আকাশ মোড়ানো চিরকুট পর্ব-৩০+৩১

0
507

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

৩০.

সকাল হতে না হতেই সৌরভ আর তার মা এসেছেন জহিরের সাথে কথা বলতে। সৌরভের বাবা এখনো মেনে না নিলেও তার মা মরিয়া হয়ে উঠেছেন ছেলের বউ আর নাতিকে ঘরে তুলতে। ভদ্রমহিলা খুব নরম মনের মানুষ বলেই মনে হয়েছে আনরুবার কাছে‌। সৌরভ ক্ষমা চেয়েছে সবার কাছে। তবে বেঁকে বসেছে নয়না‌। বিয়ে সে কাউকেই করবে না‌। সৌরভ নয়নাকে যতটা কষ্ট দিয়েছে সেটা তার নিজের ও ভোগ করা উচিত! আনরুবা নয়নাকে জোর করে না তবে সৌরভের মায়ের ব্যবহারে তিনি মুগ্ধ। বিয়ের সম্পূর্ণ বিষয়টা ঘোলাটে রেখেই ফিরে যেতে হয় সৌরভকে‌। নিজের ভুলের মাশুল খুব বিশ্রী ভাবেই দিতে হচ্ছে সৌরভকে। সৌরভ চলে গেলে নয়না ছাদে এসে বসে। কুহেলী আগে থেকেই ছিল সেখানে। পরীক্ষা শেষ হয়েছে গতকাল। পড়ার চাপ নেই এখন। রাত জেগে পড়ার চিন্তা নেই। ছাদে বসে গল্পের বইয়ে মুখ গুঁজে দিয়ে সময় কাটাচ্ছে। নয়না কে দেখে হাসি মুখে বলে,

‘ কেমন আছো? বাবুটা কেমন আছে বলো? ‘

কুহেলীকে দেখে নয়নার মন প্রফুল্ল হয়। বিস্তর হাসি ফুটিয়ে বলে,

‘ বাবুর আর কি, লাথি দিতে শিখেছে। ‘

কুহেলী হেঁসে ফেলে। নয়না কুহেলীর পাশে এসে বসতেই কুহেলী মিনমিনে গলায় বলে,

‘ আপু সৌরভ ভাইয়ার তো ক্ষমা চাইলো তাও রাজি হচ্ছো না কেনো? ‘

তপ্তশ্বাস ফেলে আকাশে মেঘের ভাঁজে দৃষ্টি হারিয়ে নয়না বলে,

‘ আমার আর কিছুই ভালো লাগে না কুহেলী! তোমার কথা মতো আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি, কোরআন শরীফ পড়ি, মনে ব্যাথা হলে নফল নামাজ পড়ি, পর্দা করি। আমার মন শান্ত হয়, কষ্ট দূর হয়। আর কিছুরই দরকার নেই। এখন আমার সন্তান পৃথিবীতে এলে আমি তাকে কোরআনের হাফেজ বানাতে চাই। ইসলামের পথে রাখতে চাই, ভালো মানুষ বানাতে চাই। সৌরভ আমার সন্তানকে এখনো মনে থেকে মেনে নিতে পারেনি। ওর চোখে আমি আমার সন্তানের জন্য ভালোবাসা,স্নেহ খুঁজে পাইনা। পাই কেবল আমার প্রতি মোহ, আকর্ষণ। ‘

কুহেলী অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। নয়নার এতোটা পরিবর্তন হবে সে ভাবেনি। আগের অগোছালো নয়না এখন অনেক বুঝের হয়ে উঠেছে। আসলে প্রতিটা মানুষের জীবনে আল্লাহ তায়ালা নিজেই বিপদ দুঃখ কষ্ট দেন তাতে তারা তাদের সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে তাঁর কাছাকাছি থাকতে পারে‌। যারা এই বিপদের পেছনে তাদের সৃষ্টিকর্তার মঙ্গল খুঁজে নিতে পারে তারা সৎ পথে চলতে শেখে আর অন্যরা হয় বিপথগামী। নয়নার তার প্রভুকে চিনেছে। প্রভুর প্রেমের কাছে দুনিয়াবি সকল কিছুই তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ। নয়নার মুখে এখন নূরানী ছাপ দেখতে পায় কুহেলী। তবে সামান্য সংকিত হয়। বলে,

‘ উনার মা এসেছিলেন। তাকে আমার ভালো মনে হয়েছে। ‘

‘ নরম মনের মানুষ আন্টি। ছেলে যা বুঝাবে তাই বুঝবে। সৌরভের চোখে যেদিন আমাদের দুজনের জন্য ভালোবাসা থাকবে সেদিন আমি তার কাছে যাব। এখন ঠিক করেছি বাবু হলে সরকারি চাকরির জন্য এপ্লাই করবো। পড়াশোনা শুরু করেছি। আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ‘

‘ এটা খুবই ভালো হবে। সুন্দর সিদ্ধান্ত নিয়েছ। ‘

নয়না কুহেলীর দিকে ফিরে তার হাত দুটো ধরে অতি বিনয়ের সাথে বলে,

‘ আমার এই পরিবর্তনের সবটা ক্রেডিট তোমার। তুমি আর আম্মা যদি সেদিন আমার পাশে না দাঁড়াতে আমি হয়তো আত্নহত্যাই করে নিতাম‌‌। ‘

নয়নার চোখে জল চলে আসে। কুহেলী স্থির বসে থাকে। নয়নার হাত শক্ত করে ধরে বলে,

‘ জীবনকে তার মতো চলতে দেয়া উচিত। খারাপ কিংবা ভালো, আমরা কেবল উপভোগ করতে পারি আপু। আব্বা আমায় সবসময় বলতেন, তুমি ভালো থাকলে দশ জন খারাপ ও তোমার কাছে এসে ভালো-সহজ হবে। ‘

‘ হুম। তুমি খুব মিস করো না আঙ্কেল কে! ‘

ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে কুহেলীর মুখ। থমথমে স্বরে বলে,

‘ খুউব। আমার আব্বা আমার সবচেয়ে প্রিয়।’

নয়না হাঁসে। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,

‘ বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেছে না সেঁজুতিকে ছাড়া! আবার ক’দিন পর তুমি নাকি যাবে বাড়িতে ,তাহলে তো মনে হবে বাড়ি শূন্য! কেমনে কাটবে সময়? ‘

কুহেলীর মন খারাপ হয়। পরীক্ষার পর কলেজ বন্ধ পনেরো দিনের জন্য। ফ্রি সময়টাতে কুহেলীকে গ্রামে নিয়ে যাবে সমারোহ। ব্যাগপত্র গোছানো শেষ। তবে এই বাড়ির সবার জন্য মন খারাপ হবে খুব করে। কুহেলী জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘ বাবু হওয়ার আগেই এসে পড়বো কিন্তু। ‘

‘ তা না আসলে তো তোমার খবর আছে। জানো কুহেলী আজ চার মাস হয়ে গেলো সমারোহ ভাইয়া আমার সাথে কথা বলে না। ভাইয়ার মনটা আমি টুকরো টুকরো করে ফেলেছি। সান্দ্র ভাইয়াও প্রয়োজন ছাড়া একটা ওয়ার্ড ও বলে না। ওদের সামনে পড়লেই লজ্জায় কান্না পায় আমার। ‘

‘ চিন্তা করো না আপু। বাকিটাও ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে তারা একটু বেশিই ভালোবাসে তাই অভিমান ভাঙ্গতেও সময় লাগছে বেশি। ‘

‘ আমাকে ভাইয়া মাফ করতে পারবে তো! ‘

আতঙ্কে চেহারার রং পাল্টে যায় নয়নার। তার বাচ্চাকে যদি মেনে না নেয়! মামার আদর থেকে বঞ্ছিত হবে তার সন্তান। এখন নয়না কে দেখেই বিরক্ত হচ্ছে তারা। আর যখন সারা বাড়িতে নয়নার সন্তান তার ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হেঁটে বেড়াবে তখন কি মায়ায় মন গলবে তাদের! নাকি আরো বাড়বে? নয়নার ভাবনায় ছেদ পড়ে কুহেলীর কন্ঠস্বরে।

‘ যাকে আমরা ভালোবাসি তার প্রতি অভিমান করা যায়, রাগ না আপু। আর অভিমান এক না একদিন ভাঙবেই। তাই অত চিন্তা করো না। ‘

‘ ইনশা’আল্লাহ। ‘ ,নয়না চোখে জল স্পষ্ট।

সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় শ্বাশুড়ির কাছে এক গাধা কথা শুনে ফেলেছে সেঁজুতি। দ্রুত গোসল করে শাড়ি পড়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়তেই হিরণ ঘুম ঘুম চোখে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। সেঁজুতির কাঁধে মুখ লুকিয়ে শাড়ির ভাঁজে হাত ডুকিয়ে উন্মুক্ত পেটে হাত বুলায়। সেঁজুতির চোখ মুখের রং পাল্টায়। মন বিষিয়ে আছে তার। ঘটা করে কথা শুনিয়ে দিতে নিলেও হিরণের ঘুম সিক্ত মুখ থেকে ভাষা হারিয়ে ফেলে সেঁজুতি। কতো সহস্র মায়া সে চেহারায়! সেঁজুতি চোখ সরিয়ে নেয় হিরণের থেকে‌। এর ফাঁকেই হিরণ কয়েকবার চুমু খেয়ে নেয় সেঁজুতিকে। সেঁজুতি জোর পূর্বক হেসে তাড়া দেখিয়ে বলে,

‘ এই ছাড়ুন এখন। মা রেগে আছেন হয়তো। এখনি যেতে হবে। ‘

হিরণ সেঁজুতির কথায় পাত্তা না দিয়ে আহ্লাদী সুরে বলে,

‘ উঁহু, কিচ্ছু হবে না। আমি দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে তো আম্মু আমাকে মারতেন। এটা আম্মুর বৈশিষ্ট্য। ‘

‘ বেশ করেছেন। এখন যাই আমি। ছাড়ুন বলছি। ‘

‘ তুমি বড্ড খারাপ সেঁজুতি। যতবার আদর করতে আসি খালি বাহানা! ভাল্লাগে না। ‘

সেঁজুতি ততক্ষণে হিরণ থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে নিজেকে। চোখ রাঙিয়ে বলে,

‘ যান এক্ষুনি গোসল করতে যান। ওয়াশরুমে তোয়ালে আর সোফায় আপনার অফিসের ড্রেস গুছিয়ে রেখেছি। মা একা কতো কাজ করবেন বলুন তো। আমি যাই একটু সাহায্য করি। ‘

হিরণ প্রতিউত্তরে হাসে। পরম যত্নে সেঁজুতির কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে,

‘ দিনের সকল কাজ সহজ হোক তোমার। ‘

‘ আপনারো। ‘ , মুচকি হাসে সেঁজুতি।

বাহিরে রান্নাঘরে এসে দেখে শ্বাশুড়ি মা সকালর নাস্তা তৈরি করে ফেলেছে। খাওয়া শেষে হিরণ আর হাসিন চলে যায় অফিসে। সেঁজুতি দুপুরের খাবার রান্না করে সবার জন্য। ঘরদোর গুছিয়ে গোসল সেরে নামাজ পড়তে পড়তে বেলা তিনটা বেজে যায়। বাড়ির সবার খাওয়া শেষ। শরীরে এতোটা ক্লান্তি এসে ভর করেছে যে খেতেও ইচ্ছে করছে না‌। এতো কাজের অভ্যাস তার নেই। বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিতেই ফোনের রিং টোন বেজে উঠে। আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। সেঁজুতি ভ্রুঁ কুঁচকে রিসিভ করে কাট কাট গলায় বলে,

‘ কে বলছেন? ‘

‘ আপনি সেঁজুতি আপু? ‘

‘ জ্বি, আপনি? ‘

‘ আমি জীতু ভাইয়ার ছোট বোন আপু। তোমার একটু সময় হবে? পাঁচ মিনিট হলেই হবে। ‘

জীতুর নাম শুনে কপাল কুঁচকায় সেঁজুতি। বুকের লুকিয়ে রাখা এক মুঠো অপ্রত্যাশিত আঘাত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মুহূর্তেই চোখের কার্নিশে অশ্রুকন্যারা এসে জমা হয়। সেঁজুতিকে চুপ থাকতে দেখে অপর পাশের নারী কন্ঠটা বলে,

‘ আপু, জীতু ভাইয়া বলেছিল আপনার সাথে মায়ের দেখা করিয়ে দিবে চাকরিটা হয়ে গেলেই। বিয়ের অনেক কেনাকাটাও হয়ে গিয়েছে। ভাইয়া খুব উত্তেজিত ছিল আপু। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ তার আচরণ কেমন যেন হয়ে গিয়েছে। চাকরির জয়েনিং এর দিনও অফিসে যায়নি। কাল বলছে চাকরি নাকি করবে না, বেকার থাকবে। বিয়েও করবে না। আপু ভাইয়াকে নিয়ে বাসার সবাই খুব বেশি টেনশন করছে। যদিও আমি ছোট তাও মা এতোবার করে বলল তোমার সাথে কথা বলিয়ে দিতে‌। তোমাদের মাঝে কিছু হয়েছে আপু? ‘

সেঁজুতি স্থির বসে থাকে। জীতু চাকরি করবে না? বি.সি.এস. পিকেও না! সেঁজুতির কষ্টগুলো দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে কেনো? কি ভুল করছে সে? অপর পাশ থেকে আরো কয়েকবার সতর্কডাক দিলে সেঁজুতি বুকে পাথর চেপে বলে,

‘ আমি এখন বিবাহিত। তোমার ভাইয়ার ভুলের জন্যই আমার তাকে ছাড়তে হয়েছে। আমাকে আর কখনো ফোন দিওনা আপু। ‘

ফোন রেখেই সজোরে কেঁদে উঠে সেঁজুতি। হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে। একটু বাদেই হিরণ ফোন দিলে রিসিভ করে। হিরণ বেশ চাঞ্চল্য দেখিয়ে বলে,

‘ বউটার খাওয়া হয়েছে? ‘

‘ না। আপনার? ‘

সেঁজুতির কাট কাট গলা। হিরণ হো হো করে হেসে উঠে। বলে,

‘ বউকে না খাইয়ে কি করে খাই? এক্ষুনি খেয়ে নাও সোনা। ‘

সেঁজুতির মেজাজ বিগড়ে যায়। রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলে,

‘ আমার কি কোনো নিজস্বতা নেই নাকি? শুধু আপনাদের কথায় চলতে হবে? কিনে নিয়েছেন নাকি আমাকে? আমার যখন ইচ্ছা করবে খাব। যত্তসব! ‘

ফোন কেটে দেয় সেঁজুতি‌। খানিক বাদেই মন পুড়ে। লোকটা তার খবর নিচ্ছিল, কতো সুন্দর করে বললো! যে মানুষটার জন্য হিরণের সাথে খারাপ আচরণ করেছে সে কোনদিন সেঁজুতির খাবারের খবর নিয়েছে কিনা জানা নেই। কি অসভ্যের মতো আচরণ করলো!

সারাটা দিন সেঁজুতির মন খারাপ ছিল। হিরণ ও আর ফোন দেয়নি। রাতে বাড়ি ফিরে সেঁজুতির হাতে টাটকা গোলাপ ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে কপালে চুমু খায়। সেঁজুতি অবাক হয়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে হিরণের দিকে তাকালে বিস্তর হেসে সে বলে,

‘ ছোট বেলা দেখতাম আম্মু রাগ করলে আব্বু ফুল দিয়ে রাগ ভাঙাতো। আমার বউয়ের রাগও তাই একটু ভাঙ্গানোর চেষ্টা করলাম মাত্র। ‘

সেঁজুতি হতবিহ্বল হয়ে যায়। অবাক হয়ে চেয়ে রয় কিছু মুহূর্ত তারপর হঠাৎই চোখ ছাপিয়ে জল নামে তার। হামলে পড়ে হিরণের বুকের শার্ট চোখের জলে ভিজিয়ে দেয়।

ঝুম বৃষ্টিকন্যারা মেঘের সঙ্গে আড়ি করে ঝড়ে পড়ছে প্রবল বিষন্নতা নিয়ে। বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে শক্তিশালী ঝড়ো হাওয়া ছুটে চলেছে নিজের খামখেয়ালিতে। বৃষ্টিকন্যারা স্বাধীনতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে ব্যস্ত চট্টগ্রাম শহরের সকলকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। লোডশেডিংয়ের আঁধারে তলিয়ে যাওয়া স্টেশনের দূরপাল্লার পথযাত্রীরা মাথায় ছাতা ধরে আর অপর হাতে ব্যাগপত্র চেপে ধরে ছুটছে গাড়ির দিকে। সবার চোখে মুখে বিরক্তির রেশ। বৃষ্টিতে আধভেজা শরীরটুকু কিভাবে শুকনো করা যায় এই নিয়ে শত চিন্তা। স্টেশনের এক কর্নারে মাথায় ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে কুহেলী। বিশাল ঝড় হয়েছে আজ বিকালে। ফলে রেলওয়ে স্টেশন থেকে বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এতো সময়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাতে আবার ঝড় শুরু হবে বলে মনে হচ্ছে।

রাত নয়টার ট্রেন ধরে ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল সমারোহ আর কুহেলীর। তখন বৃষ্টি ছিল না, স্টেশনে আসার পর থেকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে, ক্রমে বেড়েই চলেছে। স্টেশনে মানুষজন কম। গা ছমছমে পরিবেশে কেবল বৃষ্টির শব্দ ঝুম ঝুম ঝুম টুপ টুপ টুপ তালে তাল দিয়ে যাচ্ছে। কিছু সময় বাদেই ঠান্ডা লাগতে শুরু করে কুহেলীর। ব্যাগে শীতের কাপড় আছে কিন্তু ব্যাগ সমারোহের হাতে। গিয়ে বলবে তাতেও আড়ষ্টতা বোধ হচ্ছে কুহেলীর। শরীর আধভেজা। সমারোহর কাছ থেকে ততটা দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। কুহেলী তাই শীত সহ্য করেই দাঁড়িয়ে থাকে।

অনেকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সমারোহর চোখে পড়ে বিষয়টা। একবার ভাবে তার গায়ের জ্যাকেট খুলে দিয়ে আসবে। আবার কি ভেবে যেন কুহেলীর কাছে গিয়ে বলে,

‘ শীতের কাপড় এনেছো? ‘

কুহেলী মাথা উপরনিচ ঝাঁকায়, মানে এনেছে।সমারোহ ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘ নামিয়ে পড়ে নাও একটা। ‘

কুহেলী খুব দ্রুত একটা চাদর নামিয়ে জড়িয়ে নেয় গাঁয়ে। ট্রেন আসে এগারোটার পর। ট্রেনে ওঠে ব্যাগপত্র রেখে সিটে বসে পড়ে কুহেলী। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পা ধরে গিয়েছে। পুরো একটি কেবিন নিয়েছে সমারোহ। ট্রেনে উঠেই দুইটা বড় বড় ব্যাগ সিটের উপর রেখে দিয়ে সমারোহ তাড়াহুড়ো করে বলে,

‘ দরজাটা আটকে দাও। আমি আসলে তোমার নম্বরে কল করবো তারপর খুলবে।আর কেউ নক করলেও খুলবে না। পুরো কেবিনটাই আমাদের,সো কেউ আসবেও না। আমি কিছু শুকনো খাবার নিয়ে আসি গিয়ে। ‘

কুহেলী চুপচাপ শুনে। সমারোহ যাবার পর দরজা আটকে কল করে আনরুবাকে। আনরুবা ফোন ধরেই চিন্তিত কন্ঠে বলেন,

‘ ট্রেনে উঠছো মা? আমার তো খুব টেনশন হইতেছে। কি রুপ আকাশের! কি বৃষ্টি! ‘

‘ হ্যা আন্টি উঠেছি। একটু পরেই ট্রেন ছাড়বে। আপনি চিন্তা করবেন না একদম। ‘

কথাটা বলে কুহেলী সামান্য হাসে।আনরুবা বিড়বিড় করে বলে,

‘ সাবধানে যাও। ঝড়বৃষ্টির দিন, ছেলেমেয়ে বাইরে থাকলে তো চিন্তা হবেই। ‘

এরপর কল কেটে যায়। আনরুবা রেখে দিলেন নাকি নেটওয়ার্কের সমস্যা বুঝে ওঠে না কুহেলী। চুপচাপ বসে থাকে। সমারোহ চিপস, কেক আর পানি নিয়ে আসে। ততক্ষণে ধীর গতিতে ট্রেন ছেড়েছে। দরজা আটকে ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে কুহেলীর সামনের লম্বা সিটে শুয়ে পড়তে শুরু করে। কুহেলী একদৃষ্টিতে দেখে সমারোহকে। মানুষটা নিজের চারদিকে মোহের পসরা সাজিয়ে রাখে যেন সবসময়। যা কুহেলীকে তাকে পছন্দ করতে বাধ্য করে। তার থেকেও বেশি বিমোহিত করে সমারোহের নগ্ন তরবারির ন্যায় ধারালো ব্যক্তিত্ব। সন্দিহান-অবাক চোখে চেয়ে দেখে কুহেলী তাকে। কুহেলী যে তাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে তাতে কোনো মাথাব্যথাই নেই সমারোহের। সে চুপচাপ শুয়ে পড়ছে তো পড়ছেই। পুরো দুনিয়া রসাতলে গেলেও এখন তার ধ্যান ফিরবে না। কুহেলী পাঁচ মিনিট সমারোহকে দেখেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আরো অনেক অনেক দেখতে ইচ্ছে করে সমারোহকে। কিন্তু নিজের লজ্জার কাছে হার মানতেই হয়। হিড়হিড় করে কাঁপে তার শরীর। ঠান্ডায় নয়, লজ্জ্বায়! অঘোষিত অনুভুতির বেড়াজালে ফেঁসে গেছে সে। সমারোহ হচ্ছে কুহেলীর মধ্যকার সকল চিন্তাশক্তি কেড়ে নেয়ার দারুন কৌশল। অসহ্য মায়াবী লোক একটা! মুচকি হাসে কুহেলী, আপনা আপনি হাসে, কারণ ছাড়াই হাসে। অল্পবয়সী মেয়েদের নাকি আবেগ বেশি হয়। অকারণে দাঁত খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে লতারশ্মির মতো শরীর দুলিয়ে নিতে বোধ হয় তাদের ভালোলাগে। তবে কুহেলি মিটিমিটি হাসে। সেই হাসি সমারোহের চোখ এড়ায় না। সুপ্ত ভালোলাগার অনুভূতিটা স্পর্শ করে দুটি মনকেই, তবে একে অপরের অগোচরে।

কুহেলী চোখ সরিয়ে নেয় সমারোহের উপর থেকে। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাতেই চোখ চলে যায় বহুদূরে। রিমঝিম বৃষ্টিগুলো ট্রেনের গতির সাথে পেড়ে উঠছে না। ট্রেন এখন চিটাগাং শহরের শেষ প্রান্তে। তেমন বৃষ্টি নেই। দূরের সবুজ ক্ষেতগুলো যেন রাতের আঁধারে ঘন কালো গহ্বরের মতো মনে হয়। তার কিছু দূরে গৃহস্থদের বাড়ির সামনে জ্বালানো লন্ঠন বাতি চিকচিক করে কিছু অংশকে আলোকিত করে রেখেছে। তার পরে আরোও অনেক দূরে পাহাড়। পাহাড় গুলো যেন কৃষ্ণগহ্বরের ন্যায় আঁধার চিবিয়ে খায়। আকাশ তখনো মুখ রাশভারী করে রেখেছে। কুহেলীর আবার হাসি পায়। আকাশ যেন তার সনে কথা বলে! গায়ের চাদরটা আনমনে আরো শক্ত করে নিজের গায়ে জড়িয়ে মনে মনে আকাশকে বলে,

‘ এতো কাঁদার পর ও মন ভালো হচ্ছে না। অভিমান বড্ড বেশি হয়েছে বুঝি? যে অভিমান ভাঙাতে পারে না তার সাথে অভিমান করোই কেন শুনি? ‘

আকাশের কোনো উত্তর নেই। ধীরে ধীরে অভিমানের পাল্লা হাল্কা হতে থাকে। মেঘের আনাগোনাও কমে। সিটের উপর হাঁটু ভেঙে বসে আকাশ মেঘের মান অভিমান দেখতে দেখতেই ঘুমের সাগরে ডুব দেয় কুহেলী।

ঘুম ভাঙতেই কুহেলী আশেপাশে, সামনে তাকায়। কাঁচা ঘুম ভেঙে গিয়েছে। পুরো কেবিন অন্ধকার। সে এখন ট্রেনের কেবিনে আছে সেটা বুঝে উঠতেও বেশ সময় লাগে। সামনে ভালোমত খেয়াল করার পর দেখে সমারোহের তৃষ্ণার্ত চোখদুটো তাকে দেখছে। ঘুমের ঘোরে আবারো চোখ বুজে নেয় কুহেলী । সমারোহ তাকিয়ে আছে টের পেতেই আবার হুরমুড়িয়ে ঠিক হয়ে বসে।মুহুর্তেই ঘুম উড়ে যায় চোখের। উঠে বসে গাঁয়ের উরনা ঠিক করে নেয়। চারপাশে তাকিয়ে দেখে ট্রেন থেমে আছে। বাহিরে কোনো স্টেশন দেখা যাচ্ছে না। যতদূর চোখ যায় শুধু অন্ধকার। আকাশ পরিষ্কার। ট্রেন হয়তো কোনো ক্ষেতের পাশে থেমেছে। কিন্তু কেন? সাধারণত এরকম স্থানে ট্রেন থামার কথা নয়। সমারোহ তখনো কুহেলীকে দেখছে। কুহেলী সমারোহের দিকে তাকাতেই আবার লজ্জ্বায় চোখ নামিয়ে নেয়। লাজুক কন্ঠে বলে,

‘ এভাবে কি দেখছেন? ‘

থতমত খেয়ে যায় সমারোহ, দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয় কুহেলীর থেকে। চোখের মণি অস্থির হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ইনোসেন্ট কন্ঠে বলে,

‘ না মানে, তোমাকে ডাকছিলাম। ‘

‘ কেনো? ট্রেন থেমে আছে কেনো? ‘

সমারোহ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে স্পষ্ট গলায় বলে,

‘ সম্ভবত ঝড়ের কারণে সামনে রেললাইন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ঠিক করার কাজ চলছে। দু তিন ঘন্টায় সেরে যাবে। ‘

‘ দু-তিন ঘন্টা! সেতো অনেক সময়! কতক্ষন থেকে থেমে আছে? ‘

‘ হবে আধঘন্টার মতো। ‘

সমারোহ কুহেলীর দিকে কেক আর পানি এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘ ক্ষুধা লেগেছে হয়তো তোমার, কেক আর পানি ছাড়া ভারী কিছুই পেলাম না সেখানে। ‘

এগিয়ে দিয়েই আরেকটা প্যাকেট ছিড়ে খেতে শুরু করে সমারোহ। কুহেলী বিনা বাক্যে নেয় সেগুলো। পেটে যেন ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। খাওয়া শেষ হতেই সমারোহ বলে,

‘ অমাবর্ষ্যার রাত, বৃষ্টিও নেই এখন,আকাশ ফকফকে পরিষ্কার। অনেকেই নেমে হাঁটছে, বাহিরে যাবে? ভালো লাগবে। ‘

সমারোহর কথাটা বলতে দেরি হলেও কুহেলীর ‘হ্যা’ বলতে মোটেই দেরি হয় না।লাফিয়ে উঠে সে বলে,

‘ হ্যা যাবো। ‘

বলে অবশ্য নিজেই লজ্জা পেয়ে যায় বেশি এক্সাইটেড হয়ে গেছে বলে। সমারোহ হাসে কুহেলীর পাগলামিতে। বিড়বিড় করে বলে,

‘ পাগলি মেয়ে একটা! ‘

ট্রেন থেকে নেমে চারপাশের প্রকৃতি দেখে সচকিত হয় কুহেলী। স্নিগ্ধ, মনোরম চারদিক। কারো রা’ নেই। মানুষ হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর অব্দি চলে গেছে। কুহেলী ফকফকে আকাশে তারার মেলা দেখতে পায়। এতো এতো তারা সে ছোটবেলা তার গ্রামে দেখতে পেতো। চিটাগাং এ এতো ঝড় হচ্ছে অথচ এখানে বৃষ্টির নামগন্ধও নেই। জায়াগাটা কোথায় সে জানে না। সমারোহকে জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছা করে না। যতদূর চোখ যায় চারিদিকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সব। অনেক দূর অব্দি সরিষা আর অন্যান্য ফসলের ক্ষেত, রেললাইনের দুই দিকে বুনো ফুল গাছে ভর্তি। অনেক দূরে জোনাকি পোকার আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতি কৃষ্ণগহ্বরের অতলে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে যেন নৈস্বর্গিক ভালোলাগার সৃষ্টি করেছে। সমারোহ একদম কুহেলীর কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকে পকেটে হাত গুঁজে। সময়টা উপভোগ করার মতো। কুহেলী কয়েকটা বুনো ফুল ছিঁড়ে এনে সমারোহর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

‘ হাত পাতুন। ‘

সমারোহ ভ্রুঁ কুঁচকে হাত মেলে দেয়। কুহেলী ফুলগুলো সেখানে রেখে মুহূর্তেই খুব সুন্দর একটা ব্রেসলেট বানিয়ে ফেলে। পড়ে নেয় নিজের হাতে। সমারোহর বিস্তর হাঁসি পায় কুহেলীর কান্ডে। কুহেলীকে হাত দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে বলে ,

‘ ওইদিকটাতে ছোট একটা নদী আছে, যাবে? হেঁটে গেলে একটু সময় লাগবে, ক্ষেতের আল ধরে যেতে হবে। কিন্তু খুব সুন্দর হবে মনে হচ্ছে। ‘

কুহেলী সম্মতি দেয়। রেল লাইনের পাশে উঁচু স্থান থেকে নেমে আসে দুজন। দুই পাশে ফসলের ক্ষেত আর মাঝে সরু মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে। অনেকটা রাস্তা যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে কুহেলী। তাও হেঁটে চলে, সুন্দরের আশায়। হঠাৎ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ট্রেন থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে ওরা। প্রায় আধঘন্টা হাঁটার পর গন্তব্যে এসে পৌঁছায়। ঝোপঝাড়ের পর ফাঁকা নদীর পাড়, নিচে শুকনো ঘাস। ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে জোনাকি পোকাগুলো এখানেই দেখেছিল কুহেলী। তবে দেখতে খুব কাছে মনে হয়েছিল কিন্তু বাস্তবে তা নয়। নদীর পাড়ের সৌন্দর্য দেখে এক কথায় মুগ্ধ হয়ে যায় সমারোহ। কুহেলী ক্লান্ত হয়ে ঘাসের উপর বসে পড়ে। সমারোহ তা দেখে হেসে বলে ,

‘ তুমি না গ্রামে বড় হয়েছ? এতটুকুতেই হাঁপিয়ে গেলে? ‘

কুহেলী আমতা আমতা করে বলে,

‘ পায়ে কাঁটা বিঁধেছে আমার। ‘

বলার সাথে সাথে পা থেকে কাঁটাটা টেনে বের করে ফেলে। সমারোহের ভ্রু কুঁচকে আসে। দ্রুত মোবাইলের জ্বালানো আলো পা’য়ের দিকে ধরে বলে,

‘ সেকি! আমাকে বলোনি কেন? কাঁটা পায়ে নিয়েই এতদূর পথ হেঁটে চলে এলে। আচ্ছা সাহসী মেয়ে তো তুমি! ‘

‘ ও কিছু না। গ্রামে থাকতে কত কাটছে এরকম। সেরে যাবে। ‘

সমারোহ পাত্তা দেয় না কুহেলীর কথার। রুমাল দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করে বেঁধে দেয়। কাট কাট গলায় বলে,

‘ আমার ব্যাগে ফার্স্ট এইড কিট আছে। গাড়ি পর্যন্ত একটু কষ্ট করে চলো আমি ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি। ‘

‘ এসেছি,এখনো চলে যাবো? ‘

‘ এই পা নিয়ে হাঁটতে পারবে? ‘

‘ দিব্যি পারবো। ‘

বলতে বলতে ওঠে দাঁড়ায় কুহেলী। সমারোহ ভ্রু কুঁচকে হাসে কুহেলীর কান্ড দেখে। আরো একটা কাপল এসেছে এখানে। তারা তাদের মত করে ঘুরছে। নদীর স্বচ্ছ কালো পানি হাওয়ায় টলমল করছে। পাড়ে দুটো ডিঙি নৌকা বাঁধা। কুহেলী জিদ করে বসে সে নৌকায় উঠবে। নৌকার উপর দাঁড়িয়ে আকাশ দেখার মজাই অন্যরকম। ঠান্ডা বাতাস কাঁপুনি ধরিয়ে দেয় হাড়ে হাড়ে। নৌকার একদম শেষ কর্নারে গিয়ে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে কুহেলী। সমারোহ বসে কুহেলীর পাশে। তবে পা ভেজায় না, পা ভাঁজ করে বসে। কুহেলী হাতের চলন এদিক সেদিক করে বিভোর হয়ে আছে জোনাকি ধরতে। সমারোহ দুটো জোনাকি ধরে কুহেলীর চুলের ফাকে গুজে দেয়। কুহেলী হেসে বলে,

‘ জানেন ছোটবেলা নয়টা বাজতেই পড়াশুনা শেষ করে ঘুমিয়ে ভুত হয়ে যেতাম আমি।রাত জাগতে পারতাম না একদম। মাঝে মাঝে রজব ভাই জোর করে ডেকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতো মাছ ধরবে বলে। ঘুষ হিসেবে অনেকগুলো জোনাকি ধরে আঠা দিয়ে চুলের ক্লিপে লাগিয়ে দিত। জোনাকির ক্লিপ। ওই জোনাকির ক্লিপের লোভে আমিও যেতাম তার পিছুপিছু। হিহিহি! ‘

বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে মেয়েটা। সমারোহর প্রগাঢ় দৃষ্টি ছুঁয়ে যায় কুহেলীর গভীর নেশালো ঠোঁট। সমারোহর নিজেকে উন্মাদ মনে হয়। মোহের ঘোরে মিশে গিয়ে সমারোহ কুহেলীর ভেজা পা নিজের ঊরুতে তুলে নিয়ে গভীর যত্নে পড়িয়ে দেয় সেদিনের নূপুর জোড়া! পায়ে চুমু খাওয়ার সুপ্ত বাসনা জাগে হৃদয়ের সর্বো গোপন কুঠুরিতে তালাবদ্ধ অনুভূতির তাড়নায়।

চলবে.

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

৩১.

কুহেলীর নাক-কান-গাল রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার রূপ ধারণ করে সমারোহর চাহনি দেখে। বুকের ধিপ ধিপ শব্দ হয়তো সমারোহর কান অবধি পৌঁছে যাবে! হৃৎস্পন্দন মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছে। কুহেলীর নিজের কাছেই নিজেকে বেসামাল মনে হচ্ছে। কালো পানির মৃদুমন্দা স্রোতের পানে টলমলে অস্থির চোখের চাহনি তার। শরীর জমে গিয়েছে। সমারোহর দেয়া উপহার কুহেলীর হৃদয় কাঁপিয়ে তুলেছে। এই নূপুর সেদিন সে দেখেছে। তবে প্রাপ্তির অপেক্ষার প্রহর এতো দ্রুত কাটবে বুঝে উঠতে পারেনি। কুহেলী পানিতে পা ভিজিয়ে জামার উরনা একবার আঙ্গুলে প্যাঁচায় আরেকবার খোলে। সমারোহ হঠাৎই কুহেলীর হাত চেপে ধরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার তিন চারটে লাইন বলে। কুহেলী চমকে তাকায় সমারোহর দিকে। কবিতা খানি বেশ অশ্লীল মনে হয়েছে তার কাছে। সমারোহ এক নজরে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে যেন কিছুই উল্টোপাল্টা সে বলেনি। কুহেলী খানিক লজ্জা পেয়ে চুপসে থাকে। সমারোহর আঙ্গুলের ফাকে তখনো তার হাত বদ্ধ। আড়ষ্টতায় মাথা নুইয়ে পড়ে কুহেলীর।

বেশ খানিকটা সময় বসে থাকার পর সমারোহ উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে চমৎকার হেসে বলে,

‘ উঠে এসো। একটা দারুন জিনিস দেখাবো। ‘

কুহেলীর সমারোহর হাত ধরার সাহস হয় না। আপনাআপনি উঠতে গেলে সমারোহ নিজে থেকে ধরে নেয় কুহেলীর হাত। সমারোহর সাথে হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট্ট ঝোপঝাড়ের কাছে পৌঁছায়। ঝোপঝাড়ের পাশে বিশাল বড় এক শিউলি গাছে অগনিত প্রজাপতিরা বসে রয়েছে। জোনাকির মেলায় আলোকিত চারপাশ। সমারোহ কুহেলীকে ধীরে ধীরে সেদিকে নিয়ে যায়। নিচু স্বরে বলে,

‘ আস্তে চলো। আওয়াজ হলে জেগে যাবে। ‘

কুহেলী হা হয়ে চেয়ে দেখে শিউলি গাছটা। বিষ্ময় প্রকাশ পায় কন্ঠস্বরে,

‘ আপনি কিভাবে জানলেন এখানে প্রজাপতি আছে, তাও এত্তোগুলো? ‘

‘ অতো তোমায় জানতে হবে না। শুধু মুহূর্তটা উপভোগ করো। ‘

‘ শিউলি গাছে প্রজাপতি বসে জানি তবে এতো এতো প্রজাপতি একসাথে? ‘

‘ নিরিবিলি স্থান। মানুষের আনাগোনা কম তাই হয়তো। ‘

কুহেলীর চকচকে চোখ আরো উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করে। মোমের পুতুলের ন্যায় চেহারায় ফুটে উঠে মাখনের মতো মোলায়েম হাসি। সমারোহ মোবাইলের লাইট ফেললে স্পষ্ট দেখা যায় প্রজাপতির গুচ্ছ। নীল রঙের প্রজাপতি সব‌। কুহেলী নিজের খুশি চেপে রাখতে পারে না। সমারোহর হাত চেপে ধরে চঞ্চল চড়ুইয়ের মতো ছটফট করতে করতে বলে,

‘ আমি কি স্বপ্ন দেখছি? আমাকে একটা চিমটি কাটুন তো! ‘

কুহেলীর বলতে দেরি হয় সমারোহর চিমটি মারতে দেরি হয় না। কুহেলী হাত ঘষতে ঘষতে রাগে নাক ফুলিয়ে ফেলে। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলে,

‘ এই আপনাকে চিমটি মারতে বলেছি বলেই মারবেন? নখ তো না যেন কোদাল! ‘

সমারোহ মুহূর্তেই ভ্রুঁ কুঁচকে ফেলে। কুহেলীর খেয়াল হয় অতিরিক্ত উত্তেজনায় সে সমারোহর হাত খামচে ধরেছে। দ্রুত হাত ছেড়ে সরে গিয়ে চুপসে আসে মেয়েটা। সমারোহকে কোচকানো ভ্রুঁ’তে অমায়িক সুদর্শন লাগলেও কেনো যেন ভয় লাগে। সমারোহ কাট কাট গলায় বলে,

‘ মাত্র বললে চিমটি দিতে! ‘

‘ তো? ‘

‘ কিছু না। জায়গাটা কেমন? প্রজাপতি তো তোমার প্রিয়। ‘

‘ আমি এমনটা সত্যিই এর আগে কখনো দেখিনি। কি অপূর্ব না? আপনাকে অন্নেকগুলো ধন্যবাদ আমাকে এতো মনমুগ্ধকর একটা অনুভুতি দেয়ার জন্য। ‘

সমারোহ একটু ভাবনার ভান ধরে বলে,

‘ উমম, ধন্যবাদে তো কাজ হবে না ম্যাম! ‘

‘ তাহলে! ‘ বোকা বনে যায় কুহেলী। সমারোহ তড়িৎ গতিতে কুহেলীর দিকে ঝুঁকে বলে,

‘ সময় মতো চেয়ে নেবো আপাতত থাক। আর হ্যাঁ , আরো একটা পাওনা কিন্তু বাকি আছে। সুদে আসলে বুঝে নেব। ‘

কথাটা বলে ঠোঁটে বাঁকা হাঁসি ঝুলিয়ে সোজা হয়ে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়ায় সমারোহ। কুহেলী সমারোহর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝে না। গাছের কাছে গিয়ে একটা ছোট্ট নীল প্রজাপতি হাতে তুলে নিয়ে আকাশের দিকে ছেড়ে দেয়। আশেপাশে প্রজাপতিরা উড়াউড়ি করছে। থেকে থেকে মৃদু বাতাসের স্পর্শ আর কলকলে নদীর স্রোতধারার শব্দ। আকাশ ভরা তারার পসরা সাজানো। আর পাশে সমারোহ। কুহেলী খাঁ খাঁ দুপুরে তীব্র রৌদ্দুরে ভষ্ম হয়ে আসা ‌বুকে এক ছটাক বর্ষা নামে। রক্তের বৃষ্টি ঝরে সে বর্ষায়! ভাবতেই কুহেলীর শিরদাঁড়া বেয়ে সোজা শীতল পদার্থ নেমে যায়। এর চেয়ে বেশি মোহময় অনুভূতি কখনো হয়নি। এর স্থায়ীত্ব কতটুকু জানা নেই। প্রিয় মুহূর্ত স্বল্প সময়ের জন্যই হোক। তাই হয়তো এই কয়েক সেকেন্ড সময়ের জন্য মানুষ ছটফট করে সহস্র দিন।
কুহেলীর কাঁধে একটা প্রজাপতি এসে বসে। কুহেলী মৃদু কেঁপে উঠে। সমারোহ আলতো হাতে প্রজাপতিটা সরিয়ে দেয়। কুহেলীর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘ কিছু ভাবছেন ম্যাডাম? ‘

কুহেলীর ধ্যান ফিরে। সমারোহর চোখে চোখ রাখতেই কুহেলীর বুক কেঁপে উঠে। এক সমুদ্র সমান শূন্যতারা নাড়া দিয়ে যায় সবটা জুড়ে। এই মানুষটা তার নয়! যে তার নয় তাকে নিয়ে হাজার হাজার স্বপ্ন সাজাতে কেনো ভালো লাগে? মনটা এতো অবাধ্য কেনো হয়ে যায় ইদানিং? একাকী লাগে নিজেকে বড্ড বেশি! অভিমান হয় আকাশ সমঃ। কার প্রতি হয়? সমারোহ তার অভিমানের বোঝা কেন বইবে? কুহেলীর চোখের কার্ণিশে বিন্দু বিন্দু অশ্রু কণারা এসে ভীড় করে। সমারোহর কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে নিজেকে। মাথা নিচু করে মলিন হয়ে বলে,

‘ কিছু না। ‘

সমারোহর মুখের হাসি উবে যায়। একটুখানি আগেই মেয়েটা খুশিতে লাফাচ্ছিল, হঠাৎ কি হলো? সমারোহ সঙ্কিত হয়ে বলে,

‘ এনিথিং রং কুহেলী? ‘

‘ নো। ঠিক আছি। অনেকক্ষণ হয়েছে এলাম, ট্রেন ছাড়বে কখন? ‘

‘ এতোক্ষণে ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে যাওয়া যাক? ‘

‘ চলুন। ‘

সমারোহ আর কথা বাড়ায় না। ট্রেনে এসে হালকা নাস্তা করে নেয়। আধ ঘন্টার মাথায় ছেড়ে দেয় ট্রেন। সিটে শুয়ে চোখ জোর করে বুঁজে রেখেও ঘুম আসে না কুহেলীর। ঘুম আজ ছুটি নিয়েছে। এভাবে শুয়ে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে। উঠে বসে সমারোহকে এক পলক দেখে নেয় সে। সমারোহ চোখ বুজে শুয়ে আছে, ঘুমিয়েছে নাকি না বুঝার উপায় নেই। একটু আগের কথা ভেবে চলে কুহেলী। সময়টা সেখানে থেমে গেলেও মন্দ হতো না। এতো দ্রুত রেললাইন ঠিক হলোই কেনো!

কুহেলী ব্যাগ থেকে একটা বই নামিয়ে পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়ে টের পায় না। সকালে সমারোহর ডাকে ঘুম ভাঙ্গতে দেখে ঢাকা পৌঁছে গেছে। তাড়াহুড়ো করে ট্রেন থেকে নামতেই হাত নেড়ে ইশারা করে তাদের দিকে। সমারোহ কুহেলীর হাত ধরে এগিয়ে যায় সেই ছেলেটার দিকে। সমারোহর এক বন্ধুর বাসায় সকালের খাবার খেয়ে রেস্ট নিয়ে আবার রওনা হবে রাজশাহীর জন্য। এক ঘন্টার মাথায় পৌঁছে যায় বন্ধু ডা. মলিকের বাড়ি। তার স্ত্রী কুহেলীকে দেখে বেশ খুশি হয়। হাসিমুখে কুহেলীর হাত ধরে বলে,

‘ আসুন ভাবী, ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিবেন একটু। ‘

কুহেলী অপ্রস্তুত হয়ে পরে ভাবী ডাক শুনে। চমকে সমারোহর দিকে তাকিয়ে দেখে সেও বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে। সমারোহর মেজাজ একটু গরম হয়। একজন মেয়েকে সাথে নিয়ে কোথাও বের হলেই কি প্রেমিকা নয়তো বউ হয়ে যায় নাকি! কুহেলীর সামনে বারবার অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। সমারোহ ভ্রুঁ কুঞ্চিত করে,

‘ আব্বুর বন্ধুর মেয়ে। একা এতোটা রাস্তা যেতে পারবেনা তাই পৌঁছে দিচ্ছিলাম। ‘

ফ্রেশ হয়ে সামান্য রেস্ট নিয়ে দুই ঘণ্টা বাদেই রাজশাহীর জন্য রওনা হয় সমারোহ। রাস্তায় জ্যাম থাকায় প্রয়োজনের চেয়ে অনেকটা সময় বেশি লাগে রাজশাহী শহরে পৌঁছাতে। চারদিকে তখন অন্ধকারের ছড়াছড়ি। ঘড়ির কাঁটা দুইটাই ঘরে মেপে মেপে পা ফেলছে। কুহেলী সমারোহর কাঁধে মাথা রেখে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। বাস স্টেশনে পৌঁছানোর পরও সমারোহর কুহেলীকে ঘুম থেকে তুলতে ইচ্ছা করে না। ঘুমালে কুহেলীর চোখ ঠোঁট হাসে। কেইবা চাইবে এমন পুতুলের মতন চেহারাখানির হাঁসি হারাতে দিতে! তাও বাধ্য হয়ে সমারোহ কুহেলীকে ডেকে তুলে। ঘুম ঘুম চোখেই এলোপাথাড়ি পা ফেলে বাস থেকে নেমে দাঁড়ায় কুহেলী। শরীর ভাড় হয়ে রয়েছে তখনো। বাস স্ট্যান্ড থেকে শিমুলপাড়া বহু দূরের রাস্তা। শহরের জনাকীর্ণ স্থান হওয়ায় এতো রাতেও দুচারটে হোটেল খোলা রয়েছে স্টেশনের পাশে। তবে পরিবেশ তখন ঝিমুচ্ছে। স্নিগ্ধ শীতল আবহাওয়া। কুহেলী ঘুমে সিক্ত স্বরে বলে,

‘ পানির বোতল কিনুন একটা। হাত মুখ ধুবো। ‘

সমারোহ মুচকি হেসে বলে,
‘ ধুতে হবে না। অনেকটা রাস্তা তো সিএনজি ঠিক করে নিচ্ছি, খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়বে। ‘

কুহেলী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা ডানে কাত করে সম্মতি জানায়। হোটেলে গিয়ে খুব একটা খেতে পারে না কুহেলী। সারা জীবনের সব ঘুম এসে জড়ো হয়েছে চোখে। সমারোহ খেয়ে শুকনা খাবার কিনে নেয় কিছু। সিএনজিতে উঠার পর আর ঘুমের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যায় না। শরীর দুর্বল হওয়ায় চোখ বুজে বসে থাকে কুহেলী। কুহেলী ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে সমারোহ কুহেলীর মাথা নিজের কাঁধে রাখে। কুহেলীও ঘুমের ভান করে থাকে। মন তার বাকবাকুম করছে। এতোটা সময় সে সমারোহর কাছাকাছি ছিল। বাড়ি পৌঁছেই আব্বা আম্মা কুঞ্জা সব্বাইকে দেখবে।
রাত তিনটায় গাড়ি শিমুল পাড়ার রাস্তায় ঢুকে। কুহেলীর ভেতরে কেমন যেন একটা অস্থিরতা কাজ করে। প্রায় এক বছরের বেশি সময় পর কুহেলী নিজের বাড়ি ফিরছে। নিজের সবচেয়ে প্রিয় জন্মস্থান। যে জায়গাটায় ছোট থেকে বড় হয়ে উঠা। শহরের যান্ত্রিকতার বাহিরে যেন একটু স্বস্থি ফিরে পাওয়া। আকাশ বাতাসে একটা প্রিয় মাটির ঘ্রাণ! এই ঘ্রাণ অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না, এর যে মনের সাথে গভীর সংযোগ।

চারদিকে অসংখ্য গাছের মাঝখানে সরু রাস্তা। থেকে থেকে সুবজ জলের পুকুর, বিস্তারিত মাঠ! সব, সবকিছু কুহেলীর চির পরিচিত, চির প্রিয়। গাড়ি পিচ ঢালা রাস্তা থেকে মাটির পথে ঢুকেছে। আঁধারে তলিয়ে থাকা নিজের স্কুল দেখে চোখ ছাপিয়ে জল নেমে আসে কুহেলীর‌। কতো হাসি, কান্না, দুষ্টামির স্মৃতি মোড়ানো শৈশব! এই পথ ধরে সে জীবনে দশটা বছর কাটিয়েছে। বান্ধবীদের সাথে কতো হৈ হুল্লোড় করে বেড়িয়েছে, কতোবার আম, কামরাঙা চুরি করে খেয়েছে। পুরো স্কুল দাপিয়ে বেড়িয়েছে। স্কুলের প্রতিটা রুমেই হয়তো বেঞ্চ খোদাই করে তাদের নাম লিখা রয়েছে। একবার পড়া না শিখার কারণে আব্বা এই স্কুলের মাঠেই তাকে কান ধরিয়েছিল সবার সামনে। সে কি কান্না কুহেলীর! এর পর থেকে আর কোনদিন কুহেলী পড়া না শিখে স্কুলে যায়নি। সেসব এখন মনের গোপন পরিত্যক্ত কুঠুরিতে নিতান্তই স্মৃতি! যে স্মৃতি পোড়ায় না তবে চিনচিনে ব্যথা দেয় ঠিকই।

কুহেলী অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে পৌঁছে যায় বাড়িতে। বাড়ির গেইটের দিকে তাকিয়ে কুহেলীর সম্বিত ফিরে পায়, তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে। পরিচিত তামাটে রঙের গেইটটা অস্পষ্ট। কুহেলী টলমলে চোখ গাড়ি থেকে নেমেই মাপা মাপা পায়ে খোর্শেদ বাড়ির ভেতরে ঢুকে। এই গভীর রাতেও রজব বসে আছে রান্নাঘরের দ্বারপ্রান্তে। কুঞ্জা অস্থির হয়ে এদিক ওদিক পাইচারি করছে। কুহেলীকে দেখেই হা করে মৃদু স্বরে একবার বলে, ‘ আপা! ‘

কুহেলী কান্নার মাঝেই ফিক করে হেঁসে ফেলে। সমারোহ ব্যাগ হাতে এসে দাঁড়ায় কুহেলীর ঠিক পেছন দিকে। কুঞ্জা কালক্ষণেক চেয়ে থাকে। আপা যে সত্যিই তার বাড়ির শিয়রে ঠাওর করা মাত্রই চেঁচিয়ে উঠে,

‘ আপা আসছে আপা, আমার আপা! আব্বা আম্মা কই তোমরা? আমার আপা আসছে। ‘

কুঞ্জা দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে কুহেলীর বুকে। কুহেলীকে শক্ত করে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। কুঞ্জার অকস্মাৎ ছুটে আসায় কয়েক কদম পেছনে চলে আসে কুহেলী। ধমকে বলে,

‘ এভাবে কেউ ছুটে? এক্ষুনি পড়ে যেতাম তো। ‘

কুঞ্জার শরীর যেন আনন্দে অবশ হয়ে গিয়েছে। আর স্থির রাখতে পারছে না নিজেকে। অতিরিক্ত উত্তেজনায় কাঁপছে মেয়েটা। অভিমান আর কান্নায় ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,

‘ কতো দিন পর দেখলাম আমার আপাকে। অপেক্ষা করতে বড্ড কষ্ট হয় গো আপা! ‘

কুহেলী কুঞ্জার মাথায় হাত বুলায়। খোর্শেদ, হাসনাহেনা ততক্ষণে বের হয়ে এসেছে ভেতর থেকে। হাসনাহেনা মেয়েকে দেখেই বুকের মাঝে আটকে রাখেন। বিড়বিড় করে বলেন,

‘ আমার সোনামনি জাদুমনি কত্তদিন পর‌ দেখলাম তারে! মায়ের মনের হাহাকার এবার শান্ত হইলো। ‘

হাসনাহেনা কাঁদেন, কাঁদে কুহেলী কুঞ্জা খোর্শেদ ও। কুহেলী মায়ের বুকে মাথা রেখে যেন পৃথিবীর সব কিছু ভুলে যায়। কি শান্তি এখানে! মায়ের শরীরের ঘ্রাণে প্রাণ ভরে, হৃদয়ের রৌদ্দুরে নামে শ্রাবণের ঝুম বৃষ্টি। খোর্শেদ কুহেলীর মাথা হাত রাখতেই কুহেলী মাথা তুলে তাকায়। মৃদু স্বরে বলে, ‘ আব্বা! ‘

খোরশেদ হাসে। টলমলে ঘোলাটে চোখে সে হাদি আমায়িক সৌন্দর্য মাখা। খোর্শেদ বলে,

‘ আমার মামনি টা কেমন আছে? ‘

‘ ভালো। তোমার শরীরটা কেমন এখন? ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করতো ? ঔষধ খাও ঠিক মতো? তখন কতো অসুস্থ হয়ে গেলে আমি আসতেই পারিনি। ‘

কান্নায় ভেঙে পড়ে কুহেলী। খোর্শেদ পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সমারোহর দিকে চেয়ে বলে,
‘ বাবা কেমন আছো? রাস্তায় আসতে সমস্যা হয়নি তো? ‘

‘ একদম সমস্যা হয়নি, চাচা। ভালো আছেন আপনারা? ‘

‘ এই তো আছি। রজব হাত থেকে ব্যাগ গুলো নে। ‘

রজব পেছন থেকে ছুটে গিয়ে সমারোহ সাথে কুশল বিনিময় করে হাত থেকে ব্যাগ নেয়। কুহেলীর সাথে কথা বলে‌। কুঞ্জা কুহেলীর হাত সেই প্রথম থেকে নিজের আঙুলের ভাঁজে আটকে রেখেছে। সৌজন্যমূলক হেসে সে বলে,

‘ আপনি সমারোহ ভাইয়া? সান্দ্র ভাইয়া আপনার কথা বলেছেন। নয়না আপুর কথাও বলেছে। ‘

সমারোহ ফিক করে হেসে বলে,
‘ আর তুমি হলে সবার প্রিয় কুঞ্জকানন, রাইট? ‘

কুঞ্জা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে সমারোহর কথা শুনে। কুঞ্জাকে হাসতে দেখে সমারোহ মিহি হেঁসে বলে,

‘ তোমার হাসি ব্যাপক মায়া মাখা কুঞ্জামনি! ‘

কুঞ্জা কাট কাট গলায় বলে,
‘ আপনাকে আমার খুউব ভালো লাগলো। আপনাকে আমার ভাই বানালাম। এখন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হউন, আমরা কেউ এখনো খাই নাই টেনশনে। কাল জমিয়ে আড্ডা দিব। ‘

সমারোহ চমৎকার ভঙ্গিমায় বলে,
‘ রাজকুমারী আজ্ঞা শিরোধার্য। ‘

‘ রাজকুমারী খুশি হলো। ‘

হাসনাহেনা হেসে বলে, ‘ আসো আব্বা ভিতরে আসো। হাত মুখ ধুইয়া একটু খাবার মুখে দেও। ‘

কুহেলী হাত মুখ ধুয়ে রমলার ঘরে যায়। রমলা তখন তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে ব্যস্ত‌। কুহেলী রমলার পাশে বসে চুপচাপ দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নেয়। সালাম ফিরিয়ে দেখে রমলা জায়নামাজে বসে তার দিকে তাকিয়ে কাঁদছেন। কুহেলী রমলাকে আস্তে করে জড়িয়ে ধরে। রমলা ও নিশ্চুপ কুহেলীকে বুকে আবদ্ধ করে রাখেন। কিছু সময় কাটলে কুহেলী মাথা উঠিয়ে দাদীমাকে একবার দেখে নিয়ে বলে,

‘ কেমন যায় তোমার দিনকাল? আমি তোমাকে সবসময় মনে করি জানো? একা ঘুমানোর সময় সবচেয়ে বেশি মিস করি। ‘

রমলা কুহেলীর কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলেন,
‘ আমিও করি রে আমার জাদুমনি! তোর দাদু মারা যাওয়ার পর থেইক্কা তো তুই আমার লগে থাকতি। তোর লাইগ্যা আমাগো সবার মন পুড়ে। ‘

কুহেলী দাদী মাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
‘ আজকে আবার থাকবো তোমার কাছে। ওই ছোট্টবেলার মতো গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাবো। ‘

রমলা হাসেন। কুহেলীও মিষ্টি হেঁসে রমলার কপালে চুমু দিয়ে বলে, ‘ খাইছো রাতে? ‘

‘ হো, তোর মায় আমারে খাওনের লড়চড় করতে দেয়না। মেলা পথ আইছোস। খাইয়্যা তারপর শুইতে আয়। ‘

‘ আচ্ছা দাদীমা। তুমি শুয়ে থাকো হে? ‘

‘ কিসের শোয়া? তোর লগে বইয়্যা খাওয়ামু ভালো কইরা আজকে, চল। ‘

সকাল হলেও সূর্যি মামার ঘুম ভাঙ্গতে ঢের দেরি। পরিবেশ মুখরিত আজানের মধুর ধ্বনিতে। কি‌ সুন্দর আজানের প্রতিটি বাক্য! সমারোহ নামাজ আদায় করে এসে পুকুর পাড়ে বসে। রজব আগেই সেখানে বসে ছিল। সমারোহকে দেখে অবাক হয়ে বলে,

‘ ভাই ঘুমাইলেন না? আইয়্যা পড়ছেন দেহি? ‘

‘ ঘুম আসছিল না। নামাজ পড়ে আসলাম একটু হাঁটি। ‘

‘ আল্লাহ কয় কি? আমারে তো চাচায় বইক্কা পিট্টা ঘুমেত্তে তুইল্যা নামাজ পড়ায়। ঘুম ছাড়া দুনিয়া আন্ধার বুঝলেন নি! ‘

সমারোহ মলিন হাসে। তাচ্ছিল্য হাসির স্বর! বলে,

‘ ডাক্তারদের আবার ঘুম! দশ মিনিটের জায়গায় বারো মিনিট ঘুম মানেই বিলাসিতা। ‘

রজব অবাক হয়! তাদের গ্রামের ডাক্তার’টাতো দোকানে বসে সারাক্ষণই ঝিমায় আর নাক ডাকে। কুঞ্জাও এসে উপস্থিত হয় গল্পের ফাঁকে। সমারোহকে গ্রাম ঘুরে দেখাবে বলে জোরে বলে নিয়ে যায় বাড়ির বাহিরে। নামাজ পড়ে বিছানায় শোয়া মাত্রই দাদীমার আঁচল তলায় স্নেহে চোখ লেগে এসেছিল কুহেলীর। অতিরিক্ত হট্টগোলের কারণে উঠে বিরক্তি নিয়ে চেয়ে থাকে দরজার দিকে। বাহিরে অচেনা স্বরের কারা যেন অনবরত তর্ক করে চলেছে। উঠে ধীর পায়ে জানালার ধারে যেতেই দম ফুরিয়ে আসে কুহেলীর।

জানালার লোহার শিকের ফাঁকে দেখা যায় জসীম হায়দারকে। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরে হাত দুটো পেছনে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছেন উঠানের ঠিক মাঝে। তার ঠিক বামে দাঁড়ানো পলাশ হায়দার আর রহমত। পেছনে জসীমের পোষা কিছু চ্যালাপ্যালা আর গ্রামেরই বেশ খানেক মানুষজন। একেকজনের চেহারার ভঙ্গিমা একেক রকম। জসীমের লোকেরা ইতোমধ্যে উঠানে থাকা খোর্শেদের চেয়ার আর পুকুরের কাছটায় গাছের নিচে থাকা পুরনো চৌকিটা ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। কুহেলীর পিল চমকে উঠে বাহিরের পরিস্থিতি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে। বুক কাঁপছে তার। দ্রুত দরজাটা একবার দেখে নেয় সে। আটকানো আছে। তারপর আবার জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়‌। কুঞ্জা উঠানে ছিল‌। ভয়ে ছুটে পাকঘরে হাসনাহেনার কাছে যায়। হাসনাহেনা হাতে রামদা নিয়ে প্রস্তুতি নেয় জসীমের কাছে যাওয়ার। খোর্দেশ আর রজব বসার ঘর থেকে দৌড়ে আসে তাদের দেখে। স্বামীকে দেখে থেমে যায় হাসনাহেনা। সমারোহ দু’ চারটে ছোট্ট ছেলেপেলের সাথে গল্প করছিল পুকুর পাড়ে। জসীম কে দেখে তারা সব ভয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। সমারোহ চোখ মুখ কুঁচকে জসীমের ঠিক সামনে এসে ভরাট গলায় বলে,

‘ কারা আপনারা? কারো বাড়িতে এসে এভাবে ভাঙচুর করাটা কি ধরণের ভদ্রতার মধ্যে পড়ে জানতে পারি কি? ‘

সমারোহর কথায় ছ্যাৎ করে উঠে রহমত। আগেই চটে ছিল আর এখন যেন আগুনে ঘিয়ের ছিটা পড়লো। রহমত প্যাচপ্যাচে ভাঙ্গা গলায় চেঁচিয়ে উঠে বলে,

‘ চরিত্রের যেই ছিরি আবার আইছে মেলা লম্বা কথা কইতে। মাইয়্যাডা কই? কই লুকাইছে? শহরে গিয়া বেশ্যা হইয়্যা গেরামে ফিরা আইছে কি আমাগো মুখে চুনকালি মাখাইতে? ‘

সমারোহর মুখে স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ পায়। মাথা বেদম গরম হয়ে যায় লোকটার কথা শুনে। কি বিশ্রী ভাষা! তেড়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই জসীম রহমতকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

‘ চুপ কর রহমইত্তা। পুরা বিষয়ডা অহনো আমগো জানা হয়নাই। আগে কথা কইয়্যা লই খোর্শেদ মিয়ার লগে। ‘

জসীমের কথায় সবাই বেশ কম হুঁ’হা বলে। খোর্শেদ চড়া গলায় বলে,

‘ এইসবের মানে কি? আপনারে গেরামের মাতব্বর মানি বইল্লা ঘরে ঢুইকা আসবাব ভাঙবেন? ‘

জসীম হালকা হাসে খোর্শেদের কথায়। মুখ থেকে মাটিতে এক থবলা পানের পিক ফেলে বলেন,

‘ কই আপনের মাইয়্যা কই? আনেন দেহি। ‘

‘ আমার মেয়ে যেনে খুশি থাকবো আপনার কাছে কেন আনতে হইবো? ‘

খোর্শেদের কড়কড়া গলা। জসীম একটু বিরক্ত হন তার কথার মুখে কথা শুনে। গ্রামের কেউ এমন সাহস পায় না। খোর্শেদের কথার প্রতিউত্তরে পলাশ ক্ষেপে গিয়ে বলে,

‘ আনবেন না মানে? বিচার হইবো আজকা। বাড়ি ভাইঙ্গা আনমু দরকার হইলে। ‘

পলাশের কথায় হাসনাহেনা কুঞ্জার হাত ধরে আরেক হাতে রামদা নিয়ে কুহেলীর ঘরে চলে আসে। আসার পথে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আসে পলাশের দিকে। ভয়ে আৎকে উঠে দমে যায় পলাশ। সেদিনের কথা সে ভোলেনি। শরীরের ক্ষত সারিয়ে তুলতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাকে। সে কি যে বেদনার! প্রতিশোধের জন্য ভেতরটা রাগে দপদপ করে উঠে তার। ভেতরের আগুন দমানোর সময় এসেছে। প্রতিশোধেরা চারিদিকে মাদল বাজিয়ে পাগল করে তুলেছে পলাশকে। আজ খোর্শেদ বাড়ির মুখে চুনকালি মাখাবে। কালবাদে পরশু খোর্শেদ বাধ্য হবে কুহেলীকে তাদের হাতে তুলে দিতে। আহা! ভাবতেই যেন মন নেচে উঠে তার। পৈশাচিক আনন্দের মিছিল বয়ে যায় বুকে। কুহেলীর প্রতি আগে থেকেই বাজে নজর আছে পলাশের। তবে পুরো পরিবারকে কোনঠাসা করতে পারলে ভোগ করাটা আনন্দের হবে। জসীম বেশ তিক্ত গলায় বলেন,

‘ পোলা গুলার গাঁয়ে জেদ বেশি তাই ভাঙছে। অহন কথা হইলো আপনে হইলেন গেরামের মাষ্টার। সবাইরে নাকি মানুষ বানাইবেন! অনেক নাকি আত্মসম্মান আপনের। তো মাষ্টারসাব, নিজের বাড়ির খবর কি? রাইত বিড়াইতে বাড়ন্তি মাইয়্যা আপনের এক টগটবে যৌবনের জোয়ার বয়া পোলার গলে বাইত্তে আইবো কেন বুঝান আমাগোরে। ‘

পেছন থেকে আরেক জন চেঁচিয়ে উঠে বলেন,

‘ বাজারের অনেকেই দেখছে হেগোরে আইতে। জবাব দেন খোরশেদ মাস্টার। ‘

খোর্শেদ থমকে যায়। এই প্রশ্নের উত্তর সে যাই দিক গ্রামবাসী মানবে না। উল্টো তার মেয়ের দিকেই কুৎসিত হাত বাড়াবে। ভয় হয় খোর্শেদের। আদুরে মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশংকায় বুকের বাঁ পাশে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব হয়। কাঁপতে কাঁপতে পরে যেতে নিলে রজবের হাতে ভর দেয়। সমারোহ দ্রুত চেয়ার এনে বসতে দেয় খোর্শেদকে। পানি খেয়ে হাঁপিয়ে নেন একটু। সমারোহ বেশ রাগ দেখিয়ে বলে,

‘ চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী। দেশের এই মাথা আর ঐ মাথা। বাংলাদেশের মতো দেশে দূরপাল্লার যাত্রায় পৌঁছাতে দেরি হতেই পারে। এটা স্বাভাবিক। রাস্তায় জ্যাম না থাকলে বিকেলেই পৌঁছে যেতাম। ‘

সমারোহর কথা মাটিতে পড়ার আগেই একজন বলে উঠল,

‘ তোমারে আমরা বিশ্বাস করতে যামু কেন? এমুন তাগড়া জোয়ান পোলা মানুষ আর মাইয়্যা একলোগে এক বিশ্বাস করন যায় না যেই দিনকাল। কেমনে বুঝমু কোন খারাপ কাজ করতাছো না? ‘

অন্য একজনের গলা শোনা যায় এবার। তিনি বেশ ক্ষুব্ধ হয়েই বলেন,

‘ খারাপ হউক আর নাই হউক আমাগো বাড়িতে মাইয়্যা আছে বিয়ার বয়সী এইরোম অনাচার ব্যভিচার প্রকাশ্যে হইলে তারা কি শিখবো? তারাও এমন হইবো। এইনি মাষ্টারের শিক্ষাদিক্ষা! ‘

সমারোহর মেজাজ বিগড়ে যায় এবার। রাগে গাঁ রিঁরিঁ করে। খারাপ আচরণ করতে ইচ্ছে করে। এরা ভালো ব্যবহারের মূল্য বোঝার লোক নয়। তার উপর কথাগুলো বলছে কুহেলীর মতো মেয়ের চরিত্র নিয়ে। সমারোহ চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করে। তারপর গ্রামের লোকদের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় বলে,

‘ আপনারা অনেক সময় ধরেই জানেন খোর্শেদ চাচা আর তার পরিবারকে। একবছরের জন্য কুহেলী শহরে গিয়েছে পড়তে। সে ছোট থেকে বড় হয়েছে এই গ্রামে, আপনাদের চোখের সামনে। তাকে আপনারা সবাই খুব ভালো করে চিনেন। ওর মাঝে খারাপ কিছু কি দেখেছেন কখনও? আপনাদের ও মেয়ে বোন আছে ঘরে। আজ যদি আপনার মেয়ে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় তাহলে শহরে হাজারটা মেধাবী ছেলের সাথে তাল মিলিয়ে পড়তে হবে, চলতে হবে। এর মানেই সে খারাপ হয়ে গেল না বা তার চরিত্রে সমস্যা এমন না। শহরে কি মেয়েরা থাকে না? তারা কি সবাই খারাপ? কুহেলীর কথা ছাড়লাম, খোর্শেদ আঙ্কেল কেমন মানুষ তা কি আপনারা জানেন না? কখনো কোনো অন্যায় মেনে নেয়না লোকটা সে নিজের মেয়ের বিষয়ে উদাসীন নয় নিশ্চয়ই। আমি জহির আহমেদের বড় ছেলে। উনাকে তো অনেকেই চিনেন। আমার আব্বার ডাক নাম রয়েছে গ্রামে। আপনারা মানুষের কথা না শুনে একটু বিবেক দিয়ে ভাবুন। কোনো প্রমাণ ছাড়া, চোখে না দেখে আপনারা কারো সম্পর্কে খারাপ কিছু বলতে পারেন না। ‘

সমারোহর কথায় গ্রামের দুচারজন যারা ছিল চুপসে আসে। খোর্শেদ মাষ্টার সত্যিই ন্যায়বান মানুষ তা তারা জানেন। তাকে তারা প্রত্যেকেই শ্রদ্ধাও করে। জসীমের কপালে ভাঁজ পরে। জহিরের সুনাম এই গ্রামে অনেক। এই শহুরে ছেলে চালাক-চতুর। গেরামের মানুষ বোকা। তাদের মা বুঝাবে তাই বুঝবে। ব্যাপারটা যদি তার সামান্য ও হাত ছাড়া হয় তবে তার প্রতিপক্ষের অভাব নেই, তারা সুযোগ নেবে। আর তার আদরের ছেলের আবদার পূরণ করা হবে না। খোর্শেদেই যেই দুর্দিন দেখার জন্য বুকটা খাঁ খাঁ করছিল তা হাত ছাড়া হতে দেয়া চলবে না। কিছুতেই না। জসীম ভেবেচিন্তে শান্ত কন্ঠে বলেন,

‘ জহিরের পোলা তুমি? ‘

‘ জ্বি। ‘

‘ সে খুবই ভালা মানুষ আছিল। তয় গেরামের মাইষেরে কি বোকা ভাবো পোলা? আমাগো দিমাক নাই? এতো রাইত্তে যে কেন বাড়িত ফিরছো তা আমরা ঠিকই বুঝি। কি গেরামের আর মাইয়্যারা এতো এমন উশৃঙ্খল না! তাগোর কি জীবন চলতাছে না? আমরা এতো কথা কইতে চাই না। কাইল শিমুলপাড়ায় সালিশ বসবো। পঞ্চায়েতের সকলে থাকবো। বিচার হইবো এই ব্যভিচারের। গেরামের মানুষের লাইগ্যা একটা শিক্ষা হইয়া থাকবো এইডা। আর খোর্শেদ মিয়া, মাইয়্যারে যদি পালাইতে সাহায্য করো তো আমাগোর চেয়ে খারাপ কেউ হইবো না। তোমার তো আবার হেই অভ্যাস আছে। আমাগো নজর তোমাগো উপরেই থাকবো মনে রাইক্ষো। ‘

আর এক সেকেন্ড দাঁড়ায় না জসীম। তার পিছু পিছু বের হয়ে যায় পলাশ, রহমত গ্রামের সকলে। খালি পড়ে থাকে খোর্শেদ বাড়ির উঠান আর থ’ মেরে থাকা তিন-চারটে চেহারা। খোর্শেদের মাথা শূন্য হয়ে থাকে। স্বার্থপর মানুষগুলো নিজেদের ফায়দার জন্য তার নিষ্পাপ মেয়ে দুজনকে ব্যবহার করে! খোর্শেদ হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ায়। রজব চিন্তিত হয়ে ধরতে নিলে হাতের ইশারায় না করে। রজব থেমে যায়। ধীর গতিতে মাপা মাপা ফেলে নিজের ঘরে গিয়ে দুয়ার বন্ধ করে। জীবনের ছকটুকু উল্টে পাল্টে গেছে, এবার শক্ত করে সঠিক পথে ধরার পালা।

চলবে.