আকাশ মোড়ানো চিরকুট পর্ব-৫৪ এবং শেষ পর্ব

0
640

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
অন্তিম পর্ব.

রজনীগন্ধা ফুলগুলো হীরার মতো চকচকে হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসের ইশারায়। এক পশলা বৃষ্টির পর যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তারা প্রত্যেকে একেকটা নবযৌবনা তরুনীর ন্যায় উচ্ছল৷ কয়েকটা ছোট্ট হলুদ-বেগুনি প্রজাপতিও যোগ দিয়েছে তাদের খেলায়। কুহেলীরও খুব করে মন চাইছে বাগানে গিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে গাছগুলোতে। এখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আছে বাহিরে। সমারোহ বাড়ি না থাকলে হয়তো ছাদে গিয়ে বৃষ্টি ভিজে নেওয়া যেত খানিকটা সময়। ভাবতেই হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেলো কুহেলীর। সেই কবে সে বৃষ্টিতে ভিজেছে! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে ক্যারিয়ার আর সমারোহকে নিয়ে ছোটখাটো ভালোলাগা খারাপলাগা গুলোকে নিয়ে ভেবে দেখার সময়ই হয়নি! সমারোহর সঙ্গে আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছে নয় মাস হলো। এই নয়টা মাস বড়ই তিক্ততার সহিত কেটেছে কুহেলীর। নতুন পরিবেশে নতুন করে খাপ খাইয়ে নেওয়া, ইন্টার্নশীপের ব্যস্ততা, পরিবারের মানুষগুলোর কাছ থেকে এতো দূরে সরে আসা। সবটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে কুহেলীকে। এর মাঝে সমারোহ তাকে একদমই সময় দেয়নি। আসলে দেয়নি এমনটা নয়, দিতে পারেনি। পড়াশোনা নিয়ে সেও খুব ব্যাস্ত ছিল। গতকাল গ্রাজুয়েশনের সার্টিফিকেট পেয়েছে। কুহেলীর খুব গর্ব হয়েছে গতকাল সমারোহর গ্রাজুয়েশন স্রিমনিতে। খুব সুন্দর একটা দিন ছিল। কিন্তু কুহেলীর কিছুতেই মন টিকছে না এখানে। নিজেকে মানিয়ে নিতে গিয়ে খুব বেশি প্রেশার ক্রিয়েট করে ফেলেছে হয়তো। এখন আর কিছুই ভালো লাগে না।

কুহেলীর ভাবনার ছেদ পরে সমারোহর ছোঁয়ায়। কুহেলীকে আলতো করে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে চুলে মুখ গুঁজে দেয় সমারোহ। কুহেলী প্রিয় ছোঁয়ায় চোখ বুঁজে নেয়। সমারোহ কুহেলীর শার্ট ভেদ করে কোমরে হাত ছোঁয়াতেই কেঁপে ওঠে কুহেলী। কুহেলীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

‘ আ’ম সরি বউ। ‘

কুহেলী কিছু না বলে চোখ বন্ধ করেই দাঁড়িয়ে থাকে। সমারোহ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কুহেলীর গলায় ঠোঁট ছোঁয়াতেই সরে যায় কুহেলী। ব্যাস্ততা দেখিয়ে বলে,

‘ আমার মেডিক্যাল যেতে হবে। ব্র্যাকফাস্ট তৈরি করছি আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। ‘

‘ আমি রেডি করে ফেলেছি ব্র্যাকফাস্ট। তুমি আমার কাছে এসো। ‘

সমারোহ হাত বাড়িয়ে কুহেলীকে ধরতে চাইলে আরেকটু দূরে সরে যায় কুহেলী। আমতা-আমতা করে বলে,
‘ আমি গোসল করে নেই আপনি অপেক্ষা করুন একসাথে খাব এসে। পরে লেইট হয়ে যাবে আমার। ‘

সমারোহ এবার জোর করেই কুহেলীকে কাছে টেনে নিয়ে জরিয়ে নেয় বুকে। একদম শক্ত করে। বলে,
‘ যেতে হবে না আজ। আমি ছুটি নিয়ে নিয়েছি ফোন করে। ‘

কুহেলী চমকে যায়। সমারোহ কুহেলীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, ‘ আজ শুধু আমার কাছে থাকবে তুমি। আদর খাবে আমার। ‘

কুহেলী মাথা নিচু করে ফেলে সমারোহর কথা শুনে। সমারোহ হেসে ফেলে কুহেলীর অভিমান দেখে। মেয়েটা যে বড় হয়েছে তা মনেই হয় না। এখনো সেই ছোট্ট আদুরে বউটাই রয়ে গেলো। সমারোহ কুহেলীর চিবুক ধরে মাথা উঁচু করে দিতেই কুহেলী তাকায় সমারোহর চোখে। সঙ্গে সঙ্গে ধ্বক করে উঠে কুহেলীর বুকখানি। সেই প্রেম, সেই অনুভূতিটুকু আবার গ্রাস করে নেয় কুহেলীকে। কেঁপে ওঠে কুহেলী।
এই কদিন সমারোহর চোখজোড়ার দিকে ভালো করে তাকানোর সুযোগটাও হয়নি তার ঠিক মতো। কুহেলীকে দাঁড়িয়ে দুমিনিট দেখা তো দূর, বুকে জরিয়ে নিয়ে ঘুমানোর সময়টুকু হয়নি সমারোহর। কুহেলী বুঝে দোষটা সমারোহর নয়। পড়াশোনা,থাকা খাওয়া কোনোকিছুর জন্য সমারোহ নিজের ফ্যামিলির উপর ডিপেন্ডেড হয়নি। পিএইচডির পড়া কমপ্লিট করে, আরো দুই মেডিক্যালে পার্টটাইম জব করে ইনকাম করে নিজে চলা, কুহেলীর পড়াশোনার খরচ দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে ছেলেটা। রাতে ঘুমানোর সময়ও কুহেলী শুয়ে-বসে অপেক্ষা করতো তার জন্য কিন্তু সমারোহর পড়াই শেষ হতো না। সকালে উঠে স্টাডি রুমে গেলে দেখা যেতো বইয়ে মুখ গুঁজেই ঘুমিয়ে ভূত সমারোহ। দিন হলেই ছুটতো ক্লাস ধরতে, তারপর ল্যাব তারপর আবার প্যাশেন্ট দেখা। ফিরে মস্তমস্ত বইয়ের মাঝে ডুবে থাকা। কুহেলীর সবটা বুঝেও কেনো যেন একদম অবুঝ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। লোকটা তাকে নিজের অভ্যাসে এমন পাগল করে দিয়েছে যে তার বুকে মাথা রাখা ছাড়া কুহেলী ঘুমাতেও পারতো না। নতুন দেশের নতুন আবহাওয়ায় একাকিত্ব গিলে খেতো তাকে।

সমারোহকে আর কিছু বলতে না দিয়ে কুহেলী রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। সমারোহও যায় পিছুপিছু। কুহেলীকে ফ্রিজ থেকে মাছ মাংস নামাতে দেখে অবাক হয়ে বলে, ‘ এতো কিছু নামাচ্ছো কেনো? কেউ আসবে বাসায়? ‘

‘ হুম। আমার দুঃসম্পর্কের বোন কুসুম আর তার হাজবেন্ড আসবেন। ‘

সমারোহ একটু অবাক হয়ে বলে, ‘ আমাকে বলোনি তো! ‘

‘ বলতে গিয়েছিলাম ব্যাস্ত ছিলেন আর…। ‘

‘ কখন পৌঁছাবে? ‘

‘ এই তো দুপুরের আগে। গ্রোসারিতে যেতে হবে একটু। পোলাও চাল, চিংড়ি, মসলা আর টুকটাক কিনাকাটা করা লাগবে। ‘

‘ আল্লাহ! সময় নেই তো একদম! ঘরে তো তেমন কিছুই নেই। আমি বাজার করে নিয়ে আসি তাড়াতাড়ি। তুমি যাবে? না থাক তুমি মাংসটা রান্না শুরু করো আমি এসে পড়বো ততক্ষণে। ‘

‘ কিন্তু আমার কথাটা তো শুনুন। ‘

‘ এসে শুনবো। শালিকা প্রথমবার দুলাভাইয়ের বাড়িতে আসবে, যেনতেন আপ্যায়ন করলে চলবে নাকি! ‘

সমারোহ তাড়াহুড়ো করে চলে যায় বাহিরে। কুহেলী ফিক করে হেসে ফেলে সমারোহর কান্ডে। পরক্ষনেই হাসি উধাও হয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে, ‘ কথাটা না শুনেই চলে গেলেন আবারো। শোনার পর কি রিয়াকশন দিবেন আল্লাহ মালুম। ‘

দুপুরের আগেই চলে আসে তারা। খাওয়াদাওয়া শেষে সমারোহর সঙ্গে আড্ডা দিতে বসেন। গল্পের ফাঁকেই কুসুম বলে উঠে,
‘ ভাইয়া তাহলে এখনের জন্য কিন্তু আপনার বউকে নিয়ে যাচ্ছি আমাদের সঙ্গে। ‘

সমারোহ চমকে কুহেলীর দিকে তাকায়। কুহেলী নিচের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছে। কুসুম আবার বলে উঠে,
‘ আমি কুহেলীকে আগেও কয়েকবার বলেছি আমাদের বাড়িতে এসে কয়েকদিন থেকে যেতে, শুনলোই না। এবার আর কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। ভাইয়া আপনি না করবেন না প্লিজ। আপনাকেও আসতে বলতাম, কুহেলীর কাছে শুনলাম আর দুদিন পর নাকি আপনার নিউ ডক্টর হিসেবে জয়েনিং, এখন ব্যস্ত থাকবেন। তাই ভাবলাম কুহেলীকে নিয়ে যাই সাথে করে। আপনি যখন ফ্রী হবেন নিয়ে আসবেন আর ফাঁকে কুহেলীর ও একটু ঘুরা হলো। ‘

সমারোহ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মৃদু হেসে কুহেলীর দিকে তাকালো একবার। মেয়েটা তো তাকে দেখছে অব্দি না। কি অভিমানরে বাবাহ! এই বউ নিয়ে সে সংসার কেমনে করবে কে জানে। এদিকে কুসুম হা হয়ে সমারোহ দিকে চেয়ে বসে আছে উত্তরের অপেক্ষায়।

ভদ্রতা রক্ষার্থে সমারোহ আমতা-আমতা করে বলে,
‘ না না, আমার আবার কি সমস্যা থাকবে। কুহেলী চাইলে যেতেই পারে। ঘুরে আসুক। ‘

কুসুম খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে কুহেলীকে জোর করে ঘরে পাঠিয়ে দেয় ব্যাগ গোছাতে। দুপুর গরিয়ে রাতে পড়েছে। কুসুম আর তার স্বামী ডিনার শেষে গেস্ট রুমে গিয়েছে ঘুমাতে। পরদিন সকালে তারা রওনা দিবে কুহেলীকে নিয়ে। সমারোহ বিছানায় ফেলে রাখা লাগেজের পাশে বসে কুহেলীকে দেখে চলছে আপন মনে। কুহেলী দৌড়ে দৌড়ে ব্যাগ গোছাচ্ছে। যেন চলে যেতে পারলেই সে বাঁচে। সমারোহ একবার নরম কোমল স্বরে বলে,

‘ চলে যাবে? ‘

‘ আমি থাকলেই আপনার কি? ‘

‘ কিছু না। বউ চলে যাচ্ছে বোনের বাড়ি। বরের দিকে তার কোনো খেয়ালই নাই। ‘

কুহেলীর সমারোহর কান্ডে হাসি পেলেও পাত্তা দেয়না তাকে। গম্ভীর হয়েই থাকে। চুপচাপ ব্যাগ গোছায়। সমারোহ একটু পর আবার বলে, ‘ এমন তাড়াহুড়ো করছো কেনো? মনে হচ্ছে এখনই দৌড়ে চলে যাবে! ‘

‘ এখন গেলে বেশি খুশি হতেন? ‘

‘ খালি ত্যাড়া ত্যাড়া কথা। মধু খাওয়াতে হবে তোমায়। আচ্ছা এতোদিন সময় দেই বলে শোধবোধ নিচ্ছো নাকি বউ? ‘

কুহেলী উত্তর দেয়না। সমারোহ চুপচাপ বসে থাকে। একটু পর অস্থির হয়ে আবার বলে,
‘ এই! না গেলে হয় না? ‘

‘ না। ‘

‘ কেনো? ‘

‘ আপু খুব আশা নিয়ে এসেছেন। তাছাড়া আপনিই তো বড় মুখ করে বললেন নিয়ে যাও। ‘

সমারোহর নিজেকে বকতে ইচ্ছে করে বোকামির জন্য। কেন সে পারমিশন দিতে গেলো? কুহেলী চলে গেলে সে থাকবে কেমনে? একটা দিনও তো তার কুহেলীকে ছাড়া থাকা সম্ভব না! কুহেলীই বা যেয়ে কেমনে থাকবে তাকে ছাড়া। কান্না পাচ্ছে এইবার সমারোহর। কুহেলী ব্যাগে একটা শাড়ি রাখতে আসলে সমারোহ খপ করে ধরে ফেলে তার হাত। টান দিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে দিয়ে গলায় মুখ গুঁজে দেয় কুহেলীর। অসংখ্য ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকে কুহেলীর গলা। কুহেলী চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। খামচে ধরে সমারোহর শার্ট। কতোটা সময় কেটে গেছে তাদের বিয়ের! সমারোহ গভীর আদরে ছুঁয়ে দিয়েছে তাকে বহুবার। অথচ অনুভূতিরা এখনো কতো তাজা। লজ্জারা সেই প্রথম দিনের মতো ছড়িয়ে পরে সারা শরীরে। এখনো সমারোহর স্পর্শগুলোকে চেনা অথচ নতুন মনে হয়। ইশঃ! এমন লাগছে কেনো কুহেলীর! কুহেলী কাঁপা কাঁপা গলায় কিছু বলতে চাইলে সমারোহ মৃদু কামোড় বসিয়ে দেয় কুহেলীর গলায়। গলায় নাক ঘষতে ঘষতে বলে,

‘ এই তুমি বলে দাও তুমি যেতে পারবে না। তোমার অনেক কাজ, অনেক পড়া। তোমার পক্ষে কিছুতেই যাওয়া সম্ভব না। ‘

কুহেলী হেসে ফেলে এবার। সমারোহর প্রতি যত অভিমান আছে যেনো নিমিষেই মিলিয়ে যায়। সমারোহর মাথায় হাত রেখে চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলে,

‘ কিন্তু আমি যে বলে দিয়েছি আমি ফ্রী আছি এখন। ‘

‘ ওফ! কেনো বললে? তাহলে বলে দাও আমি যেতে দিচ্ছি না। ‘

‘ কিন্তু আপনি যেতেন দিলেন কেনো? ‘

‘ শ্বশুরবাড়ির লোক, না বলি কিভাবে? যেওনা প্লিজ, আর কদিনই তো। তারপর বড় ছুটি পাচ্ছি, বাংলাদেশে যাওয়ার আগে অনেক ঘুরাবো তোমাকে। এখন যেও না প্লিজ। না করে দাও না! কালকে না গেলে অনেক আদর করবো কথা দিচ্ছি। ‘

কুহেলী অবাক হয়ে যায় সমারোহর এমন বাচ্চামো কথা শুনে। কি বলেন লোকটা! তার যাওয়ার শোকে পাগল হয়ে গেছে মনে হয়। কুহেলী নিচুস্বরে বলে,
‘ পারমিশন যখন আপনিই দিয়েছেন তখন থাকুন বউ ছাড়া। আমি পারবো না বলতে। ‘

সমারোহ রাগ করে কুহেলীকে ছেড়ে দিয়ে লাইট অফ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে। কুহেলী এসে তার বুকে মাথা রেখে শুতে চাইলে অন্যদিকে ফিরে যায় সমারোহ। এই প্রথম কুহেলী পাশে থাকা স্বত্বেও তাকে বুকে না নিয়ে শুয়েছে সমারোহ। কুহেলীও কিছু না বলে চুপচাপ পেছন থেকে জরিয়ে ধরলো সমারোহকে। খানিকক্ষণ বাদে সমারোহ ও ঘুমের ভান করে জরিয়ে ধরে কুহেলীকে।

সকাল বেলাও কুহেলীর সঙ্গে কথা বলে না সমারোহ। না খেয়েই বের হয়ে যায় স্ট্যানফোর্ডের উদ্দেশ্যে। বিকেল হতে না হতেই সকল কাজ শেষ হয়ে যায় সমারোহর। বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছে করছে না মোটেই। এতোদিন অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকলেও বাড়ি ফিরার জন্য পাগল হয়ে থাকতো সে। ক্লান্ত শরীরে ঘরে প্রবেশ করেই কুহেলীর কপালে একটা চুমু খেলেই যে এনার্জি রিফিল হয়ে যেতো তার। আদুরে বউটা সারাক্ষণ এটা ওটা দেওয়ার বাহানায় ঘুরঘুর করতো চারদিকে। অথচ আজকে যেয়ে দেখবে ঘরটা ফাঁকা। ভাবতেই বুকটা শূন্য শূন্য লাগছে তার। কিভাবে থাকবে সমারোহ সেই ঘরটাতে? ইচ্ছে করে লেইট করে বাড়ি ফিরে দেখে তখন সবে মাত্র সন্ধ্যা আটটা! চাবি দিয়ে লক খুলে ভেতরে ঢুকতেই হাহাকার করে উঠে সমারোহর ভেতরটা। অন্যান্য দিন এই সময় ভরপুর হয়ে থাকে ঘরটা কুহেলীর সুভাসে, অথচ আজ অন্ধকার। ডাইনিং এ লাইট ছেড়ে বেডরুমে ঢোকার সময়ই কেমন কুহেলী কুহেলী ঘ্রাণ নাকে লাগে সমারোহর। সেই! কুহেলীর ঘর থেকে আর কার ঘ্রাণ আসবে! তবে ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালতেই শকড হয় সমারোহ। সাদা জামদানী শাড়ি পরিহিতা এক অপূর্ব মোহনীয় রমনী তার বিছানায় বিভোর ঘুমে মগ্ন। সমারোহর ঠোঁট জুড়ে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। কুহেলী যায়নি। ইশঃ তাহলে সে শুধু শুধুই দুই ঘন্টা লেইট করে বাড়ি ফিরলো কেন! সময় মতো ফিরলে আরেকটু বেশি দেখা যেতো বউটাকে।

সমারোহ নিঃশব্দে কুহেলীর কাছে গিয়ে ভালো করে দেখে তাকে। সাদা শাড়িতে এতোটাই সুন্দর লাগছে তাকে যে সমারোহ পুরোটাই এলোমেলো হয়ে গেছে। তার উপর সুন্দর করে সেজেছে আজ কুহেলী। লম্বা চুলগুলো সাদা বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে এলোমেলো ভাবে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। শাড়ির অবস্থাও খুব একটা ঠিক নেই। সমারোহর অস্ফুটস্বরে বলে উঠে,

‘ মাশাআল্লাহ। ‘

আল্লাহর কাছে মনে মনে সে শুকরিয়া যায় এমন একটা হুরপরীরকে তার ঘরে পাঠানোর জন্য, যে কিনা তার পুরো ঘরটা সারাক্ষণ আলোকিত করে রাখে।

সমারোহ আলতো করে কুহেলীর পাশে বসে কপালে চুমু একে দেয়। তার গলায় মুখ গুঁজে লম্বা শ্বাস নিতেই কুহেলীর ঘুম ভেঙে যায়। হঠাৎ সমারোহকে দেখে ভড়কে গিয়ে চিৎকার করতে নিলেই সমারোহ তার ঠোঁট জোড়া দখল করে নেয়। একটু পরে ছেড়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে আড়চোখে একবার দেখে কুহেলীকে। লজ্জায় যেন মারাই যাবে মেয়েটা। এখনো তাকে এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে সমারোহ বুঝে না। তবে তার লাজুক কুহেলীকেই সবচেয়ে বেশি ভালোলাগে। আয়নায় কুহেলীর দিকে তাকিয়ে ঘড়ি খুলতে খুলতে সমারোহ বলে,

‘ শরীর ক্লান্ত? অসময় ঘুমিয়ে ছিলে যে? ‘

‘ কাজ শেষ করে এসে বসতেই চোখ লেগে গেছে একটু। আপনার পছন্দের সব খাবার রান্না করেছি আজ। ‘

‘ যাওনি কেনো? ‘

‘ আপনি এভাবে রাগ করে চলে গেলে কিভাবে যাই! ‘

‘ আমার সাথে না রাগ করেছিলে? ‘

‘ করেছিই তো। আপনি জানেন আমি বেশিক্ষণ রাগ করতে পারিনা আর সেই সুযোগটাই নেন। ‘

সমারোহ শব্দ করে হেসে ফেলে। শার্ট খুলে কুহেলীর কাছে এসে বলে, ‘ আচ্ছা! তাহলে আজ এতো এতো আদর দেবে যে আর কখনো রাগ করার কথা মাথায়ই আসবে না সোনা। ‘

কুহেলী চোখ বড়বড় করে সমারোহর দিকে তাকিয়ে দ্রুত উঠে যেতে নিয়ে বলে, ‘ সরুন তো। খাবার গরম করছি ফ্রেশ হয়ে আসুন। ‘

কুহেলী দৌড়ে যেতে নিলে সমারোহ খপ করে তাকে জরিয়ে ধরে বলে, ‘ হুম ক্ষুধা লেগেছে তো খুব। ‘

‘ ওফ ছাড়ুন তাহলে! ‘

‘ আজ অন্য কিছু খাবো। ‘

‘ মানে? ‘ অসহায় চোখে তাকে কুহেলী সমারোহর দিকে।

‘ তোমাকে খাবো। ‘

‘ আপনি অনেক দুষ্ট হয়ে যাচ্ছেন কিন্তু। ‘

‘ আমি ভালো ছিলাম কবে? ‘

একটু থেমে কুহেলীকে ভালো করে পরখ করে সমারোহ আবার বলে, ‘ তো আজ এতো সাজলেন কেনো ম্যাডাম? ‘

‘ আ’আপনার জন্য। ‘

কুহেলী লজ্জায় সমারোহর বুকে মুখ লুকায়। সমারোহ মৃদু হেসে বলে, ‘ তোমার লজ্জা এখনো ভাঙে না কেনো? ‘

‘ আপনি এভাবে দেখেন কেনো? ‘

‘ তো আমার জিনিস আমি দেখবো না? তোমাকে আজীবন দেখলেও তো আমার হৃদয় ভরবে না কৃষ্ণলতা। ‘

কুহেলী সমারোহর বুকে হাত রেখে মাথা উঁচু করে সমারোহর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ আমাকে চুপিচুপি চিঠি গুলো আপনি লিখতেন। কিন্তু কেনো? ‘

‘ তোমাকে দেখে কেনো যেনো নিজেকে আটকে রাখা খুব দায় হয়ে যেতো। পাগল পাগল লাগতো নিজেকে। তাই হৃদয়ের অনুভূতিটুকু প্রকাশ করেছি মাত্র। ‘

‘ সামনাসামনি কেনো বলেননি? জানেন আমি কেমন পাগল হয়ে খুঁজতাম এই চিঠির মালিককে! ‘

‘ কেনো খুঁজতে? ‘

‘ জানি না। হয়তো লোভে পরেছিলাম চিঠির মালিককের প্রতি! বলুন না, লুকিয়ে কেনো দিতেন? ‘

‘ ভয় হতো। খুব বেশি ভয় হতো। ভাঙ্গা হৃদয় অনেক কষ্টে জোরা লাগিয়েছি আমি কুহেলী। আবার যদি আমার ভালোবাসার কথা শুনে আমার থেকে দূরে সরে যাও তুমি তাহলে, তাহলে আমার কি হতো! মরে যেতাম আমি। মন ভেঙ্গে যাওয়ার যন্ত্রণা যে অনেক কঠিন কুহেলী। ‘

কুহেলীর চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রুরা এসে ভীর করে। সমারোহ আবার বলতে থাকে, ‘ তোমাকে প্রথম দেখায় ভালোলেগে গেছিলো আমার। জানিনা কিভাবে সম্ভব কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমি রিয়েলাইজ করি আমি তোমাতে পুরোপুরি আসক্ত হয়ে গেছি। পাগল করে দিয়েছো আমাকে তুমি। ভয় পেয়ে সরে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এতোটাই পাগল করে দিয়েছিলে আমায় যে তোমায় একদিন না দেখলে নিজেকে পাগল পাগল মনে হতো। যখন বাবা তোমাকে বিয়ে করার কথা বলেছিলো আমায়, খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে মেনে নিতে পারছিলাম এভাবে বিয়েটা। কিন্তু অনেক আগে থেকে ভালোবাসি আমি তোমাকে। ‘

কুহেলীর কান্নার দমক বেড়ে যায়। শক্ত করে জরিয়ে ধরে সমারোহকে। ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে,
‘ আমিও খুব ভালোবাসি আপনাকে সমারোহ। খুব বেশি ভালোবাসি। আমাকে কক্ষনো আপনার কাছ থেকে দূরে সরাবেন না। সবসময় আপনার হৃদয় আকাশে ভালোবাসার চিরকুটে মুড়িয়ে রাখবেন আমায় কথা দিন। ‘

সমারোহ মুচকি হেসে বলে, ‘ তোমার কাছ থেকে দূরে গেলে তো আমি নিজেই নিঃশ্বাস নিতে না পেরে মারা যাব। তুমি আমার সবটা জুড়ে আছো কুহুপাখি। তোমার কাছ থেকে সামান্য দূরত্বও যে আমার সহ্য হবে না। ভালোবাসি তোমায়। ‘

‘ আমিও ভালোবাসি। ‘

সমারোহ কুহেলীর কানের কাছ মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ তাহলে প্রমাণ দাও! ‘

সমারোহ কন্ঠে ব্যাপক দুষ্টুমির ছোঁয়া। কুহেলী লজ্জা পেয়ে বলে, ‘ ধ্যাত দু্ষ্ট লোক। ‘

‘ যতযাই বলো কোন ছাড়াছাড়ি নাই। ‘

কুহেলী লজ্জায় নুইয়ে পড়ে। সমারোহ হেসে শক্ত করে জরিয়ে ধরে কুহেলীকে। আকাশের বুক চিড়ে পূর্ণিমার বিশাল থালার মতো চাঁদ উঠেছে আজ। চাঁদের মাখনের মতো মোলায়ের আলো বিশাল করিডোর ভেদ করে এসে সিক্ত করে যায় সমারোহ কুহেলীকে। চারদিক মুখরিত হয় তাদের ভালোবাসায়।

সমাপ্ত.