আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
১.
এগারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট।দক্ষিণা জানালার দোপাট খুলে বসে রয়েছে কুহেলী।ফকফকা পরিষ্কার আকাশে মাঝে মাঝে এক গুচ্ছ মেঘ উড়ে এসে ঝড়ো হচ্ছে।আবার নিমিষেই মিলিয়ে যাচ্ছে।বাড়ির পাশেই বিশাল বড় দুটো গাছ থেকে কদম ফুলের তীব্র গন্ধ ধেঁয়ে নিয়ে আসছে বাতাস।গাঢ় মিষ্টি ঘ্রাণ!মাঝে মাঝে তীব্র বাতাসের দমকায় কুহেলীর কপালের হালকা কালো-খয়েরি মিশেল চুলগুলো উড়ছে।একটা মৃদু ভালোলাগা কাজ করলেও বুকটা ধপধপ করছে কুহেলীর।আজ সেই আঠারো’ই অক্টোবর।কুহেলীর জন্ম তারিখ।তবে এই দিনটা অন্যান্য বাকি সকল বারের মতো নয়।হয় আজকের দিনটা তার জীবনের অনেক স্পেশাল হবে নয় সবচেয়ে দুঃখের।আজ তার মেডিক্যাল পরীক্ষার ফলাফল আসবে।ভয়ে গলা থেকে কলিজা পর্যন্ত শুকিয়ে যায় কুহেলীর।অস্থির অস্থির লাগে।কুহেলীর একবার মনে হচ্ছে সে সিলেক্ট হয়ে যাবে।নামটা তার এসেই পড়বে। আসলেই সে ডাক্তার হয়ে যাবে!নাঈম ভাই তাকে এতো কষ্ট করে একদিনের যাতায়াতে ঢাকা শহরে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে ফিরতি নিয়ে এসেছে,এই কষ্ট সফল হবে।আব্বা হয়ত কালোজাম মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে দৌড়ে আসবে বাজার থেকে।কুহেলী তখন কি করবে?সারা উঠান জুড়ে নাচবে।ছোট বোন কুঞ্জা আর সে মিলে এক সাথে নাচবে।বুকটা চিনচিন করে ওঠে কুহেলীর, এই হয়ত সে ভুল কিছু ভাবলো।
বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে থেকে ভাবে এই বুঝি এখনি মরে যাবে।বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘরের কালো হয়ে যাওয়া ছাদ দেখে কুহেলী।গাঢ় জাম রঙের ফ্যানটা ভটভট আওয়াজ তুলে চলছে তো চলছেই।কি অদ্ভুত বিচ্ছিড়ি তার শব্দ তোলার রীতি!মাথা ঝিমঝিম করে।
‘কুহূ,এই কুহূ।কুহেলী মা রে।শিগ্গিরই বের হইয়া আয় ঘর থেইক্কান।দেইখ্খা যা তাড়াতাড়ি।ও কুহূ…।’
কর্কশ গলার আওয়াজে ঘুম ছুটে যায় কুহেলীর।গলাটা হাসনাহেনার।ভাঙ্গা গলায় তার আম্মা চেঁচিয়ে যাচ্ছেন।যেন বাড়ির মধ্যে ডাকাত পড়েছে।বিছানার মাঝে নিজেকে দেখে হুড়মুড়িয়ে ওঠে বসে কুহেলী।কখন যে চোখটা লেগে গিয়েছিল ঠাওর করতে পারেনি।দ্রুত গায়ে ভারী উড়না জড়িয়ে উঠানে নেমে এলো কুহেলী।উঠানের এক কোণায় লাহাড়ি ঘরের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন হাসনাহেনা আর তার দাদিমা।আসতে না আসতেই হঠাৎ করে দৌড়ে এসে কুহেলীকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো কুঞ্জা।সবে মাত্র ক্লাস সিক্সএ ওঠেছে সে।কথায় কথায় বাচ্চাদের মতোনই কাঁদে মেয়েটা।এখনোও কাঁদছে।গরগরিয়ে চোখের জল পড়ছে কুঞ্জার চোখ বেয়ে।তা দেখে যেন বোকা বনে গেল কুহেলী।
কুঞ্জার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে কুহেলী বলে,
‘কাঁদিস কেন?আম্মা আবার তরে বরইয়ের ঢাল দিয়ে মারছে?কোথায় লাগছে?দেখি দেখি,দেখা আমারে।’
কুহেলী কপাল কুঁচকে বললো কথাটা।সাথে সাথে শরীরে উত্তপ্ত তেল পড়ার মতো করে জ্বলে ওঠলো হাসনাহেনা।অনুযোগ করে হাসনাহেনা নরম গলায় বলেন,
‘হো আমি তো সারাদিন খালি তোদের মারি?অনেক খারাপ আমি।খালি তোরা ভালো।’
হাসনাহেনার কথায় তেমন খেয়াল না করে কুঞ্জার শরীরে মারের চিহৃ খুঁজে কুহেলী।
কুঞ্জা থ’ মেরে থাকে কিছুক্ষণ।তারপর বলে,
‘আপা আম্মা মারে নাই।’
‘তাহলে কাঁদিস কেন?কি হয়েছে?’
‘আপা তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাইবা?আমার কষ্ট হবে কিন্তু তোমাকে ছাড়া থাকতে।অনেক কাঁদবো।তুমি যেও না আপা।’
‘ছেড়ে কেন যাব?কি যা তা বলিস।’
‘আপা তুমি তো শহরের মেডিক্যাল কলেজে চান্স পাইলা।এখন চলে যাবা না?আমি কেমনে থাকবো।’
কুহেলী এক মুহূর্তের জন্য স্তব্দ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।বুঝতে পারে না কুঞ্জা কি ঠিক বলছে কিনা!সত্যিই কি তার নাম এসেছে ডাক্তারী কলেজের তালিকায়?নাকি উল্টোপাল্টা বকছে মেয়েটা।কুহেলী মায়ের দিকে দেখে এক রাশ প্রশ্ন নিয়ে।
দুই হাত প্রস্তত করে কুহেলীকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কুঞ্জা।কুহেলী ভ্রুঁক্রুটি করে কুঞ্জাকে দেখে। হাসনাহেনা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে এগিয়ে আসেন।কোমল হাতে স্পর্শ করেন কুহেলীর মাথা।ঘন চুলে হাত বুলিয়ে আদর দেন।কপালের সামনে পড়ে থাকা কাঁধ অবদি চুলগুলোকে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে ভেজা গলায় বলেন,
‘জানোস রে মা শেফালির পোলা যেদিন রাজধানীর ভালো বড় কলেজ পাশ দিয়া ইয়া বড় চাকরি পাইলো।ইয়া বড় গাড়িতে চইড়া আইছিল বাড়িত।আমি সেইদিন ভাবছিলাম আমার পোলা নাই।কিন্তু মাইয়্যা গুলারে অমন ভালো কলেজে পড়ামু।আজ তুই আমার আশা পূরণ করলি।আমিও সবায়রে (সবাই) কমু আমার মাইয়া ডাক্তার।কি খুশি হইতাছে আমার জানস?’
কুহেলীর মনে হয় তার কান ভুল শুনছে।দেহ হালকা হয়ে আসছে।সত্যিই সে মেডিক্যালে চান্স পেয়েছে!মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে হাসনাহেনা চোখের জল মুছে কুহেলীকে আবার বলেন,
‘রজব বাজার থেইক্কা দৌড়াইয়্যা আইয়া খবরটা কইয়া গেল।তোর আব্বা বাজারে ইন্টারনেট দেইখ্খা নিজে পাঠাইছে রজবরে।সে মিষ্টি কিনা লইয়্যা সারা পাড়া বিলাইয়্যা ফিরবো বাড়ি।’
কুহেলী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে হাসনাহেনার কথা শুনে।চোখ গড়িয়ে নেমে আসে অশ্রু।আম্মার দিকে তাকিয়ে দেখে কাঁদছেন হাসনাহেনা।কুঞ্জা অবাক হয়ে দেখে বড় বোন আর আম্মাকে। ছোট্ট কুঞ্জার মাথায় ঢুকে না তার আম্মা আর আপা এতো অদ্ভুত ভাবে কাঁদে কেন!হাসছে একবার,কাঁদছে আবার!এ কেমন কান্না।আপা কি তাহলে কুঞ্জাকে ছেড়ে যাবে বলে কাঁদছে?তাহলে আবার হাসে কেন?কুঞ্জা বিষ্ময় নিয়ে বলে,
‘আম্মা তুমি কাঁদো কেন?আপাকে আর মারতে পারবানা বলে?’
হাসনাহেনা কুহেলী দুজনেই হেসে ফেলেন কুঞ্জার অবুজ কথায়।হাসনাহেনা দুই সন্তানের মাথায় হাত রেখে বলেন,
‘সেই জন্য না।তোমার আপা ডাক্তার হইবো।মেলা নাম হইবো তার।তাই খুশিতে কাঁন্দি।’
কুঞ্জা এবার ভারী চমকে যায়।চটপট বলে,’খুশিতে আবার কাঁদে কেউ?’
‘কাঁদে বড়রা কাঁদে খুশিতে।’
কুহেলীর সোজা উত্তরে খেই হারায় কুঞ্জা।কত্তো অদ্ভুত এই বড় মানুষগুলো।স্কুলের মাষ্টরের মতো এদের কেউ মারে না।অথচ এরা কাঁদে।কুঞ্জা আর কিছু বলার আগেই মাটির পাতিলে করে মিষ্টি নিয়ে ফিরেন খোর্শেদ।সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে কিছু সময় পর্যন্ত চলে আনন্দ। খুশিতে আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি।মাস্টারি জীবনে অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন তিনি গড়েছেন।সকলকে ভালো শিক্ষা দিয়েছেন।গরিবকে ফ্রি পড়িয়েছেন।আজ তার মেয়েও তার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে।এবার তার মেয়েকে দেখেই না হয় গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ে পড়ালেখায় আগ্রহী হবে।
রাতে বারান্দা ঘরে বসে চলে ভালোমন্দ খাওয়া আর গোল বৈঠক।বৈঠকের মূল বিষয়বস্তু হলো কুহেলীকে ঘিরে।চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে নাম এসেছে।কিন্তু একা একা সেখানে থাকবে কি করে।অবশ্য অবশেষ ঠিক হলো খোর্শেদের এক ছোটবেলার বন্ধু জহিরের বাড়িতেই প্রথম ওঠে কয়েকদিন থাকবে কুহেলী।খোর্শেদ নিজে তাকে সেখানে দিয়ে আসবেন।বন্ধুর সাথে বাজার থেকেই মুঠো ফোনে কথা বলে এসেছেন তিনি।মাস তিনেক থাকবে।তবে হাসনাহেনা কিছুতেই রাজি হয়নি এতো সময়।মেয়েকে অন্যের বাড়িতে কিভাবে নিশ্চিন্তে থাকবেন তিনি?
খোর্শেদ অবশ্য হাসনাহেনাকে সাহস জুগিয়েছেন এই ব্যপারে।রাতে কুহেলী,কুঞ্জা আর হাসনাহেনা একসাথে ঘুমায়।মেয়ে যতদিন আছে নিজের কাছে যত্নেই রাখবেন।
পরদিন খোর্শদ সদরে গিয়ে দুটো মোবাইল ফোন কিনে আনলেন।এই প্রথম মোবাইল ফোন ঢুকলো কুহেলীদের বাড়িতে।যদিও গ্রামের অনেকেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে।তবুও খোর্শেদ নিজেই এর আগে তা ব্যবহারে আগ্রহী ছিলেন না।মেয়েদের পড়ালেখার ক্ষতি হবে বলে কথা।কিন্তু এবার কুহেলীকে ভালো রেজাল্টের ফল সরূপ ফোন এনে দিয়েছেন।তার শিক্ষকতা জীবনের চার বছরের জমানো টাকা দিয়ে কিনেছেন এই মোবাইল।আর যাই হোক তার মেয়ে এখন শুধু কুহেলী নয়,তার মেয়ে ডাক্তার কুহেলী হতে চলেছে।আরেকটা মুঠো ফোন এনেছেন বাড়ি থেকে কুহেলীর সাথে যোগাযোগ করার জন্য।সেটা দিলেন কুঞ্জাকে।মেয়েটা দুদিন ধরে মুখ রাশভারী করে রেখেছিল। নতুন জিনিস পেয়ে তা একটু কমেছে।
পাঁচদিন পর কুহেলীকে নিয়ে চিটাগাং এর উদ্দেশ্যে রওনা হন খোর্শেদ।স্টেশন গিয়ে লম্বা ট্রেনে চেপে বসে খোর্শেদ আর কুহেলী।জানালার পাশে বসে ব্যস্ত স্টেশন অবাক চোখে দেখে কুহেলী।রেলগাড়িতে এর আগে কখনো উঠা হয়নি।এই প্রথম। অবশ্য বই পত্রে ছবি দেখেছে অনেকবার।বসার কিছুক্ষণ পর বিশাল এক ধাক্কা খেয়ে ঝিকঝিক করে পিঁপড়ার চলতে শুরু করে ট্রেন।ধীরে ধীরে মানুষজন পেছনে ফেলে অযত্নে গড়ে ওঠা জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলে।ধেয়ে আসা বাতাসে কপালের সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো অবাধ্যের মতো উড়তে থাকে।কুহেলী চুল ঠিক করে লম্বা ঘোমটা টেনে দেয় কপাল পর্যন্ত।খোর্শেদ ঘুমের মতো চোখ বুজে সিটে হেলান দিয়ে থাকেন।কিছু সময় বাদেই ট্রেন ছুটে চলে দ্রুত গতিতে।সারারাত পার করে ভোর চারটায় ট্রেন পৌঁছায় চিটাগাং শহরে।স্টেশন এখনো ঢের দূর।দূরদূরান্তের এতো পাহাড়ের সমারোহ দেখে মন জুড়িয়ে আসে কুহেলীর।পাহাড়গুলো দেখে মনে হয় যেন খুব কাছে।দুকদম গেলেই ধরা যাবে,ছোঁয়া যাবে।আসলে তেমনটা না।
খোর্শেদ তার নরম হাত রাখেন মেয়ের মাথায়।কুহেলী খোর্শেদের দিকে ফিরে মুচকি হাসে।খোর্শেদের প্রাণ জুড়ে একটা ভালোলাগা খেলে যায়।বুকটাতে একটা চিনচিনে ব্যথা করে।
কুহেলীর মাথায় দু’একবার হাত বুলিয়ে বলেন,
‘আমাদের কথা মনে করে করে কষ্ট পাবি না।বরং দোয়া করবি।সাবধানে থাকবি নতুন শহরে।শহরের মানুষ গ্রামের মানুষের মতো এতো সহজ-সরল না।বুঝে শুনে চলবি প্রত্যেকটা পদক্ষেপে।এখন আমার পরিচিত বন্ধুর বাড়ি আছিস।এখানে হয়ত আদর যত্ন করবে সবাই।কদিন পর যখন হলে চলে যাবি সেখানে কিন্তু সবাই পর।বন্ধুমহলে যেমন অনেক ভালোবাসা পাবি,ভালো বন্ধু পাবি!তেমন অনেক শত্রুও গড়ে ওঠবে। অনেকে হিংসা করবে,অপছন্দ করবে,অপদস্ত করার চেষ্টাও করবে।কাওকে অসম্মান করবি না,সম্মান দিবি।তাহলে নিজেও পাবি।কেউ খারাপ করলে তার সাথে খারাপ করবি না।আল্লাহ্ অনিষ্ঠ কারীর শাস্তি নিজে দেন।অন্যায়কে প্রস্রয় দিবি না।প্রতিবাদ করবি,দমন করবি।ধর্মের পথে থাকবি।বিপদে আপদে আল্লাহ্ কে স্মরণ রাখবি।নিজেকে সবসময় খারাপ বা অন্যায় থেকে দূরে রাখবি।ভালোবাসবি সকলকে।’
খোর্শেদের প্রত্যেকটা কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে কুহেলী।এই প্রত্যেকটা কথা খোর্শেদ ছোট থেকে বুঝিয়ে শিখিয়ে বড় করেছে তাকে।কুহেলী খোর্শেদের চোখের কার্ণিশে পানি কণার চিলিক দেখতে পায়।আব্বা কাঁদছে?তার আব্বা কাঁদছে!সত্যিই তো কাঁদার কথা।কুহেলী জন্মানোর পর থেকে আজ পর্যন্ত খোর্শেদ নিজের মেয়েকে ছেড়ে একটা রাতও কোথাও কাটাননি।
প্রায় সময়ই পড়া থেকে কুহেলী আর কুঞ্জাকে ডেকে নিয়ে নিজ পাত থেকে তুলে নলা খাইয়ে দিতেন।হাতে টাকা না থাকলেও বাড়িতে অন্তত সপ্তাহে দু’দিন ওদের পছন্দের বড় মাছ আর গরুর মাংস এসেছে।এতটা আদর তিনি তার মেয়েদের করেছেন যতটা হয়ত গ্রামের আর কোন বাবার মাঝে কুহেলী দেখেনি।
প্রায় একঘন্টা কেটে যাওয়ার পর পাহাড় রাজ্যের প্রাসাদে পা রাখে কুহেলী। কুয়াশার চাদরে ঘেরা স্টেশনকে এই মুহূর্তে বেশ আপন মনে হচ্ছে। এখন থেকে এখানেই,এই শহরেই থাকবে সে।এই শহরের পথে পা ফেলে পূরণ হবে তার স্বপ্নগুলো। টুকরো টুকরো ইচ্ছা জুড়বে বিশাল আকাশ ঘেরা চিরকুটের মেলায়।
কুহেলী চট করে ভাবে কুঞ্জাকে একটা চিঠি লিখবে। মোবাইল থাকলেও চিঠি শিখার আনন্দ অন্যরকম।আসার সময় কুঞ্জা খামচে ধরেছিল কুহেলীর জামা।মুখ ফুলিয়ে চোখ রক্ত লাল করে ফেলেছিল মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে।কিছুতেই কুহেলীকে ছাড়বেনা।আম্মা কতো বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে সিনেমা দেখানো লোভ দেখিয়ে নিয়ে গেলো।কুঞ্জা তাকে একটা চিরকুট হাতে দিয়ে বলেছিল,
‘আপা এটা তোর প্রথম চিঠি নে।এখন খুলবি না। ওইখানে গিয়ে পড়বি।’
কুহেলী খুব করে হেঁসে যত্ন করে রেখেছিল চিরকুট’টা।উপরে লিখা ছিল ‘আকাশ মোড়ানো চিরকুট’।
আব্বার সাথে অনেকটা পথ হেঁটে স্টেশন থেকে বের হয়ে এলো কুহেলী। খোর্শেদ কুহেলীর মোবাইল থেকে ফোন করলো তার বন্ধু জহিরকে।সে জানালো তার ছেলে নিতে গিয়েছে তাদের। স্টেশনেই আরো একটু খুজতে।প্রায় দশ মিনিট এদিক ওদিক খোঁজর পর হঠাৎ কুহেলী আর খোর্শেদের সামনে এসে দাঁড়ালো একটা যুকব ছেলে।খোর্শেদ চোখের চশমা ঠিক করে ছেলেটিকে দেখে বললেন,
‘কিছু বলবে বাবা?’
ছেলেটি ভারী মিষ্টি সুরে বলে,
‘চাচা চিনেছেন আমাকে? অবশ্য চিন্তার কথা নয়।আমি ক্লাস টু’তে আপনার ছাত্র ছিলাম।আমি সমারোহ।’
চলবে.
আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
২.
প্রসস্ত এক হাঁসি ফুটে ওঠলো খোর্শেদের মুখ জুড়ে।বাল্যকালের প্রিয় বন্ধুকে দেখা মাত্রই যেন মনের মাঝে পুরনো সেই দিনের কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠলো।আঁখি পটে ঝাপসা থেকে সতেজ হতে লাগলো শৈশব।কতো শত স্মৃতি বুকের মাঝে জমা ছিল সব বের হয়ে এসেছে চোখে।জহির আহমেদ খোর্শেদকে দেখামাত্র ছুটে এলেন।বক্ষে চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।এ খুশির কান্না,মিলনের কান্না।বাড়ি কিছুটা থমথমে হয়ে রয়েছে।সকলে অবাক চোখে চেয়ে দেখছে এই বন্ধুত্বের দৃশ্য।জহির এতো সহজে নরম হয়ে পড়েন না সাধারণত।
কুহেলী খোর্শেদের পাশে দাড়িয়ে সম্পূর্ণ বাড়িটা চোখ বুলিয়ে দেখছে।বাহির থেকে ততটা সুন্দর না হলেও ভেতরটা মনোরম,শীতল।তিনতলা ডুপ্লেক্স বাড়ি।হলরুমের ডান পাশ দিয়ে সিড়ি চলে গিয়েছে দোতলায়।তিনতলায় যাবার জন্য আছে প্যাচানো কালো কাঠের সিড়ি।কি দারুণ!প্রথম তলায় বেশ কয়েকটা ঘর।দ্বিতীয় তলায়ও সমসংখ্যক ঘর রয়েছে।তৃতীয় তলায় তার চেয়ে কম কামরা।কুহেলীর মনে হলো আম্মা একটা কথা বলতো, ‘ বাইরে দিয়া সদর ঘাট,ভেতর দিয়া ফিটফাট ‘। মিলে গেছে বাড়িটার সাথে।ভেতরে ঢুকেই ছোট্ট বাগানের মতো।কি কি গাছ আছে তাড়াহুড়োতে বুঝতে পারেনি কুহেলী।বাড়িটা ভালো লেগেছে কুহেলীর।
জহির আহমেদের পাশে দাড়িয়ে আছে তার স্ত্রী আনরুবা।তারপাশে দুটো মেয়ে।ওদের নাম সম্ভবত নয়না আর সেযুঁথি।একটু আগে আনরুবা ডাকছিল তাদের,শুনেছে কুহেলী।নয়না আর সেযুঁথির চেহার প্রায় একই রকম দেখতে।তাদের পাশে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে খুনশুটিতে ব্যস্ত নয়নার সাথে।কুহেলীর অবচেতন মন ঠিক করে নিল এরা সমারোহ’র ভাই বোন।
তাদের পাশে চোখ যেতেই দৃষ্টি আটকে যায় কুহেলীর।মুগ্ধ নয়নে কিছু কালক্ষণ চুপিচুপি সে দেখে নেয় সমারোহকে।এই প্রথম কোনো ছেলে মুগ্ধ হয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে।মানুষটাকে তার শীতল রক্তের মানুষ মনে হয়।একজন পুরুষ মানুষ এতোটা গোছালো,সুন্দর হতে পারে!উজ্জ্বল গায়ের রং।বাঁকা ধনুকের মতো হাসিতে মত্ত আখিঁযুগল,তীরের ফলার মতো সরু নাক,ওষ্ঠদ্বয় গাঢ় গোলাপী।যেন লিপষ্টিক মাখানো।চোখের চিকন ফ্রেমের চশমা লোকটাকে একদম স্নিগ্ধ রূপ দিয়েছে।কুহেলীর মনে হলো সমারোহের চেহারায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে হাসলে দু’পার্শ্বের গালে সৃষ্টি হওয়া বিশাল গর্ত আর হাসলে ভ্যাম্পায়ারের মতো উঁকি দেয়া গেজ দাঁত।তবে আরো বেশি আকর্ষণীয় হলো সমারোহ’র গলার স্পষ্ট নীল শিরাগুলো।কুহেলীকে বেশ মুগ্ধ করে তুলে এই মানুষটি।
মুচকি হেসে কুহেলী দেখছে সমারোহকে।তখনি সমারোহও তাকালো কুহেলীর দিকে।হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে যাওয়াতে বেশি রকম অস্বস্তিতে পড়তে হলো কুহেলীর।ভয়ে লজ্জায় দ্রুত চোখ নামিয়ে কাঁপতে লাগলো সে।নিজের লজ্জা অনেক কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেও লাভ হলো না বিশেষ।অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে গেলে প্রচন্ড রকম কাঁপুনি ধরে কুহেলীর দেহে।
সমারোহ মুচকি হেসে চোখ সরিয়ে নেয়।আনরুবা কুহেলীর কাছে এসে দাঁড়ায়।কুহেলীর চিবুকে হাত রেখে বলে,
‘কত্তো মিষ্টি তোমার মুকখানি মা।এখন থেইকা আমি আরেকটা মেয়ে পাইলাম ।আমার এখন চারটা মেয়ে।ওদের তো চিনছোই।ও হইলো নয়না,সেযুঁথি,সান্দ্র আর সমারোহ।’
পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় কুহেলী আরেক পলক দেখলো সমারোহকে।সমারোহ তখনো হাসছে।অদ্ভুত!কতো হাসে একটা মানুষ।তবে সুন্দর ছেলেদের বেশি হাসান উচিত নয় বলে মনে করে কুহেলী।
সমারোহর ঘনঘন হাসি চোখে পড়লো সান্দ্রও। সান্দ্র সমারোহ’র পেটে চিমটি কেটে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘কিরে ভাই,প্রেমে পড়লি নি?এতো মুচকি হাসোস কেন পিচ্চি মাইয়াটারে দেইখ্খা।’
সমারোহ ভ্রুঁক্রুটি করে তাকায় সান্দ্রের দিকে।চোখ গরম করে বলে,
‘আজাইরা কথা বলবি না বেয়াদব ছেলে।চুপ থাক নইলে থাপ্পড় একটাও মিস হবে না।’
সান্দ্র এবার একটু আওয়াজ তুলে হেসে ফেলে।আনরুবা সেদিকে খেয়াল রাখেন না। তিনি বলেই চলেন,
‘আমার বড় মেয়ে সারিকা আমেরিকাতে থাকে।বিয়ে হয়ে গেছে সেখানেই।তুমি এদের সবকয়টার থেকে ছোট।আমার ছোট মেয়ে এখন থেকে।সবাই গল্প করুক।তুমি আমার সাথে আসো।তোমার জন্য ঘর গুছিয়ে রাখছি আমি নিজেই।গোসল করে ফেলবা আসো।’
কুহেলী বাধ্যের মতো আনরুবার কথা শুনে।দেখতে যেমন চমৎকার তেমন হাসিতেও মত্তো মহিলা তিনি।নিজের লাগেজ আর ব্যাগপত্র নিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই আনরুবা চকিতে বলে ওঠেন,
‘আরে আরে কি করছো?ওগুলো ওইখানেই ছাড়ো। তোমাকে নিতে হবে না।সান্দ্র ঘর অবদি দিয়ে আসবে।তুমি নিতে পাড়বে না,সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠতে হবে।’
সান্দ্র দুষ্টু হাসি মেখে দ্রুত বলে,
‘আম্মা আমি না,সমারোহ দিয়ে আসবে।’
‘আচ্ছা দিয়া যা।’, আনরুবা বলেন।
সমারোহ’র কথা শুনে কাচুমাচু হয়ে যায় কুহেলী।ধীর কাঁপা সুরে বলে, ‘আমি পারবো।আমি নেই?’
সমারোহ পুরুষালী কন্ঠে বলে,
‘না।আম্মা তুমি ওকে নিয়ে ঘরে যাও।আমি দিয়ে আসছি।’
তারপর সান্দ্রকে রাগী চোখে দেখে চুপিসারে বলে,
‘তোরে আমি পরে দেখতেছি শালা।’
গোসল,খাওয়া-দাওয়া শেষে বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রয়েছে কুহেলী।বেশ ঠান্ডা এই ঘরে।তবে বিছানার আশেপাশে কম্বল ছিল না।দু’তলাতে কুহেলীর ঘর।আনরুবা আর জহিরের ঘর নিচে।সারিকা আপু আসলেও নিচেই থাকেন বিয়ের পর থেকে আর কয়টা গেস্টরুম।বিয়ের আগে এটা সারিকা আপুর ঘরে ছিল।দড়জার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে কুহেলীর ঘরের ঠিক বাম দিকে নয়না আর সেযুঁথির ঘর।ডানে ছোট্ট লাইব্রেরি তার পাশে সমারোহের ঘর।আর তার পাশে সান্দ্রের।
শুয়ে শুয়ে ঘরের আসবাবপত্রে চোখ বুলাচ্ছে কুহেলী।বাড়ির প্রত্যেকটা আসবাবে সৌখিনতার ছাপ সুস্পষ্ট।যা একজন অপরিচিতাকে সহজেই মুগ্ধ করতে পারবে।ঘরে বেলকনি নেই।তবে পূর্বে পরপর দুটো বিশাল কাঠের জানালা।জানালায় পাকা করা দেয়ালে আরামে বসে থাকা যাবে।সামনে দু’চারটে ফুলের টব।হঠাৎ দরজায় কড়া আওয়াজে ওঠে বসে কুহেলী।গায়ে সুতি উড়না শালের মতো জড়িয়ে ওঠে দরজা খুলে সমারোহকে দেখে আরেক দফা চমকে ওঠে।হাত পায়ে মৃদু কাঁপুনি ধরে। সমারোহ ঠোঁটে পরিচিত হাঁসি ফুটিয়ে বলে,’আসবো?’
কুহেলীর তখন খেয়াল হয় সে একদম দরজার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।দ্রুত সরে গিয়ে বলল,
‘অবশ্যই। আসুন।’
‘নাহ, এখন ইচ্ছা নেই।’
কুহেলী হা হয়ে যায়।এ কেমন কথা।মাত্রই তো আসতে চাইলো আর এখনি ইচ্ছা শেষ!কুহেলী বোকার মতো বলে ফেলল,’কেনো?’
কুহেলীর বলার ধরন দেখে হেসে ফেললো সমারোহ।সাদা ভারী একটা কম্বল এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘এটা দিতে এসেছি।জায়গাটা পাহাড়ের কাছে।রাতে শীত পড়বে ভীষণ।আম্মা ভুল করে দিতে ভুলে গিয়েছিল।আর কোন কিছুর দরকার পড়লে আম্মাকে বলবা।রাতে ভয় পেলে বা সমস্যা হলে নয়না বা সেযুঁথিকে বলবে।আমাকেও বলতে পারো।খোর্শেদ আঙ্কেল আব্বার সাথে একটু বের হয়েছে।আসি।রেস্ট নাও।’
সমারোহ যেতেই দরজা আটকে দিল কুহেলী।যেন ওর যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল।লোকটার সামনে দম আটকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কুহেলীর।কি ভয়ংকর ব্যাপার স্যাপার।কোন ছেলের সাথে মেলামেশা করেনি বলে এমনটা হয় তার?নাকি অন্য কারণ!
রাতে খোর্শেদ বাড়ি ফিরে কিছু সময় কাটালো মেয়ের সাথে।খাওয়া দাওয়ার পাট চুকে গেলে সকলে ছাদে বসে আড্ডা জমালো।রূপোর থালার মতো বিশাল দেহী চাঁদ উঠেছে আজ আকাশে পূর্ণিমার রাত।ঘন কালো রাতের আকাশে কুয়াশা মিশ্রিত চাঁদ যেন একটুকরো আঁধার লুকোনোর খেলা।অথবা ক্লান্ত পথিককে পথ দেখানোর জন্য একরাশ জোনাকির মেলা!জহির,খোর্শেদ আর আনরুবা পাটি বিছিয়ে একসাথে বসে খোশ গল্প জুড়েছে।সেযুঁথির কিছু পড়া শেষ হয়নি বলে পড়ছে।নয়না আর কুহেলী রেলিংএ বসে গল্প করছে।আর সান্দ্র আর সমারোহ ছাদের অপর পাশে রেলিং এর ধারে দাড়িয়ে।নয়না হঠাৎ করেই কুহেলীকে বলে,
‘এই তুমি প্রেম করো কুহেলী?’
অসময়ে নয়নার এই প্রশ্ন ঘাবড়ে যায় কুহেলী। ‘মানে?’
‘মানে তোমার প্রেমিক আছে প্রেমিক?আই মিন বয়ফ্রেন্ড।’
কুহেলী মাথা দ্রুত পদক্ষেপে ডানে-বামে নারিয়ে বুঝায় না,তার নেই।নয়না ব্যাপক সন্দেহ নিয়ে তাঁকায় কুহেলীর দিকে।তারপর ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে বসে বলে,
‘তাহলে তোমার জীবনটাই পান্তা ভাত।কাঁচা মরিচ আর পিঁয়াজ ছাড়া কিছুই নাই।আমরা কিন্তু বিরিয়ানি।’
কুহেলী নয়নার কথায় হা হা করে হেঁসে ওঠে।বলে,
‘তবে একজনকে ভালোলেগেছে আপু।’
নয়না তিনগুন আগ্রহ নিয়ে কুহেলীর দিকে তাকিয়ে বলে,
‘কে কে কে?তাড়াতাড়ি বলো।’
লজ্জায় কুহেলীর মুখ লাল হয়ে যায়।বলে,
‘আরে এটা ভালোবাসা না।আর যাকে করি সে আমাকে করে না।তাই ছাড়ো।তোমার কথা বলো।কার সাথে করো প্রেম?আমি দেখবো তাকে।’
‘আরে না না।এখন দেখাবো না পরে।তবে তুমি ঠিক করছো না।আরে ভাই আমাকে বলো আমি ভালোলাগা ভালোবাসা বানায় দিমু।হা হা হা।’
কুহেলীও উচ্চস্বরে হেসে ওঠে নয়নার কথায়।সান্দ্র কুহেলীকে হাসতে দেখে বুকে হাত দিয়ে নায়কের ভঙ্গিমায় সমারোহকে বললো,
‘ভাই দেখ,কি সুন্দর হাসি মেয়েটার।সামনের দাঁতগুলো বাঁকা-তেড়া।ঠোঁটের পাশে হালকা টোল,ছলছলে চোখ।প্রেমে পইড়া যা,ভাই প্রেমে পইড়া যা।’
সমারোহ গিটারের নষ্ট হয়ে যাওয়া স্ট্রিং ঠিক করছিল।সান্দ্রের কথায় একপলক দেখে কুহেলীকে।মেয়েটা সত্যিই রূপবতী।মাধুর্য্যময় তার হাসি।হাজারো জোনাকি পোকারা যেন তাদের সৌন্দর্য উৎসর্গ করেছে তাকে।মাদকতা মেশানো কোমর ছাড়ানো চুল ওড়নায় ঢাকা পড়ে আছে।।কুহেলী থেকে চোখ সরিয়ে সান্দ্রের দিকে ফিরে ঠাস করে মাথায় চাটি মেরে বললো,
‘আমি যে তোর বড় মনে আছে তোর?’
‘হোহ!বেশ মনে আছে।আট মাসের বড়।’
‘তো রেসপেক্ট কর।আর তোর এতো ভাল্লাগলে তুই কর প্রেম,তুই কর।’
‘আরে ভাই কি কস।আমার মাইশু আছে।প্রেম তো দূরের কথা,কইসে অন্য মেয়ের দিকে তাকাইলেও চোখ দুইটা ফালায় দিব।তুই সিঙ্গেল আছস করতে পারস প্রেম।’
‘আরেকবার এই কথা বলবি তো দেখিস আমি মাইশারে বইলা দিমু তুই সিগারেট খাস।’
‘এসব ঠিক না ভাই।ওইটা তো মাঝে মধ্যে খাই আরকি।যাহ,আর বলবো না।তাইলে তুই …।’
মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠলো সান্দ্রের।ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দু’বার মাথা চাপড়ালো।তারপর বললো,
‘নিশ্চয়ই আবার বকাঝকা করতে ফোন দিল।আজ সারাদিন কথা বলিনাই।সেই ফুলে আছে।যাই বাঘের খাঁচায় ঢুকে বাঘের রাগ ভাঙ্গাই।’
সমারোহ হাসতে হাসতে বললো,
‘এই কারণেই প্রেম করা উচিত না।আমি বুঝি প্রেমের প্যারা কি জিনিস!’
কানে ইয়ারফোন গুজে রেলিংএ ওঠে বসে সমারোহ।গায়ে হলুদ টি-শার্ট আর থ্রিকোয়ার্টার পেন্ট।রবীন্দ্রনাথের গান এই পরিবেশের সাথে পার্ফেক্ট।পাশে তাকিয়ে দেখে কুহেলীও একাকি দাড়িয়ে আছে।সমারোহ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছু একটা ভাবলো।তারপর পাতলা গলায় ডাকলো কুহেলীকে।
‘পিচ্ছি,এদিকে এসো।’
কুহেলী সমারোহের কথা শুনে সচকিত হয়ে তাকালো।তারপর আশেপাশে দেখলো কেউ নেই।চিন্তিত সুরে বললো, ‘আমাকে ডাকছেন?’
‘জি তোমাকেই।’
কুহেলী চুপচাপ গিয়ে দাড়ালো সমারোহের পাশে।
‘তা কেমন লাগছে আমাদের বাড়ি?’
‘ভালো।এখানের প্রত্যেকটা মানুষ খুব ভালো।’
‘একা কেন?নয়না কোথায়?’
‘ফোনে কথা বলছে।’
‘এই এক প্রবলেম।প্রেম করতে করতে সবগুলো প্রেম মাষ্টার হয়ে যাচছে আর সিম কোম্পানির মালিক সব কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে।যাই হোক, বাড়ির পেছন দিকে পাহাড় আছে দেখেছো?অবশ্য অনেকটা দূরে।’
কুহেলী চকিতে পেছন ফিরে দেখলো।কুয়াশা আর অন্ধকারের জন্য কিছু বোঝা যাচ্ছে না।কুন্ঠিত স্বরে বলে,
‘মিস করে গেছি।’
‘হুম।কাল ভোরে এসো।দেখবে কতটা সুন্দর।’
‘আচ্ছা!আপনাদের জন্য কত ভালো তাইনা পাহাড় দেখতে যেতে হয়না।বাড়িতেই আছে।’
‘হো হো হো।তোমাকে নিয়ে যাব একদিন হাটতে।যাবে তো?’
কুহেলী সলজ্জিত হয়ে বলে,
‘আচ্ছা।যাব।’
‘পড়ালেখা মন দিয়ে করতে হবে কিন্তু।চান্স পেয়েছো বলেই কিন্তু ভাবা যাবে না ডাক্তার হয়ে গেছ।বাংলাদেশে কিন্তু এমন অনেকই আছে যারা মেডিক্যালে চান্স পায় ঠিকই কিন্তু গাফলতির জন্য ভালো ডাক্তার হতে পারে না।থার্ড সেমিস্টার পাশ আর করতে পারে না।তাই মন দিয়ে পড়বে।’
কুহেলী মাথা কাত করে সায় দেয়।সমারোহ মিষ্টি করে হাসে।কুহেলী ভেতরে ভেতরে এই প্রথম খুন হয় কোন ছেলের হাসিতে।সমারোহ রেলিং থেকে নেমে নিচে চলে আসে।
ফজর আজান কানে বাজতেই জেগে ওঠে কুহেলী।দরজায় সেযুঁথি ডাকছে কুহেলীকে।কুহেলী ওঠে উড়না ছাড়াই দরজা খুলে।
‘কিছু বলবে আপু?’
‘ফজর নামাজ পড়তে ডাকছিলাম।বাড়িতে সবাই সকালে ওঠে নামাজ পড়ে ফেলে।তুমিও পড়ো।’
কুহেলী মাথা ডানে হেলিয়ে মুচকি হেসে বলে,
‘আমি ওঠে পড়েছি নামাজ তারপর শুয়েছিলাম।চোখ লেগে গিয়েছিল।’
‘ওফ!সরি সরি।একদম বুঝিনি।তুমি ঘুমাও তাহলে।’
‘এখন আর ঘুমাবো না।ছাদে যাবো।চাবিটা দিবে ছাদের?’
‘চাবি লাগবে না।আমাদের ছাদ খোলাই থাকে সবসময়।যাও।’
‘আচ্ছা।তুমি যাবে?’
সেযুঁথি এক মুহূর্ত ভেবে বলে,
‘হুম যেতে তো পারি তবে কফি সমেত।তুমি যাও আমি নিয়ে আসছি।’
সেযুঁথি চলে যায়।কুহেলী ব্যাগ থেকে মোটা চাদর গায়ে জড়িয়ে ছাদে চলে আসে।ছাদে পা বাড়ানোর সাথে সাথেই আবার লজ্জিত হয়ে উল্টো পথে নিচে চলে আসতে নেয়।পেছন থেকে ধেঁয়ে আসা একটা কড়া আওয়াজ ওর শরীরে শিহরণ জুগিয়ে থামিয়ে দেয় ওকে।
‘যাচ্ছো কেনো?এসো ছাদে।পাহাড় দেখবে না?হাওয়া কিন্তু এখন একদম ফ্রেশ।’
সমারোহ কুহেলীর আগে থেকেই ছাদে ছিল।রোজ ভোরের আলো ফুটতেই বই নিয়ে ছাদে এসে টুকটাক পড়ালেখা করা সমারোহর অভ্যাস।এতে মন শরীর ফুরফুরে থাকে সারাদিন।ভোরের সৌন্দর্য একবার নিজের ভেতর পুড়ে নিতে পারলেই মন ভালো করার টনিক পাওয়া যায়।সমারোহ হাঁটতে হাঁটতে রেলিঙের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে,
‘নামাজ পড়া হলো?’
‘জি।’
কুহেলী পাহাড়ের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়।কুয়াশার চাদরে মোড়ানো সবুজাভ স্তম্ভগুলো খুব সহজেই মন কেড়ে নেয় কুহেলীর।বাসা থেকে পাহাড়ের দূরত্ব কম নয় তবে এই মুহূর্তের জন্য কুহেলীর ইচ্ছা করছে দৌড়ে চলে যেতে সেখানে।এর আগে এতো কাছ থেকে পাহাড় দেখা হয়নি।ঘুরাঘুরি খুব করা হতো,বলতে গেলে হতোই না।আর সেখানে এমন নয়নাভিরাম জায়গায় সে থাকছে!যখন খুশি দেখা যাবে।কুহেলী মনে মনে ভেবেই নেয় হলে থাকাকালীন বর্ষাকালে একবার আসবে এই বাড়িতে।এখন পাহাড় কুয়াশার আঁচলে লুকিয়ে,তখনের দৃশ্য নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হবে!
কুহেলীকে মুগ্ধ হতে দেখে খুশি হয় সমারোহ।কোথায় যেন মেশেটার প্রতি একটা ভালোলাগা সৃষ্টি হয়।সমারোহ দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘বুঝলে কুহেলী,মানুষ খুব আজব প্রাণী।কেউ অল্পতেই খুব খুশি।আবার কারোর জন্য পুরো দুনিয়াটা এনে দিলেও সন্তুষ্টি পায়না।’
এতো গভীর কথা শুনে কুহেলী বিচলিত হয়।সমারোহ বেশ কষ্ট নিয়ে বলেছে কথাটা।সমারোহর চেহারায় বাস্তববাদি মানুষের একটা ছাপ আছে যা তার কথাগুলোর সাথে মানানসই।ব্যাপারটা ভালোলাগে তার।
নয়না ছাদে এসে কুহেলীকে কফি দেয়।সমারোহ আগেই কফি খেয়ে নিয়েছে।নয়না আসাতে বইপত্র নিয়ে নিচে চলে যায়।কুহেলী আর নয়না কিছুটা সময় আড্ডা দিয়ে কাটায়।ধীরে ধীরে ডিমের কুসুমের মতো নমনীয় হলুদ সূর্য উঁকি দেয় আকাশে।সোনালী কিরণ গিয়ে পড়ে পাহাড়ের চূড়ায়।ঝলমল করে উঠে চারিদিক।রাতে যেমনটা ভেবেছিল তার থেকে হাজার হাজার গুন বেশি সুন্দর পরিবেশটা।কুহেলীর মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে আসে, ‘মাশা-আল্লাহ।’
নয়না হেসে বলে,
‘বসন্তে আরো সুন্দর লাগে।আর কদিন পরই তো বসন্ত আসবে।’
কুহেলী বলে,
‘এতো আগে সূর্য উঠলো!’
‘সমুদ্রের কাছে তো,এখানেও শীতকালেও সূর্য তাড়াতাড়ি উঠে।দুপুরে আবার গরম ও লাগে মাঝেমধ্যে।রাতে শীত বাড়ে।সবে তো শীতের শুরু।সামনে আরো তো বাড়বে।’
‘তোমার শীত ভালোলাগে?’
‘খুব।’
‘আমার কিন্তু বর্ষা প্রিয়।’
নয়না নাক ছিটকে ওঠে।স্তম্ভিত হয়ে বলে,
‘বৃষ্টি বিরক্তিকর শহরে।রাস্তাঘাটের যা অবস্থা হয়!আমার কলেজের সামনে তো রাস্তায় ময়লা পানিই জমে যায়।’
কুহেলী হেসে ওঠে নয়নার কথায়।গল্প করতে করতে আটটা বেজে যায়।নিচ থেকে আনরুবার ডাক পরে।সবাইকে খেতে ডাকছেন তিনি।
চলবে.
আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৩.
বুক ফেটে অশ্রুর স্রোতধারা বইতে চাইছে।আবদ্ধ ঘরে প্রায় একঘন্টা যাবৎ কেঁদেই যাচ্ছে কুহেলী।নিচে আনরুবা অস্বস্তিতে পাইচারি করছে আর বারবার কুহেলীর ঘরের দিকে তাকাচ্ছে।মেয়েটার দেখি বের হওয়ার নামই না!আর কতো সময় পায়চারি করা যায়?ভিতরে ভিতরে ভয়ও হচ্ছে এবার।আনরুবা আর থাকতে না পেরে বলা শুরু করেন,
‘আরে বাবা গেছে বুঝলাম।কিন্ত আমরা তো আছি না?এতো কাঁদতে হবে কেন?কি করি আমি এই মেয়েরে নিয়ে খোদা জানে।পুতুলের মতো মেয়েটা কাঁদলে ভালো লাগে?ওর কান্না থামাই কেমনে?’
আনরুবার চেঁচামেচিতে সমারোহ আর সান্দ্র বসার ঘরে আসে।আনরুবা ছেলেদের দেখে বলে,
‘বাবা যা না।মেয়েটারে ঘর থেকে বাহিট করে আন।’
‘এখনো কাঁদছে?’ সমারোহ বলে।
‘জি। কেঁদে বন্যা বানিয়ে ফেলতেছে। মুখখানি ছোট হয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে।’
আনরুবার কথা শুনে সমারোহ একবার উপরে কুহেলীর ঘরটা দেখে।সান্দ্র গিয়ে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে নিচে নিয়ে আসে তাকে।অনেক জোর করে সকালের খাবার খাওয়ায়।কুহেলীর মুখ জুড়ে সারাদিন নেমে থাকে ঘন কালো মেঘের ছায়া,ভয়ংকর আষাঢ়।বিকেল বেলা আনরুবা এসে জোর করে বাহিরে নিয়ে যায়।একসাথে হাঁটতে।জায়গাটা মনোরম।কিছুটা গ্রামের ছোঁয়া আছে।তবে গ্রাম বলা চলে না।আবার শহরও না।হাঁটতে এসে মনের বিষন্নতা প্রায় খানিকটাই কেটে ওঠেছে কুহেলীর।আধঘন্টা পর আনরুবা হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে ওঠেন।কুহেলী দুই হাতে আনরুবার হাত চেঁপে ধরে।আনরুবা আরেক হাত কোমরে রেখে বললেন,
‘কোমরের ব্যথাটা কমতেই হাটুরটা বেড়ে যায়।একটু বসতে হবে এখন।’
কুহেলী আশেপাশে তাকিয়ে দেখে দশ-বারো কদম সামনেই একটা ছোট্ট পার্কের মতো জায়গা আছে।কয়েকটা ছোট বাচ্চা সেখানে কানামাছি খেলছে।বাশের বেড়া দিয়ে ঘেরা পার্কটা।কুহেলী বেশ প্রফুল্ল হয়ে বলে,
‘আন্টি ওইখানে চলুন।নদী আছে,বাতাসও আসবে।বসতে পারবেন।’
আনরুবা চমকে তাকালেন কুহেলীর দিকে।তারপর কি একটা ভেবে যেন চোখ দু’খানা নরম,সিক্ত হয়ে গেল তার।পার্কের দিকে উদাসীনভাবে মিনিট পাঁচেক চেয়ে থেকে বললো,
‘এখানে বসার চেয়ে দশ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে ব্যথায় মরা ভালো।বাসায় যাব চলো।’
কুহেলী খানিক চমকালো।কেন যেন অদ্ভুত ঠেঁকলো তার কাছে আনরুবার কথা।তারপরও নাছোড়বান্দা হয়ে বললো,
‘না চলুন বসবেন।এখনো হাটলে পায়ে প্রেশার পরবে বেশি।অসুস্থ হয়ে যাবেন আরো।’
আনরুবা আর কিছু বলেননি।চুপচাপ কুহেলীর সাহায্যে গিয়ে বসেন নদীর পাশের বেঞ্চিতে।কুহেলী আনরুবার পাশে বসে হাজারো কথা বলে।কিছু সময় পর খেয়াল করে আনরুবা কোন কথাই বলছেন না।মুখটা শুকনো।বিষাদ মাখা চাহনি নদীর পানিতে স্থির।শ্বাস নিতে যেন বড্ড কষ্ট হচ্ছে আনরুবার।কুহেলী নিচুস্বরে বলে,
‘আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে?’
‘না।আমাকে আর কখনো এখানে আসতে বলবে না।নিজেও আসবে না।কিছু কিছু স্মৃতি একটা পরিপূর্ণ মানুষকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে চায়।সামলে নিতে হয় তার আগেই।নিজেকে ভালো রাখার জন্য কিছু সৌন্দর্য ত্যাগ করাই উত্তম।’
আনরুবা সূক্ষ পায়ের ছাপে দ্রুত বের হয়ে গেলেন পার্ক থেকে।যেন কিছু অস্বস্তিকর অদৃশ্য কিছু তাকে ঘিরে গিলে ফেলতে চাইছে।কুহেলী অবাক হয়ে জায়গাটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে চলে আসে আনরুবার পিছু পিছু।
–
শীত যেন খানিকটা বেশিই মাতিয়ে তুলেছে হাওয়া।ভারী সোয়েটার পড়ে তার উপর ভারী কালো শাল জড়িয়েছে কুহেলী।উদ্দেশ্য ছাদে যাওয়া।একবার ভাবলো গিয়ে কি হবে,সবই তো কুয়াশা। আবার ভাবলো যাবে।কুয়াশা হলে তাতেই যাবে।গিয়ে কুঞ্জার চিঠিটার উত্তর লিখবে।রাতের ট্রেন ধরে ভালোভাবেই বাড়ি পৌঁছেছে খোর্শেদ।সকালে কুহেলীর সাথে কথা হয়েছে।কুঞ্জা মোবাইল নিয়ে সে কি কান্না!কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে ওঠে বারবার বলছিল,
‘আপা গো,আম্মা আর মারবে না।তুমি বাড়ি চলে আসো।আমার ভালোলাগেনা তোমাকে ছাড়া।’
কুহেলী অনেক কষ্টে তাকে বুঝ দিয়ে বলে,
‘কাঁদে না সোনা বোন, আমি আসবো তো ক’দিন পরই আসবো।এতোদূর আসলাম একটু বিশ্রাম নিতে হবে না?নাহলে তো অসুস্থ হয়ে যাব।তুমি সেটা চাও?’
‘আব্বা আসলো কেমনে?’
‘আব্বার গায়ে তো অনেক শক্তি।যেমন আব্বা তো গাছে ওঠতে পারে।তুমি পারো?’
‘আচ্ছা,মনে রাখলাম কয়দিন পরে আসবা।আমার চিঠিটা পড়ছো?’
‘এই যা একদম ভুলে গেছি।কান ধরলাম।এক্ষুনি পড়ে ফেলবো।’
কুঞ্জা কান্না থামিয়ে গাল ফুলিয়ে বলে, ‘আমাকেও পাঠাবা।তাড়াতাড়ি যেন পাই।’
‘আচ্ছা,এবার আম্মাকে দে।’
হাসনাহেনার ফোনে কথার বলার অভ্যাস নেই।কিন্তু মোবাইল কানে ঠেকিয়ে যখন কুহেলীর কন্ঠ শোনামাত্র হুড়হুড় করে কেঁদে ওঠেন।কুহেলীও কান্না করে।বলে, ‘কেমন আছো আম্মা? ‘
‘ভালো,তুই?খাবার ঠিকঠাক মতো খাস?ওখানে সবাই অনেক ভালো না!’
‘হ্যাঁ আম্মা সবাই ভালো।আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।পাঁচ কি ছ’দিন পর যাবো ভর্তি হতে।কিছু জামা-কাপড়,ইউনিফর্ম আর বই কিনতে হবে।আব্বা টাকা দিয়ে গেছেন।আমি এই বছরের মধ্যেই কয়েকটা টিউশনি নিয়ে ফেলবো দেখো।তারপর আব্বার আর টাকা পাঠাতে হবে না।পারলে আমিও পাঠাবো টাকা।’
হাসনাহেনা মুচকি হাসেন মেয়ের কথা শুনে।এই প্রথম পড়তে এতো দূর গিয়েই নিজেকে বড় মনে করতে শুরু করেছে।কি কান্ড!হাসতে হাসতে তিনি বলেন,
‘অতো চিন্তা তোমার না বুঝলা!এখন আগে পড়ায় মন দাও।পড়ো শহরটা চিনো,মানুষ চিনো তারপর টিউশন।এই কয়েকদিন কষ্ট করে হলেও তোমার আব্বাই টাকা পাঠাবে।মনে একবার টাকার চিন্তা ডুকলে পরে আর পড়া হবে না।’
‘আচ্ছা।’
‘টিউশনি নিবা সামনের বছর,তাও মানুষ যাচাই করে নিবা।কম টাকাতে ভালো মানুষের কাছে পড়াতে গেলেও চিন্তা নাই।আর টাকা পাঠাতে হবেনা।নিজের হাত খরচ চলে এমন হলেই হবে।ঠিক মতো থাইকো।’
‘তুমি এতো চিন্তা করো না তো।আব্বা জার্নি করে গেছে।খেয়াল রাইখো।রাখি পরে ফোন দিব।আসসালামু আলাইকুম।’
‘আচ্ছা।অলাইকুম আসসালাম।’
তখনি চিঠিটা পড়ে নিয়েছে কুহেলী।কি পাকা পাকা কথা মেয়ের,বলে কিনা বকলে কুঞ্জাকেও যেন নিয়ে আসে!আম্মা তাকে আচার খেতে দেয়নি বলে সে রাগ করেছে।তাকে ফেলে অন্য কাউকে যেন আদর না দেয়!আরো কতো কি!কুহেলী হেঁসে কুটিকুটি হয়ে গিয়েছিল চিঠি পড়ে।
সাত দিন হয়েছে এই বাড়িতে এসেছে কুহেলী।তবে বাগানটা ঘুরে দেখা হয়নি।বাগান এবং বাড়ির চারদিকে শক্ত রঙ-বেরঙের কাঠের তক্তা দিয়ে ঘেরা।এটা বাড়ির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে আরো।কতো কতো গাছ সেখানে।বড় বড় ফুল গাছ আছে অনেক,তবে শাক-সবজিই বেশি।বাগানের কর্ণার ঘেঁষে ডানে বামে চারপাশে কয়েকটা কৃষ্ণচূড়া,জারুল আর হাসনাহেনা ফুলের গাছ, আর একটু সামনে দিকে একটা বকুল আর শিউলি!কয়েক রঙের গোলাপ আরো অনেক গাছ।সমারোহ লাগিয়েছে সব।যত্নও করে নিজেই।আর ফুল ছিড়ে সান্দ্র।ছিড়ে মাইশাকে নিয়ে উপহার দেয়।কুহেলী কতক শিউলি ফুল কুড়িয়ে নেয় মাটি থেকে।টাটকা তাজা সুভাষে মোহ লাগে হৃদয়ে।শিশির ভেজা একটা টকটকে লাল গোলাপ নিয়েও গেঁথে নেয় খোপায়।কিছুক্ষণ বাগানে হেটে আটটার আগেই ঘরে চলে এলো কুহেলী।আনরুবার কড়া রুলস রয়েছে ন’টার পর কেউ খাবার পাবে না।খাবার শেষে সকলে টুকটাক কথা বললো।সামনের মাসের এক তারিখ থেকেই কুহেলীর ক্লাস।ভর্তির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে।
ঘরের ভেতর ডুকেই সমারোহের সামনে পরে যায় কুহেলী।সমারোহ সামান্য ভ্রুকুঞ্চন করে দেখে কুহেলীকে।মিষ্টি লাগছে মেয়েটাকে।যতবারই দেখে কেমন যেন একটা অনুভূতির সাথে সংঘর্ষ হয়।কোন আকর্ষণে যেন সমারোহর মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে,
‘তোমার মাদকতা মেশানো চুলের ভাঁজে গোলাপের চেয়ে জারুল বেশি শোভা ছড়াবে প্রিয়।’
কুহেলীর মুখখানি লজ্জায় লাল হয়ে যায় সমারোহর কথা শুনে।মাথা হেট করে দাঁড়িয়ে থাকে কুহেলী।কান গরম হয়ে আসে যেন।সমারোহ নিজেই চমকে যায়।কাকে কি বলছে সে।কুহেলী পাশ কাটিয়ে চলে গেলে বেশ ইতস্ততবিক্ষিপ্ত করে মনে মনে।
খাওয়া শেষে সমারোহ টেবিল ছেড়ে ওঠতে নিলেই জহির তাকে শান্ত কন্ঠে বলেন,
‘আব্বা বসো।কথা আছে।’
সমারোহ কিছুটা আগ্রহ নিয়ে বসে পড়লো আবার।বলে,
‘কোন কিছু জরুরি আব্বা?তোমার সব ঔষুধ গুলো আছে?নাকি আনতে হবে?’
‘সেই সব না।কুহেলীর তো ভর্তি চলছে।তুমি কাল হসপিটালে যাওয়ার সময় ওকে নিয়ে যাবা।’
সমারোহ এক পলক দেখলো কুহেলীকে।মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে।সমারোহর মুখ কালো হয়ে যায়।সমারোহ বাবার দিকে আবার ফিরে বললো,
‘আব্বা কালকে আমার ডিউটি তো তিনটা থেকে।তখন অফিসে ভর্তির কাজ চলবে না।এরচেয়ে বরং সান্দ্র নিয়ে যাক?’
কুহেলী এবার একটু নড়ে চড়ে বসলো।লোকটা হসপিটালে যাবে ডিউটি করতে?তাহলে সে কি ডাক্তার?ওফ!এই লোকটা ডাক্তার?যাকে পছন্দ করে তার পেশাটাই জানতো না সে! ছিঃ ছিঃ!
মনে মনে নিজেকে শত ধিক্কারে লাঞ্ছিত করে কুহেলী।কি মোটা মাথা তার!তবে এই লোকটা ডাক্তার হিসাবে তো একদম পার্ফেক্ট।গম্ভীর মুখশ্রী,সুঠাম দেহ।তবে একটা জিনিস কুহেলীর ছোট খুলির ছোট্ট ব্রেইনে আটছে না।
লোকটা কি মানুষ সুস্থ করে?নাকি তার রূপে মেয়ে পেশেন্টরা আবার হার্ট অ্যাটাক না করে বসে।কুহেলীর তো একটুর জন্য করতে করতেই হলো না।রোগীরা নিঃশ্চয়ই করে।কি ডেঞ্জারাস ডক্টর!
সানন্দে বসে বসে আপেল জুস খাচ্ছিল সান্দ্র।সমারোহর কথা শুনে শব্দ করে কেশে ওঠলো সে।আনরুবা দ্রুত গিয়ে ছেলের মাথায়-পিঠে জোরে জোরে চাপড় দিতে লাগলেন।
‘এভাবে কেউ খায়?কত্তোবার বলছি খাবার খেতে হয় আস্তে আস্তে।এমনে তাড়াহুড়া করলে দম আটকে যাবে যে।’
নয়না পানি এগিয়ে দিল।রুদ্ধশ্বাস ঢকঢক করে পানি গিলে সান্দ্র জোরে একটু শ্বাস নিল।তারপর বললো,
‘আমার কালকে অনেক কাজ আছে।তুই নিয়ে যাবি পুচকিকে।’
‘কি কাজ বল?শোন কাল যে তোর ডিউটি নেই আর হসপিটালে যেতেও হবে না তা আমি ভালো করে জানি।’ ব্যাঙ্গ করে বললো সমারোহ।
সান্দ্র অগ্নিচোখে দেখে সমারোহকে।যেন এখনি দৈবিক কোনো শক্তি দিয়ে ভষ্ক করে দিবে।আর নয়তো বা দুর্গন্ধ যুক্ত পানিতে ফেলে রাখবে ঘন্টার পর ঘন্টা,তাও হয়তো ক্ষোভ মিটবেনা।আড় চোখে সমারোহকে মিনিট খানেক দেখলো সান্দ্র।তারপর বড় সহজ গলায় বলল,
‘তো কি?পার্সনাল কাজ থাকতে পারে না?তুই তো একটা ছাগল তুই বুঝবি না।’
নয়না এবার চেঁচিয়ে বলে ওঠলো,
‘এ্যাহ!কি কাজ করে উল্টায় ফেলছেন উনি।এইটা বলিস না যে, মাইশার সাথে প্রেম করতে যাবি!’
সান্দ্র চোখ বড় বড় করে তাকালো নয়নার দিকে।
‘ওই শয়তান মেয়ে,আর তুই যে লুকাইয়া লুকাইয়া সভিকের সাথে প্রেম করস আমি কাউরে বলছি?’
নয়না মুখ ভেঙচি কেটে বললো, ‘এহহ!ওটা আম্মা জানে।’
ভাই বোনের কান্ড দেখে কুহেলীর খুব হাসি পায় আবার অবাকও লাগে।কিভাবে বাবা মার সামনে বলছে প্রেম করে!যেন মহৎ কাজ করে উদ্ধার করে ফেলেছে তারা।তবে বাবা-মার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ বিষয়টা বেশ মন ছুঁয়েছে কুহেলী।কি সুন্দর তারা সব শেয়ার করছে।আনরুবা আর জহিরও মেনে নিচ্ছেন।তবে শিখাচ্ছেন পবিত্রতা রেখে ভালোবাসো।ভালোবাসা মানে নোংরা ছিটানো নয়,ভালোবাসা মানে একে অপরের মনের মাঝে কাটা পবিত্র আঁচড়।ভালোবাসা মানে আকাশের বিশালতা।বিষন্নতা আর প্রাপ্তির অগোচরে লুকিয়ে রাখা আকাশ মোড়ানো চিরকুট।
জহির সজোরে শব্দ করে বলে ওঠেন,
‘সমারোহ তুমি নিয়া যাবা।’ তারপর আনরুবার দিকে তাকিয়ে বলেন,
‘আর তোমার ছেলে মেয়েগুলা কি বেহাইয়া হইছে দেখো।এইখানে যে তাদের আব্বা আম্মা আছে খেয়ালই নাই।’
জহিরের কথা শুনে ফোঁস করে ওঠেন আনরুবা,
‘এই তুমি আমার ছেলে মেয়েদের বেহাইয়া বলবা না।আর কিছু শয়তানি করলেই আমার ছেলে মেয়ে।পূণ্য করলেই তখন আবার তোমার ছেলে মেয়ে হয়ে যায় না?’
‘তো এরা কি সাধু?প্রত্যেকটা প্রেম কইরা বেড়ায়।’
‘আর তুমি যখন আমার সাথে করছিলা তখন?’
‘আমি কি করতে না করছি?তবে বলে কেন আমাদের সামনে?লজ্জাও নাই।’
আনরুবা বলেন,
‘আর তুমি যে নিজের আব্বারে বইলা নিয়ে আম্মার টাকা চুড়ি করতা?তারপর আমারে নিয়ে ঘুরতে যাইতা?’
আনরুবার কথায় থতমত খেয়ে যায় জহির।সেযুঁতি বড় লাজুক প্রকৃতির। এতক্ষণ লজ্জা পেয়ে কথা শুনছিল। এবার মোটা গ্লাসের চশমাটা হাত দিয়ে ঠিক করে তাকায় জহিরের দিকে।বলে,
‘আব্বা তুমি এইগুলাও করতা?তুমি না বলছো আম্মা তোমারে প্রথম প্রোপজ করছে।তুমি তো রাজিই ছিলা না।তাহলে এগুলা কি?’
সেযুঁতির কথায় গরম তেলে জল পড়ার মতো রেগে ওঠেন আনরুবা।কপট রাগ নাকের ডগায় চাঁপিয়ে বলেন,
‘কিহ!এইসব বলছে?তোরা জানস তোদের আ…।’
আনরুবা কিছু বলার আগেই জহির দ্রুত ওঠে মুখ চেপে ধরেন আনরুবা।বলেন, ‘আনা ঘরে এসো তো কথা আছে।আসো।’
আনরুবা রাগ করে যেতে না চাইলেও জহির জোর করে নিয়ে যান।সকলে হাসতে থাকে এই কান্ডে।সমারোহ মুখে প্রসন্নতা ফুটিয়ে তুলে বলে,
‘কুহেলী,তুমি কাল ছয়টায় তৈরী থাকবা।তাহলে সাতটার মধ্যে পৌঁছাতে পারবো।আর ভর্তির কাজ শুরু হবে আটটার দিকে।আগে গেলে সুবিধা হবে।’
কুহেলী আড়ষ্টতা সরিয়ে মাথা ডানে ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানায়,সে তৈরী থাকবে।সমারোহ,সান্দ্র বের হয়ে যায়।নয়না আর সেযুঁতিও চলে যায় ভার্সিটিতে।জহির আগে সরকারি পুলিশ অফিসার ছিলেন।রিটায়ার্ড হয়েছেন চার বছর।এখন বাড়ি থেকে দূরে নিজের জমিতে মানুষকে দিয়ে চাষাবাদ করান।নিজেই তদারকি করেন সবকিছুর।বয়স বাড়লেও কাজের নেশা তার পিছু ছাড়েনি।ব্যস্ত রাখতেই পছন্দ করেন নিজেকে।আনরুবা আর কাজের মেয়ে রান্নাতে লেগেছে।কুহেলী কাজ খুঁজে পায়না তাই রান্নাঘরে গিয়ে আনরুবাকে বলে,
‘আন্টি আমি কিছু সাহায্য করি!রান্না করি?’
‘এমা এই কি কথা!তুমি রাঁধবা ক্যান?যাও যাও ঘরে যাও।’
‘বোর হচ্ছিলাম।আর রাঁধতে তো ভালো লাগে আমার।গ্রামের অনেক পিঠা বা তরকারি রেঁধে খাওয়াতে পারি যেটার রেসিপি আপনারা হয়তো জানেও না।’
আনরুবা ঠোঁট প্রসারিত করেন।মুচকি হাসি হেঁসে বলেন,
‘আচ্ছা বিকালে রাঁইধো।রাতে সবাই খাইতে পারবো।এখন লাইব্রেরি থেকে বই নিয়া পড়তে পারো।’
কুহেলী হঠাৎই খেয়াল করে আনরুবার মুচকি হাসিটুকু বিশাল দারুন।ধবধবে ফর্সা মুখে বার্ধক্যের সূক্ষ্ম ছাপ পড়ে হাসলে।এই হাসির আলাদা এক সৌন্দর্য আছে।যা উপভোগ করার ক্ষমতা রাখে না সবাই।তারা রাখে তারা সৌভাগ্যবান।কুহেলীর দাদীমার মুখখানিও এমন মাধুর্যময় ছিল।দাদীমার কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে যায় কুহেলীর।কতো কতো ভালোবাসতো তার দাদীমা তাকে।দাদীর বুকে মাথা ঠেকিয়ে কতো রাত সে পার করেছে গল্প শুনে।কুহেলী আর কুঞ্জা রোজ রূপকথার গল্প না শুনে ঘুমোতে চাইতো না।দাদী রোকসানা রোজ শোনাতেন। আচার বানিয়ে দিতেন। শীতের সময় রাতে বারবার উঠে গায়ের কাপড় ঠিক করে দিতেন।দেখতেন নাতনিদের ঠান্ডা লাগলো কিনা।কতো মায়ের হাতের মার খাওয়া থেকে বাঁচিয়েন।
কুহেলীর কান্না পায়।ভীষণ ভাবে কাঁদতে ইচ্ছে করে।কিন্তু এখন তো কাঁদা যাবে না! আনরুবা নিশ্চিত মন খারাপ করে ফেলবেন।তাই মনের আকাশ থেকে গাঢ় কুচকুচে কালো মেঘ গুলো সরিয়ে ফেলতে চাইলো কুহেলী।পারলো কিনা কে জানে! তবে কন্ঠ স্বাভাবিক করে কিছু বলার চেষ্টা করলো।কথা আটকে গেল।মুখ থেকে যেন কিছুই বের হতে চায় না।কাঁপা গলায় বলল,
‘আনতে গিয়েছিলাম।দরজা তো ভেতর থেকে আটকানো।’
আনরুবা ব্যস্ত ছিলো।তাই কুহেলীর বিষয়টা বুঝেননি। বললেন,
‘ও আচ্ছা।আসলে সমারোহ আর সেযুঁতি ছাড়া কেউ তেমন একটা বই পড়ে না।সমারোহের ঘরের ভিতর দিয়ে বইঘরে ঢোকার দরজা আছে।আর আজ সমারোহের একটা এক্সাম আছে।রাত জেগে পড়ছে।তাই দরজা ভিতর থেকে আটকিয়ে পড়ছে হয়তো।ওর ঘরের ভিতর দিয়া যাও।’
‘আচ্ছা।’
সমারোহর কথা ভাবতেই মনটা একটু হালকা হলো কুহেলীর।খারাপ লাগা গুলো উড়ে গিয়ে জমা হলো কিছু ভয়।কুহেলী আলীসান ভঙ্গিমায় পা ফেলে এসে দাঁড়ালো সমারোহের ঘরের সামনে। বাহির থেকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। ভিতরে যাওয়ার কথা ভাবতেই কেমন যেন ভয় ভয় করছে।বুকে ফুঁ দিয়ে ঘরের ভেতর ঢোকার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে ভেসে এলো,
‘ আমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কি করছো?কিছু লাগবে?’
ভরকে গিয়ে ভয়ে হাত পা হিমশীতল হয়ে আসে কুহেলীর।সকালের কথাটা মনে পড়ে আরো লজ্জা লাগে।গায়ের জোর বুঝি একদমই নেই।এখনি ধুপ করে পড়ে যাবে।বিড়বিড় করে সে আল্লাহর কাছে মিনতি করে বলে,
‘প্লিজ আমারে এই মুহূর্তে অদৃশ্য করে দাও নয়তো একটা দড়ি ফালাও আমি উপরে ওঠে যাই।’
কুহেলীর কথা শুনে দম আটকে হাসি আসে সমারোহর।কোনো রকম হাসি থামিয়ে বলে,’কি হলো,বলো?’
পেছন ফিরে সমারোহকে দেখে জোরপূর্বক হাসে কুহেলী।জোরে দম নিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে,
‘উপন্যাস নিতে এসেছিলাম।’
সমারোহ কুহেলীর মাথা থেকে পা অবদি দেখে।মেয়েটা কাঁপছে।হালকা ভয়ও পাচ্ছে হয়ত।কিন্তু কেনো?তাকে দেখে ভয় পাওয়ার কি আছে!সমারোহ চোখ সরিয়ে নেয়।এই মুহূর্তে কুহেলীকে তার একদমই দেখতে ইচ্ছা করছে না।একজন রোগীর অপারেশনের ফাইল ভুল করে ফেলে রেখে গেছে বাড়িতে।নইলে আবার কষ্ট করে বাড়ি আসতে হতো না।
‘রাতে পড়ার পর ঘরের দরজা আর খোলা হয়নি।আসো এদিক দিয়েই।’
সমারোহ কুহেলীর পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলে কথাটুকু।কুহেলী পা টিপে টিপে যায় সমারোহের পিছুপিছু।লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে চমকে ওঠে কুহেলী।তার কলেজে লাইব্রেরি ছিল না।বিদ্যালয়ে ছিল।তবে সেখানে সর্বোচ্চ তিনশ’র বেশি বই হবে না।পড়ার মতো অবস্থায় ছিল মাত্র বিশটা।আর এই লাইব্রেরিটা তার চেয়েও বড়।কমছে কম একহাজার বই তো হবেই।কুহেলী হা হয়ে দেখে বইগুলো।সমারোহ বাহিরের ঘরে যাওয়ার দরজা খুলতে খুলতে বলে,
‘বই মানুষের সবচেয়ে ভালো বন্ধু।আর আমাদের বাড়ির সবাই কম বেশি পড়ে বই।ঘরটা আমার প্রচেষ্টাতেই।একদিন বড় হবে লাইব্রেরিটা।’
কুহেলী টুকুর টুকুর পায়ে ঘুরে দেখে ঘরটা।খুব যত্নে সাজানো।এটা দেখলেই বুঝা যায় লোকটা কতটা গোছালো।কুহেলী হাঁটতে হাঁটতে অনায়াসে কয়েকটা বই নিজের হাতে তুলে নিল।কয়েক পাতা দেখে আবার রেখেও দিল।এতো এতো বই যে বুঝতেই পারছে না কোনটা নিবে। হঠাৎ একটা সুন্দর মলাট করা বই হাতে পড়লো কুহেলীর। বইটির নাম ‘মিডলমার্চ’ ।কুহেলী কয়েক পাতা উল্টে পাল্টে সমারোহকে বলে,
‘আমি কি এই বইটা নিতে পারি?’
‘হুম অবশ্যই।জর্জ এলিয়টের বই।আমার বেশ পছন্দের।’
‘এই বইটি কি সম্পর্কিত?’
সমারোহ কিছুক্ষণ চুপ থেকে সবটা ভেবে নিয়ে বললো,
‘এলিয়টের মাস্টারপিস বলে উপন্যাসটিকে। মিডলমার্চ’ নামে একটি কাল্পনিক শহরের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জীবন নিয়ে বিশ্লেষণ করে এই বইয়ে। তবে মূল চরিত্রে দুইজন।একজন হলো জেদি আর দৃঢ়-ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন ডোরোথিয়া ব্রুক এবং অপরজন আদর্শবাদী টারটিয়াস লিডগেট।তারা দুজনেই বিপর্যস্ত বৈবাহিক জীবনের শিকার।১৯শতকে লেখা।পড়ে দেখো ভালো লাগবে আশা করি।’
‘আচ্ছা।’
‘বইটা ইন্ডিয়া থেকে আনিয়েছিলাম। বাংলাদেশ অনেক খুঁজেও পাই নাই।’
‘আপনি ইন্ডিয়া গেছেন?’
‘না তা যাই নি। ইচ্ছা তেমন একটা নাই।’
‘কেনো ?কেনো?এমনটা কেন?’
‘আর বই নিবে?’
কথাটা গম্ভীর হয়ে বললো সমারোহ। কেমন যেন এড়িয়ে গেল কথা,নয়তো কুহেলীর সাথে কথা বলার অনিচ্ছা প্রকাশ করলো। হঠাৎ করেই এভাবে বলাতে যথেষ্ট খারাপ লাগে কুহেলীর।অতি সুনিপুণ ভাবে মাথা উপরে নিচে নাড়িয়ে কুহেলী সম্মতি জানালো।সমারোহ সেই ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে যেতে যেতে বললো,
‘এখন থেকে এই ঘরের দরজা খোলা থাকবে।যখন ইচ্ছা এসে বই নিবে।তবে বই যত্নে রাখবে।আর কাল একদম সকাল সকাল বের হবো। তৈরি থেকো।’
‘থাকবো।’
কুহেলীও আর কথা বাড়ালো না।মনে মনে বেশ ঘটা করে গালি দিল।ভয়ংকর সুন্দর ডাক্তার বলেই এতো ভাব থাকতে হবে!একবার কিসব বলে লজ্জা পাইয়ে দেয় আবার এমন ভাবে বলে যেন কথাই বলতে চায় না।ভালো লেগেও কি বিপদে পড়লো নাকি?
সমারোহ ফাইল নিয়ে এসে গাড়িতে বসে।সে এখনো আনইজি ফিল করছে কুহেলীর সামনে।তার মেয়েটা তো তার কারণে মাটিতেই মিশে যাচ্ছিল লজ্জায়।লম্বা একটা শ্বাস নেয়।নিঃসন্দেহে সকালের তার বলা কথাগুলোই তাকে ভাবাচ্ছে।আজ এফ.সি.পি.এস. পরীক্ষা ছিল।পরীক্ষাটাও ভালো হয়নি এসব কথা ভেবে ভেবে।বাচ্চা মেয়েটাকে দেখলে এমন মনে হয় কেনো তার?নিজেকে কন্ট্রোল করা যেন একটু দায় হয়ে পরে!এমনটা তো সাধারণত হয় না।সমারোহ কি দূর্বল হয়ে পরছে নাকি।সমারোহ নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় নিজের বিবেকের কাছে।উত্তর ও খুব সোজা!দূরত্ব রেখে চলতে হবে।সেটা কঠিন কিছু না।মানুষ ভুল করে, তবে বারবার না।একটা সামান্য ভুল সম্পূর্ণ জীবন নষ্ট করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট আর সেখানে সমারোহর তা প্রতিবার করার মানেই হয়না।একবার ভুল করে নাহয় কিছু বলেই দিয়েছে।দ্বিতীয়বার থেকে সামনেই পড়তে দেবে না মেয়েটাকে।মনে মনে ঠিক করে কুহেলীকে এখন থেকে এড়িয়ে চলবে সমারোহ।তারপর গাড়ি স্টার্ট দেয়।
কফির মগ একটু আগে এসে দিয়ে গিয়েছে সেযুঁতি।গল্প করতে চেয়েছিল কিন্তু পাড়েনি। সন্ধ্যে বেলা গোসল করে এসেছে কুহেলী।উপায় ও ছিল না।৮৮০ পৃষ্ঠার কি ভারী বই।এক বসাতেই ৫৪৭ পৃষ্ঠা শেষ করে ফেলেছে।এখন মাথা ঝিমঝিম করে ব্যথা করছে। বাথরুম থেকেই কয়েকবার তার ডাক শুনেছে।তারপর কফি রেখে চলে গেছে। নতুন কোন এক ভাইয়া এসেছে কয়েকদিন তাদের পড়াগুলো দেখিয়ে দিতে।কুহেলী ভিজা ঘন মেরুন রঙের চুলগুলো সম্পূর্ণ পিঠে ছড়িয়ে দিয়ে জানালার ধারে এসে বসলো।গায়ে পশমি শীতের কাপড়।শীতের কারণে ভারী কুয়াশা বৃষ্টি হয়ে ঝরছে।শীতের সন্ধ্যায় ভারী বৃষ্টি কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার।তার মাঝে গরম চা’য়ে চুমুক।কুহেলীর মুখ থেকে ছুটে বের হয়ে আসে,
‘ অসাধারণ!’
কুহেলীর গ্রামের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।কুহেলী বাড়ি থাকতে পড়ালেখা না পারলে হাসনাহেনা যখন মারতো তখন সবসময় সে ভাবতো কবে সে একটা ভালো কোথাও পড়ার সুযোগ পাবে।আর এই বাড়ি থেকে চলে যাবে।আর আসবে না।অথচ এখন ভিতরটা কাঁদে মায়ের জন্য।মায়ের হাতের প্রত্যেকটা স্পর্শে যেন মায়া,আদর, ভালোবাসা সব একসাথে লুকিয়ে আছে।তখন ছোট্ট মনটা এগুলো খুঁজে পেতো না।এখন খুব করে খুঁজে তবু পায়না।কতোটা ভালোবাসা আছে তার গ্রামে।বাবার আদর, ছোট্ট বোনটার পাগলামী সব ছেড়ে কি করে পড়ে আছে সে এখানে! কলিজা কেঁপে উঠে কুহেলীর। দৌড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সে পারবে না।বাবা মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে আছে যে এখন!তবে হৃদয় জুড়ে শুধুই তারা আছে।কুহেলী বিড়বিড় করে বলে,
‘আচ্ছা আম্মাও এখন আমার কথা মনে করে কাঁদে?আম্মা তো কাঁদে না কোনদিন।এখন নিশ্চয়ই কাঁদে।আব্বাও তো কাঁদে।’
কুহেলীর কান্নার বেগ বাড়ে।আব্বাকেও সেদিন যাওয়ার সময় কাঁদতে দেখেছে কুহেলী। গুনগুন শব্দ করে কেঁদে ওঠে কুহেলী।এই মুহূর্তে খুব বেশি অনুভব করছে তাদের।
কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে ওঠে গিয়ে বিছানা থেকে মোবাইল নিয়ে আসে কুহেলী।বাড়ির নম্বরে কল করে।ওপাশ থেকে কোনো এক নারী খুব সহজ কন্ঠে বলে ওঠে,
‘আপনি যে নম্বরে ফোন করেছেন সেটি এখন বন্ধ আছে।আপনি যদি…’
কেটে দিল। মোবাইল থাকলেই কি! নেটওয়ার্ক নেই।আসার পর মাত্র দুই বার কথা হয়েছে। ইচ্ছা থাকলে একটু কন্ঠটাও শুনতে পারে না। হতাশায় ডুবে যায় কুহেলী।মনের বিপরীতে গিয়েও অনেক কিছু মানুষকে করতে হয়।ভালোর জন্যই করতে হয়।অবশ্য বিচ্ছেদের পরেই তো মিলন।হঠাৎ আবার সমারোহর ইগনোর করার কথাটা মনে পড়ে।না চেয়েও সমারোহকে মনে মনে ঘাটাচ্ছে সে।তাই বিষন্নতা বাড়ছে একটু একটু।
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালো কুহেলী।কফি শেষ করে নিচে যায় মগ ধুয়ে রাখতে। রান্নাঘরে গিয়ে মগ পরিষ্কার করে রেখে উপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হঠাৎ কানে বেজে উঠলো কারো গোঙানির আওয়াজ। কপাল কুঁচকে যায় কুহেলী।মাঝ-ঘরের লাইট বন্ধ।থমথমে পরিবেশ।কুহেলী হতভম্ব হয়ে বুঝার চেষ্টা করতে লাগলো ব্যাপারটা।ধীরে ধীরে গোঙানির আওয়াজ বাড়তে লাগলো।ভয়ে হঠাৎ করেই কেমন কলিজা চাপ দিয়ে ওঠলো কুহেলীর।এই রকম আওয়াজ সে আরো একবার শুনেছিল জীবনে।সেই রাতটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বিষাক্ত রাত। নিমিষেই ধ্বংস করে দিয়েছিল শৈশব।শিরা উপশিরাতেও কাঁপুনি ধরে কুহেলী। হঠাৎই খেয়াল করে মাথাটা চক্কর দিচ্ছে।বমি পাচ্ছে। ততক্ষণে এটাও খেয়ালে এলো গোঙানির আওয়াজটা আসছে আনরুবার ঘরের ভেতর থেকে।কুহেলী মাথায় হাত দিয়ে নিজের চুল জোর করে চেপে ধরে দৌড়ে গেল আনরুবার ঘরের দিকে।ঘরের দরজায় গিয়ে দাড়াতেই আরো জোরে যেন ধাক্কা খেল।আনরুবা বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন আর মুখ দিয়ে ঝরে পড়ছে সাদা ফেনা।কি ভয়াবহ সে চিত্র কাঁপিয়ে তুললো কুহেলীর ভেতরটা। চিৎকার করে যেয়েও যেন পাড়ে না। অনুভূতির স্নায়ু ছিঁড়ে যাচ্ছে তার।কুহেলীর বোধগম্য হয় গলা বসে গেছে তার।একটা টু শব্দও আসছে না ভিতর থেকে।বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে সে।
চলবে.