অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
125

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_৩০(১৮+ এলার্ট)

রাতের খাবার শেষ করে তুলি বাসনপত্র রান্নাঘরে নিয়ে যাচ্ছিল। আফরোজা হাত মেলাতে চাইলেন কাজে- তুলি জোর করে তাকে রুমে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিলো। তারপর নিজেই একা একা বাসনপত্র নিতে লাগলো রান্নাঘরে। হঠাৎ শুভ্র হাত ধুয়ে এসে নিজেও একটা একটা করে বাসন রান্নাঘরে নিয়ে এলো। তুলি শুভ্রকে কাজ করতে দেখে হইহই করে উঠে বললো- ‘কী করছেন? আমি পারব। কটা বাসনই তো।’

শুভ্র গ্লাসগুলো রান্নাঘরের বেসিনে রেখে বললো -‘হাতে হাতে করলে দ্রুত শেষ হবে। আমি বাসন আনছি- তুমি এগুলো ডিশ ওয়াশারে দিয়ে দাও।’

শুভ্র বাসন রেখে আবারও ডাইনিংয়ে গেলো। তুলি মৃদু হেসে শুভ্রর যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকল। ওমন একটা সোনার মানুষ আল্লাহ তুলির কপালে রেখেছিলেন? তুলি হালকা হেসে সব বাসন ডিশ ওয়াশারে দিলো। তুলি তরকারিগুলো ফ্রিজে রাখছে। শুভ্র হাত ধুয়ে তুলির পাশে এসে দাড়ালো। তুলি বললো- ‘রুমে যান। আমি এটুকু করে নিচ্ছি।’

শুভ্র এবার কথা শুনলো। এগিয়ে এসে তুলির কপালে চুমু খেয়ে অশান্ত গলায় বললো -‘দ্রুত আসো। অপেক্ষা করবো।’

শুভ্র তুলির দিকে চেয়ে দুষ্টু একটা হাসি উপহার দিয়ে রুমে চলে গেলো। তুলি অবাক হয়ে তরকারি হাতে শুভ্রর চলে যাওয়া দেখলো। পরপর হালকা হেসে আবার কাজে মন দিল।

আজকের রাতটা কেমন অদ্ভুত! শুনশান, আকাশের মাঝখানে মস্ত বড় এক চাঁদ। আজকের রাতটা যেন ডাকছে কাউকে; আহ্বান করছে এক নতুন শুরুর। তুলি আফরোজার সঙ্গে রান্নাঘর সামলে নিজেদের বেডরুম এলো। শুভ্র বারান্দায় বসে আছে। কোলের উপর ল্যাপটপ। অথচ সে ল্যাপটপ দেখছে না। মাথা তুলে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো বেশ খানিক সময়। তুলি হালকা হেসে দরজা লক করে ধীর পায়ে শুভ্রর কাছে এসে দাঁড়ালো। শুভ্র আনমনে আকাশ দেখছে। তুলি আর তাকে বিরক্ত করলো না। রান্নাঘর থেকে এসেছে- গায়ে ঘাম। তাই সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। ওয়াশরুম থেকে একদম গোসল করেই বের হয়েছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে তুলি অবাক। বাইরে এখন বৃষ্টি নেমেছে। একটু আগেই তো দেখলো আকাশ পরিষ্কার। এক্ষুনি বৃষ্টিও নেমে গেলো? তুলি চুলগুলো গামছাতে পেঁচিয়ে বারান্দায় এলো। শুভ্র তখন ল্যাপটপটা ঘরে রেখে আবারও বারান্দায় দোলনায় বসেছে। তুলি গিয়ে শুভ্রর পাশে দাঁড়াল। হঠাৎ করেই শুভ্রর আশেপাশে শ্যাম্পুর সুন্দর এক গন্ধ পেয়ে পাশে তাকাল। চুলে গামছা পেঁচিয়ে তুলি শুভ্রর পাশে দাঁড়ানো। মুগ্ধ দৃষ্টি আকাশের দিকে। ভেজা গায়ে জড়ানো গোলাপি রঙের শাড়ি, তুলির গায়ের সঙ্গে শাড়ির রঙটা এতটা মানাচ্ছে- শুভ্র মুগ্ধ হয়ে তুলিকে দেখেই মন ভরছে না।

তুলি আকাশের দিকে চেয়ে বললো- ‘হুট করেই বৃষ্টি নামলো? গোসলে যাওয়ার আগেও তো দেখলাম আকাশ ফকফকা।’

শুভ্র শুনে না। সাজেকের সেই রাতের ন্যায় আবারও আজকের বৃষ্টি উষ্কাতে চাইছে শুভ্রকে। বৃষ্টির ফোঁটা গ্রিল পেরিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে শুভ্র-তুলি দুজনকেই। শুভ্রর সাদা টিশার্ট ভিজে গেছে অনেকটাই। শুভ্র মুগ্ধ হয়ে দোলনা থেকে উঠে তুলির পেছনে এসে দাঁড়াল। গামছায় তুলির ভিজে চুল খোঁপা করা। কপালের উপর ভিজে কয়েকটা চুল পরে আছে। মারাত্মক একটা দৃশ্য। শুভ্র তুলির পেছনে দাঁড়িয়ে আলগোছে হাত বাড়িয়ে তুলির চুলের গামছা খুলে দিল। ভিজে চুল সব ঘাড়ে ঝরঝরিয়ে পরতেই তুলির গা শিরশির করে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে শুভ্রর দিকে তাকাল। শুভ্রর চোখে চেনাপরিচিত সেই একই নেশা। ছোঁয়াচে রোগের ন্যায় তুলির মধ্যেও সঞ্চারিত হল সেই একই নেশা। শুভ্র তুলির ভিজা চুলগুলো ঘাড়ের পাশ থেকে সরিয়ে ডান কাঁধে ছড়িয়ে দিয়ে মুখ ডুবালো তুলির ঘাড়ের নরম অংশে। তুলি শিরশিরিয়ে উঠে পরনের শাড়ি খামছে ধরলো। মুখ ফুটে অস্ফুট স্বরে বলতে চাইল- ‘মাত্র গোসল-‘
শুভ্র জড়ানো গলায় তুলির ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বললো- ‘আবার করবে।’

নির্লজ্জ লোকের নির্লজ্জ যত কথা। তুলি এখন আবেশে গা না ভাসালে না থাকলে কটা কথা শোনাত। ঠাণ্ডার পড়েছে আজ, তারমধ্যে সকালে একবার, রাতে দুবার গোসল করলে তুলিকে কী খুঁজে পাওয়া যাবে? মনে তো হয়না। শুভ্র তুলির ঘাড় থেকে মুখ তুলে পেছন থেকে জড়িয়ে ধড়ে কাঁধে থুতনি রাখলো। তুলি অশান্ত শ্বাস ফেলছে। শুভ্র থামল- তুলিকে একপল দেখে নিয়ে বড্ড আবেগ নিয়ে ডাকলো- ‘তুলি, আমার জান?’

তুলি চোখ বুজলো, থেমে থেমে জবাব দিলো- ‘হু?’

শুভ্র তুলির কাঁধে চুমু খেলো। জড়ানো গলায় শোধালো- ‘আই নিড অ্যা বেবি।’

তুলি জবাব দিলো না। বুকটা ধড়ফড় করছে তুলির। কিছুক্ষণ অশান্ত একেকটা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। চোখে ভাসল- এক নিষ্পাপ শিশুর ছবি। শুভ্রর কোলে মাথা ঠেকানো শিশুর- শুভ্র আলগোছে পিঠে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। তুলির চোখটা ছলছল করে উঠল। হ্যাঁ; তুলির চাই একটা বাচ্চা। এক নিষ্পাপ অংশ চাই- তার আর শুভ্রর। তুলি মুখে উত্তর দিলো না- বরং সম্মতিস্বরূপ মাথাটা আলগোছে শুভ্রর গালের সঙ্গে ঠেকালো। শুভ্র উত্তর বুঝে হালকা হাসলো। তুলির গালে নিজের গাল ঘষে ঝট করে তুলিকে পাঁজকোলে তুলে নিল। বিছানার দিকে এগুতে এগুতে বললো- ‘প্রসেসিং শুরু হোক তাহলে।’

তুলি লজ্জা পেয়ে শুভ্রর টিশার্টের কলার খামছে ধরল- অস্ফুট স্বরে বললো- ‘নির্লজ্জ আপনি।’

শুভ্র তুলিকে আলগোছে বিছানায় শোয়ালো। নিজের সমস্ত ভার তুলির উপর ছেড়ে বললো -‘শুভ্রকে নির্লজ্জ করেছিলটা কে?’

তুলি লজ্জা পেয়ে মুখটা ডান পাশে সরাল। শুভ্র তুলির থুতনি চেপে নিজের দিকে ফেরাল। শুভ্র বললো – ‘মনে নেই? সাজেকের বৃষ্টি ভেজা রাতে আমার চূড়ান্ত সর্বনাশ করে ফেলেছিলি? ইউ রিমেম্বার?’

তুলি মেকি রাগ দেখিয়ে বললো -‘আমি কাছে ডেকেছিলাম আপনাকে? মিথ্যা বলছেন কেন?’

শুভ্র তুলির কপালে গাঢ় এক চুমু খেয়ে বললো -‘আমি জানি তুমি ডাকো নি আমায়। তুমি শুধু আমায় সিডিউজ্ড করেছিলে। কাছে যা যাওয়ার, তা আমি আপনা আপনি গিয়েছিলাম।’

বলে ডান চোখটা আবারও টিপলো শুভ্র। তুলি হা হয়ে গেলো। অবাক হয়ে বললো- ‘সিডিউজ্ড? আমি করেছি?’

শুভ্র উত্তর দিলো- ‘হ্যাঁ করেছ। আমি ভালো ছেলে হয়ে রুমে বসেছিলাম। তুমি বারান্দায় বৃষ্টিতে ভিজছিলে। আমি গেলাম, আমাকে কাছে ডাকলে। ভদ্র আমাকে ভেজা গায়ে মুগ্ধ করলে। ওই রাতের পর আমার আর ভদ্র হয়ে থাকতে ইচ্ছাই করে না। ভদ্র হয়ে থাকলে- বেবিরা কি আসবে কখনো? তাই বেবিদের বাবা ইচ্ছে করেই নির্লজ্জ হয়েছে। অল ফল্ট ইজ ইয়োর্স।’

তুলি হতবম্ব হয়ে শুভ্রর কথা শুনছিলো।শুভ্রর একেকটা কথা শুনে ইচ্ছে তো করছে- মাথাটায় ধরে একটা দিতে। নিজে এগিয়ে এসে- দোষ সব তুলির কাঁধে দেওয়া হচ্ছে। তুলি ঝগড়া ঝগড়া মুখ করে আঙুল উচিয়ে বলতে চাইল- ‘দেখুন-‘

শুভ্র বলতে দিল না। তার আগেই তুলির আঙ্গুলের ডগায় চুমু খেয়ে বললো – ‘সারারাত পরেই আছে মিসেস শুভ্র। আই উইল ডেফিনেটলি অবসার্ভ ইউ দিস নাইট।’

তুলি বড়বড় চোখে শুভ্রর দিকে তাকালো। আরও কিছু বলতে যাবে- তার আগেই শুভ্র তুলির ঠোঁটে আঙুল চেপে চোখের দিকে চেয়ে বললো -‘আজকেও ঝগড়া করবে? লেটস মেইক দিস নাইট মেমোরেবোল- মিসেস শুভ্র।’

তুলি শুভ্রর চোখে চোখ রাখলো। চূড়ান্ত নেশা লেগে আছে শুভ্রর চোখে-মুখে। তুলি সেই নেশায় ডুবলো বরাবরের ন্যায়। মাথাটা একটু তুলে শুভ্রর গলা জড়িয়ে হালকা করে ঠোঁট ছুয়ালো শুভ্রর ঠোঁটে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা শুভ্রর দিকে চেয়ে লাজুক গলায় বললো -‘লেটস মেইক দিস নাইট মেমোরেবোল, মিস্টার শুভ্র।’

শুভ্র কিছুক্ষণ চমকে তুলির দিকে চেয়ে থাকলো। তুলি আপাতত শ্বাস আটকে মাথা নিচু করে আছে। শুভ্র মৃদু হেসে লাজুক তুলিকে আস্তে করে বিছানায় শোয়ালো। তারপর ধীরে ধীরে কপালে চুমু খেলো। চুমু খেল নাকের ডগায়। চুমু খেলো তুলির নরম দু গালে। ধীরে ধীরে তুলির সর্বাঙ্গ শুভ্রর দখলে চলে গেল। বৃষ্টি ভেজা রাত এ দম্পত্তিকে উষ্কে দিলো চূড়ান্তে। শুভ্র বরাবরের মতো নিজের কন্ট্রোল হারাল। তুলি- সে তো মাতোয়ারা শুভ্রর স্পর্শে।

#চলবে

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_৩১

সকালটা আজ বড্ড মিষ্টি ছিলো। এক ছটাক শান্ত রোদ গায়ে লেপ্টে আছে শুভ্র-তুলির। শুভ্রর ঘুমটা আগেই ভাঙলো। শুভ্রর বুকে ঘুমিয়ে আছে তুলি। ফোলা ফোলা গাল, গায়ে শুভ্রর রাতের সেই সাদা শার্ট। মারাত্মক একটা দৃশ্য সাতসকালে দেখে শুভ্রর রক্ত পুনরায় গরম হয়ে গেলো। শুভ্র আলগোছে তুলিকে বুক থেকে সরিয়ে বিছানায় শোয়ালো। পর্দা ডিঙিয়ে রোদ সোজা তুলির চোখে পরছে। শুভ্র জানালার দিকে একবার চেয়ে তুলির চোখটা হাতের পিঠ দিয়ে ঢেকে দিল। তুলি রোদের জন্যে ঘুমাতে পারছে না। চোখ-মুখ কুঁচকে পাশ ফিরে বললো- ‘জানালাটা লাগান না। আমি ঘুমে মারা যাচ্ছি, উফ।’

শুভ্র হেসে উঠে। তুলির ফোলা গালটা নিজেকে বড্ড টানছে।শুভ্র সেই গালে চুমু খেয়ে বিছানা থেকে উঠলো। মেঝেময় এলোমেলো হয়ে তুলির শাড়ি, চুলে পেঁচানোর গামছা পরে আছে। শুভ্র উঠে শাড়ি, গামছা বাথরুমের ওয়াশিংমেশিনে রেখে আসলো। তারপর জানালার পর্দা লাগিয়ে দিল। তুলি ঘুমাক আরো কিছুসময়। এমনিতেই গতকাল রাতে মেয়েটাকে কম জ্বালায় নি সে। তুলির ঘুমন্ত চেহারার দিকে চেয়ে শুভ্র হেসে টাওয়াল নিয়ে সোজা বাথরুমে চলে গেলো।

শাওয়ার নিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে তুলি কাবার্ড থেকে শাড়ি বের করছে। গায়ে এখনো শুভ্রর শার্ট। শুভ্র স্বীয় স্ত্রীর এমন আবেদনময়ী দৃশ্যে কাবু হলো বরাবরের ন্যায়। টাওয়াল বিছানার উপর ফেলেই সোজা তুলিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতে চাইলে তুলি নিজের মতো করে ড্রয়ার লাগিয়ে ওপাশে সরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায়। আচমকা সরে যাওয়ায শুভ্র থতমত খেয়ে তুলির দিকে তাকায়। তুলির সেসবে মন নেই। সে তার নিজের কাজে ব্যস্ত। ব্যস্ততা দেখিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে নতুন শ্যাম্পু বের করে হাতে নেয়। শাড়ি-টাওয়াল নিয়ে বাথরুমে যাবে তখন চোখ যায় বিছানার দিকে। শুভ্রর ভিজে টাওয়াল বিছানায় ফেলে রাখা দেখে মুহূর্তেই মেজাজ চড়ে যায় তুলির। বিছানা থেকে টাওয়াল হাতে নিয়ে শুভ্রর দিকে চেয়ে গরম চোখ নিয়ে বলে- ‘এটা বিছানায় কেন? হু?’

শুভ্র দেখে বিছানা বেশ ভিজে গেছে টাওয়ালে। শুভ্র বোকা বোকা গলায় বললো -‘সরি। তোমাকে ওভাবে দেখে-‘

তুলি ভিজে টাওয়াল নিয়ে বারান্দায় যেতে যেতে বললো- ‘দাঁড়ান, নতুন বিছানা আমি আপনাকে দিয়ে বিছাবো। সবসময় খামখেয়ালি আপনার।’

তুলি এ কথা বলে বারান্দার দরজা পাড় করার আগেই শুভ্র পেছন থেকে তুলির হাত টেনে ধরলো। তুলি অবাক হয়ে তাকাল। শুভ্র বললো- ‘বারান্দায় যাচ্ছো কেন?’

তুলি হাতের টাওয়াল দেখিয়ে বললো -‘মেলে দিয়ে আসি এটা?’

শুভ্র তুলিকে আপাদমস্তক দেখে বললো -‘এই কাপড়ে? পাগল তুমি?’

তুলি শুভ্রর ইশারা দেখে নিজের দিকে তাকাল। নিজেকে শুধুমাত্র শুভ্রর একটা শার্টে দেখে তুলির রীতিমতো মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়। সঙ্গেসঙ্গে হাতের টাওয়াল দিয়ে তুলি হাঁটু ঢাকল। শার্ট এটা কখন পড়েছে তুলি? রাতে? তার তো মনে পড়ছে না। আচমকা এলার্মে ঘুম থেকে উঠায় তুলির মস্তিষ্ক হ্যাং ছিল। সকালের নাস্তার চিন্তা মাথায় এতটা ঝেঁকে ছিল খেয়ালই ছিল না নিজের দিকে। মনে হচ্ছিল- সে শাড়ি পরেই আছে। অথচ সে কিনা হাফ জামা কাপড় পরে ঘুরছে? ছিঃ: ছিঃ। তুলির মাথা নিচু করে হাশফাঁস করে বললো -‘আসলে আমি- আমি এভাবে-‘

শুভ্র গাঢ় চোখে তাকালো। লজ্জায় তুলি নীল হয়ে গেছে। লজ্জার চেয়ে বেশি অপ্রস্তুত হয়েছে। শুভ্র তুলির কাঁধে হাত রাখলো। বললো -‘লজ্জা রাখো। আমি ছাড়া আর কেউই দেখেনি কিছু। গোসল সেরে আসো। আমার কাছে টাওয়াল দাও, আমি মেলে আসছি।’

কথাটা বলে শুভ্র হাত বাড়িয়ে দেয় টাওয়াল নিতে। তুলি টাওয়ালটা দু-আঙুলে আরও চেপে ধরে বললো -‘না।’

শুভ্র ভ্রূ বাঁকালো। তুলি ওভাবেই হাঁটু টাওয়াল দিয়ে ঢেকে শাড়ি নিলো বিছানার উপর থেকে। তারপর টাওয়াল-সমেত সোজা বাথরুমে চলে গেল। শুভ্র এতক্ষণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তুলির কাজকারবার দেখছিল। তুলির ঠাস করে দরজা বন্ধ করায় শুভ্র প্রথমে হা হয়ে দরজার দিকে চেয়ে পরপরই হেসে চেচিয়ে বললো -‘ওমা তুলি? লজ্জা পেলে? আমাকে? ভুলে গেছো আমি তোমার হাস-‘

‘চুপ একদম নির্লজ্জ পুরুষ।’

তুলি বাথরুম থেকেই ধমকাল। শুভ্র শব্দ করে হেসে ফেললো।

শাড়ি গায়েই ওয়াসরুম থেকে বের হয়েছে তুলি। ওয়াশরুমে চেঞ্জিং এরিয়া থাকায় লাভ হয়েছে। শাড়ি ভেজার চান্স নেই। তুলি মাথার চুল গামছায় ঝাড়তে ঝাড়তে আয়নার সামনে দাঁড়াল। শুভ্র তখন তুলির পেছনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে। তুলি ফেইসক্রিম মেখে সাজ হিসেবে টিপ দিল কপালে, কাজল দিল চোখে। কাজল চোখ শুভ্রর ভীষণ পছন্দ। কপালের টিপটাও তেমনি ভালো লাগে শুভ্রর। শুভ্র আর তুলির কদিন ছুটি হাতে আছে। এ কদিন তুলি সারাক্ষণ শুভ্রর মনমতো সেজে থাকবে। এমনটাই ভেবে রেখেছে তুলি। তুলি সাজ শেষ করে শুভ্রর দিকে ফিরল। কোমরে হাত রেখে চোখ টিপটিপ করে কাজল দেখিয়ে শুভ্রকে জিজ্ঞেস করল -‘আমায় কেমন লাগছে বলুন তো।’

শুভ্র তুলিকে দেখল। শার্টের শেষ বোতামটুকু লাগিয়ে তুলির চোখের কোণা থেকে কাজল নিয়ে কানের পেছনে লাগিয়ে দিয়ে হেসে বললো -‘শুভ্রর বৌকে বরাবরই অস্থির লাগে।’

তুলি লাজুক হাসলো। শুভ্র তুলির কপালের টিপ সোজা করে দিয়ে ছোট্ট করে বললো -‘কন্ট্রাসেপটিভ আজ থেকে বন্ধ, হু?’

শুভ্রর এ কথা শুনে তুলি অবাক হয়ে প্রথমে শুভ্রর দিকে চাইলো, পরপর লাজুক হেসে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরলো। মিহি গলায় বললো -‘হু।’
_________________________

তুলির ক্লিনিকের ছুটি শেষ হয়ে গেছে প্রায় দুমাস। বিয়ের পর প্রায় দশদিনের মতো ছুটি ছিল। এক সপ্তাহ ছিলো শুভ্রর ছুটি। শুভ্র চেয়েছিল, পনেরো দিনের ছুটি নিবে, সাজেক যাবে দুজন। শুভ্র ছুটি পেলেও, নতুন জয়েন করায় তুলি সেই ছুটি পায়নি। তাই দুজন সিদ্ধান্ত নিয়েছে- ওরা ঈদের বন্ধে সাজেক যাবে। তবে- দুজন মিলে এই দশ-সাত দিনের ছুটিগুলো বেশ আনন্দ নিয়ে কাটিয়েছে। তবে এখন আবার শুরু হয়েছে গদবাঁধা সেই একই জীবন। সকালে নাস্তা করে শুভ্র-তুলি একসঙ্গে বেরিয়েছে চাকরিতে। তুলিকে ক্লিনিকে ছেড়ে শুভ্র নিজের হাসপাতালে চলে গেছে। তুলি নিজের রুমে বসলো। এখানে আরও কজন নতুন ডাক্তার বসে। তুলি সবার আগে ওদের সঙ্গে এক কাপ চা খেলো। তুলির ফ্রেন্ড-ঊষা বললো- ‘তুলি? কেমন কাটল দিন? আহা শুভ্র স্যার কে রেখে ক্লিনিকে আসতে বড্ড কষ্ট হয়েছে না?’

তুলি হাসি চেপে গম্ভীর স্বরে বললো- ‘জামাইর কোলে সারাদিন বসে থাকার জন্যে ডাক্তার হইনি।’

ওপাশ থেকে ঊর্মি বললো- ‘কোলেই তো ছিলি এতদিন। কোল থেকে নেমে আসলি কাজে।’

তুলি মেকি রাগ দেখিয়ে বললো- ‘যার কোলে বসার কথা বলছিস- সে তোদের এককালে স্যার হতো। স্যারকে নিয়ে এমন অশ্লীল কথা বলিস?’

ঊষা যেন এ কথায় মজা পেয়ে গেলো। বললো-‘তুমি সেই স্যারেরই কোলে বসবা, চুমু খাবা সব অশ্লীল কাজ করবা। আর আমরা বললেও দোষ? স্যার তো তোরও হয়।’

তুলি জবাব দিলো- ‘উহু, সে এখন শুধুই আমার বর। আমার অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের বর।’

ঊষা-ঊর্মি দুজনেই ‘ওহো’ করে উঠল। তুলি লজ্জা পেয়ে চায়ের কাপ রেখে উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে। স্টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো- ‘কাজে লাগ দ্রুত। নাহলে সিনিয়র অফিসার ধরবে একেকজনকে, স্যালারির উপর বাজ পড়বে।’

——-
আজ তুলি ভেবেছে, কাজ শেষ করে সোজা বাবার বাসায় যাবে। অনেকদিন ওদিকে যাওয়া হয়নি। ইয়াসমিন বারবার করে বলছেন। ইয়াজিদও আর পনেরো দিন পর সৌদি চলে যাবেন। বাবার সঙ্গে বিয়ের পর তেমন সময়ও কাটানো হয়নি। তাই যেই ভাবা সেই কাজ। দ্রুত ক্লিনিকের কাজ সামলে রওনা দিলো বাবর বাসার উদ্দেশ্যে। রিকশায় বসে কল করল শুভ্রকে।

‘হ্যালো।’
‘হু ,বলো। কাজ শেষ?’
‘হ্যাঁ। আমি বাসায় ফিরব না এখন। বাবার বাসায় যাচ্ছি। আম্মুকে বলে এসেছি। বাসায় রাধা আঁছে, খেয়ে নিও।’

‘ঠিকাছে। রাতে থাকবে নাকি?’
‘চাইলে দিবে নাকি?’

তুলির পাল্টা প্রশ্ন। শুভ্র হেসে বললো -‘আমি দেওয়ার কথা পরে। তুমি নিজেই তো চাইবে না।’

তুলি লজ্জা পেয়ে হেসে বললো -‘সন্ধ্যার পর ফিরছি।’
শুভ্র হেসে বলল- ‘ঠিকাছে, ঘুরে আসো।’

তুলি কল কেটে মোবাইল আবার ব্যাগে ভরলো। আজ মাথাটা বড্ড ঘুরাচ্ছে। রিকশার ঝাঁকুনি অনেক খেয়েছে, অথচ আজ এই ঝাঁকুনিতেই পেটের সব যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কাজে তো তেমন কিছুই খায়নি। দুকাপ চা খেয়েছিলো, আর ক্যান্টিনে রুটি-ভাজি খেয়েছে। এসব তো রোজই খায়। তাহলে আজকে এমন অদ্ভুত লাগছে কেন শরীর। চিন্তা করার মধ্যে হঠাৎ তুলির কিছু একটা মনে পড়ল। দ্রুত মোবাইল আবার ব্যাগ থেকে বের করে আজকের তারিখ দেখল। ক্যালেন্ডার দেখে সন্দেহ তখনই গাঢ় হলো আরও। তুলি ভ্রু কুঁচকে পেটে হাত রাখল। অশান্ত একেকটা নিঃশ্বাস ফেলছে তুলি। খুশি-অনুভুতি সব ঝট পাকিয়ে যাচ্ছে। তুলি কী শেষ অব্দি শুভ্রর এতদিনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারছে? পেটে হাত রেখে আনমনে ফিসফিস করে বললো তুলি বললো -‘তু-তুমি এসে গেছো?’

#চলবে

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_৩২

প্রায় এক সপ্তাহ পর বাবার বাসায় এসে তুলি আনন্দে আশপাশ ভুলতে বসেছে। জোবায়েরের সঙ্গে অনেকদিন পর আজ স্পাইডার ম্যান মুভি দেখতে বসেছে। জোবায়ের বুঝিয়ে দিচ্ছিল তুলিকে মুভির কাহিনি। মুভি দেখার ফাঁকে শুভ্রর কল এলো। তুলি কল রিসিভ করে রুমে আসল-

‘বাসায় ফিরেছেন?’
‘হ্যাঁ, খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম মাত্র।’
‘আম্মু খেয়েছে? উনার জন্যে শুটকি রেঁধে রেখে এসেছিলাম।’
‘হ্যাঁ, খেয়েছে। বাপের বাড়ি ভালো লাগছে তো?’
‘অনেক।’
‘কী করছিলে?’
‘স্পাইডার ম্যান মুভি দেখছিলাম।’

শুভ্র এ কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে, পরপরই হেসে উঠল। বললো-‘এত বড় হয়ে এখনো জোবায়েরের সঙ্গে স্পাইডার মুভি দেখো?’

তুলি লজ্জা পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর একটু থেমে ম্লান কণ্ঠে বলল- ‘আর কিছুদিন পর থেকে ‘মা-মা’ জিনিস দেখার সময় হয়ে যাবে, এখন এগুলোই দেখি।’

শুভ্র হাসছিল, তুলির কথা শুনে হাসি থামিয়ে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল-‘মানে? কেন?’

তুলি বলতে চাইলো কিছু। শুভ্রকে জানাতে চাইল নিজের সন্দেহের কথা। মুখ খুলতে চাইলে, পরপর থেমে যায়। সন্দেহের বশে এতবড় সুখবর শুভ্রকে এখুনি জানাবে না তুলি। পরে যদি সন্দেহ ভুল হয়, তবে কষ্ট পাবে শুভ্র। আগে শিউর হোক, জানুক সে সত্যি আসছে। তারপর একটা বড় সারপ্রাইজ দিয়ে শুভ্রকে জানাবে তাদের দুজনের অংশের কথা।তুলি শুভ্রের প্রশ্নের উত্তর চেপে গেলো। আরও কিছুক্ষণ শুভ্রর সঙ্গে কথা বলে নিল। তারপর একটু পর শুভ্র নিজেই বললো- ‘আমরা পরে কথা বলবো। এখন যাও, বাবা মার সঙ্গে সময় কাটাও। অনেকদিন পর আসলে না?’

তুলি সায় দিল শুভ্রর কথা। কল রেখে গেলো ইয়াসমিনের রুমে। ইয়াসমিন চুল আঁচড়াচ্ছেন। তুলি গিয়ে নিজের হাতে চিরুনি তুলে আঁচড়ে দিতে লাগলো ইয়াসমিনের চুল। ইয়াসমিন আরামে চোখ বুজে আছেন। জিজ্ঞেস করলেন-‘ওই বাড়িতে দিনকাল কেমন কাটছে তোর, তুলি?’

তুলি আনমনে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে জবাব দিলো-‘ভীষণ ভালো।’

‘তুই যে এলি শুভ্র কিছু বলেছে? অনুমতি নিয়ে এলি তো?’
‘হু, উনিই বলেছেন ঘুরে আসতে।’

ইয়াসমিন গল্প করতে লাগলেন তুলির সঙ্গে। একসময় তুলি দোনামোননা করে করে বললো-‘মা, আজ সন্ধ্যার পর একজায়গায় যাব। আমার সঙ্গে তুমি যাবে?’

‘কই যাবি? তুই না ফিরবি সন্ধ্যার পর?’
‘রাতে ওখান থেকেই সোজা ওই বাড়ি চলে যাব, এদিকে আর আসবো না।’
‘আচ্ছা যাবো। আগে বল কই যেতে চাইছিস? ফ্রেন্ডের বাসায়?’
‘না, হসপিটাল।’
‘হসপিটালে কেন?’
‘আমি সোনোগ্রাফি করবো।
‘সো-‘

ইয়াসমিন অবাক হয়ে তুলির দিকে তাকালেন। তুলি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো। মায়ের সামনে আর কিছু বলার নেই তার। ইয়াসমিন মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে পরপর খুশি হয়ে বললেন-‘কিছু আন্দাজ করেছিস? পরীক্ষা করবি? কিট দিয়ে কর আগে, সন্ধ্যার পর যাব রিপোর্ট করতে।’

‘কিট আনিনি সঙ্গে।
‘দাঁড়া, আমি দেখি আছে কিনা ঘরে। নাহলে নিয়ে আসছি আমি ফার্মেসি থেকে।’

ইয়াসমিন উঠতে চাইলেন। তবে তুলি পেছন থেকে তার হাত আটকে দিল। ইয়াসমিন তাকালেন, তুলি বললো-‘আম্মু- আমি ডাইরেক্ট রিপোর্ট করব।’

ইয়াসমিন আর মেয়েকে ঘাটালেন না। বিছানায় বসলে, তুলি মায়ের কোলে মাথা রাখে। ইয়াসমিন তুলির চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ইয়াসমিনের চোখ দুটো ছলছল করছে। সেদিনের তুলি, ওই বাচ্চা তুলি আজ নিজেও মা হবে। আবেগে চোখ থেকে জল পড়তে চাইলে, ইয়াসমিন মুছে ফেলেন। তুলি মায়ের কোলে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।ইয়াসমিন তুলিকে বিছানায় শুইয়ে আলমারি ঘেঁটে পুরনো শাড়ি বের করলেন। কটা বাচ্চাদের কাথা সেলাই করতে হবে- এখন থেকে শুরু না করলে পরে যদি দেরি হয়ে যায়।
____________________
রিপোর্ট হাতে বিছানার উপর বসে আছে তুলি। শুভ্র এখন চেম্বার থেকে ফিরেনি। যখন ফিরবে, তুলির রিপোর্ট দেখবে- কী করবে তখন শুভ্র? কিভাবে সামলাবে নিজেকে। তুলি আজ মনের মতো সেজেছে। গায়ে শুভ্রর দেওয়া সেই কাবিনের দিনের জামদানি শাড়ি, হাতে শুভ্রর দেওয়া চুড়ি, শুভ্রর নামের খোদাই করা আংটি অনামিকা আঙুলে। সাজ নেই তেমন, তবে কপালে টিপ আর কাজল দিয়েছে। শুভ্র এতেই মুগ্ধ, তুলি জানে। শুভ্র এলো, আফরোজার সঙ্গে দেখা করে রুমে টোকা দিল। তুলির পা কাঁপছে, হাতের থাকা রিপোর্টও কাঁপছে। তুলি রিপোর্ট হাতে এগিয়ে গেলো। উত্তেজনায় হাঁটতেও পারছে না তুলি। অবশ লাগছে নিজেকে। ওপাশ থেকে শুভ্র মিহি স্বরে ডাকলো একবার- ‘তুলি, ভেতরে আছো? দরজা খুলো।’

তুলি ঢোল গিললো। রুমের লাইট নেভানো। মোমবাতি জ্বালান অনেকগুলো। তুলি সিটকিনি খুলে দিল দরজার। শুভ্র বলতে থাকে-‘কী করছিল-‘

সঙ্গেসঙ্গে তুলির দিকে চেয়ে থমকে যায় শুভ্র। তুলি দরজায় বাঁকা হয়ে হেলান দিয়ে আছে। ডান হাতে শাড়ি খামছে ধরে আছে- বাম হাত দরজা ঠেসে রাখা। শাড়িটা এমনভাবে পড়েছে, কোমর উন্মুক্ত, গায়ে লেপ্টে আছে একদম। শুভ্র ঢোক গিলে। তুলির পা থেকে মাথা অব্দি দেখে ভ্রু বাঁকিয়ে বলে- ‘পাগল করার ধান্দায় আছেন নাকি- মিসেস শুভ্র?’

তুলি শুভ্রর টাই একহাতে ধরে টেনে শুভ্রকে রুমের ভেতরে আনল। তারপর নিজেই দরজায় সিটকিনি তুলে দিল। শুভ্র দরজা লক করার আওয়াজে পেছন ফিরে একবার দেখলো। তুলি আঙুল দিয়ে শুভ্রর মুখটা আবার নিজের দিকে করে নিলো। শুভ্র আবারও ঢোক গিলে। তুলিকে আপাদমস্তক বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে। তুলি শুভ্রর সম্পূর্ন মুখে আঙুল ঘুরিয়ে বললো-‘পেছনে কি, হুঁ? আমাকে দেখুন, শুধু এবং শুধু আমাকে।’

শুভ্র এবার হাসলো। তুলির কানের কাছে ফিসফিস করে শুভ্র বললো-‘আ’ম ডায়িং।’

তুলির বুকটা কেঁপে উঠে। শুভ্র তুলির কানের লতিতে চুমু খেলো। তুলি কেঁপে উঠে শুভ্রর শার্ট চেপে ধরলো। শুভ্র দুহাতে তুলির উন্মুক্ত কোমর চেপে ধরে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। তুলি শুভ্রর গলার টাই খুলে মাটিতে ফেলল। শুভ্র আনমনে দেখে যাচ্ছে তুলিকে। শুভ্র একসময় গাঢ় গলায় বললো—‘ইউর গ্লোসি লিপস মেকিং মি ক্রেজি। ক্যান আই কিস?’

তুলি মায়া দৃষ্টিতে তাকালো শুভ্রর দিকে। শুভ্র মুখটা এগিয়ে নিলে তুলি মাথা পিছিয়ে নেই। শুভ্র ভ্রু বাঁকায়- ‘কী?’

তুলির শুভ্রর বুকে হাত রেখে ঠেলে বললো-‘এত অধৈর্য্য কেন? এখন তো মাত্র শুরু।’

শুভ্র ব্যস্ত ভঙ্গিতে তুলির কোমরে চাপ দিয়ে নিজের দিকে টেনে বললো-‘অধৈর্য্য বানানো হয়েছে আমাকে। কাম, জাস্ট ওয়ান কিস।’

শুভ্র এগিয়ে আসলে, তুলি আবারো সরে শুভ্রর থেকে জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। শুভ্র হতাশ চোখে তাকিয়ে আছে তুলির দিকে।
তুলি থামল। তারপর ধীর হাতে শুভ্রর ডান হাত নিজের পেটের উপর রাখল। শুভ্র বুঝতে পারলো না প্রথমে তুলির এ আচরণের অর্থ। প্রথমে স্বাভাবিক চোখে তাকিয়ে হঠাৎই চোখ বড়বড় করে তুলির পেটের দিকে তাকিয়ে আবার তুলির দিকে তাকাল। তুলির শুভ্রর কানের কাছে ফিসফিস করে শোনাল-‘ছোট্ট শুভ্র আসছে। আপনার অপেক্ষার ফল ফাইনালি আসছে,শিশু ডক্টর।’

শুভ্র চমকালো, ভীষণ চমকে তুলির পেটে হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। তুলি হালকা হেসে আবারও বললো- ‘আপনার এতদিনের ইচ্ছা শেষ অব্দি পূরণ হচ্ছে। কেমন লাগছে ডাক্তার মশাই?’

আবেগে শুভ্রর চোখের কোণে অল্প কিছু পানি জমেছিল। শুভ্র পানিটুকু আড়াল করে তুলিকে ছেড়ে নিজের কোমরের দুপাশে হাত দিয়ে উপরের দিকে চেয়ে ঢোক গিলছে। শুভ্র ভয়াবহ নার্ভাস। কী বলবে, এমন একটা অবস্থায় কেমন রিয়েক্ট করা হয় শুভ্র জানে না। সে প্রথম বাবা হচ্ছে, বাচ্চা সম্পর্কিত অনুভূতিতে সে নতুন। শুভ্র ঢোক গিলছে, তার অ্যাডাম অ্যাপলস ফুলছে বারবার। তুলি শুভ্রকে সময় দিল। শুভ্র মাথা নিচু করল। দুপাশে মাথা নেড়ে নিজের কাঁদোকাঁদো অনুভুতি সামলে নিয়ে তাকাল তুলির দিকে। তুলি আবার হাসল। ভ্রু নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল- ‘কেমন লাগছে?’

শুভ্র এবার হালকা হাসার ভান করে তুলিকে আচমকা জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ ডুবাল। তুলিকে যতটা পারে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে দিল। পিষে ফেলতে চাইছে যেমন তুলিকে নিজের সঙ্গে। তুলি সাবধানতা অবলম্বন করে পেটে এক হাত রেখে শুভ্রকে অপরহাতে জড়িয়ে রাখলো। শুভ্র ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বললো-‘আমাকে বাবা হওয়ার মতো বেস্ট একটা ফিলিংসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ তুলি। তুমি- তোমাকে ভা-ভালোবাসি,ভা-‘

শুভ্র আর বলল না কিছু। তুলি অনুভব করছে তার ঘাড় ভিজে যাচ্ছে। ওমা, শুভ্র কাঁদছে? তুলি বোকা হয়ে গেলো একদম, শুভ্রকে জোর করে নিজের থেকে ছাড়াতে চাইলে শুভ্র আরও শক্ত করে চেপে ধরল। তুলি হাল ছাড়ল। শুভ্র নিজের চোখের জল তুলিকে দেখাতে নারাজ, তাই তুলিও জোর করলো না। একসময় শুভ্র নিজেই নিজেকে সামলে সরে আসল। অন্যপাশে মুখ লুকিয়ে চোখ মুছে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো- ‘কয় মাস? এ খবর কখন পেলে? কাল? আজ? আজ পেয়েছো? আর কেউ জানে? আম্মু জানে?’

‘বলছি সব। ভ্রুণের বয়স ২ মাস ৭ দিন। কাল বাবার বাসায় ছিলাম না? আম্মুকে নিয়ে গিয়েছিলাম সনোগ্রাফি করতে। রিপোর্ট আজ ক্লিনিক থেকে ফেরার সময় নিয়ে এসেছি। রিপোর্ট পেয়ে আপনাকেই প্রথম বললাম।’

শুভ্র হা হয়ে গেলো। বললো-‘বিয়ের প্রথমরাতে ছক্কা? আমার বাবু বাবাকে বেশি অপেক্ষা করায় নাই।’

তুলি লজ্জা পেয়ে বললো-‘কী ভাষা মুখের।’

শুভ্র হেসে বললো-‘যাও ভাষা ঠিক করছি। আগামীকাল আমার সঙ্গে আবার যাবে ডাক্তারের কাছে। আমরা মহুকে কনসাল্ট করব আমাদের বেবির জন্য। ও তো গাইনোকলোজি স্পেশালিস্ট।’

তুলিও সায় দিলো। শুভ্র তুলিকে সামনে ঘুরিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। তারপর কাঁধে থুতনি রেখে বলতে লাগলো-‘এখন থেকে বাইরে চলাচল বন্ধ, ঘরেও তেমন কিছু করা লাগবে না। বুয়া এসে তো সব করেই যাই। রান্না আর বাসন থাকে। এগুলো আমি ঘরে থাকলে করে দিবো। ওয়েট, রান্নার জন্যে নতুন বুয়া রাখলেই তো হয়? কী বলো?’

‘বুয়ার হাতের রান্না খাবেন? আগে খেয়েছেন?’
‘না, তবে এখন থেকে খাবো।’
‘না, তার কোনো দরকার নেই। আমি রান্না করবো। আর আম্মু তো আমাকে সাহায্য করেনই। সমস্যা হবে না কোন।’

শুভ্র একটু থামল। তারপর দোনামোনা করে বললো-‘ ক্লিনিক করা লাগবে এ কদিন? বাদ দিলে হয়না? যদি কিছু হয়ে যায়।’

তুলি পেটের উপর রাখা শুভ্রর হাতের উপর হাত রাখল। বললো-‘ক্লিনিক ছুটি নিব ৭ মাসের সময়। এখন নেওয়া যাবে না। নতুন চাকরি, বাদ দিলে আর নিবে না আমাকে।’

‘ঠিকাছে, আমি জোর করব না তোমাকে। তবে এখন থেকে রিকশা বা সিএনজি কিছু চড়া যাবে না। আমাদের গাড়ি ইউজ করবে।’

‘তাহলে আপনি কী দিয়ে আসবেন? আপনার হসপিটাল তো আমার থেকেও বেশি দূরে।’

‘আমি একটা সিএনজি রিজার্ভ করে নিব এই কয়েক মাসের জন্যে। সিএনজি নিবে-আনবে।’

আরও কিছুক্ষণ কথা বললো দুজন। শুভ্রর হাতে তুলির সনোগ্রাফির ছবি। অবশ্য কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ছবিতে। তবুও শুভ্র হাতে ছবি নিয়ে বসে আছে। তুলি বেশ অনেকক্ষণ হলো ঘুমিয়েছে। শুভ্র তুলিকে বিছানায় শুইয়ে বারান্দায় গেল। এক হাতে নিজের বাচ্চার সনোগ্রাফির ছবি, অপরহাতে শুভ্রর বাবার ছবি। শুভ্র বারান্দার দোলনায় বসে বাবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর একসময় বললো-

‘আব্বু, আমি বাবা হচ্ছি।’

থামল শুভ্র। গলাটা আজ কাঁপছে কেন এত?কথাই বলতে পারছে না শুভ্র। ছবিতে শুভ্রর বাবা কথা বলতে পারেন না। যদি পারতেন খুশিতে শুভ্রকে বলতেন-‘এই তো আসল পুরুষের মতো কাজ। আমার ছেলে বাবা হচ্ছে, মিষ্টি বিলাব। মিষ্টির কেজি এখন কত করে রে শুভ্র? আমাদের সময় তো ছিলো ১ কেজি ১৮০ টাকা।’

শুভ্র থামে কিছুক্ষণ- তারপর নিজের মতো করেই বলতে লাগলো-
‘আমি তোমায় সেদিন বলেছিলাম, আমার ছাত্রিকে কিভাবে বিয়ে করবো। আম্মু কেন এমন ছেলেমানুষি সিদ্ধান্ত নিল। কিম্তু এখন- এখন আমি ভাবছি-আম্মু ছাড়া আমাকে আর কেউই বুঝে না আব্বু। আম্মু জানতেন, ওই মেয়ে, ওই ছাত্রির মধ্যেই আমার সব সুখ থাকবে। আর দেখো- থাকলোও। আমি ওই মেয়ে ছাড়া এখন কিছুই বুঝি না আব্বু। ওই মেয়ে আমার সমস্ত স্বত্তার মধ্য খুব বাজে ভাবে মিশে গেছে আব্বু। এখন ওই মেয়ের মধ্যে আমার আরেকটা স্বত্তা আসছে। তোমার শুভ্রর সন্তান। তুমি দাদা হচ্ছো। খুশি তুমি? ‘

কথা বলতে বলতে শুভ্রর চোখ থেকে এক ফোঁটা জল শুভ্রর বাবার ছবির মধ্যে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে শুভ্র জল মুছে ফেলল। বাবার ছবিকেই হাত বাড়িয়ে সনোগ্রাফির ছবি দেখিয়ে বললো-‘দেখো আব্বু, এটা আমার সন্তান। হাত পা বোঝা যাচ্ছে না এখন। কিম্তু আর কদিন, তারপর সব বোঝা যাবে। তোমাকে তখন আরেকবার দেখাব। এখন এটাই দেখো।’

শুভ্র আনমনে বাবার ছবির দিকে অনেক কথা বললো। তুলি ঘুমে ছিল, শুভ্রর কথা শুনে উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ শুভ্রর সব কথা শুনছিল। শুভ্র কাঁদছে, আর কথা বলছে। তুলি শুভ্রকে আর বিরক্ত করলো না। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ভালোবাসার লোভী নারীর মতো শুভ্রর সব কথা শুনতে লাগল।

#চলবে