আবার এলো যে সন্ধ্যা পর্ব-০৪

0
240

#আবার এলো যে সন্ধ্যা
পর্ব-৪

রিফাতের মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। অকারণে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। সেদিন মেঘার এমন আচরণ মন থেকে মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই। এমন কেন করলো মেয়েটা? হাত না মিলিয়ে ত্রস্ত পায়ে চপল হরিনীর মতো পালিয়ে গেল। যেন তার সম্মুখে কোন বাঘ দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিজেকে কেমন যেন অনাহুত আগন্তুক লাগছিলো। সত্যি বলতে এই প্রথম এমন ঘটনার স্বীকার হলো। তাছাড়া নিজে যেচে পড়ে কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে চেয়েছে আর সেই মেয়েটা কিনা তাকে না দেখার ভান করেছে। মেয়েটার আচরণ রীতিমতো অপমানজনক লাগছে তার কাছে। মেয়েটা হয়তো কোন কারণে ওর সাথে আলাপ বাড়াতে চাইছে না। কিন্তু রিফাত নিজের মধ্যে জেদ টের পাচ্ছে। কেন এমন অভদ্রতা দেখালো মেয়েটা? প্রথমদিন আলাপ করে বেশ সুবোধ বালিকা মনেহচ্ছিল। অথচ জানা গেল সে তার নাম ধাম সবই মিছে বলেছে। তারপর দেখা হলে না চেনার ভান করেছে। মানে পুরাই কেস খাওয়া অবস্থা।

সেদিন মেঘার পিছু পিছু বেরিয়ে আসতে যেয়ে টের পেলো স্টেজে ওকে ডাকছে। ফলে বাধ্য হয়ে মেঘার ভাবনা বাদ দিতে হয়েছিল তাকে। পরে খোঁজ করার কথা মনে এলেও বন্ধুরা জানতে পারলে অকারণ কৌতূহলের চাপে পড়তে পারে ভেবে বাদ দিয়েছিল। কিন্তু গত তিনদিনে ঘুরে ফিরে মেঘার কথাই মাথায় আসছে। কিছুতেই বাদ দিতে পারছেনা। কেন যেন মেঘার উপেক্ষা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
ভিডিও তৈরিতে মন নেই। এমনকি খাওয়া দাওয়া অনিয়মিত হয়ে গেছে। বারবার মনেহচ্ছে মেঘার মুখোমুখি হয়ে কৈফিয়ত চায়,কেন এমন করলো?

অস্থির পায়চারি করে সারাদিন। চাইলে কানিজের কাছ থেকে মেঘার বিষয়ে জানতে চাইতে পারো। কিন্তু সেটা মনেহয় না কোন ভালো আইডিয়া। কানিজ মেয়েটা ভীষণ তেড়া। মুখের ভাষা যাচ্ছেতাই। মেঘার কথা জানতে চাইলো কি বুঝতে কি বুঝবে, এই ভয়ে সে বুদ্ধি বাদ দিলো। বাকি থাকে মেঘার ক্যাম্পাসে যাওয়া। আচ্ছা, রিফাত দেখা করতে গেলে কি মেয়েটা ওকে খুব গায়ে পড়া ভাববে?

এমনিতে পজিটিভ ছেলে রিফাত। সহজে রেগে যায় না অথচ এখন অকারণে রেগে যাচ্ছে। তোড়ার সাথে রাগ দেখিয়ে ফেলছে। মায়ের সাথে গম্ভীর হয়ে থাকছে।
রিফাত বুঝতে পারছে মেঘার উদাসীনতায় ওর পৌরুষে আঘাত লেগেছে। ঠিক যেন নেওয়া যাচ্ছে না। মেঘার এমন ব্যবহারের কারন কি সেটা না জানা পর্যন্ত সস্তি পাবে না। তাই ঠিক করেছে ও একাই জাবিতে আসবে মেঘার সাথে কথা বলতে। তাতে যদি ওকে বেহায়া বা গায়েপড়া ভাবে ক্ষতি নেই।

★★★

মেঘার খোঁজ বের করতে খুব বেশি কষ্ট করতে হলোনা রিফাতকে৷ ওর মতো ইউটিউব সেলিব্রিটিকে সহায়তা করতে সকলেই রাজি। একজনকে ডেকে বলতেই সে মেঘাকে ডেকে দিলো। মেঘা আসার ফাঁকে রিফাত লুকিং গ্লাসে নিজেকে দেখে নেয়। সিল্কি চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে শার্টটা আরেকবার প্যান্টের মধ্যে গুঁজে নিল। সবচেয়ে পছন্দের কালারের শার্ট পরে এসেছে আজ। ওশান ব্লু কালারের শার্টের সাথে ডেনিম চমৎকার মানিয়ে গেছে। পায়ে নিকের স্নিকারটা প্যান্টে মুছে পরিস্কার করে নিল। এমনিতে উজ্জ্বল ফর্সা রিফাত। ব্লু কালারের কল্যানে আজ আরও ফর্সা লাগছে৷ নিজের উপর সন্তুষ্ট হলে রিফাত। এর চাইতে ভালো দেখার কোন প্রয়োজন নেই।

“আপনি কি আমার খোঁজ করেছেন?”
গলা শুনে রিফাত ঘুরে দাঁড়াতেই চমকে উঠলো মেঘা। আপনাতেই গলা দিয়ে স্বর বেরিয়ে এলো-“আপনি!”
“হ্যা আমি। এখন দয়া করে পালিয়ে যাবেন না সেদিনের মতো।”
নিজেকে সামলে নিয়ে যথাসম্ভব শান্ত হয়ে রিফাতকে দেখলো মেঘা ওরফে শোভা-“কেন এসেছেন?”
“কিছু জানতে। আশাকরি উত্তর দিতে আপত্তি নেই আপনার।”
“সেটা নির্ভর করছে আপনার প্রশ্নের ধরনের উপর।”
চমৎকৃত হলো রিফাত। আজ মেয়েটা বেশ চটাং চটাং কথা বলছে দেখা যায়? রিফাত মন দিয়ে মেঘা ওরফে শোভাকে দেখলো। ও ঠিক বুঝতে পারছে না মেয়েটা ওর সাথে এমন কঠোর আচরণ কেন করছে? সেদিন কোন অশোভন আচরণ করেছে বলে তো মনে পড়ে না।
“আগে বলুন কি নামে ডাকবো আপনাকে? মেঘা নাকি শোভা?”
শোভা জবাব দিলো না। রিফাত বললো-
“আপনি মিথ্যে বলেছেন আমাকে। কেন?”
ভ্রু কুঁচকে গেলো শোভার। রিফাতের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো-“মিথ্যে? কোনটা মিথ্যে?”
“আপনি সুকন্যা গার্লস হোস্টেলে থাকেন। এটা মিথ্যে না? নিজের নামটাও বানিয়ে বলেছেন।”
মেঘা চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছে-“আমার খোঁজ নিতে এরই মধ্যে আপনি হোস্টেলে গেছিলেন?”
রিফাত মাথা দুলায়। মেঘা হাসলো-“কেন মিথ্যে বলেছি বুঝতে পারছেন তো? এই যে আমার খোঁজ নিতে হোস্টেল অবদি চলে গেছেন। যদি বাড়ির ঠিকানা দিতাম তাহলে বাড়ি চলে যেতেন না? আমার পরিবারের লোকেরা তখন কি ভাবতো বলুন? কেউ কি বিশ্বাস করতো যে আপনার সাথে আমার একদিনের আলাপ? কোনদিনও না। এই পৃথিবীতে সত্য বলা আর মানুষকে বিশ্বাস করার মতো বোকামি আর দ্বিতীয়টি নেই।”
রিফাত চুপ করে রইলো।
“দেখুন, আমার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর কি পরিমাণ হেরাসমেন্টের স্বীকার হয়েছি সেটা কাউকে বলে বোঝান সম্ভব না। না পরিবার না সমাজ কোথাও আমার কোন সে নাই। মুখ লুকিয়ে চলতে হয়েছে বহুদিন। আমি ভুলেই গেছি আমি একজন মানুষ। আমার কোন অনুভূতি আছে। এই যে এখনো যদি কেউ আমাকে চিনে ফেলে খুব একটা ভালো নজরে দেখবে না। সবার মনে আমি ছেলে পটিয়ে পকেট হাতিয়ে নেওয়া মেয়ে হিসেবে থেকে যাব। আর ছেলেরা চিনলে ঠিক আপনার মতো রিয়্যাক্ট করে। ভাববে যেহেতু আমি ভাইরাল গার্ল সেহেতু আমি খুব সস্তা। যা খুশি করা যায় আমার সাথে।”
মেঘা থামতেই রিফাত প্রতিবাদ করে-“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমার মোটেও সেরকম কোন ইনটেনশন নেই। আমার জাস্ট কিউরিওসিটি হয়েছে আপনাকে নিয়ে। সত্যি বলতে আপনার ভিডিও আমি দেখেছিলাম আড়াই বছর আগে। তখনও দেখে আমার এটাই মনে হয়েছিল যে যা ঘটেছে আপনি কোন ভাবেই সেটার সাথে রিলেট করেন না। সামহাউ আপনি ভিকটিম বলে গেছেন। সেদিন কথা বলার পরও সেটাই মনে হয়েছে। তাই বলতে পারেন ক্যামেরার পেছনের সত্যিটা কি সেই ঘটনা জানার জন্যই আপনার সাথে আলাপ করা। আমার সত্যিই অন্য কোন ইনটেনশন নেই কখনোই ছিলনা।”
রিফাত সত্যি কথাই বললো। মেঘা ঠোঁট টিপে কিছু ভাবলো-“ধরুন যা দেখেছেন সেটাই সত্যি। তাহলে তো আর কিছু জানার নেই তাই না?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার মুখ খোলে মেঘা-“আর ক্যামেরার পেছনের ঘটনা জেনেই বা কি করবেন? কিছু কি পাল্টে যাবে? আমি বা আমার পরিবার যে হেনস্তার স্বীকার হয়েছি তা কি মুছে ফেলা যাবে? যে সন্মানহানি হয়েছে সেটা ফেরত আসবে? কিছুই হবে না। উল্টো এখন এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে আমার গায়েই নতুন করে কাঁদা ছিটবে। যারা এ ঘটনা ভুলে গেছে তাদের নতুন করে মনে হবে। আমাকে লোকে নতুন করে চিনবে। আবারও সেই আলোচনা সমালোচনা হবে আমাকে নিয়ে। বাকি কারো কিছু হবে না। আমি আবারও সেই একই ট্রমার মধ্যে দিয়ে যেতে চাই না। প্লিজ এতো উপকারের চিন্তা করবেন না।”
মেঘা হাত জোর করে অনুরোধ করলো। রিফাত হাসলো-“তার মানে সত্যিই আপনি ভিকটিম ছিলেন?”
মেঘা থমকে গেলো। নিশ্চুপ থেকে রিফাতকে দেখছে। রিফাতের কথার জালে জড়িয়ে গেছে দেখে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সে কি সারাজীবন বোকারানী থেকে যাবে নাকি? উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরলো মেঘা। দৌড়ে ওর পিছু নিলো রিফাত।
“আবারও পালাচ্ছেন? সমস্যা কি আপনার? কথা শেষ না করে হাঁটা ধরলেন কেন?”
“আপনি প্লিজ চলে যান। কথা বলতে চাই না আপনার সাথে।”
“কেন? আপনার সত্যি জেনে যেতে পারি এই ভয়ে?”
রিফাতের কথার মেঘা হাঁটা থামায়। রাগত দৃষ্টি নিয়ে রিফাতের দিকে তাকালো। তারপর আবার হাটতে শুরু করলো-“যা ভাবেন তাই। কিছু বলার নেই আমার।”
রিফাত দৌড়ে মেঘার সামনে দাঁড়িয়ে গেল-“যদি কথা না বলেন তাহলে কি করবো জানেন? নতুন করে আপনাকে ভাইরাল করবো। আপনি কি তাই চান? আপনার পরিবারের লোকজন নিশ্চয়ই এটা ভালো ভাবে নেবে না?”
মেঘা স্থবির হয়ে দাঁড়ায়। অসহায় দৃষ্টি হেনে বললো-“কি চান বলুন তো? পিছনে পড়ে আছেন কেন?”
“সত্যিটা জানতে চাই। আসলে কি ঘটেছিল আপনার সাথে। এর ফলে কি পরিবর্তন এসেছে আপনার জীবনে?”
“এতো আগ্রহের কারনটা কি? আমার ঘটনা নিয়ে আপনি কনটেন্ট তৈরি করবেন তাই না?”
এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না রিফাত। মেঘা ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্যের হাসি-“এমন আচরণ আশা করিনি আপনার কাছে। অন্তত আপনাকে বাকীদের থেকে আলাদা মনে হয়েছিল। সেই আপনিও দেখা যাচ্ছে বাকীদের মতো। আসলে কি জানেন? পৃথিবীটাই এমন হয়ে গেছে। সবাই নিজের বাইরে আর কিছু…”
শেষ করতে পারে না মেঘা ওরফে শোভা। রিফাত ওর মুখ আঁটকে ধরলো-“সবসময় নিজের মতো ভেবে নেওয়া আপনার মানসিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে। তবে আপনার ভাবনায় বাঁধা দেব না। সে আপনি যা খুশি ভাবতে পারেন। কিন্তু একটা ব্যাপার কি জানেন, আপনার সাথে যদি অন্যায় হয়ে থাকে তাহলে তার প্রতিবাদ করা উচিত। ওই যে বলে না, অন্যায় যে করে আর যে সহে দু’জনেই সমান অপরাধী। আপনি অন্যায় না করেও অপরাধী হয়ে বেঁচে আছেন। এটা তো উচিত না।”
“কি করবো তাহলে? জনে জনে বলে বেড়াব যে এ কাজ আমি করিনি? কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনেহয়? আমার নিজের বাবা মাই তো বিশ্বাস করে না। বাকীদের কথা বাদই দিলাম।”
“কেউ না করুক এই আমি বিশ্বাস করছি।”
এ কথা শুনে মেঘার রেগে থাকা মুখটা বদলে যায়। মুখের টানটান হয়ে থাকা পেশীতে ঢিল পড়ে-“তাতে পৃথিবী বদলে যাবে না। ইনফ্যাক্ট আমার জীবনেও কেন পরিবর্তন আসবে না। আপনি প্লিজ এবার আসুন।”
শোভা এবার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। পিছু ফিরলো না একবারও। রিফাত দাঁড়িয়ে থেকে ওর চলে যাওয়া দেখলো। মেয়েটার মধ্যে এক ধরনের তেজ দেখা যাচ্ছে যেটা সেদিন ও বোঝেনি। এই তেজটা মেয়েদের সন্মানে আঘাত লাগলে তৈরি হয়। ধৈর্যের চুড়ান্ত সীমায় পৌঁছার পরে জাগে। এই মেয়েটা অনেকদিন ধরে ব্লেমিং এর স্বীকার হয়ে অত্যাচারীত হয়েছে। এখন হয়তো আর সহ্য করতে পারছে না। যার ফলে নিজের উপর মিথ্যে আর অবিশ্বাসের খোলস মুড়ে দিয়েছে। এই ভাবনাটাই ওকে শোভার প্রতি দূর্বল করে তুলছে। রিফাত ভাবছে, এই মেয়েটাকে কোন ভাবে সাহায্য করতে হবে। ওর জীবনের প্রকৃত সত্যিটা সকলের সামনে আনতে হবে। আর এই কাজটা ওকেই করতে হবে। যে করেই হোক কাজটা ও করবে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin