অনেক সাধনার পরে পর্ব-৪৯

0
344

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[৪৯]

শেফালীর হাত শক্ত করে ধরে হাঁটতে লাগলো রাকিব। থামার নাম নেই তার মাঝে। রাকিবের পায়ের গতির সাথে লেহেঙ্গা পরিহিত শেফালী তাল মেলাতে পারছে না। লেহেঙ্গায় পা পরছে বারবার। বিরক্ত হলো বেশ। বাহিরে আসার পর রাকিবের হাত ঝামটা মে’রে ছাড়িয়ে নিলো। দাঁড়িয়ে পরলো রাকিব। তীক্ষ্ণ চোখে শেফালীর দিকে ফিরে তাকালো। রাকিব শক্ত করে হাত ধরায় হাতটা এখন জ্বলছে প্রচুর। ফরশা হাতে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ পরে লাল হয়ে গেছে। লাল লাল আঙ্গুলের দাগ দেখে মহা বিরক্ত ও রাগ হলো শেফালী। অসন্তোষজনক চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘সমস্যা কি আপনার? এভাবে ধরে আনার মানে কি?’

রাকিব চোয়াল শক্ত করে রাগি গলায় বললো, ‘সমস্যা আমার না তোমার। ওই রায়াজের সাথে এতো কিসের তোমার হ্যাঁ? ওই ছেলে কেন তোমার হাত ধরবে? ভাই বলেই কি হাত ধরে হাহা হিহি করা লাগবে? আমারো তো অনেক মেয়ে কাজিন আছে। আমি তাদের হাত ধরেছি কখনো? তাহলে রায়াজ কেন ধরবে তোমাকে?’

রাকিবের কথা শুনে বোকা বনে গেলো শেফালী। আহাম্মকের মতো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল। রাকিবের এমন করার কারণ সম্পূর্ণ ভাবে বুঝে আসলো শেফালীর। জেলাস!

রাকিব আবারো রাগে দাঁত চিবিয়ে বললো, ‘শেফালি তোমাকে লাস্ট বারের মতো বলছি। ওই ছেলে যেন তোমার আশেপাশে না থাকে। নয়তো, নয়তো বড় ঝা’মে’লা পাকিয়ে ফেলবো।’

শেফালী ভ্রুঁ দুটো উচিয়ে রেগে তাকালো। কোমড়ে দুই হাত রেখে পালটা রাগ দেখিয়ে বললো, ‘রায়াজ আমার হাত ধরলে আপনার কি?’

‘শেফালী??’ দাঁতে দাঁত কটমট করে বললো রাকিব। শেফালীর রাগ আরো বাড়লো। রুক্ষভাষী কন্ঠে বলল, ‘জেলাস হবেন ভালো কথা। তাই বলে না জেনে ভুলবাল দেখে জেলাস হবেন? আশ্চর্য ভাই আপনি। রায়াজ আমার মামাতো ভাইই লাগে। তার একটা বউ আছে। আর তিন মাস পর সে বাবা হবে। বলি দুনিয়াতে এতো এতো ছেলে থাকতে আমার বিয়াইত্তা মামাতো ভাইরে দেখে জেলাস হলেন? আর একটু আগে কাহিনী টা কি করলেন? বড় ভাইয়ের সামনে আমার মান ইজ্জতের ফালুদা করে দিলেন। এখন উনি কি ভাব্বে বলেন।’

রাকিব বিস্মিত হলো। অবাক চোখে তাকালো শেফালীর দিকে। বিবর্ণ হলো তার মুখখানি। এক হাতে মাথার পিছনের চুল গুলো চুলকে বললো, ‘উনার বউ আছে?’

রাকিবের কথাটি ব্যঙ্গ্য করে শেফালী রিপিট করলো। রাগ দেখিয়ে বললো, ‘চুপ! আর একটাও কথা বলবেন না। কি বললেন তখন? ডোন্ট ট্রাই টু টাচ হার এগেইন। খুব তো বড় বড় করে বলে দিলেন। এখন রায়াজ ভাই যদি আব্বুকে বলে দেয়?’

ফ্যাকাশে হয়ে এলো রাকিবের মুখ খানি। আড়ষ্ট গলায় বললো, ‘এখন আমি কি করবো?’

শেফালী কটমট চোখে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো, ‘আমার মাথাটা চিবিয়ে খান।’

চলে লেহেঙ্গা ধরে সামনে এগুতে লাগলো শেফালী। পিছন থেকে রাকিব ডাক দিলো আবারো। বললো, ‘এখন কি করবো কিছু তো বলে যাও।’

শেফালী পিছনে মাথা ঘুরিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো, ‘খবরদার! আমাকে ডাকবেন না। তখন বলার আগে মাথায় ছিলো না? স্টুপিড।’

দাঁড়ালো না শেফালী। দ্রুত পা চালিয়ে ভিতরে চলে গেলো। রাকিব আগের জায়গায় আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত হলো। মনে মনে নিজেকে শ’খানেক গালি শুনিয়ে দিলো। বিড়বিড় করে বললো, ‘একেই বুঝি বলে নিজের পায়ে নিজে কু’ড়া’ল মা’রা।’
.

রিসিপশন শেষ! এবার মিতালীদের বাসায় যাওয়ার পালা। মিতালী অংকুরের ব্যাগ সহ নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। তার শাশুড়ির দেওয়া জলপাই রঙের একটা শাড়ি হাতে নিয়ে পরে নিলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ রুপে তৈরি হয়ে নিলো। তখুনি রুমে আসলো অংকুর। তাকে দেখে মিতালী সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘আমি রেডি। এবার যাওয়া যাক?’

অংকুর মিতালীর পা থেকে মাথা অব্ধি দেখলো। সাজটা তার পছন্দ হলো না। চুপচাপ আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো। অংকুরের এমন কাজে অবাক হলো মিতালী। কিছু বললো না কেন লোকটা? মন খারাপ? নাকি রেগে আছে? অংকুর চুপচাপ পুরো আলমারি ঘাটলো। মিতালীকে দেওয়া সব শাড়ি খুঁজে খুঁজে পছন্দ মতো হলুদ রঙের একটা শাড়ি বের করলো। শাড়িটা মিতালীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘এটা পরে আসো।’

বিবর্ণ ধারণ করলো মিতালী মুখশ্রী। মাথা নিচু করে নিজের পরনের শাড়িটা দেখলো। এই জলপাই কালারের শাড়িটা তার শাশুড়ির দ্বিতীয় শাড়ি। এই শাড়ি পরেই নাকি উনি বিয়ের পর প্রথম তার বাবার বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাই সখ করে এই শাড়িটা মিতালীকে দিয়েছে পরার জন্য। এখন এই শাড়ি খুলে হলুদ শাড়িটা পরবে সে? শাশুড়ি মায়ের এইটুকু ইচ্ছেটা পূরণ করবে না সে? মিতালী অংকুরের দিকে মলিন চোখে তাকিয়ে বললো, ‘পরনের টাই থাক না। শাড়িটা মা দিয়েছে পরার জন্য। খুলে ফেললে কষ্ট পাবে।’

অংকুর তার কথায় অটুট থেকে বললো, ‘পাবে না। তুমি হলুদ শাড়িটা পরো। হলুদ শাড়িতে তোমাকে দারুণ লাগে। যাও বদলে আসো।’

‘হলুদ শাড়িটা নাহয় কাল পরি? আজ এটাই থাক।’

কিছুটা বিরক্ত হলো অংকুর। কন্ঠস্বর একটু বড় করে বললো, ‘বললাম তো কষ্ট পাবে না। তুমি হলুদটাই পরবে।’

মিতালী এগিয়ে অংকুরের কাছে এসে শাড়িটা হাতে নিয়ে বললো, ‘শাড়িটা ব্যাগে নিয়ে নিচ্ছি। কাল পরবো।’

হঠাৎ-ই রাগ হলো অংকুরের। মিতালীর হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে আলমারি ঢিল দিয়ে ফেলে বললো, ‘পরতেই হবে না।’ বলেই গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। বিয়ের পর এই প্রথম কোনো ব্যাপারে অংকুর তার কাছে আবদার করলো। কিন্তু সেই আবদার মিতালী রাখতে পারলো না? কি হতো হলুদ শাড়ি টা পরলে? আম্মুকে বললে তো আম্মু বুঝতে পারতো। মুখের উপর বলে দিলো কাল পরবে? ইগোতে লাগলো অংকুরের। রাগ হলো প্রচুর। অভিমান জমলো মনে।

মিতালী অবাক চোখে দরজায় তাকিয়ে রইলো। রেগে গেলো লোকটা? ক্ষুন্ন হলো মিতালীর মন। অংকুরের ছোট আবদারটা পূরণ না করার জন্য মন খারাপ হলো। কিন্তু শাশুড়ির এই শাড়িটা না পরলে উনি মন খারাপ করতেন। এতোদিনের ইচ্ছেটা মিতালী আজ পূরণ করবে। আজ না পরলে হবেও না। ব্যাপারটা অংকুর বুঝলো না! লোকটা অনেক অদ্ভুত। মিতালী হতাশ হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হলুদ শাড়িটা ব্যাগে নিয়ে নিলো।
.

গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। মেয়েদের দল আবিরের সাথে চলে গেছে। জুলফিকার ও তার ভাইয়েরা সুপ্তি বেগম ও অলীউর রাহমানের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। রইলো শুধু রায়াজ, অংকুর, মিতালী ও জারা। মিতালী শাশুড়ি মায়ের কাছে বিদায় গাড়িতে উঠে বসলো। অংকুর সামনের সিটে বসায় জারা মিতালীর পাশে বসলো। মিতালী খেয়াল করলো অংকুর এখনো তার সাথে রেগে আছে। ক্ষুন্ন হলো তার মন। বিষন্ন মনে বসে রইলো নিরবে।

রায়াজ ড্রাইভ করবে। তাই চাবি হাতে নিয়ে গাড়িতে বসার জন্য দজরা খুলতেই ডাক দিলো রাকিব। দাঁড়িয়ে পরলো রায়াজ। গাড়ির দরজা বন্ধ করে প্যান্টের পকেটে দুই হাত গুঁজে দাঁড়াল। রাকিব রায়াজের সামনে ইতস্তত করে বললো, ‘আসলে ভাইজান! তখনের ঘটনার জন্য আই’ম স্যরি। আসলে আমি জানতাম না আপনি ম্যারিড। তাছাড়া শেফালীর হাত ধরাতে রাগ উঠেছিলো আমার। তাই..!’

রাকিবের কথার পিঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো রায়াজ, ‘ম্যারিড না হলে কি করতে?’

রায়াজের চোখে চোখ রাখলো রাকিব। ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো প্রশ্নের, ‘সাধারন ভাবে যা করার দরকার তাই করতাম।’

রায়াজ মাথা দুলালো। রাকিব আবারো বললো, ‘তবে যাইহোক, তখনের জন্য আই’ম স্যরি।’

‘ইট’স ওকে। আমি কিছু মনে করিনি।’

বলেই গাড়িতে উঠলো রায়াজ। রাকিব আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো গাড়ির দিকে। এখন স্যরি বললেও রাগ কমেনি তার। ভাই তোর বউ আছে। তাও কেন ফুফাতো বোনের হাত ধরবি তুই? বেশরম! মনে মনে রায়াজের চৌদ্দ গোষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো রাকিব।
.

নতুন জামাই! প্রথম আগমন! আপ্যায়ন চলছে তুমুল রুপে। ব্যস্ত আমেনা। ব্যস্ত জুলেখা। মেহমান বলতে শুধু মিতালীর কয়েকজন কাজিনরা রয়েছে। তাদের সাথেই সোফায় বসে কথা বলছে অংকুর। মিতালী রান্না ঘরে আমেনা আর জুলেখা কে সাহায্য করতে ব্যস্ত। রাতের খাবারের সময় হলো। জামাই আপ্যায়নে কোনো কিছুর কমতি রাখলো না আমেনা। টেবিলে এতো এতো খাবার দেখে অবাক হলো অংকুর। খাবার খাওয়ার পরে তো যায় যায় অবস্থা। এতো খাবার কেউ খায়? একদিনে মনে হয় ১০ কেজি ওজন বেড়ে গেছে তার।

খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে অংকুরের দিকে আড় চোখে তাকিয়েছে মিতালী। এখন অব্ধি মিতালীর সাথে কথা বলেনি অংকুর। বিষণ্ণবদন হলো মিতালীর মন। কিভাবে রাগ ভাঙ্গাবে সে নিয়ে চিন্তিত হলো।

খাওয়া দাওয়া শেষে জুলফিকার ও রায়াজের সাথে অনেকক্ষণ আলাপ আলোচনা করলো অংকুর। এক পর্যায়ে ঘড়িতে সময় দেখে রায়াজ আলোচনার সমাপ্তি ঘটালো। অংকুর বসার রুম ছেড়ে মিতালীর রুমে আসলো। দরজা বন্ধ করে পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো মিতালী নেই। বুকশেলফের দিকে তাকালো একবার। মেয়েটা এতো বই পড়ে? বুকশেলফের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা বই হাতে নিলো। বইটার কয়েকটা পৃষ্টা উলটে দেখলো অংকুর। তখুনি পিছন থেকে পরিচিত কেউ একজন জড়িয়ে ধরলো। কোমল হাত দুটো, শরিরের ঘ্রাণ, সংস্পর্শে আসা মানুষটা অংকুরের চেনা। স্পর্শ পেতেই চিনতে ভুল করলো না। মিতালী অংকুরকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে গুনগুন করে মিষ্টি সুরে গান গায়লো একটা।

‘আজ এক নাম না জানা কোনো হাওয়া
চোখ বুজে ভাবছে বেয়াদব ধূলো
টুপটাপ বৃষ্টিফোঁটা গেলো থেমে
ভেজাভেজা খিড়কি দরজা তুমি খুলো

তুমি যাবে কি? বলো যাবে কি?
দেখো ডাকছে, ডাকলো কেউ
তুমি পাবে কি? পা-পাবে কি?
সামনে বেপরোয়া ঢেউ।’

অংকুর মিতালীর হাত দুটো ছাড়িয়ে পিছু ফিরে তাকালো। তার বলা সেই হলুদ শাড়িটি পরেছে মিতালী। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। চুল গুলো উন্মুক্ত। লাজুক হাসিতে একদম মিষ্টি লাগছে। মিতালীর মুখের সামনে আঁচড়ে পরা অবাধ্য চুল গুলো আলতো হাতে কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে নিজেও পরের লাইন গুলো গায়লো..

‘ছুঁয়ে দিলে সোনাকাঠি খুঁজে পাই
যদি যাই ভেসে, এমনি ভেসে যাই।
ছুঁয়ে দিলে সোনাকাঠি খুঁজে পাই
যদি যাই ভেসে, এমনি ভেসে যাই।’

মিতালীর কপালে প্রগাঢ় চুমু একে দিলো অংকুর। আবেশে মিতালী নেত্রপল্লব বন্ধ করে ফেললো। চুমু দেওয়ার পর মিতালীর গাল দুটো আদুরে দুই হাতে ধরলো অংকুর। মিতালী অংকুরের চোখে চোখ রাখতেই অংকুর মৃদু গলায় বললো, ‘তোমার সাথে রেগে থাকা বড্ড মুশকিল। তোমার সংস্পর্শে আসলে রাগ, অভিমান কর্পূরের ন্যায় উড়ে যায়।’

মিতালী মিষ্টি করে হাসি দিলো একটা। অংকুরকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলো। এইখানটা তার ভরশার জায়গা। এইখানেই রয়েছে যতো শান্তি। এইখানেই সারাজীবন থাকতে চায় মিতালী। এইখানের অধিকারী মানুষটা তার পাশে সারাজীবন থাকুক।
.

চলমান..