আকাশ মোড়ানো চিরকুট পর্ব-৫১+৫২+৫৩

0
377

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৫১.

বারান্দার কোনে একটা ছোট্ট স্পাইডার গাছ লাগিয়েছিল সমারোহ। সমারোহ চলে যাওয়ার পর তেমন একটা খেয়াল নেয়া হয়নি গাছটার। তবে এখন আবার তরতাজা হয়ে উঠেছে সে। সমারোহর গায়ের সুবাস পেয়েছে হয়তো! কুহেলী একমনে তাকিয়ে আছে গাছটার দিকে। সমারোহ মানুষটা এতো আকর্ষণীয় কেনো? উনার সংস্পর্শে যারা থাকে তারা প্রত্যেকেই কেনো কেবল সমারোহতেই মত্ত থাকে? কুহেলীর আনন্দ হওয়ার কথা তার স্বামীকে সকলেই পছন্দ করে! কিন্তু হচ্ছে না, মোটেই সে খুশি হতে পারছেনা। আলোকে যতবার সে সমারোহর কাছাকাছি দেখে পাগল হয়ে যায় সে। আগে কেবল রাগ হতো কিন্তু এখন খুন করতে ইচ্ছা করে। যত দিন যাচ্ছে কুহেলী আরো ডেস্পারেট হয়ে উঠছে, এটা অবশ্য খুব ভাবাচ্ছে কুহেলীকে। তার নিজেকে খারাপ মনে হচ্ছে। কেনো সে কাউকে হিংসা করবে? তাও আবার নিজের কাউকে নিয়ে। অবশ্য সমারোহই বা কেনো কিছু বুঝবে না। কেনো বুঝবে না আলোকে উনার সাথে কুহেলীর ভালো লাগে না! আর আলোই বা সারাক্ষণ কেনো সমারোহর আগে-পিছে ঘুরঘুর করবে? কুহেলীর মা সবসময় বলতেন ছেলে মানুষের মন ভোলাভালা, যেকোনো নারী সহজেই আকর্ষণ করতে পারে। তাই সবসময় স্বামীকে নিজের আঁচলের সঙ্গে বেধে রাখতে হয়। কুহেলীর ভয় হয়, খুব ভয় হয়। সে যে সমারোহকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। কুহেলী সমারোহকে বিশ্বাসও করে প্রবল। কিন্তু মনে শান্তি না থাকলে যা হয় আরকি! আলো আর সমারোহ একই বাড়িতে আছে সেটাতে কুহেলী কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না।

একাকী মন খারাপ করে বেলকনির কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল কুহেলী। ঘরে কারো প্রবেশ করার শব্দ পেয়ে ভেতরে আসে কুহেলী। সমারোহ কুহেলীকে দেখেই মুচকি হেসে কাছে গিয়ে চুলে খোঁপা করে টাটকা কদমের মালা গেঁথে দেয়। কুহেলী প্রচন্ড অবাক হয় তাতে।

‘ কেনো এনেছেন এটা? ‘

‘ আমার জন্য! ‘

‘ তাহলে আমায় দিলেন কেনো? ‘

‘ ইচ্ছা করলো। ‘

‘ সেটা কেনো? ‘

পেছন থেকে কুহেলীকে জরিয়ে ধরে সমারোহ বলে,
‘ রাগ ভাঙাতে। তো ভাঙলো আমার কৃষ্ণলতার? ‘

কুহেলী এবার চমকে উঠে একঝাটকায় সমারোহকে ছাড়িয়ে পেছন ফিরে তাকায়। সমারোহর ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি। কুহেলী লজ্জা আর ভয়ে সরে যাওয়ার আগেই সমারোহ কুহেলীর কোমর ধরে টেনে কাছে নিয়ে এসে গুনগুনিয়ে বলে,

‘ এতোই ভালোবাসলে কাছে টেনে নিলে কি হয় হে? ‘

কুহেলীর শরীর গরম হয়ে আসে অস্বস্তিতে। বুকের ভেতর ধীপ ধীপ করে। সমারোহ বুকে হাত রেখে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বলে,
‘ কি বলছেন কি আপনি?

‘ কি বলছি? ‘

‘ আ’ আ’ আমি আপনাকে… ‘

‘ আমাকে? ‘

‘ কিছু না। ‘

‘ কিন্তু আমি ভালোবাসি। তোমাকে। ‘

কুহেলী চোখ বড়বড় করে তাকায় সমারোহর দিকে। কি বলছেন সমারোহ তা কুহেলীর বোধগম্য হচ্ছে না। সত্যিই সমারোহ কুহেলীকে ভালোবাসি বললো? সমারোহ তাকে ভালোবাসে! কুহেলীর নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না এখন। কুহেলী কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,

‘ কি, কি বললেন আপনি? ‘

‘ বললাম ভালোবাসি। আমার বউকে আমি ভালোবাসি। কুহেলীকে আমি ভালোবাসি। ‘

কুহেলী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তার কান্না পাচ্ছে। এ মুহুর্তে তার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটার মুখে তার প্রতি অনুভূতির কথা শুনে হয়তো। কুহেলী চোখ বুঁজে থাকে৷ এ সময়টা তার জন্য খুবই আবেগপ্রবণ, খুবই স্পেশাল! সমারোহ কুহেলী ঠোঁটের সঙ্গে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে নেয়। কুহেলী তার কাঁপা হাতে খামছে ধরে সমারোহর শার্ট।
আকাশের শেষ কোনাটায় মেঘের কোনায় গিয়ে লুকিয়েছে সূর্য। টুকটুকে লাল প্রেমের রঙ ছড়িয়ে মুহূর্তটাকে আরো রঙিন করে তুলতে ব্যাস্ত সে! মেঘের ফাঁকে নীল,সবুজ আবিরের মাফামাখি। সমারোহর প্রেমে লাজুক রঙে রঙ্গিন প্রকৃতি। চঞ্চল সময়টাও যেন থমকে গিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
সমারোহ কুহেলী ঠোঁট ছেড়ে গলায় ঠোঁট ছোঁয়াতেই নয়নার আওয়াজ কানে আসে,

‘ কুহু! কুহু! বৃষ্টি নেমেছে যে। ছাদ থেকে আমার জামাগুলো এনে দে না বোন! ‘

কুহেলী নড়েচড়ে উঠে। সমারোহর কাছ থেকে নিজেকে দ্রুত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে,

‘ আ’আপনি ছাড়ুন আমাকে! ‘

সমারোহকে ছাড়িয়ে নিয়েই দৌড়ে ছাদে চলে যায় কুহেলী। তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না সমারোহ তাকে ভালোবাসি বলেছে। কাপড় তোলার কথা বেমালুম ভুলে যায় কুহেলী। বৃষ্টির একেকটা ফোঁটার কাছে সমর্পণ করে দেয় নিজেকে। কিছু সময় পর কারো স্পর্শে চমকে উঠে সে। কুহেলীকে কোলে করে জোর করে ছাদ থেকে নিয়ে আসে সমারোহ। কুহেলী অস্ফুটস্বরে বলে,

‘ জামাগুলো… ‘

‘ আনতে হবে না। ‘

অবাক হয়ে তাকায় কুহেলী সমারোহর দিকে। সমারোহ ভ্রুঁ কুঁচকে রাগী গলায় বলে,

‘ কখন গিয়েছো ছাদে খবর আছে তোমার? ঘর থেকে বের হয়েছো পয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গিয়েছে পরেও যখন ছাদ থেকে নামছো না তাই ছাদে এসে দেখি ম্যাম বৃষ্টিতে ভিজচ্ছেন! ‘

সমারোহর রাগ দেখে কুহেলী চাপা স্বরে বলে,
‘ এমন করেন কেনো? কি হবে একটু ভিজলে! ‘

‘ কি হবে? পরে জ্বর আসলে কি হবে ভেবে দেখেছো? ‘

ঘরে নিয়ে এসে কুহেলীর মাথা খুব ভালো করে মুছে দেয় সমারোহ। নিজের হাতে আদা চা বানিয়ে এনে জোর করে খাইয়ে দেয়। কুহেলী অবাক হয়ে কেবল দেখে সমারোহর কান্ডখানি। কিন্তু এতো খেয়াল রেখেও লাভ হয় না। রাতের দিকে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে কুহেলীর। সঙ্গে বারবার হাঁচি দিতে দিতে ক্লান্ত সে। সমারোহ খুব করে খেয়াল রাখছে কুহেলীর।
রাতে ঘুমানোর সময় কুহেলীকে সযত্নে জরিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পারানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কুহেলী ক্লান্তি আর লাজে আড়োষ্ট হয়ে থাকে। সমারোহ এভাবে অপলক চেয়ে থাকলে সে ঘুমাবে কি করে! এক পর্যায়ে অধৈর্য্য হয়েই কুহেলী বলে,

‘ এভাবে কি দেখছেন হে? ‘

‘ ভাবছি। ‘

‘ কি? ‘

‘ আমার ভালোবাসার প্রথম ডোজেই যদি তোমার এই অবস্থা হয় তাহলে পরেরগুলো সহ্য করবে কিভাবে? এখনো যে অনেক ভালোবাসার বাকি ! ‘

চলবে.

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৫২.

ফজর নামাজ পড়ে বাগানে হাটতে যায় কুহেলী। একা একা গাছে পানি দিতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পরে বাড়ির গেইটের সাথে থাকা ছোট্ট চিঠির বক্সটার দিকে।
নতুন কোনো চিঠি এসেছে কিনা দেখতে গিয়ে একটা সাদা খাম পায় সে। কিন্তু অবাক হয় যখন তাতে নিজেরই নাম দেখে। তার জন্য আবার কে চিঠি পাঠাতে যাবে? অদ্ভুত! কৌতুহল নিয়ে চিঠির খামটা ছিঁড়তেই কেউ একজন খাপ মেড়ে চিঠিটা নিয়ে যায় কুহেলীর কাছ থেকে। কুহেলী তাকিয়ে সমারোহকে দেখেই ভ্রুঁ কুঁচকে ফেলে। রাগী স্বরে বলে,

‘ এভাবে নিয়ে গেলেন কেনো? আমি দেখবো কি এটা। ‘

‘ আমার জিনিস তোমাকে কেন দেবো? ‘

নির্বিকার কথা সমারোহর।
‘ মোটেই আপনার না। আমি দেখেছি আমার নামে এসেছে এটা। দিন বলছি আমাকে। ‘

‘ পারবো না। আমারটাও আমার, বউয়েরটাও আমার। ‘

কুহেলী এবার তেতিয়ে উঠে বলে,
‘ এই ইদানীং আপনার আচরণ কেমন রহস্যময় ঠেকাচ্ছে আমার কাছে। এক্ষুনি দিন বলছি, নাহলে খারাপ হয়ে যাবে। ‘

সমারোহ মুচকি হাসে কুহেলীর রাগী রূপ দেখে। মৃদুপায়ে হেটে কুহেলীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
‘ কিছু পেতে হলে তো কিছু দিতে হয়। সমারোহ ফ্রীতে কাউকে কিছু দেয় না। ‘

‘ মানে? ‘

‘ চুমু খেতে হবে আমাকে তাহলে দিয়ে দেব। ‘

কুহেলীর চেখ বড়বড় হয়ে যায় সমারোহর কথা শুনে। কি অসভ্য লোক! নাকের ফুলিয়ে কুহেলী বলে, ‘ পারবো না আমি। লাগবে না আমার কিছু। ‘

বলেই গঢগঢ করে সেখান থেকে চলে যায় কুহেলী। সমারোহ শব্দ করে হাসে। ভাগ্যিস কুহেলী দেখে নেয়নি কি ছিল এতে। তাহলে পুরো সারপ্রাইজটাই মাটি হয়ে যেত!

কুহেলী বাড়ি এসে সারাদিন রাগী রাগী মুখ করে থাকার পরও সমারোহ মোটেই রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টাও করেনি তার। এর উপর আলোর অতিরিক্ত ঢলাঢলি করতে চাওয়া তার স্বামীর সঙ্গে, সব মিলিয়ে মেজাজ তুঙ্গে উঠে রয়েছে কুহেলীর। নেক্সট মান্থের প্রফটাও যেন এতো প্যারা দেয় না তাকে। অভিমানের দমকে সব কিছু ছাড়খার করে দিতে ইচ্ছে করছে কুহেলীর। সারাদিনের রাগ যেন রাতে ফুলকির আকার নিয়েছে। বাড়িতে বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলতে যেয়ে একটু লেট করে নিচে নামতে যেয়ে দেখে আলো খাবার বেড়ে দিচ্ছে সমারোহকে আর সমারোহ সানন্দে খেয়ে চলেছে! কি অদ্ভুত মানুষ। শরীর জ্বলে যাচ্ছে কুহেলীর। নিচে যাওয়ার আর সাহস হয়নি তার। দ্রুত পায়ে ঘরে আসতেই চোখ ছাপিয়ে জল আসে তার। এমন কেনো হচ্ছে সব? সমারোহকে অন্য কারো সঙ্গে দেখার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা কুহেলীর নেই এটা কি সে বোঝে না? তার উপর প্রাক্তন প্রেমিকার পাশে নিজের স্বামীকে কোনো মেয়েই চাইবে না। ওহ অস্য! কুহেলী এক পর্যায়ে রাগ সামলাতে না পেরে ওজু করে এসে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে কোরআন শরিফ। কুহেলীর সুরেলা কন্ঠে কোরআনের প্রতিটি ধ্বনি যেন মাতিয়ে তোলে সম্পূর্ণ বাড়িটাকে। জায়নামাজ তুলে কি মনে করে যেন গিয়ে গোসল করে আসে কুহেলী। হলুদ রঙের জামদানী একটা পড়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। চুল বেয়ে টুপটুপ করা পানিতে কোমরের কিছু অংশ ভিজে গিয়েছে। স্নিগ্ধ হলুদ পরীর মতো দেখাচ্ছে কুহেলীকে। সমারোহ কুহেলীর উপর থেকে চোখ সরানো তো পলক ফেলাও যেন এখন বড্ড দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুহেলী সমারোহকে খেয়ালই করেনি, কখন এসে বসেছে সোফায়।

কুহেলীকে দেখে আর এক মুহুর্ত নিজেকে আটকে রাখতে পারে না সমারোহ। কুহেলীকে আস্তে করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মুখ ডুবিয়ে দেয় চুলে। মাদকতা মেশানো কন্ঠে বলে,
‘ পাগল করে ফেলবে ভেবেছো নাকি? ‘

কুহেলী কেবল নির্বিকার চোখে চেয়ে থাকে সমারোহর দিকে। কিছু বলছে না, বাঁধাও দিচ্ছে না অন্যদিনের মতো। আর না পাচ্ছে লজ্জা। সমারোহ ভয়পায় বউয়ের এমন ভয়ংকরী রূপ দেখে। অবশ্য সমারোহর বউ বলে কথা, এতটুকু তেজ না থাকলে চলে!
সমারোহ সুযোগ হাতছাড়া না করে কুহেলীর গলায় হুট করে চুমু খেয়ে নিয়ে বলে,

‘ শাড়ি পড়েছো কেনো হঠাৎ? ‘

‘ নিষেধ? ‘

‘ না না। শাড়ি পড়লে যে আদর আদর পায় বউটাকে! পরে ছুঁয়ে দিলে যে দোষ হয়ে যাবে। ‘

কুহেলীর গাল লাল হয়ে আসে। চোখের পলক ফেলার পরিমাণও বেড়ে যায়। তাও তেজী কন্ঠে বলে,

‘ ছোঁয়া তো দূর, যেটা মাত্র করলেন সেটাই আরেকবার করার চেষ্টা করে দেখুন, বুকে ছুড়ি ঢুকিয়ে একদম জাহান্নামের রাস্তা দেখিয়ে দেব। ‘

এমন সিরিয়াস মুহুর্তেও হেসে ফেলে সমারোহ। এতো জেলাসী কুহেলীর তাকে নিয়ে! সমারোহকে হাসতে দেখে মাথাটা রাগে ধপধপ করে উঠে। জোর করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই সমারোহ এক অদ্ভুত কাজ করে বসে। কুহেলীর শাড়ির আঁচল দিয়ে বেঁধে ফেলে তার হাত। একটা কালো কাপড় দিয়ে চোখও বেধে ফেলে। কুহেলী ছোটার জন্য ছটফট করতে থাকলে সমারোহ খুবই নরম কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘ আমি তো ভেবেছি আজ তোমার সম্পূর্ণ শরীরে আমার চিহ্ন এঁকে দেবো। তোমার এই অল্প প্রেমে যে আমি অবসেস্ড। ‘

সমারোহর কথা শুনে আরো বেশি ছটফট করতে থাকে কুহেলী। চেঁচিয়ে উঠে বলে,
‘ একদম ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। হাত বেঁধেছেন কেনো আমার। এক্ষুনি খুলে দিন বলছি নাহলে…। ‘

কুহেলীর কথা শেষ হওয়ার আগেই সমারোহর অধর কুহেলীর অধর স্পর্শ করে। কুহেলী সরে যেতে চাইলে এক হাত মাথার পেছন জোরে আঁকড়ে ধরে। বেশ কয়েকখানি কামোড় ও বসিয়ে দেয় সমারোহ। কুহেলী শক্তিতে পেরে ওঠে না তার সঙ্গে। দম আটকে আসছে তার। সমারোহ এমনভাবে চেপে ধরেছে যে শ্বাস নিতে পারছে না কুহেলী। অবশেষে একটু পর ছেড়ে দিয়ে আলতো করে আরকবার চুমু খেয়ে বলে,

‘ বেশি ছটফট করলে এমনই শাস্তি পাবে। তাই একদম চুপচাপ থাকবে। ‘

‘ একবার হাত খুলে দেখুন কি করি আ…। ‘

কথা শেষ করার আগেই আবারো সমারোহ একই কাজ কাজ করে। এবারের ছোঁয়া যেন আরো বেপরোয়া! ব্যাথায় কান্না পাচ্ছে কুহেলীর এবার। সমারোহ তাকে এমনিতেও ছাড়বে না। তাই চুপচাপ থাকাই ভালো। সমারোহ কোলে তুলে নেয় তাকে। চুপচাপ বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে কুহেলীকে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতেই টনক নড়ে কুহেলীর। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে সমারোহ! এমনিতেই তো এখন তাকে পছন্দই করে না। কোথায় নিয়ে গিয়ে মেরে গুমটুম করে দেবে না তো! না না। কি সব ভাবছে সে! সমারোহ এমন কেনো করবে এমন! কুহেলী এবার আবার ছটফট করতে করতে বলে,

‘ এই কি করছেন হে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? আমি কোত্থাও যাব না আপনার সাথে। আমি কিছু দেখতেও পাচ্ছি না। ‘

সমারোহ রাগী গলায় বললো, ‘ তোমার মনে হয়ে আরো চুমু চাই আমার কাছে তাই না? সরাসরি বললেই তো পারো! কি দেবো নাকি আরেকবার? এবার আমার মেজাজ খারাপ করলে কিন্তু এই পাবলিক প্লেসেই আদর করা শুরু করে দেব। ‘

‘ আপনি এতো অত্যাচার করেন কেনো আমার উপর বলুন তো! ‘

সমারোহ এবার খুব জোরাল কন্ঠে বলে,
‘ আমি অত্যাচার করি তাই না! আমি অত্যাচারী? দাঁড়াও। ‘

কুহেলী ভড়কে গিয়ে দ্রুত বলে উঠে, ‘ না না। আপনাকে তো আমি খুব ভালো বললাম। এইযে একদম চুপ করে গেছি আমি। ‘

‘ আর কি যেনো বললে? যাবে না আমার সঙ্গে? ‘

‘ আরে কি যে বলেন না! আমি তো আপনার সঙ্গে জাহান্নামে যেতেও প্রস্তুত। আমাকে আর শাস্তি দিবেন না প্লিজ! ‘

কুহেলীর বাচ্চামো কথা শুনে হাসে সমারোহ। মুচকি হেসে বলে, ‘ এই তো গুড গার্ল। ‘

‘ এইবার চোখটা খুলে দিন না! ভয় লাগছে, যে স্পিডে ড্রাইভ করছেন আপনি! ‘

‘ আমার পাশে থেকেও? ‘

কুহেলী একটু থামে। বলে, ‘ না। কিন্তু দিন না খুলে। হাত খুলতে হবে না তো। ‘

‘ না। খোলা যাবে না। এভাবেই চুপচাপ বসে থাকো। ‘

‘ বজ্জাত। ‘

‘ কিহ? ‘

‘ না কিছু না। ‘

‘ না হলেই ভালো। ‘

কুহেলী আর কিছু বলেনা। গাড়ি চলতে থাকে আপন গতিতে। স্লো মিউজিকে বাংলা বাজছে ‘ ডিসেম্বরের শহরে’। শুনতে শুনতে একসময় ঘুমের দেশে পাড়ি জমায় কুহেলী। যখন ঘুম ভাঙ্গে দেখে চারদিকে কেবলই অন্ধকারের ছড়াছড়ি। হাত খোলা তার। চোখের বাধনটাও এখন আর নেই। পাশে সমারোহও নেই! কুহেলী ঘাবড়ে গিয়ে বেশ কয়েকবার সমারোহকে ডাকে। নাহ! কোনো সাড়াশব্দ নেই। এতোই আধার যে বোঝাও যাচ্ছে না কোথায় আছে সে! শুধু বোঝা যাচ্ছে চারিদিকে অসংখ্য গাছওালার মাঝে থামানো গাড়িটা। ভয়ে এবার কেঁদে ফেলে সে। কোথায় গিয়েছে সমারোহ এভাবে তাকে একা ফেলে?

চলবে.

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৫৩.

চারিদিকে আঁধারের হাতছানি আর নিস্তব্ধতার গহীনে তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে কুহেলী ভেতর আতঁকে উঠে। হাতের ঘড়িটা জানান দিচ্ছে সময় এখন দুইটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট! অদ্ভুত, সবাই আজ ডিনার করেছে আটটায়। এতোটা সময় ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল কি করে? আর এখনই বা কোথায় সে? সমারোহ কখনো তো এমন করেন না। তবে আজ কুহেলীকে একা ফেলে কোথায় গেলেন। এতো করে যে ডাকছে তা কি সমারোহর কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না? আচ্ছা সমারোহর কোনো বিপদ হয়নি তো! ভাবতে কুহেলী বুক মোচড় দিয়ে উঠে। সমারোহ ঠিক আছেন তো! একবার কি সে বের হয়ে দেখবে? এটা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই।
কাঁপা কাঁপা পায়ে গাড়ি থেকে নেমে চারদিক ভালো করে পরখ করতে থাকে। কোনো জঙ্গলের মাঝে সে? কিন্তু সমারোহ এমন জায়গাতেই বা কেনো নিয়ে আসবে। কুহেলী নরম শঙ্কিত গলায় বলে,

‘ সমারোহ! কোথায় আপনি? আপনি কি মজা করছেন আমার সাথে? আমি কিন্তু সত্যি ভয় পাচ্ছি। প্লিজ এমনটা করবেন না। সমারোহ, সমারোহ! ‘

কুহেলী কয়েকপা সামনে এগিয়ে যায় সমারোহকে ডাকতে ডাকতে। হঠাৎই অনেকটা দূরে আলো জ্বলে উঠে। প্রথমে ভড়কে গেলেও ধীর গতিতে সেদিকে এগিয়ে যায় কুহেলী। সচকিত হয় কুহেলী। এতোক্ষণে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে কোথায় সে। একটু সামনে এগোতেই চোখে পরে বিশাল সমুদ্র। সাগরের ডাকে নিরব পরিবেশ আর প্রেমময় ছন্দরা মিলেমিশে কলঙ্কিত হয়ে যাচ্ছে। অথচ সমুদ্রের এই বিশাল গর্জনকেই ক্ষনিক আগে কি ভয় পাচ্ছিল সে! আরো একটু সামনে এগিয়ে যেতে চোখের সামনে স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো সমুদ্র সৈকতের মাঝে সাজানো জায়গাটা। খুব বেশি আহামরি কিছু নয়, তবে কুহেলীর মনে মতো। ছোট্ট একটা গোল টেবিলে খুব আকর্ষণীয় একটা কেক রাখা। টেবিলের চারিদিকে নীল সাদা পর্দার ছড়াছড়ি। তার সামনে বালির মাঝে ফুল দিয়ে লিখা ‘ হ্যাপি বার্থডে বউ ‘।

কুহেলী চোখজোড়া চিকচিক করে উঠে এবার। সমারোহর প্রতি এতো এতো অভিমান মনে দানা বেধেছিল যে আজ তার জন্মদিন সেটা সে ভুলেই গেছে! কিন্তু কুহেলীর কমে না বরং আরো বেড়ে যায়। সে এবার মোটেই ক্ষমা করবে না সমারোহকে। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে ভালো কথা কিন্তু তাই বলে এভাবে ভয় দেখানোর দরকারটা কি ছিল! কি সাংঘাতিক ভয়টাই না সে পেয়েছিল একটু আগে! কুহেলীর ভাবনায় ছেদ পরে যখন কারো বুকের বিশাল উষ্ণতা ছুঁয়ে যায় তার শরীর। সমারোহ আলতো করে কুহেলীকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘ হ্যাপি বার্থডে বউ। অনেক অনেক ধন্যবাদ আজকের দিনে পৃথিবীতে আসার জন্য। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ এই দিনটার জন্য। ‘

কুহেলী কিছু বলবে তার আগেই সমারোহ কুহেলীর ঠোঁটে তার শাহাদাত আঙুল স্পর্শ করিয়ে চুপ করিয়ে দিয়ে বলে, ‘ এখন কোনো কথা বলবে না। আগে কেকটা তো কাটো! বড্ড ক্ষুধা লেগেছে আমার। ‘

‘ কেন? ক্ষুধা লেগেছে কেন? তখন তো দিব্বি দেয়ে গেছেন অন্য মেয়ের বেরে দেয়া খাবার। আমি কোনো কেক-টেক কাটতে পারবো না। ‘

সমারোহ হেসে ফেলে কুহেলীর কথা শুনে। মুচকি হেসে হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে বলে,
‘ আহ! অবিশ্বাস করে ফেললো বউটা! রাগলে এতো ভুলভাল ভাবো কেনো তুমি বলোতো? আমি সেই দুপুর থেকে না খাওয়া। তখন তো তোমায় রাগাতে চাচ্ছিলাম একটু কেবল। আর তুমিও লুচির মতো ফুলে গেলে? ‘

কুহেলী চোখ খোঁচ করে তাকায়। আহ্লাদী কন্ঠে বলে, ‘ আর সকালে যে চিঠিটা লুকালেন? ‘

‘ কোথায় লুকিয়েছি? বলেছি টিকেট কেটে নিয়ে নাও! ‘

‘ অসভ্য লোক একটা আপনি। ‘

‘ তোমার জন্যই তো। ‘

লজ্জায় মুখ নিচু করে নেয় কুহেলী। সমারোহ কুহেলী মাথায় আলতো করে অধর ছুঁইয়ে দিয়ে বলে, ‘ চলো এবার। ‘

কুহেলী কেক কেটে খাইয়ে দেয় সমারোহকে। খাওয়া দাওয়া করে কুহেলীর হাতে সকালের সেই খামটা ধরিয়ে দেয় সমারোহ। কুহেলী কৌতুহল বশত দ্রুত খামটা খুলে বিষ্ফরিত চোখে তাকায় সমারোহর দিকে। এখানে তার পাসপোর্ট, আমেরিকা যাওয়ার টিকিট আর ওখানের একটা ভার্সিটিতে করা কুহেলীর আবেদনের কপি রয়েছে। কুহেলীর চাহনি দেখে হেসে ফেলে সমারোহ। মুচকি হেসে কুহেলীর কোমর ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলে,

‘ বউ ছাড়া আর থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। ‘

‘ কখন করলেন এগুলো? ‘

‘ ফিরার আগেই! পাসপোর্ট তো আগেই রেডি করে রেখেছি আর আজ সকালে টিকেট এসে পড়েছে। এপ্লিকেশনের মেইলের আন্সার এসেছে কাল। ফাইনাল প্রফ শেষে স্যার এমেলি দিমার্টিনা তোমার একটা ইন্টারভিউ নিতে চান। প্রফ পর্যন্ত তো আছিই। এবার একেবার বউ নিয়েই ফিরছি তাহলে। ‘

কুহেলী অবাক হয়ে শুনে সমারোহর কথাগুলো। সে খুশি হবে নাকি অবাক হবে ভেবে পাচ্ছে না। তবে এই মুহুর্তে সমারোহর প্রতি তার সকল অভিমান যেন বিলিন হয়ে গেছে।
কক্সবাজার বিচের সমুদ্রের ঠিক পাড় ঘেঁষে হাটছে সমারোহ আর কুহেলী। কুহেলীর আঙ্গুলের ভাঁজে জরিয়ে রেখেছে সমারোহ নিজের হাত। জোয়ারের বিশাল বিশাল স্রোত একটু পর পর এসে বাড়ি খাচ্ছে দুজনার পায়ে। কিছু সময় পাড় হতেই ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে স্রোতের টান। কিন্তু কুহেলীর কেনো যেন ভয় করছে না খুব একটা। পাশের মানুষটার উপস্থিতিতে? কে জানে। পূর্ণিমার রাতে জোৎস্না গায়ে মাখিয়ে প্রিয় মানুষটার সঙ্গে একান্তই সময় কাটানোটা রোমাঞ্চকর, আর তা যদি হয় সমুদ্রের গর্জনের মাঝে তাহলে তো কথাই নেই। হাঁটতে হাঁটতে সমারোহ কুহেলীর হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

‘ পানিতে নামবে? আমার কিন্তু খুব ইচ্ছে করছে। ‘

ভড়কে উঠে কুহেলী। জোয়ারের শক্তি বাড়ছে ধীরে ধীরে। হাটুর একটু নিচ অব্দি পানি বারি খাচ্ছে তাতেই তার তাল সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে আর এই লোক এখন বলে কওনা জলে নামতে! কুহেলী শুনেছে রাতে কক্সবাজার সমুদ্র ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। অতো সাহস তার নেই। এদিকে চারপাশ জনমানবশূন্য। কোনো বিপদ ঘটলেও কাউকে পাওয়া যাবে না। কুহেলী বিস্ফরিত চোখে সমারোহর দিকে চেয়ে বলে,

‘ পাগল আপনি? কিভাবে পানি বাড়ছে দেখেছেন? মুহূর্তে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আমার ভয় লাগছে এবার! ‘

‘ আরে এতো ভয় পেলে চলবে? আমি আছি তো, এতো সহজ নাকি তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে! খুব রোমাঞ্চকর একটা অনুভূতি হবে। অল্প সময় থাকবো। ‘

কুহেলী ভয়ে জবুথবু হয়ে বলে, ‘ না প্লিজ। যাওয়ার দরকার নেই। এখানেই এক-দু মিনিট থেকে উঠে পড়ি না! ‘

‘ আমি নিয়ে যাচ্ছি চলো। চোখ বন্ধ করে থাকো ভয় লাগলে। অসাধারণ লাগবে। ‘

কুহেলী আর কথা বাড়ায় না। সত্যি সত্যি ভয়ে চোখ বুঁজে ফেলে। সমারোহ হেঁসে ফেলে ওর কান্ড দেখে। কুহেলীকে নিয়ে আরেকটু গভীরে নেমে যায় পানির। কুহেলীর এবার দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে। ভয়ে সমারোহর গায়ের থাকে একদম মিশে গিয়ে সমারোহর পায়ের উপর দাঁড়িয়ে যায় কুহেলী। সমারোহ পেছন থেকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে তাকে। এবার একটু ঠিকঠাক স্থির করতে পেরেছে সে নিজেকে। কোমর অব্দি পানি, বাতাসের শীত মাদকতা যেন মুহূর্তে বশ করে নেয় কুহেলীকে। একেকটা স্রোত পানির ঝাপটায় পুরোপুরি ভিজিয়ে দিচ্ছে দুজনাকে। কুহেলীর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। চোখ বুঁজে সবটা অনুভব করছে সে।

সমারোহ কুহেলী গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে চুমু খেতেই কেঁপে ওঠে কুহেলী। গলায় অসংখ্যবার চুমু খেয়ে কানের কাছে মুখ নেয় ঝাঁঝালো কন্ঠে একরাশ বিষ ঢেলে দিয়ে বলে,

‘ কখনো ভোর, কখনো মাঝ রাতে, আমার জীবনের প্রতিটা পাতাতে লিখেছি তোমায়। আমি যে তোমার অভাবে কিংবা স্বভাবে মাতাল হয়ে গেছি বউ! আর কতো মাদকতা ছড়াতে চাও তুমি? প্রথম চাহনিতে, তারপর তোমার আধো অবিন্যস্ত কথাতে ঘায়েল করেছো আমার। আমি এবার পুরোপুরি আহতো তোমাতে। আগে তোমাকে একদিন না দেখলে বুকে জ্বালা করতো আর এখন যে তুমি ছাড়া গোটা দুনিয়াটাই আমার শূন্য! কিন্তু তুমি যে বড়ই স্বার্থপর লাজুকলতা! সমারোহকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়ে ঔষধ নিয়ে পালিয়ে গেলে? আমার ধরাছোঁয়ার বাহিরে গিয়ে নিজেকে এতো সুনিপুণ করে সাজালে যে সমারোহ এখন তোমার বিরহে মারা যাচ্ছে! এখন ধরা না দিলে সত্যিই যে তোমার প্রেমিক পুরুষের অকাল মৃত্যু ঘটবে! আমি যে সত্যিই আর তুমিহীনা থাকতে পারছি না। এবার আপনার ব্যাক্তিগত প্রেমিকের কাছে ধরা দিয়ে তাকে ধন্য করুন, মুক্ত করুন এই যন্ত্রণা থেকে কৃষ্ণলতা। ‘

চলবে.