আবার এলো যে সন্ধ্যা পর্ব-০৩

0
198

#আবার এলো যে সন্ধ্যা
পর্ব-৩

ঢাকার সবগুলো পাবলিকে চান্স পাওয়ার পরও শোভা ভর্তি হলো ঢাকা থেকে কিছুটা দূরের জে ইউ তো। এখানে ও নিজের পছন্দমত প্রথমসারির সাবজেক্টে ভর্তি হওয়ার সু্যোগ পেয়েছে। সব বাদ দিয়ে এই জায়গায় ভর্তি হওয়ার জন্য অবশ্য এটাই প্রধান কারণ না। শোভা চেয়েছে বাসা থেকে দূরে থাকতে তাতে ওর বাবা আর ভাইবোনেরা স্বস্তিতে থাকতে পারবে। ও থাকলে ঘরে যে গুমোট ভাবটা থাকে সেটা ওর দূরে থাকাতে কেটে যাবে। তাছাড়া নিজেকে গুছিয়ে নিতে একা থাকা জরুরি। গত দুই বছরের বেশি সময় ও প্রায় ঘরবন্দী হয়ে থেকেছে। কলেজে বাধ্য হয়ে যে সময়টুকু থাকতে হয়েছে সেটুকু বাদে বাইরে বের হয়নি বললেই চলে। বাসায় কেউ ওর সাথে কথা বলত না। বাইরের কারো সাথে মেশা বারন। ওর কাজ ছিলো একটাই, মন উজার করে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া, ও সেটাই করেছে। এখন খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়াটা জরুরি হয়ে গেছে। আর এর জন্য জে ইউ থেকে বেটার প্লেস আর নেই।

প্রথম সুযোগেই শোভা হোস্টেলে সিট নিয়ে ফেলেছে। বাবা কোন রা করেনি আর মাকে বুঝিয়ে বলতেই মেনে নিল। হয়তো ওরাও একটু আলাদা থাকতে পেরে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। বাবা মাকে খুব একটা দোষ দেয়না শোভা। ওর জন্য ওদের কম কষ্ট পেতে হয়নি। হুট করে নিজের দীর্ঘ দিনের বাসস্থান ছেড়ে এই শহরে থিতু হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। নিজেদের পৌত্রিক ব্যবসা ছেড়ে দশটা পাঁচটা চাকরি করাটাও সহজ না। বাবা সেটাও করছে ওর জন্য। মফস্বলের বনেদি বাড়ির জাদরেল মানুষটা যখন চাকরিতে চাকর খাটতে যায় দেখে একদম ভালো লাগে না শোভার। আর মায়ের কষ্টই বা কম কিসের? আগে লোকে মায়ের কাজ করতো এখন মা নিজ হাতে সংসারের কাজ করে। এই অল্প দিনেই যেন মা বুড়িয়ে গেছে। ভাইটা স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠলো আর বোনটা ক্লাস নাইন। ওরা প্রায়ই মন খারাপ করে থাকে। এই শহরে অনেকেই আছে তবুও যেন কেউ নেই ওদের। পরিচিত লোকের মধ্যে গেলে আলাপ ঘুরে ফিরে শোভাতে এসে আঁটকে যায়। তাই কাছের দূরের সব আত্মীয়দের থেকে দূরে থাকে ওরা। বেড়ানোর জায়গা নেই, কথা বলার মানুষ নেই। শহুরে ছেলেমেয়েদের সাথে মেশা বারন। সবচেয়ে বড় কথা, মফস্বলের খোলা মেলা বড় বাড়ি ফেলে ওদের থাকতে হচ্ছে এই দুই রুমের ঘুপচি ঘরে। সবমিলিয়ে ওরা একদমই ভালো নেই। শোভাকে তাই সরে আসতে হয়, এটাই এগিয়ে যাওয়ার ঈশ্বর প্রদত্ত পথ মনেহয় ওর কাছে।

আর সেজন্যই গাছগাছালিতেই ভরপুর ক্যাম্পাসটা শোভার ভীষণ ভালো লাগে। হোষ্টেলে ওর তিন বেডের ঘুপচি ঘরটা স্বর্গ মনেহয়। তিনতলায় নিজের রুমে বসে বৃষ্টি দিনে পুকুরের পানিতে ছন্দময় বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য দেখা ওর জন্য আশির্বাদের মতো লাগে। টুকটাক শখের জিনিস ক্যাম্পাসেই পাওয়া যায়। সেসব কিনে কিনে শোভা ঘরের কোন সাজায়৷ একা একা পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ায়। স্মৃতি স্তম্ভ দেখে, দুপুরের নিঝুম বৃষ্টিতে পুকুর পারে বসে বৃষ্টিস্নান করে, স্নিগ্ধ কোমল বিকেলগুলো উঁচু উঁচু গাছ দেখতে দেখতে হেঁটে বেড়ায় অনেকটা পথ। চায়ের দোকানে বসে চা খায়। মাঝে মাঝে গভীর রাতে হলের ছাদে উঠে আকাশ দেখে, তারা গুনে। ক্যাম্পাসে এখনো কেউ চেনেনি ওকে তাই স্বস্তি বোধ করলেন ভেতর ভেতর ঘাবড়ে থাকে। তবুও অদ্ভুত পাগলামিতে ঘিরে থাকা দিনগুলো মন্দ কাটে না শোভার।

আসলে বাবা মায়ের চোখের আড়ালে এসে যেটা হলো, শোভা যেন খোলস মুক্ত হলো। ঘটনার অনেকদিন পার হয়েছে। এখন হুটহাট লোকে ওকে চিনে ফেলে না। ভার্সিটিতে পড়তে এসে কনফিডেন্স খানিকটা বেড়েছে। ফলশ্রুতিতে শোভা একটু একটু করে প্রজাপতির মতো ডানা মেলতে শুরু করেছে। পড়ালেখায় ভালো বলে শিক্ষকরা একটু আলাদা নজরে দেখছে ওকে। ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সাথে মিশে যাচ্ছে অনায়াসে। হইহুল্লোর এর মাঝে ওর সময় যেন চোখের পলকে কেটে যায়। এইযে একটু স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে বলেই মনটা ভীষণই ভালো থাকছে ওর আজকাল। আপনাতেই গুনগুনিয়ে সুর ভাজছে। যেন অনেকটা শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে যাওয়া।
শৈশবের কিছু অভ্যাসও ফেরত আসছে। এই যেমন গান গাওয়া। সুরেলা গলা ছিলো বলে স্কুলে থাকতে টিচার রেখে
নিয়মিত রেওয়াজ করে গান শিখেছিল। পরবর্তীতে পড়ালেখার চাপে জীবন থেকে গান হারিয়ে গেল। এই সুন্দর পরিবেশে থাকার কারনেই হয়তো পুরনো ইচ্ছে মাথাচারা দিচ্ছে। সেই শখ ফিরে আসছে মনে। মাঝে মাঝে মোবাইলে গান রেকর্ড করে শুনে অবাক হচ্ছে। সুর তাল লয় সবই তো ঠিক ধরতে পারছে। গলাটাও শুনতে খারাপ লাগছে না। গভীর রাতে পড়ার টেবিলে গুনগুন করতে করতে চুপ হয়ে যায় শোভা। একটা ভয়ংকর পরিকল্পনা মনের কোনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মত ব্যাপার। সেই চেষ্টা কি একবার করে দেখবে? কিন্তু বাবা! বাবা কি মেনে নেবে?

★★★

“এই ভাইয়া, তুমি নাকি আমাদের ক্যাম্পাসে যাচ্ছ?”
খাওয়ার টেবিলে বসতেই আদৃতা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। রিফাত বাবার মুখখানা দেখে নিল একবার। বেশ গম্ভীর, মানে রিফাতের কপালে আজ খাওয়া না লেকচার জুটবে। সে মাথা দুলায়-“হ্যা, তোদের ক্যাম্পাসে যাব এটা ঠিক আছে তবে তোদের ডিপার্টমেন্টে নয়। আইবিএ থেকে নিমন্ত্রণ পেয়েছি নতুনদের বরন অনুষ্ঠানের জন্য। কেন বল তো?”
আদৃতার মুখ শুকিয়ে গেছে। সে পাংসু মুখে বললো-“ওহহ। আমি তো আরও ক্লাসে তোমার গল্প করলাম যে তুমি ক্যাম্পাসে যাচ্ছ। সবাই খুব এক্সাইটেড ছিল তোমাকে দেখবে এই আশায়। ওরা তো বিশ্বাসই করতে চায় না তুমি আমার কাজিন ব্রাদার।”
রিফাত জবাব দিলো না। ওর হয়ে জবাব দিলো ওর বাবা গোলাম রসুল-“তুমি শিওর না হয়ে বন্ধুদের কাছে গল্প করেছ কেন দিতি? জানো তো অতি বালখিল্যতা ভালো ব্যাপার না?”
“সরি চাচ্চু, আমি বুঝতে পারিনি আসলে।”
আদৃতা মুখ কালো করে খাবার খেতে মনোযোগ দেয়। রিফাত মুখ নিচু করে হাসছিল।
“তা তোমার এইসব ভিডিও বানানো কতদিন চলবে? সারাজীবন এসব করেই কি পেট ভরবে? এই হাইপ কি সারাজীবন থাকবে? কতদিন টাকা ইনকাম করতে পারবে এসব করে? আর যখন পারবে না তখন জীবন ধারনের জন্য কি করবে বলে ভেবেছ?”
রিফাতের মুখের হাসি মুছে গেল। রোকোয়া ছেলেকে বাঁচাতে মুখ খুললেন-“খাওয়ার টেবিলে বসে আপনারা এতো কথা বলেন কেন? নিজে খান অন্যকেও খেতে দেন।”
গোলাম রসুল গম্ভীর মুখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন-“তোমার ছেলেকে কি পাওয়া যায় সবসময়? উনি তো আকাশের চাঁদ। ওনার দেখা পেলে আমরা ধন্য হই। কতবার বলছি অফিসে আয়, নিজেদের ব্যবসাটা বুঝে নে। নাহ, উনি ইউটিউবার হবেন।”
“গালিব তো আছে বাবা। আমি না বসলে কি সমস্যা?”
রিফাতের কথায় গালিবের গলায় খাবার আঁটকে গেল। রোকেয়া পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। গালিব এক ঢোকে গ্লাসের পানি শেষ করে-“বাবা তোমার কথা বলছে ভাইয়া, তুমি আমাকে টানছো কেন?”
গোলাম রসুল অত্যাধিক মেজাজ খারাপ করে তার ছেলেদের দেখলেন-“তোমাদের দেখে অবাক হয়ে যাই। কিভাবে একজন আরেকজনকে ঠেলছিস। তোরা সবাই দেখছি আসাদের মতো হয়েছিস। আসাদ যেমন সুযোগ থাকা সত্বেও সারাজীবন গ্রামে কাটিয়ে দিলো। হাজার ডেকেও ওকে ঢাকায় আনতে পারলাম না। কি ভাবিস নিজেদের? এত কষ্ট করে একটা বিজনেস দাঁড় করিয়েছি সেটার প্রতি কারো ইন্টারেস্ট নেই। কেন? আচ্ছা রিফাত না হয় নিজের একটা ভবিষ্যত বানিয়ে ফেলেছে তুমি কি করবে গালিব? বাবার ব্যবসা না করে কি এবার ব্লগিং শুরু করবে? তাহলে পড়ালেখা করছো কেন? আমার টাকাগুলো নষ্ট করার কি মানে?”
গালিব মাথা নিচু করে গরুর মাংস দিয়ে ভাত মুখে দিলো।
“আমি ইন্টারেস্টেড বাবা। পড়ালেখা শেষ করে তোমার বিজনেস দেখব।”
রিফাতের ইন্টারে পড়ুয়া একমাত্র বোন তোড়া বলে উঠলো। আদৃতাও গলা মেলালো-“তোড়ার সাথে আমিও আছি চাচ্চু।”
গোলাম রসুল গোটা পরিবারের উপর অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে খাবার ফেলে রেখে চলে গেলেন। তার মাথার শিরা দপদপ করছে। কেমন ছেলেমেয়ে তার?

শনিবার সকাল সকাল রিফাত বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো। গন্তব্য জাবি, সাথে আছে তার বন্ধুরা। ছাত্রজীবনে খুব আসা হতো এখানে। রিফাতের নিমন্ত্রণের খবর পেয়ে বন্ধুরা বায়না ধরেছে ওরাও আসবে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে। তাছাড়া আজ জাবির অনেক পুরনো বন্ধুরাও আসবে ওদের সাথে দেখা করতে। মুলত রিফাতরা যাচ্ছে শুনেই বন্ধুরা আসবে। সারাদিন আড্ডা দেবে সদ্য ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়া বন্ধুরা সবাই। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আজকের যাত্রা। ফুয়াদের এতো সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস নেই। তাই গাড়িতে উঠেই সে ঘুম দিয়েছে। হাফিজ ফুয়াদকে চিমটি কাটে-“এই ওঠ, এত ঘুম কিসের তোর? এতোদিন পর বাইরে বেড়িয়েছি গল্প করবে তানা উনি ঘুমাচ্ছেন। ওঠ বলছি।”
“মামা, ভোরের দিকে ঘুমাইছি। ঘুমাইতে দে না।” ঘুমের মধ্যেই জবাব দিলো ফুয়াদ।
“কেন? বউ তো নাই তোর তাহলে সারারাত কি করছস? ল্যাপটপে কাম সারছোস নাকি?”
বাকীরা হাফিজের কথা হাসলো। ফুয়াদ বাধ্য হয়ে উঠে বসলো-“তুই শালা সবসময় এইসবই ভাববি। বিয়া ফরজ হয়া গেছে তোর জন্য। আন্টিকে ক তারাতাড়ি তোরে বিয়া দিতে।”
“হাফিজ বিয়ে ছাড়াই বিন্দাস আছে তাই নারে হাফিজ?”
নিয়াজ রহস্যময় হাসলো। মিনহাজ নিয়াজকে গুতো দেয়-“আমার হিসু লাগছে আপাতত বোতলে কাম সারতে চাই। ওই নিয়াজ তোর পাশে ফাঁকা বোতল দেখতেছি ওইটা দে।”
নিয়াজ মুখ বিকৃত করলো-“ছিহ মামা, কি সুন্দর রোমান্টিক আলাপ চলতেছে এরমধ্যে তুই বাম হাত ঢুকাইয়া দিলি তো আনহাইজেনিক কইরা। তুই খাওয়ার আগে হাত ভালোমতো ধোস তো? তোর খাওনের ভিডিও দেখলে এখন খালি মনে হইব তুই বাথরুম কইরা হাত না ধুয়ে খাইতে বসছিস। ইয়াক।”
আবারও হাসির রোল। রিফাত গাড়ি চালাতে যেয়ে হিমশিম খাচ্ছে। ও ধমকে উঠলো-“এই তোরা থাম। এরকম করলে এক্সিডেন্ট করবো তো।”
বেশ কিছুটা পথ মৌন গেল ওরা। এরপর হাফিজ জানতে চাইলো-“রিফুর ভিডিও আসছে না অনেকদিন ধরে। কি ঘটনা রে রিফু? তোর নেক্সট ভিডিও কবে আপলোড হবে?”
“জানি নারে। সেরকম মজাদার টপিকস পাচ্ছি না। পেলে তো ভিডিও দেখতে পেতি।”
বলতে বলতে মনটা খারাপ হয় রিফাতের। আসলেই কিছুদিন ধরে কন্টেন্ট পাচ্ছে না সে। অজানা কারনে ভিডিও বানানো হচ্ছে না। ও তো মনে মনে ভেবে রেখেছে, আজ জাবিতে গিয়ে কন্টেন্ট খুঁজবে। তবে সে কথা আর বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলোনা।

বিশেষ অতিথি হিসেবে মঞ্চে ডাক পাওয়ার আগেই সারপ্রাইজ হয়ে গেলো রিফাত। শোভা শেখ নামে যে মেয়েটা তসলিমা নাসরিনের ‘এমন ভেঙেচুরে কেউ ভালোবাসেনি আগে’ আবৃত্তি করলো তাকে অবিকল মেঘার মতো লাগে রিফাতের কাছে। আশ্চর্য বিস্ময় নিয়ে শোভাকে দেখে রিফাত। আবৃতি শেষে তুমুল করতালির মধ্যে দিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে শোভা যখন নিজের জায়গায় যাচ্ছে নিজের অজান্তেই রিফাত ডাকলো ওকে-“মেঘা! ইজ দ্যাট ইউ?”
মেঘা থামে, তাকায়, অবাক হয়। সামনে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে থাকা রিফাতকে দেখে ওর মুখটা ক্রমশ ফ্যাকাসে রক্তশুন্য হয়ে যাচ্ছে। রিফাত বিস্ময় নিয়েই হাত বাড়িয়ে দিয়েছে-“হোয়াট আ সারপ্রাইজ! সত্যিই আপনাকে এখানে আশা করিনি।”
শোভা দ্বিধান্তিত হয়ে রিফাতের বাড়ানো হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, এমন কোইন্সিডেন্স না হলেও পারতো তার সাথে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin