আকাশ মোড়ানো চিরকুট পর্ব-১৮+১৯+২০

0
426

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

১৮.

ভোর বেলা পুকুরের ঠান্ডা জলে ইচ্ছে মতো সাঁতার কেটে গোসল সেরে এসেছে কুঞ্জা।মন, শরীর অনেক বেশি হালকা লাগছে এখন।রাতে সে স্বপ্নে দাদাভাইকে দেখেছে। দাদাভাইয়ের কোলে মাথা রেখে কুঞ্জা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর গল্প। যে ঘরে শুয়ে ছিল ঘরটা অন্ধকার। দাদুভাইয়ের শিয়রে একটা মোটা মোমবাতি জ্বলছিল। দাদাভাই কুঞ্জাকে গল্প শোনার মাঝে হুট করে থেমে বলেন,

‘ দাদুমনি আমার এবার যেতে হবে।তুমি যাবে আমার সাথে?’

কুঞ্জা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘না যেয়ো না তুমি।’

দাদাভাই চিন্তিত হয়ে বলেন,
‘যেতে তো হবেই তবে চিন্তা করোনা তুমিও খুব দ্রুত চলে আসবে।আমি তোমায় নিতেই এসেছিলাম কিন্তু এখন না পরের বার নিয়ে যাব।’

দাদাভাইয়ের চেহারার রং পাল্টে গেছে। ভয়ংকর দেখায় তাকে।কুঞ্জার ভয়ে ঘুম ভাঙ্গে স্বপ্নটা দেখে।তার দাদা প্রায় সাতাশ বছর আগেই মারা গিয়েছিলেন নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে নৌকাডুবিতে।কুঞ্জা তাকে সামনাসামনি দেখেনি, একটা সাদাকালো ছবি আছে দাদাভাইয়ের, তাও চেহারা বুঝা দায়।যাকে কোনোদিন দেখেনি তাকে স্বপ্নে কেন দেখলো?সময়টা এতো বাজে কেনো যাচ্ছে! সারারাত আর ঘুম হয়নি। সকালে ফজর নামায পড়ে কোরআন শরীফ পড়ে দুঘন্টা।তার গোসল সেরে উঠানে আসতেই দেখে খোর্শেদ আর সান্দ্র নাশতা করছে।গরম গরম লুচি দিয়ে বেগুন ভাজা সাথে রসুনের আচার।

কুঞ্জা কাল রাতে বাড়ির বাহিরে যায়নি।সান্দ্র বলেছে সে দেখবে বিষয়টা। সান্দ্র গত দু’রাত ঠিক মতো ঘুমায়নি কুঞ্জা বাহিরে রায় কিনা খেয়াল রাখতে কিন্তু মেয়েটা যায়নি। সান্দ্র মনে মনে ভেবে নেয় এটা‌ হয়তো কুঞ্জার দুঃস্বপ্ন।আজকেই চিটাগাং ফিরে যাওয়ার কথা সান্দ্রর‌।ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়েছে সব।দশটায় রওনা দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা আর হলো না। গোসল করে খেতে বসে কুঞ্জা হঠাৎ চেঁচামেচি শুরু করে।তার গলায় কিছু আটকেছে, খুব ব্যাথখ করছে। হাসনাহেনা ভাবেন হয়তো খুব তাড়াহুড়ো করে খেতে গিয়ে গলায় খাবার আটকে ফেলেছে।কয়েকবার বকাঝকা করেন তারপর পানি খাওয়ান,ব্যাথা কমে না।রমলা দোয়া পড়ে ফুঁ দেন কুঞ্জার গলায়। সঙ্গে সঙ্গে গড়গড়িয়ে রক্তবমি করা শুরু করে কুঞ্জা।মুখ থেকে অনবরত বের হয়ে আসে টাটকা রক্ত। উপস্থিত সকলেই ঘাবড়ে যান তাতে‌। সান্দ্র দ্রতু কুঞ্জাকে মাথা উঁচু করে শুইয়ে দিতে বলে‌।পানি দিয়ে পরিষ্কার করে দেয়া হয় মুখের রক্ত।মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে যায় এবার।

সান্দ্র খোর্শেদের সাথে কথা বলে জানতে পারে এমন এর আগে কখনোই হয়নি। তাছাড়া পুরনো রিপোর্টগুলো চেক করে দেখছে কুঞ্জার কোনো ফুসফুসের রোগও নেই।তাহলে এমন হওয়ার কারনটা কি!তাহলে কুঞ্জা যে সেদিন ভয় পাচ্ছিল এর পিছনে সত্যিই কি কোনো কারন আছে! কিছু তো একটা ঘাপলা আছে এখানে।সান্দ্রর মন যা বলছে তা সে কিছুই বিশ্বাস করতে চাইছে না কিন্তু বিষয়টা হয়তো এর চেয়েও জটিল। একবার ঘাটিয়ে দেখতে হচ্ছে।

______________

অল্প কিছু সময় আগে জ্ঞান ফিরেছে কুহেলীর। পটিয়া সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তাকে।ঢিপঢিপ চোখে তাকাতে দেখতে পায় ঘরে দুজন নার্স খুব ব্যস্ত নিজেদের কাজে। ঘড়িতে দেখে রাত সাড়ে তিনটা। চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয় মাথার ডান পাশে। ইচ্ছে করে হাত দিয়ে জোরে চেপে ধরতে।ব্যাথায় প্রচুর কষ্ট হচ্ছে।কুহেলীকে তাকাতে দেখে একজন নার্স এগিয়ে এসে কুহেলীর মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে নিচু স্বরে বলে,

‘প্যাশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।তার ফ্যামিলি মেম্বারকে খবর দাও।’

তারপর কুহেলীর দিকে ফিরে বলে, ‘মাথার ব্যাথা আছে?’

কুহেলী ইশারায় সম্মতি জানায়।নার্স পাশের একটা ইঞ্জেকশনে ‘ট্রসপা’ ৪০ এম জি নিয়ে পুশ করে দেয় কুহেলীকে। ইঞ্জেকশন দেয়া জায়গায় তুলা দিয়ে মুছতে মুছতে বলে,

‘ব্যাথা কমে যাবে ধীরে ধীরে।ক্ষতটা খুব বেশি গভীর। তুমি করেই বলি, খুব সাহসী মেয়ে তুমি।একটা লোকের চোখ দুটো একদম নষ্ট করে দিয়েছো,কানের নিচে আঘাত দেয়ার মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লোকটা।’

কুহেলী শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে। কষ্ট করে একবার বলে,
‘ চন্দ্রিমা কেমন আছে?’
কথা বলতে চাইলে মনে হয় মাথা ফেটে মস্তিষ্ক বের হয়ে আসছে।মাত্র তিনটা ওয়ার্ড বলতেই এতো কষ্ট হচ্ছে! নার্স ব্যস্ত ভঙ্গিতে ওকে কথা বলতে নিষেধ করে। তারপর জানায় চন্দ্রিমাকে এখন অবজারভেশনে রাখা হয়েছে,তার অবস্থা সিরিয়াস।
অপর সিস্টার ঘরের ভেতর ঢুকে বলেন,
‘খবর দিয়েছি, আসছেন।’ তারপর আবার রুম ত্যাগ করেন।

কুহেলীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্স মুচকি হেসে বলেন, ‘তুমি খুব ভাগ্যবতী।’

কুহেলী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে তিনি আবার বলা শুরু করেন,
‘তোমার হাসবেন্ড তোমাকে খুব বেশিই ভালোবাসেন।‌যখন তোমাকে নিয়ে আসা হয়েছে তিনি কাঁদছিলেন। যতক্ষণ জ্ঞান ফিরেননি তোমার পাশেই বসে ছিলেন।এইতো কাল দুপুর থেকে একচুল ও নড়েননি।একটু আগেই তার বোন তাকে জোর করে নিয়ে গেলেন। অবশ্য তিনি ডক্টর বলে তোমার পাশে থাকার চান্স পেয়েছে।
ভালো হাসবেন্ড পাওয়া যায় কিন্তু এমন কেয়ারিং হাসবেন্ড কম মেয়েরাই পায়। তুমিও বুঝি ভালোবাসো খুব তাইনা?’

নার্সের কথা শুনে তাজ্জব বনে যায় কুহেলী।ভালোও লাগে।পুরো সময়টা সমারোহ কেন ছিল কুহেলীর পাশে? তখন না পৌঁছালে আজ হয়তো চোখ মেলে এই সুন্দর পৃথিবী দেখার তৌফিক হতো না। সমারোহ কেবিনে আসতেই হেসে সমারোহর সাথে কিছু কথা বলে চলে যান নার্স।কুহেলী চোখ বুঁজে থাকে, একবারও তাকায় না সমারোহর দিকে। সমারোহ এসে চুপচাপ কুহেলীর পাশে বসে। দুমিনিট বসে থাকার পর কুহেলী কথা বলতে চায় সমারোহর সাথে।বলতে চায় তার জন্য কেনো এতো কষ্ট করছে!সে তো সমারোহর কিছু হয়না। সহানুভূতি দেখাচ্ছে? সহানুভূতি দেখিয়েও কি এতো কিছু করে মানুষ? কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না কিছুই‌। প্রচন্ড ব্যাথায় কুঁকড়ে থাকে কুহেলী।ব্যাথাটা হয়তো আস্তে আস্তে কমবে।অবশ হয়ে থাকবে কুহেলী। সমারোহও কিছু বলে না। চুপচাপ বসে থেকে একটু পর বাহিরে চলে যায়।কুহেলী অনুভব করে চোখ বুঁজে। চোখের কার্ণিশ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে।একটু পড়েই সারিকা কেবিনে আসে খাবার নিয়ে।বড় একটা ট্রেতে বাড়িতে রান্না করা খাবার।কুহেলীর পছন্দের খাবার দেখেও খেতে ইচ্ছা করে না তার।উল্টো খাবারের ঘ্রাণে বমি পায়।

সারিকা খুব যত্ন করে কুহেলীর হাত পা মুছিয়ে দিয়ে নিজ হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দেয়।নরম খাবার এনেছে।তাও চিবিয়ে খেতে কষ্ট হয় বলে খেতে পারেনা খুব একটা।পেটে ক্ষুধা থেকেই যায়‌‌।সারিকা জোরাজুরি করলে সমারোহ রুমের ভিতরে এসে বলে,

‘আপু তুমি যাও আমি খাইয়ে দিচ্ছি ওকে।’

সারিকা অবাক চোখে সমারোহকে একবার দেখে বলে, ‘পারবি?’

‘টেনশন করতে হবে না। তুমি চলে যাও।নয়না কিংবা সেঁজুতি কেউকে পাঠিয়ে দিও।’

‘তুই যাবিনা?’

‘যাব পরে।’

সারিকা আর কিছু না বলে চলে যায়‌‌। সমারোহ এসে বিছানায় কুহেলীর সামনে বসে। সমারোহকে একপলক দেখে কুহেলী। সমারোহ কালকের সেই সাদা মেরুন মিশেল শার্টটাই পড়ে আছে।চোখ লাল টুকটুকে হয়ে আছে, হয়তো একফোঁটাও ঘুমায়নি। মুখে বিধ্বস্ততার ছাপ, চুল অগোছালো হয়ে কপাল ছেয়ে পড়ে আছে।মুখে একটা গম্ভীর ভাব।গলার অ্যাডামস অ্যাপলের দিকে চোখ যায় কুহেলীর।কথা বলার সময় দ্রুত উঠানামা করছে সেটা। সমারোহর মাঝে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গলার এই উঁচু অংশটা,তারপর তার নাক।কুহেলী অবচেতন মনে ভাবে তার স্বামীর যদি এমন অ্যাডামস অ্যাপল আর নাক থাকে তাহলে সবচেয়ে বেশি কামড়ে দেবে সেখানে।লোকটাকে এলোমেলো লাগলেও চোখ ফিরানো যায় না।ঢোক গিলে কুহেলী। সমারোহ তার জন্য স্যুপ নিয়ে এসেছে।কুহেলীকে খাওয়াতে চাইলে সে হাতের ইশারায় না করে দেয়। সমারোহ স্যুপের চামচ হাতেই চুপচাপ বসে থেকে একটু পর খুবই নরম গলায় জানতে চায়,

‘ক্ষুধা নেই?’

কুহেলী কিছু বলেনা। সমারোহ বুঝে নেয়।কুহেলীর সামন থেকে উঠে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

‘আচ্ছা এতোটা খেতে হবে না। শুধু পাঁচ চুমুক খাবে।এরপর আর জোর করবো না।’

কুহেলী কিছু বলেনা। সমারোহ তার খুব কাছে চলে আসে।কুহেলী এই প্রথম কোনো দ্বিধা ছাড়াই সমারোহর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সমারোহও অপলক তাকে দেখে চলে।সময়টা যেন থেমে যায়। অজান্তেই মনের অন্তর্হিত গোপন কুঠুরিতে তালাবদ্ধ করে করা কিছু কথা চোখের ভাষায় আদান-প্রদান হয়ে যায়।মনের মাঝে নব যৌবন মাখা বসন্তের বীণা।এই চোখে তাকিয়ে তাকিয়েই যদি মৃত্যু ঘনিয়ে আসে কোনো আফসোস থাকবে না।

সময় অতিবাহিত হয় এবং হতেই থাকে। হঠাৎই সমারোহ মাথা নুইয়ে মুচকি হেসে কুহেলীর দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়।কুহেলীর ধ্যান ভেঙ্গে যায়। কপাল কুঁচকে ফেলে সে। সমারোহ হাসতে হাসতে বলে,

‘ম্যাডাম মুখটা বন্ধ করুন।হা করে থাকলে তো মশা ঢুকে যাবে আর সেটাই খেতে হবে।স্যুপ তো পুরোটাই সাবার করে দিলেন।’

কুহেলী থতমত খেয়ে স্যুপের বাটির দিকে তাকায়।বাটিটাতে কম হলেও আধা কেজি স্যুপ ধরবে‌। আল্লাহ, এতোটা সে কখন খেলো? সুস্থ থাকলেও এতোটা খেতে পারতো না। সমারোহর সামনে আবার লজ্জায় পড়তে হলো কুহেলীকে।একটা একটা যাচ্ছে তাই অসভ্য জাতের লোক।সবার সামনে ততটা ভালো আর সাধু ভিতরে ভিতরে ঠিক ততটাই শয়তান।

চলবে.

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

১৯.

ছোট্ট বেলী ফুল গাছটাতে এই প্রথম ফুলের কুঁড়ি এসেছে। নিষ্পাপ সুদর্শন ছোট্ট কুঁড়িটার তীব্র গ্রাণ!ফুল ফুটলে হয়তো আরো মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়াবে! একদৃষ্টিতে বেলী গাছটার তাকিয়ে থাকে নয়না। সকালের নাস্তা সেরেই ছাদে এসেছে পরেছে সে। ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক এগারোতে।মাথা ফাঁটা কড়া রোদ। ঝলমলে সূর্যটা একটু পরপর গুচ্ছ মেঘে ঢাকা পড়ছে। আবার মেঘমালা গলে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।বাতাস তেমন একটা নেই।তাও নয়নার চুল মৃদু উড়ছে।রোদে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, শরীর পুড়ে যাচ্ছে, মাথা ঘুরাচ্ছে।উঠে নিচে যাওয়ার শক্তিটুকু নেই। সৌরভকে কমছে কম একশো বারের উপরে কল করে ফেলেছে নয়না।প্রথম দিকে শুধু রিং হয়ে গেছে আর এখন ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে।বুক ধড়ফড় করে নয়নার, পেটে অস্বস্তিকর ব্যাথা হয়‌ অতিরিক্ত টেনশন থেকে। দু’বছর হলো সৌরভের সাথে তার সম্পর্কের। ছেলেটা ভালো পরিবারের, নম্র-ভদ্র , কেয়ারিং।সব মিলিয়ে ভালো। সিগারেট খাওয়ার বাজে অভ্যাস আছে।আর নামাজ ঠিকমতো পড়তে চায়না, আলসেমি করে এই যা‌।

নয়না মুচকি হাসে সৌরভের কথা মনে করে। কিন্তু সে হাসি দীর্ঘস্থায়ী হয় না।ঘন বিষন্নতার চাদরে ছেয়ে পরে মনটা। অনেক বড় একটা ভুল সে করে ফেলেছে। ভুল না সেটা, অন্যায়।যে অন্যায়ের কোনো মাফ হয়তো নেই।কিভাবে দিবে মাশুল? গত দুই মাস ধরে টানা পিরিয়ড মিস হওয়ায় ভয়ে ভয়ে প্রেগন্যান্সি কীট এনেছিল কয়েক দিন আগে।সাহস হয়নি চেক করার। দুইদিন আগে মনে সাহস জুগিয়ে চেক করে দেখে পজেটিভ।এরপর আরো তিনবার চেক করেছিল নয়না।প্রতিবারেই পজেটিভ এসেছে। সৌরভকে জানাতেই সে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।নয়না মনে প্রাণে চাচ্ছিল রাতে সবটা মিথ্যে হয়।যেদিন ফ্রেন্ডরা একসাথে পিকনিকে গিয়েছিল সেদিন যদি সৌরভ জোর না করতো তাহলে এমন একটা পাপ কাজ নয়না কখনোই করতো না।

ডক্টরের চেম্বার থেকে বের হয়ে গুরুতর ঝগড়া হয় নয়না আর সৌরভের মাঝে।সৌরভ বারবার বলে এখনকার সময়টা তার বিয়ে করার জন্য উপযুক্ত নয়,সামনে তার বিশাল ক্যারিয়ার পরে আছে।সে নয়নাকে এভশন করাতে কিন্তু নয়না তাতে রাজি নয়। সেদিনের পর থেকে ফোন বন্ধ সৌরভের,আর খোলেনি।রাগ করেছে হয়তো। ছেলেটার আবার অভিমান বড্ড বেশি।হোক বেশি কিন্তু এভশন সে করবে না।কি করে সে একটা নিষ্পাপ প্রাণকে মারবে!তার মধ্যে সামান্য মনুষ্যত্ব বোধ আছে এখনো। অনুতাপ হয় নয়নার, ভীষণ অনুতাপ।এতো অন্যায় সে কোথায় লুকাবে। ছোট থেকে তার সকল ভুল সমারোহ লুকিয়ে যেতো, সান্দ্র ফাজলামো করে বাবা মা কে বলে মার খাওয়া তো পরে চকলেট দিয়ে রাগ ভাঙাতো।সেই ভাইদের কাছে এই ভুলের কথা কি করে বলবে?সমাজে তার বাবা মা কিভাবে মুখ দেখাবে?নয়নার মরে যেতে ইচ্ছা করে।ক্লান্ত দেহে ছাদ থেকে উঠে ঘরে আসে নয়না।যোহরের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে মোনাজাতে অঝড়ে চোখের পানি ফালায়। আল্লাহ কাছে মাফ চায়।সারা দুনিয়া মাফ না করলেও,মুখ ফিরিয়ে নিলেও সৃষ্টিকর্তা মুখ ফিরিয়ে নেন না।নয়নাকে তিনি মাফ করবেন না?

নয়না মোনাজাত শেষে চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে আনরুবা পেছনের চেয়ারে বসে আছে‌। হঠাৎ দেখায় কেঁপে উঠে নয়না বলে,

‘আম্মা তুমি কখন আসলা?’

আনরুবা ভালো করে পরখ করে দেখেন নয়নাকে। ইদানিং নয়নার আচরণ তার সন্দেহজনক ঠেকছে।মেয়েটা বাসার সকলের সামনে যায়না বললেই চলে। একাকার ঘরে বসে কি করে করে যানে। একদুইবার একতলা থেকে দোতলায় উঠে আসলে হাঁপিয়ে যায়‌। আনরুবা মেয়ের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু দিন শেষে যত কাজের চাপ আর এতো বিপদের মাঝে সব ভুলেই যান। বুড়ো হচ্ছেন,শরীর আগের মতো সাথ দেয়না। আনরুবা কর্কশ গলায় বলেন,

‘এমন চমকানোর মতো কিছু করি নাই।তেল গরম করে আনছি মাথায় দিয়ে দেব।আয় এদিক আয়।’

নয়না কথা বাড়ায় না। আনরুবা মেয়ের মাথায় তেল মালিশ করতে করতে বলেন,
‘কুহেলীর কাছে যাইতে বললাম গেলি না কেন? সেঁজুতির কাল পরীক্ষা,পড়া ফেলে ও গেল।’

‘ভালো লাগছিলো না আম্মা‌। তুমি ঘরে যাও আমি ঘুমাবো রাতে ঘুম হয়নি।’

‘কেনো?কি করছোস বইসা বইসা।’

‘কোরআন শরীফ। ঘুম আসছিল না তাই।’

আনরুবা আর কিছু বলেন না।উঠে ঘরে থেকে বের হতে উদ্যত হলে নয়না ক্ষিপ্র গতিতে তাঁর হাত চেপে ধরে বলে,
‘আম্মা আমি যদি বড় কোনো ভুল করে,আর তারপর মাফ চাই মাফ করবা আমাকে?’

‘আজ পর্যন্ত কোন দিন ভুল বুঝতে পারার পর শাস্তি দিয়েছি?’

‘দাওনি যদী বড় ভুল হয়?’

‘শাস্তি বাচ্চাদের দেয় যাতে তারা অনুশোচনা করতে শিখে।কেউ তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত হতে কাতর হলে সেটাই তার সবচেয়ে বড় শাস্তি।আমরা মা বাবা কেবল সঠিক পথ প্রদর্শক।শাস্তি দেয়ার কে, মানুষের সব কৃতকর্মের ফল দিবেন আল্লাহ।’

বলে হেসে ঘর ত্যাগ করেন আনারুবা।নয়না ভেঙে পড়ে কান্নায়।

অবশেষে চন্দ্রিমার জ্ঞান ফিরে।অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে দেহে রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছে।ও নেগেটিভ রক্ত জোগাড় করার জন্য পাগলের মতো খাটতে হয়েছিল আরশকে। মিসেস রাহেলাও ঢাকা থেকে এসেছেন। তিনি আসাতে একটু জোর পায় চন্দ্রিমা।এসে চন্দ্রিমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ৈ বলেন,

‘আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে মা!আবির পাগল হয়ে দেশে ফিরে আসতে চাইছিল। টিকিট ও কিনে ফেলেছিলো।’

চন্দ্রিমা কথা বলে না।চোখ মুখ সাদা হয়ে গেছে তার। আবিরের কথা শুনে ভালো লাগে। চন্দ্রিমার পাশে বসে একা একাই বকবক করে চলেন তিনি। সেখানে তার কুহেলীর সাথেও দেখা হয়ে যায়। সেঁজুতি তাকে ধরে ধরে নিয়ে এসেছে।কুহেলীর কথা আরশের মুখে শুনেছিলেন কয়েকবার,আর চন্দ্রিমা তো সারাক্ষণই তার নাম জপতে থাকে।মাথায় চাপ পড়ে বিধায় কুহেলীর কথা বলা নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। চন্দ্রিমার পাশে কয়েকমিনিট বসে দিকে সে।এর বেশি আর হিম্মত নেই।মিসেস রাহেলা এই প্রথম জীবনে এতো বড় ভয় পান দুই মেয়ের অবস্থা দেখে। চন্দ্রিমাকে দেখে কুহেলী কেবিনে ফিরে যায়।কুহেলীকে গল্পের বই পড়ে শোনায় সেঁজুতি। সমারোহ এসে রুমে ঢুকে বলে,

‘তুই বাড়ি যা।তোকে দরকার নেই এখানে।আমি চলে এসেছি।’

সেঁজুতি ফার্মের মুরগীর চোখের মতো বড়বড় চোখ করে বলে,
‘ভাই তুমি তো বাড়ি গেলি এক ঘন্টা হলো না আইসাও পড়ছো?খাইছো কখন, ফ্রেশ হইলা কখন আর এতো না ঘুমিয়ে থাকো কেমনে?’

সেঁজুতির কথায় চোখ গরম করে তাকায় সমারোহ‌।তাতেই সেঁজুতির হয়ে যায়। হনহনিয়ে উঠে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছি বলে চলে যায়। সমারোহ কুহেলীর মাথার ব্যান্ডেজ খুলে খুব যত্ন সহকারে ড্রেসিং করিয়ে দেয়।এই এক বিরাট বিরক্তিকর জিনিস।ডক্টর যতোই মায়া,আদর, সোহাগ দিয়েই কাজ করুক না কেন ব্যাথা তো দিবেই!ড্রেসিং শেষে কুহেলী মাথা যেন আবার অবশ হয়ে থাকে। অতিরিক্ত ব্যাথার কারণে ড্রেসিং করার পরপরই ঘুমের ঔষুধ খাইয়ে দেয়া হয়, হাই পাওয়ারের ডোজ। ঔষধ খাওয়ার মিনিট খানেকের মধ্যেই টুকরো টুকরো ঘুম জড়ো হয় কুহেলীর চোখের পাতা জুড়ে।কুহেলীর বেডের বাম পাশে ছোট্ট একটা জানালা,তার পাশে কাঠের চেয়ারে সমারোহ বসে বই পড়ে।কুহেলী নেশা সিক্ত ঘুমঘুম চোখে সমারোহকে দেখে আবারো মুগ্ধ হয়। লোকটার চুল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানির ফোঁটা পড়ছে একটু পরপর।দুই পাশের কাঁধ আর বুকের অংশের শার্ট ভিজে গেছে। গোসল করে ভালো মতো চুলটাও মুছেনি। নেভিব্লু শার্টের হাতাটা ফোল্ড করা,ডান হাতে সাদা এনালগ ওয়াচে দারুন মানিয়েছে সমারোহকে।চেয়ে দেখতে দেখতেই ধীরে ধীরে চোখ বুঁজে আসে কুহেলীর।

হালকা ঘুমের ঘোরে সে বুঝতে পারে কেউ তার শরীরে কাঁথা টেনে দিয়ে কপালে অসংখ্যবার চুমু খেয়েছে।তবু চোখ খুলে তাকায় না কুহেলী। ঘুম ভাঙ্গার পর সমারোহ কে কাছে দেখতে পায় না। আনরুবা আছেন কাছে।কুহেলী ভাবে তখন হয়তো আনরুবাই ছিলেন।আজ রাতেই কুহেলীকে বাড়ি নিয়ে যাবেন,বাড়ি ফিরে একদম বেড রেস্টে থাকতে হবে।চন্দ্রিমা থাকবে আরো সপ্তাহখানেক।জহির ও এসেছেন আনরুবার সাথে।কুহেলীর সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়ার পর সে জানতে পারে হসপিটালের সব ফর্মালিটিজ পূরণ করে সমারোহ অনেক আগেই চলে গেছে।জহির আর আনরুবা বাড়ি নিয়ে আসে কুহেলীকে।

দেখতে দেখতে তিন সপ্তাহ খুব ভালোভাবে কেটে যায়।মাথার ক্ষতটা সেরে উঠতে শুরু করেছে।এখন ব্যান্ডেজ করে রাখতে হয়না সবসময়।আজ থেকে সে কথা বলতে পারবে, এতো দিন কথা বলা নিষেধ ছিল,টুকটাক কথায় কাজ সারতে হতো।এই তিনটা সপ্তাহে একটা বারের জন্যও কুহেলীর সাথে দেখা হয়নি সমারোহর। অবশ্য আলো এসে মাঝে মধ্যে দুচারটা কথা শুনিয়ে গেছে।মেয়েটা সমারোহর প্রতি অনেক বেশি আগ্রহী তা কুহেলী বুঝেছে ঠিকই তবে বিষয়টা ভালো লাগেনি। সান্দ্র ফিরেছে আজ সকালে।একবার কুহেলীর ঘরে ঢু মেরে গেছিলো।বলেছে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কুহেলীর ঘরে আসবে। অনেককিছু বলার আছে , অনেক গল্প করার আছে।কুহেলীও অপেক্ষা করে, বাড়ির সবার কথা সে জানতে পারবে এখন।কুঞ্জার পাগলামি গুলোও শুনতে পারবে। নিশ্চয়ই সান্দ্র আসার সময় বায়না ধরেছিল আসার কুহেলীকে দেখতে!

সান্দ্র ফ্রেশ হয়ে খাবার প্লেট নিয়েই চলে আসে কুহেলীর ঘরে।কুহেলী উদগ্রীব হয়ে উঠে বসে রুদ্ধশ্বাস বলতে থাকে,

‘ভাইয়া আব্বা কেমন আছেন? আমার কথা জিজ্ঞেস করছেন না?আম্মা আমার জন্য কাঁদে নাই? আচ্ছা কুঞ্জা,ওর কি হয়েছে?আমাকে বললো ও খুব অসুস্থ?কি হয়েছে আমার বোনটার? আচ্ছা, আপনার তো কয়েকদিনের মধ্যেই আসার কথা ছিল, এতো দিন থাকলেন মানে কোনো সমস্যা হয়েছিল কি? বলুন না!’

সান্দ্র ভ্রুঁ কুঞ্চিত করে হাসে কুহেলীর এহেন কান্ডে।মুখে থাকা খাবারটুকু শেষ করে বলে,
‘একসাথে এতো কিছু কিভাবে বলি?’

‘আস্তে আস্তে বলুন।’ কুহেলী লজ্জিত হয়।

‘কুঞ্জাকে নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছিল তাই থাকতে হয়েছে‌।মেয়েটা প্রায় মারাই যাচ্ছিল আরেকটু হলে।’

চলবে.
®সাইমা ইসলাম প্রীতি

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী- সাইমা ইসলাম প্রীতি

২০.

গভীর রাত।একটা কি দেড়টা বাজে।রাত দেড়টা বাজা মানে শিমুলপাড়া তখন কুয়াশার চাদরে মুড়ে ভীষণ অন্ধকারে লুকিয়ে নিয়েছে নিজেকে। জনমানবশূন্য রাস্তাঘাট, ঝিঁঝিঁ পোকার আক্রমণে ছমছমে বাঁশঝাড়ের পাশে কুচকুচে কালো পানির দিঘি!গ্রামের মানুষ রাত্রে বাড়ির বাহিরে যেতে ভয় পায়।অনেকেই নাকি জ্বীন ভূতের হাতে মারা গেছে এর আগে।কুঞ্জাদের বাড়ির পেছন দিকে মে জঙ্গল সেটা একদম বাজার পর্যন্ত চলে গেছে। জঙ্গলের পাশের রাস্তা ধরে রাতের বেলা হাঁটতে ভয় পায় মানুষজন।একবার পাশের গ্রামের এক ছেলেকে ভূতে মেরে জঙ্গলের বিশাল সেগুন গাছে লটকে দিয়েছিল। আরেকজনকে তো গলা কেটে ফেলে রেখেছিল।বাজারে শেষ প্রান্তে আগে আতিকুরের দোকান ছিল একটা,সে তো মরতে মরতে বেঁচে গেছে।তার ভাষ্যমতে রাতে বাজারের দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিল জঙ্গলের পাশের রাস্তা ধরে। তখনই সাত আট ফুট লম্বা এক অবয়ব তাড়া করে তাকে।জানে বেঁচে গেলেও একটা পা খোয়া গেছে তার। আরেকবার গ্রামের অতিসুন্দরী মিলিকে ভূতে ধরে জঙ্গলের অপরপাশের নদীর ধারে চোরাবালিতে ডুবিয়ে মেরেছে।রাতে খাওয়ার পর বসে বসে রমলার কাছে গল্পগুলো শুনেছে সান্দ্র।এগুলো রমলার যুবতী বয়সের গল্প।কতকের সাক্ষীও সে ছিল। গল্প শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও জেগে থাকে সান্দ্র।মাইশার কড়া আদেশ আছে তার সাথে কথা না বলে ঘুমানো বারণ।

ঘরে ফোনে কথা বললে সবাই টের পাবে ভেবে বাড়ির বাহিরে এসে চুপিসারে মাইশার সাথে কথা বলছিল সান্দ্র। নেটওয়ার্কের যাচ্ছেতাই অবস্থা।তার উপর মেয়েটা রাগ করে আছে। আগামী রবিবার মাইশার বাবা সুইজারল্যান্ড থেকে ফিরবেন, সেদিন মাইশা সান্দ্রর সাথে তার বাবার সাথে দেখা করাবে বলে দাওয়াত দিয়েছিল।সে যেতে পারবে না। অভিমান করাটাই স্বাভাবিক।তবে মাইশা মেয়ে অতীব লক্ষী। বুঝিয়ে বললে সব বুঝে। শুধু একটু বেশি আহ্লাদী।মাইশার সাথে কথা বলার সময় হঠাৎ সান্দ্র লক্ষ্য করে বাড়ির ভেতর থেকে কেউ একজন চাদর মুড়ি দিয়ে খুব সাবধানে বের হয়ে আসছে।ডাকতে গিয়েও থেমে যায় সান্দ্র। লোকটার পেছন পেছন কুঞ্জাও বের হয়েছে।তাদের পেছনে পেছনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সান্দ্র।লোকটা কুঞ্জার হাত ধরে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে যায় কুঞ্জা রোবটের মত যায়‌। সান্দ্র অনেকটা পথ তাদের পেছন পেছন পাড়ি দিয়ে জঙ্গলের অপর প্রান্ত পর্যন্ত চলে আসে তারপর হারিয়ে ফেলে দুজনকে।পরপর দুইদিন হয় এমন। কিন্তু এবারো সান্দ্র ধরতে পারেনা তাদের।উল্টো সে লোকটা টের পেয়ে যায়। তৃতীয় দিন রজবকে সব বলে তারা দুজন মিলে অপেক্ষা করে। কিন্তু লোকটা আসে না। সান্দ্র খানিকটা অবাক হয়। লোকটাকে তারা কেউ বাড়িতে আসতে দেখেনি অথচ বাড়ি থেকে বের হলো কিভাবে?কোথা থেকে আসলো?আজ রজবের সাহায্য চেয়েছে অথচ লোকটা আসেনি। এমন নয়তো যে লোকটা রজবই! সান্দ্রর সন্দেহ হয়।কুঞ্জা তাকে বলেছিল নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে যখন রোজ বাহিরে যায় রজবকে সে একবার দেখেছে রাতে।

পরের দুদিন ও এমন ঘটনা ঘটে না।কুঞ্জার বাড়ির বাহিরে যায়নি।সব স্বভাবিক।সান্দ্র ও এমন ভান করে থাকে যেন কিছুই হয়নি।রজবকের বুঝতে দেয়না কিছু। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয় যখন একদিন রাতে রজব আর সান্দ্র একসাথে শুয়ে ছিল। দরজা খোলা রেখেছিল রাতে কুঞ্জা বের হলে দেখতে পারে। জেগে থাকতে থাকে চোখ লেগে আসে তার।সান্দ্রকে অবাক করে দিয়ে কুঞ্জা সেদিনও বাড়ির বাহিরে যায়।রমলার ঘুম অনেক গভীর।রাতে সহজে ঘুম ভাঙ্গে না। সেদিন ঠান্ডায় ঘুম ভেঙ্গে যায়। কাঁথা নিতে উঠে দেখে কুঞ্জা নেই তার পাশে।ব্যাস, পুরো বাড়ি পাগল করে তুলেন তিনি। আশেপাশে রাস্তাঘাট, পুকুর পাড়, ফসলের ক্ষেত খোঁজাখুঁজি করার পর পাওয়া না গেলেও একঘন্টা পর আপনাআপনি ফিরে আসে সে। জিজ্ঞেস করলে বলে ঘুম আসছিল না বলে একটু বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়েছে। সকালে সান্দ্র জিজ্ঞেস করলে বলে কালও কোথায় গিয়েছে সে জানেনা।দাদিমা চিন্তা করবে ভেবে বলেনি।

সেদিন রাত ঠিক বারোটায় হঠাৎ গলায় প্রচন্ড ব্যাথা হয়,একটু বাদে আবার গড়গড়িয়ে রক্তবমি করে কুঞ্জার।কালো কুচকুচে রক্ত। সকলের সাথে সান্দ্র নিজেও ভয় পেয়ে যায়। পরদিন সান্দ্র নিজে মেডিক্যালে নিয়ে গিয়ে চেকআপ‌ করায়‌।সব ঠিকঠাক।রক্ত বমি হওয়ার কারণ কি তাহলে।তারপর হঠাৎ করেই কুঞ্জার এসকল বিষয়ে মাথা খাটানো ছেড়ে দেয়।যারা এসব কাজের পেছনে রয়েছে তারা যাতে ভাবে এসবের কিছুই সান্দ্র ভাবছে না।সেরকম টাই হয়।

রাতটা শুক্রবারের।সবাই ঘুমিয়ে পড়লে কুঞ্জা সেদিন বাহিরে যায়। সান্দ্র আর পিছু করে না।ফিরে আসা অব্দি অপেক্ষা করে।কুঞ্জা ফিরে এসে যখন ঘরে ঢুকে কুঞ্জার পেছন পেছন আরো একটা লোক এসে খোর্শেদ ঘরে যায়।

কুহেলীকে সেদিনের ঘটনাগুলো একের পর এক বলে যায় সান্দ্র। ছোট্ট বোনটা এতো কষ্ট সহ্য করেছে ভাবতেই অঝোরে কেঁদে চলে মেয়েটা। সান্দ্র সান্তনা দেয়। আনরুবা সান্দ্রকে পুরো বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে কুহেলীর ঘরে এসে দেখে কুহেলী কাঁদছে।সামনে বসে আছে সান্দ্র।চোখ মুখ কুঁচকে যায় আনরুবার।ছেলেটা কি এমন বলেছে যে মেয়েটা কেঁদেকেটে একাকার!আনরুবা কুহেলীর কাছে গিয়ে নিজের বুকে মিশিয়ে নেন কুহেলীকে।স্নেহের পরশে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলেন,

‘এই শয়তান পোলা আবার তোমারে কি বললো মা?সব ঠিকঠাক আছে তো?খোর্শেদ ভাই তো ভালো আছে শুনলাম।এমনে কাঁদতাছো কেন মা আমার?’

আনরুবার মমতা পেয়ে যেন কুহেলীর কান্নার বেগ হুড়হুড় করে বেড়ে যায়। আনরুবা বিপদে পড়ে যান এবার।রাগে গিজগিজ করতে করতে বলেন,
‘এই ছ্যামড়া,তুই আর ভালো হইলি না?কি বলছিস ওরে?’

সান্দ্র বোকা বনে যায়‌। কিছু বলতে নিলে কুহেলী জড়ানো কন্ঠে ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে বলে,
‘আন্টি উনি বাড়ির কথা বলছিলেন। আমার সবাইকে মনে পড়ছিল খুব তাই কাঁদছিলাম উনার দোষ নাই।’

‘আহারে মা’টা আমার।এভাবে কাঁদতে নাই।মাথায় প্রেশার পড়বে না?এমনেই সেইদিন প্রেশার মাপলাম তোমার অনেক বেশি। পড়ালেখার কি ক্ষতিটাই না হলো মাথায় চাপ পড়লে এখন পরে পড়া মনে রাখতে পারবা না কিছু।ডাক্তার বলছে না এখন কোনো স্ট্রেস না নিতে? কান্নাকাটি চিন্তা ভাবনা কম করবা।’

কুহেলী মাথা উপর নিচ দুলিয়ে বাচ্চাদের মতো‌‌ সম্মতি জানায়। আনরুবা আদর করে কুহেলীর কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে চুমু খান।আর সান্দ্রর দিকে ফিরে বলেন,

‘তুই জানতি না ওরে কাঁদানো যাবে না?বাড়ির কথা পরে বলা যায় না? কষ্ট দেহ খালি।’

‘সরি আম্মা, আমি উত্তেজিত ছিল।’

‘হইছে হইছে আর ঢং করতে হবে না, মাইশা আসছে অনেকক্ষণ।নিচে একাকি বসায় রাখছি মেয়েটারে।তোরে খুঁজতে খুঁজতে আমার পৃথিবীকে এক চক্কর লাগানো হয়ে গেছে।’

সান্দ্র চোখ বড়বড় করে ফেলে।রুদ্ধশ্বাসে বলে,
‘সত্যি এসেছে!ওফ আম্মা আগে বলবা না?কতো কষ্ট করে অপেক্ষা করছে আমার বউটা…!’

মাইশা তাকে সবসময় বউ বলে ডাকতে বলেছে।সেটাই ডাকে সান্দ্র, ভালোলাগে বেশি।ফলে মুখ ফসকে ওদের সামনেও বলে ফেলে সান্দ্র।বলেই দ্রুত জিভ কাঁটে। আনরুবার দিকে তাকিয়ে দেখে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছেন তিনি।সান্দ্র অস্বস্তিতে পড়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে,

‘ইয়ে, মানে আম্মা আসলে…।আমি নিচে গেলাম।’

ক্ষিপ্র গতিতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আনরুবা আর কুহেলী হাসিতে ফেটে পড়েন।কুহেলী হাসছে দেখে আনরুবা চোখ শীতল করে চেয়ে থাকেন, চোখ জুড়ায় মন জুড়ায়। আনরুবাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কুহেলী হাসি থামায়। আনরুবা হেসে বলেন,

‘ছেলে আমার পাগল হয়েছে বুঝলা! এবার তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে হবে।’

নিমিষেই আবার বিষন্নতার রেখা ফুটে তার মুখে।বড় একটা শ্বাস ফেলে বলেন,

‘সমারোহর জন্যই আটকাইয়া আছে।কবে যে ছেলেটা একটু শান্তি পাবে জীবনে কে জানে।নিজেকে নিয়া একটু তো ভাবতে হয়!
আচ্ছা কুহেলী তুমি বিশ্রাম নাও।আমি যাই মাইশার জন্য নাস্তা বানাই, কিছু লাগলে বাবা আমাকে।’

কুহেলী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। আনরুবা গেলে কুঞ্জার কথা ভেবে মন খারাপ করে আবার।বাড়িতে ফোন দেয়‌।খোর্শেদ,আম্মা,দাদিমা,কুঞ্জা সবাই ভালো আছে এখন। চিন্তা নেই।বাকি কাহিনী নাহয় পরে শুনে নেবে।

রাহেলা চন্দ্রিমার মাথায় তেল মালিশ করতে করতে হাজারটা গল্প করেন। মানুষ যতোই স্মার্ট আর মিতভাষী হোক না কেন বয়স বাড়ার সাথে তার কথা বলার পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন তারা এমন একটা অবলম্বন চান যেটাকে আঁকড়ে ধরে মনের সব কথা ব্যক্ত করা যাবে।সেই মানুষটি সব কথা শুনে চলবে বিনা বিরক্তিতে।কথা বলতে পারলেই তাদের শান্তি।কথা বলার ফাঁকে আরশ এসে বসে চন্দ্রিমার পাশে। তেল চকচকে চেহারা তার শুষ্ক হয়ে রয়েছে। চন্দ্রিমার পাশে বসে তেলের বোতল ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলার মতো মাটিতে ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,

‘ভাবী কুহেলীকে দেখতে যাবা?’

চন্দ্রিমা বিচলিত হয় না আরশের মুখে ‘ভাবী’ বাক শুনে।আরশ তাকে ভাবী বলেই ডাকে।রাহেলা রান্নাঘরে যান চা নিয়ে আসতে। চন্দ্রিমা আরশের দিকে মুখ করে বসে বলে,

‘হুম যাওয়া যায়। কিন্তু আপনার চেহারার এই অবস্থা কেন মিস্টার।মনে হয় কোনো এক রাজকন্যাকে রাজারানী করতে গিয়ে ছ্যাকা খেয়ে বেকা হয়ে গেছেন। হুমহ ব্যাপারটা কি?’

‘ভাইয়া ভিডিও কল করেছিল তোমায় দেখতে। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে।কল দিতে বলেছে আবার।’

এরিয়ে যায় আরশ।কুহেলীর কোনো খবরাখবর তার কাছে নেই।মন একদম ভালো না তাই।মায়িবী হরিণী চোখের অধিকারীনি কুহেলী তার চিন্তা শক্তি কেড়ে নিয়েছে। চন্দ্রিমাও খুঁজে পায়না কি বলবে। শুধু ছোট্ট করে বলে,

‘সন্ধ্যায় নিয়ে যেও।কুহেলীকে বলে দিব আমি।’

আরশ চরম খুশি হয়ে যায়।মানুষ তার ভাবনাগুলো যতোই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করুক চোখের চাহনি আর ঠোঁটে হেলদুল তা প্রকাশ করতে বাধ্য। তেমনি আরশও তার খুশি হওয়াটা চন্দ্রিমাকে বুঝতে দিতে না চাইলেও চোখে মুখে স্পষ্ট আনন্দের ছটা চিলিক দেয়। চন্দ্রিমার খেয়াল করে না।তার মনে এখন আবির নামক লাড্ডু ফুটে চলছে।

চলবে.

(রি-চেক করা হয়নি। ভুল ক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)