#অভিনয়ে
#পর্ব_৮
#মুমতাহিনা_তারিন
সব ভুলে যাওয়া কি এতোই সহজ? তিন বছর যে আমি কি দহনে পুড়েছে তার আন্দাজ কী তুমি রাখো..সব সময় পারু কে তুমি সহজ সরল হিসেবে দেখেছো । তুমি কি জানো না মানুষ কষ্ট পেতে পেতে পাথর হয়ে যায়?তুমি চাইলেই আমাকে আগলে রাখতে পারতে । সব ভুল বোঝাবুঝি প্রথমই পরিষ্কার করে দিতে পারতে তুমি কি সেটা করেছো!
আনমনে কথা গুলো বলে তাচ্ছিল্য হাসলো পারু । ও যে আর নিজেকে ভাঙতে চায় না । ও বুঝে গেছে নিজেকে নিজেই গড়তে হবে যাতে কেউ ভাঙতে না পারে । নিশুতি রাত কত কেঁদে কেটে ভাসালো এবার না হয় একটু হাসা যাক।
তনুজা ডাকে ভাবনা থেকে ফিরে আসে পারু । রাতে লাউ দিয়ে ডিম দিয়ে খুব সুন্দর রান্না করেছে তনুজা পারুর খুব পছন্দের খাবার।
“পারু আয় খেয়ে নে ”
“জি ”
________________________
ঝি ঝি পোকার ডাকে পরিবেশ কেমন গম্ভির হয়ে আছে । নয়ন সকালের ঘটনার পরে শহরে চলে গেছে । তাহেরা বানুকে কল দিয়ে নিধি রহমান আসবে না সেটা সাফ সাফ বলে দিয়েছে । নয়ন চলে যাওয়ার পর তাহেরা বানু দম ধরে বসে আছে । ছেলে যে এমন কাণ্ড ঘটাবে সেটা তার কল্পনাতে ও ছিল না । তার আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝে দরজা ঠেলে প্রবেশ করে রিপা ।
” কি গো আম্মা এমন হাড়ির কালির মত মুখ বানায় রেখেছো কেনো?”
” তোর পাকনা কথা কইতে কইসি আমি বেয়াদপ মেয়ে দূর হ নয়নের মত এতো সুন্দর মেয়ে রেখে ছেলের মাথায় কি ভুত চেপেছে যে ওই কালিরে বিয়ে করতে হবে ”
” আম্মা তুমি ও তো তাহলে কালি ”
” কি বললি তুই!!!!”
” তুমি ও তো পারুর মতোই তাই বললাম ”
ঘর বাড়ি এক করে জোরে চড় পড়লো রিপার গালে । একেতো সব প্রথম থেকেই ঘেঁটে আছে তারপর রিপার চাটাং চটাং কথা তাহেরার একদম সহ্য সীমা পার করে দিলো । মুহূর্তেই রিপার চোখে পানি জমলো । আজকে আবার নতুন করে অনুধাবন করলো সব সত্য কথা সব জায়গায় বলতে হয় না । মাথাটা নিচু করে ঘর থেকে বিনা শব্দে বেরিয়ে গেলো রিপা । তাহেরা কিন্তু চুপ নেই কয়েকটা অশ্রব্য গালি দিয়ে খান্ত হলো।
নিচের থেকে মায়ের আসা কণ্ঠস্বর ভালোভাবেই কানে আসলো শাওনের কিন্তু মনে চাইলো না মায়ের সামনে দাঁড়াতে। বাবা চলে যাওয়ার পর তাহেরারএকা হাতে কোলে পিঠে মানুষ সে। যদি ও সালাম মিয়ার ও অনেক অবদান আছে । কিন্তু মা যে মা তার জায়গা যে আর কেউ দখল করতে পারে না । নিজের ফেলে আশা তিনটে বছর নিয়ে বড়ই আফসোস হচ্ছে শাওনের । ও শুধু কি মোহে পড়েছিল? নাহিন আর ইমরানের সাথে থেকে পারু যে ওর সাথে যায় না এই চিন্তাটা মাথায় গেঁথে যাচ্ছিল । কিন্তু হায় এই গ্রামের মেয়েটার পিছনে ও কত ঘুরছে । কত সহজেই অদেখা করে দিয়েছিল পারুর সব অবদান । যখন নিজের ঘোর কাটলো ততক্ষন যে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে! পারুর এতো কাছে থেকেই যে কত হাজার মাইল দূরে সরে গেছে শাওন ।
_________________________
সকালটা হলো মেঘ মেঘ ভাব নিয়ে । যখন সূর্য উঠে রোদ্র ছড়ায় তখন বাইরে দিকে তাকালে মনে হচ্ছে কেবল অন্ধকার ধরণী থেকে বিদায় নিয়েছে । পারু নিজের নিয়ম অনুসারে উঠলো ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব থাকায় যেনো একটু দেরি হয়েই গেলো । নামাজ পড়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো ।আজকে রাস্তার পাশে লাগানো বেলী গুলো ফুটেছে। বাইরে বেরোতেই মিষ্টি গন্ধটা নাকে লাগলো পারুর ।নিজেকে ও তৈরি করে নিয়েছে তাই হয়তো আকাশের গমুট ভাব সূর্যি মামার মাঝে মাঝে উকি দেওয়া আর বেলীর গন্ধটা ওর এতো ভালো লাগছে ।মন ভালো থাকলে সব ভালো লাগে ।
শাওন ঘুম থেকে উঠেই আজকে ব্যালকনিতে গেলো । আজকে থেকে ওর একটা দায়িত্ব বেড়ে গেলো । প্রতিদিন অফিস থেকে এসে পারুর রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করতে হবে । ও জানে পারু ওকে মাফ করবে,, মাফ করতে বাধ্য হবে । কিন্তু জানে না কতদিন লাগবে ওর যে অন্যায়ের পাল্লা অনেক ভারী হয়ে গেছে ।
ব্যালকনি তে দাড়িয়ে পরুদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে পারুকে খুজার চেষ্টা করলো । পারু তখন বাড়ির পাশে থাকা বাগান থেকে শাক তুলছিলো । আজকে কেনা তরকারী নেই । চাঁচা দোকানের কাজে ব্যস্ত থাকায় বাজার করতে পারে নি । তাতে সমস্যা নেই বাড়িতে তো দুই তিন প্রকার তরকারী পাওয়ায় যায় । মুঠি ভরে ভরে পেপোলি শাক তুলে রাখছে ছোট্ট ঝুড়ি তে । শাওন পারুর দিকে চাইলো মাথায় হটাৎ দুষ্টু বুদ্ধি চেপে বসলো ওর ..
” এই পারু পারু তোর পিছনে দেখ কি ”
পারু খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে শাওন ওর সাথে কথা বলার জন্য চেষ্টা করছে । কিন্তু পারু তো বুঝতে পারছে তাই কোনো কথা না বলে নিজের মতো শাক তুলতে লাগলো । এমন একটা ভ্যান করলো যেনো ও কিছু শুনতে পাই নি।
” তোর কি মনে হচ্ছে আমি মজা করছি? একবার পিছে তাকা দেখা জোঁক ”
পারুর মন শক্ত করার চেষ্টা করছে ছোটো থেকেই ওর জোঁকে খুব ভয় পায় । পারু জানে শাওন ওকে ভয় দিচ্ছে তাও ওর অবচেতন মন টা মানতেই চাইছে না । হঠাৎ পার আঙ্গুলে কেমন ভেজা ভেজা অনুভব হলো । চোখ গুলো বড়ো বড় করে পর দিকে তাকালো পারু ছোট্ট একটা কালো কাপড় দেখে ভয়তে চিল্লায় উঠলো । হাত থেকে ঝুড়ি আতঙ্কে পরে গেলো তাড়াতাড়ি স্থান পরিবর্তনের চেষ্টা করতেই মাটির নিচে থাকা একটা ইটের আগের সাথে বেধে ধপাস শব্দ তুলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পারু । সাথে সাথেই হাত কাদায় ডেবে গেলো মুখের এক পাশে হালকা জ্বলে উঠলো । কাদার ভিতর থাকা কিছুতে হয়তো ছিলে গেছে । গলার এক পাশে কাদায় মাখামাখি তার সাথে হাঁটু ভর করে পড়ার জন্য পার নিচ থেকে ও কাদা মেখে গেলো । কাদার বাজে গন্ধে পার থেকে সব বেরিয়ে আসতে চাইলো যেনো ।
ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষন কিছু বুঝে উঠতে পারল না শাওন । যখন ওর মস্তিষ্ক সকল ঘটনা বিশ্লেষণ করলো পেট ফেটে হাসি বেরিয়ে আসলো শাওনের । পুরুষালি কণ্ঠের ঝঙ্কার তুলে হাসিতে লুটিয়ে পড়লো ও ।
শাওনের হাসিতে রাগে দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছা হলো পারুর । ও তো বুঝতে পেরেছিল শাওন ওকে ভয় দেখাচ্ছে তাও এমন বোকামিটা করতে হলো । নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে পারুর মনে হচ্ছে দুই গালে জোরে জোরে দুটো থাপ্পড় দিতে। দাতের সাথে দাত পিষে উঠে দাড়ালো পারু হাতে একটা ইটের টুকরো নিয়ে কটমট করে তাকালো শাওনের দিকে । শাওন হাসতে ফ্লোরে বসে পড়েছে চোখ দিয়ে পানি বেরোচ্ছে ওর ।
হাত উচু করে শাওনকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো । হাত উচু করে কিছু ছুঁড়তে দেখে একটু ভয় পেলো শাওন । টুস করে শব্দ তুলে শাওন দের দেওয়া পাঁচিল এ গিয়ে লাগলো ইটের টুকরোটা । শাওনের গায় তো দূর পাঁচিল টপকাতে পারলো না পারুর ছুঁড়ে দেওয়া ইট । শাওন যেনো আরো বেশি মজা পেলো আরো বেশি শব্দ তুলে হাসা শুরু করলো । পারুর শেষ প্রচেষ্টা ও ব্যর্থ হওয়ায় প্রচণ্ড রাগ লাগলে ও পরাস্ত সৈনিকের ন্যায় শাক গুলো তুলে দৌড়ে ঘরে চলে গেল । কারোর হাসির খোরাক হতে চায় না ও।
শাওনের হাসি শুনে নিচ থেকে তাহেরা উপরে উঠে আসলো ।শহর থেকে আসার পর ছেলেকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখে তৃপ্তি পেল তাহেরা । শহরে যাওয়ার আগে কত দুষ্টুমি করতো শাওন। তাহেরা বানুকে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শাওন জিজ্ঞাসা করলো _
” কি হলো আম্মা? কিছু বলবা?”
” হাঁ বাবু অফিস যাবি না নয়টা বাজতে গেলো”
তাহেরা বানুর কথা শুনে হুশ ফিরলো শাওনের ।অনেকটা দেরি করে ফেলছে আজকে,, পারুর সাথে মজা করতে গিয়ে । তাহেরা বানুকে ভাত বাড়তে বলে গোসল করার জন্য বাথরুমে ঢুকলো শাওন ।
ঘরে পারুকে কাদা মাখা অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে গেলো তনুজা বেগম।
” শুকনো জমিনে কাদা মাখালি কিভাবে?”
” চাচী শাক তুলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম ”
” এই অবস্থায় ঘরে কেনো উঠছিস যা গোসল করে নে । গোসল করে বারান্দার নোংরা পরিস্কার করে ফেলবি । তাড়াতাড়ি গোসল করে নে আজকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে তোর মনে নেই নাকি? অনেক কাজ পরে আছে ”
” জি চাচী মা ”
__________________
গোসল করে খেয়ে দেয়ে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল অফিসের উদ্দেশে রওনা দিতে । আরো রাস্তায় এসে ও ঠিক সময় গাড়ি পায়নি শাওন । যার ফল স্বরূপ দেরি হয়ে গেল অফিসে । বসের ঝাড়ি টা যেনো আজকে আর শাওনকে স্পর্শ করতে পারলো না । মন ভালো তো সব ভালো।
গোসল করে জামা কাপড় নাড়তে নাড়তে যখন ঘরের উদ্দেশ্যে যাবে পারু । তখন রিপার আগমন মুঠো ভর্তি বুজ ফল নিয়ে হাজির সে । ছোটো বেলায় শাওন দের ঘরের পিছনের বাগানটায় বড় বুজ গাছ ছিল সেই গাছের ফল ছিঁড়ে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা গাছের গুঁড়ির উপর বসে দুইজন মনের সুখে গল্পঃ করতো আর খেতো।
রান্নার কাজে পারু রিপা দুইজনে হাত লাগলো চাচী তো ছিলোই তাই খুব তাড়াতাড়ি সব গোছানো হয়ে গেলো। নাস্তা গুছিয়ে সরবত বানিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো রিপা। রিপার মতে শাওন মাফ পাওয়ার অযোগ্য ও পায় পড়ে কান্নাকাটি করলে ও মাফ করা যাবে না । রিপার কথা শুনে পারু হো হো করে কিছুক্ষন হাসলো । নিজের ভাইয়ের সম্পর্কে কেউ এমন মন্তব্য করতে পরে সেটা কেবল অনুধাবন করলো পারু।
বেলা দশটা নাগাদ পাত্রী দেখতে হাজির হলো তনুজা বেগমের ফুফু আর ছেলের খালা । যেহুতু বাবা মা কেউ নেই তাই অভিভাবক হিসেবে খালা । ঠোঁট লাল টুক টুক দেখেই বুঝা যাচ্ছে অতিরিক্ত পান খাওয়া অভ্যাস আছে মহিলার । লাল দাত গুলো মেলে দিয়ে স্মিত হাসলো মহিলা । বিছানার বসে পুঁটলি থেকে আরেকটা পান বের করে সাজাতে লাগলো ।
নাস্তার প্লেট গুলো সামনে রেখে এক পাশে বসলো তনুজা বেগম । রিপাকে ডেকে সালাম মিয়ার কাছে ফোন দিতে বললো । খালার পাশে বসে আছে বিয়ে উপযোগ্য পাত্র । লম্বা দীর্ঘকায় এক পুরুষ ,মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি দিয়ে ভরা ।চাপা বর্ণের হলে ও মোটামুটি সুন্দর বলা চলে ।সালাম মিয়া বাজারে তার দোকানটা বন্ধ করে হন্তদ্বন্ত পায়ে বাড়ি ফিরলো।
সালাম মিয়া কুশল বিনিময় করে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো । পাত্রের খালা তার দিকে একবার গোল গোল চোখে তাকালো তারপর আবার একটা ফিচলে হাসি দিয়ে ট্রে তে থাকা এক গ্লাস শরবত নিয়ে গালে দিলো।
” বড্ড তেষ্টা পেয়েছিল আপা । ”
” আরে আপনাদের জন্য তো । নাও বাবা তুমি কিছু নাও । পিঠাগুলো পারু বানিয়েছে খেয়ে দেখ”
” জি অ্যান্টি”
” আপা মেয়ে আপনার কি হয় ? ”
এই প্রশ্নে সালাম মিয়া আর তনুজা বেগম মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো । ফুফু কি তাদের কিছুই বলে নি ।
“আসলে পারুর তো বাপ মা নেই আমাদের কাছেই মানুষ আমরা ওর চাঁচা চাচী”
সালাম মিয়ার উত্তর শুনে কিছুটা চোখ ছোটো করলো পাত্রের খালা অতঃপর আবার জিজ্ঞাসা করলো –
” মেয়েকে আনেন তবে ।”
” জি জি “