আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৪৬.
অনেকক্ষন শাড়ি পরে রাখার পর এখন গোসল করে ড্রেস চেঞ্জ করতে পেরে এখন একটু ভালো লাগছে কুহেলীর। নিজেকে একদম হালকা মনে হচ্ছে। কুহেলী ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়াল করে সমারোহ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে আজ। শীতের সময় বৃষ্টি যেন আরো ঠান্ডা করে তুলেছে আশেপাশের পরিবেশ। কুহেলী দ্রুত সমারোহর কাছে গিয়ে বলে,
‘ বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছেন তো আপনি। কি করছেন বারান্দায় ? ‘
‘ ভাবছি। ‘
‘ কি ভাবছেন? ‘
সমারোহ কুহেলীর দিকে ফিরে রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। কুহেলী চোখ নামিয়ে নরম স্বরে বলে,
‘ যদি বলতে সমস্যা না থাকে তাহলে…। ‘
সমারোহ ফিক করে হেসে ফেলে। আবার আনমনে আকাশের দিকে চেয়ে চোখ বুঁজে লম্বা একটা শ্বাস নেয়। পুরুষালী কন্ঠে বলে,
‘ তুমি তো আমারই, তো তোমায় বলতে কি সমস্যা হতে পারে! ‘
একটু থেমে সমারোহ আবার বলে,
‘ ভাবছিলাম জীবন কতোটা বিচিত্র তাই না? আমাদের সবকিছু আছে, প্রিয় মানুষ আছে। তবু আমরা আরো বেশি কিছু পাওয়ার জন্য লক্ষ্যের পিছু ছুটে বেড়াই। শুধু ছুটিই না, এমন ভাবে ছুটি যে লাইফের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সময়টুকু এনজয় করি না। আর যখন রঙিন সময়টা হারিয়ে যায় তখন দেয়ালে মাথা ঠুকে বলি আমার জীবন সুন্দর ছিল না। বিধাতা কেনো আমায় কিছু দিলো না? আবার এক জিনিসের পেছনে ছুটার পরও কেউ খুব সহজে লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারে আর অন্যজন খুব খাটুনির পরও না। তবে জানো কি কুহেলী, আমি আসলেই লাকি। আমি আল্লাহর কাছে যা যা চেয়েছি সবটাই পেয়েছি। তোমাকেও! ‘
‘তোমাকেও’ শব্দটা মনে মনে উচ্চারণ করলো সমারোহ। কুহেলী বুঝতে পারে না সমারোহ আজ হঠাৎ এসব কথা কেনো বলছে। কুহেলীকে চুপিসারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সমারোহ কুহেলীর দিকে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘ এখানে তোমার দেনমোহর আছে পুরোটা। আলমারিতে রেখে দিও আমি পরে তোমার নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলে সেখানে জমা করে দিব। ‘
কুহেলী অবাক হয়ে তাকায় সমারোহর দিকে। বিষ্ময় মিশ্রিত কন্ঠে বলে, ‘ আপনি এখনি কেনো দিচ্ছেন? আমি জানতাম এটা ডিভোর্স হলে দেয়। ‘
‘ ভুল জানো। এটা স্ত্রীর হক যা স্বামীর উপর ঋণের মতো। আমি এই ঋণের বোঝা বইতে চাই না আর তাছাড়া দেনমোহর বিয়ের রাতেই পরিশোধ করা উত্তম। ‘
কুহেলী মিষ্টি করে হাসে। সমারোহর চোখ আটকে যায় এই পাতলা ঠোঁটের ভেজা হাসিতে। সে সত্যিই খুব ভাগ্যবান এই হাসির অধিকারীনী কেবলই তার। সমারোহর হঠাৎ কি জেনো হয়। কুহেলীকে ক্ষীণ স্বরে বলে,
‘ একবার সমারোহ বলে ডাকবে? ‘
চমকিত হয়ে লজ্জায় লজ্জাবতীর মতো চুপসে গিয়ে দ্রুত বলে উঠে কুহেলী,
‘ নানা না। পারবো না। ‘
‘ কেনো? তুমি আমার নাম ধরে ডাকো না কেনো? আগে বলতে সমারোহ ভাইয়া আর এখন নামই নাও না। ‘
‘ আ’আমার লজ্জা করে। আমি ঘরে যাচ্ছি আপনিও আসুন। ‘
কথাটা বলে কুহেলী ঘরের দিকে পা বাড়াতে নিবে তার আগেই সমারোহ সন্দিহান কন্ঠে বলে,
‘ কাছে এসো। ‘
কুহেলী ভেবাচেকা খেয়ে বলে ফেলে, ‘ কি বললেন? ‘
‘ বললাম এদিকে এসো। ‘
কুহেলী সমারোহর কাছে যেতেই সমারোহ দুই হাতের তালু দিয়ে কুহেলীর চিকস শক্ত করে চেপে ধরে। চ্যাপ্টা হয়ে থাকে কুহেলীর গাল। কুহেলী হতবুদ্ধি হয়ে সমারোহর দিকে তাকিয়ে বলার চেষ্টা করে ‘এই ছাড়ুন আমাকে এভাবে ধরেছেন কেনো?’ কিন্তু বলতে পারে না। সমারোহর হাত ছুটানোর অনেক চেষ্টা করে। সমারোহ কপাল কুঞ্চিত করে কুহেলীকে বলে,
‘ আপনি ডাক আর শুনতে চাই না। তুমি করে বলবে এখন থেকে। আর এক্ষুনি আমার নাম ধরে ডাকবে, কুইক। ‘
‘ পারবো না। ‘
‘ তাহলে আমিও ছাড়বো না। ‘
কুহেলী অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছুসময় চেয়ে থাকে সমারোহর দিকে। এ চাহনিতে কতো যে আকুতি! সমারোহ ভ্রুঁ কুঁচকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে, ‘ কাজ হবে না এতে। এখন কিন্তু আরও শক্ত করে ধরবো। আর সঙ্গে… ‘
সমারোহ ছাড়ছে তো না’ই আরো শক্ত করে ধরেছে। পরিস্থিতি খারাপ দেখে কুহেলী নিরুপায় হয়ে দ্রুত বলে,
‘ সমারোহ সমারোহ সমারোহ। হয়েছে? ছাড়ুন এবার, ব্যাথা পাচ্ছি আমি। ‘
‘ হয়নি সুন্দর করে বলো। ‘
‘ সমারোহ, ছাড়ুন আমাকে। ‘
সমারোহ ছেড়ে দেয় কুহেলীকে। কুহেলী সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে দূরে সরে গিয়ে চাপায় হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখে বলে,
‘ আপনি বেজায় খারাপ লোক। ব্যাথা দিলেন শুধুশুধু। আমি আপনাকে ক্ষমা করবো না। ‘
সমারোহ অন্যদিক তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। মাথার চুল ঝাঁকি দিয়ে আঙুল দিয়ে একবার হাত বুলিয়ে হাসতে হাসতেই বলে,
‘ তুমি জানো না তুমি রাগ করলে কতটা অপূর্ব দেখায় তোমায়। জানলে আমার সামনে কখনো রাগই করতে না। ‘
কুহেলী রাগার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সমারোহর কথায় রাগ লজ্জায় পরিনত হয়ে লজ্জাবতী লতিকার ন্যায় লুটিয়ে পড়ে। মাথা নিচু করে কুহেলী বলে,
‘ আপনি একটা যা তা! ‘
‘ হা হা, মেডিক্যালে চাকরিটা রিজাইন দিয়েছি। দুদিন পর আমার জন্য একটা ফেয়ারওয়েল পার্টি দিয়েছে। আমার সঙ্গে তোমাকেও এটেন্ড করতে হবে এজ মাই ওয়াইফ। ‘
‘ আপনার ফ্লাইট তো একমাস বাদে, এখনই কেনো ব্রেক নিলেন? ‘, অবাক হয় কুহেলী।
‘ তোমার জন্য। ‘
কুহেলীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে সমারোহ। এ চাহনি গভীর, বড্ড গভীর। কুহেলী হতবিহ্বল হয়ে বলে, ‘ আমার জন্য মানে? আমি কি বলেছি ছেড়ে দিন এখনই? ‘
‘ এখন শুধু তোমায় সময় দিব। ‘
সমারোহর কথা শুনে হুট করেই কুহেলীর মন খারাপ হয়ে যায়। একহাতে অপর হাত ঘষতে ঘষতে চাপা স্বরে কুহেলী বলে,
‘ অভ্যাস করিয়ে দিয়ে চলে যাবেন তাই তো! ‘
কুহেলীর কথা শুনে হালকা হাসে সমারোহ। অভ্যাস! কিন্তু সমারোহর যে অভ্যাসের চেয়েও ভয়ংকর কিছু হয়ে গেছে কুহেলী। চাহনি ভর্তি ভালোবাসা নিয়ে কুহেলীর দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকে সমারোহ। কেনো যেন আজ অনেক ইচ্ছে করছে তার বিয়ে করা বউকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে আমি তোমায় খুব ভালোবাসি কুহেলী। কিন্তু বউটা যে খুব ছোট কাছাকাছি এসে চলে যাওয়ার ধাক্কা সামলাতে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমারোহ নিজেকে কন্ট্রোল করে বলে,
‘ এসো এসো, এদিকে আসো। ‘
কুহেলী আরো দূরে সরে গিয়ে বলে, ‘ মোটেই না। গেলেই আবার ধরে জ্বালাতন করেন! আমি আপনার দ্বারকাছ মারাবো না আর। ‘
‘ তো কোথায় যাবা? আমার ঘরেই তো আছো। ‘
‘ দূরে দূরে থাকবো। ‘
‘ তা হতে দেব না। আরে আসোনা কিচ্ছু করবো না, আসো। ‘
কুহেলী আড়চোখে তাকিয়ে থাকে সমারোহর দিকে। গোটা মুখ জুড়ে তার অবিশ্বাসের ছাপ। সমারোহ কুহেলীকে দেখে হাসি থামাতে পারেনা। হাসতে হাসতেই বলে, ‘ সত্যি বলছি, আসোনা! ‘
‘ প্রমিজ? ‘
‘ আচ্ছা প্রমিজ। ‘
তার কুহেলী সমারোহর কাছে যেতেই সমারোহ কুহেলীকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে লেপ্টে থাকা অবাধ্য কিছু চুল হাতে নিয়ে দু‘আ পড়ে,
‘
اَللّهُمَّ إنِّيْ أسْألُكَ مِنْ خَيْرِهَا وَخَيْرِ مَا جَبَلْتَ عَلَيْهِ . وأعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَشَرِّ مَا جَبَلْتَ عَلَيْهِ.
আল্লাহুম্মা ইন্নি আসয়ালুকা খায়রাহা ওয়া খায়রা মা জাবালতাহা আলাইহি। ওয়া আউজু বিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি মা জাবালবাহা আলাইহে। ‘
তারপর কুহেলীর কপালে গভীর চুমু খেয়ে তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কিছুসময়। পরক্ষনেই কুহেলীর হাতে একটা সুন্দর ব্রেসলেট পরিয়ে দিয়ে বলে,
‘ তোমার গিফ্ট। এবার দ্রুত গিয়ে ওজু করে আসো নামাজ পড়বো। ‘
মুহুর্তেই অত্যন্ত খুশি হয়ে যায় কুহেলী। দুজন একসাথে নফল নামাজ পরে নেয়। নামাজ শেষে একসঙ্গে মোনাজাত করে। আজ সমারোহর মোনাজাতে কেবলই কুহেলী ছিল। কুহেলীর যেন আজ নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। অনেকদিনের অপ্রত্যাশিত ভাবনা আজ পূরণ হলো। প্রিয় মানুষটার ভেতর জুড়ে হয়তো এখন কেবল তার বসবাস। কুহেলীর তখন খুব ইচ্ছে করছিল সমারোহকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে গিয়ে তারা গুনবে, কফিতে হালকা গল্প হবে। প্রফুল্ল মনে সমারোহকে কিছু বলতে গিয়ে দেখে সমারোহ জায়নামাজ রাখতে গিয়ে কি একটা কাগজ খুব মন দিয়ে পড়ছে। সমারোহর মুখ দেখে কুহেলীর মনে হয় খুব খারাপ কিছু একটা হয়েছে। কুহেলী সমারোহর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে কাগজটা কুহেলীর দিকে এগিয়ে দেয় সমারোহ। কুহেলী পড়তে শুরু করে,
‘ প্রিয় সমারোহ,
প্রিয় বলার অধিকার আমি রাখি কিনা জানি না। তবে তুমি আমার প্রিয় সবসময়ই ছিলে। আমি তোমার জীবনের উপর অনেক অন্যায় করেছি আমি জানি, ক্ষমাও চেয়েছি। আজ শেষ বারের মতো চাইছি। আমি সত্যিই অনুতপ্ত। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার প্রতি এতো অন্যায় করার পরও তোমার পরিবার আমার অসহায়ত্বের সময় আমার পাশে ছিল। যখন আমার কেউ নেই এমনকি শ্বশুর বাড়ির কেউ আমায় চায়না তখনও আমি ভরসা পেয়েছি, তোমরা আছো। সারিকা আপু আমাকে নিজের বুকে আগলে রেখেছেন আমার কঠিন সময়ে। আপু না থাকলে হয়তো এই আলো সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকেই থাকতে পারতো না। আমি তোমাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি আর ঋণের বোঝা বাড়াতে চাই না। তুমি যখন চিঠিটা পাবে ততক্ষণে আমি হয়তো অনেক দূরে চলে এসেছি। সারিকা আপুকে বলিনি আমি চলে যাচ্ছি। আপু জানেন আমার এক ক্লোজ ফ্রেন্ডের বাসায় এসেছি ক’দিনের জন্য দেখা করতে। বললে হয়তো এভাবে চলে যেতে দিতো না। আপুকে জানিয়ে দিও আমি আর কোনোদিনই ফিরবো না। তোমরা সবাই ভালো থেকো। তোমার জীবন সঙ্গিনী হিসেবে কুহেলীই পুরোপুরি পারফেক্ট। আমি দোয়া করি তোমাদের জন্য। আমি বেশি কিছু লিখতে চাইছি না। অনেকদিন ছিলাম তো তোমাদের বাড়ি। এবার যাওয়ার সময়। আমি চলে যাচ্ছি। সবার মাঝে আমি ইউজলেস। তাই সবার থেকে বিদায় নিলাম।
ইতি,
আলো। ‘
কুহেলী অবাক হয়ে চেয়ে থাকে সমারোহর দিকে। সমারোহ কিছু না বলে কয়েক সেকেন্ড কিছু ভেবে চিঠিটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সারিকা চিঠিটা পড়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। সারিকা জানে আলোর এখন তাদের দরকার। এই মুহূর্তে তার আপন বলতে কেউ নেই। আলোর বাবা মা মারা গেছে অনেক আগেই। পৃথিবীতে বাবা মা ছাড়া আত্মীয়-স্বজন সকলেই পর। আলোর তেমনটা। মেয়েটা এমন কঠিন সময় কোথায় যাবে? সারিকা পাগল হয়ে উঠে। একে একে আলোর পরিচিত সবার কাছে খোঁজ নেয়া হয়। আত্মীয় থেকে শুরু করে ক্লাসমেইট অবধি। কেউ আলোর খবর জানে না। উপায় না পেয়ে সমারোহ আর সান্দ্র সে রাতেই ছুটে পুলিশ স্টেশন আলোর মিসিং ডাইরি লিখাতে। সমারোহ যাওয়ার পর কুহেলী চুপচাপ ছাদে চলে আসে। দোলনায় বসে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। এমন না যে তার চিন্তা হচ্ছে না আলো জন্য। খুব হচ্ছে। কিন্তু কেনো যেন মন অবাধ্য হয়ে চোখকে আষাঢ়ের বৃষ্টির ন্যায় সিক্ত করতে চাইছে। এই রাতে কি তার একা হওয়ার কথা!
চলবে.
আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৪৭.
ক্লান্ত শরীরে সোফার একধারে বসে রয়েছে আলো। তার ঠিক পাশেই সারিকা আর সমারোহ। আলোকে খাইয়ে দিচ্ছেন আনরুবা, মাঝেমধ্যে দু’একবার শাসনও করছেন এভাবে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার জন্য। আলো মাথা নিচু করে রয়েছে। কুহেলী উপরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখছে সবটা। আলোকে খোঁজার দুদিন পর তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়। তার বাবা মার কবর বাড়ির ঠিক পেছনে। এতোদিন কবরের পাশেই কাটিয়েছে আলোর দিন রাত। দাদু মারা যাওয়ার পর তালাবন্ধই ছিল বাড়িটা এতো বছর। একলা বাড়িতে থেকে না খেয়ে-পরে শরীর অসুস্থ বানিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। আলো ফিরে আসতে নারাজ হলেও সারিকা একপ্রকার পাগল প্রায় হয়ে সমারোহকে সাথে নিয়ে গিয়ে ফিরিয়ে এনেছে আলোকে।
আলো ফিরে এলেও একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। চোখের ক্লান্ত চাহনি আর ঠোঁটের মৃত হাসি দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে একাকিত্ব মেয়েটাকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে দিয়েছে। বাড়ির সকলে অনেক বেশি করে খেয়াল রাখছে আলোর। ডিপ্রেশনের জন্য সাইক্রেটিস দেখানো হচ্ছে নিয়ম করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু লাভ হচ্ছে না। তবে এখন সমারোহর সঙ্গে আলোর সম্পর্ক আর আগের মতো নেই। আলো ভুল শুধরেছে বিপরীতে সমারোহ তার প্রতি বন্ধুত্বের পথ খুলে দিয়েছে। এছাড়া বাড়ির বাকি সকল কিছুই প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী চলছে। তবুও মাঝে মাঝে কুহেলীর আলোকে অসহ্য লাগে। সমারোহর পাশে আলোকে দেখলে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। কিন্তু হিংসা কিংবা আলোকে অপছন্দ কুহেলী কোনোদিনই করেনি। ইদানীং কেনো এমনটা হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। ভালো লাগে না কিছু তার। সমারোহর কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতে ইচ্ছে করে। গোটা দুনিয়ার সামনে অদৃশ্য হয়ে যেতে চায় সে কারণবিহীন। ভালোলাগাগুলো অপছন্দের কারণ হচ্ছে। সব ছন্নছাড়া শূণ্যে ভেসে যাওয়া ফেকাসে পাতার মতোন যেন। নিজের মানুষকে একান্তই নিজের সৃষ্ট গন্ডির মধ্যে রাখার ইচ্ছা এটা! নাকি আসলেই অজানা কিছু রয়েছে এতে।
কুহেলীর পরীক্ষা শুরু হয়েছে দুদিন হলো। এখন সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজেই দিন কাটে কুহেলীর। ঘুম খাওয়ার বাহিরে এক সেকেন্ড সময় নষ্ট করা চলবে না। ইয়ার ফাইনাল প্রফ এটা! একেকটা প্রফ মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের জন্য একেকটা অগ্নিপরীক্ষার চেয়েও বেশি কিছু। ক্লাস বন্ধ থাকায় রোজ সকালে উঠে আনরুবার হাতের কফি খেয়ে সমারোহর স্টাডিরুমের দক্ষিণা জানালার কাছে বইয়ে মুখ লুকিয়ে যে বসে, উঠে একদম সন্ধ্যায়। দুপুরে আনরুবা এসে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে যায়। সন্ধ্যায় ঠিক দশ মিনিট ছাদে রিলাক্স হয়ে এসে আবার পড়া চলে রাত একটা দুটা অব্দি। ইদানীং আনরুবার সঙ্গেই ঘুমায় সে। সমারোহ নামক মানুষটাকে যেন কুহেলী তার প্রতিটা সময় থেকে মুছে দিয়েছে। পড়ার চাপে কিংবা পরীক্ষার ভয়ে নয়, ইচ্ছে করেই। মাঝেমধ্যে খুব ভাবে কুহেলী নিজে থেকেই কেনো এই দূরত্ব সৃষ্টি করছে? জানা নেই, আসলে কোনো কারণ নেই। কিন্তু ভেতরে কোথায় যেন বিশাল বড় একটা অভিমান কাটার মতো বিধে আছে। কুহেলী খুব করে চাইছে সমারোহ তার অভিমান ভেঙে দিক কিন্তু সমারোহ তা করছেন না। যত দিন যাচ্ছে অভিমানের সমুদ্রে আছড়ে পড়া ঢেউগুলো অভিযোগে পরিনত হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে দূরত্ব। সমারোহর মোহজাল ছিড়ে কুহেলী হারিয়ে যাচ্ছে তবু সমারোহ যেতে দেবে কেনো!
একটু আগে দুপুরের খাবার খাইয়ে দিয়ে গিয়েছেন কুহেলীর মামনি। আজ কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারছে না কুহেলী অথচ পরশু পরীক্ষা। বই বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। দেখতে দেখতে সমারোহর চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আজকের দিনটার পর কাল দিন ফুরিয়ে রাত হলেই সমারোহ কুহেলীর কাছ থেকে অনেক, আরো অনেক দূরে সরে যাবে। কাছে থেকেও যে দূরত্বের পরিমাপ কুহেলী করতে পারছে না শতশত কিলোমিটার দূরে চলে সে শূন্যস্থান কুহেলী পূরণ করবে কি করে। গত অনেকদিন ধরে কুহেলীর ভেতরে আগুন জ্বলে রয়েছে। মানুষটা চলে যাবে সহ্য করতে পারছে না সে। চাইলেই আর দেখা হবে না। ছুঁয়ে দিতে চাইলে উনার ঘরের স্মৃতিটুকুই হবে শেষ সম্বল। কুহেলীর অন্তরে কাঁপুনি ধরানো কন্ঠস্বর যে আর তার নাম ধরে ডাকবে না। আচ্ছা! উনার বুকে কি আর কখনো মাথা রাখার সৌভাগ্য হবে কুহেলীর? কুহেলীর বুক ফেটে যায় এসব ভাবলে। কাউকে হয়তো বুঝতে দেয়নি সে, বইয়ের পাতায় পাতায় কাটিয়েছে সময় কিন্তু তার ভেতর যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কুহেলীর চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরে পড়ে। টেবিলে হাত ভাঁজ করে তার উপর মাথা ঠেকিয়ে শব্দ করে কাঁদতে থাকে সে। নাহ, কুহেলী একমুহূর্তও থাকতে পারবে না সমারোহকে ছাড়া। সমারোহ যে তাট শিরায় শিরায় মিশে গিয়েছে। তাকো ছাড়া নিঃশ্বাস নিবে কি করে সে! তার তো এখনই দম বন্ধ হয়ে আসছে।
কুহেলী কাঁদছিল তখন লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে সমারোহ। কুহেলীর সঙ্গে কথা বলতেই এখানে এসেছিল সে। মন গভীর কালো মেঘে ছেয়ে ছিল। কুহেলীকে কাঁদতে দেখে তা যেন বিধংসী কালবৈশাখীর রূপ নিয়েছে। সমারোহ চুপচাপ দাড়িয়ে কুহেলীকে দেখে কিছুক্ষন। তার ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে কুহেলী কষ্টগুলো সব গিলে নিতে। বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নিতে তার প্রেয়সীকে। অথচ সময়টা বড়ই ভুল। সমারোহ চাইলেই সব পারে না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে ত্রস্ত পায়ে স্টাডিরুম থেকে বের হয়ে দরজায় নক করে ভেজা গলায় বলে,
‘ কুহেলী আসবো? ভেতরে আছো? ‘
সমারোহর কন্ঠ পেতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে কুহেলী। নিজেকে ধাতস্থ করে দ্রুত চোখের জল মুছে নিয়ে খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে বলে,
‘ হ্যা,হ্যা আসুন। ‘
সমারোহ ভেতরে ঢুকে কিছু সময় অপলক চেয়ে থাকে কুহেলীর পানে। কুহেলী জানালার পাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখ ফোলা ফোলা। দেখে মনে হয় গত কয়েকদিন ঠিক মতো ঘুম হয়নি। চেহারায় কান্নার ভাব স্পষ্ট অথচ কন্ঠে তা বোঝার উপায় নেই। সমারোহ টেবিলের কাছে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে বলে,
‘ প্রস্তুতি কেমন? ‘
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ‘
‘ সব কমপ্লিট? ‘
‘ হুম। ‘
‘ আমার ঘরে বিছানায় শাড়ি আর অর্নামেন্টস আছে। পড়ে নিচে আসো আমি অপেক্ষা করছি। ‘
সমারোহ দরজার দিকে পা বাড়াতে কুহেলী পেছন থেকে বলে উঠে, ‘ কিন্তু আমি… ‘
সমারোহ কুহেলীকে কিছু বলতে না দিয়ে বলে উঠে, ‘ আআঃ, আমি কোনো কিন্তু-টিন্তু শুনতে চাইনা আর কোনো এক্সকিউজ ও চাইনা। দ্রুত আসবে বেশি সময় নেবে না। ‘
সমারোহ চলে গেলে কুহেলী ঘরে এসে দেখে বিছানায় দুটো ব্যাগ রাখা আছে। কুহেলী ব্যাগ থেকে শাড়িটা বেড় করে দেখে হ্যান্ডপ্রিন্ট করা সম্পূর্ণ হোয়াইট হাফ-সিল্কের একটা শাড়ি, সঙ্গে ব্ল্যাক স্টোনের কানের দুল আর বালা। শাড়িটা দেখে নিমিষেই মন ভালো হয়ে যায় তার। কি সুন্দর! মুচকি হেসে ঘরটার দিকে একবার চোখ বুলায় কুহেলী। প্রায় বিশ-একুশ দিন এই ঘরে আসা হয়নি তার। ঘরটা আগের মতো থাকলেও নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে যেন। পড়াশোনার ব্যস্ত কুহেলীর কোনোদিন সাজসজ্জায় নজর দেয়া হয়নি। ভালো করে শাড়ি পড়তে জানা নেই তাই আনরুবা পড়িয়ে সাজিয়ে দেন কুহেলীকে। তারপর কুহেলীর কপালে চুমু খেয়ে বলেন,
‘ সমারোহ দিয়েছে বুঝি শাড়িটা! বের হবে ওর সাথে? ‘
কুহেলী লাজুক হাসে। আনরুবা কুহেলীর হাসি দেখে হেসে বলে,
‘ হয়েছে আবার লজ্জা পেতে হবে না। সারাক্ষণ শুধু লজ্জা পায় মেয়ে আমার। ‘
তারপর কুহেলীর কানের কাছে গিয়ে নিচুস্বরে বলেন, ‘ দুজনার মাঝের দূরত্ব সব এবার মিটিয়ে ফেলবে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হবে বন্ধু মতো যেখানে চাইলেও কেউ কারো থেকে সরে যেতে পারবে না। আর এখানে নিজে থেকে দূরত্ব সৃষ্টি করলে দুজনার মাঝে তৃতীয় হয়ে আসে শয়তান। আমার ছেলেটা চলে যাওয়ার আগে তার মনটা আচ্ছা করে তোমার আঁচলে বেধে ফেলো তো! ‘
কুহেলী এতোটাই লজ্জা পায় যে দৌড়ে সে ঘর থেকে চলে আসে। আনরুবা হো হো করে হেসে উঠেন। পরক্ষনেই তার মুখশ্রী আষাঢ়ের বাদলে ছেড়ে যায়। সারা দুনিয়ার খবর তিনি জানেন না। আনরুবা শুধুমাত্র তার ছেলেকে আগের অবস্থানে দেখতে চান না। খুব ভয় তার। মায়ের মন বলে কথা!
সমারোহ ড্রইংরুমে বসে ম্যাগাজিন দেখছিল তখনই আলো জগে পানি নিতে নিচে এসে দেখে সমারোহ কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছে। আলো কৌতুহল বশত সমারোহকে জিজ্ঞেস করে,
‘ বউকে নিয়ে কোথাও বের হচ্ছো নাকি এভাবে সেজেগুজে। ‘
কথাটা মজার ছলে বলেছিল আলো। সমারোহ সামান্য হেসে বলে, ‘ হুম। ‘
সমারোহর কথা শুনে আলোর মুখ ফসকে বের হয়ে গেল, ‘ সমারোহ তুমি কুহেলীর সঙ্গে বের হচ্ছো? কই আগে বলোনি তো? ‘
‘ কেনো তোমাকে বলার কথা ছিল? ‘
সমারোহ পাল্টা জবাবে বেশখানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে আলো। হাসার চেষ্টা করে বলে, ‘ না,না মানে আমি ভেবেছিলাম বিকেলে কুহেলীর সঙ্গে একটু আড্ডা দেব। এই আর কি। এনজয় দ্যা টুর। ‘
আলো কিছু না বলে দ্রুত প্রস্থান করে। সমারোহও কুহেলীকে নিয়ে বের হয়ে পরে। সমারোহ গাড়ি ড্রাইভ করছে একমনে। সঙ্গে মৃদু সুরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’। কুহেলী নিশ্চুপ জানলায় বাহিরের দৃশ্য দেখছে। তার আধা খুলে যাওয়া খোপার অগোছালো চুল বারংবার অন্যমনস্ক করে তুলছে সমারোহকে। একটু বাদে বাদে আঁড়চোখে কুহেলীকে দেখে নিজের চোখ শান্ত করছে সমারোহ। কুহেলীর অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই। সমারোহকে সে একপলক ও দেখবে না। অভিমান করছে যে! ঘন্টাখানেক টানা ফুলস্প্রিডে ড্রাইভ করে রাঙ্গুনিয়ার কোদালা চা বাগানে গাড়ি থামায় সমারোহ। কুহেলী এক ঝলক দেখে পরিবেশটা। একদিকে পাহাড় ঘেরা সবুজের সাথে মেঘের লুকোচুরির অপূর্ব সন্ধির দৃশ্য অন্যদিকে চা বাগানের পাশ ঘেঁষে লুসাই কন্যা কর্ণফুলীর মন মাতানো ঢেউ যে কাউকে মুহুর্তে সতেজ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। চা বাগানের একদিকে দৃষ্টি কেড়ে নেওয়া ব্রিটিশ বাংলো, পাখির খঁচিমিচির শব্দ আর চা শ্রমিকদের ক্লান্তিহীন কর্মযজ্ঞ বিনোদনে যেন জায়গাটা পুরো রূপকথার অজানা এক রাজ্য। কুহেলী যেন এক মুহূর্তের জন্য সমারোহর প্রতি সব মান-অভিমান ভুলে যায়।
সমারোহ কুহেলীর কাছে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘ পছন্দ হয়েছে ম্যাডাম? ‘
‘ খুব। ‘
অনেক উত্তেজেনা নিয়ে কথাটা বলে নিজেই লজ্জা পায় কুহেলী। তার চোখে মুখে ঠোঁটে আনন্দের ঝলক। সমারোহ অনেকদিন পর কুহেলীকে এমন খুশি দেখছে। মেঘলা আকাশের আলো ছায়ার খেলায় ব্রিটিশ স্থাপত্যের বাংলোগুলো ঘুরে দেখে সমারোহ আর কুহেলী। দুজনারই মুখে কোনো শব্দ নেই। নিস্তব্ধ পরিবেশে একে অপরের আঙুল আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে হেটে চলেছে উঁচুনিচু টিলার আঁকাবাকা সরু রাস্তা ধরে। টিলা ধরে অনেকটা উপরে যাওয়ার পর নিরিবিলি একটা জায়গায় বসে পরে সমারোহ। কুহেলী দাঁড়িয়ে থাকায় তাকেও টান দিয়ে বসিয়ে দেয় নিজের পাশে। কুহেলীর দিকে একবার তাকিয়ে একটানে তার খোঁপা খুলে ফেলে সমারোহ। কুহেলী সমারোহর এহেন কান্ডে চমকে গেলেও তাকে বুঝতে না দিয়ে আবার চুল বাঁধতে শুরু করে। সমারোহ মৃদু স্বরে বলে,
‘ খোলা থাক না। সুন্দর লাগছে। ‘
কুহেলী সমারোহর কথায় পাত্তা না দিয়ে বেঁধে ফেলে চুল। রাগান্বিত কুহেলী ফোলা মুখশ্রী দেখে ভীষণরকম হাসি পায় সমারোহর। নাটকীয় ভঙ্গিতে সে বলে,
‘ পরীক্ষায় কনসেন্ট্রট কার জন্য আমার কাছ থেকে দূরে রাখায় দেখি ম্যাডাম বেশিই দূরে সরে গেছেন আমার কাছ থেকে! তো এতো অভিমানের কারণ জানতে পারি। ‘
‘ আমি অভিমান কিংবা রাগ কিছুই করিনি। ‘
‘ তাহলে নাকটা লাল কেনো? ‘
সমারোহ কুহেলীর নাক আলতো করে টেনে দেয়। চমকে গিয়ে নিজের দ্রুত নিজের নাকে হাত দিয়ে পেছনে সরে যায় কুহেলী। সমারোহ কুহেলীর চোখে চোখ রেখে ভেজা স্বরে বলে,
‘ কুহেলী, তোমার অভিমান কিংবা রাগ, কোনটা ভালোলাগা, কিসে কতটুকু খারাপ লাগা সবটা আমি বুঝি। তুমি অভিমান করতে পারো। আমার প্রতি রাগও করতে পারো। এটা অধিকার তোমার। তবে আমাকে তোমার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য তোমার কাছে আসার সুযোগ তো দিতে হবে। পরশু চলে যাচ্ছি, যতটুকু সময় হাতে ছিল একে অপরকে বুঝতেই লেগে যেতো। তুমি আমাকে তোমার কাছেই যেতে দিলে না! এই দূরত্বটা কি আমার প্রাপ্য ছিল? আমার কোনো ভুল ছিল? থাকলে কি ভুল বা কোনটা তোমার ভালোলাগছে না বুঝিয়ে দিতে। ‘
‘ আমি ভেবেছি আপনি বুঝেছেন। ‘
কথাটা বলে কুহেলী মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সমারোহ কুহেলীর কাছে গিয়ে মাথার কোণে একটা চুমু খেয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
‘ আমি বুঝেছি। ‘
‘ আমার ভালো লাগছে না। বাড়ি যাব। ‘
‘ আমার সাথেও লাগছে না? ‘
‘ না। ‘
‘ এতো কষ্ট দিয়ে ফেলেছি? ‘
‘ হুম। ‘
সমারোহর ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠে। কুহেলীর খুব কাছাকাছি গিয়ে বলে, ‘ আমি জানি ভালোবাসার মানুষের যেকোনো ছোট্ট ভুলেই কষ্ট বেশি পাওয়া যায়। তা, ভালোবাসো নাকি আমায়? ‘
ভড়কে যায় কুহেলী সমারোহর কথা শুনে। লোকটা এমন অসময়ে অদ্ভুত সব কথা বলে যে কুহেলী প্রতিবার স্তব্ধ হয়ে যায়। কুহেলী কেনো যেনো এখন চেয়েও রাগ করতে পারছে না। তারপরও মুখ ভাড় করে বলে,
‘ আলোর সঙ্গেই কেনো যেতে হবে! অন্য ফ্লাইটে যাওয়া যেতো না? ‘
‘ আপু আর বাবুরা আছে সঙ্গে। দুলাভাই নেই, একা কিভাবে ছাড়ি? ‘
‘ যেয়ে আপুর বাসাতেই থাকবেন? ‘
‘ আপাতত সেখানে কয়েকমাস থাকবো। ‘
‘ ওহ! ‘
সমারোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কুহেলী তাকে নিয়ে কেনো ইনসিকিউর ফিল করছে সে জানে কিন্তু তার এটা মোটেই ভালো লাগেনি। কুহেলী কি এখনো বুঝতে পারছে না সে কতোটা চায় তাকে! কতোটা ভালোবাসে। এবার তো তার নিজের ও রাগ করতে মন চাইছে। সমারোহ গম্ভীর হয়ে বলে,
‘ আমাদের স্পেস দরকার কুহেলী! তুমি হয়তো আমাকে এখনো বিশ্বাস করতে পারছো না। আমি চলে যাওয়ার পর হয়তো তুমিও সময় পাবে একটু আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানার। ‘
কুহেলী অবাক চোখে দেখে সমারোহকে। তার মনের গভীরে জায়গা করে নেয়া মানুষটা আর বর্তমানে তার সমানে দাঁড়ানো সমারোহতে যেন আকাশ পাতাল তফাৎ। কুহেলীর কথা বলার ইচ্ছা হারিয়ে গিয়েছে। সমারোহ তার দিকে জিজ্ঞেসাপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে আছে বলে অনিচ্ছা স্বত্তেও কুহেলী বলে,
‘ ব্যাপারটা অবিশ্বাসের নয়। আমার মনে হয় আপনি কুহেলীকে চিনতে ভুল করেছেন। কুহেলী অতো সহজে কারো উপর অবিশ্বাসের বোঝা চাপিয়ে দেয় না আবার অত সহজে বিশ্বাস ও করে না। বিষয়টা হলো এমন আমি কোনো ছেলের সঙ্গে ক্লোজ হওয়া তো দূরের কোনো পুরুষ আমাকে পছন্দ করলেও আপনার সহ্য হয়না। কেনো? এর মানে আপনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন? ‘
সমারোহ চুপ থাকে। কুহেলী সমারোহর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে উঠে যায় সমারোহর পাশ থেকে। কটমটে গলায় বলে,
‘ আমি বাড়ি যাব। ‘
‘ তো যাও। ‘
‘ মানে? ‘
‘ মানেটা সহজ। আটকে রেখেছে কে তোমায়? যেতে ইচ্ছা হলে একা চলে যাও। ‘
লোকটা মজা করছেন তাকে রাগিয়ে দিয়ে! কুহেলীর এবার অদম্য ইচ্ছা জাগে পাগলা কুকুরের মতো সমারোহকে কামড়ে দিতে। তবে যদি একটু মাথা ঠান্ডা হয়! চোখ বুঁজে ঠোঁট কামড়ে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে কুহেলী বলে,
‘ আমি রাস্তাঘাট কিছু চিনিনা। একা কিভাবে যাবো? ‘
‘ সে তুমি জানো। আমি তো এলাম বউয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে। ‘
‘ আমি বাড়ি যেতে চাই মানে যেতে চাই। আপনি নিয়ে এসেছেন আর এক্ষুনি আপনিই আমাকে বাড়ি দিয়ে আসবেন। ‘
‘ কিন্তু আমি তোমাকে এখন আমার কাছে চাই, একদম কাছে। ‘
কথাটা বলেই কুহেলীর কোমড় ধরে নিজের সাথে লাগিয়ে নিয়ে কিছুটা উঁচু করে ধরলো। কুহেলী এখন সমারোহ বরাবর হয়েছে। সমারোহ এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে টপাটপ অনেকগুলো চুমু খেয়ে নেয় কুহেলীর পুরো মুখে। তারপর মুখ গুঁজে দেয় গলায়। সেদিনের কামড় দেয়া জায়গায় ছোট্ট আরেকটা কামড় বসায় সমারোহ। কুহেলী ছুটার জন্য ছটফট করলেও সাথে সাথে ছাড়ে না। কামড়ের দাগ আরো গভীরতর করে সেখানে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে ফিসফিসে গলায় বলে,
‘ তুৃমি চাও কিংবা না চাও তোমাকে আমার খুব কাছেই থাকতে হবে। তোমার পায়ের শিকল যে আমার কাছে। যতোই দূরে থাকো আর যাই করো দিন শেষে আমার কাছেই তোমায় ফিরতে হবে। ‘
চলবে.