অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ পর্ব-১৮+১৯

0
191

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_১৮

রাতের বৃষ্টি যখন থামলো তখন প্রায় সকাল। সকালের কোমল রোদ বারান্দা থেকে ধরাধরি করে নেমে এসেছে মেঝেময়। পর্দা উড়ছে মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাসে। রাতটা শুভ্র-তুলির ভীষণ ভালো কেটেছে। গত রাতটা দুজনের জন্যেই স্বপ্নের রাত ছিলো। রাতে দেরি করে ঘুমিয়েও দুজনের ঘুমই পূর্ণ। শুভ্রর ঘুমটাই বরাবর তুলির আগে ভাঙলো। শুভ্র চোখ খুলে; দেখে তুলি বিড়ালছানার ন্যায় শুভ্রকে কোলবালিশের ন্যায় জড়িয়ে বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। শুভ্র মৃদু হাসলো। বুকটাতে যে অদ্ভুত এক শান্তি পাচ্ছে সে; বেশ বুঝতে পারছে। শুভ্র হাত বাড়িয়ে কম্বল দিয়ে তুলির উদোম পিঠ ঢেকে দিলো। তুলি আরাম পেল যেন। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল শুভ্রকে। শুভ্রর রক্ত পুনরায় গরম হচ্ছে। আবার তুলিকে নিজের সঙ্গে রাতের ন্যায় চেপে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে। শুভ্র নিজেকে সামলালো তবুও। মৃদু হেসে তুলিকে বালিশে শুইয়ে তুলির বুকে মাথা রাখলো। তুলির ঘুমের মধ্যেই শুভ্রর চুলে হাত রাখে। শুভ্র ফিসফিস করে ডাকে;

‘তু-লি, তু-লি! উঠবে না আজ?’

ঘুমের ঘোরে ওমন আদুরে ডাক শুনে চোখ কুচকায় তুলি। কে ডাকছে তাকে এত সকালে? বুকের মধ্যে কিছু একটা অনুভব করতে পারছে তুলি। শক্ত কোনো কিছু। তুলির শ্বাস না নিতে পেরে ধীরে ধীরে চোখ খুললো শুভ্র তখন তুলির বুক থেকে মুখ তুলে তুলির চোখের দিকে চাইলো। দুজনের চোখে চোখে মিলন ঘটলো। শুভ্র হালকা হাসল। তুলির কপালে চুমু খেয়ে ফিচেল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

‘তুলি,ঘুম কেমন হলো আজ?’

বলে ডান চোখটা টিপে দিল শুভ্র। ধীরে ধীরে তুলির মনে পড়তে লাগল রাতের কথা। কী অসম্ভব সুন্দর এক রাত ছিল গতকাল। শুভ্র প্রথমে নিজেকে সামলাতে না পেরে এগ্রেসিভ আচরণ করছিল। পরবর্তীতে হঠাৎ নিজে নিজেই বুঝতে পারলো, তুলির কষ্ট হচ্ছে। পরবর্তীতে সে হয়ে যায় শান্ত। স্পর্শও হয়ে আসে নমনীয়। ওই চরম আবেগের মুহূর্তেও তুলির সুবিধা অসুবিধার কথা শুভ্রর মাথায় ছিল। তুলি ভাবে; হয়তো জীবনে কোন এক পুণ্য করেছিল সে। যার দরুন তার ভাগ্যে এমন এক শুভ্র জুটেছে। শুভ্র তুলির কপালে পূনরাহ ঠোঁট বসালে ধ্যান ফেরে ওর। তুলি লাজুক হেসে শুভ্রকে এড়িয়ে পাশ ফিরে গেলো। কম্বলটা বুকের সঙ্গে ভালো করে পেঁচিয়ে ওদিক ফিরে মিটমিট করে হাসতে লাগলো। শুভ্র তুলির লজ্জা দেখে হেসে ফেলল শব্দ করে। তুলির সফ্ট কাঁধে মুখ রাখল অবলীলায়। আয়োজন করে আরও লজ্জা দিতে বললো,

‘তুমি তো দেখি একরাতেই আমাকে পাগল করে দিয়েছ, তুলি। লাস্ট নাইট ওয়াজ দি বেস্ট, ইউ নো?’

বলে শুভ্র তুলির গালে হালকা করে ঠোঁট ছুয়ালো। তুলি লাজুক হাসল। লজ্জায় শুভ্রকে কনুই দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলে শুভ্র যেন আরও শক্ত করে ঝেঁকে শোয়। তুলি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। তারপর ধিমে আওয়াজে বলে;

‘আমার জন্যেও।’

শুভ্রর কথার প্রেক্ষিতে তুলির এই উত্তর শুনে একদম অবাক হয়ে যায় শুভ্র। ব্যস্ত ভঙ্গিতে তুলিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। তুলি তখন চোখ প্রায় খিচে শুয়ে আছে। শুভ্রর চোখের দিকে চোখ মেলানোর সাহস আর নেই তুলির মধ্যে।ছেলেটা এমন করে তাকায়; যেন চোখ দিয়েই তুলিকে ছোয়, গা ভাসায়। শুভ্র তুলির খিঁচে রাখা চোখে চুমু বসায়।বড্ড ছটফটে গলায় বললো,

‘সত্যি? তাহলে হয়ে যাক আরেকবার? হোয়াটস সে?’

তুলি বোকা বনে গেলো। শুভ্র এটা বলেছে, তার বিশ্বাসই হলো না। তারপর মনে হলো; কাল রাত থেকে লাজুক শুভ্র বদলে অসভ্য শুভ্র নামক নতুন শুভ্রর জম্ম হয়েছে। সে এমন নির্লজ্জ কথা বলে, বলবেই। তুলি চোখ পাকাল শুভ্রর দিকে। বললো,

‘একদম নয়। আপনি জানেন; গতকাল দুপুর অব্দি আমি জানতাম আমি একজন লাজুক ছেলে। মনেমনে একটু খুশিও ছিলাম সেটা ভেবে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পেরুতেই আপনার অসভ্য রূপ বেরিয়ে এসেছে। আমার ঠোঁট দেখুন, অবস্থা নেই। এমনটা আপনার দ্বারা হবে, আই ডিন্ট নো দ্যাট।’

তুলি ঠোঁটটা আঙুল দিয়ে ইশারা করে শুভ্রকে দেখাল। শুভ্র তুলির ঠোঁটের দিকে বড্ড কাতর চোখে তাকাল। সত্যিই ঠোঁটটার একদম যাচ্ছেতাই অবস্থা করে ফেলেছে সে। শুভ্র এতেই নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করেছে। তুলি হার্ট হয়েছে; ভাবলেই সে ভেতরে ভেতরে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছে। শুভ্র বুড়ো আঙুল দিয়ে তুলির ঠোঁটে হালকা করে স্লাইড করে কাতর গলায় বললো,

‘সরি, আসলে কখন এভাবে আঘাত পরে গেলো- আমি বুঝতে পারিনি।।’

তুলি ভ্রু নাচলো। শুভ্র আবারো বললো;

‘সত্যি সরি আমি। আর এমন হবে না, আই সোয়ার।’

শুভ্র কণ্ঠমনিতে হাত দিয়ে চোখ বেটে প্রমিজ করল। তুলি এবার ভেতরে ভেতরে ভীষণ রাগল। আহাম্মক একটা। এই কাজের জন্যে অন্য স্বামীরা আরও দুষ্ট দুষ্টু কথা শোনায়। সেখানে ইনি সরি বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলছেন। এই লোককে নিয়ে কই যাবে তুলি?

শুভ্র ভাবছে, তুলি কষ্ট পেয়েছে হয়তো। তাই শুভ্রর ভুল ভাঙাতে তুলি এক কাজ করল। শুভ্রর গালে ডান হাতটা তুলে হালকা করে স্পর্শ করল প্রথমে। শুভ্র একবার গাল স্পর্শ করা তুলির হাতের দিকে চেয়ে আবারো তুলির দিকে তাকাল। তুলি শুভ্র ঠোঁটের দিকে চেয়ে শুকনো ঢোক গিলে। শুভ্রর ঠোটটা তুলিকে বারবার-বারবার এত আকৃষ্ট করে কেন। দেখলেই ছুতে ইচ্ছে করে তুলির। মেয়ে হয়ে যেচে বলতেও পারেনা। তুলি থামল কিছুসময়ের জন্যে। তারপর কম্বলটা ভালো করে বাম হাতে বুকের সঙ্গে পেঁচিয়ে উঁচু হয়ে নিজেই শুভ্রর ঠোঁটে ঠোঁট বসায়। শুভ্র বুঝে যায়, তুলি হার্ট হয়নি, একদমই না। ধীরে ধীরে দুজন ভেসে যায় এক অদম্য সুখে। খানিক পর তুলি সরে আসে। শুভ্র তখন থম হয়ে চেয়ে আছে তুলির দিকে। তুলি গায়ে শুভ্রর একটা শার্ট জড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটে যায়। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করার আগে থম বনে বসে ঘাকা শুভ্রর দিকে চেয়ে বলে;

‘ইউ শুড গ্রো আপ, ম্যাই হাসবেন্ড।’

শুভ্রর ধ্যান ভাঙ্গে। অবাক হয়ে এক হাত বাড়িয়ে তুলিকে ধরার চেষ্টা করে চেঁচায়;

‘এই কী বল-‘

শুভ্র বাকি কথা শেষ করতে পারেনা, তার আগেই তুলি ঠাস করে দরজা বন্ধ করে ফেলে। শুভ্র কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে তারপর মাথা চুলকে শব্দ করে হেসে ফেলে।
______________
সকালের খাবার খাওয়ার সময় দেখা গেলো শুভম আবারও মহুদের সাথে একসঙ্গে খাবার খেতে বসেছে সেদিনের মত। এবং বসেই রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে। শুভ্র তখন মাত্রই তুলিকে নিয়ে ঢুকেছে রেস্তোরাঁয়। শুভমকে দেখে শুভ্রর ফুরফুরে মেজাজ মুহূর্তেও খিঁচড়ে গেলো। শুভ্রর যে হাত তুলির ডান হাতকে সফ্টলি ধরে ছিল, সেই হাতের স্পর্শ শক্ত হয়ে গেলো মুহূর্তেই। তুলি হাতের মধ্যে শক্ত চাপ উপলব্ধি করে শুভ্রর দিকে চাইল। ভ্রু উচিয়ে প্রশ্ন করল,

‘কী হয়েছে? কোন সমস্যা?’

শুভ্র কথা বলল না। শুভ্রর রক্ত চোখে চাওনি অনুসরন করে তুলি সামনে তাকাল। শুভমকে মহুদের সাথে দেখতে পেয়ে তুলি প্রথমে শুভ্রর দিকে তাকালো। শুভ্রর মুখটা একদম কালো হয়ে গেছে। রাগে একদম ফুঁসছে শুধু। শুভ্রর এমন করুণ অবস্থা দেখে তুলি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেলল।
শুভ্র তুলির হাতটা ধরে সেভাবেই এগিয়ে গেলো। মহু আরিফদের সামনে যেতেই তুলি জোর করে শুভ্রর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। স্যারদের সামনে ভদ্রতা বজায় রাখা উচিত। শুভ্র চেয়ারে বসল, তুলিও বসল শুভ্রর পাশে। মহু তুলির দিকে একপল তাকাল। কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিলো যেমন; পরপরই তুলিকে আপাদমস্তক দেখে কিছু একটা ভেবে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দে হাসল। তারপর আবার মুখ স্বাভাবিক করে সবার সঙ্গে গল্পে মন দিল। তুলিকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই, যা ভেবেছে তাই ঘটেছে।

শুভম শুভ্রকে দেখে হালকা হেসে সাধারণ আলাপচারিতা করতে চাইল। দেখা গেলো, শুভ্র টুকটাক উত্তর দিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইছে শুভমকে। শুভম হয়তো বুঝতে পারলো। দেখা গেল; সেও আর কথা বাড়াল না। মৃদু হাসল শুধু। তাদের গল্পের মধ্যে; খানিক পর শাড়ি পরা অসম্ভব সুম্দর এক রমণী রেস্তোরাঁয় ঢুকলো। ব্যাগটা দ্রুতহাতে টেবিলে রেখে শুভমের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো;

‘সরি, সরি। বড্ড দেরি হয়ে গেলো, তাইনা? এগেইন সরি, হুঁ?’

শুভ্র এই মেয়েটার কথার ধরন দেখে কিছু একটা সন্দেহ করছে। এমন ভাবে মেয়েটা শুভমের সঙ্গে কথা বলছে যেন শুভমের খুব কাছের কেউ। শুভম হালকা হেসে বলল,

‘সমস্যা নেই। বসো। তোদের পরিচিয় করিয়ে দেই। ও হচ্ছে মিসেস শুভম তালুকদার; ইভা। ইভা এরা হচ্ছে আমার এমবিবিএস লাইফের ফ্রেন্স সার্কেল।’

শুভ্র চোখ বড়বড় করে তাকাল শুভমের দিকে। শুভম শুভ্রর এমন চাওনি দেখে শুভ্র দিকে চেয়ে হেসে ফেলল। ইভা সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করল। ওর কথাবার্তা বেশ মার্জিত এবং গোছানো ছিল। তাছাড়া বড্ড মিশুকেও। শুভ্রর এখনো তাদের দিকে চেয়ে হিসাব মিলাচ্ছে। মেয়েটা শুভমের স্ত্রী? একপর্যায়ে শুভমই সকল হিসাবের খাতা চুকালো। শুভ্রর উদ্দেশ্যে বললো,

‘শুভ্র, ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যা প্ল্যান, ডিজাইনড বাই আওয়ার মহু। অ্যা প্ল্যান টু মেইক ইউ জেলাস এবাইউট তুলি। আমার বউ আছে ব্যাটা, বাইরে চোখ দিকে চোখ তু লে নিবে একদম। আমি জাস্ট অভিনয় করেছি, তুলি তোদের ভালোর জন্যে জাস্ট আমার সঙ্গে তাল দিয়েছে। এন্ড অ্যাজ পার ম্যাই অভজারবেন্স, আমাদের প্ল্যান সাকসেসফুল। তোদের একসাথে দেখে তেমনটাই মনে হচ্ছে আমার।’

#চলবে

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_১৯

‘শুভ্র, ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যা প্ল্যান, ডিজাইনড বাই আওয়ার মহু। অ্যা প্ল্যান টু মেইক ইউ জেলাস এবাইউট তুলি। আমার বউ আছে ব্যাটা, বাইরে চোখ দিলে চোখ তু লে নিবে একদম। আমি জাস্ট অভিনয় করেছি, তুলি তোদের ভালোর জন্যে জাস্ট আমার সঙ্গে তাল দিয়েছে। এন্ড অ্যাজ পার ম্যাই অভজারবেন্স, আমাদের প্ল্যান সাকসেসফুল। তোদের একসাথে দেখে তেমনটাই মনে হচ্ছে আমার।’

শুভ্র এ কথা শুনে সবার আগে তুলির দিকে বাঁকা চোখে তাকাল। তুলি শুভ্রর এমন চাওনি দেখে একটু কেশে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। শুভ্র সব জেনেছে; এখন তো টিপ্পনী কাটতে কাটতেএই মে রে ফেলবে। তুলির নজর লুকানো দেখে; শুভ্র ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। শুভমকে কিছু কথা শোনাতে ইচ্ছে হলেও, চেপে গেলো। গত রাতের ন্যায় চমৎকার এক রাত তাদের জীবনে আসার পেছনে মূলত তাদের এই অবাস্তব প্ল্যানই দায়ী; স্বীকার করতে বাধ্য হলো শুভ্র।তাদের সম্পর্ক ঠিকঠাক চলছিল না; সেটা এভাবে সবাই জেনে গেলো? লজ্জা পেয়ে গেলো শুভ্র। শুভম শুভ্রর দিকে চেয়ে ভ্রু নাচালে, শুভ্র মাথা চুলকে হেসে উঠল। শুভমের দিকে চেয়ে বললো,

‘থ্যাংকস শুভম। ইওর প্ল্যান ওয়ার্কড লাইক অ্য ম্যাজিক।’

শুভম কলার ঝাঁকিয়ে হাসলো। সবাই খাবার-দাবার শেষ করল। শুভ্র এরপর বারবার তুলির দিকে চাইলেও, তুলি এখন অব্দি আর মুখ তুলে নিই তুলি। শুভ্র তুলির এমন মুখ লুকানো দেখে মুখ টিপে হাসে।
_________
তারপর তুলিকে একা পেয়ে শুভ্র ঝেঁকে ধরল ওকে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুলি। শুভ্রর দুহাতে তুলির কোমর চেপে রেখেছে। তুলি ইতি-ওতি চেয়ে বারবার মুখ লুকাচ্ছে। শুভ্র যেভাবে চেপে রেখেছে, আজ বোধহয় রক্ষা নেই আর তুলির। শুভ্র তুলির কপালের চুল আঙুলে পেছনের দিকে ঠেলে দিলো। এই কাজটা বোধহয় শুভ্রর সবচেয়ে পছন্দের কাজ। যখনই শুভ্র তুলির মুখোমুখি হয়, বারবার হাট বাড়িয়ে তুলির চুল আঙুলে দিয়ে কপাল থেকে সরায়। শুভ্র যখন এমন করে না; তুলির তখন কী যে ভালো লাগে। শুভ্রর মধ্যে ডুবে যাচ্ছে মনে হয় তখন।

তুলির ভাবনার মধ্যেই; শুভ্র তুলির থুতনিতে দুই আঙুল ঠেকিয়ে ওর মুখটা নিজের দিকে উঁচু করল। তুলি সরাসরি এবার শুভ্রর চোখের দিকে চাইল। শুভ্র বাঁকা হেসে টিপ্পনী কেটে বললো,

‘শুভ্রর কাছে আসার এত তাড়া ছিলো আপনার? প্ল্যান না করে নিজে থেকে এগিয়ে এলে আমি কী মানা করতাম?’

শুভ্রর অ সভ্য কথায় তুলি লজ্জা পেয়ে গেলো। জোর করে নিজের মুখ শুভ্রর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যপাশে মুখ ঘুরাল। শুভ্র কিভাবে জানবে; তুলি রীতিমতো মরিয়া হয়ে যাচ্ছিলো শুভ্রর মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ কথাটা শোনার জন্যে।
শুভ্র তুলিকে সামনে এনে নিজে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। দুজনেই তারপর চুপচাপ। যতবার শুভ্রর গরম নিঃশ্বাস তুলির ঘাড়ে পরছে, ততবারই ছটফট করে উঠছে তুলি। মানুষটার স্পর্শ তুলির শরীরে যেন আ গু ন লাগিয়ে দেয়। শুভ্র একটাপর্যায়ে শীতল গলায় ডাকল;

‘তুলি?’

তুলি তখন ডুবে আছে আকন্ঠ শুভ্রর স্পর্শে। অনুভব করছে নিজের শরীরে শুভ্রর বেসামাল স্পর্শ! তুলি অনুভবের এইপর্যায়ে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তুলি জবাব দেয়;,

‘হু?’

‘আজ আমাদের ফিরতে হবে, বাস রাত ৭ টায়।।’

তাৎক্ষণিক তুলি চোখ খুলে ফেলল। শুভ্রকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সরাসরি শুভ্রর চোখের দিকে তাকাল। শুভ্রর এ কথা বলার সময় কষ্ট হয়েছে। কিন্তু তুলির সামনে নিজে দুর্বল হয়ে গেলে; তুলির পাগলামি আরো বেড়ে যাবে; তাই সে স্বাভাবিক ভাবেই তুলির দিকে চেয়ে রইল। তুলি জিজ্ঞেস করল,

‘তার মানে আমরা একসঙ্গে আর মাত্র ৫ ঘণ্টা আছি। তারপর-‘

বাকি কথা শেষ করার আগেই তুলির চোখ চলছল করে উঠল। শুভ্র তুলিকে এভাবে দেখে মুখটা দুহাতে আগলে চোখ মুছে দিয়ে মিষ্টি গলায় বললো,

‘৫ ঘণ্টা কোথায়? বাসেও তো একসঙ্গে থাকব আমরা।’

শুভ্রর এমন ছেলেমানুষী কথায় তুলি একদমই মন ভুলল না। চোখ বেয়ে অবশেষে জল গড়িয়ে পরলোই। তুলি বাচ্চাদের ন্যায় বায়না করল;,

‘আরো কটাদিন থাকি না? বাস ক্যানসেল করে দিন প্লিজ।’

শুভ্র তুলির পাগলামি দেখলো। তারপর ভীষণ দায়িত্ব নিয়ে তুলির চোখের জল মুছে বোঝাল,

‘তোমার বন্ধ আরও মাত্র ১০/১২ দিনের মতো আছে। বন্ধের পরপরই তোমার এক্সাম। পড়াশোনা লাগবে না করা?’

তুলি নাছোড়বান্দার ন্যায় বললো,

‘একটা এক্সাম খারাপ করলে কিছু হয়না। জীবনে হাজার এক্সাম আসবে, কিম্তু এমন সুন্দর সময় আর আসবে না, কখনোই না।’

তুলির কথা শুভ্রর ভীষণ ভালো লাগল। সত্যি বলতে, শুভ্রর ইচ্ছে হচ্ছে না তুলিকে এভাবে যেতে দিতে। বরং ইচ্ছে হচ্ছে, এ সময়টাকে এভাবেই হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরতে। ঢাকা ফিরে গেলে শুভ্র থাকবে শুভ্রর মতো, তুলি নিজের বাসায়। দুজনের এভাবে এতটা কাছে থেকে দেখা হওয়া, স্পর্শ, তুলির এসব পাগলামি আর দেখবে কোথায় শুভ্র। কিম্তু বাস্তবতা তেমন নয়। তাদের মানতে হবে সেটা। তুলি অবুঝ, তাই বলে শুভ্র নিজেও তুলির সাথে অবুঝ হয়ে যেতে পারে না। শুভ্র তুলিকে বোঝাল,

‘এক্সাম নাহয় খারাপ হলো। আমার চাকরি? চাকরিতে তো ছুটি নেই। পরশু থেকে ডিউটি শুরু। যাওয়া লাগবে না আমাকে?’

‘পরশু শুরু, তাইনা? তাহলে আমরা আজ থাকি। কাল যাই?’

তুলি কী বলছে নিজেও জানে না। শুভ্র হালকা হাসল। তারপর বললো,

‘সাজেকে আসার সময় রাস্তা দেখো নি? যেদিন প্রথম সাজেক আসলে, ব্যথা ছিল না গায়ে? সাজকের রাস্তা তো ভালো না, এইজন্যে। এখান থেকে সারাদিন লাগবে ঢাকা যেতে, আর একটু রেস্ট না করলে পরদিন ডিউটি করতে পারব না তো।’

তুলির নিজের কাছে যতো যুক্তি ছিলো সব শেষ হয়ে গেলো। তুলি একদম বাচ্চাদের মতো ভেঙে পড়েছে। মূলত ভয় পাচ্ছে; বাসায় ফিরে গেলে এভাবে তাদের আর একসঙ্গে থাকা হবে না। নিজেদের মধ্যে তেমন কথাবার্তাও হবে না। শুভ্র কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে; তুলি পড়াশোনায়। এভাবে টাইম কেটে যাবে। দুজনের দূরত্ব বাড়বে। তুলি তখন বাঁচবে কিভাবে? তুলি শুভ্রকে আচমকা জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ এমন করায় টাল সামলাতে না পেরে দু কদম পিছিয়ে গেল শুভ্র। পরপর নিজেকে সামলে দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো তুলিকে। যতটা আঁকড়ে ধরলও বুকের মধ্যে পি ষে ফেলা যায়; টিক ততটা। অন্যবার তুলি এমন করে জড়িয়ে ধরলে চেঁচাতো, তবে আজ তুলির মুখে ‘রা’ অব্দি নেই। আরাম করে শুভ্রর বুকের মধ্যে পরে আছে ও। শুভ্র তুলির চুলে চুমু খেলো। তারপর টিপ্পনী কেটে বললো ও; ,

‘ভালোবাসায় তো জ্ব লে-পু ড়ে যাচ্ছো, তুলি। এক কাজ করতে পারো, আন্টিকে বলে একেবারে চলে আসো না আমার কাছে। তাহলে আর এত পু ড়তে হবে না।’

তুলির কী হলো। শুভৃক জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ ঘষে ব্যস্ত হয়ে বলল,

‘আমি আজকেই বলবো গিয়ে। কীসের চার বছর, কোন চার বছর-টছর না। উই আর ম্যারেড, কেন আলাদা থাকব আমরা?ইসলামে নেই সেসব।’

শুভ্র থমকে গেলো। তুলির পাগলামি এবার লিমিট ক্রস করছে। শুভ্র এবার তুলিকে জোর করে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। তুলি কান্নামাখা মুখে শুভ্রর দিকে চাইল। শুভ্র কিছুটা কঠোর হয়ে বললো;

‘পাগলমি করবে না। আমাদের বিয়ের মূল শর্ত এটাই ছিল। বিয়েরপর তোমার পড়াশোনায় ইমপ্যাক্ট যেন কক্ষণো না পরে। আগে যেভাবে পড়াশোনা করতে, এখনো তাই করবে। আর আমাদের একসাথে চার বছর পরই থাকা হবে, গট ইট? কিসব বলছো তুমি, তুলি? তোমার আম্মু শুনলে ভাববেন; আমি তোমাকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছি। আমাকে দোষী বানিও না সবার সামনে প্লিজ।’

তুলি কাতর চোখে শুভ্রর দিকে চাইল। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,

‘আমাদের একসাথে থাকা কি পাপ? আপনি কেন দোষী হবেন?’

‘পাপ নয় তুলি। পরিস্থিতি বুঝো।’

তুলি নিজেকে সামলালো। সে কবে থেকে এমন ছিচকাঁদুনে হয়ে গেছে। শুভ্রর ইচ্ছে নেই, তুলিকে উঠিয়ে নেওয়ার, দুজন একসঙ্গে থাকার। তুলিকে দূরে দূরে রাখতে পারলেই শুভ্র যেনো বাঁচে। তাহলে সে কেন খামোকা পাগলামি করবে। সম্পর্কের শুরু থেকে তুলিই সবসময় আগে স্টেপ নিয়ে এসেছে। শুভ্র কী করেছে? কিছুই না। সম্পর্ককে আগ বাড়ানোর ক্ষেতে একমাত্র তুলি ভূমিকাই আছে, আর কারোর নেই; কারোর না। শুভ্র একা যদি থাকতে পারে, তাহলে তুলিও পারবে। তুলির দরকার নেই কারোর।

তারপর- তারপর বদলে গেলো সব। তুলি আর একটাবারও পাগলামি করল না। আর নাইবা শুভ্রকে জ্বা লালো। দুজনেই ঢাকা ফিরে এলো। বাসেও দেখা গেল, তুলি বড্ড নীরব ছিল। যা বলার, শুভ্রই বলেছে। শুভ্র ভেবেছে, তুলির মন খারাপ; তাই কথা বলছে না। কিন্তু শুভ্র ভুল ছিল। মন খারাপ নিয়; বরং তুলি অভিমান চেপে রেখেছিলো নিজের মধ্যে।

মনের মধ্যে অভিমানের ধোয়া উড়তে উড়তে একপর্যায়ে তা ঘনীভূত হয়ে ক্ষোভে পরিনত হয়েছে। ক্ষোভ থেকে অবহেলা। তারপর- তারপর কী?

#চলবে