আমি সেই চারুলতা পর্ব-৪২ এবং শেষ পর্ব

0
564

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ৪২ (অন্তিম পর্ব)
_________________________

একটা চেয়ারের উপর বসে আছে চারু। হাত পা সব বাধা। বস নামক সেই অজ্ঞাত লোকটি শাওন সেটা দেখে স্তম্ভিত সে। চারুর বুকের ভেতরটা যেনো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। শাওন! শাওন এইটা করেছে? কিভাবে সম্ভব? আর শাওন যদি এইসব করে তবে ওর সামনে সেদিন কে মারা গিয়েছলো? আর শাওনই যদি বস হয় তবে ছোট জমিদার কেনো বললো তার ছেলে? আর মিলিই বা কেনো নিজেকে স্মৃতি দাবি করছে? এমন সময়েই ঘরে প্রবেশ করলো অসম্ভব মায়াবী চেহারার এক যুবক। চারুর ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে একসময় এই ছেলেটাই ছিলো তার কিশোরী বয়সের আবেগ,
– ছিহ! শাওন ভাই ছিহ! এত বড় জঘন্য খেলাটা খেলতে পারলে তুমি আমার সাথে?
– আমি শাওন নই, আমি অভি।
চারু একরাশ ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকালো শাওনের দিকে।
– নামটাও মিথ্যা ছিলো?
– এখন কথা বলার সময় নেই চারুলতা। শুধু এইটুকু জেনে রেখো শাওন তোমাকে ঠকায়নি। তোমার হাতে একটা লক করা আছে। আমরা তিনজনের কেউ একজন সেটা খুলতে পারবো তবে আধা ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন। আমি খুলে দেওয়ারও আধা ঘণ্টা তুমি এখানে লক থাকবে। সিকিউরিটির জন্য রাখা হয়েছে। আর খুলে যাওয়ার পর দেখবে হামিদ পাশের রুমে আছে। তাকে কোনোরকম বাধা হয়নি। তাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে এইখান থেকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালিয়ে যাবে। আর কখনো এখানে আসবেনা।
– মানে?
শাওন চারুর কথার কোনো জবাব দিলো না। চুপচাপ সে চারুর হাতের বাধনে কিছু একটা করলো।
– আধা ঘণ্টা লাগবে খুলে যেতে। তারপর হামিদকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাবে। হামিদ বোধহয় এখন অজ্ঞান অবস্থায় রয়েছে।
– শ শাওন ভাই, কেনো করলে এমনটা আমার সাথে?
– আমি শাওন নই। আমি অভি। শাওন আর অভি আমরা দুজনেই আলাদা দুজন ব্যক্তি চারুলতা। শাওন মারা গেছে তোমার সামনে আর আমি বেঁচে আছি।
– মিথ্যা, মিথ্যা বলছো তুমি।
– মিথ্যা বলছিনা। তুমি আমাকে ভালো ভাবে দেখলেই বুঝতে পারবে সত্যটা।
চারু একবার তাকালো অভির দিকে।হঠাৎই চারু শাওনের সাথে তার অমিল লক্ষ্য করলো,ছেলেটার গালে হাসলে টোল পড়ে কিন্তু শাওনের পড়তো না।চারুকে দেখানোর জন্যই এ মুহুর্তে সে হাসছে।অভির কণ্ঠস্বর একটু মোটা কিন্তু শাওনেরটা চিকন ছিলো।অভি সম্পূর্ণ শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছে কিন্তু শাওন সেটা কখনোই পারতো না।
-তুমি শাওন ভাইয়ের জমজ ভাই?
-না।আমি তার ক্লোন।ক্লোন বোঝো তো?শাওনের থেকে ডিএনএ স্যাম্পল নিয়ে আমাকে তার ক্লোন হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।
-তুমি যে-ই হও আমার জীবন ধ্বংসের কোনো অধিকার দেওয়া হয়নি তোমাকে।তুমি কেনো করলে আমার সাথে এমনটা?
– আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ চারুলতা তাই এসব করেছি।শাওনের শরীর থেকে ডিএনএ স্যাম্পল নিয়ে আমাকে তৈরি করা হয়।সেই ডিএনএ এর সাহায্যে আমার জন্ম হয় পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হিসাবে।শিশুরা জন্মায় পবিত্র হয়ে কিন্তু আমার জন্ম হয় দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হিসেবে।জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সাহায্যে আমার ভেতরে থাকা সব ভালো জিন সরিয়ে দিয়ে পৃথিবীর ভয়ংকর ভয়ংকর অপরাধীদের জিন আমার ভেতর প্রবেশ করানো হয় আর আমি জন্ম থেকেই বেড়ে উঠি জঘন্য মানুষ হিসেবে।আমাদের আলাদা করার জন্যই আমার গালে এ টোল।
-বাজে বকা বন্ধ করো। মানুষের ক্লোনিং করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
-এর জন্যই তো আমাদের কাছ থেকে মেয়েগুলোকে নেওয়া হয়েছিলো।পৃথিবীর কাছে বর্তমানে তাদের আর কোনো অস্তিত্ব নেই তাই তারা থাকলো কিংবা মারা গেলো কিন্তু তাদের সাথে কি করা হলো তাতে কিছুই যাবে আসবেনা।খারাপ আমি হইনি চারুলতা, খারাপ হয়েছিলো আমার নিয়তি।আমার, তোমার, শিহাব, শাওন, মিলি, স্মৃতি আমাদের সকলের নিয়তি আমাদের নিয়ে খেলেছে আর ছোট জমিদারের সাথে সবচেয়ে বড় মাস্টারমাইন্ড কে ছিলো জানো?
-আরো কেউ ছিলো?
-হুম।সে তোমার খুবই সম্মানের একজন ব্যক্তি কিন্তু আজকের পর থেকে তুমি আর তাকে সম্মান করতে পারবেনা কারণ তোমার জীবনের দুর্বিষহের কাহিনি তিনিই লিখেছিলেন।
-ভনিতা করো না,যা বলার সরাসরি বলো।কে সে?
-মাস্টারমশাই!
-মাস্টারমশাই?
-হুম।সেও আজ এখানেই আছে। তবে তোমার সামনাসামনি আসেনি।
চারু যেনো অবাক হতেও ভুলে যায়।এক মুহুর্তের জন্য মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে।শেষ অবধি মাস্টারমশাই? এই লোকটাকে চারু কতটা সম্মান করতো তা সে নিজেও কল্পনা করতে পারেনা আর সেই পথপ্রদর্শক মাস্টারমশাই কি না এইসবের সাথে জড়িত?
– হ্যাঁ চারুলতা! তোমার মাস্টারমশাই এইসবের সাথে জড়িত। তোমাদের তেরো জনকে নিয়ে আমাদের অনেক রকমের পরিকল্পনা ছিলো। তোমাদের কাজ হবে বিদেশে। তাই সেখানের মানুষের সাথেই তোমাদের মানিয়ে নিতে হবে। তোমরা সকলেই গ্রামের মেয়ে। টার্গেট ছিলো তোমাদের বাবা-মা। অত্যাধিক সুন্দরী নারী কিংবা অত্যাধিক সুন্দর পুরুষ এদের সন্তানকেই প্রথম টার্গেট করা হয়। তারপর আসে যেসব দম্পতি স্বামী স্ত্রী দুজনেই দেখতে সুন্দর। এমন একশত জন কাপল ছিলো আমাদের কাছে। যাদের বাচ্চা সবচেয়ে সুন্দর হবে তারাই ছিলো টার্গেট। বিশ্বজিৎও এর সাথে সংযুক্ত ছিলো এবং তোমার জন্ম হলো। বাকি নিরানব্বই জন দম্পতির মাঝে বারো জন দম্পতির মেয়েরা বড় হলে আগুন সুন্দরী হয়ে উঠলো আর এভাবেই তারা নিজেদের অজান্তেই আমাদের প্ল্যানে সংযুক্ত হয়ে গেলো। যেহেতু তোমরা সকলেই গ্রামের তাই তেমন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তোমাদের সেভাবেই তৈরি করতে হতো। বিদেশে বড় বড় শিল্পপতিরা কখনোই গ্রাম্য ধরনের মেয়েদের লম্বা সময়ের জন্য নিজেদের রক্ষিতা বানায় না তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তোমাদের শেখার ব্যাবস্থা হলো। আর সেই দায়িত্ব গ্রহণ করলো তোমার মাস্টারমশাই নিজেই। তুমি খেয়াল করেছো কি না বলতে পারছিনা তবে একটু মনে করো, মাস্টারমশাই কিন্তু সবসময়ই তোমাকে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার জন্য জোর দিতো। বাকিদের তুলনায় তোমাকে বেশি দিতো। বাকিদের তুলনায় তোমাকে ইংরেজিতেও বেশি পারদর্শী করে তোলে মাস্টারমশাই। তুমি খেয়াল করেছো কি? তবে ঝামেলা বেধে যায় অন্য জায়গায় গিয়ে। আমরা না চাইতেও তোমার মাঝে প্রতিবাদী মনোভাব জাগ্রত হয়। আগের মেয়েগুলো কখনোই প্রতিবাদের সাহস দেখায়নি কিন্তু তুমিই ছিলে ভিন্নরকম। যখন আমরা ব্যাপারটা বুঝতে পারি সাথে সাথেও পড়াশোনা বন্ধ করে তোমার বিয়ে করিয়ে দেই জামাল হোসেনের সাথে। অবশ্য জামাল হোসেনের সাথে প্রথম দিকে তোমার বিয়ে দেবার কোনো ইচ্ছেই আমাদের ছিলোনা। কথা ছিলো আমি শাওন হয়ে তোমাকে বিয়ে করবো আর শাওনকে অন্য কোথাও সরিয়ে দেবো। কিন্তু সেটাও হতে পারেনা শিহাবের জন্য। তোমার ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর ছিলো আমাদের। তুমি শাওনের প্রতি দুর্বল হওয়ার পর সাথে সাথেই আমরা সেটা জানতে পারি আর তখনই এ পরিকল্পনা করি।
আমাদের পরিকল্পনা ছিলো সাধারণ। শাওনের সাথে তোমার প্রণয়ের সম্পর্ক। একটা সময় পরে গিয়ে তোমরা বিয়ে করবে। আর সেই সময়েই শাওনকে সরিয়ে দিয়ে শাওনের জায়গায় তোমাকে আমি বিয়েটা করে নেবো। অবশ্য নকল বিয়ে। আর তারপর সু্যোগ বুঝে তোমাকে নিয়ে শহরে স্যাটেল হয়ে যাবো। মানে শাওনের পরিচয়ে আমি তোমাকে গ্রাম থেকে শহরে আনবো। তার কিছুদিন সংসার করার অভিনয় করে নির্দিষ্ট দিনে তোমাকে পাঠিয়ে দেবো তোমার নিজস্ব ঠিকানায়। অবশ্য বাকি বারো জন মেয়ের দশজন কিন্তু প্রস্টিটিউড হয়েছিলো আর বাকি দুজন গিয়েছিলো ল্যাবে। পাগলা বিজ্ঞানীদের পাগলা এক্সপ্রিমিন্টের জালে ফেসে যায় তারা তবে স্মৃতি চায় তুমি প্রস্টিটিউড হও। কেনো জানো? কিছুটা হিংসে। সুন্দরীরা নিজের চেয়ে অধিক সুন্দরীদের সহ্য করতে পারে না। তাই স্মৃতিও তোমার জন্য সর্বোচ্চ খারাপটাই চাইতো।

আমাদের পরিকল্পনা সঠিকই এগোচ্ছিলে চারুলতা কিন্তু মাঝখানে শিহাব এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিলো। শাওন তার ভাইকে বলেছিলো মা-কে রাজি করাতে। কিন্তু জমিদার গিন্নি আগে শিহাবের বিয়ে দিতে চান এবং ভুলবশত তিনি শিহাবের জন্য তোমাকেই খুজে বের করেন। সেটাই স্বাভাবিক, আশেপাশের পাঁচ গ্রামে তোমার চেয়ে যোগ্য কোনো মেয়ে ছিলোনা। থাকবে কিভাবে, তোমাকে আমরা নিজ হাতে গড়ে তুলেছি। আমি অবশ্য তখন খুব ছোট ছিলাম। ছোট জমিদার আর তোমার মাস্টারমশাই এইসব প্ল্যান করেন আর আমাকে নিজেদের সাথেই রাখেন। আমি বড়ই হই এসব শিখে। যাই হোক যা বলছিলাম, শিহাব প্রথমবার তোমাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে। মজিদ সেদিন তোমার ওপর জোর খাটাতে চেয়েছিলো। মজিদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিলো না তবে আমরা তাকে বাধা দিতে চাইনি কারণ আমাদের উদ্দেশ্যই ছিলো তোমাকে একাধিক পুরুষের ঘনিষ্ঠ করে তোলা। বিশ্বজিৎ তো রাজি হয়নি আর হামিদের কথা তো বাদই দিলাম। তখন অবশ্য বুঝিনি তবে এখন বুঝতে পারছি সেটা আসলেই খুব জঘন্য একটা কাজ ছিলো। আর আমার পাপিষ্ঠ হাতেই আমি এইসব করেছি। শাওনের সাথে হামিদের একটা বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিলো তাই আমি শাওন হয়ে হামিদের কাছে গিয়েছিলাম। তাকে নিজেদের দলে টানতে চেয়েছিলাম কিন্তু হামিদ পালিয়ে যায়। এরপর আর শাওনের সাথে সে যোগাযোগ করেই না। হামিদ আসলে আগেই সব জানতো, বুঝতো কিন্তু বুঝেও অবুঝ হয়েছিলো সে। শাওনের কথাটা শুনে তুমি যে ধাক্কাটা খাবে এইটা সে দিতে চায়নি তোমাকে। ও চেয়েছিল যা তুমি দেখবে সরাসরিই দেখো কিন্তু এতবড় আঘাত ও কখনোই তোমাকে দিতে চায়নি।

শিহাব তোমার সাথে বিয়েটা ভেঙে দিলেও অসম্ভব রকমের অনুভূতি পুষে রাখলো নিজেরই ভেতর। ভালোবাসায় পুড়ে গেলেও ভাইয়ের মুখের হাসিটা ছিলো তার কাছে মুখ্য কিন্তু নিয়তিটা একবার দেখো, যেই খুশির জন্য ও তোমাকে ছেড়ে গেলো সেই খুশিটাই তোমার হলো না। শিহাবের অনুভূতি বোঝার সাথে সাথে পরিকল্পনা পরিবর্তন করি। আমি যদি বলতাম, চারুর শহরে গিয়ে অন্যকারোর সাথে সম্পর্ক হয়েছে আর সে আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে সেটা সকলে বিশ্বাস করলেও শিহাব করতো না। যখন দেখলাম শিহাব আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ তখন আমরা সম্পূর্ণ পরিকল্পনাই বদলে তোমার বিয়ে জামাল হোসেনের সাথে দিয়ে নিজে সব পরিকল্পনা করতে থাকি। তবে তুমি ছিলে প্রচন্ড জেদী মেয়ে, ঠিকই পালালে সেখান থেকে। তোমাকে দ্বিতীয়বার আর ধরার মতো সাহস না করে আবারও নজরে রাখতে লাগলাম। যেদিন ভাবলাম তোমাকে পাচার করবো সেদিন আবার তুমি গায়েব। সর্বশেষে আবার একবার এই গ্রাম।

নিজের লম্বা বক্তব্য শেষ করে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে অভি। আবার নিজ থেকেই বলে,
– স্মৃতিও কিন্তু আমারই মতন ক্লোন। আমি যেমন শাওনের ক্লোন, স্মৃতিও তেমনি মিলির ক্লোন। মিলি ছিলো বিশ্বজিতের আরেক মেয়ে। কে জানে কিসের জন্য ওই লোক মিলিকে নিজের মেয়ের পরিচয় দিচ্ছে। সম্ভবত নাজিমুদ্দিনের সাথে তার কোনো চুক্তি হয়েছিলো। আর মিলির ডিএনএ থেকেই স্মৃতির জন্ম। আমি যেমন ছোট জমিদারকে কখনো বাবা হিসেবে মানি নি, স্মৃতিও তেমনি মানেনি। কিন্তু ঘৃণিত হলেও সত্য, আমার শরীরে তারই রক্ত বইছে।
– কিন্তু তোমার ভাষ্যমতে তুমি তো শাওন ভাইয়ের ক্লোন।শাওন ভাই তো জমিদারের ছেলে। ছোট জমিদার কিভাবে তোমার বাবা হয়?
– শুরু থেকেই বলি, মন দিয়ে শোনো,
এই সবকিছুর শুরু হয় জমিদার বাড়ি থেকে। ছোট জমিদারের মেয়ের নেশা ছিলো খুব তাই সে বিভিন্ন ধরনের মেয়েদের রক্ষিতা হিসেবে রাখতেন। একটা পর্যায়ে গিয়ে মেয়েদের নিয়ে ব্যাবসা করতে শুরু করেন কিন্তু বাইরে খুব বোকাসোকা প্রকাশ করতেন নিজেকে যেনো কেউ তাকে সন্দেহ না করে। সব ভালোই চলছিলো। একটা সময় গিয়ে তার দল ভারি হতে শুরু করে। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ ঘটনা তখন ঘটে যখন নাজিমুদ্দিন বিদেশে পাচার করে মেয়েদের। নাহ! প্রস্টিটিউড হিসেবে নয়, সাইন্টিস্টদের গবেষণার গিনিপিগ হিসেবে।
তখন আমেরিকায় একটা গবেষণা চলছিলো, ক্লোনিং গবেষণা। একটা মানুষের ডিএনএ এর সাহায্যে কিভাবে তার মতো হুবুহু মানুষ তৈরি করা সম্ভব। শিপাঞ্জির উপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা সফলতা লাভ করেন কিন্তু তারপরেই সরকার গবেষণা বন্ধ করে দিতে বলে কিন্তু কিছু পাগলা বিজ্ঞানী সেটা মেনে নেয়না। তারা যেকোনো উপায়ে গবেষণা করতে চায় তাই আমাদের থেকে বেশ চড়া দামে মেয়েদের কিনে নেয়। তারপর সেখানে কৃত্রিম উপায়ে জরায়ুতে স্প্যামের প্রবেশ করিয়ে বাচ্চা প্রসব করান। আর সেই বাচ্চাদের থেকেই শুরু হয় প্রথম ক্লোনিং প্রকিয়া। প্রথম প্রথম ফেইল হলেও পরে ঠিকই সফলতা অর্জন করতে শুরু করে আর তারই সুযোগ নেয় ছোট জমিদার।

ছোট জমিদার বড় একটা এমাউন্টের সাহায্যে নিজের পছন্দ মতো আমাকে তৈরি করেন শাওনের ডিএনএ থেকে। আমিই ভবিষ্যতে তার এ ব্যাবসা দেখবো এবং এরজন্য আমাকে খারাপ হতে হবে তাই আমার ভেতর খারাপ জিন প্রবেশ করানো হয়। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই নিজেকে দেখতাম ল্যাবে। তিনবেলা হাজার হাজার বিজ্ঞানীদের আমি দেখতাম কিন্তু কেউই আমার সাথে কথা বলতো না। তাদের এত সময় কোথায়? এত এত মানুষের ভীড়েও আমি ছিলাম একা। এইটা সবচেয়ে জঘন্য অনুভূতি জানো চারুলতা, আশেপাশেই এত এত মানুষ অথচ কেউই আমার আপন নয়। কেউ আমার জন্য মায়া অনুভব করেনা। কি ভীষণ একা একা ছিলাম সেই ল্যাবে। তারা কেউ আমাকে কখনো মানুষ হিসাবে গন্য করেনি। তারা কখনোই বুঝতে চাইতো না আমি ক্লোন হলেও ছিলাম একেবারে মানুষের মতো। আমারও সুখ দুঃখ কষ্টের অনুভূতি ছিলো। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হতো আমি ক্লোন নই আমি মানুষ। আমি মানুষ হতে চাই কিন্তু আমার ভেতরের সেই আর্তচিৎকার শোনার জন্য কেউ ছিলো না। কেউ কখনো আমাকে বোঝেনি তাই ক্রমশই আমি হয়ে উঠি, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর আর ভয়ংকর। আর খারাপ জিন তো আগেই ছিলো আমার শরীরে। তেরো বছর বয়সে আমি প্রথম বাংলাদেশ আসি এবং ধীরে ধীরে সব শিখতে থাকি জমিদার কাছ থেকে। এতদিনে আমার নিঃসঙ্গ জীবনের একজন সাথী আসে। তার নাম স্মৃতি। আমারই মতন ক্লোন। একাকিত্বে ভোগে সবসময়। দুজনের বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনা আর তখন থেকেই আমরা দুজন একসাথে। আমি স্মৃতিকে খুব ভালোবাসি চারুলতা। প্রচন্ড ভালোবাসি।
– তুমি আর স্মৃতি! তোমাদের দুজনের বাবাই ছোট জমিদার, তাহলে তোমরা কিভাবে একে অপরকে ভালোবাসো?
– তুমি বোধহয় ব্যাপারটা বোঝোনি। আমি শাওনের ক্লোন যে আসলে ছোট জমিদারের ছেলে আর স্মৃতি মিলির ক্লোন যে আসলে বিশ্বজিতের মেয়ে। এখন বুঝেছো?
– শাওন ভাই ছোট জমিদারের ছেলে?
– হুম। জমিদার বাড়ির প্রতি তার লোভ সবসময়ই ছিলো কিন্তু সে তা চরিতার্থ করতে পারেনি। তার বড় ভাই জমিদার হলো। তার জঘন্য চিন্তাভাবনা এইবার অন্য পর্যায়ে রূপ নিলো। সে চিন্তা করলো, সে জমিদার হয়নি তো কি হয়েছে তার ছেলেরা জমিদার হবে। জমিদার গিন্নি যখন প্রথম সন্তান জন্ম দেন তখন সেই বাচ্চাটি মারা যায়নি, ছোট জমিদার ইচ্ছাপূর্বক তাকে খুন করে, নিজের ছেলের সাথে তাকে বদলে দিতে যায়। কিন্তু তার আগেই সকলে বুঝতে পেরে যায় জমিদারের বাচ্চাটি মারা গেছে। তখন হাসপাতালে নাজিমুদ্দিনের বউয়েরও বাচ্চা হয়। জমিদার ঠিক করে সেই বাচ্চাটিকে তুলে দেবে জমিদার গিন্নির হাতে তাই ছোট জমিদার আরো এক ঘৃণ্য কাজ করে। সেই বাচ্চাটিকেও মেরে তার জায়গায় নিজ ছেলেকে রেখে দেয়। আর তার ছেলেটিকেই জমিদার গিন্নি নিজের ছেলে হিসেবে বড় করে। এর মানে বুঝতে পারছো চারুলতা?
– শিহাব! শিহাব ছোট জমিদারের ছেলে?
– হ্যাঁ ঠিক ধরেছো। শিহাব নাজিমুদ্দিন নয় বরং ছোট জমিদারের ছেলে। নাজিমুদ্দিনও তখন সেটা জানতো না। এই অবধি সব ঠিক ছিলো কিন্তু আরো বেশি জঘন্য ঘটনা ঘটে শাওনের জন্মের সময়। সেবারও জমিদারের ছেলেকে খু*ন করে ছোট জমিদার নিজ ছেলে অর্থাৎ শাওনকে সেখানে রেখে দেয়।
– শাওন ভাইও তার ছেলে?
– হ্যাঁ।আমার আর শাওনের মাঝে আচরণগত পার্থক্য ছাড়া আর কোনো পার্থক্য ছিলো না।আমাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য তারা আমার গালে এ টোলের সৃষ্টি করে আর কন্ঠস্বর কিছুটা মোটা করে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সাহায্যে।
– জঘন্য! সবটা জঘন্য।
– ঠিকই বলেছো চারুলতা।আসলেই সবটা জঘন্য।আরো একটা ঘটনা কি জানো,জমিদার বাড়ির সকল খবরাখবর মিলির সাহায্যে রাখতাম আমি।রং নাম্বার হিসেবে ফোন করেছিলাম মিলিকে।মিলি অবশ্য তাই জানতো।আমার প্ল্যানের বিন্দুবিসর্গ সে জানতো না। একপর্যায়ে আমাদের কথা হতে থাকে।নিজের কথার জালে আমি আটকে নেই মিলিকে।ভালোবেসে ফেলে প্রচন্ড কিন্তু আমাকে যেদিন দেখে সেদিন চমকেছিলো বেশ।আমার আর শাওনের চেহারা তো একই।আমি তখন মিলিকে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কাহিনি শুনিয়ে দিলাম।বললাম আমি জমিদারের এক ছেলে কিন্তু তিনি আমাকে অস্বীকার করেছেন।আর আমি যেহেতু তারই ছেলে তাই আমার আর শাওনের চেহারায় বেশ মিল।দুই ভাইয়ের যেমন হয়।সেসব অনেক কথা।এত গভীরে যেতে চাইছি না।ততদিনে মিলি অনেকটা আসক্ত হয়ে যায় আমার প্রতি তাই আমাকে ছেড়ে দিতে পারেনা।শাওনের রূপেই আমাকে ভালোবেসেছিলো।

তবে একটা পর্যায়ে গিয়ে শাওন সব জানতে পেরে যায় বুঝলে।তখন স্মৃতি মিলির সাজপোশাকে গিয়ে প্রতিনিয়ত শাওনকে বিষ দিতো।স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজ ছেলেকে খু*ন করতে দ্বিধাবোধ করেননি ছোট জমিদার।শাওন মনে করতো মিলিই ওকে বিষ দিচ্ছে। আর ডাক্তারের সাহায্যে শিহাবকে জানাই অতিরিক্ত ঔষধ খাওয়ায় সে মানষিক ভারসাম্য হারিয়েছে।ডক্টর শিহাবের বন্ধু হলেও টাকার কাছে চুপ করে গিয়েছিলো সে।
-এইসব আমাকে কেনো বললে আর আমাকেই বা কেনো মুক্ত করে দিচ্ছো?
-আমি নিজের ভুলটা উপলব্ধি করতে পারছি চারুলতা। আমি আমার সবকিছু আবার নতুনভাবে শুরু করতে চাই।তোমার অভিশাপ নিয়ে আমি আমার নতুন জীবন শুরু করতে চাইনা তাই আমি তোমাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। তুমি আমাকে মাফ করে দিও।
-কক্ষনো নয়।তুমি সত্যিই মনে করো এতগুলো জীবন নষ্ট করার পরেও তুমি শান্তিতে থাকতে পারবে?
-তুমি চাইলে পারবো।
-আমি চাই না।আমার কাছে নাহয় ক্ষমা চেয়ে নিলে যেসব মেয়েদের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছো তাদের কি হবে?তাদের অভিশাপ থেকে কিভাবে বাঁচবে?
-তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার উপায় নেই আমার তাই তোমার কাছ থেকে চাইছি।তুমি আমাকে ক্ষমা করে। তাদের পক্ষ থেকেও ক্ষমা করো আমাকে।
-আমি নিজের পক্ষ থেকেই তোমাকে ক্ষমা করবো না অন্যের পক্ষ থেকে অনেক দুরের কথা।আমার সুখ কেড়ে নিয়েছো তুমি।আমার স্বামীকে আমারই চোখের সামনে তুমি খু*ন করেছো তাও তুমি কিভাবে আশা করো আমি তোমাকে মাফ করে দেবো?পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য মৃ*ত্যু আমি তোমাকে উপহার দেবো।
-আমি ইচ্ছা করে সিফাতকে গু*লি করিনি চারুলতা। হামিদকেও করতে চাইনি।তোমাদের তিনজনকে মুক্ত করে দেওয়ার ইচ্ছে ছিলো আমার কিন্তু হামিদের আকষ্মিক আক্রমনটা সহ্য করতে না পেরে হাত ফসকে গু*লিটা বেড়িয়ে যায়।বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছা করে করিনি সেটা।আমি তোমার কাছ থেকে তোমার ভালোবাসা কেড়ে নিতে চাইনি চারুলতা।আফটার অল আমিও কাউকে ভালোবাসি।জানো, আমি না প্রথমে স্মৃতিকে ভালোবাসতাম না।বহুবার শারীরিক সম্পর্কের পরেও না কিন্তু হঠাৎ একদিন জানালো সে প্রেগন্যান্ট। আর আমি জানি বাচ্চাটা আমার।তুমি ভাবতেও পারোনা চারুলতা, সেদিন কতটা খুশি হয়েছিলাম আমি।মনে হচ্ছিলো যেনো আমার জীবনটা স্মৃতি সাজিয়ে দিলো নতুন এক রূপে।বিয়ে না করে এই বাচ্চাটা পালন করা আমাদের জন্য কোনো ব্যাপারই নয়।কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাই চারুলতা।নিজের জীবনটাকে সুন্দর একটা নিয়মে বাধতে চাই।ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে চাই আমার নিজস্ব মানুষদের।আমি জানি আমি খুবই অন্যায় করেছি তোমার সাথে।তবে যা যা করেছি এতদিন, তার প্রায়শ্চিত্ত আমি তোমার মাধ্যমে করতে চাই। তুমি এইসব আগের কথা ভুলে যাও প্লিজ।আমি এইসব ছেড়ে দেবো চারুলতা।আমি স্মৃতিতে ভালোবেসে ফেলেছি।আমি স্মৃতির সাথে সব নতুন করে শুরু করতে চাই।আমি জানি তুমি আমার পিছু করছো তাই আমি চাই তুমি আমার পিছু করা ছেড়ে দাও।
-তুমি জাহান্নামে গেলেও তোমাকে আমি শাস্তি দিয়ে ছাড়বো।আমার জীবনটা নরক বানিয়ে ছেড়েছো তুমি। তোমার মতো কীটদের জন্য আমার মনে বিন্দুমাত্র মায়া নেই।আমার ভালোবাসা বিহীন খরাময় জীবনের সুত্রপাত ঘটেছে তোমার হাত ধরে।আমার জীবন শুষ্ক মরুভূমি মতো তৈরি করেছো তুমি আর এই মরুভূমিতেই তৃষ্ণার্থ মরতে হবে তোমাকে।আমার শরীরে শুধু বিশ্বজিতের রক্তই বইছেনা বরং তার মতো কঠিন হৃদয় আমারও। সেই কাঠিন্য তোমার শত হাজার কাকুতি মিনতিও ভাঙতে পারবেনা।শেষ নিঃশ্বাস অবধিও যদি তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও,আমি তোমাকে ক্ষমা করবোনা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি।
– না চারুলতা।আমি এ পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ব্যক্তি নই। হতে পারিনা।পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য তো তারা যারা আমাকে এভাবে বানিয়েছে।জানো চারুলতা,কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমি ভাবতাম আমি এই দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি।নিজের শান্তির জন্য আমি অপরকে প্রচন্ড কষ্ট দিতাম মনে হতো তাদের কষ্ট দিলেই আমি শান্তি পাবো।পেতামও সাময়িক শান্তি কিন্তু সবসময়ই মনে অস্থিরতা কাজ করতো।কিন্তু তুমি বিশ্বাস করবেনা চারুলতা,কিছুদিন আগে আমি একটা ভালো কাজ করেছিলাম। সত্যিই করেছিলাম।একটা বাচ্চা ছেলের জীবন বাঁচিয়েছিলাম।আমি সেদিন আনন্দ পেয়েছি। সত্যিকারের প্রশান্তি পেয়েছি।এখন তুমিই বলো যেখানে আমি অন্যের উপকারে প্রশান্তি পাই সেখানে আমি কিভাবে হবো এই দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি?বলো কিভাবে হবো?আমি এই দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি নই চারুলতা।নই আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। হতে পারি না। কক্ষনো পারি।আমার মনে মায়া আছে।ভালোবাসা আছে।বিশ্বাস করো আমিও ভালোবাসতে জানি আর যে ভালোবাসতে জানে সে কিভাবে এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি হয়? বলো কিভাবে হয়?

অভি পাগলের মতো নিজের স্বপক্ষে যুক্তি দিতে চাইছে। সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য ব্যক্তি নয়।হতে পারেনা কিন্তু অভির এইসব যুক্তি চারুর মাথায় ঢুকছেনা।মাথায় বারবার ঘুরে চলছে সিফাতের গুলি লাগার ভয়ংকর দৃশ্যটি।কি ভয়ংকর নির্মমতার সাথে সিফাতের বেলিফুলকে একলা করে দিলো অভি!এর শাস্তি কি সে পাবেনা? এমনিই মুক্তি পেয়ে যাবে সে? এমন সময়েই ঘরে প্রবেশ করলো স্মৃতি।অভি দাঁড়িয়ে ছিলো। তারই পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে,
– এখানে কি করছো?
– এমনিই দেখতে এসেছিলাম। তুমি এখানে?
– একমাত্র বোনের একটা ইচ্ছে পূরণ করতে এলাম।
অভি খানিকটা অবাক হয়ে স্মৃতির দিকে তাকাতেই স্মৃতি সাথে সাথে একটা ছু*ড়ি গেথে দিলো অভির পেটে। অভি অবাক হয়ে তাকালো স্মৃতির দিকে। ঘটনার আকষ্মিকতায় চমকে গেলো চারু নিজেও। এটা কি হলো?
– তোমার তো সারাজীবন কষ্টেই কাটতে চলেছে চারুলতা তাই ভাবলাম কষ্টে জীবন কাটানোর আগে একটা সুখ স্মৃতি না হয় নিয়ে যাও। তোমার জীবন ধ্বংসকারীকে তোমার বোন নিজ হাতে খু*ন করেছে৷
অভি এখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে স্মৃতির দিকে।
– ক কেনো করলে স্মৃতি? (অভি)
– অন্য কারোর উপর আসক্ত হয়ে গেছি গো অভি। শিহাবকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি। এখন গিয়ে মিলিকেও খু*ন করবো তারপর মিলি হয়ে জমিদার বাড়িতে ঘাটি গাড়বো। বলবো আমার মানে মিলির আর কি, আমি তো তখন মিলি হয়ে যাবে। তখন শিহাবকে বলবো আমার পেটে অভির বাচ্চা৷ সে আমাকে ঠকিয়েছে। আমার সম্মান বাঁচানোর জন্য শিহাব আমাকে বিয়ে করে নেবে তখন।
– শিহাব মিলিকে নিজের ছোট বোনের মতো ভালোবাসে। সে কখনোই তোমাকে বিয়ে করবেনা।
– সেটা তোমাকে ভাবতে হবেনা। তুমি তাড়াতাড়ি ম*রো তো।
– আপন মানুষের দেওয়া ক কষ্ট সত্যিই ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি। না কিছু বলা যায় আর না সহ্য করা যায়। আমার সোনামণির খেয়াল রেখো। পাপের ঘটা শেষ অবধি পূর্ণ হয়েই গেলো আমার। প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ পেলাম না।
– কিসের সোনামণি? তোমার কি মনে হয় তোমার বাচ্চা আমি এখনো নিজের পেটে রেখে দিয়েছি? আমি অলরেডি এবর্শন করে নিয়েছি। আমার প্রথম বাচ্চা হবে শিহাব আর আমার বাচ্চা।
স্মৃতি অভিকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে বেড়িয়ে গেলো সেখান থেকে। মেঝেতে লুটিয়েই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো অভি। কষ্টে মিশ্রিত সেই হাসি।
– ঘটনাটা বোধহয় আগেই আচ করতে পেরেছিলাম চারুলতা। তোমার অভিশাপ ফলে গেলো চারু। মনে আছে সেদিন তুমি আমাকে বলেছিলে, “তোমার ধ্বংস অনিবার্য! নিজের ভালোবাসার মানুষটির হাতেই তোমার পতন ঘটবে।” তবে কি তোমার সেদিনের অভিশাপ ফলে গেলো চারুলতা? সেই অভিশাপে কি এতটাই জোর ছিলো? এতদিন কত কত মানুষকে আপন মানুষ দ্বারা প্রতারিত করেছি আর আজ আমি নিজেই প্রতারিত হয়ে গেলাম। প্রতারিত হয়েছি এরচেয়েও বেশি যন্ত্রনাদায়ক ভালোবাসার মানুষটির হাতে প্রতারিত হলাম। আমি আজও স্মৃতিকে ভালোবাসি চারুলতা। তুমি ওকে কিছু করো না প্লিজ। আফসোস আমার সোনামণিটা পৃথিবীর মুখ দেখলো না।
অভির জন্য সর্বোচ্চ শাস্তিই বোধহয় ছিলো এইটা। তার বাচ্চা দুনিয়ায় এলো না, ভালোবাসার মানুষটির হাতেই তার পতন ঘটলো। কিন্তু চারুর তো কিছুই করা হলোনা। সে তো শান্তি পাবেনা। অভির কষ্টটা আরো বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বললো,
– তোমার স্মৃতিকে আমি সবচেয়ে ভয়ংকর মৃ*ত্যু দিতে চলেছি অভি। তার একচোখে গরম লোহার রড ঢুকিয়ে দেবো, অন্যচোখে গরম লাভা ঢেলে দেবো। সম্পূর্ণ শরীরে অসংখ্য ছিদ্র করে তাতে লবণ মরিচ লাগবো। জিব কে*টে ফেলবো। হাতের কবজি হাতুড়ি দিয়ে গুড়ো করে ফেলবো। প্রতিটা আঙ্গুলের তিনটা করে ভাগ করবো, যেখানে তাকে হ*ত্যা করার সেখানে বিষাক্ত গ্যাস ছেড়ে দেবো। মৃত প্রায় অবস্থায় নিঃস্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইবে তার আর তখনই তার গায়ে আগুন লাগিয়ে দেবো আমি। জানো তো, আগুনের মৃত্যু সবচেয়ে বেশি কষ্টকর!
অভির চোখেমুখে ভয় প্রস্ফুটিত হলো, চারুর এই ভয়ংকর কথাটা সহ্য হচ্ছেনা তার। অভির স্মৃতি কিভাবে এত ভয়ংকর শাস্তি পাবে? এর চেয়ে তো হাজার গুণ বেশি ভালো হতো ও নিজে এভাবে মরে গেলে।
– না চারুলতা! এমন করো না। তোমার যত রাগ আমার উপর মেটাও। আমার স্মৃতিকে রেহাই দাও। ও সইতে পারবেনা। প্লিজ চারু,,,
চারু হাতের বাধন খুলে গেলো। অভি এখনো ছটপট করছে। মৃত্যুর আগ অবধি এভাবেই ছটপট করবে সে। মৃ*ত্যু নয়, সে যতক্ষণ বেঁচে আছে সেটাই হতে চলেছে তার কঠিনতম শাস্তি।

পরিশিষ্টঃ

বারান্দায় চায়ের কাপ ও তিনমাস আগের একটি খবরের কাগজ নিয়ে বসে আছে চারু।খবরের কাগজের টপ পেইজে রয়েছে চারটি নৃসংশ খু*নের বর্ণনা।মধুরোড ৭/৫ পল্লিগীতি ফ্যাক্টরিতে চারটি নৃ*সংশ খু*ন হয়।তন্মধ্যে একজন প্রায় ২৮ বছর বয়সী যুবক, অন্যজন প্রায় ২৪-২৫ বছর বয়সী এক যুবতী, আর দুজন পঞ্চাশার্ধ ব্যক্তি। তাদের প্রত্যেকেরই এক চোখে গর*ম রড ঢোকানো হয় এবং অন্য চোখ পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়। সারা শরীরে অসংখ্য ক্ষ*ত এবং সেই ক্ষ*তের উপর লবন মরিচের প্রলেপ লাগানো। হাতে সম্ভবত হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। প্রত্যেকের আঙ্গুল কে*টে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সবারই জিব কে*টে নেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি তাদের সকলের কলিজা বের করে নেওয়া হয়েছে আর কলিজা থেকে শুরু করে কাটা জিব, আঙ্গুল ইত্যাদি তাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছিলো।
চারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হামিদই ওকে খেতে দেয়নি সেসব কলিজা। সিফাতের মৃ*তদেহ নিয়ে সেদিন বেড়িয়ে এসেছিলো সেখান থেকে। হামিদ ছিলো সদ্য যৌবনে পা দেওয়া যুবক আর শত্রুপক্ষের সকলে বৃদ্ধ আর স্মৃতি মেয়ে। তারা পেরে ওঠেনি হামিদ আর চারুর সাথে। তারা ভাবেইনি চারু এখান থেকে মুক্তি পেতে পারে। তাই ব্যাপারটা সহজেই হয়ে গেছে। ভয়ংকরতম শাস্তি দিয়েছে পাপীদের।
– মা, আমার এক বান্ধবী হাসপাতালে আছে। আমি তাকে দেখতে যেতে চাই।
– সেই বান্ধবী যার ফুড পয়জনিং হয়েছে?সে তো কালই বাসায় চলে আসবে,বাসায় দেখতে যেও।এখন নিজের হোমওয়ার্ক শেষ করো।
চারুর কথায় পুতুল মন খারাপ করে বিরবির করে উচ্চারণ করলো,
– আমার বাবা থাকলে আমাকে ঠিকই যেতে দিতো।
চারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটা ব্ল্যাকমেইলে প্রচন্ড পারদর্শী। কিছু হলেই সিফাতের কথা টেনে এনে চারুকে দুর্বল করে দেয়।
– যাও তৈরি হয়ে নাও।

পুতুলকে বান্ধবীর সাথে বসিয়ে রেখে এসেছে চারু। হাসপাতালে বেশ সুন্দর একটা বাগান আছে।যান্ত্রিক এই শহরে একটু মুক্ত বাতাসের খোজে এখানে এসে দাঁড়ালো সে।কিছুটা দুরেই দাঁড়িয়ে ছিলো এক পুরুষ অবয়ব। তাকে দেখে এক মুহুর্তের জন্য চমকালো চারু কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো,শিহাব কাছাকাছি এগিয়ে এলো চারুর।এই লোকটাই একমাত্র ব্যক্তি যে নিঃস্বার্থভাবে চারুকে এতদিন যাবত ভালোবেসে এসেছে।চারুর দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষের মধ্যে বোধহয় এই মানুষটাই অন্যতম।চারু সাথে সাথে শিহাবের পা ছুয়ে সালাম করতেই শিহাব ভড়কে গেলো,কোনোমতে উচ্চারণ করলো,
-আরে কি করছো তুমি?
-তেমন কিছুনা। আপনি আমার বেশ সম্মানের জায়গা তাই সম্মান দেখাচ্ছিলাম।
-এভাবে?সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারোর সামনে ঝুকতে নেই চারুলতা।যাই হোক,তুমি এখানে?
-মেয়েকে নিয়ে এসেছিলাম।তার বান্ধবী অসুস্থ তাই দেখতে এসেছি।
– কোন ক্লাসে পড়ছে মেয়ে?
– ক্লাস ফাইভ।
শিহাব একটু অবাক হয়ে তাকালো চারুর দিকে।ক্লাস ফাইভ?তারমানে এইটা চারুর নিজের মেয়ে নয়।আগের স্বামীর সন্তান বোধহয়।
– হাসবেন্ড কেমন আছে তোমার?
– সে আর নেই।
– মানে?
চারু উত্তর দেয়না। শিহাব কিছুটা জোড়াজুড়ি করায় খন্ডাংশ তাকে জানিয়ে দ্রুতই বিদায় নিলো সেখান থেকে। শিহাব এখনো স্তব্ধ, সে কখনোই চায়নি চারুর স্বামীর মৃত্যু। তবে কি সৃষ্টিকর্তা শিহাবের জন্যেই তার স্বর্ণলতাকে আবার ফিরিয়ে দিলেন?এত বছরের ভালোবাসা কি তাহলে এইবার পূর্ণতা পেতে চলেছে? কিন্তু শিহাবের এমন কেনো মনে হলো চারুলতা এখনো তাকে নিজের করে নেবেনা।তবে কি আবারও আলাদা হতে চলেছে তারা?শিহাব নিজ মনে প্রতিজ্ঞা করলো, এইবার যাই হয়ে যাক না কেনো,স্বর্ণলতাকে আর হারাতে দেবেনা সে। কিছুতেই দেবেনা। আজ থেকেই শুরু হলো তার সত্যিকারের ভালোবাসার পরিক্ষা!

★★★সমাপ্ত★★★