আমার আসক্তি যে তুমি Part-51

0
3689

#আমার_আসক্তি_যে_তুমি
#Part_51
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
মেঝেতে বসে আছে রিয়ান। চোখ দুটো একদম রক্তিম বর্ন ধারণ করে আছে। চোখের নিচটা একটু ফোলা। পাশেই তার পরে আছে একটি ঔষধের কোটা। তার আশেপাশে ছিটিয়ে ঔষধগুলো। বা হাত দিয়ে টুপ টুপ করে রক্ত পড়ে চলেছে মেঝেতে। ফলস্বরূপ মেঝেতে সৃষ্টি হয়েছে রক্তের সুরু রেখা। যা একটু একটু করে প্রসারিত হয়েই চলেছে।
কিন্তু রিয়ানের সেইদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। রিয়ান এইবার বলতে শুরু করে।
.
— তোমাকে পাওয়ার জন্য ৫ বছর অপেক্ষা করেছি। তোমাকে আপন করতে নিজের পাগলামোগুলো গোপন ঠিক করেছি কিন্তু ভালবাসা নিয়ে কোন ছলনা করেনি। সবসময় নিঃস্বার্থভাবে ভালবেসেই গিয়েছি।
ভাবি নি কখনো আমার মত কেউ কাউকে এতটা ভালবাসবে। ঠিকই বলেছ তুমি রিয়ুপাখি আমি মানুষ না অমানুষ। নরপশু! তাই তো তোমার দিকে বাড়ানো হাতগুলো আমি দ্বিধা ছাড়াই মেরে ফেলতে পারি। আর এতে আমার আফসোসও নেই।
.
রিয়ান এইবার পাশে পরে থাকা ঔষধ গুলোর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যর হাসি হেসে বলে,
.
— তুমি ঠিক জানোও না আমার মধ্যে ঠিক কতটা হিংস্রতা আছে। হিংস্রতায় পুরিপূর্ণ আমি। কিন্তু এই নিরর্থক ঔষধগুলো সেই হিংস্রতা যে বের হতে দেয় না। খানিকটা দমিয়ে দিয়েছে এইটা আমার হিংস্রতাকে। কিন্তু তাও মাঝে মধ্যে যে আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। আমাকে শান্ত রাখার কাজই যে এদের।
খুব করে চাই তোমাকে। ঠিক এমন করে যে কোনদিনও কখনো কাউকে চাই নি। কেন বুঝো না তুমি আমার ভালবাসা সাধারণ নয়। এইটা যে সকল ভালবাসা হতে ভিন্ন। এইটা যে রিয়ানের আসক্তিময় ভালবাসা।
.
.
?
.
রাত বেশ ঘনিয়ে এসেছে। বাইরের বয়ে চলেছে হিম শীতল বাতাস। আকাশটা আজ মেঘলা। ব্যস্ত শহরটি এখন একদম নীরব হয়ে পড়েছে। মাঝে মধ্যে দুই একটি গাড়ি শা শা শব্দ এগিয়ে চলেছে।
আমি মেঝেতেই গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছি। তখন কান্না করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ি। তখন দরজা খুলতে গিয়ে আমার জন্য দরজা আটকে যায়। যেহেতু আমি দরজার পাশেই শুয়ে ছিলাম সেহেতু দরজাটি খুলতে গিয়ে রিয়ান বাধাপ্রাপ্ত হয়। রিয়ান এইবার নিচে তাকিয়ে দেখে আমি গুটিসুটি হয়ে মেঝেতে শুয়ে আছি। রিয়ান আস্তে করে দরজা ফাঁক দিয়ে রুমে ঢুকে এবং নিজের হাতে থাকা খাবারের প্লেট টা পাশের টেবিলে রাখে। তারপর আমার কাছে এসে হাটু ভাজ করে বসে আর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখের নিচটা ফোলা। চোখের কোনে পানি শুকিয়ে আছে। মুখটা একদম মলিন হয়ে আছে। রিয়ান বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে এক দীর্ঘ শ্বাস নেয়।
তারপর আমায় কোলে করে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে দেয়। ধীর কণ্ঠে আমায় ডাকতে থাকে,
— রিয়ুপাখি! রিয়ুপাখি!
.
আমি এইবার কিছুটা নড়েচড়ে উঠি। কিন্তু ঘুমের রেশ না কাটায় আবার ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের মধ্যেই রিয়ানের হাত জড়িয়ে ধরি। রিয়ান এইবার মুচকি হেসে আবার আমায় ডাকতে শুরু করে।
.
— রিয়ুপাখি উঠো! খেতে হবে তো। দুপুর থেকে কিছু খাও নি তুমি। রিয়ুপাখি! একটু উঁচু স্বরে।
.
এইবার আমি পিটি পিটি করে চোখ খুলি। তাকিয়ে দেখি রিয়ান আমায় ডাকছে। আমি এইবার ভালোমত চোখ খুলি তারপর রিয়ানের মুখের পানে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকি। হুট করেই পুরানো ঘটনাগুলো মাথায় খেলে উঠে। সাথে সাথে আমি লাফ দিয়ে উঠি আর ভয়ে দূরে ছিটকে সড়ে যাই। রিয়ানকে দেখে কেন যেন আমার খুব ভয় করছে। খুব! বার বার চোখের সামনে সেই ভয়ানক দৃশ্য ফুটে উঠছে। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,
.
— ককাছে আআসবেন ননা আআমার। দদূরে যযান। আআমি থথাকব ননা এএইখানে। চচলে যযাব! আমায় যযেতে দদিন।
.
আমার মুখ থেকে এমন কথা শুনে রিয়ান রেগে যায়। কিন্তু তাও নিজেকে সংযত রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
— এইসব কথা পড়ে হবে। আগে খেয়ে নাও! আমি খায়িয়ে দিচ্ছি আসো।
.
— আমি খাব না। আমি চলে যাব। আপনার সাথে আমি থাকতে চাই না। ঘৃণা করি আপনাকে আমি৷ ঘৃণা করি! চেঁচিয়ে।
.
— রাগ উঠিও না বলছি! তা না হলে খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি। দাঁতে দাঁত চেপে।
.
— কি আমাকেও মেরে ফেলবেন? তো মেরে ফেলুন না। এমন অমানুষের সাথে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।
.
— রিয়ুপাখি!! তুমি কিন্তু এখন অতিরিক্ত করছো। আমার সহ্যের সকল সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে। চুপচাপ বলছি খেয়ে নাও তা না হলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। নিজের রাগ কোন মতে দমন করার চেষ্টা করে।
.
— আপনার হাতে আমি বিষও খেতে রাজি না। শুনেছেন! আমি না খেয়ে মরে যাব তাও আপনার হাতে খাব না।
.
আমার মুখে এতবার মরার কথা শুনে রিয়ান নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলো। তার সকল ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে যায়। সে আমার চুলের মুঠি ধরে আমাকে তার মুখের সামনে এনে ধরে বলে,
— আর একবার যদি মরার কথা বলেছিস না তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আমার হিংস্রতাকে জাগিয়েও না। তারপর নিজেকে কিছুটা সামলিয়ে জোর করে আমার কপালের সাথে কপাল লাগিয়ে সে বলে,

–তোমাকে কতটা ভালবাসি তা তুমি কেন বুঝো না? তোমাকে ছাড়া যে আমি নিঃস্বন। তুমি না থাকলে মরে যাব আমি। তুমি জানো তুমি আমার দূর্বলতা। আমার বেঁচে থাকার উৎস তুমি। তাহলে তুমি কেন বার বার সেই দূর্বল জায়গাতেই আঘাত করো। কেন!
একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো তুমি আমায় ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না। আমার মৃত্যু ব্যতীত কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না বুঝলে। তাই এমন বাচ্চামো ছেড়ে দাও। তা না হলে খুব খারাপ হবে। শান্ত চাহনিতে।
.
আমি শুধু নির্বাকের মত রিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকি। রিয়ানের এই শান্ত চাহনিতে যে কতটা হিংস্রতা লুকিয়ে আছে তা আমার অজ্ঞাত নয়।রিয়ান এইবার আমায় ছেড়ে দেয় আর সোজা হয়ে বসে। আমি এইবার কিছু বলতে যাব তার আগেই রিয়ান আমার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বলে,
.
— নো মোর ওয়ার্ডস! এখন খাবে আসো।
.
আমি আমার ঠোঁট থেকে আঙুলটা সরিয়ে দিয়ে বলি,
— আমি খাব না বলেছি না। চেঁচিয়ে।
.
রিয়ান এইবার কিছু না বলে উঠে দাড়ায় তারপর খাবারের প্লেটটা নিয়ে এসে আমার সামনে বসে। প্লেটটা সাইড টেবিলে রেখে আমায় টেনে তার কোলে বসিয়ে দেয় এবং এক হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে। এইবার আমি সাপের মত ফোস ফোস করতে থাকি আর মোচড়াতে থাকি। তা দেখে রিয়ান খুব জোরে হুংকার দিয়ে উঠে। সাথে সাথে আমি ভয়ে কেঁপে উঠি আর একদম শান্ত হয়ে যাই। রিয়ান এইবার খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে ভাতের মাখিয়ে আমার মুখের সামনে ধরে। কিন্তু আমিও নাছরবান্দা। খাব না মানে খাব না।
রিয়ান এইবার প্লেট সাইডে রেখে আমার গাল চেপে ধরে আমার মুখে খাবার ভরে দেয়। আর বলতে থাকে,
— যা হয়েছে আমার সাথে তাহলে খাবারের উপর নিজের রাগ কেন ঝাড়ছো? খাবারের সাথে তো আর কোন শত্রুতা নেই। তো এখন ঠিক মত খাও কেমন। খেয়ে আমার সাথে যুদ্ধ করো।
.
আমি কিছু বললাম না। শুধু একটা ভেংচি কাটলাম কেন না রিয়ানের সাথে এখন পেরে উঠা সম্ভব না তা আমি জানি। তাই চুপচাপ খেতে লাগলাম। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। তখনই আমার নজর যায় রিয়ানের কাটা হাতটির দিকে। সাথে সাথে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। ক্ষতটা একদম সতেজ। রক্ত জমাট বেধে আছে। রিয়ান তাতে শুধু হ্যেক্সিসোল দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে নিয়েছে। এতে কোন ক্রিম লাগাই নি যার জন্য ক্ষতটা ফুটে উঠেছে। আমি এক ধ্যানে সেইদিকে তাকিয়ে থাকি। রিয়ান তা লক্ষ্য করে সেইদিকে তাকিয়ে বলে,
.
— যার ভালবাসার মানুষটি ক্ষত পেয়ে বসে আছে সে কিভাবে নিজেকে ক্ষত না দিয়ে পারে? কষ্ট পেতে হলে আমি পাবো তুমি না। যেহেতু আঘাতটা তুমি পেয়েছো তাই আঘাতটা আমাকেও পেতে হবে। কষ্টটা সমান না হলে বুঝবো কিভাবে ভালবাসার মানুষটির মর্ম।
.
রিয়ানের কথায় আমি হতভম্ব হয়ে যাই। রিয়ানের ভালবাসা যে একদম নিখুঁত। এতে যে কোন খাত নেই। মন বার বার রিয়ানের ভালবাসায় মশগুল হতে চাইলে মস্তিষ্ক আবার উল্টো পথে দৌড়ায়। সে বার বার রিয়ান যা করেছে তার দৃশ্য চোখের সামনে তুলে ধরতে থাকে। বার বার আমায় জানান দিয়ে দেয় যে রিয়ান একজন খুনি। প্রতারক! ওর থেকে দূরে চলে যাওয়াই উত্তম।
আর এমন সময়ে যখন নিজেই একদম ভেঙে পড়ি তখন মন আর মস্তিষ্কের লড়াইয়ের মধ্যে মস্তিষ্কই বরাবর জিতে যায়। আর আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।
.
.
খাওয়া শেষে রিয়ান আমার কাছে এসে আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে। আমি না আসতে চাইলে জোর করে নিয়ে আসে। আমি এইবার সাপের মত ফোসফাস করতে করতে বলি,
— ছাড়েন আমায় বলছি। আপনার ছোঁয়া আমার সহ্য হয় না। একদম না! একজন খুনির স্পর্শ আমি চাই না। ছাড়েন আমায়।
.
এই বলে আমি মোচড়ামুচড়ি করতে থাকলে রিয়ান বলে উঠে,
.
— যার জায়গা যেখানে তাকে সেখানেই থাকতে হয়। আর তোমার জায়গায় আমার হৃদয়ে তাই তোমায় এইখানেই রেখেছি। এখন সেটা দূষিত হোক আর পবিত্র হোক তোমায় এইখানেই থাকতে হবে। এখন মোচড়ামুচড়ি বাদ দিয়ে চুপচাপ ঘুমাও। এই বলে রিয়ান আমায় আরও শক্ত করে আমায় জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে।
.
আমি বেশকিছুক্ষণ মোচড়ামুচড়ি করে হাল ছেড়ে দেই। আর ফুপিয়ে কেঁদে উঠি। যাকে সবসময় আমার আশেপাশে চেয়েছিলাম আজ তার থেকে দূরে যাওয়ার জন্যই এত প্রচেষ্টা। রিয়ানও বেশ সবকিছুই বুঝতে পারে কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সে জানে এমনটা হওয়ার এই কথা। তাই রিয়ান চাওয়া সত্তেও কিছু করতে পারলো না। শুধু নিরবে দীর্ঘ শ্বাস নিলো। একসময় আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ি আর রিয়ান তা দেখে আমার কপালে ভালবাসার এক ছোঁয়া দিয়ে আমার মুখের পানে তাকিয়ে থাকে। তারপর আনমনে বলে,
.
— কাল রাতেও যেখানে সব ঠিক ছিল। তুমি স্বেচ্ছায় আমার বাহুদ্বয়ে আবদ্ধ ছিলে আজ সেই তুমি আমার বাহুদ্বয় হতে দূরে যাওয়ার জন্য এত কারসাজি। এইটা হয়তো ভাগ্যের পরিহাস।
.
.
?
.
সকালে রিয়ানের আগেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি উঠে দেখি রিয়ানের আমায় এখনো জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। কিন্তু হাতের বাঁধনটা বেশ ঢিলে। হুট করেই মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে উঠে আর আমায় সর্তক করে দিতে থাকে,
” রিয়ানা এইটাই সুযোগ পালিয়ে যা এইখান থেকে। চলে যা রিয়ানের কাছ থেকে। চলে যা! ”
.
আমি এইবার আলতো করে রিয়ানের হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে পড়ি। তারপর দ্রুত নিজের গায়ে ভালো মত ওরনা জড়িয়ে নিয়ে বাহিরের দরজার দিকে অগ্রসর হই। মাথায় শুধু একটি কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে যে,
” আমাকে এইখান থেকে বেরুতেই হবে। আমি রিয়ানের সাথে থাকতে পারবো না। কিছুতেই না।”
.
আমি দরজার কাছে এসে দরজার লক খুলতেই যাব তখনই কেউ এসে আমার হাত খপ করে ধরে ফেলে। আমি এইবার ভয়ে একদম জমে যাই। তাও কিছুটা সাহস জুগিয়ে আস্তে আস্তে পাশে তাকাই। আমি পাশে তাকাতেই কেউ স্বজোরে আমার গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।
.
.
#চলবে