আমি সেই চারুলতা পর্ব-৪২+৪৩

0
261

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ৪২ (শেষ পর্বের প্রথম অংশ)
_________________________

মেঘে ঢেকে আছে সম্পূর্ণ আকাশ। আকাশে বাতাসে কান্নার ধ্বনি। ফাতেমার বাড়ির লোকেরাই কান্না করছে অথচ বেঁচে থাকতে কেউ কখনো কোনো খবর নেয়নি তার। হামিদের কালো পদ্মের গায়ে আজ সাদা কাফন। হামিদ বলেছিলো সাদা নাকি কালো গায়ের রঙে মানাবেনা কিন্তু ফাতেমাকে মানাচ্ছে। কি ভীষণ শুভ্র লাগছে তাকে! নিষ্পাপ পবিত্র কালো পদ্ম আজ সাদায় ঢেকে গেছে। হামিদ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে চৌকিতে। এখনো যেনো বিশ্বাস হতে চায়না তার, কেনো সে পদ্মের নাম মুখে এনেছিলো? ফাতেমাকে পদ্মের কথা না বললে তো আজ সে বেঁচে থাকতো। তবে কি ফাতেমা হামিদের ভালোবাসার জন্য এতটাই মরিয়া ছিলো যে নিজের জীবন ঝুকিতে ফেলতে সে দ্বিতীয়বার ভাবেনি? মাথাটা ভীষণ ফাকা ফাকা লাগছে, পানিতে ডুবে ফাতেমার মুখ সাদা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে কিন্তু এই সাদা তো হামিদ চায়না, সে তো তার কালো পদ্মই ফেরত চায়। এই সাদার কোনো প্রয়োজন তার নেই। তবে কেনো এতদিন অবহেলা করে এসেছে তাকে?
লতা কান্না করে চলেছে ফাতেমার কাছে যাওয়ার জন্য। চারু থামাতে পারছেনা তাকে। এমনকি হামিদও পারছেনা। যেই মেয়ে বাবা বলতে পাগল আজ সে বাবার কাছেই থাকতে চায়না। সন্তান যতই বাবার ভক্ত হোক না কেনো দিন শেষে মা-কে তার চাই-ই চাই। এইটুকু মেয়ে কিভাবে থাকবে মা ছাড়া?
ফাতেমাকে যখন পানি থেকে তোলা হয় তখন কি সুন্দর করে সেজে ছিলো সে। হামিদ রাতে ঠিক যেভাবে বলেছিলো ঠিক সেভাবেই সেজেছিলো ফাতেমা। কম ছিলো শুধু পদ্মফুল। তবে ফাতেমার কি আদেও পদ্মফুলে সাজার প্রয়োজন ছিলো? হামিদের এখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, “আমি ক্যান সাজতে বলছিলাম তোমারে পদ্মফুলে? আমি আগে ক্যান বুঝি নাই তুমিই আমার পদ্মফুল!” কিন্তু বলা হয়না, শোনার জন্য হামিদের কালো পদ্ম কই? হামিদ বাইরের কোনো পরপুরুষকে ভেতরে আসার অনুমতি দেয়নি। ফাতেমা অতিপ্রয়োজন না হলে কখনো বাইরের পুরুষের সামনে যেতো না সেখানে তার মৃত্যুর পর কিভাবে পরপুরুষ তাকে দেখতে পারে? আর তাছাড়া হামিদের কালো পদ্ম অন্য কেউ দেখবেই বা কেনো? হামিদ ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ফাতেমার খাটিয়ার কাছে। চুপচাপ বসে তার একহাত ধরে বললো,
– তুমি তো ভারি অভদ্র মাইয়া। একদমই আমার কথা শুনো না। আমি কি তোমারে কইছি আমারে রাইখা যাইতে? এত সাহস কই পাও যে তুমি আমারে রাইখা না ফেরার দুনিয়ায় চইলা যাও। একটুও ভয় হইলো না তোমার?
হামিদ নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলে। সে নিজেই তো বলেছিলো ফাতেমাকে ম*রে যেতে। ফাতেমা মরে গেলে ও অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে পারে, তবে আজ কেনো এত তীব্র অনুভূতি হচ্ছে? কেনো মনে হচ্ছে এই কালো মেয়েটা ছাড়া আর কাউকে জীবনে আনা সম্ভব না? তবে কি মানুষের প্রকৃতিই এমন, থাকতে মূল্য দেয়না অথচ হারিয়ে গেলে পাগলপ্রায় দশা হয়। কিন্তু এখন যে কাদতে কাদতে মরে গেলেও মানুষটা আর ফিরে আসবেনা। তীব্র অভিমান, অপূর্ণ ভালোবাসা আর একরাশ অবহেলা নিয়েই যে সে বিদায় নিলো। আর দিয়ে গেলো আকাশ সম ভালোবাসা যার মর্মতা হামিদ কখনো বুঝতেও পারেনি।
– ফাতেমা তুমি আমারে জিজ্ঞেস করছিলা না আমি তোমারে ভালোবাসি কি না? তহন উত্তর দেই নাই, উত্তর তো জানতামই না। এহন শুনো আমি ভালোবাসি তোমারে। তুমি বলছিলা না আমার ভালোবাসার জন্য তুমি সব করতে পারবা? এহন উঠো। আমি তো বলছি আমি তোমারে ভালোবাসি, এইবার তুমি নিজের কথা রাখো।
ফাতেমা উত্তর দেয়না, উঠেও না। হামিদের মনে হচ্ছে তার যেনো হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসছে,
– কি হইলো? উঠো না ক্যান? একবার উঠো, এতদিন করা সব অবহেলার প্রায়শ্চিত্ত করমু আমি। রানীর হালে রাখমু, অনেক ভালোও বাসমু। উঠো তুমি। তোমারে মাটি দিতে দিমু না আমি। আমার কালো পদ্ম আমার কাছেই থাকবো। তুমি তো আন্ধারে ভয় পাও, তুমি ক্যামনে ওই অন্ধকার ঘরে একলা থাকবা?
– আদেও কি কোনো লাভ আছে? থাকতে তো তাকে কখনো ভালোবাসনি। প্রতিনিয়ত অবহেলা করে এসেছো আর এখন তার যখন ফিরে আসার পথ নেই তখন ভালোবাসা দেখাচ্ছো? এইসব যা তা অভিনয় বন্ধ করো। আমার ভাবতেও ঘৃণা হয় তুমি আমার ভাই। তুমি মেরে ফেলেছো ভাবিকে। তোমার অবহেলা দিয়ে মেরেছো। এমনকি মৃত্যুর আগের দিনও যা তা শুনিয়েছো তাকে। তোমার আর নাজিমুদ্দিনের মাঝে কি পার্থক্য রইলো বলতে পারো? দুজনেই এমন নারীদের খু*ন করলে যারা তোমাদের নিজেদের জীবন দিয়ে ভালোবাসে। আসলে রক্ত খারাপ তো, মানুষ কিভাবে ভালো আশা করা যায়?(চারু)
– তুই অন্তত আমারে ভুল বুঝিস না৷ তুই ভুল বুঝলে আমি কই যামু। বিশ্বাস কর, আমি সত্যিই চাই নাই এমনটা হোক। আমি চাই নাই সে এইভাবে চইলা যাক।
– সে মা*রা যাক তা চাওনি অথচ তাকে কোনোদিন সুখে বাঁচতেও দাওনি। তোমরা সব পুরুষ এক। ভালোবাসার মূল্য দিতে জানোনি। শেষ কয়েকটা দিন তুমি ভাবির সাথে কেমন আচরণ করেছো তার সবটাই লক্ষ্য করেছি আমি। কেনো করেছিলে এমন? বিন্দিয়ার জন্য? তাহলে এখন কেনো ভান করছো? রাস্তা তো পরিষ্কার হয়েই গেলো তাই না?
অনেকক্ষণ যাবত মাথায় কথাগুলো ঘুরছিলো চারুর। হামিদকে একা পেয়ে কথাগুলো বলতে সে ভুললো না। মনের কথা গুলো বলার এরচেয়ে ভালো সময় কি হতে পারে? নিজের ভুল উপলব্ধি করতে হবে হামিদকে। যাকে বেঁচে থাকতে ভালোবাসেনি, মৃ*ত্যুর পর কিসের অনুভূতি তার জন্য? চারু দাঁড়ায় না সেখানে। হামিদকে আরো কিছু কথা শুনিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।

★★★

ফাতেমার কবরে মাটি দেওয়া হয়েছে ঘন্টাখানেক আগে। সবাই চলে গেছে কবরস্থান থেকে শুধু কবর থেকে কিছুটা দূরে বসে আছে হামিদ। গাছের সাথে হেলান দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফাতেমার কবরের দিকে। হামিদের কথায় মনোরমার পাশে কবর দেওয়া হয়েছে তাকে। অনেকক্ষণ একটানা চুপচাপ বসে থাকার পর হামিদ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো মনোরমার কবরের পাশে,
– কেমন আছো মা? আমি কিন্তু ভালো নাই জানো। আমি মা ছাড়া যতটা কষ্ট করছি আমার মাইয়াটারে তেমন কষ্ট পাইতে হইবো। মা ছাড়া কি বাঁচা যায় কও? আমার মাইয়াটা যতটা না বাচ্চা তার চেয়ে বেশি বাচ্চা ছিলো আমার বউটা। ও প্রচন্ড বোকা জানো মা। কিচ্ছু ঠিকমতন করতে পারেনা নইলে গ্রামের মাইয়া হইয়া কেউ কি পানিতে ডুইবা মরে বলো? পানিরে নাকি ভয় পাইতো, কি অদ্ভুত না! সেই ছোটবেলা থেইকা কত নদীতে ডুবাইছি তার হিসাব নাই। সে না অন্ধকারেও খুব ভয় পায়। একদম সহ্য করতে পারেনা অন্ধকার কিন্তু আমিই তার জীবনটা অন্ধকারে ঢাইকা দিছিলাম। তারে একটা সুন্দর জীবন আমি দিতে পারতাম মা কিন্তু আমি দেই নাই। তোমার পোলা হইয়াও একটা মাইয়ারে আমি অনেক কষ্ট দিছি। ওরে আমার আর চারুর মতো কইরা দেইখা রাইখো মা। ও-ও তো তোমার মাইয়ার মতনই। অন্ধকারে একা থাকতে ভয় পায়। তুমি সবসময় ওর সাথে সাথে থাইকো আর ওরে বইলা দিও, আমি অসময়ে ভালোবাসছিলাম আমার কালো পদ্মরে। তার শূন্যতা আমারে ভালোবাসতে শিখাইছে। ভালো তো তারে আগেই বাসতাম মা, কিন্তু আমি বুঝি নাই। সে আমারে এতই ভালোবাসতো, তার ভালোবাসায় আমি এতটাই পরিপূর্ণ ছিলাম কহনো ভাবিই নাই আমারও তারে ভালোবাসা উচিত। সেও ভালোবাসা চায়, আর আইজ যহন বুঝলাম তহন অনেক দেরি হইয়া গেলো। কিন্তু কি লাভ! ও তো জানবো না মা। চারু ঠিকই কয় জানো, আমি আসলে ওর যোগ্যই ছিলাম না। এত ভালোবাসা কি কোনো স্বাভাবিক মানুষ পায়ে ঠেলতে পারে কও? আমার না অনেক কান্না পাইতাছে মা কিন্তু আমি পারতাছি না। বারবার মনে হইতাছে ওর জন্য কান্দনের যোগ্যতাও আমার নাই। ক্যামনে থাকবো কও, ঝগড়া লাগলেই তো কইতাম তুই মইরা যা। তুই মরলে আমি বাঁচি। এহন কোন মুখে তার বিরহে চোখের জল ফেলমু। আমি সময় থাকতে ক্যান বুঝলাম না মা? আচ্ছা এইটা কি স্বপ্ন হইতে পারেনা? একটা বার আমারে সুযোগ দেওয়া যায়না ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করনের? কও না মা, যায় না? একবার খালি সুযোগ পাই, আর কোনোদিন আমি তারে অবহেলা করমু না।
হামিদ চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করতে থাকে এইগুলো যেনো শুধুই এক স্বপ্ন হয় আর এখনি ভেঙে যাক এই সর্বনাশা ঘুম। কিন্তু ঘুম ভাঙেনা। এইসবও স্বপ্ন হয়না। চোখে বাধ দিয়ে রেখেছে ঠিকই কিন্তু অন্তরের বাধ ভেঙে গুড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। সে হারিয়ে ফেলছে নিজের কালো পদ্মকে। এমন মহামূল্যবান কালো পদ্ম, যে কালো পদ্ম তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে গেছে আজীবন। সন্ধ্যা ছাড়িয়ে রাত নেমেছে ধরনীর বুকে। হামিদ কুপি জালিয়ে রাখলো কবরের পাশে,
– অন্ধকারে ভয় লাগে না তোমার? আলো দিলাম, ভয় পাইয়ো না। আমি আছি।
হামিদের আরো একবার আফসোস হয়, বেঁচে থাকতে সে কখনো ফাতেমাকে বলেনি, ভয় পেয়ো না, আমি আছি। অথচ ফাতেমা বোধহয় প্রতিবার ভয় পেলে হামিদের কাছে আসতো এই কথাটাই শুনতে। হামিদ কতক্ষণ এভাবে বসে ছিলো সে নিজেও জানেনা কিন্তু সিফাত যখন তাকে নিতে এলো তখন প্রায় মধ্যরাত।

হামিদ ঘরে প্রবেশ করতেই বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠলো। কি ভীষণ খালি খালি লাগছে ঘরটাকে। কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। লতাকে সম্ভবত চারু নিয়ে গেছে। হামিদ নিজের শার্টটা খুলে বিছানায় ছুড়ে মারলো। কোনোমতে বিছানায় বসে মাথার চুলগুলো দু’হাতে চেপে ধরলো। এ কেমন অস্থিরতাবোধ! হামিদের ইচ্ছে হচ্ছে ওর আয়ুর অর্ধেকটা দিয়ে হলেও যেনো ও বাঁচিয়ে তোলে ফাতেমাকে। সৃষ্টিকর্তা কেনো এমন সুযোগ দিলো না? কেনো নিজ ইচ্ছায় একজনের আয়ু অন্যজনকে দেওয়া যায়না। কালো পদ্মের এই হাজার হাজার স্মৃতি কিভাবে ভুলে যাবে সে? কেনো শুকিয়ে গেলো পদ্মফুল? অবশ্য শুকোনোরই কথা, পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান পদ্মটি ছিলো হামিদের। পৃথিবীর একমাত্র কালো পদ্ম, কিন্তু কালো বলে সেই পদ্মকে অবহেলা করেছে হামিদ। সঠিক জিনিসের মূল্য সে দিতে পারেনি তবে পদ্ম কেনো শুকাবে না?
ঘরে কুপি জ্বলছে। মৃদুমন্দ আলো! হামিদের মনে পড়ে কাল রাতের কথা, কালও ফাতেমা ছিলো এখানে আর আজ সে শুধুমাত্র এক স্মৃতি। অন্ধকারে ভয় পেয়ে বাতি না নেভানোর অনুরোধ করেছিলো সে। ফাতেমা কিভাবে থাকবে সেই অন্ধকার কবরে? হামিদ মনেপ্রাণে চেষ্টা করছে ঘুমিয়ে যেতে। মনে হচ্ছে যেনো ঘুম ভাঙলেই দেখা যাবে সব স্বপ্ন আর ফাতেমা জাগিয়ে তুলবে তাকে। আর একবার ফাতেমা তাকে জাগিয়ে দিক, আর কখনো ফাতেমাকে অবহেলা করবেনা সে। হামিদ কোনোমতে শুয়ে পড়লো তবে ঘুম আসছেনা। বিছানাটা কেমন খালি খালি লাগছে। কাল রাত অবধি এখানে ওর স্ত্রী ছিলো, ওর মেয়ে ছিলো কিন্তু আজ সে একা। কি ভীষণ দুর্বিষহ রাত এইটা। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফাতেমা আবদার করতো তাকে বুকে নিয়ে ঘুমানোর জন্য। আজ কেউ আবদার করছেনা। কেনো করছেনা? হামিদ তো সবসময়ই ফাতেমার কথা শুনতো তবে আজ যখন ও নিজ থেকে ফাতেমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতে চাইছে তখন সে নেই। হামিদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ফাতেমার বালিশখানি। এখনো ফাতেমার গন্ধ মিশে আছে এই বালিশে। মনে হচ্ছে যেনো ফাতেমাকেই জড়িয়ে ধরে আছে সে। হামিদ চোখ বন্ধ করতেই চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়লো। হামিদ আজ কাদেনি। পুরুষ মানুষদের তো কাদতে নেই কিন্তু নিজের সাথে কতটা যুদ্ধ করা যায়? দিন শেষে এসে সে হেরে যায় নিজেরই কাছে। চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝরে চলেছে। হামিদের চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে। বালিশে মুখ গুজে কেদে চলেছে হামিদ। তার সহ্য হচ্ছেনা এ বিচ্ছেদ। কালো পদ্মের বিরহে পাগলপ্রায় হয়ে গেছে সে।
কালো পদ্ম কেনো বিরহের নাম,
কালো পদ্ম শুধু তোমারি লাগি,
আমার সুখ আজ হারাম।
হামিদ হাজার চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছেনা। হামিদ আসার সময় কিছু ঔষধপত্র নিয়ে এসেছিলো। গ্রামে ফার্মেসি পাওয়া যাবেনা, কারোর কিছু হলে লাগতে পারে। হামিদ সেই ঔষধের বক্সে তন্নতন্ন করে খুজে চলেছে ঘুমের ঔষধ। বরাবরের মতো এবারেও হামিদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন, পেয়েও গেলো সে ঘুমের ঔষধ। কোনোকিছু না ভেবেই দুটো ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিলো। সে এখন শুধু একটু ঘুমাতে চায়। বক্সটা ব্যাগে রেখে উঠতেই যাবে এমন সময়েই চোখ পড়লো একটি ডায়রিতে। ডায়রিটা ফাতেমার। এইটা নিয়ে কখনো বিশেষ কোনো কৌতুহল দেখায়নি হামিদ তবে আজ বেশ দেখতে ইচ্ছে হলো। এখানে কি হামিদ সম্পর্কে কিছু বলেছে ফাতেমা? ফাতেমার অবশ্য ডায়েরি লেখার কথা নয়, সপ্তম শ্রেণী অবধি পড়াশোনা করেই পড়াশোনার ইতি টেনেছে সে। আবার লিখতেও পারে। হামিদ ডায়েরিটা খুললো। বেশ সুন্দর হাতের লেখা, সপ্তম শ্রেনীর ছাত্রীর হাতের লেখা এত সুন্দর তা জানা ছিলো না হামিদের। প্রথম পাতাগুলো খালি, মাঝের কিছু পাতায় লেখা ফাতেমার পারিবারিক সমস্যা গুলো আর তারপর আবার ফাকা। তারপর আবার কিছু পৃষ্ঠা পরে আরেকটা লেখা। হামিদকে উদ্দেশ্য করে লেখাটা,

সম্মোধন করে কিছু লিখছি না আপনাকে। আসলে কি সম্মোধন করবো ভেবে পাচ্ছিনা। আপনাকে কি প্রিয় সম্মোধন করা উচিত? কিন্তু আপনি তো শুধুই আমার প্রিয় নন। প্রিয়র চেয়েও আরো বেশিকিছু। আপনি আমার নিজস্ব পুরুষ। অবশ্য কি সম্মোধন করলাম না করলাম তাতে কিছু যায় আসেনা কারণ আপনি কখনো এই চিঠিটা পড়বেনই না। আমি জানি আমি আপনার কাছে বিরক্তিকর তবুও আপনি আমার কাছে ভালোবাসার চাদরে আবৃত এক পুরুষ যার জন্য আমি বিনা দ্বিধায় নিজের জীবনটা দিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করবো না। আপনি যদি কখনো এই চিঠিটা দেখেন আমি কিন্তু বেশ লজ্জা পাবো। একটা কথা জানেন, আমি যতই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি না কেনো, লেখার জন্য কিন্তু চলিত ভাষাই উত্তম। আমি জানি এইটা দেখলেও আপনি হাসবেন। আপনি আমার জন্য রূপকথার রাজপুত্রের চেয়ে কম নন জানেন!
ছোটবেলা থেকেই আমি খুব বোকাসোকা আর শ্যামবর্ণা একটি মেয়ে। আমাকে অবশ্য কেউ শ্যামবর্ণা বলে না। সকলেই কালো বলে। আপনিও বলেন। ছোট থেকেই নিজের চেয়ে অধিক সুন্দরী মেয়ে দেখলে আমার হিংসে হতো। আমার মনে হতো সৃষ্টিকর্তা আমার প্রতি অন্যায় করেছেন। তিনি চাইলে আমাকেও সুন্দরভাবে বানাতে পারতেন। গায়ের রঙ কালো হলেও আমি কিন্তু রাজপুত্রের মতোই স্বামী চেয়েছিলাম কিন্তু রাজপুত্র তো দূর, আমাকে কেউই বিয়ে করতে চাইতো না। বিয়ের জন্য ছেলে দেখা শুরু হয় সেই ক্লাস সেভেনে। তখন থেকেই পড়াশোনা বন্ধ। ভাবির কথায় ভাই আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিলো। ছোটবেলা থেকেই ভালো ছাত্রী ছিলাম। শিক্ষকদের প্রসংশাও পেতাম কিন্তু ভাবির তা পছন্দ ছিলো না। ভালো গানও করতাম কিন্তু ভাবি গাইতে দিতো না। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ভাবি আমাকে পছন্দ করতোনা। আমিও ভাবতাম, সব ভাবিরাই বুঝি ননদকে পছন্দ করেনা। ঠিক করেছিলাম বিয়ের পর বরকে গান শোনাবো কিন্তু আপনি কখনো আমার দিকে তাকানোর সময়ই পাননি আর গান শুনবেন। বছরের পর বছর পাত্র দেখার পর ভাই যখন আপনার ছবি আমার হাতে দিয়া বললো, আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম আপনার দিকে। কোনো মানুষ এতটা সুন্দর হতে পারে? আর এই সুন্দর ছেলে আমার মতো কালো একটা মেয়েকে বিয়ে করবে? আদেও সম্ভব কি? বিয়েটা হয়ে গেলো আমাদের। আমাকে দেখে আপনি সারারাতও বাসায় এলেন না। বোকা হলেও সেইদিন বুঝেছিলাম আমার ভাগ্যে স্বামীর ভালোবাসা নেই। তবে মিথ্যা বলবো না, নিজেকে যতটা অভাগা ভেবেছিলাম ততটা ছিলাম না। আপনি আমাকে পছন্দ করতেন না, ভালোও বাসতেন না তাও কখনো অসম্মান করেননি। গায়ে হাত তোলেননি। কখনো পরনারীর প্রতি আসক্ত ছিলেন না। এই ব্যাপারেই আমি সবচেয়ে খুশি ছিলাম। আপনি আমার সাথে একটু ভালো আচরণ করলেও আমার কাছে তা ঈদের খুশির মতো মনে হতো। আমার জীবনের প্রতিটা ক্ষণে আপনাকে ভালোবেসে এসেছি আমি। আজীবন বাসবোও। আপনাকে শতভাগ ভালোবাসি, বিশ্বাস করি ঠিকই কিন্তু আপনার ভাগ আমি কিভাবে কাউকে দেবো বলুন। আমার মৃত্যুর পর আপনি বিয়ে করবেন সেটা ভাবলেও আমার কলিজা শুকিয়ে যায়। আমার নিজস্ব পুরুষ কিভাবে পরনারীর কাছে সুখ খুজবে? যার প্রথম ও প্রতিটা স্পর্শ আমি ছিলাম সেখানে অন্য কারোর রাজত্ব কিভাবে মানবো আমি? আপনি যে আমার নিজস্ব পুরুষ। আমার মৃ*ত্যু সহজ, কিন্তু আপনার ভাগ কাউকে দেওয়া কঠিন। ভয়ানক কঠিন!

হামিদ স্তব্ধ হয়ে বারবার পড়ে চলেছে চিঠিটি। কি সুন্দর করে ফাতেমা লিখেছে নিজের মনোভাব। ইশ! দুই বছরে একবারও তার গানটা শোনা হলোনা। তার শখের ইচ্ছে পুরণ হলো না। শখের পদ্মফুলের মূল্য দেওয়া হলো না। হামিদ বিরবির করে কোনোমতে উচ্চারণ করলো,

– আমার শুকনা নদীতেও পদ্মফুল ফুটছিলো কিন্তু আমি তার মূল্য দিতে পারি নাই।

★★★

সকাল থেকেই চিৎকার করে কান্না করে চলেছে লতা। চারু হাজার চেষ্টা করেও তাকে থামাতে পারছেনা। রাতে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমানোর কারণে হামিদের ঘুম ভাঙলো দেরিতে। বাসায় এখনো বেশ কিছু প্রতিবেশিরা আছেন। তারা চারুকে চুলোয় আগুন ধরাতে নিষেধ করেছে। মৃ’ত বাড়িতে চারদিন অবধি আগুন জ্বালাতে হয়না। চারু প্রতিবাদ করে বলেছিলো, মনোরমার মৃত্যুর পরেও আগুন সে জ্বালিয়েছিলো। কই কিছু তো হয়নি। তখন গ্রামবাসী নাজিমুদ্দিনের নতুন বিয়ের খোড়া যুক্তি দিলো। চারু কেমন যেনো প্রতিবাদের শক্তি পাচ্ছেনা। মনটা তার এমনিতেও আজ বিশেষ ভালো নেই। ফাতেমার সাথে আর কোনোকালেই এতটা সখ্যতা গড়ে ওঠেনি কিন্তু তাও সে ভালোবাসতো ফাতেমাকে। বিশেষ করে শেষ কিছুদিন যাবত ফাতেমা চারুকে নিজের সন্তানের মতোই যত্ন করেছে, ভালোবেসেছে। এই সহজ সরল মেয়েটার মায়ায় পড়ে গিয়েছিলো চারু নিজেও। কত হাজার বার ফাতেমার পক্ষ নিয়ে হামিদকে কথা শুনিয়েছে তার হিসেব নেই চারুর নিজেরও। তার উপর লতার কান্নাকাটি। টুনির মা দুধ গরম করে এনেছে লতার জন্য। চারু হাজার চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারছেনা। কিছুক্ষণের মাঝেই হামিদের ঘুম ভাঙে। মেয়ের কান্নার আওয়াজে মুহুর্তেই ছুটে আসে সে। হামিদকে দেখেই লতা ঠোঁট ফুলিয়ে তার কোলে গিয়ে একরাশ নালিশ জানাতে থাকে। তার ভাষা অবশ্য বুঝতে পারেনা হামিদ। ফাতেমা থাকলে নিশ্চয়ই বুঝতো।
– কি হইছে আমার আম্মাজানের? কে বকা দিছে? একবার কও তারে মাইর দিয়া দিমু।
– আম মাম মাম্ম ম্মাম্মমা মামস আমাম্ম
লতার এই অর্থহীন কথার কিছুই বুঝলো না হামিদ। হঠাৎই কেনো যেনো মনে হলো লতা ফাতেমাকে খুজছে। দীর্ঘ চব্বিশ ঘন্টারও বেশি সময় মেয়েটা মা ছাড়া আছে। হামিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার মনে পড়ে যায় চারুর সেদিনের বলা কথাটি। “ভাবির কিছু হয়ে গেলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট কিন্তু তোমার মেয়েরই হবে।” সেদিন কথাটা তেমন বিশেষ পাত্তা দেয়নি হামিদ তবে আজ এভাবে তা ফলে যাবে তা কখনো কল্পনাও করেনি সে।
– মা আসবে আম্মাজান। তুমি খাইয়া নাও, তুমি খাইলেই তোমার মা চইলা আসবো।

কাল থেকে সমস্ত ঘটনাই লক্ষ্য করে চলেছে বিন্দিয়া। বেশ খারাপও লাগছে তার৷ ফাতেমাকে সে পছন্দ করতো না কিন্তু তাই বলে সে কখনোই চায়নি ফাতেমা মা’রা যাক। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে হামিদের বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে। মায়ের জন্য কতটা পাগল হয়ে আছে মেয়েটি। আরো বেশি খারাপ লাগছে হামিদের চোখে ফাতেমার প্রতি ভালোবাসা দেখে। কই আগে তো কখনো দেখেনি।
নিজের এই মনোভাবে নিজেকেই নিজে ধিক্কার জানালো বিন্দিয়া। ছিহ! কি জ’ঘ’ন্য চিন্তাভাবনা। কই ও তো এমন ছিলো না। তবে আজ ওর কি হয়ে গেলো? ভালোবাসা কি ওকে এতটাই নীচে নামিয়ে দিলো যে একজন মৃ*ত ব্যক্তিকেও ও হিংসে করছে।
এত মানুষের ভীড়ে কেউই বিন্দিয়াকে আলাদাভাবে খেয়াল করেছে না। হামিদ তো আরো আগে করছেনা। এইটাই বোধহয় ভালো হয়েছে, হামিদের চোখে চোখ রাখার সাহস আজ তার নেই। বিন্দিয়া অকারণেই নিজেকে এইসবের জন্য দায়ী করছে। আবার পরক্ষণেই মনে পড়ছে ওরই বা কি দোষ? ও তো কিছু করেইনি।

★★★

ফাতেমার মৃত্যুর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও হামিদ যেনো কেমন হয়ে গেছে। ঠিকঠাক বাসায় আসেনা, খাবার খায়না, দিনের বেশির ভাগ সময়েই কবরস্থানে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে ফাতেমার কবরের দিকে। মাঝে মাঝে আবার বলে উঠে,”তুমি ভয় পাইয়ো না, আমি আছি।” মাঝে মাঝে সেই গাছে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে সে। চারু, সিফাত কিংবা হিমেল তাকে সেখান থেকে তুলে আনে। মাঝে মাঝে নিজে নিজে কথা বলে। এমনভাবে যেনো ফাতেমার সাথেই কথা বলছে সে। চারু চিন্তিত হয়! হামিদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। হামিদের জন্য এখানে থাকাটা উচিত নয়। চারু হিমেলকে বলেছিলো হামিদকে নিয়ে শহরে চলে যেতে কিন্তু হামিদ রাজি হয়না। প্রধানত দুইটা কারণে রাজি হয়না। প্রথমত, চারুকে একা রেখে সে যেতে চায়না আর দ্বিতীয়ত, ফাতেমা একা থাকতে ভীষণ ভয় পায়। তাকে একা রেখে কিছুতেই যাওয়া যাবেনা। আর শহরের বাড়িটির প্রতি কোনায় ফাতেমার হাজার হাজার স্মৃতি। সেই স্মৃতি নিয়ে কিভাবে বাচবে হামিদ? স্মৃতি সবসময়ই মানুষকে কাঁদায়, সেটা হোক সুখের কিংবা দুঃখের। আর এত সুখ স্মৃতির মাঝে হামিদ কিছুতেই থাকতে পারবেনা।
কিন্তু হামিদের এ অবস্থাও চারু মানতে পারেনা। হিমেল আর সিফাতও হামিদকে নিয়ে চিন্তিত। এই কয়দিনে বেশ শুকিয়ে গেছে ছেলেটা। রাত জাগার ফলে চোখের নীচে কালো দাগ পড়েছে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেনা। চুল দাড়িও বেশ বড় হয়েছে। একদিন চারু খুব কৌশলে হামিদের ঘুমের মাঝে চুল দাড়ি কেটে দিয়েছিলো। চারুর এই বাচ্চামিতে ফাতেমার মৃত্যুর পর প্রথম হেসেছিলো হামিদ। অবশ্য সে মৃদু হাসি সাময়িকই ছিলো। তারপর আবার যেমনটা তেমনই।

সবসময়কার মতো কুপি জালিয়ে কবরস্থানে বসে ছিলো হামিদ। ফাতেমার সাথে আজ নিজের সুখের ভাগ করতে এসেছে। হামিদ ধীর পায়ে ফাতেমার কবরের পাশে গিয়ে বসে বললো,
– জানো ফাতেমা, আজ আমার মাইয়া প্রথমবারের মতো আমারে বাবা কইয়া ডাকছে। আমার মাইয়াটা তোমাকে অনেক মিস করে জানো? সারাক্ষণ খালি কান্নাকাটি করে। তার কান্নার ভয়ে বাসায় যাইতে পারিনা আমি। তুমি খুবই অসভ্য একটা মাইয়া। আমার ওপর অভিমান কইরা এইভাবে চইলা গেলা? একবারও নিজের মাইয়াটার কথা ভাবলা না?
ফাতেমা উত্তর দেয়না। সেই শক্তি আর এখন নেই ফাতেমার। হামিদ চুপচাপ ফাতেমার কবরের পাশে শুয়ে পড়লো। ফাতেমা থাকলে নিশ্চয়ই বলতো, “আমারে একটু বুকে নিয়া ঘুমাইবেন?”
হামিদ ঠিক কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে নিজেও জানেনা কিন্তু তার ঘুম ভাঙে চারুর ডাকে। হামিদ ভেবেছিলো প্রতিবারের মতো এবারেও চারু রাগ দেখিয়ে বলবে, যাকে জীবিত অবস্থায় ভালো বাসোনি মৃত্যুর পর তার প্রতি আদিক্ষেতা দেখাতে হবেনা তোমার। কিন্তু চারু এইবার এমন কিছুই বললো না। চুপচাপ বাসার দিকে নিয়ে যেতে লাগলো তাকে।
– তুমি যে এভাবে সবসময় কবরস্থানে এসে বসে থাকো সেইটা কি ঠিক?
– জানিনা। সব কেমন তালগোল পাকায়া যায়। মনে হয় আমি পাগল হইয়া গেছি। আমি কি সত্যিই পাগল হইয়া গেছি রে চারু?
– না তুমি পাগল হওনি। পাগল কখনো বোঝেনা সে পাগল হয়ে গেছে। এখনো সময় আছে এসব কিছু থেকে বের হয়ে এসো নইলে পাগল হয়ে যেতেও সময় লাগবেনা তোমার।
– পাগলই বরং হইয়া যাই। পাগলের তো কোনো দুঃখ কষ্ট নাই। এই কষ্ট নিয়া আর থাকতে পারতাছি না। অপরাধবোধে শেষ হইয়া যাইতাছি আমি। কখনো ভালো আচরণ করি নাই তার সাথে। সে হাজার ভালোবাসার শর্তেও তারে কেবল অবহেলা কইরা গেছি আর আজ তারে হারানোর পর বুঝলাম, নিজ পায়ে ক্যামনে কুড়াল মারছি আমি। কিন্তু এহন বুইঝাও লাভ নাই।
– এখন কি আদেও এইসব করে লাভ আছে? নিজের জীবন নতুন করে শুরু করো। মেয়েটার জন্য ভালোভাবে বাঁচতে হবে তোমাকে। ভাবি তোমার হাসিটা খুব পছন্দ করতো। সেই হাসিটাই আবার ফিরিয়ে আনো নিজের মাঝে।
– বলা যতটা সহজ, আসলে সব তত সহজ না। যার সাথে হয় কেবল সে-ই বুঝে এইটা কেমন যন্ত্রণা। আমিও আগে কত মানুষরে কত উপদেশ দিছি অথচ, নিজের ক্ষেত্রেই সেইগুলা আর কাজে লাগাইতে পারতাছি না।
– একজন মানুষের ইচ্ছাশক্তি যতটা প্রবল হয় সে ততই দ্রুত সব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়।
– আমার ইচ্ছাশক্তি প্রবল না।
– হতে হবে।
হামিদ আর কথা বাড়ায় না। লাভ নেই, চারুর সাথে কথায় পারবেনা সে। সারা শরীরে কবরস্থানের মাটি লেগে থাকায় হামিদ গোসল করে নিলো। হাজারবার চেষ্টা করেও চারু কেবল অল্প কিছু খাওয়াতেই সক্ষম হলো তাকে। তারপর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। অনেক গোপনে নিজের ব্যাগ থেকে ফাতেমার একটা ফ্রেমে বাধানো ছবি সে বের করলো। ছবির কোয়ালিটি তেমন ভালো না কিন্তু হামিদের কালো পদ্মের মুখটি স্পষ্ট। নিজের কিছু কিছু ব্যাবহারে আজ আফসোস হয় হামিদের।
– কেমন আছো ফাতেমা? নিশ্চয়ই ভালোই আছো। আমার সব সুখ তোমারে দিয়া দিলাম তাও তুমি সুখী থাকো। তোমার মনে আছে, একদিন তুমি আমারে বলছিলা, ভাই আর বাবা হিসেবে আমি আদর্শ হইলেও স্বামী হিসেবে জঘন্য, আজ আমি তা হারে হারে টের পাইতাছি। আসলেই আমি দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ স্বামী। পদ্মফুলের কোনো ইচ্ছা আমি কখনো পুরণ করতে পারি নাই। তার শখগুলা কখনো জানতে চাই নাই। শখ জানলেও কহনো পূরণ করি নাই। তুমি খুব কইরা চাইতা তোমার সাথে একটা যেনো আমার একটা ছবি হয় কিন্তু আমি তুলি নাই ছবি। তোমারে অপমান করছি। আমার মুখে নিজের প্রসংসা শুনতে চাইতা কিন্তু আমি সবসময়ই সবার কাছে শুধু তোমার দুর্নামই কইরা আসছি। আসলেই আমি জঘন্য স্বামী। কতবার কত কথায় তোমারে কষ্ট দিছি তার হিসাব নাই। কি করলে তোমারে আরেকবার পাওয়া যাইবো কও তো? আমি তোমারে আবার চাই। একবারের জন্য হইলেও চাই। তোমারে কইছিলাম না তোমার কবরের মাটি শুকাইলেই বিয়া করমু কিন্তু দেখো আমি করি নাই। আমার মন কয়, তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর কেউ কহনো আসতে পারবো না। আমি তোমারে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। তোমার হামিদ শুধু তোমারই থাকবো। তোমার নিজস্ব পুরুষ হইয়াই থাকবো। পরকালে কেউ আমার ভাগ চাইবো না তোমার আছে। আমার জীবনের প্রথম স্পর্শ যেমন তুমি ছিলা, আমার জীবনের শেষ স্পর্শও তেমনি তুমিই থাকবা। আফসোস একটাই আমার কালো পদ্মফুল, তুমি কহনো জানতেও পারলা না আমি তোমারে ঠিক কতটা ভালোবাসছিলাম। এই জন্মের ভালোবাসাটা নাহয় পরকালেই তোমার পাওনা রইলো। একবার তোমার কাছে আসি, সবটা ভালোবাসা বুঝায়া দিমু তোমারে। তুমি দেইখা নিও। ভালোবাসি আমার একান্ত ব্যক্তিগত কালো পদ্ম। পারো তো দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট তোমার এই স্বামীটারে মাফ কইরা দিও।

★★★

ফাতেমার মৃত্যুর পর প্রায় দুইমাস কেটে গেছে। সবকিছুই মোটামুটি ঠিক হয়ে এসেছে। তবে ঠিক হতে পারেনি হামিদ। আজও কালো পদ্মেই আসক্ত সে। এত ভালোবাসা কবে জন্মালো তার প্রতি? এই কয়দিনে বিন্দিয়া একবারও আসেনি হামিদের সামনে কিন্তু এইবার আর কোনো সুযোগ নেই। বিন্দিয়া সরাসরি এসে হামিদের পা চেপে ধরলো। হামিদ অনুভূতি শূন্য মানুষের মতোই বসে রইলো। বিন্দিয়ার প্রতি প্রচন্ড রাগ তার। এই মানুষটার জন্যই শেষ কয়েকটা দিন ফাতেমাকে প্রচন্ডরকম অবহেলা করেছে সে। দোষ অবশ্য বিন্দিয়ার একার ছিলো না। দোষটা তারও ছিলো, সে কেনো এই মেয়ের কথায় চলে আসবে তাই বিন্দিয়ার উপর কোনো রাগ দেখাচ্ছেনা। এই মেয়েটার চেয়েও তো বড় দোষী সে নিজেই,
– হামিদ ভাই, আপনে কিছু একটা করেন। আমি বাচমু না আপনেরে ছাড়া। কালকে আমারে দেখতে আসবো। সব ঠিকঠাক হইলে বিয়াও হইয়া যাইবো। আপনে কিছু একটা করেন।
– কি করমু? চাচিরে রাজি করামু যেনো তোমার বিয়া এমনে না দিয়া ধুমধামের সাথে দেয়?
– না আপনে মায়রে বলবেন আপনে আমারে বিয়া করতে চান। আমি আপনেরে ছাড়া কাউরে বিয়া করমু না হামিদ ভাই।
– আমিও তোমারে বিয়া করমু না।
– ক্যান করতাছেন আমার সাথে এমন? আপনি তো জানেন আপনেরে ছাড়া অন্য কেউরে বিয়া করনের কথা আমি ভাবতেও পারিনা। আপনে যদি আমারে না মাইনা নেন তাইলে গলায় কলসি বাইন্ধা নদীতে ডুইবা মরা ছাড়া আমার আর কোনো পথ নাই।
হামিদ হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেলো। কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে ঘরের ভেতরে চলে গেলো সে। অতি শীঘ্রই ঘর থেকে একটা কলস আর একটা দড়ি বের করে বিন্দিয়ার সামনে রেখে বললো,
– গলায় কলস বাইন্ধা নদীতে ডুইবা মরবা কিন্তু তোমার কাছে তো কলস বা দড়ি নাই তাই এইগুলা নিয়া আসলাম তোমার সুবিধার জন্য। যাও তাড়াতাড়ি নিয়া নদীতে ডুইবা ম*রো। তোমার মতো মাইয়া এই সমাজে প্রয়োজন নাই।
বিন্দিয়া স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো হামিদের দিকে। সে কল্পনাও করতে পারেনি হামিদ এমন কিছু বলবে বা করবে। কিন্তু হামিদ এমন কেনো করছে? ফাতেমা তো আর বেঁচেও নেই।
– এতটা পাষাণ ক্যান হইতাছেন হামিদ ভাই? একটু দয়া করেন আমার উপর। আমি বাঁচতে চাই।
– তুমি বাঁচো কি মরো তাতে আমার কিছুই যায় আসেনা।

বিঃদ্রঃ এই অংশে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি তবে দ্বিতীয় অংশে সম্পূর্ণ অংশ নতুন করে লেখা হবে। আজকের টার্গেট ১০০০+ রিয়েক্ট। তাড়াতাড়ি কমপ্লিট করে দিন আমিও দ্রুত নেক্সট পর্ব দেবো ইনশাআল্লাহ আর আগের পোস্টটি যারা কপি করে রেখেছেন তাদের ডিলিট করার অনুরোধ রইলো কারণ ওই অংশটা আমি পরিবর্তন করবো। সুন্দরভাবে সমাপ্তি টানতে চাইছি। ধন্যবাদ।

_______________________

To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া

(প্লট পরিবর্তিত হয়েছে। যারা আগের পর্বটি(ডিলিট করা পর্ব) পড়েছেন তাদের আবারও পড়ার অনুরোধ রইলো।)

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ৪২ (অন্তিম পর্বের দ্বিতীয় অংশ)
_________________________

– বাসায় যা বিন্দিয়া। বিয়ের আগে এখানে সেখানে ঘোরা উচিত না। সবাই বলে, তাতে নাকি নজর লাগে। তোর বিয়েতে কিন্তু আমি তোকে সাজাবো। তুই মানা করতে পারবিনা।
– চারু তুই! চারু এমন করিস না আমার সাথে। তুই অন্তত আমারে বোঝার চেষ্টা কর। জমিদার বাড়ির ছেলের সাথে বিয়া ঠিক হইছে আমার। বিয়াটা হইয়া গেলে আমি বিষ খামু চারু। তোর ভাইয়ে তো তোর সব কথা শুনে। একটু বোঝা তোর ভাইরে।
– আমার ভাইয়ের নিজস্ব একটা জীবন আছে। তার যেমন ইচ্ছে নিজের জীবন তেমন ভাবেই সাজাবে সে। বিয়েটা করে নে বিন্দিয়া। তবে সাবধানে থাকিস, ওবাড়ির সবাই যেমন খারাপ না তেমমি সবাই কিন্তু ভালোও না। আর আমার ভাইয়ের আশা ছেড়ে দে। সে একবার যে সিদ্ধান্ত নেয় তাতে অটুট থাকে। আমরা দুই ভাই-বোন একই রকম বিন্দিয়া। আমাদের মনে মায়া দয়া নেই। কোথাও না কোথাও বাবার ছায়া পেয়েছি আমরা দুজনেই। তোর প্রতি আমারই মায়া হচ্ছেনা আমার ভাইয়ের কি মায়া হবে?
– আমার প্রতি তোর মায়া হইতাছে না?
– সত্যি বলতে হচ্ছেনা। করুণাও হচ্ছেনা। আমরা মানুষ বিন্দিয়া। আর মানুষ কখনো নিখুঁত হয়না। আমরাও নিখুঁত না। আমাদের মন পাথরের মতো শক্ত। সেখানে কারোর প্রতি সহজে মায়া জন্মায় না। জীবনে অনেক ভুল করেছি কিন্তু কখনো সর্বস্ব দিয়ে অনুতপ্ত হইনি। তবে ভাইয়া হয়েছে। ভাবির প্রতি করা প্রতিটা অন্যায়ের প্রতি সে অনুতপ্ত হয়েছে। আমরা যেমন সহজে কাউকে ভালোবাসিনা তেমনি একজনকে ভালোবাসলে নিজেদের সবটা দিয়ে ভালোবাসি। তাই বলছি, আমার ভাইয়ের মনে তুই জায়গা করতে পারবিনা। বিয়ে করে সুন্দরমতো সংসার কর।
চারুর কথার প্রভাবে নাকি অপরাধবোধে সেইটা ঠিক বোঝা গেলো না তবে বিন্দিয়া জাবিনকে বিয়েটা করেই নিলো। ছেলেটা ভালোই। শহরে থেকেছে অনেকটা সময় আবার গ্রামেও থেকেছে। সে যেমনি শহুরে ভাষায় কথা বলতে পারে তেমনি গ্রামীণ ভাষায়ও কথা বলতে পারে। সকলের সাথে মিশে যেতে পারে দ্রুতই। বিন্দিয়া সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জাবিনকে মেনে নেওয়ার। হয়তো কিছুদিনের মধ্যে মেনেও নেবে। মানব মন বড়ই অদ্ভুত, যেসব কাজ আজ অসম্ভব বলে মনে হয় সময়ের ব্যাবধানে সেসব কাজই হয়ে ওঠে খুব স্বাভাবিক। তবে পুরোনো দীর্ঘশ্বাসটি কোথাও না কোথাও রয়েই যায়।

★★★

হামিদ সোনাদীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এখনো জল পদ্মে পরিপূর্ণ। পদ্ম কি কম ছিলো যে হামিদের একটা মাত্র পদ্মকেও সে গ্রাস করে নিলো। হামিদ ভাবে নিজের ছোটবেলার কথা, ছোটবেলাই ভালো ছিলো। বড় হওয়ার এ কষ্ট আর সহ্য হয়না তার। কি সুন্দর দেড়শো টাকা বেতনের কাজে হয়ে যেতো তার। অবশ্য হতো না, সে শুধু হেলাফেলায় সময় কাটানোর জন্য ওই কাজটা বেছে নিয়েছিলো। যদিও বাইরে দেখা যাচ্ছে সে কাজ করছে তবে তেমন কাজ সে করতো না। গ্রামে সবকিছুর দাম কম ছিলো বিধায় হাতখরচ কোনোমতে চলে যেতো। তখন টাকা ছিলো না কিন্তু সুখে ভরপুর ছিলো জীবনটা আর এখন হাজার হাজার টাকা মাসে আয় করে কিন্তু তাও মনে কোথাও একটু সুখ নেই। কালো পদ্মের সাথে সাথেই সুখটাও মরে গেছে তার। ইশ! যদি আরেকটা বার ফিরে পাওয়া যেতো পদ্মফুলটাকে। আরেকটা বার আবদার করতো, “আমারে একটু বুকে নিয়া ঘুমাইবেন?” হামিদ নিজের সর্বশক্তি দিয়ে হলেও আকড়ে ধরতো নিজের কালো পদ্মকে। আর কখনোই যেতে দিতো না। কক্ষনো না।

★★★

– তোমার কাছে বিষাক্ত ভালোবাসার সংজ্ঞা কি সুহাসিনী?
– হঠাৎ এ প্রশ্ন করছেন শিহাব?
– এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।
– বিবেকহীন, যুক্তিহীন, আত্মসম্মান বর্জিত অনুভূতিকেই বিষাক্ত ভালোবাসা বলে। ঠিক যেমনটা আমি আপনাকে ভালোবাসি কিন্তু আপনি ভালোবাসেন অন্য কাউকে। নিজের আত্মসম্মানের বলি দিয়ে আমি আপনাকে ভালোবাসি। তবে আপনার ভালোবাসাটাও বিষাক্ত ভালোবাসা শিহাব কারণ আপনি যাকে ভালোবাসেন সে আপনাকে ভালোবাসেনা। এইটাও কিন্তু একটা বিষাক্ত ভালোবাসা।
– ঠিকই বলেছো সুহাসিনী। আমি যাকে ভালোবাসি সে অন্য কাউকে ভালোবাসে এইটা পৃথিবীর বিষাক্ততম অনুভূতি। বুকটা হাজারো কষ্টে চৌচির হয়, মনের হাজারো খন্ড হয় কিন্তু যার জন্য হয় সে কখনো চেয়েও দেখেও না।
– আর যদিও বা দেখে তবুও তার মূল্য দেওয়ার সাধ্য তার নেই কারণ সে ইতিমধ্যেই অন্যজনে আসক্ত।
শিহাব এক পলক সুহাসিনীর দিকে তাকিয়ে নিজের দৃষ্টি নত করে। সুহাসিনী যে কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে সেটা বুঝতে সময় লাগেনা শিহাবের।
– তুমি বিয়েটা ভেঙে দাও সুহাসিনী। আমি তোমাকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারবোনা। মেয়ে হিসেবে তুমি শতভাগ পার্ফেক্ট। রুপে, গুনে, বুদ্ধিমত্তায় অনন্য। সেখানে আমার নিজেকেই তোমার অযোগ্য মনে হয়, আমি তো কখনো তোমাকে মন থেকে ভালোও বাসতে পারবোনা।
– রূপ, গুন, বুদ্ধি এইসব থেকেই বা কি হবে শিহাব যদি ভালোবাসার মানুষটিকে নিজেরই করতে না পারলাম।
– সবার তো আর সব ইচ্ছে পূরণ হয়না সুহাসিনী। আমি স্বর্ণলতাকে ভালোবাসি। তাকে পাবোনা জেনেও ভালোবাসি। আমার ভালোবাসায় কোনো খাত নেই, কারণ আমি তাকে পাওয়ার জন্য ভালোবাসিনি, আমি তাকে পাবোনা জেনেই ভালোবেসেছি।
– আমিও আপনাকে পাওয়ার জন্য ভালোবাসিনি শিহাব, তবে ভাগ্য যদি আমাকে আপনার সাথে মিলিয়ে দেয় তবে আমি কেনো ছাড়বো?
– তুমি বুদ্ধিমতি সুহাসিনী, এইসব বাচ্চামো তোমাকে মানায় না। তুমি যথেষ্ট ম্যাচুয়র।
– আমার না আপনার স্বর্ণলতাকে দেখার খুব ইচ্ছে। সে ঠিক কতটা সুন্দরী যে তাকে ছাড়িয়ে আপনার মন মস্তিষ্ক অন্য কাউকে কল্পনা করতে জানেনা!
– সে যথেষ্ট সুন্দরী সুহাসিনী তবে আমাকে কেবল তার সৌন্দর্য আকৃষ্ট করেনি। সৌন্দর্যের মায়ায় পড়লে বোধহয় অনেক আগেই তাকে ভুলে যেতাম। তবে আমি আজও প্রতিদিন একটু একটু করে নতুনভাবে তাকে ভালোবাসি আর এই পাঁচ বছরে এমন এক মুহুর্ত নেই যখন আমি তাকে ভালোবাসিনি। পাঁচ বছর আগে আমি যতটা তাকে ভালোবাসতাম এখন তার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসি কিন্তু এই পাঁচটা বছরে আমি একবারও দেখিনি আমার স্বর্ণলতাকে। তাকে শেষবার দেখেছিলাম কিছুদিন আগে। নিজের স্বামীর কাধে মাথা রেখে বসে ছিলো নদীর পাড়ে। আমার স্বর্ণলতা ভালোই অন্যের সাথে সুখে আছে। আমিও চাই সে সুখে থাকুক। আমার সবটুকু সুখ শুষে নিয়ে আমার ভালোবাসাটা সুখে থাকুক।
– তাহলে তার এই সুখ সহ্য করতে না পেরে বিয়ের তারিখ আগে বাড়িয়ে দিলেন কেনো শিহাব?
– ভালোবাসার মানুষটিকে অন্যের হাতে তুলে দিতে সক্ষম এমন খুব কম মানুষই আছে দুনিয়ায় কিন্তু ভালোবাসার মানুষটিকে অন্যকারোর সাথে দেখার মতো সাহস কারোর নেই। তেমনি আমি জানি স্বর্ণলতা অন্যকারোর। আমি মেনে নিয়েছি তবে স্বচক্ষে সেটা দেখার সাহস আমার মাঝে ছিলোনা তাই রাগের মাথায় মা-কে বলে বিয়ের তারিখ সামনে এনেছিলাম। যখন রাগ কমে এলো তখন বুঝলাম কি সর্বনাশ ঘটে গেছে আমার দ্বারা। এখন আমার হাতে আর কিছু নেই। তুমি বিয়েটা ভেঙে দাও সুহাসিনী।
– না শিহাব আমি বিয়েটা ভাঙবো না। আমি আপনাকে চাই। যেকোনো মূল্যেই চাই।
– তুমি আমাকে কখনোই পাবেনা সুহাসিনী। হয়তো পরিস্থিতির চাপে মানিয়ে নেবো কিন্তু ভালোবাসাটা সম্ভব নয়। প্রতিটি মানুষের মনেই একটা বিশেষ জায়গা থাকে আর ওই বিশেষ জায়গাটা কেবল একজন বিশেষ মানুষকেই দেওয়া যায়। আর আমি সেই জায়গাটা অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছি। আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবো মানিয়ে নেওয়ার কিন্তু আমি যদি মানিয়ে নিতে অক্ষম হই তবে আমি পালিয়ে যাবো সুহাসিনী। বিয়ের আসরে বর পালিয়ে গেলে সেইটা নিশ্চয়ই তোমার কিংবা আমার কোনো পরিবারের জন্যই সুখকর হবেনা?
– ভালোবাসি আপনাকে শিহাব। সবটা দিয়ে ভালোবাসি। আপনার জন্য সব ধরনের কলঙ্ক মাথা পেতে নিতেও আমি রাজি শিহাব।
– তুমি ঠিকই বলেছিলে সুহাসিনী, বিবেকহীন, যুক্তিহীন, আত্মসম্মান বর্জিত অনুভূতিকেই বিষাক্ত ভালোবাসা বলে।

★★★

আমাকে খোজার জন্য খুব তাড়া তাই না অফিসার, সোজা গ্রাম অবধি চলে এলেন? ফোন নাম্বার ট্র‍্যাক করছেন। সিমের ডিটেইলস বের করতে চাইছেন। আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। এইসব থেকে দূরে সরে যান। শুধু শুধু আমার শত্রুর সংখ্যা বাড়ানোর কোনো ইচ্ছে নেই। আর নিতান্তই যদি না সরতে চান তবে চলুন দেখা করা যাক। কাল সন্ধ্যা ৭ টায়, মধুরোড ৭/৫ পল্লিগীতি ফ্যাক্টরির সামনে। করবেন নাকি দেখা? আপনার বউয়েরও তো খুব শখ আমার সাথে দেখা করার, তো আশা করছি আসছেন।

হোসেনের কাছে থেকে পাওয়া বসের নাম্বারটা সিফাত নিয়েছিলো চারুর কাছ থেকে। সেই নাম্বারটা ট্র‍্যাক করতে পাঠানো হয়েছিলো কিন্তু পাঁচ বছরে একটা বারের জন্যেও সিম কার্ডটি ওপেন হয়নি। আর আজ সরাসরি এমন একটা ম্যাসেজের জন্য প্রস্তুত ছিলোনা সে। সিফাত বিলম্ব না করে সরাসরি চলে গেলো চারুর কাছে। লতাকে ঘুম পাড়াচ্ছে সে। হামিদ কিছুটা দূরেই চেয়ারে বসে দেখে যাচ্ছে নিজের মেয়েকে। ফাতেমার সাথে মিল নেই চেহারার তাও কেমন যেনো ফাতেমার কথাই মনে করাচ্ছে মেয়েটা,
– বেলিফুল, মধুরোড ৭/৫ পল্লিগীতি ফ্যাক্টরিটা কোথায়?
– এড্রেস তো আপনিই বলে দিলেন সিফাত। আমি আর কি বলবো?
– মানে আমি বলতে চাইছি জায়গাটা কোথায়?
– পাশের গ্রামে? (হামিদ)
– পাশের গ্রামে কোথায়?
– এ গ্রাম থেকে উত্তর পূর্ব দিকে ৯ কি.মি. এর মতো গেলেই পল্লিগীতি ফ্যাক্টরি। আপনি হঠাৎ সেই ফ্যাক্টরির কথা জিজ্ঞেস করছেন কেনো? সেটা তো অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। (চারু)
– আমার জন্মেরও আগে ওই ফ্যাক্টরি বন্ধ পইড়া রইছে। কোনোদিন খুলতে দেহি নাই। বাইশ বছর আগেও যেমন ছিলো এহনও তেমনই পইড়া আছে। (হামিদ)
– এর জন্যই তথাকথিত সেই বস আমাকে সেখানে দেখা করতে বললো।
– বস দেখা করতে বলেছে মানে? কোন বস?
সিফাত হামিদ এবং চারুকে ক্ষুদ্র বার্তাটি দেখালো। চারু এই প্রথমবারের মতো আশার আলো দেখতে পেলো। সেই তথাকথিত বসকে তার খুজতে হবেনা সে নিজেই ডেকে নিয়েছে নিজের মৃ*ত্যুকে। এইবার সকল হিসেব হবে সমানে সমানে। নিজের জীবন দিলে হলেও চারু তার ভবলীলা সাঙ্গ করবে।
হামিদ চোখমুখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়বো। শেষ অবধি চারু জানতে চলেছে সেই ভয়ংকর সত্য। চারু কি আদেও সইতে পারবে সেটা?
– প্রস্তুতি গ্রহণ করুন সিফাত। কাল রাতেই আমরা সেখানে যাবো।
– বাচ্চাদের কে দেখবে?
– হিমেল দেখবো। ওই ভীতু এমনেও কোনো কামের না। উল্টাপাল্টা কিছু হইতে দেখলেই প্যান্ট ভিজায়া ফেলবো, এরচেয়ে ভালো সে এখানে বাচ্চাদের সাথেই থাকুক।(হামিদ)
– কথাটা কিন্তু খারাপ বলোনি হামিদ।
অতঃপর কাজ সবটাই হলো পরিকল্পনা মাফিক। নির্দিষ্ট সময়েই তারা পৌঁছে গেলো ফ্যাক্টরির সামনে। নিচতলায় কাউকেই দেখা গেলো না। তিনজনেই সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলো আর সেখানেই অপেক্ষা করছিলো তাদের জন্য এক চমক। মোটা ভারী পুরষালি কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো,
– বাহ! চলে এসেছো তবে? বলতে হয় সাহস আছে তোমাদের। আমার নরকপুরীতে তোমাদের আজ খুবই বাজেভাবে স্বাগত করা হবে। প্রস্তুত তো তোমরা?
চারিদিকে অন্ধকার ছিলো এতক্ষণ। মুহুর্তেই লাইট জ্বলে উঠলো। সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল কালো মুখশে আবৃত এক ব্যক্তি। তবে চারু জানে এই লোকটি বস নয়। বস আরো লম্বা, হ্যাংলা পাতলা কিন্তু এই লোকটার পেটটা একটু মোটা। লম্বাও নয় তেমন, যদিও চেহারা দেখেনি তবুও হাত পায়ের কিছুটা কুচকানো চামরা দেখে অনুমান করা যায় লোকাটা নিঃসন্দেহে পঞ্চাশার্ধ। এইটা কি সেই বসের আন্ডারে কাজ করা কেউ। এইবার লোকটা মুখোশ খুলতেই চমকে উঠলো হামিদ আর চারু, কারণ এ আর কেউ নয় বরং ছোট জমিদার সাহেব।
– আ আপনে? (হামিদ)
হামিদের এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা এইটা সেই লোক। এই লোকটা নিতান্তই সহজ সরল ধরনের। হামিদের সাথে বেশ কয়েকবার কথাও হয়েছিলো তার। এই লোকের বেকুবের মতো কথাবার্তায় নিজ মনেই কতবার হেসেছে তার হিসেব নেই কিন্তু এই লোক কিভাবে বস হয়? এইটা কিভাবে সম্ভব?
– না আপনি বস নন। হতে পারেন না। নিশ্চয়ই বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন আমাদের৷ ভালোয় ভালোয় তাকে বের করে আনুন বলে দিচ্ছি। (চারু)
– আরে বাবা আস্তে। এত চিৎকার করো তুমি? আমিই বস আর তুমি যার কথা বলছো সে অভি। আমার ছেলে অভি। দেখা করবে তার সাথে? পরে করো, আগে তোমাদের সাথে একটু কথাবার্তা বলি। চা নাস্তা করো। ততক্ষণে চলে আসবে অভি এবং স্মৃতি। ওহ, তোমাকে তো বলাই হয়নি স্মৃতি তোমার বোন। বিশ্বজিতের বড় মেয়ে। স্মৃতি অবশ্য তোমাকে বোন বলে স্বীকার করেনা। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ পজিশনে তুমি থাকো সেটাই তার লক্ষ্য। এই নারী চরিত্র সত্যিই ভীষণ অস্বাভাবিক। নইলে কোনো শত্রুতা নেই, কিছু নেই সে কেনো তোমার খারাপ চাইবে বলো তো? যাই হোক, অনেকক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে আছো। এখন একটু বসো। চা নাস্তা কিছু করবে নাকি?
– আপনার এখানে খেতে আসিনি আমরা।
– যাক বাবা ভালোই হয়েছে। এখানে খাবার দাবারের ব্যবস্থাও নেই। দূরের দোকান থেকে কিনে আনতে হয়। আরে তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেনো? এতগুলো চেয়ার আছে, বসে যাও কোনো একটায় নইলে কিছুক্ষণ পর যা দেখবে তাতে তো এমন ধাক্কা খাবে যে আর উঠে দাঁড়ানোর জোর পাবেনা।
– বাজে বকা বন্ধ করুন। ডাকুন অভিকে।
– বাব্বাহ! এত শখ অভিকে দেখার? এক রাতেই মায়ায় ফেলে দিয়েছে বুঝি?
কথা বলেই ছোট জমিদার বিশ্রী একটা হাসি দিলো। চারুর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অবধি ঘৃণায়, রাগে বিষিয়ে উঠলো। ইচ্ছে করছে এখনি এই নরপিশাচটির ধর থেকে মাথা আলাদা করে দিতে, কিন্তু চারু অপারগ এখনো অনেক কিছু জানতে হবে তাকে।
– লজ্জা করলো না আপনের সকলের সাথে এই ভালো মানুষির নাটক করতে? (হামিদ)
– লজ্জা থাকলে তো লজ্জা করবে? আরে বাবা এইসব কাজে কি লজ্জা পেলে চলে নাকি? তুমি তো লজ্জা পেয়েই চলে গিয়েছিলে এখান থেকে। তো এখনো বোনকে বলোনি বস কে? হ্যাঁ আমার কথা হয়তো জানতেনা কিন্তু অভির কথা তো জানতে? বলো জানতে না?
চারু এবং সিফাত দুজনেই বিষ্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হামিদের দিকে। দুজনের চোখেই খেলা করছে হাজারো প্রশ্ন। হামিদ নিজের চোখ বন্ধ করে নিলো। চারুকে কিছু বলার সাহস তার ছিলো না। হামিদের এই চোখ বন্ধ করে নেওয়া যেনো আরো একবার সকল উত্তর দিয়ে দিলো চারুকে।
– ধোকা! আরো একবার ধোকা দিলে তুমি আমাকে!
হামিদ ব্যাথাতুর চোখে চেয়ে রইলো চারুর দিকে। সে হাজার চেষ্টা করেও একথা চারুকে বলতে সক্ষম হয়নি তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো চারু যা দেখার সরাসরি দেখবো। চারুর এমন প্রতিক্রিয়াতেও খুব একটা অবাক হলোনা হামিদ। এইটাই তো হওয়ার ছিলো। আসলেই সে দ্বিতীয়বার ঠকালো চারুকে।
– সয়ে গেছে ভাইয়া। এখন আর অবাক হইনা। তবে ঠকানোর মাত্রাটা এইবার অনেক বাড়িয়ে দিলে তুমি। একবারও ভাবলেনা এই বোঝাটা আমার সইবে কি না?
– চারু আমি সাহস পাই নাই তোরে জানাইতে কিন্তু বিশ্বাস কর তোরে ঠকানোর ইচ্ছা আমার ছিলোনা।
– আমাকে কেনো বলোনি হামিদ?(সিফাত)
হামিদ কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই ভেতরের ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে দুজন তরুন তরুণী। চারু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে তাদের দিকে। তারা যে চারুরই চেনাজানা কেউ সেটা বুঝতে দেরি হয়নি তার। এমনকি এই মুখোশে আবৃত লোকটিই তথাকথিত সেই বস। আচমকা অভি নিজের মুখ থেকে খুলে ফেললো মুখোশটি।

চারু মাটিতে বসে পড়লো। তার ভেতরে কেমন ঝড় বয়ে চলেছে তা কল্পনা করতে পারছেনা কেউ। মনে হচ্ছে যেনো দুনিয়া উলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে। চারু একমুহূর্তের জন্য ভেবে নিয়েছিলো এখানে আজ সে শিহাবকে দেখবে কিন্তু,, চারু আর কিছু ভাবতে পারেনা। কাপাকাপা কন্ঠে উচ্চারণ করলো
– শ শ শাওন ভাই! তুমি? তুমি বেঁচে আছো?
অভি কিছু না বলে মুচকি এক হাসি দিলো। মায়াবী হাসি যা দেখলে মুহূর্তের মাঝেই মন জুড়িয়ে যেতো চারুর আর আজ সেই হাসি দেখে বিতৃষ্ণায় দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।
– তুমি? তুমি এতো বড় ধোকা দিলে আমাকে?
– শুধু আমি নয়, হামিদও দিয়েছে। ও আগে থেকেই সবটা জানতো।
চারু নিস্তব্ধ হয়ে যায়। জীবনটা আজ দ্বিতীয়বারের মতো ভীষণ শূন্য লাগছে। চারুকে চুপ থাকতে দেখে মোহিত কণ্ঠে শাওন বলে উঠলো,
– কেমন আছো মায়াবিনী?
চারুর চোখ থেকে আরো একফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়লো। এও কি সম্ভব? সবশেষে কি না শাওন?
– তোমার ভাইয়ের বয়স তখন সম্ভবত সতেরো। তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের নরকপুরীতে। দেখেছিলাম শত শত মেয়ে কিন্তু ভাইটা তোমার তখনও বেশ ছোট। নারী আকর্ষণ বুঝলোই না। ভয় লজ্জায় পালিয়ে গেলো। আমি তো ভেবেছিলাম হামিদ তোমাকে সব বলেই দেবে। এই বুঝি আমার প্ল্যান ফ্লপ হয়ে যায়। কিন্তু বেচারা এতটাই কনফিউশনে পড়ে গিয়েছিলো যে এইসব ভাবতেও পারেনি। তোমাকে বলা তো দূরে থাক। আসলে হামিদ নিজেও বেশ বোকা। সে শুধুই আমাকে সন্দেহ করে গিয়েছে কিন্তু শতভাগ নিশ্চিত ছিলোনা এইটা আমি। এইটা কোনো কথা বলো? পানির মতো পরিষ্কার সব আর হামিদ বুঝলোই না।
হামিদ অস্বস্তিতে মিইয়ে যায়। সে সত্যিই সবটা নিশ্চিত জানতো না। শাওন চারুর সাথে এমনটা করতে পারে তা কল্পনাও করেনি হামিদ তাই বারবার হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছিলো তার। পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়ার কারণে সিফাতকেও কখনো সত্যটা জানায়নি হামিদ।
– কি হামিদ! বলো তোমার আদরের বোনকে সবটা। বলো বলো।
হামিদ চুপ করে রয়। শাওনকে চারু নিজের খুব ভালো বন্ধু বলেই মনে করেছে সবসময়। তার এমন জঘন্য রূপ কিভাবে মেনে নেবে? আদৌও কি সম্ভব মেনে নেওয়া?
– বাদ দাও, তোমাকে বলতে হবেনা আমিই বলছি। বলবো নাকি?
শাওন উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজ থেকেই বলতে শুরু করলো,
– তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক প্ল্যান ছিলো চারুলতা। গোটা দেশে আমাদের আলাদা আলাদা আটটি ভাগ রয়েছে। একেক ভাগ একেক কাজ করে। কিন্তু এই আট দলেরই কমন এক কাজ ছিলো যাচাইকৃত সুন্দরীদের চিহ্নিত করে বিদেশে পাচার করা। মোট তেরোটি মেয়ে আমরা এভাবে সিলেক্ট করি। বারোজনকে আমরা কাজে লাগিয়ে দিয়েছি, তুমিই সর্বকনিষ্ঠ এবং একমাত্র মেয়ে যে সবটা জানার পর নিজের সর্বনাশ নিজের চোখে দেখবে। লাকি গার্ল!
– তেরোটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট করেছো তোমরা?
– উহুম! প্রচুর করেছি তবে বারো জন অত্যাধিক সুন্দরী। মেয়েরা সাধারণ খুবই সংকীর্ণ মনের হয়। তারা একাধিক পুরুষের শয্যাসঙ্গী কখনোই হতে চায়না তাই মোটামুটি কৈশোরে পা দেওয়া মাত্রই তার সাথে একাধিক পুরুষের ঘনিষ্ঠতা তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে তুমি আবারও সৌভাগ্যবান যে কেবলমাত্র তিন জনের সানিধ্যেই তোমাকে যেতে হয়েছে আর বর্তমানে যাকে বিয়ে করেছো তাকেই নিজের পরিচয়ে বিয়ে করেছো তুমি। সব মিলিয়ে মাত্র চার। বাকি বারো জনের সাথে যা হয়েছে তা তুমি কল্পনাও করতে পারোনা। তারা তাদের কুমারিত্ব হারায়ই নিজের পিতার কাছে। তারপর কোনো ভাই থাকলে সে। আর একাধিক ভাই থাকলে তো কথাই নেই। তারপর বিয়ে হয়, আর বিয়ের পর কি হয় সেটা তো তোমার জানাই। তুমি প্রচন্ড সৌভাগ্যবান চারুলতা। প্রচন্ড সৌভাগ্যবান। বিশ্বজিৎ শুরু থেকেই নারী লোভী ছিলো কিন্তু সে কখনোই তোমাকে ধর্ষনে রাজি হয়নি। এই প্রথম কোনো মেয়ের প্রতি সম্মান দেখেছিলাম তার চোখে। অবশ্য শয়তান শয়তানই হয়। সে নিজে না করলেও অন্যকেউ করার ইচ্ছে পোষণ করলেই বাধা দিতো না। পিতৃত্ববোধ বিশেষভাবে ছিলো তার মাঝে। বিশ্বজিৎকে দিয়ে যখন আর কোনো আশা থাকেনা তখন টার্গেট করি হামিদকে। হামিদের সাথে আগে থেকেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলো আমার। সেই সুযোগেই তাকে একদিন নিয়ে যাই সুন্দরী নারীদের ডেরায় কিন্তু মনোরমা সত্যিই ছেলেটাকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলেছিলো। মহিলার প্রসংসা না করে পারলাম না। সেই আদর্শেই হামিদ সেখান থেকে একপ্রকার পালিয়ে যায় আর যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ করে দেয়। হামিদকে দিয়ে তোমাকে প্রহার করানো তো দূরে থাক, মায়ের মৃত্যুর পর ও তোমার রক্ষক হয়ে আমাদের পুরো পরিকল্পনাটা আবারও ভেস্তে দিলো।
এই অবধি হামিদ সহ্য করতে পারলোনা। নিজের বোন কে নিয়ে এমন জঘন্য মনোভাব কোনো সুস্থ মানুষেরই সহ্য হবেনা। চেয়ার গুলো থেকে হাতের কাছে থাকা একটা চেয়ার উঠিয়ে ছুড়ে মারলো অভি ওরফে শাওনের দিকে। শাওন বোধহয় প্রস্তুতই ছিলো এমন কিছুর জন্য তাই দ্রুতই কোনোরকম ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই সরে যেতে সক্ষম হলো সেখান থেকে,
– ভাই র*ক্ত এতো গরম কেনো? আস্তে-ধীরে করো। আমি মরলে তোমার বোনের এত প্রশ্নের উত্তর কে দেবে বলো তো? তবে যাই বলো তেরো জন মেয়ের মাঝে সত্যিই সবচেয়ে সৌভাগ্যবান চারুলতা!
– খবরদার তোর ওই জঘন্য মুখে আমার বইনের নাম নিবি না।
– এই তুমি! যত নষ্টের গোড়া ভাই তুমি। আমাদের প্ল্যান একে একে সব ফেইল হলো তোমারই জন্য। আর সবচেয়ে বড় প্ল্যান ফেইল হলো শিহাবের জন্য। এই শিহাবও না, ভালোবাসার জন্য দুনিয়ায় আর কোনো মেয়ে পায়নি। তবে যাই বলো না কেনো, শিহাব সত্যিই তোমাকে ভালোবেসেছে। দুনিয়ার একমাত্র ছেলে যে তোমাকে সত্যিই নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছে। আর বাকি রইলো আরেক জঘন্য লোকের কথা। নিঃসন্দেহে সে তোমার জন্যেও জঘন্য আর আমার জন্যেও জঘন্য। কে জানো? বিশ্বজিৎ! শেষ বয়সে এসে তার মনে হলো সে এইসব ঠিক করছেনা। আমাদের বিরুদ্ধে প্রমান রাখতে সব লিখে রাখতে লাগলো একটা খাতায় সাথে ছিলো আমাদের একটা ছবি কিন্তু অর্ধেকটা লিখতেই তোমরা তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলে আর সেই আধ লেখা খাতাটা গিয়ে পড়লো শিহাবের হাতে। তার কাছে আমি তো মা*রা গেছি। সে হন্য হয়ে খুজতে লাগলো ছোট জমিদারকে। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো যে আমরা আগেই বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম শিহাব জানতে পেরে গেছে অনেককিছুই। ওহ তোমাকে তো একজনের সাথে পরিচয় করানোই হয়নি। স্মৃতি তোমার বড় বোন। স্মৃতির পরিচয় দিতে মুখ থেকে মুখোশ খুলে নেয় স্মৃতি। এলোমেলো স্ট্রেইট হেয়ারগুলো ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। অত্যাধিক সুন্দরী এ নারী। তবে চারু তার মুখ দেখে অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গেলো কারণ এ কার কেউ নয় বরং মিলি! সিফাত মাথায় একটু চাপ দিতেই মনে পড়ে গেলো সেদিন সপিং মলে দেখা হয়েছিলো মেয়েটার সাথে। হামিদ এখনো ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে মিলিকে চেনার চেষ্টা চালালেও খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না।
– চিনতে পারলে তো চারুলতা?
– তুমি! তুমি কিভাবে আমার বোন হও তুমি তো শিহাবের বোন তাই না?
– আজব এক ক্যারেক্টর তুমি চারুলতা। এখন তুমি গবেষণা করতে বসে যাবে আমি কার বোন? আশা করি তোমার নরকে বসবাস করা দিনগুলো খুবই কষ্টের সাথে কাটবে।
– এই সুন্দরীদের দিয়ে অনেক কিছু করিয়েছি আমরা চারুলতা তবে তোমার জায়গা কেবল পতিতা পল্লীতেই হবে। এইটা স্মৃতির ঠিক করা।
হামিদ অনেকক্ষণ যাবত চারুর এই অসম্মান সহ্য করে গেলেও এইবার আর পারলো না। মুহূর্তেই রড জাতীয় কিছু একটা নীচ থেকে তুলে ছুড়ে মারলো সেটা অভির দিকে। অভি প্রস্তুত ছিলোনা বিধায় সেটা সরাসরি তার মাথায় গিয়ে আঘাত হবে এবং হাতে বন্দুক থাকায় এলোমেলোভাবে সেটা এগিয়ে যায় হামিদের দিকে। ঘটনার আকষ্মিকতায় স্তব্ধ অভি নিজেও কিন্তু এমন সময়েই সিফাত ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিলো হামিদকে আর গু*লিটা সরাসরি তার বুকের বাঁ পাশে গিয়ে আঘাত করলো। চারু চিৎকার করে উঠলো সিফাতের নাম ধরে। দৌড়ে এগিয়ে গেলো সেখানে। চারিদিক র*ক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সিফাতের নিঃশ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে। কোনোমতে চারুকে বললো,
– আপনার সাথে অনেকে পথ চলার বাকি ছিলো বেলিফুল। কিন্তু আফসোস তা হলোনা। মেয়েটার খেয়াল রাখবেন বেলিফুল। আপনি ছাড়া ওর আর কেউ নেই।
– সিফাত! সিফাত কি বলছেন আপনি? কিচ্ছু হবেনা আপনার। আমি এখনি আপনাকে হসপিটালে নিয়ে যাবো।
– লাভ নেই বেলিফুল। মানুষ নাকি মৃ*ত্যুর আগেই বুঝতে পারে তার মৃ*ত্যু হবে। আমিও বোধহয় বুঝেছিলাম। আমি আমার সকল সম্পদ আপনার আর পুতুলের নামে করে দিয়েছি। যদিও পুতুলের নামে আগেও সব করা ছিলো কিন্তু আমি আপনার নামেও করে দিয়েছি। বাবার শখ ছিলো একটা অনাথ আশ্রম দেবেন তিনি। আমি পূরণ করতে পারিনি আপনি করবেন। আর শেষ একটা কথা বলতে চাইছি বেলিফুল, আমি ভালোবাসি আপনাকে। প্রচন্ড রকমের ভালোবাসি। আমার বেলিফুল যেনো কখনো অন্যের বাগানে শোভা না পায়। পরকালে আমি আল্লাহর কাছে চাইলে যেনো খুব সহজেই আপনাকে পেয়ে যাই। অন্য কারোর সাথে যেনো আমার তুলনা না হয়। কথাটা রাখবেন বেলিফুল। আমাদের একসাথে দীর্ঘপথ চলাটা না হয় পরকালেই হবে।
– স স সিফাত!
– শহহহহহ! কিচ্ছু বলবেন না বেলিফুল। আমি জানি আমার সময় শেষ। অন্তিম মূহুর্তটা আমি আপনার বুকে মাথা রেখে কাটিয়ে দিতে চাই। ইশশ! আসার আগে কেনো মেয়েটাকে একবার ভালো করে দেখে এলাম না বেলিফুল? কে জানতো এইটাই শেষবারের মতো মেয়েটাকে দেখা! আমার মেয়ের খেয়াল রাখবেন বেলিফুল। ওর মায়ের কুদৃষ্টি হতে বাঁচিয়ে রাখবেন। জানি সহজ নয় তবে অসম্ভবও নয়। আপনি চারুলতা, আপনি সেই চারুলতা যে একাই নিজের শত্রু নিধনের ক্ষমতা রাখে বুকে অসীম সাহস নিয়ে। যে কখনোই হার মানেনা।কক্ষনো না!
– না! না আমি চারুলতা নই। আমি বেলিফুল। আপনার বেলিফুল। আপনার বেলিফুল। চোখ খুলে রাখুন সিফাত। কিচ্ছু হবেনা আপনার। আপনার বেলিফুল বাঁচাবে আপনাকে।
সিফাতের ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা ফুটে ওঠে এবং শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করে ভালোবাসার মানুষটির কোলে। চারু এখনো অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাদতে পারছেনা সে। নিজেকে কেমন অনুভূতিহীন পাথর লাগছে। চারু একবার সিফাতের কপাল ছুয়ে দিলো, তারপর দুটো গাল তারপর বন্ধ হয়ে যাওয়া দুচোখ, এলোমেলো চুল। তাজা গরম রক্ত। এই রক্ত যেনো হাজার গুনে বাড়িয়ে দেয় চারুর র*ক্তপিপাসা। আজ এখানে র*ক্তের বন্যা বইবে। হয় মরবে নয় মারবে। আজ হবে সকল হিসাব। চারু সিফাতকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই অভি আর স্মৃতি একধরনের মাস্ক পড়ে নিলো আর সাথে সাথে একধরনের গ্যাসে ছেয়ে গেলো সম্পূর্ণ ঘরটি। চারু যেনো অবাক হওয়াও ক্ষমতা ভুলে গেছে। রাগে, দুঃখে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অবধি কাপছে। তবে সে রাগ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মুহুর্তের মাঝেই শিথিল হয়ে এলো সকল কিছু। সে কখন মেঝেতে পড়ে গেলো তা সে নিজেও ঠাহর করতে পারেনা। আচ্ছা হামিদ? হামিদের কি হলো? ঠিক আছে তো ও?

বিঃদ্রঃ দুই পর্বে শেষ করা গেলো না। লাইট ইউজাররা পড়তে পারবেনা। তাই অন্তিম পর্ব আগামীকাল পোস্ট করা হবে এই পর্বে আশানুরূপ রেসপন্স পাওয়া গেলে। সবাই রেসপন্স করুন। কাল গল্প দেওয়ার কথা থাকলেও অনলাইনে যাওয়ার সুযোগ হয়নি বিধায় পোস্ট করতে পারিনি। এরজন্য আবারও দুঃখিত। আপনারা দয়া করে বিরূপ মন্তব্য করবেন না। লেখার আগ্রহ হারিয়ে যায়। আর হাজার দুয়ের শব্দের মতো একটা পর্ব বাকি আছে। আর গল্প গল্পই হয়। সকলের মনমতো হবেনা সেটাই স্বাভাবিক। এন্ডিং যেমনই হয়, আশা করছি আপনারা মেনে নেবেন। এই গল্পের এন্ডিং অন্য সাধারণ গল্পের থেকে আলাদা ভেবে রাখা হয়েছে। সেভাবেই এন্ডিং আসবে আর ২০২০ সাল থেকেই আমি এভাবে ভেবে রেখেছিলাম। মাঝখানে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে জগাখিচুরি বানিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু সেই পর্ব এখন ডিলিট। যারা কপি করে রেখেছেন তারাও ডিলিট করে দিন।

_______________________

To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া