আমি সেই চারুলতা পর্ব-৩৭+৩৮

0
345

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ৩৭
_______________________

নিজের দিদির দুই সন্তানকে প্রথমবারের মতো দেখে আবেগে আপ্লুত হলেন প্রতিমা দেবী। হামিদ তখনও জানেনা মহিলাটি কে তবে এটা জানে মহিলাটি তাকে খুব ভালোবাসে। কিছুটা দুরেই দাঁড়িয়ে আছে হামিদের চেয়ে বয়েসে একটু বড় আরেকটা ছেলে। নাজিমুদ্দিনকে বাজান সম্মোধন করছে সে। হামিদের রাগ হলো, অন্য একটা ছেলে কেনো তার বাবাকে বাজান ডাকবে? হামিদ এইটা মানতে পারছেনা কিছুতেই। হামিদ ইচ্ছে করে গিয়ে ছেলেটার সামনে গিয়ে বারবার বলতে লাগলো এইটা তার বাবা। ছেলেটা ছোট হলেও তার বুঝতে অসুবিধা হয়নি হামিদ নাজিমুদ্দিনের অন্য আরেক ছেলে। প্রচন্ড হতাশ হলো সে। মুখ চেপে কান্না শুরু করলো। প্রতিমা দেবী এলেন তার কান্না থামানোর জন্য কিন্তু সেটা থামলো না। নাজিমুদ্দিন কোনোমতে বুঝিয়ে ছেলেটাকে থামালেও মনের মাঝে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি তার। বাসায় ফিরেই সবটা জানিয়ে দেয় তার মাকে। এতদিন সে দেখে এসেছে কত কষ্ট নিয়ে তার মা বেঁচে আছে। বাবা একদিন আসে তো ছয়মাস আসেনা। কোনোরকম হাতখরচও দেয়না। অন্যের বাসায় কাজ করে মা সংসার চালাতো। সেদিন থেকেই হিমেল নিজ মনে দৃঢ় সংকল্প করে সে মায়ের জন্য কিছু একটা করবে। হিমেলের মা চলে আসে হিমেলকে নিয়ে অনেকটা দূরে, নাজিমুদ্দিনের নাগালের বাইরে।

অপরদিকে, প্রতিমার সাথে হামিদের পরিচয় করানো হয় ফুপি হিসেবে। চৌদ্দ বছরের হামিদের মাথায় প্রশ্ন আসেনি কেনো সে ভিন্ন ধর্মের? বড় হওয়ার পর মাথায় বেশ কয়েকবার প্রশ্নটা আসলেও মাথা ঘামায়নি সে। নাজিমুদ্দিনের সকল রহস্য সে জানতে পেরেছিলো তাকে খু*নের দিন। আট বছর আগে হামিদের সাথে তাদের প্রথম দেখা হলেও দ্বিতীয়বার দেখা হয় পাঁচ বছর আগে এবং তৃতীয়বার দেখা হয় মাত্র ছয়মাস মাসে। নাজিমুদ্দিনকে খু*নের মাত্র কিছুদিন আগে। সেখান থেকেই সমস্ত পরিকল্পনা করে হিমেল, সাজিদ ওরফে সিফাতের অগোচরে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে হামিদ এবং হিমেল তখনও জানতো না নাজিমুদ্দিন ব্রাহ্মণ।
ঘটনাটি ঘটেছিলো প্রায় মাস ছয়েক আগে। সাজিদের সাথে তখন দেখা হয়নি হামিদের। দেখা হয়েছিলো কেবল হিমেলের সাথে। সেখানেই হামিদ জানতে পারে নাজিমুদ্দিন সম্পর্কে তার বিদ্বেষ। হামিদও চারুর সাথে হওয়া সকল অন্যায় হিমেলকে জানায় যতটা সে জানতো। হামিদ এবং হিমেল দুজনে মিলে ঠিক করবে তারা নাজিমুদ্দিনের ওপর প্রতিশোধ নেবে কিন্তু হামিদ শর্ত জুড়ে দেয় চারুকে বাঁচাতে হবে হিমেলের। চারুর কোনোপ্রকার ক্ষতি হামিদ হতে দেবেনা। এরজন্য নতুন এক পরিকল্পনা করে সাজিদের সাথে মিলে যায় তারা।

সিফাত ছোটবেলা থেকেই ছিলো ভবঘুরে ছেলে। পেশায় তার মনোযোগ ছিলোনা কিন্তু তবুও ভাইয়ের সাথে মিলে পুলিশে জয়েন করেছিলো। ঘুরতে ঘুরতে একপর্যায়ে সে পৌছেছিলো চারুদের গ্রামে। সেখানেই চারুকে প্রথমবারের মতো দেখে সে। সিফাত ভবঘুরে হলেও ছিলো তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন। নাজিমুদ্দিনকে তার সন্দেহ হলে সে খুব দ্রুতই বুঝতে পারে সে এই মেয়েটাকে নিয়ে কিছু ষড়যন্ত্র করছে কিন্তু সে কিছু করার আগেই নাজিমুদ্দিন সেটা টের পেয়ে যায় এবং কৌশলে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সিফাত ভবঘুরে হওয়ায় চারুকে নিয়ে অত্যাধিক চিন্তা সে করেনি তবে হামিদকে জানিয়ে দিয়ে আসে চারুর সাথে কিছু একটা করতে চায় নাজিমুদ্দিন। সেসময়টাতে হামিদও চারুর খেয়াল তেমন রাখতো না। তাই ব্যাপারটা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি।
হামিদের যখন মনে পড়লো, সিফাত তাকে সতর্ক করেছিলো চারুর সম্পর্কে তখন হামিদ আবারও হিমেলকে নিয়ে ছুটে গেলো সিফাতের কাছে কিন্তু বাসায় পৌঁছেই তারা জানতে পারলো সিফাত মা*রা গেছে। অতঃপর বাধ্য হয়ে সাজিদের সাথেই কথা বলে তারা। সাজিদ আগে থেকেই সব জানতো কারণ রোড এক্সিডেন্টে সেদিন সিফাত নয়, সাজিদ মা*রা গিয়েছিলো। আর সিফাতই সাজিদের পরিচয়ে সেখানে অবস্থান করছিলো।
ততদিনে সিফাত বদলে যায় সম্পূর্ণ। ভবঘুরে হয়ে থাকা ছেড়ে দিয়ে সাজিদের মতোই কাজে সিরিয়াস হয়। কাউকে বুঝতে দিতে চলবেনা সেই সিফাত। এই কারণে হামিদও জানতে পারেনি সাজিদ আসলে সাজিদ নয়। সে তারই জমজ ভাই সিফাত। হামিদ তাকে সকল কথা খুলে বললেও সে প্রথমে রাজি হতে চায়না কারণ এইসব আইনের ঘোর বিরোধী কিন্তু হামিদের এত অনুরোধ ফেলতে পারেনা সে। তৈরি হয় নতুন এক ইতিহাসের

★★★

– তারমানে তুমি নাজিমুদ্দিন সম্পর্কে কিছুই জানতে না? শুধু জানতে তার আরো বিয়ে আছে।
– হুম কিন্তু এতগুলা আছে তা জানতাম না।
– বস কে?
– আমি ক্যামনে জানমু?
– তাহলে তার পিছু করা ছেড়ে দিতে বললে কেনো?
– সে তো আর কোনো ঝামেলা করতাছেনা তাই বলছি।
– পরে করবেনা তার কি গ্যারান্টি?
– আমরা তো আছি চারু।
– তোমাদের আর আমি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করিনা। যাকগে বাদ দাও, এখন বলো এইসব কেনো করলে?
– আমরা সবাই তোরে একটা স্বাভাবিক জীবন দিতে চাইছিলাম।
– আমাকে স্বাভাবিক জীবন দিতে গিয়ে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক বানিয়ে দিলে তাই তো? আমি যদি সঠিক হই আপনি আমাকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেননি তাই না সাজিদ?
– বিয়েটা দায়বদ্ধতা থেকে করলেও বিয়ের পরে আমি সত্যি আপনাকে ভালোবেসেছি বেলিফুল। বিশ্বাস করুন।
– করলাম না। প্রতিমা দেবী সব জানতেন?
– না। উনি শুধু জানতেন দুর্ঘটনায় নাজিমুদ্দিন আর সারদা দেবী মারা যান আর আপনারা একা হয়ে গেছেন। আমরা তাকে যতটুকু করতে বলেছিলাম তিনি ততটুকুই করছেন। আর এর বিনিময়ে চেয়েছিলেন আমি যেনো তার দিদির মেয়েকে বিয়ে করে নেই। তিনি জানতেন না তুমি সারদা দেবীর মেয়ে নও। তোমাদের সারদা দেবীর সন্তান মনে করেই তিনি তোমাদের ভালোবাসেন।
– আমি সেদিন ড্রইংরুমে আপনাদের যেই কথপোকথন শুনেছিলাম সেটাও সাজানো ছিলো?
– বিয়ের ব্যাপারে রাজি না হওয়া?
– হুম।
– হ্যাঁ সেটা সাজানো ছিলো।
– সবাই শুরু থেকে সব জানতো কেবল আমিই জানতাম না।
– আমি চারুলতা, আমি প্রথমে তোমাকে চিনিনি। একদিন ব্যস আমি তোমাকে কেইসটা নিয়ে বাসায় ঘাটাঘাটি করি, সেদিনই জানি হামিদ তোমার ভাই আর তুমি সেই চারুলতা যাকে আমার বাঁচতে হবে। হামিদ আমাকে সব বলেছিলো ঠিকই কিন্তু তোমার কোনো ছবি আমাকে দেয়নি এবং পরবর্তীতে আমাদের যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। (হিমেল)
– সাজিদ ওরফে সিফাত প্রথমেই সব জানতেন?
– হুম। এমনকি আমিই আপনাকে আমার খোজ দিয়েছিলাম যা আপনি বুঝতে পারেননি।
– নাম কেনো বদলালেন?
– নাম আমি আপনি জন্য বদলাইনি চারুলতা। এইটা সম্পূর্ণই আমার নিজস্ব কারণে বদলেছিলাম। আমার বাবা সায়মার সাথে সাজিদের বিয়ে ঠিক করায় তাদের বিয়েটা হয়। সম্পত্তির জন্য সায়মা সাজিদকে খু*ন করতে চায় এবং সে সম্পদ নিয়ে সে হোসেনের সাথে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলো তাই সাজিদের গাড়ির ব্রেক ফেইল করিয়ে দেয়। সেদিন দুষ্টুমি করে আমি আর সাজিদ প্ল্যান করি প্রতিমা আন্টিকে বোকা বানাবো তাই আমি সাজিদের পোশাক পড়ি আর সাজিদ আমার পোশাক। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। গাড়ি ব্রেক ফেইল হয়ে খাদে পড়ে গেলো। আমি কোনোমতে বেঁচে গেলেও সাজিদ বাঁচলো না। আমার পরনে সাজিদের পোশাক থাকার সকলে ভেবে নেয় আমার অর্থাৎ সিফাতের মৃ*ত্যু হয়েছে আর সাজিদ বেঁচে আছে। সায়মাও তাই মনে করে। ততদিনে আমি সায়মা সম্পর্কে সব জানতে পারি এবং নিজের সম্পূর্ণ পরিচয় লুকিয়ে আমার নতুন পরিচয় হয় আমি সাজিদ। এরপরই সায়মার সাথে আমার ডিভোর্স হয়। এইটা অবশ্য ডিভোর্স ছিলোই না কারণ সায়মার সাথে আমার নয় সাজিদের বিয়ে হয়েছিলো। ব্যাস তারপর থেকে সাজিদের হয়ে আমি পুতুলকে মানুষ করছি। আমি ছাড়া আর কেউ এই সত্য জানতো না এমনকি প্রতিমা আন্টিও না।
– আপনারা সকলেই বিশ্বাসঘাতক! বেড়িয়ে যান ঘর থেকে। আমাকে একা থাকতে দিন।
কেউই বের হলো না। হামিদ বলে উঠলো,
– তুই কি চাস চারু?
– আমি যা চাই তা আমি নিজেই করে নিতে পারবো। কোনো বিশ্বাসঘাতকের সহায়তা আমার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া তোমরাও তো চাও আমি বসকে না খুজি। এমন হলে আমার তোমাদের প্রয়োজন নেই।
– চারু আমি,,,
– পুলিশ অফিসার সীমা কে? তার কি রহস্য?
– তার কোন রহস্য নেই। সে সাধারণ এক পুলিশ অফিসার। কিছুদিনের মাঝেই তার ট্রান্সফার হতো। সে সবটা জানলেও কোনো সমস্যা ছিলোনা কারণ সে এই কেইসটার তত্ত্বাবধানে থাকবেনা।
– তোমরা সবাই এখন নিজেদের মতো থাকো আর আমাকে আমার কাজ একাই করতে দাও৷ আমার আর কাউকে প্রয়োজন নেই।
– কি করতে চাস তুই?
– তোমরা ইচ্ছে করেই কেইসটা সমাধান করোনি আমি জানি। আমার কেইসের সমাধান আমিই করবো।
– কি করবি তুই?
– যেখানে সব শেষ হয়েছিলো সেখানেই আবার সব শুরু করবো। আমি গ্রামে ফিরে যাবো। সেখানেই খুজবো ঘাতককে।
– আমিও তোর সাথে যামু।
– তুমি ভাবলে কিভাবে আমি তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাবো?

★★★

অফিসে বসে কাজ করছিলো শিহাব। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে উন্নত দেশে। কিছুদিনের মাঝেই নতুন ধরনের কিছু পোশাক শিহাব বাইরের দেশে রপ্তানি করবে। যার জন্য তড়িঘড়ি করে শিহাব শহরে এসেছিলো তাকে পায়নি সে। সে নাকি অন্য এক কাজে রাজশাহী আছে। আসতে এক সপ্তাহের মতো লেগে যাবে৷ অপেক্ষা ছাড়া কিছুই করার নেই শিহাবের। সে নতুন তৈরি করা পোশাকের ডিজাইনগুলো দেখছিলো। এমন সময়েই কেবিনে নক হয়। শিহাব ভেতরে আসার অনুমতি দিলে ঘরে প্রবেশ করে সুহাসিনী।
– তুমি? এখানে কি চাই?
– চলে এলাম আপনার সাথে দেখা করতে। এখন থেকে প্রায়ই আসবো।
– কেনো?
– যেনো আপনি আমাকে প্রতিদিন দেখেন আর আমার জন্য আপনার মনে মায়ার সৃষ্টি হয়।
শিহাব ভ্রুকুঞ্চন করে তাকালো সুহাসিনীর দিকে কিন্তু প্রত্যুত্তরে মেয়েটি কেবল মিষ্টি করে হাসলো।
– এইসব কি ছেলেমানুষী করছো তুমি?
– ছেলেমানুষী আমি নই আপনি করছেন। যাকে কোনোদিন পাবেন না তাকে কেনো ভালোবাসেন? যাকে পেতে চলেছেন তাকে ভালোবাসুন।
– তুমি বুঝবেনা সুহাসিনী। জোর করে অন্তত ভালোবাসা হয়না।
– হবে। এখন থেকেই হবে। আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে জানেন তো?
– হুম জানি।
– তারমানে আমি এখন আপনার হবু বউ। আমাকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আসুন।
– আমি বিজি আছি সুহাসিনী। তুমি এখন যাও।
– না যাবোনা।
সুহাসিনী একপ্রকার জোর করেই জড়িয়ে ধরলো শিহাবকে।
– আমি আপনাকে ভালোবাসি শিহাব। খুব ভালোবাসি। আপনি কেনো আমাকে বোঝেন না? একতরফা ভালোবাসা এতটা কেনো কষ্ট দেয় শিহাব? কেনো ভুলতে পারিনা আপনাকে? কেনো আপনি আমাকে ভালোবাসেননা জেনেও আমার মন শুধু আপনাকেই চায়।
শিহাব নিরুত্তর রইলো। এইসব প্রশ্নের উত্তর সে নিজেও জানেনা। পাঁচটা বছর ধরে সেও তো কাউকে একতরফা ভালোবেসে এসেছে। সুহাসিনী মেয়েটা তাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। তার কি উচিত হবে জীবনকে আরো একটা সুযোগ দেওয়া? হয়তো হবে, জীবন তো একটাই। একটা মাত্র জীবনকে শুধুমাত্র একটা মেয়ের জন্য পার হয়ে দেওয়া বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। শিহাবের মস্তিষ্ক কথাটা বিশ্বাস করলেও মন যেনো কিছুতেই মানতে চায়না।
– এতটা পাষাণ কেনো হচ্ছেন শিহাব? আমি জড়িয়ে ধরেছি আপনাকে। আপনিও আমাকে ধরুন। প্লিজ!
শিহাব জড়িয়ে ধরেনা সুহাসিনীকে তবে সিদ্ধান্ত নিলো সত্যিই সে বিয়ে করবে সুহাসিনীকে। একতরফা ভালোবাসার কষ্ট সে জানে। একটা মেয়েকে আর কত কষ্ট দেবে সে? সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে নিজের জীবন গুছিয়ে নেওয়ার।

★★★

অভিকে একপ্রকার টেনে হিচরে জোর করে আইসক্রিম পার্লারে নিয়ে এসেছে স্মৃতি। ছেলেটা কোথাও যেতে চায়না। কোথাও গেলেই তার মনে হয়, এতগুলো গার্লফ্রেন্ডের মাঝে কেউ একজন দেখে নিতে পারে। আজ স্মৃতির জোড়াজুড়িতে একপ্রকার বাধ্য হয়ে বের হতে হলো তাকে। আইসক্রিম নিয়ে একটা পার্কে ঢুকলো তারা।
– অভি!
– বলো।
– পরিবেশটা কেমন?
– ভালোই তবে কেউ আমাকে দেখলে,,,
– উফ! কেউ দেখবেনা তোমাকে। এইটা কাপল পার্ক। যদি কেউ দেখে তাহলে তার ভিতরেও ঘাপলা আছে। সে কেনো বয়ফ্রেন্ড ছাড়া কাপল পার্কে এলো?
– তা অবশ্য ঠিক বলেছো।
– মেয়েগুলোর ফ্লাইট আজ রাত নয়টায়?
– হুম।
– কি অদ্ভুত!
– এখানে অদ্ভুতের কিছু নেই স্মৃতি। আসলে তুমি সবটা জানোনা তাই তোমার কাছে ব্যাপারটা এইখানেই অদ্ভুত লাগছে।
– আবার কি লুকিয়েছো আমার কাছে?
– ঠিক লুকাইনি তবে তোমাকে জানানো হয়নি। এই মেয়েদের প্রস্টিটিউড হিসেবে পাঠানো হচ্ছেনা।
– মানে? তবে কেনো?
– মেয়েদের পাচার করলে যতটা না টাকা পাওয়া যায় তার চেয়ে বেশি টাকা পাওয়া যায়, সাইন্টিস্টদের কাছে বিক্রি করলে। তারা বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষা করে তাদের উপর যা তাদের দেশের সরকার নিষেধ করে দিয়েছে। এই ধরনের পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় মানুষের আর আমরা বেশ কয়েকবার সেই ধরনের মেয়ে পাচার করেছি। তাদের বৈধ লাইসেন্স প্রয়োজন নেই তবে তারা হিপ্নোটাইজ নিয়ে গবেষণা করছে। মেয়েগুলো দেখে একবারও মনে হবেনা তারা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। তারা একটু বেশি রিস্ক নিয়ে মেয়েদের নিতে চাইছে।
– তাহলে চারুলতাকে কেনো ওখানে পাঠাচ্ছো?
– তারা সুন্দর মানুষ এবং কুৎসিত মানুষের মাঝে একটা পরীক্ষা করবে। দুইজনের জন্যই বেশ ভালো এমাউন্ট পাওয়া যাবে। তুমি ভাবতেও পারোনা এত টাকা!
– না তুমি চারুলতাকে সেখানে দেবেনা। ওর যখন এত রূপের দেমাক যখন তার অবস্থান হওয়া উচিত পতিতা পল্লিতে।
– রুপের দেমাক তার নয় স্মৃতি। তুমি ওর সৌন্দর্যকে হিংসে করো। অবশ্য এতে তোমার দোষ নেই। সুন্দরী মেয়েরা তাদের চেয়ে অধিক সুন্দরীদের হিংসে করেই থাকে।
– তারমানে তুমি আমার কথা মানছো না?
– না। এমন বেকুবের কথা মেনে আমি এতগুলো টাকা হাতছাড়া করতে চাইনা।
– তুমি আমাকে বেকুব বললে?
স্মৃতি মুখ ফুলালো। অভির ভিতরটা হঠাৎই কেমন করে উঠলো। আজকাল এই মেয়েটার প্রতি অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে সে। না এমনটা হওয়ায় যাবে। অভির ভাবনার ঘোর কাটে ফোনের আওয়াজে,
– হ্যাঁ বলো।
– বস চারুলতাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা।
– হোয়াট? পাওয়া যাচ্ছেনা মানে?
– পুলিশের বাড়িতে তালা দেওয়া। ভেতরে কেউ নেই। হামিদের বাড়িও খালি। কোথাও কেউ নেই।
– কোথায় গেছে?
– জানিনা বস।
– শু*য়োরের বাচ্চা, তোদের বলেছিলাম না ওর দিকে নজর রাখবি? তোদের খু*ন করে ফেলবো আমি। যেখান থেকে পারিস, এখন একটা মেয়ে জোগাড় করবি। রাত আটটার মধ্যে মেয়েটা আমার চাই।
– কি হয়েছে অভি?
স্মৃতির কথার জবাব না দিয়ে ফোনটা দূরে ছুড়ে ফেললো অভি।

বিঃদ্রঃ গল্পটা কেনো ভালো লাগছেনা কারণটা জানতে চাইছি। হ্যাঁ আমি মেনে নিচ্ছি গল্পটাতে একটু প্যাচ লেগে যাচ্ছে আমি সাজাতে পারছিনা। ১৬ তারিখ আমার পরীক্ষা তাই আমি কাভার তেমন করতে পারছিনা। এইটা ছাড়া অন্যান্য কারণ গুলো জানান। আর গল্পটা আপনারাও মনোযোগ দিয়ে পড়ছেননা। মনোযোগ সহকারে না পড়লে বুঝবেন না সেইটা স্বাভাবিক। যাদের যে বিষয় নিয়ে সমস্যা তা বলে ফেলুন। স্লভ করবো আজকে। সকলের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। আর নিতান্তই ভালো না লাগলে দুই পর্বের মাঝেই শেষ করে দেবো। অবশ্য আমার ভেবে রাখা অনেক কিছুই এতে স্কিপ হবে। তবে আপনাদের অসুবিধা হবেনা।

_______________________

To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ৩৮
_______________________

মিলির চোখের সামনে রয়েছে তার নগ্ন ছবি। ছবিটি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো সে। মিলি নিশ্চিত এমন কোন ছবিতে সে নেই। আর সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় ছবিগুলো সেন্ড করেছে অভি। অভির সাথে তার এখনো এমন কোনো সম্পর্ক হয়ে ওঠেনি, অভির বাবাবার জোড়াজুড়ির পরেও না। এরজন্য কয়েকবার বিচ্ছেদ হলেও মিলি কখনোই রাজি হয়নি। তবে এই ছবি? তবে অভি কি তাকে ধোকা দিলো? মিলি হন্তদন্ত হয়ে ফোন লাগালো অভিকে। বেশিক্ষণ সময় লাগলো না ফোনটা তুলতে।
– কেমন আছো বেবস? সব ঠিকঠাক তো?
– অভি তুমি! তুমি ওই ছবিটা কোথায় পেলে? আমার সরলতার এমন সুযোগ নিলে তুমি?
– শাট আপ মিলি। আমি কেনো তোমার সরলতার সুযোগ নেবো? তুমিই তো ছবিটা তুলে আমাকে পাঠিয়েছো।
– মিথ্যা বলবেনা অভি।
– মিথ্যা কেনো বলবো বলো তো? আচ্ছা তুমি আগে ছবিটা ভালোভাবে দেখো। দেখো ছবিটা তুমি নিজে তুলেছো।
মিলি স্তব্ধ হয়ে আবার লক্ষ্য করে ছবিটা সত্যিই তার হাতে তোলা। এমনকি ছবিটি নকলও নয়।
– কি হলো বেবস? দেখেছো?
– এখনই ছবি ডিলিট করো অভি।
– কেনো করবো? আমার যদি তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হয় তবে আমি এই ছবিটি দেখবো।
– একদম বাজে বকবেনা। ছবিটি ডিলিট করবে কি না বলো?
– আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি এসে করে দিয়ে যাও।
– কোথায় আসবো?
– বাসায় চলে এসো।
মিলি সম্মতি জানিয়ে ফোন রেখে দিতেই হাসিতে গড়িয়ে পড়লো অভি এবং স্মৃতি।
– এই বোকা মেয়ের সাথে তুমি প্রেম করছো জেনেই আমার হাসি পাচ্ছে অভি।
– বাদ দাও। এতগুলো মেয়ে থাকতে তুমি মিলিকে টার্গেট করলে কেনো?
– সোনার রাজ্যে এক রানীই মানানসই।

অভির বাড়িতে যেতে হলে কিছু গলি ক্রস করতে হয়। গলি গুলো অতিরিক্ত নিরব। কাক পক্ষীও সেখান দিয়ে উড়ে যায়না। প্রতিবার অভিই এসে তাকে নিয়ে যায় তবে আজ সে আসেনি। মিলি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলো গলিটার ভেতর। গলির ভেতর দুজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মিলি হকচকিয়ে গেলো। ছেলেগুলো মিলিকে দেখেই বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে বললো,
– আপনিই মিলি?
মিলি কোনো জবাব দিলো না। কে জানে এই লোকগুলো তার নাম জানলো কিভাবে?
– আসেন আমাদের সাথে। আমাদেরই আপনাকে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
– আমি একাই যেতে পারবো।
– আরে আসেন তো।
দুজনেই একপ্রকার মিলির হাত ধরে টানাটানি শুরু করলো। মিলি হাজার চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারছেনা। বেশ জোরে জোরে চিৎকার করলেও কেউ এলোনা। ব্যাপারটা স্বাভাবিক, এখানে কেউই আসেনা। তারা একপ্রকার জোর করেই মিলিকে নিয়ে যেতে চাইলো নিজেদের গাড়িতে কিন্তু এমন সময়েই একটি মেয়ে মোটা গাছের ডাল নিয়ে আঘাত করলো একজনের মাথায়। সে অজ্ঞান না হলেও মাথা থেকে র*ক্তক্ষরণ শুরু হলো। মিলি অবাক বিষ্ময়ে খেয়াল করলো মেয়েটি সুহাসিনী। সুহাসিনী এখানে কি করছে?

★★★

শিহাব এখনো সেই ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছে। চারুলতার ষড়যন্ত্রকারী বোধহয় সে-ই কিন্তু শিহাবের মন মানতে চায়না। একটা মানুষ এত নিখুঁত অভিনয় কিভাবে করে আর তার কথা নাহয় বাদই দেওয়া যায় কিন্তু তার পাশে যে আরো একজন আছে তার কি হবে? ও চারুর কোনো ক্ষতি করতে পারে এইটা শিহাব কল্পনাতেও আনতে পারেনা তবে কোনো উত্তর নেই। রাজশাহীতে আছে এখন সে। শিহাব কয়েকজনকে পাঠিয়েছে রাজশাহী থেকে তাকে নিয়ে আসতে। শিহাবের কাজের প্রয়োজন নেই, স্বর্ণলতার জীবন তার কাছে অধিক মূল্যবান। সময় কোনোভাবে কাটছেনা বিধায় মাইন্ড ডায়ভার্ট করার জন্য শিহাব অফিসে এসে বসেছে তবে এখানেও জ্বালাতন করছে সুহাসিনী নামের মেয়েটি। সুহাসিনীর কথা ভাবতেই সুহাসিনী জাদুর মতো শিহাবের কেবিনে উপস্থিত হয়ে গেলো, শিহাব কিছুটা চমকে গেলেও সুহাসিনীকে বুঝতে দিলোনা।
– চলুন না শিহাব।
– কোথায় যাবো?
– কোথাও থেকে ঘুরে আসি।
– এখন সম্ভব নয় সুহাসিনী। তুমি প্লিজ চলে যাও।
– যাচ্ছিনা।
– তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?
– করুন।
– ধরো, তোমার এক আপন মানুষ তোমার ভালোবাসার মানুষটির ক্ষতি করতে চায়। তুমি কি করবে সুহাসিনী?
– হঠাৎ এমন প্রশ্ন?
– এমনি।
– কোনো কারণ ছাড়া একজন আরেকজনের কোনো ক্ষতি করেনা শিহাব। আমি সেই কারণটা উদঘাটন করবো। যে দোষী হবে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবো।
কারণ? আসলেই কি কোনো কারণ আছে এর পেছনে? দোষ তবে কার? চারুলতা বাচ্চা একটা মেয়ে। প্রতিবাদী মনোভাবের হলেও সহজ সরল। তার কি আদেও কোনো দোষ থাকতে পারে? সে সবচেয়ে বড় দোষ করেছে শিহাবের সাথে। বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও সে পায়নি স্বর্ণলতাকে। কিন্তু স্বর্ণলতার আর কোনো দোষ থাকা পারে তা মানতে শিহাব নারাজ।
– আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি শিহাব। এইবার চলুন ঘুরে আসি। ঘুরে আসলে মন ভালো হবে।
– আমি স্বর্ণলতাকে ভালোবাসি সুহাসিনী।
– বিয়ের পর আমাকেও বাসবেন।
– আমি পারছিনা সুহাসিনী। নিজের সাথে কত যুদ্ধ করা যায়?
– একবার আপন করেই দেখুন না শিহাব। ভালোবাসার খামতি রাখবোনা আমি।
– এত ভালোবেসেও তো ভালোবাসা পাচ্ছোনা সুহাসিনী। তবে কেনো ভালোবাসো?
– আপনি কেনো স্বর্ণলতাকে ভালোবাসেন?
– উত্তর নেই।
– আমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করা যায়না শিহাব?
– আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
– তাহলে চলুন ঘুরে আসি। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরবো। যেখানে দুচোখ যায়।
শিহাব আর মানা করলো না। দেখা যাক, ওর সাথে কোথাও গেলে স্বর্ণলতার পোকাটা মাথা থেকে বের হয় কি না! এই কষ্টের জীবন আর নিতে পারছেনা সে।

ঘুরতে ঘুরতে একটা পর্যায়ে সুহাসিনী ক্লান্ত হয়ে যায় বিধায় শিহাব গিয়েছিলো পানি আনতে। তখনই সুহাসিনী নারী কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পায়। কণ্ঠস্বর চেনা লাগতেই সেখানে এগিয়ে যায় সে। সেখানে গিয়েই সে দেখতে পেলো মিলির সাথে দুজন মানুষের ধস্তাধস্তি চলছে। সুহাসিনী কোনোমত একটা গাছের ঢাল জোগাড় করে লোকটার মাথায় মারলেও সে অজ্ঞান হলোনা। ক্ষিপ্র গতিতে সে সুহাসিনীকেও আঘাত করতে যাবে এমন সময়েই চলে আসে শিহাব। শিহাব লোক দুটোকে চেনে, তারাও খুব ভালো করেই চেনে শিহাবকে তাই তারা ঝামেলা না করে দ্রুত মিলিকে ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে গেলো। শিহাব দ্রুত এগিয়ে গেলো মিলির দিকে।
– কি হয়েছে মিলি? তুই এখানে কেনো? আর ওরা তোর পেছনে লাগলোই বা কিভাবে?
– তুমি ওদের চেনো?
– বাদ দে। তুই এখানে কেনো?
মিলি উপায়ন্তর না পেয়ে অভির কথা খুলে বলে শিহাবকে। শিহাব অতিরিক্ত পরিমাণে রেগে গেলেও শান্ত থেকে মিলিকে বলে অভির সাথে দেখা করাতে। কিন্তু মিলি চমকে উঠে বললো,
– নাহ! ওর সাথে দেখা করা যাবেনা। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। ওর সাথে দেখা করা যাবেনা।
শিহাব অবাক হলো। কেনো দেখা করা যাবেনা অভির সাথে? কিসের এত উদ্বিগ্নতা তার?

বিঃদ্রঃ আমি সত্যিই খুব দুঃখিত এতদিন পর এইটুকু একটা পর্ব দেওয়ায়। পরীক্ষার মাঝেই ঠান্ডা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ি আমি। কোনোমতে পরীক্ষাটা দেই। ঔষধ খাচ্ছি তবে ভালো হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। আমি কথা দিয়েছিলাম ২১ তারিখ দেবো, তাই কথা রাখতে অসুস্থতার মাঝেই লিখলাম। রিচেকও হলোনা। কালকে ৩৮ পর্বের বর্ধিতাংশ দেবো। সবার কাছে আবারও দুঃখিত। আজকের পর্বটা একটু ভালো করে পড়বেন। কারণ বলছি না তবে এন্ডিং-এ কাজে দেবে। আর অনেকদিন পর লিখলাম। একটু রেসপন্স করবেন, যারা পায়নি তাদের পেতে সুবিধা হবে। সকলকে ধন্যবাদ।

____________________

To Be Continue
®️শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ৩৮(বর্ধিতাংশ)
_______________________

– গ্রামটা কি এহনো আগের মতো আছে নাকি রে চারু? এহনও এমন থাকলে মনে হয় মানায়া নিতে পারমু না। এতদিনে অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটছে।
চারু হামিদের কথার কোনো উত্তর দিলো না। হামিদ অনেকক্ষণ যাবত চেষ্টা করছে চারুর সাথে কথা বলার কিন্তু চারু এমনভাবে ওকে এড়িয়ে চলছে যেনো হামিদ বলে কেউ নেই। খুব বেশি হলে শুধু হু হা করে জবাব দিচ্ছে।
– চারু!
– কি চাই তোমার? বিরক্ত করছো কেনো আমাকে?
– তুই আমার সাথে কথা বলতাছস না ক্যান?
– তুমি আশা রাখো আমি তোমার সাথে কথা বলবো?
– ক্যান বলবি না? আমি কি করছি? আমি যা করছি সব তো তোর জন্যই করছি।
– আমার বিশ্বাস ভেঙেছো তুমি। বিশ্বাস গড়াটা অনেক কঠিন কাজ। অনেকটা সময় লাগে কিন্তু ভেঙে যাওয়াটা কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার।
– আমি তোর ভালো চাই, এইটাই কি আমার দোষ?
– আমার কাছে এত কিছু লুকিয়ে যাওয়া তোমার দোষ। তুমি চাইলে আজ আমার জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো।
– আমি তোর জীবনডা পরিবর্তন করতে চাইছি। সুস্থ পরিবর্তন! তহন রাগের মাথায় তোর সাথে মি’লা এতগুলা খু*ন করছি। কিন্তু রাগ ঠান্ডা হইয়া আসার পর বুঝছি এইটা ঠিক হয় নাই। অবশ্য তাদের খু*ন না করলে হয়তো আমি শান্ত হইতাম না। কিন্তু চারু দেখ, যা হওয়ার হইছে। তুই কি একবার নিজের জীবনটা গুছায়া নিতে পারস না?
– না পারিনা। আমার অপরাধীদের আমি শাস্তি না দিয়ে শান্ত হবোনা। তারা শুধু আমার শান্ত জীবনটা এলোমেলো করে দেয়নি বরং আমার আশেপাশে থাকা সবার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। তারা আমার মা-কে খু*ন করেছে। শাওন ভাইকে খু*ন করেছে। চারুলতার জীবন্ত হত্যার দায়ও তাদের। শিহাব আজও সঙ্গীহীন তাদেরই জন্য। তারা যদি প্ল্যান মাফিক আমার আর শিহাবের পরিচয় না ঘটাতো তবে আজ সে সুন্দর এক জীবন কাটাতো। নানু বাড়ির কেউ আজও জানেনা মা আর নেই। আদরের মেয়েকে তারা হারিয়েছে ওদেরই কারণে। কে জানে আর কত কত মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর কষ্টের কারণ তারা!
– ও বাড়িতে চিঠি পাঠাইছিলাম। উত্তর আসছে কালকে। তোরে জানানো হয় নাই।
– কি উত্তর এসেছে?
– নানাজানের অবস্থা আসলেই ভালা না। মৃ*ত্যুর দুয়ারে মনে হয় পৌছায়া গেছে। মরার আগে একবার মায়েরে দেখতে চায়। ভাবতাছি আর চিঠি লিখমু না। কি উত্তর লিখমু? লেখারও কিছু নাই।
চারু আর উত্তর দিলো না। হামিদ কয়েকবার চেষ্টা করেও চারুকে দিয়ে আর কিছু বলাতে পারলো না। হামিদ জানে চারু তার উপর রেগে নেই তবে বড্ড অভিমান! অভিমান তো কেবল ভালোবাসার মানুষদের সাথেই করা যায়। যার-তার সাথে অভিমান করা যায়না। চারু হামিদকে মন থেকে নিয়ে আসতে চায়নি তবে চারুর মনে পড়লো সেদিন মনোরমার বলা কথাটি। কোনো অবস্থাতেই হামিদকে অবিশ্বাস করতে বারন করেছিলো সে। মনোরমার কথাতেই মূলত চারু হামিদকে নিতে রাজি হয়েছে। সিফাত আর হিমেলও একপ্রকার চারুর অনুমতি ছাড়াই তার সাথে চলে গেছে। সিফাতের সাথে পুতুল আর হামিদের সাথে ফাতেমা আর লতা। সিফাতের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যাবহার করেই তারা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে।
– আমরা কোথায় যাচ্ছি মা?
পুতুলের ডাকে চারুর ভাবনার ঘোর কাটে। চারু শূন্য দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে পুতুলকে। পৃথিবীতে এই মেয়েটাই সম্ভবত একমাত্র মানুষ যে একমুহূর্তের জন্যেও ধোকা দেয়নি চারুকে। চারুর হঠাৎ আরো একটা কথা মনে পড়লো। মনোরমা বলেছিলো, একটা এতিম মেয়েকে বড় করার দায়িত্ব তার। তবে কি সেই মেয়েটা পুতুল? হতেও পারে। পুতুলের বাবা সাজিদ তো আর নেই। সিফাত রয়েছে সাজিদের পরিচয়ে। আর পুতুলের তো মা থেকেও নেই। যার মা-বাবা কোনোটাই নেই, সে তো এতিমই। তবে কি সেদিন পুতুলের কথাই মনোরমা বলেছিলো?
– ও মা! বলো না আমরা কোথায় যাচ্ছি?
– গ্রামে যাচ্ছি মা।
– গ্রামে কেনো যাচ্ছি?
– ঘুরতে যাচ্ছি।
পুতুল আর কথা বাড়ালো না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো সে।

চারুরা যখন গ্রামে পৌছালো তখন ভরদুপুর। সূর্য মাথার উপরে। হেমন্তকাল সন্নিকটে। ধান পাকতে শুরু করেছে। কৃষকেরা সে ধান কাটার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। ফসলি ক্ষেতে কাকতাড়ুয়া মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তবে আজকাল কাকেরা খুব বেশি বুদ্ধিমান হয়ে গেছে। তারা আর কাকতাড়ুয়া ভয় পায়না বরং নিজেই কাকতাড়ুয়ার উপর বসে খানিকক্ষণ জিড়িয়ে নেয়। অবশ্য পাখিদের মাঝে কাকই সবচেয়ে বুদ্ধিমান। প্রায় আধঘন্টা পথ পায়ে হেটে তারা বাড়িতে পৌছালো। গ্রামের এই আঁকাবাকা রাস্তায় হঠাৎই সিফাতের গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে যাওয়ায় এই দুরবস্থা! হামিদ হাটতে হাটতে একপ্রকার বিরক্ত হয়ে গেছে। এই গ্রামে আজও কোনো উন্নত প্রযুক্তি দেখা পাওয়া যাচ্ছেনা। গাড়ি তো দূর একটা গরুর গাড়িও পাওয়া যাচ্ছেনা। অথচ আগে এই গ্রামেই হামিদ ঘন্টার পর ঘন্টা দৌড়াদৌড়ি করেও ক্লান্ত হতোনা। শহরের হাওয়া গায়ে লেগে এই অবস্থা।
– চারু!
চারু ডাকটা শুনলেও প্রতিউত্তর করলোনা। হামিদ অবশ্য এতে কিছু মনে করলো না।
– চারু গ্রামে কি এহনো বিদুৎ আসে নাই? গরমে ক্যামনে থাকমু?
– আগে কিভাবে থাকতে?
– আগে তো অভ্যাস হইয়া গেছিলো। ছয় বছর পার হইলো এহনো বিদুৎ আসে নাই?
– জানি না। আসতেও পারে। বাসায় গিয়েই জানা যাবে।
– হাটতে হাটতে তো পা ব্যাথা হইয়া যাইতাছে। বাচ্চা দুইটারও কত কষ্ট হইতাছে দেখ।
– ঢং কমিয়ে করো। বাচ্চারা দুজনেই কোলে আছে। মাত্র আধাঘন্টা হেটেই এই অবস্থা। পেটের ভুড়িও বেড়েছে। হাটাহাটি না করলে যা হয়।
– আমি তো তাও হাটতাছি, হিমেল আর সিফাত ভাইয়েরে দেখ। তারা এহনো কত পিছনে। ফাতেমা গ্রামের মাইয়া বইলা তাল মিলাইতে পারতাছে।
– ভাবির গ্রাম কোথায়?
– জানিনা। শহরে যাওনের পর পরিচয় হইছে আমাদের। তোরে কইছিলাম না?
চারু উত্তর দেয়না। আরো দশ মিনিটের মতো হেটে সকলেই বাড়ি পৌছালো। বাড়ির অবস্থা যাচ্ছেতাই। কে জানে কতদিন যাবত এখানে কেউ প্রবেশ করেনা!

★★★

অভির সামনে পড়ে আছে মিলিকে কিডন্যাপ করতে যাওয়া লোক দুটির লা’শ। এদের উপরই চারুকে নজরে রাখার দায়িত্ব ছিলো। অভি এত কষ্ট করে একেকটা প্ল্যান করে আর এই গর্দভ দুটো সব প্ল্যান ভেস্তে দেয়। অভি রাগ সামলাতে না পেরে গু*লি করে দিয়েছে দুজনকেই।
– স্মৃতি!
– বলো।
– মেক আপ বাদ দিয়ে এদের লা’শ সরাও। আর এদের দুজনের বাড়িতে এক লাখ করে টাকা সহ লা’শটা পাঠিয়ে দাও।
– টাকা কেনো?
– এরা এদের পরিবারের একমাত্র আর্নিং মেম্বার।
– তাতে তোমার কি? লা*শ গুম করে দেবো কেউ খুজেও পাবেনা। শুধু শুধু বাড়িতে লা*শ পাঠিয়ে, টাকা দিয়ে ঝামেলা করার কি মানে?
– আমি ব্যাখা দিতে পছন্দ করিনা স্মৃতি। যতটুকু করতে বলছি ততটুকু করো। ভুলে যেওনা তুমি শুধুই আমার একজন ওয়ার্কার। অন্য পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই। তোমাকে আমি বিশেষ জায়গা দিয়েছি বলে এই না যে তুমি আমার কাজে হস্তক্ষেপ করবে।
– আমি কি সত্যিই বিশেষ নই অভি?
– না। তুমি শুধুমাত্র আমার একজন ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছো ঠিকই কিন্তু নিজের সীমা অতিক্রমের চেষ্টা করো না।
– বুঝেছি।
স্মৃতি মুখ কালো করে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। অভির হঠাৎই কেনো যেনো মনে হলো, এই মেয়েটা সাধারণ নয়। একটু বিশেষত্ব আছে তার মাঝে।

– কোথায় আছো তুমি?
– সেটা জেনে আপনার কি কাজ? কেনো ফোন করেছেন সেইটা বলুন।
– তুমি দিন দিন অভদ্রতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাচ্ছো। ভুলে যেও না আমি তোমার বাবা।
– আপনি আমার বাবা নন। আপনিও জানেন আর আমিও জানি। তাই আমার কাছে ভদ্রতা আশা করবেন না। আপনিই তো বলেন আমি পৃথিবীর জঘন্যতম মানুষদের মধ্যে একজন তবে আমার কাছে আপনি ভদ্রতা আশা করেন কোন যুক্তিতে?
– বাজে কথা বলোনা। তুমি আমারই ছেলে। আমার রক্ত তোমার শরীরে বইছে।
– আপনার রক্ত আমার শরীরে আছেন মানেই আপনি আমার বাবা হয়ে যাননি। আমার না আছে কোনো বাবা, না আছে মা। আমি শুধুই এক,,
অভির গলা ধরে আসে। প্রচন্ড অভিমান তার ভেতর। ফোন কেটে দিয়ে নিজেকে সামলে নিলো দ্রুত। শপিং মলে ঢুকতেই রাজ্যের মানুষজন চোখে পড়লো তার। মিলির জন্য একটা শাড়ি কেনা প্রয়োজন। মেয়েটা প্রচন্ড রেগে আছে। যতদিন ও আছে ততদিন ওকে কাজে লাগাতে হবে। শাড়ির দোকানে গিয়ে খুব সহজেই শাড়ি পছন্দ করে নিলো অভি। মিলির পছন্দ সম্পর্কে সে অবগত৷ শাড়ি কিনে বাড়ি ফিরে যাবে এমন সময়েই অভি একটা জায়গায় বেশ ছোটখাটো জটলা দেখতে পেলো৷ ভীড় ঠেলে সামনে যেতেই দেখতে পেলো একটা বাচ্চা মেয়ে খেলার ছলে গাছের মগডালে উঠেছিলো কিন্তু এখন সে নামতে পারছেনা। গাছটার ঢালও খুব সরু। বড় কেউ উঠতে গেলেই সেটা ভেঙে যাবে। বাচ্চাটা সমানে কেদে যাচ্ছে নীচে নামার জন্য কিন্তু তার সাহসে কুলাচ্ছে না। অভি একবার নিজের দিকে তাকালো। বয়স এইবার ২৫ হলো তার। দেখতেও হ্যাংলা পাতলা। ওজন মাত্র ৫৯ কেজি। ৫.১১ উচ্চতার এই ছেলের জন্য তার ওজন যথেষ্ট কম। কিন্তু তাও এই ওজন নিয়ে গাছের মগডালে ওঠা সম্ভব না৷ জায়গাটা ঢাকা জেলার হলেও উপজেলার ভেতর পড়েছে। মফস্বল এলাকা। মেয়েটির বাবা-মায়ের কান্না দেখে অভির হঠাৎই বেশ মায়া লাগলো। অভি তখনই একটা নীল রঙের বড় প্লাস্টিক জোগাড় করে কিছু লোক দিয়ে সেটা ধরিয়ে রাখলো আর নিজে সাবধানে উঠে গেলো গাছের বেশ উপরের একটা ডালে।
– এসো আমার কাছে এসো। আমি তোমাকে নীচে নিয়ে যাচ্ছি।
– কে তুমি? আমি যাবোনা তোমার কাছে। আমি পড়ে যাবো।
– পড়বে কেনো? আমি আছি না? হাত দাও নিজের।
– যদি পড়ে যাই?
– পড়বেনা।
– তুমি বাঁচাবে আমাকে?
অভি মাথা নাড়লো। মেয়েটি একটু আস্বস্ত হয়ে অভির দিকে হাত বাড়ালো৷ অভির মগডালে উঠতে হলোনা। নীচে বেছানো প্লাষ্টিকটাও আর কাজে লাগলো না। সে সাবধানে বাচ্চাটাকে নীচে নামিয়ে আনতেই সকলের মাঝে একপ্রকার হুড়োহুড়ি লেগে গেলো। এতক্ষণ কান্নাকাটি করা বাচ্চাটির মা দৌড়ে এসে বাচ্চাটাকে বুকে টেনে নিলো।
– আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো। আপনি মানুষ না সাক্ষাৎ ফেরেশতা হয়ে এখানে এসেছিলেন। আল্লাহ আপনার ভালো করুন। দুনিয়ায় এখনো ভালো লোক বেঁচে আছে আপনিই তার উদাহরণ।
অভি বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো। এই প্রথম কেউ তাকে দোয়া করলো। তাকে ফেরেশতার সাথে তুলনা করলো কিন্তু সে পৃথিবীর জঘন্যতম মানুষ। বাবা বলেছিলো, অভিই পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ। শিশুরা জন্ম নেয় পবিত্রতার সাথে কিন্তু অভির জন্মই হয়েছিলো খুনি হিসেবে। সারাজীবন সকলের কাছে জেনে এসেছে সে খারাপ। সে নিজেও জানে সে খারাপ। তবে সে যদি খারাপ হয়েই থাকে তবে এই মেয়েটিকে কেনো বাঁচালো৷ মহিলাটি বারবার অভির প্রশংসা করলে অভি স্পষ্ট বলে দিলো,
– না আমি ভালো মানুষ নই। হতে পারিনা। আমি এই পৃথিবীর জঘন্যতম মানুষ আর আমি সেভাবেই থাকতে চাই।
উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো অভির দিকে।

★★★

চারু আর ফাতেমা মিলে সম্পূর্ণ বাড়ি পরিষ্কার করে ফেলেছে। তবে সমস্যা হয়েছিলো থাকার জায়গা নিয়ে। ঘরে মাত্র দুটো ঘর। একটায় চারু আর সিফাত, অন্যটায় হামিদ আর ফাতেমা। বাচ্চারা নাহয় ওদের সাথেই থাকলো কিন্তু হিমেল কোথায় থাকবে? ধান রাখার জন্য ওদের একটা ঘর ছিলো৷ সেটা কিছুটা দূরে। চারু ওটাকেও কোনোমতে পরিষ্কার করে হামিদের পুরোনো চৌকিটা সেখানে পৌঁছে দিয়েছে। ইতিমধ্যে ওদের গ্রামে আসার কথা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। সকলেই দেখতে আসছে তাদের৷ সিফাতকে চারুর স্বামী হিসেবে পরিচয় করানো হলো। জামাল হোসেনের মৃ*ত্যুর পর হামিদই বিয়ে দিয়েছে চারুকে৷ মুখে মুখে সিফাতের গুনগান চলছে। অনেকে আবার হিংসেয় মুখ বাকিয়ে বলছে, পোলার এত বড় মাইয়া আছে দেইখাই গ্রামের মাইয়া বিয়া করতে রাজি হইছে। চারু কারোর কোনো কথাই গায়ে মাখলো না। হিমেলকে বলা হয়েছে সাজিদের ভাই। হামিদের বউ দেখে আফসোসের সীমা নেই কারোরই। এমন সুন্দর ছেলের বউ কি না এই কালো মেয়ে। চারুর অনুপুস্থিতিতে দু-একজন তো মুখের উপর বলেও দিলো। স্বাভাবিক ভাবেই এতে হামিদের মন নষ্ট হয়ে গেলো। মুখে কিছু না বলেও ফাতেমার প্রতি রূঢ় ব্যাবহার করা শুরু করলো সে। অবশ্য চারুর সামনে খুব বেশিক্ষণ সেটা স্থায়ী হলো না।

শাপলার মা ভাত দিয়ে গেছে আজ। এতদিন পর গ্রামে ফিরে আসায় কেউই আর রান্না করতে দেয়নি। টুনির মা তো আগেই বলে রেখেছে রাতে সে সবাইকে রান্না করে খাওয়াবে। দু-একজন পুরোনো বন্ধুর দৌলতে হামিদ জানতে পেরেছে গত বছরই গ্রামে বিদুৎ এসেছে। অবশ্য বিদ্যুৎ শুধু দিনেই থাকে। রাত হলে তার আর কোনো খবর পাওয়া যায়না। ঝড় বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। আল্লাহর নাম নিয়ে সেই যে যায়, দু-তিন দিনে আর আসার নাম নেয় না। তাও হামিদ ঠিক করেছে কালই বিদ্যুতের লাইন টেনে আনবে। হামিদ অবাক হয়ে লক্ষ্য করে গ্রামে আজও পাঁচ টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে এই প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত যাওয়া যায় আর গ্রামের মানুষ আজও কিপটেমি করে হেটেই মাইলের পর মাইল পার করে। হামিদের আসার কথা শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলো বিন্দিয়া।
ছুটে এসেছিলো সে৷ পুতুল আর লতা বাদে সকলেই এ-কাজ ওকাজ করছিলো। বিন্দিয়া যখন আসে হামিদ আর চারু তখন রান্নাঘর পরিষ্কারে ব্যস্ত ছিলো। হামিদকে দেখেই তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। কোনো এক অজানা কারণে চারু সহজেই সেটা বুঝতে পেলো। বিন্দিয়ার বয়স এখন চারুর প্রায় সমান। এখনো বিয়ে করেনি সে। গ্রামে এই বয়সে বিয়ে করেনি মানে অনেক কিছু। সে সম্ভবত অপেক্ষা করছিলো হামিদের জন্য। কিন্তু হামিদ কখনোই তাকে কোনো কথা দেয়নি। হামিদের জন্য তার অপেক্ষাটা কতটা যুক্তিযুক্ত ছিলো? সম্ভবত একেবারেই না। চারুর সাথে কথা বলে বিন্দিয়া এগিয়ে গেলো হামিদের দিকে।
– কেমন আছেন হামিদ ভাই? আমারে চিনতে পারছেন?
হামিদ ভ্রুকুচকে মনে করার চেষ্টা করছে বিন্দিয়াকে সে ঠিক কোথায় দেখছে। হঠাৎই তার মনে এলো বিন্দিয়াই চারুর সম্পর্কে হামিদকে বলেছিলো।
– হ্যাঁ হ্যাঁ চিনতে পারছি। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
– আমিও ভালো আছি।
বিন্দিয়া ভেবেছিলো হামিদ কথা এগোবে কিন্তু কথা না এগিয়ে হামিদ চুলোয় মাটির প্রলেপ দেওয়ার কাজ শুরু করে দিলো। গ্যাস আসেনি এখনো গ্রামে। এই অজপারা গায়ে গ্যাস আসার কথাও না। মাটির উনুন দিয়েই কাজ চালাতে হবে। বিন্দিয়ার যেনো এই মাটি মাখা হাতেই হামিদকে ভালো লাগছে। অবশেষে তার এত বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটলো। হামিদ কি জানে, ও এতো বছর যাবত শুধুই তার জন্য অপেক্ষা করেছে। হঠাৎই একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজে হামিদ দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো রান্নাঘর থেকে। বিন্দিয়াও আর পিছু পিছু বের হলো। চারু অবশ্য কিছুই বললোনা। মেয়ের প্রতি হামিদের ভালোবাসা দেখলে এমনিই সরে যাবে বিন্দিয়া। তবে বান্ধবীর জন্য বেশ খারাপ লাগছে তার। হামিদ গিয়ে দেখলো ফাতেমা লতাকে বারবার শান্ত করার চেষ্টা করলেও লতা শান্ত হচ্ছেনা। হামিদকে দেখে আবারও ঠোঁট ফুলিয়ে কেদে উঠলো সে। বাবার কাছে কত অভিমান তার। কোলে আসার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো লতা,
– আমার হাতে তো কাদা মাখা। তোমার শরীরেও লাইগ্যা যাইবো মা। তুমি মায়ের কাছে থাকো!
লতা মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। সে মায়ের কাছে থাকবেনা। হামিদের ঠোঁটে সুক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে এলো। মেয়েটা তার প্রচন্ড আহ্লাদী হয়েছে। বাবা ছাড়া কিছুই বোঝেনা। মায়ের বিরুদ্ধে কত নালিশ তার বাবার কাছে। হামিদ হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো লতাকে।
– এই বাচ্চাটা কার হামিদ ভাই? একেবারে চারুর মতো দেহা যায়। এইটাই কি চারুর মাইয়া?
– না, ও লতা। আমার আদরের একমাত্র মাইয়া। দেখতে একদম চারুর মতো। তাই না কও?
বিন্দিয়া বেশ জোরে একটা ধাক্কা খেলো।
– ও আপনার মাইয়া?
– হুম। ওইযে তোমার ভাবি।
ফাতেমা মুচকি হাসলো। বিন্দিয়ার মাথায় বাজ পড়লেও হয়তো সে এতটা চমকাতো না। গ্রামের সবাই বলাবলি করছিলো কালো বউ, কিন্তু বিন্দিয়া হামিদের আসার খবরে এতটাই খুশি ছিলো যে কার বউ সেটা জানার প্রয়োজন বোধ সে করেনি। কান্না আটকাতে না পেরে দৌড়ে উঠোন থেকে বেড়িয়ে গেলো সে। ফাতেমা অবাক হয়ে বললো,
– ওর আবার কি হইলো?

★★★

বসন্তের মাঝামাঝি সময়ে শিহাব আর সুহাসিনীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। কাছের আত্মীয় স্বজনরা সবাই জেনে গেছে। বাড়ির সকলেই বেশ খুশি। সুহাসিনীও প্রচন্ড খুশি তবে খুশি হতে পারেনা শিহাব। একেধারে অনেককিছু মাথায় ঘুরতে থাকে তার। সবচেয়ে বেশি মাথায় যন্ত্রণা দিচ্ছে চারুলতা আর অভি। তার জীবনে চারুলতার জায়গা সে অন্যকাউকে দেওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেনা। মাথায় প্রচুর চাপ পড়ছে তার উপর অভি। মিলি যে কতটা কষ্ট পেয়ে শিহাবকে সব বলেছে তা সে অনুমান করতে পারে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। মিলি কেনো অভির সাথে শিহাবের দেখা করালো না? কি এমন হয়ে যেতো ওর সাথে দেখা করালে? মিলি কি কিছু লুকাচ্ছে?
– শিহাব!
সুহাসিনীর ডাকে পেছনে ফিরে তাকায় সে। সুহাসিনী শাড়ি পড়েছে। অতিরিক্ত রকমের সুন্দর হলে কাউকে যেমন লাগে, সুহাসিনীকেও তেমনই সুন্দর বলা চলে। এক দেখায় চোখে পড়ার মতো মেয়ে সে। তবে স্বর্ণলতা শিহাবের মনে যে দাগ কেটেছে, সুহাসিনীর সৌন্দর্য সে দাগ মুছতে ব্যর্থ। হবে নাই বা কেনো, শিহাব তো শুধু চারুলতার রূপটাকে ভালোবাসেনি। তার প্রতিবাদী মনোভাব, বাচ্চামো, নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা, রাগ, জেদ, ভালোবাসা, সরলতা সবকিছুতেই মুগ্ধ হয়েছে। ভালোবেসেছে। এত সহজে কি পাঁচটা বছরের মায়া কাটানো যায়?
– শিহাব শুনছেন?
– হ্যাঁ শুনছি, বলো।
– আমাদের বিয়ে কিন্তু বসন্তে ঠিক করা হয়েছে। জানেন তো?
– হুম জানি।
শিহাব মুচকি হাসে। ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসে একবুক দীর্ঘশ্বাস। আবারও এক বসন্ত! শিহাব নিজ মনে নিজেকেই বললো নিজের ভিতরের কথাগুলো,
বসন্ত আমাদের জীবনে চমৎকার ভূমিকা পালন করছে তাই না স্বর্ণলতা? সেদিন এক বিবর্ণ বসন্তে তুমি অন্য কারোর হয়েছিলে, আজ আরেক বিবর্ণ বসন্তে আমি অন্যকারো হওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম।
আমার কাছে বসন্ত মানেই বিচ্ছেদ।
বিচ্ছেদ মানেই তুমি।
তুমি মানেই আমার ভালোবাসা।

_______________________

To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া