজনের মাঝে। এখন থেকে তো সাপ নেউলের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাবে। আড় চোখে শেফালীর দিকে তাকালে দেখতে পেলো সে অগ্নি চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখ ফিরিয়ে নিলো রাকিব। হাত ঘড়িতে সময় দেখে জুলফিকারের উদ্দেশ্যে বললো, ‘হবে হয়তো কোনো পরিচিত মুখের সাথে আপনাকে মিলিয়ে ফেলেছি। আচ্ছা আঙ্কেল আমি চাচির সাথে শপিং’এ এসেছিলাম। অনেকক্ষন তো হলো চাচি বোধহয় আমাকে খুঁজছে। আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। এবার আসি।’

জুলফিকার প্রছন্ন হেসে সম্মতি দিলেন। এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না রাকিব। দ্রুততার সাথে পা চালিয়ে স্থান প্রত্যাখ্যান করলো। সে যেন এখান থেকে পালিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

রাকিব যেতেই জুলফিকার প্রশ্ন করলেন, ‘ছেলেটা কে শেফালী?’

রাকিবের যাওয়ার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে ছিলো শেফালী। বাবার কথা কর্ণপাত হতেই চকচকিয়ে তাকালো। তাৎক্ষনাৎ মাথায় যা আসলো তাই বলে ফেললো।

‘আমাদের কোচিং’এ স্যার অসুস্থ থাকায় তার পরিবর্তে উনি ক্লাস করিয়েছিলো কয়েকদিন। সেখানেই পরিচয়।’

‘ছেলেটা অনেক ভালো।’ প্রতিত্তুরে আলতো হেসে বললেন জুলফিকার। ইশারায় শেফালীকে আসতে বলে শপিং মল থেকে বের হওয়ার জন্য অগ্রসর হলেন। শেফালী আহাম্মকের মতো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। কি বললো বাবা? ছেলেটা ভালো? সিরিয়াসলি? এই ছেলের মতো বদ ও ছ্যাঁচড়া দুনিয়াতে আর একটাও আছে কিনা সন্দেহ। একবার শেফালীর জায়গায় এসে দেখতো এই ছেলের রুপ তাহলে বুঝতে পারতো ভালো কিনা। বিরক্তিতে নাক মুখ কালো করে জুলফিকারের পিছু হাঁটছে আর ভাবছে রাকিব কে কিভাবে হ্যানস্তা করা যায় তা নিয়ে। এতোদিন যে এভাবে ভয় দেখিয়েছে তার প্রতিশোধ তো নিতেই হবে।

চলমান..

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[২৩]

সন্ধ্যা নেমে চারপাশ অন্ধকার হলো কেবল। কিছুসময় পূর্বে মুয়াজ্জিনদের আজানের ধ্বনি তে মুখরিত হয়ছে পরিবেশ। মুসল্লি সব মসজিদে পারি জমিয়েছে জামায়াতে নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে। বাসার গেইট পর্যন্ত শেফালীকে পৌঁছে দিয়ে মসজিদে গেলেন জুলফিকার। শেফালী গটগট পায়ে বাসায় আসলো। নিজের রুমে গিয়ে প্রথমে ফ্রেশ হয়ে নিলো। শপিং ব্যাগ গুলো হাতে নিয়ে পা বাড়ালো বোনের রুমের উদ্দেশ্যে।
.

অন্ধকারাচ্ছন্ন বারান্দার কিনার। মৃদু বাতাসে বারান্দায় ঝুলন্ত টবে বেবি টিয়ারস গুলো দুলছে। রাস্তাঘাট সোডিয়ামের নিয়ন আলোতে আলোকিত। বেতের মোড়ায় পা তুলে আসন পেতে বসে আছে মিতালী। কানে মোবাইল রেখে শুনছে অংকুরের যতো সব অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা। সন্ধ্যার পরেই অংকুর কল দিয়ে সেই যে কথা শুরু করেছে। সেই কথার ঝুলি এখনো শেষ হয়নি তার। মিতালী শুধু ‘হ্যাঁ’ ‘হুম’ ‘আচ্ছা’ বলে কথার সাথে তাল মেলাচ্ছে। অংকুরের মতো মিচিউরড একটা পারসনের এমন বাচ্চা সুভল আচরনে ভারী আশ্চর্য হয় মিতালী। হাসি পায় প্রচুর। আবার ভালোলাগা কাজ করে মনে। আনমনে মুচকি হাসলো মিতালী।

‘কি দেখছো তুমি?’

অংকুরের এমন প্রশ্ন শুনে আলতোভাবে হাসলো মিতালী। সেই কখন থেকে অংকুর বাচ্চাদের মতো অপ্রয়োজনীয় কথা বলছে। কখনো মিতালীর হাসি পাচ্ছে। আবার কখনো এমন উদ্ভট প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে। ব্যাপার টা বেশ উপভোগ করে সে। এখনও তাই হচ্ছে। দেয়ালে মাথা হেলান দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো, ‘আকাশ দেখছি।’

মোবাইলের অপর পাশে অংকুরও আকাশের দিকে তাকালো। ছাদের এক পাশে বসে আছে সে। তার থেকে একটু দূরে রাকিব মোবাইল ঘাটছে। সন্ধ্যার পর রাতে বেশিরভাগ সময় সে ও রাকিব একইসঙ্গে ছাদে সময় কাটায়। রাকিবের মোবাইলে মৃদু আওয়াজে চন্দ্রপাঠ ব্যান্ডের ‘ব্যবিলন’ গানটা বাজছে। গানটা রাকিবের প্রিয়। বলতে গেলে দুই ভাই বাংলা ব্যান্ডের বিশাল ভক্ত। বাঙ্গালী ছেলে হয়ে বাংলা ব্যান্ডের প্রতি আগ্রহ থাকবে না তা কখনোই হয়না। বাংলা ব্যান্ডের গান মানে আবেগ, হৃদয়ে লোকানো অনুভূতি। যা বুঝার মতো মন সবার থাকে না। তাই তো বর্তমান প্রজন্ম গান মানেই হিন্দি ও ইংলিশই বুঝে। এই জন্যই বোধহয় বাংলা গান রসাতলে যাচ্ছে।
.

অংকুর রেলিং’এর উপর বসে আছে। রাত্রীর জ্যোৎস্নায় আলোকিত আকাশের দিকে তাকিয়ে মিতালীর কথার প্রতিত্তুর করলো, ‘আকাশ হচ্ছে একটা মানুষের মনের অদৃশ্য ক্যানভাস। তাই এই বিশাল আকাশটা আমার খুব প্রিয়।’

অংকুরের কথার গভীরত্ব ঠিক ধরতে পারলো না মিতালী। ভাবান্তর আসলো তার মাঝে। দূর আকাশটা অদৃশ্য ক্যানভাস? কিভাবে? বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো, ‘মানুষের মনের অদৃশ্য ক্যানভাস?’

অংকুর স্বাভাবিক ভাবে উত্তরে বললো, ‘মানুষের মন যেমন পরিবর্তনশীল। ঠিক তেমন আকাশের রুপও পরিবর্তনশীল। কখনো রৌদ্দুর, কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি আবার কখনো পরিষ্কার আকাশ। মানুষ কথার মাধ্যমে অনুভূতি প্রকাশ করে কিন্তু আকাশ করে তার রুপ পরিবর্তনের মাধ্যমে। আকারের মতোই তার গভীরত্ব। যা বুঝার সাধ্য সবার থাকে না।’

এতোটুকু বলে থামলো অংকুর। মিতালীর প্রতিত্তুর শুনার জন্য অপেক্ষা করলো। কিন্তু অপর পাশে মিতালী নিশ্চুপ রইলো। আসলে চুপ থেকে অংকুরের কথা বুঝার চেষ্টা করছে। তাকে নিরব দেখে অংকুর মৃদু গলায় আবারো বলতে লাগলো,

‘মানুষের মন যখন বিষন্ন থাকে তখন সে নিরব থাকে। চেহারা তার মলিন দেখায়। দুঃখের সাথে যখন আর পেরে উঠতে পারে না। তখুনি অঝরে কেঁদে উঠে। দীর্ঘক্ষণ কান্নার পর বিষন্ন মন হালকা হয়। মেজাজ হয় ফুরফুরে। আকাশও তেমনি। যখন তার মন খারাপ থাকে তখন ঘন কালো মেঘে আবৃত হয়। তারপর আকাশ কাঁপিয়ে ভারি বর্ষণ হয়ে পৃথিবীর বুকে আঁচড়ে পরে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটার সাথে মুছে যায় যতো গ্লানি। কেটে যায় মন খারাপ। স্বচ্ছ হয় আকাশ।’

সম্পূর্ণ সংজ্ঞা শুনে স্মিতি হাসলো মিতালী। তাকালো আকাশের দিকে। থোকায়-থোকায় সাদা মেঘ উড়ছে। তারা গুলো স্পষ্ট ঝিকিমিকি হয়ে জ্বলছে। পূর্ণাঙ্গ চাঁদটা গোলাকার। তার জ্যোৎস্না গায়ে মাখছে পৃথিবী। তাহলে কি আজকের আকাশের মন ভালো? বিষণ্ণবদন নেই আকাশের মাঝে? মিতালীর মনের মতোই আকাশের মন ফুরফুরে? আনমনে হেসে উঠলো। বললো, ‘বাহ্ আকাশের গভীরত্ব বুঝার ক্ষমতা আপনার আছে। তবে আমার নীল আকাশটা ভালো লাগে।’

মৃদু আওয়াজে হাসলো অংকুর। হাসির ধ্বনি অল্প হলেও স্পষ্ট মিতালীর কানে এসে বাজলো। অংকুর আবারো বলে উঠলো,

‘আকাশের কোন রং নেই। আমার মনের মত অসীম। আমার মহাশূন্যের শূন্যতা তোমার কাছে নীল মনে হয়। আমার দুঃখের বোঝা তোমার কাছে মেঘ মনে হয়। তুমি বৃষ্টিতে ভিজো। আমি নীল হয়ে গেলে তুমি ভুল হয়ে ভাবো আমি বেদনার মত সুন্দর।’

মিতালী নিশ্চুপ রইলো। অংকুরের বলা প্রতিটা কথা অর্থপূর্ণ। তাকে নিয়ে বলা। হয়তো সে অংকুরের কাছে একটু বেশি স্প্রেশাল! ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুটে এলো মিতালী। আরো কিছু বলতে নিলেই পিছন থেকে শেফালী ডেকে উঠলো।

‘বুবু? বারান্দায় আছো তুমি?’

কান থেকে মোবাইল নামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বারান্দার দরজার দিকে তাকালো। বললো, ‘হ্যাঁ এখানেই আমি। আয়।’

অপর পাশে অংকুর নিশ্চুপ হয়ে রইলো। বুঝতে পারলো দুই বোন এক সাথে কথা বলবে। কিন্তু তার কথা শেষ হয়নি। তাই লাইন কাটলো না। ওদের দুই বোনের কথা শেষে নিজের কথা বলবে।

শেফালী মোবাইলের লাইট অন করে বারান্দায় এসে মিতালীর পাশে ধপ করে বসে লাইট অফ করলো। এইটুকু আলোতে মিতালী বুঝে গেলো বোনের মন ভালো নেই। কোনো ব্যাপারে সে অসন্তুষ্ট। কি হয়েছে তা জানার জন্য প্রশ্ন করলো, ‘কি হয়েছে তোর?

শেফালী বিরক্ত সহিত বলে উঠলো, ‘ইচ্ছে করে একটা শয়তান কে বুড়িগঙ্গা নদীতে নিয়ে চু:বিয়ে মা:রি। প্রচুর রাগ হচ্ছে আমার বুবু। এই শেফালীকে কিনা একটা ছেলে বোকা বানায়? এতো সাহস এই দুনিয়াতে কারোর হয় নাই। সত্যি বলছি বুবু এই ছেলে কে মে:রে জেলে গেলেও আমার আফসোস থাকবো না। তুমি আমার জামিন করিয়ে আনবে। ঠিক আছে?’

মিতালী ভ্রুঁ কুঁচকিয়ে বললো, ‘ কোন ছেলে?’

‘তুমি চিনবে না। এখন বলো শয়তান পোলাকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায়?’ শেফালীর কথায় পালটা প্রশ্ন করলো মিতালী, ‘তার আগে বলেন আপনি কি করেছেন?’

থমথমে খেলো শেফালী। এমন প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। কিছুটা আমতা আমতা করে বলে উঠলো, ‘আমি কিছু করিনি। আমি একদম নিষ্পাপ একটা মেয়ে। আমি কিছুই করতে পারি না।’

মিতালী সন্দেহপ্রবন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘এক হাতে তালি বাজে না। সত্যি করে বল কি করেছিস তুই?’

চুপ হয়ে গেলো শেফালী। সোজা হয়ে বসলো। আড় চোখে মিতালীর দিকে তাকালো একবার। ইশ এখন যদি বলে সে কাপ ভেঙ্গে ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে তাহলে নির্ঘাত তাকে বকবে বুবু। তাছাড়া টাকা ফেরত দিতে বলবে যা কখনোই সম্ভব না। এতো দিন জ্বালাতন সহ্য করে কিনা শেষে এসে টাকা দিয়ে দিবে? ইম্পসিবল!

মিতালী এখনো তার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ-ই মোবাইলের স্কিন জ্বলে উঠলো। দেখলো অংকুর এখনো লাইনে। স্বাভাবিক ভাবেই মোবাইল উঠিয়ে কানের কাছে এনে বললো, ‘লাইন কাটেন নি?’

দুই বোনের কথোপকথন শুনে বেশ মজা পেলো অংকুর। হাসি পেলো তার। মিতালীর কথার প্রতিত্তুরে বললো, ‘না। তোমাদের দুই বোনের আলাপ শুনছিলাম।’

বোনকে কথা বলতে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকালো শেফালী। স্কিনে অংকুরের নাম দেখে বুঝে গেছে সব। তার মানে বুবু আর অংকুর ভাইয়া? ভাবতেই উল্লাসিত হলো। প্রফুল্লিত মনে বলে উঠলো, ‘বুবু স্পিকার দাও। কথা বলবো জিমির সাথে।’

বিরক্তির চোখে শেফালীর দিকে তাকালো মিতালী। শেফালীর কথা অংকুর অপর পাশ থেকে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। তাই মিতালীকে বললো, ‘স্পিকার দাও। এক মাত্র শালিকার সাথে কথা বলি।’

মিতালী কন্ঠস্বরে অসন্তুষ্টি এনে বললো, ‘বেশি কথা বলেন কেন? আজব মানুষ।’

শেফালী এক প্রকার জোড় করে মিতালীর হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে স্পিকার দিয়ে বললো, ‘হ্যালো জিমি। কেমন আছো?’

অংকুর প্রছন্ন হেসে উত্তর দিলো, ‘ভালো। তুমি?’

‘এইতো আমিও ভালো। জানো আমি এখন অনেক অনেক খুশি।’

‘একটু আগে না রেগে ছিলে? কাকে যেন মে:রে জেলে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলে তুমি?’

‘ওটা তো আগের কথা। কিন্তু আমি এখন খুশি। আমার ভাবতেই অবাক লাগছে বুবু আর তুমি ইন আ রিলেশনশিপ। সিরিয়াসলি ভাইয়া? এই খুশিতে কালকে একটা ট্রিট চাই।’

‘অবশ্যই।’

দুজনের কথোপকথন নিরবে শুনছে মিতালী। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে তারা বহু পূর্বের পরিচিত। আর মিতালী? সে তো তাদের দুইজনের মাঝে কাবাবের হাড্ডি। শেফালী কথায় কথায় কখনো জিজু, কখনো জিমি বলে ডাকছে। সব শুনে হতাশ হলো মিতালী। এই মেয়েকে নিয়ে সে আর পারে না।

দূর থেকে অংকুরের কথা শুনে ভ্রুঁ কুঁচকালো রাকিব। একটু আগেও ফিশফিশ করে কথা বলা ছেলেটা এখন জোড়ে জোড়ে কথা বলছে। আবার হাসছে। সন্দেহ হলো তার। কার সাথে কথা চলছে এখন? জানার আগ্রহ হলো । তাই দূর থেকেই ডেকে বলে উঠলো, ‘কিরেহ্? এখন আবার কার সাথে কথা বলছিস তুই?’

মোবাইল কানে রেখেই অংকুর আওয়াজ বড় করে উত্তর দিলো, ‘একমাত্র শালিকার সাথে।’

হেসে উঠলো রাকিব। ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো, ‘বাহ্ শালিও আছে দেখছি।’

‘হ্যাঁ। তুই কিন্তু আবার নজর দিস না।’ অংকুরের কথা শুনে অপর পাশ থেকে শেফালী নিঃশব্দে হেসে উঠলো। যদিও সে জানে না অপর পাশের দ্বিতীয় ব্যক্তিটি রাকিব। অন্যদিকে মিতালী বরাবরই বিরক্ত হয়ে বসে আছে। বিয়ের আগেই দুলাভাই – শালি হয়ে বসে আছে দুজন।

অংকুরের কথার প্রতিত্তুরে রাকিব বললো, ‘অন্য কারোর দিকে তাকানোর দরকার নেই। কারণ আমার একজন আছে।’

ছেলেটির কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত হলো শেফালী। নিঃসংকোচে স্বীকার করে নিলো তার একজন আছে। মেয়েটি নিশ্চয় অনেক লাকি। নাহলে আজকালকার যুগে এমন লয়াল বয়ফ্রেন্ড কয়টা পাওয়া যায়?

চলমান..