আমি একা পর্বঃ২

0
2987

#আমি_একা
#পর্বঃ২
#আরিয়া_সুলতানা

রাতে মা আমার মাথাটা কোলের উপরে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, “গল্প শুনবি?”
“কি গল্প মা?”
“একটা সাধারণ মেয়ে আর অসাধারণ ছেলের জীবনের পথচলার গল্প।”
মায়ের কথা শুনে বুঝলাম প্রেমের গল্প বলতে চাচ্ছে। প্রেমের গল্পতে আমার এলার্জি আছে মা জানে। তবুও কেনো বলতে চাচ্ছে বুঝতে পারছি না। যাক শুনি, হাতে তো মাত্র আর কয়টা দিনই আছে। চোখটা বুজে বললাম, “বলো মা, আমি শুনছি।”
“মেয়েটার নাম কুহু আর ছেলেটার নাম শ্রাবণ।”
কুহু নামটা আমার কাছে পরিচিত লাগছে। আগে শুনেছি বোধহয়। যাই হোক, শুনতে থাকি কি বলছে মা।
“কুহুর বয়স তখন সবে ১৪বছর। প্রচণ্ড দুরন্তপনা আর ফাজলামি দিয়ে ঠাসা ছিল ওর মাথা। তখন স্কুল হতো সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। স্কুলের এক বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত পণ্ডিতই বলা চলে সুজিত স্যারকে। স্যার হিন্দু ছিলেন, প্রচণ্ড রাগী। তার ক্লাসে কেউ একটু টু শব্দটিও করার সাহস পেত না। কেউ পড়া না পারলেই সপাসপ জোড়া বেতের বারিতে তার রাতে জ্বর আসা নিশ্চিত। কুহু একটু খারাপ ছিল পড়ালেখায়। কোনো টিচারের পড়া না করলেও কুহু ঠিক-ই সুজিত স্যারের পড়া করেই আসতো। একদিন জ্বর হওয়ার জন্য পড়া করতে না পারায় খুব মার খেয়ে বাসায় ফিরেছিল। হাত কেঁটে লম্বা লম্বা দাগ পড়ে গেছে। কুহুর বাবা তো মেয়ের এই অবস্থা দেখে তক্ষণই সুজিত স্যারের বাড়িতে কুহুকে নিয়ে উপস্থিত।
“আপনে মাস্টের মানুষ! পড়া না পারলে মারবেন ঠিক-ই কিন্তু এমনে কেডা মারে? দ্যাহেন মাইয়াডার হাতে কাঁটা দাগ পইড়া গেছে। রক্ত জমাট বাইন্ধা চাইয়া আছে। আপনি মাস্টের নাকি পাষাণ? আপনার নামে আমি শালিশ-বিচার করমু। আপনারে যদি এই গেরাম ছাড়া না করছি তো আমার নাম ও কামরুল না!”
এইদিকে কুহু হাতের দিকে তাকিয়ে ভাবছে “আসলেই কি আমি ব্যাথা পেয়েছি? নাকি ভান করছি? আমার হাতে তো ব্যাথা নেই তেমম। কতই তো ব্যাথা পাই ফাযলামি করার সময়। বাবা তখন তো উল্টে আমাকেই রাগ করে তাহলে বাবা এখন স্যারের বাসায় কেনো নিয়ে এলো আমাকে?” এইদিকে সুজিত স্যার ও কুহুর বাবার কথার পিঠে কথা বলছে। এবার কুহুর বাবা রীতিমতো ঝগড়া লাগিয়ে দিল সুজিত স্যারের সাথে। কুহু ওর বাবার মুখের দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে। তার বাবাকে সে চিনতে পারছে না আজ। এমন রূপের সাথে কুহু পরিচিত নয়। কুহুর বাবা আর সুজিত স্যারের চিল্লাপাল্লা শুনে স্যারের বাসা থেকে একটা ছেলে বের হয়ে এলো। কুহু ছেলেটিকে প্রথম দেখছে। বেশ লম্বা, সুদর্শন। তবে দেখলেই বোঝা যায় তার স্বভাবে তেমন চঞ্চলতা নেই। শান্ত স্বভাবের।
“কি হয়েছে আব্বু? চিল্লা-পাল্লা করছো কেনো এখানে দাঁড়িয়ে? বাইরের মানুষ শুনছে তো।”
কথা বলার ভাব দেখে বোঝা গেল ছেলেটি সুজিত স্যারের ছেলে। কুহু আগে শুনেছিল সুজিত স্যারের একটা ছেলে আছে। তবে কখনো দেখেনি আজকের আগে। কুহুর দিকে ছেলেটি তাকাতেই কুহু চোখ ফিরিয়ে নিল সেই দিক থেকে। সেদিনের মতো হুমকি-ধামকি দিয়ে কামরুল সাহেব ফিরে এলো বাড়িতে। বাড়িতে ঢোকার আগেও কামরুল সাহেবের চেহারা রাগ ফুঁটে ছিল। তবে বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে তা বিশ্বজয়ী হাসিতে রূপান্তরিত হলো। কুহুর মাথায় হাত দিয়ে বললো, “যাও মা, ঘরে যেয়ে পড়তে বসো!”
কুহু কোনো কথা না বলে মাথা উপরনিচ করে সায় দিয়ে চলে এলো। পড়ায় মন বসছে না কুহুর।
“বাবা এমন কেনো করলো স্যারের সাথে? স্যার তো আমাকে বেশি মারেনি। আর বাবাও তো আমাকে যখন মারে তখন এর চেয়ে বেশি কাঁটে। তাহলে কি হলো আজ বাবার। যাই হোক, আমি যেয়ে দেখি রান্নাঘরে কিছু আছে কিনা।”
রান্নাঘরের পাশের ঘরের কুহুর বাবা-মা থাকে।
“বুইঝলে রেখা! আচ্ছা মতো শিক্ষা দিছি ওই বজ্জাতদের!”
কামরুল সাহেবের কথা শুনে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে পড়লো কুহু। কিছুটা পিছনে যেয়ে আঁড়ালে দাঁড়ালো যাতে দেখা না যায় ওকে।
“ক্যান কি করছো?”
“আরেহ, জানোইতো সুজিতগো লগে আমাগো ওই মিঠাপুকুরের জমি নিয়া ঝামেলা চলতাছে। এইবার কোনোমতে শালিশ-বিচারে সুজিতরে গ্রাম ছাড়া করতে পারলেই ওই জমিটুক আউড়াইতে পারমু।”
এবার সব কিছুই পরিষ্কার হয়ে গেল কুহুর কাছে। বাবার করা ব্যবহারের জন্য লজ্জিতও হলো খুব। কুহু সিদ্ধান্ত নিলো সুজিত স্যারকে বলে দিবে আর ক্ষমাও চেয়ে নিবে। পরেরদিন শুক্রবার হওয়ায় স্কুল বন্ধ। সকালের নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়লো স্যারের বাসার উদ্দেশ্যে। স্যারের বাসায় যাওয়ার পথেই স্যারের ছেলের সাথে দেখা হয়ে গেল। কুহু তার তাকেই বলার কথা ভেবে তার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো।
“ভাইয়া একটা কথা বলার ছিল। একটু শুনবেন?”
কুহুকে দেখেই ছেলেটির মুখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে বিরক্ত।
“হ্যা বলুন।”
তারপর কুহু তার বাবার খারাপ ব্যবহারের পিছনের কারণগুলো বললো যা সে জানে। ছেলেটি শুনে অবাক। এই সে বাবারই মেয়ে যেয়ে বাবা তার বাবাকে অপমান করে গ্রাম ছাড়া করার হুমকি দিয়ে গেছে আগেরদিন। কিছুক্ষণ কথা বলার পরই কুহু হঠাত জিজ্ঞাসা করে বসলো,
“ভাইয়া আপনার নাম কি?”
“শ্রাবণ সাহা!”
এরপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর কুহু স্যারের সামনেই কিছু কথা বলতে চায় বলে স্যারের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল শ্রাবণের সাথে। আশ্চর্যজনকভাবে স্যার কুহুকে দেখে একটুও রাগ হলো না।
“কুহু আমি জানি এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। তোমার মুখ দেখেই বুঝেছিলাম কালকে। তোমার ক্ষমা চাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে পড়া না পারলে কিন্তু মারবো ঠিকই।”
এরপর কিছুক্ষণ হাসি-ঠাট্টা করে কুহু বাড়িতে ফিরে এলো। পরের দিন শালিশ-বিচার হলো ঠিকই তবে কামরুল সাহেব সুজিত স্যারকে গ্রাম ছাড়া করতে পারেনি। তার ১বছর পরই কামরুল সাহেব মারা যান রোড এক্সিডেন্টে। কুহুর বয়স যখন ১৬বছর তখন বুঝতে পারে সে শ্রাবণের প্রতি দুর্বল। অবশেষে ২বছর প্রেম করার পর যখন রেখা বেগম কুহুর বিয়ে ঠিক করলো তখনই বাঁধলো বিপত্তি। ধর্ম ভিন্ন ওদের। রেখা বেগম কুহুকে শ্রাবণের কাছ থেকে সরানোর জন্য অনেক মেরেছেন ও।
“এতো বছর তোরে পড়িয়ে কি প্রতিদান ডা পাইলাম? তার চেয়ে ভালো হইতো তোরে বিষ খাওয়াইয়া মাইরা ফেলাইলে।”
কুহু শ্রাবণের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। “ভুলে যাও আমাকে। আমাদের মাঝে একটা লোহার দেয়াল দাঁড়িয়া আছে। কখনোই সম্ভব হবেনা আমাদের এক হওয়া।”
শ্রাবণ সেদিন একটি কথাও বলেনি। কুহুর হাত টা ধরে মসজিদে নিয়ে গিয়েছিল।

“ছিহঃ, তুই আমার ছেলে হয়ে কিভাবে এটা করতে পারলি! এই শিক্ষা দিয়েছিলাম তোকে? নিজের ধর্ম, জাত সব ভুলে মুসলমান হয়েছিস শুধুমাত্র এই মেয়েটার জন্য? আবার বিয়েও করে নিয়ে এসেছিস? ঘেন্না হচ্ছে আমার তোর মুখ দেখতে! বেরিয়ে যাহ আমার বাড়ি থেকে।”
সেদিন রেখা বেগমই থাকতে দিয়েছিল কুহু আর মোঃ সামিউল ইসলামকে।
এরপর কেঁটে গেছে এক বছর…
৩মাসের অন্তঃসত্ত্বা কুহুকে নিয়ে সামিউল দাঁড়িয়ে আছে সুজিত সাহার সামনে।
“তোদের মেনে নিব যদি তোর বউয়ের প্রথম সন্তান ছেলে হয় তবেই! নাহলে তুই এখানে থাকতে পারবি না।”

(চলবে)