আবারো?
তৃধা মোহিনী(মৃন্ময়ী)
সমাপ্তি পর্ব
?
পেরিয়ে গেছে সাতটা মাস..তিন মাসের তিশরা এখন দশমাস হয়ে গেছে..এখন সে হামাগুড়ি দেয়,ছোট ছোট কেমন আউড়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে কথা বলার চেষ্টা করে কথা বলার জন্য, মনে হয় কত কথা তার মুখের ভিতরে জমে আছে তার ছোট্ট মুখে..আর দেখতে??পরীর মতো সুন্দর হয়েছে।।
নিহিন তিশরাকে যেইভাবে আগলে রাখে মনে হয় না তিশরা ওর সন্তান না,তিশরাকে নিজের জীবন ভাবে নিহিন..তিশরাকে ছাড়া নিহিন আর কিছু ভাবতে পারে না,তাকে গোসল করানো থেকে মাথাই তেল দেয়া,বাথরুম করানো সব নিহিন করে..আর তিশরা নিহিন ছাড়া কিছু বুঝে না,কারো কোলে যেতেও চায় না..এমনকি তিতাস নিলেও কিছুক্ষন থেকে কান্নাকাটি আরম্ভ করে দেয়,তখন বাধ্য হয়ে রুবা তিশরাকে নিয়ে নিহিনের কাছে দিয়ে আসে।।
সেদিনের ঘটনার পর থেকে নিহিন আর তিতাসের সামনে যায় নি,তিতাসের মনে জায়গা করার চেষ্টা টুকুও করে নি..তাকে তার মতো থাকতে দিয়েছে আর সে নিজেকে নিজের মতো থাকতে দিয়েছে..কি হবে মায়া বাড়িয়ে যেখানে তিতাসের মনে অন্য কারো অবস্থান..বেশ ত আছে তিশরা কে নিয়ে সে..তিতাস মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করে সকালে যায় বিকালে আসে..তিতাসের সামনে নিহিন সবসময় না পরার চেষ্টায় থাকে কিন্তু তিশরার আর রুবার জন্য মাঝেমধ্যে বাধ্য হয়ে তাকে যেতে হয় তবে কখনো মাসে দুই একবার দেখা হয়ে যায়..এক বাড়ির এক ছাদের নিচে থাকে দুইজন দুই রুমে কিন্তু কেও কারো মনের খবর রাখে না।।
তিতাস দেখতে যথেষ্ট সুন্দর,শ্যামলা গায়ের রঙ কিন্তু শ্যামলা রঙের পুরুষ দেখতেও যে এতো সুন্দর হয় তিতাসকে না দেখলে বুঝা যায় না..ভালোবেসে দিবাকে বিয়ে করেছিলো তিতাস,খুব সুন্দর সংসার চলছিলো..তিশরা যখন দিবার পেটে আসে তখন দিবার শরীর মাত্রাতিরিক্ত দুর্বল থাকতো,ডাক্তার বেবি নিতেও না করেছিলো কিন্তু দিবা তিতাসকে না জানিয়ে বেবি নেয়..ডেলিভারির সময় ডাক্তারকে বলেছিলো আগে তার বাচ্চা যেন দুনিয়ার মুখ দেখে..তিশরা ত দুনিয়াতে আসলো কিমতু দিবা দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে ওপারে পারি জমালো..অতিরিক্ত ব্লিডিং কারনে দিবাকে বাচানো হয় নি..দিবা যে নেই তিতাস মানতে পারে না,পাগলের মতো জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদেছিলো..সদ্য জন্ম নেয়া কন্যার দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলে দিবাকে কবর দিয়ে এসেছিলো বুকে পাথর রেখে..তিশরাকে বুকে ধরে সেদিন সারারাত কান্না করেছে তিতাস..দিবাকে সে কতটা ভালোবাসে সেটা হয়তো কেও দেখছিলো উপরে বসে,তিতাসের দুঃখ কষ্ট কমানোর জন্য নিহিন জীবনে এলেও..নিহিনকে না গ্রহন করেছে না তার কোন দায়িত্ব নিয়েছে..নিহিন শুধু তিশরার মা হয়ে এই বাড়িতে আছে,তিতাসের স্ত্রী নামক ট্যাগ টা তার কপালে আর নেয়..কিন্তু ওই যে আরোশে বসে ছড়ি ঘুরাচ্ছে একজন যে নিহিন আর তিতাসের মিলন ঘটনার প্ল্যান করছে।।
শনিবার,
নিহিনের ডিপার্টমেন্টের আজকে এসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে..তার শাশুড়ী তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বলেছে,সে কেন থেমে থাকবে??তিনিও অনেক চেষ্টা করেছে তিতাস আর নিহিনের সম্পর্কে একটু উন্নতি আনার কিন্তু ফলাফল কি??সবসময়ের মতো শুন্য..আজকে নিহিন হালকা নীল কালারের পারের শাড়ি পরেছে যেহেতু প্রেজেন্টেশন দিতে হবে একটু গুড লুকে না গেলে মার্কস দিবে না..হাতে ঘড়ি, চোখে কাজল মোটা করে..টিপ পছন্দ না তাই পরে নাই..চুল খোপা করে কাঠি দিয়ে দিলো,নিহিনের চুল ত আবার বেশ লম্বা আর একটু লালচে কালার.. সেফটিপিন দিয়ে নিজের কাধের আচলটা আটকে ব্যাগ আর জিনিসপত্র নিয়ে নিচে গেলো,সে চিন্তায় আছে তিশরাকে কারন সে কারো কাছে থাকে না..তাই ভাবছে ওকে সাথে করে ভার্সিটি নিয়ে যাবে,যেহেতু গাড়ি করে যাবে সাথে রুবাও যাবে প্রব হবে না..নিজের সবকিছু নিচে নামলো যখন লাল টুকটুকে জামাতে তিশরা ফোকলা দাঁত বের করে হাসছে আর নিহিনকে কাছে ডাকছে,মাথায় লাল ব্যান্ড..চুল নেয় তবুও রুবা অনেক শৌখিন থাকার কারনে পরিয়ে দিয়েছে..নিহিন মুচকি হেসে এগিয়ে নিলো নিজের কোলে তিশরাকে..তিশরাও হাত বাড়িয়ে কোলে উঠে নিহিনের থুতনীতে মাড়ি দিয়ে চাপ দিচ্ছে,এটা তার সবসময়ের অভ্যাস..রুবা নিহিনকে দেখে মাশাল্লাহ বলে পরী বললো..নিহিন,তিশরা আর রুবা যখন বের হলো গাড়িতে উঠার জন্য তখন তিতাসকে ড্রাইভিং সিটে দেখা গেলো,নিহিন দেখে উল্টা পথ ধরলে…রুবা চেপে সাথে নিয়ে বসায়..গাড়িতে বসে আছে ওরা চারজন,রুবা অনেক চেষ্টা করেও নিহিনকে সামনে বসাতে পারে নি..নিহিনের এমন রুপ দেখে তিতাস প্রথমে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলেও পরে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলো,লুকিংগ্লাস দিয়ে ঠিকই দেখছে এক ধ্যানে নিহিনকে..নিহিনের নার্ভাস +ভয় দুটোই লাগছে কারন তিতাসের সামনে কোনভাবে আসতে চায় না,সেদিনের মার খেয়ে তার ভিতরে অনেক ভয় ঢুকে গেছে।।
গাড়ি এসে থামলো ভার্সিটিতে, নিহিন দ্রুত পদে তিশরাকে নিয়ে নেমে পরলো তারপর গেটের আড়াল হলো যেন তিতাস দেখতে না পায়,এদিকে রুবা খুজে বেড়ায় কই গেলো তারা..অবশেষে নিহিনকে দেখতে পেয়ে তিনি ওখানে গেলেন..নিহিনের এমন নার্ভাসনেস, ভয়াতুর চেহারা,আড়াল হওয়া সবকিছু দেখছিলো তিতাস..গেটের আড়াল হলেও নিহিন,কারের গ্লাসেস দিয়ে তাকে দেখছে তিতাস..সাত মাস পর তার চোখে পরলো বিবাহিত স্ত্রীকে,যাকে না গ্রহন আর না নিয়েছে তার দায়িত্ব..এতো অপসারী তার দিবাও ছিলো..দিবা নিহিনের মধ্যে একটা মিল তা হলো চুল,দুইজনের চুল বেশ লম্বা..নিহিনের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতে আজ মন চাচ্ছে তিতাসের পরক্ষনে তার মনে হলো বিয়ের প্রথম রাতে তার দেয়া থাপ্পড়ের কথা কি আর করবে..গাড়ি নিয়ে নিজের অফিসে গেলো।।
প্রেজেন্টেশন +এসাইনমেন্টে দুটোতে ভালো করছে নিহিন..বাসায় এসে মা মেয়ে গোসল করে খেয়ে ফ্রেশ ঘুম দেয়,রুবাও খেয়ে ঘুমিয়ে যায়..নিহিন আর তিশরা আলাদা ঘুমায়,আজ আবার ঘুমানোর সময় দরজা লাগাতে ভুলে গেছে তারা..ওই সময় তিতাস মাত্র অফিস থেকে বাড়িতে ঢুকছে,ছেলে আসছে বলে রুবা তাড়াতাড়ি উঠে খাবার রেডি করলো অন্য সময় নিহিন করে কিন্তু আজ সে ক্লান্ত বলে উনি নিজেই করলো..তিতাস ঘরে ঢুকতে যাওয়ার সময় দেখলো তিশরার ঘরের দরজা খুলা,ঢুকবে কিনা এই নিয়া অস্বস্তিতে ভুগছে তাই সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব বাদ দিয়ে ঢুকে দেখলো মা মেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে..নিহিনের বুকের উপর তিশরা ঘুমাচ্ছে হা করে,নিহিনও তাকে দুই হাত জাপটে ধরে ঘাড় কাত করে ঘুমাচ্ছে..তিতাস খেয়াল হলো নিহিন বেডের ধারের কাছে একদম চলে আসছে,পরে যেতে যেকোন সময়..তাই দেরী না করে নিহিনের কোমরে হাত দিয়ে ঠেলে দিচ্ছে একটু ভিতরে..নিহিন কে ছুয়ার সাথে তিতাসের মনে অদ্ভুত শিহরণ জাগলো..মেঝেতে বসে বসে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে এই প্রথমবার নিহিনেকে..নাকফুল কেমন মানিয়েছে তা নাকে মনে হচ্ছে তার জন্যই করা,আবার ঠোটটা কি সুন্দর গোলাপী..চোখের নিচে কালি পরছে কিন্তু পাপড়ি গুলা কি বড়বড়..তিতাসের চোখ আটকে গেলো নিহিনের থুতনীতে থাকা তিলকে দেখে,কেমন যেন চুম্বকের মতো টানছে তাকে..নিজের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে একটু ছুয়ে দিলে,নিহিন ঘুমের মাঝেই কেপে উঠলো।।
তিতাস নিজেকে সংযত করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো কিন্তু তার চোখে এখনো ভাসছে নিহিনের থুতনীর তিলটা..সেই তিল যে তিতাসের মনে ঝড় সৃষ্টি করে মাদকতা কাজ করাচ্ছে যদি নিহিন জাগ্রত অবস্থায় বুঝতো।।
সাত দিন পর,
এই সাত দিনে তিতাস বিভিন্ন ছুতোয় নিহিনকে দেখতো কখনো চায়ের জন্য আবার কখনো সার্ভের জন্য..কিন্তু নিহিন সে এইসব তোয়াক্কা করতো না যা চাইতো দিয়ে দিতো যদি সে বুঝতো তিতাস নামে মানুষের মনে নিহিন নামক মাদকটা ঢুকে গেছে যা তার ভেতর আউলাঝাউলা করে দিয়েছে।।
রাতেরবেলা,
তিতাসের মেজাজ গরম হয়ে আছে এতোবেশি যে সামনে থাকা ব্যক্তিটি কে তার মনে হচ্ছে খুন করে ফেলতে ইচ্ছা করছে..এক হাতে নিহিনের হাত শক্ত করে আছে,তিশরা ঘুমিয়ে আছে ওকে নিয়ে রুবা ভিতরে রেখে আসছে।।
ফ্ল্যাশব্যাক,
তিতাসের বাড়িতে তার ফুফু এসেছে..এসে বিভিন্ন গল্প গুজব করছে তারা তার ওই সময় চোখে যায় নিহিনের উপর..তিনি নিহিনকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন বাজে কথা বলে,যে ডিভোর্সি মেয়ে বাড়িতে আনছ,অপয়া এইজন্য তিতাস তার দিকে তাকায় না হরেক রকম কথা..নিহিন এইসব শুনে চোখের জল মুছে নিজের রুমে গেলে,তিতাস তার হাত টান মারে তাদের সামনে নিয়ে দাড় করায়..নিহিন অবাক তিতাসের এমন কাজে।।
“আমার বউ ডিভোর্সি নয়!!তার স্বামী এই যে আশফাক রহমান তিতাস, তিশরা নিহিনের মেয়ে..আমার স্ত্রী কোন অপয়া না,আর কখনো এমন বাজে কথা বললে ভুলে যাবো আপনি আমার মরহুম বাবার বোন হোন” তিতাস রাগে বললো।।
বর্তমান,
তিতাসের এমন কথা শুনে তার ফুফু চলে যায় সেখান থেকে…তিতাস নিহিনকে টানতে টানতে নিজের রুমে নিয়ে যায়,এদিকে নিহিনের বুক দুরুদুরু করছে তিতাসের এমন রাগী মুখ দেখে..তিতাস নিহিনকে রুমে নিয়ে যেয়ে ছুড়ে মারে বেডে।।
“এই মেয়ে মুখ নেই তোমার??নাকি সবসময় এমন বোবা হয়ে থাকো??নাকি বাঁশ খাইতে ভাল্লাগে??হ্যাভ ইউ এনি কাইন্ড অফ সেন্স” তিতাস বলে দরজাতে এক লাথি দিলো,এদিকে নিহিন ভয়ে কুকড়ে যেয়ে বেডের চাদর খামচে ধরলো।।
তিতাস নিজের রাগ কোনভাবে কমাতে পারছে না,কপালে বার বার আঙ্গুল দিয়ে ঘষছে..দুই তিনটা লম্বা ঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিহিনের কাছে গেলো,নিহিন তিতাসের আগানো দেখে সরতে গেলে তিতাস তার দুই হাটুর মাঝে এসে বসে।।
“আমি আবারো ভালোবেসে ফেলেছি!!আমারো আবারো কারো মাদকাসক্ত হয়েছি!!আমি আবারো এই যে সামনে থাকা মেয়েটার মোহে পরেছি!!আমি আবারো আমার বেচে থাকার কারন খুজে পেয়েছি!!আমি আবারো তোমাকে চাইছি নিহিন??হবে কি আমার আবারো??” তিতাস নিহিনের হাটুতে ভর দিয়ে তার হাত ধরে বললো,এদিকে নিহিনের চোখ দিয়ে নোনাজলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে..সে আবারো তার হতে পেরেছে।।
নিহিন উঠে দাড়িয়ে তিতাসকে জড়িয়ে ধরে চিল্লিয়ে হাউমাউ করে কাদছে আর তিতাস??সে ত আবারো নিহিনের মাঝে নিজের অস্তিত্ব টের পেয়েছে..নিহিনকে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে আছে..হোক না কান্না হোক একটু সুখের মিলন ক্ষতি কি??
আবারো শুরু হল তাদের দুজনের পথযাত্রা,যেখানে শুধু সুখের মিলনমেলা থাকবে।।
সমাপ্ত?