আমি সেই চারুলতা পর্ব-৪১

0
411

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
|৪১|
_________________________

আকাশে কালো মেঘের রাজত্ব। মাঝে মাঝে সেখানে দেখা যাচ্ছে বিদ্যুতের ঝলকানি। গাছপালা এমনভাবে বাতাসে নড়াচড়া করছে, মনে হচ্ছে যেনো এখনি সব ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। রেডিওটি চালু আছে তবে এই ঝড় বৃষ্টির মাঝে বারবার সিগন্যাল কেটে যাচ্ছে। অদ্ভুত ঝিরিঝিরি শব্দ আসছে সেখান থেকে। রেডিওতে যা বলা হচ্ছে তার সারমর্ম হলো, বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় দেশের দারুণ ক্ষয়ক্ষতি করছে। এক সপ্তাহ ব্যাপী সারা বাংলাদেশে এই ঝড় অব্যাহত থাকবে। এমনকি ভারতের কিছু অংশেও ব্যাপকভাবে ক্ষতি করছে এ ঝড়!
তবে তার চেয়েও বেশি ঝড় বয়ে চলেছে বিন্দিয়ার মনে। আজ প্রথমবারের মতো মা তার গায়ে হাত তুলেছে। জীবনে সকল ক্ষেত্রে মায়ের সাপোর্ট পেয়ে এসেছে সে আর আজ কি না সেই মা-ই তাকে না বুঝে চড় মারলো। বিন্দিয়া যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে বললো,
– মা তুমি আমারে একটু বুঝার চেষ্টা করো। তুমি তো জানো আমি তারে কতটা পছন্দ করি। তুমিও ক্যান সবার মতো আমারে ভুল বুঝতাছো?
– তোরে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেওয়াই আমার ভুল হইছে। তুই হইলি আমার গর্ভের কলঙ্ক। তোরে আমি লেহাপড়া করাইছি কি অন্য মাইয়ার ঘর ভাঙার জন্য?
– আমি তো ঘর ভাঙতে চাইনা মা। আমি তার দুই নাম্বার বউ হইয়াও থাকতে রাজি।
বিন্দিয়ার কথায় ক্রোধে ফেটে পড়লেন জুলেখা বেগম। একটা মাত্র মেয়ে হওয়ায় মেয়েকে খুব ভালোবাসেন তিনি। যখন জেনেছিলো তার মেয়ে হামিদকে পছন্দ করে তিনি অমত করেননি। হামিদের জন্য অপেক্ষা করতে চাইলেও তিনি দ্বিমত করেননি। মেয়ের সুখকেই তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছেন কিন্তু তাই বলে মেয়ের এমন অধঃপতন হবে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। সে কি না হামিদের দ্বিতীয় বউ হয়েও এখন থাকতে রাজি। নিজের মেয়ের কোনো দুর্বলতা তিনি খুজে পেলেন না যার কারণে তিনি মেয়েকে হামিদের দ্বিতীয় বউ করে ঘরে পাঠাবেন। তাছাড়া একটা মেয়ের সাজানো সংসার তার মেয়ে নষ্ট করবে সেটাও তিনি মানতে পারছেন না।
– আমার কথাটা শুনো মা। হামিদ ভাই এমনেও তার বউরে একদমই পছন্দ করেনা। আমি যদি তার বউ হইয়া যাই তাতে কোনো সমস্যা হইবো না। হইতে পারে সে তার আগের বউরেও ছাইড়া দেয়।
– মুখপুড়ি, অলক্ষি! এক মাইয়ার ঘর ভাঙতে চাইয়া আমার কাছে সাফাই গাইতে আসছোস? তোর মতো মাইয়া আমার কাছে ভাবলেই আমার নিজের উপর ঘৃণা হয়। তুই গলায় কলসি বাইন্ধা নদীতে ঝাপায়া পড়। এমন মাইয়ার দরকার নাই আমার।
বিন্দিয়ার মা কথা আর বাড়াতে দিলেন না। তিনি নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন আর বিন্দিয়া বারান্দায় একটা কোনায় পড়ে রইলো। ঘরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। আজ মা-ও তার থেকে মুখ ঘুড়িয়ে নিলো। বিন্দিয়ার ভাবতেও অবাক লাগে সে একজন কালো মেয়ের কাছে হেরে গেলো। একটা কালো মেয়ে হামিদকে অধিকার করে নিলো কিন্তু তার রূপ গুন যৌবন সব থাকার পরেও সে হামিদকে পেলো না। কি আছে ওই কালো মেয়ের মাঝে? অসম্ভব! দুনিয়া উল্টে গেলেও হামিদকে সে নিজের করেই ছাড়বে। যে করেই হোক না কেনো।

★★★

চারু এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নামটির দিকে। “শিহাব আজমীর অভি” এমন বিষাক্ত লাগছে কেনো নামটাকে? শিহাব! নাজিমুদ্দিনের ভাষ্যমতে বস চারুর পরিচিত কিন্তু তাই বলে শিহাব?
– কি হলো? চুপ করে রইলে কেনো?
– এইটা মোটেই ভয়ংকর কিছু ছিলোনা। এইটা শুধুই কাকতালীয়। অভি তো সকলের কাছে সুবহান নামে পরিচিত তবে সেখানে শিহাবের নাম অভি না হয়ে সুবহান হতো।
চারু খাতাটা বন্ধ করে দিয়ে বেড়িয়ে গেলো উঠোন থেকে।
– আরে এই ঝড় বৃষ্টির মাঝে তুমি কোথায় যাচ্ছো? চারুলতা!
হিমেলের ডাক কিংবা প্রশ্নের কোনো জবাব দিলোনা চারু। চুপচাপ সে চলে গেলো পুকুর পাড়ে। শরীরে কাটা দিয়ে ওঠা ঠান্ডা পানিতে গলা অবধি নেমে গেলো সে। মন খারাপ হয়ে গেলে পুকুর পাড়ে, দীঘির পাড়ে গিয়ে বসে থাকে হরহামেশাই তবে এভাবে নেমে পড়েনি কখনো। হিমেলকে কিছু একটা বলে শান্তনা দিয়ে আসলেও চারুর মন মানতে চায়না। শিহাবের চোখে সে ভালোবাসা দেখেছে। মানুষ মিথ্যা বলতে পারে কিন্তু মানুষের চোখ কিভাবে মিথ্যা বলে? শিহাব যদি সেই তথাকথিত বস হয় তবে চারু কিভাবে লড়বে তার সাথে? শিহাব এতগুলো মানুষের জীবন নষ্টের জন্য দায়ী এইটা কিছুতেই চারু মানতে পারছেনা। এখানে নিশ্চয়ই কিছু একটা রয়েছে।
চারু ঠিক কতক্ষণ এভাবে পুকুরের জলে ডুবে ছিলো সে নিজেও জানেনা। সে সজ্ঞানে আসে সিফাতের ধমকে, এইভাবে এইসময়ে পুকুরে ডুবে থাকার কারণে প্রচুর রেগে আছে সে। চারু আর তার রাগটা বাড়িয়ে দিলো না। চুপচাপ উঠে এলো সেখান থেকে।
– সমস্যা কি আপনার? এই সময়ে পুকুরে নেমেছেন কেনো?
– গোসল করতে।
– এই সময়ে?
চারু উত্তর দেয়না। সিফাত খুব শক্ত করে চারুর হাত ধরে তাকে বাড়ির দিকে টেনে নিতে থাকে। চারুর হাতে একটু ব্যথা লাগলেও সে উচ্চবাক্য করলো না। সিফাত প্রচন্ড রেগে আছে তার উপর।
– শুনুন। (সিফাত)
– বলুন।
– আমি একজন হুজুরের সাথে কথা বলেছি।
– কোন বিষয়ে?
– বাবার সত ছেলেকে বিয়ে করা জায়েজ কি না? তার উত্তর কিন্তু না ছিলো।
– মানে?
– মানে আপনি শিহাবকে বিয়ে করতে পারবেননা।
– আপনি এমন একটা ভাব করছেন যেনো মনে হয় আমি তাকে বিয়ে করার জন্য মুখিয়ে আছি। যাই হোক, এই বিষয়ে ভিন্ন মতভেদ আছে। আমি সেসব দিকে যেতে চাইছিনা কারণ সেসব মূল্যহীন।
– মোট কথা আমার অবর্তমানেও আপনি অন্য কারোর হবেন না বেলিফুল। আপনি সারাজীবন আমার বাগানেই সুভাস ছড়াবেন। অন্য কারোর বাগানে আমার বেলিফুল আমি একদম সহ্য করবোনা বলে দিলাম।
– বেশ কিছুদিন যাবত আপনি খুবই পজেসিভ বিহেভ করছেন সিফাত৷ আগে কখনো দেখিনি এমনটা।
– আগে তো আপনাকে আমি ভালোবাসতাম না। এই কি জাদু করলেন বলুন তো আমাকে? আমি এখন আপনাকে ছেড়ে কিছু ভাবতেই পারিনা। প্রচুর জেলাসিও হয় কাউকে আপনার সাথে দেখলে। এমনকি আপনি বিশ্বাস করবেন না, মাঝে মাঝে যখন আমি ভাবি আপনি হামিদকে অনেক বেশি ভালোবাসেন, আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসেন তখন আমি হামিদের প্রতিও জেলাস হই। আমার মনে হয় তার উচিত না আপনার পাশে থাকা। মানে আপনি ভাবতে পারছেন, আপনার পাশে আমি আপনার বড় ভাইকেও সহ্য করতে পারিনা। কি পরিমান জেলাসি আমার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আমার মতো ভদ্র সভ্য ছেলেকে কি বানিয়ে দিচ্ছেন আপনি বেলিফুল?
চারু অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে রইলো সিফাতের দিকে। শেষ পর্যন্ত সে হামিদকে নিয়েও জেলাস! এইরকম ছেলে বোধহয় দুনিয়ায় একপিসই আছে।
– এভাবে তাকাবেন না। শুনুন ভালো করে, আমি থাকি আর না থাকি আপনি আমার। যদি অন্যকারোর হওয়ার কথা চিন্তাও করেন না, আপনার মুখে যেনো ব্রন ওঠে। অভিশাপ দিচ্ছি। স্বামীর অভিশাও কিন্তু খুব লাগে!
– কিসব উল্টোপাল্টা কথা বলছেন সিফাত?
– ঠিকই বলছি বেলিফুল। আপনি আমাকে বুঝবেন না।
– কি বুঝবো না?
– আপনি আর আমি, আমরা দুজনেই একজোড়া সুখপাখি। আমাদের দুজনের মিলনপথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশাল এক নদী। আমি বড়জোর ডানা ঝাপটে নদীর অর্ধেকটা পাড় হতে পারি কিন্তু বাকি অর্ধেকটা তো আপনাকে এগিয়ে আসতে হবে বেলিফুল। আমরা দুজনেই যদি অর্ধেক অর্ধেক করে পাড়ি দেই তবে আমাদের মিলন সন্নিকটে কিন্তু আমি ডানা ঝাপটে অর্ধেক নদী পাড়ি দিলাম কিন্তু আমার আহ্বানে আপনি সায় দিলেন না। চুপটি করে বসে রইলেন নদীর অপর প্রান্তে তবে কি আমাদের মিলন আদেও সম্ভব?

★★★

বৃষ্টির কারণে রাস্তায় কাদার ছড়াছড়ি। দুই হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে কঠিন বিরম্বনায় পড়ে গেছে হামিদ। কিছুক্ষণ আগে তো এক পা কাদার নীচে চলে গিয়েছিলো প্রায় হাটু অবধি। একটুর জন্য বাজারের ব্যাগ পড়তে পড়তে পড়েনি। সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হচ্ছে বাজারের জন্যই। সাথে কাউকে নিয়ে আসলে বোধহয় ভালো হতো,
– কেমন আছেন হামিদ ভাই?
মেয়েলি কন্ঠের আওয়াজে পেছনে ফিরে তাকায় হামিদ। মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ হচ্ছে তার। এমন ব্যক্তিত্বহীন মেয়ে আজ অবধি দেখেনি সে। আবার তার কথা ভেবে কিঞ্চিৎ খারাপও লাগছে। গ্রামে ২০+ বয়স মানে অনেক বয়স। এই বয়সেও বিন্দিয়া অবিবাহিত শুধুই তার জন্য। কিন্তু এর দায়ভার নিশ্চয়ই হামিদের নয়। সে তো ভালো করে চিনতোও না বিন্দিয়াকে। হামিদ যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো বিন্দিয়াকে,
– বাসায় যাইতেছেন বুঝি?
হামিদ শুনেও না শোনার ভান করে এগিয়ে গেলো।
– আপনি আমার কথার উত্তর ক্যান দিতাছেন না? কথা বলেন আমার সাথে।
– একটা মাইয়া মানুষের সাধারণ লজ্জাবোধ থাকা উচিত বিন্দিয়া। তুমি কেমন মাইয়া যে সাধারণ আত্মসম্মানবোধ লজ্জাবোধ কিছুই তোমার মাঝে নাই।
– প্রচুর আছে। এত আছে যে তা কল্পনা করাও আপনের সাধ্য নাই। আমি যদি আপনেরে ভালো না বাসতাম তাইলে জীবনে কোনোদিন আপনের চেহারাও আমি দেখতাম না। কিন্তু কি বলেন তো, ভালোবাসা মানুষরে বেহায়া কইরা দেয়। আমিও বেহায়া হইয়া গেছি। আমারে কি আপনের এতবড় জীবনের ছোট একটা অংশেও রাখা যায়না?
– না যায়না।
– ক্যান যায়না? একটু দয়া করেন আমারে। আমি কিচ্ছু চাইনা, আপনে নাহয় আমারে ঘরের দাসী বাদি বানাইয়া রাইখেন। সারাদিন সব কাজ করমু। আপনে শুধু সকলের কাছে আমার পরিচয় দেবেন। আপনের পরিচয়ে আমি আমার জীবন কাটাইতে চাই। এইটুকু দয়া অন্তত করেন। কত মানুষেরই তো একাধিক বউ
থাকে।
হামিদ বিন্দিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিলেও তার প্রতি একটু করুনা হচ্ছে। সেটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে দ্রুতই হামিদ সেখান থেকে চলে এলো। একজন মানুষকে কতটা ভালোবাসলে এমন সর্বগুনসম্পন্না হয়েও এইভাবে কাউকে ভিক্ষা চাওয়া যায়? আদেও কি দ্বিতীয় বিয়ে করা উচিত হবে?
হামিদের চিন্তাভাবনায় চমকে উঠে সে নিজেই। ছিহ! এমন একটা জঘন্য ভাবনা কিভাবে ভাবতে পারে? সে নিজেই তো দুই বিয়ে করা পুরুষদের পছন্দ করেনা। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে সে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। কিছুটা দূরে যেতেই দেখা গেলো কাদের মিয়াকে। কাদের মিয়ারও দুই বউ। দুই বউকে নিয়ে একসাথেই থাকেন তিনি। আচ্ছা দুই বউ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? আবারও নিজের জঘন্য চিন্তাভাবনায় শিউরে ওঠে সে, কি হয়েছে তার? এই বিন্দিয়া তার মাথাটাই খারাপ করে দিয়েছে। সুন্দরী মেয়ে, তার জন্য তো ছেলের অভাব হবার কথা নয় তবে সে কেনো হামিদের পেছনে পড়ে আছে। হামিদ সিদ্ধান্ত নিলো সে কাদের মিয়ার সাথে সে কথা বলবেনা। কিন্তু পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়ে কাদের মিয়া নিজেই ডাকলেন হামিদকে। ভদ্রতার খাতিরে হামিদকে এগিয়ে যেতে হলো সেখানে।
– তুমি হামিদ না?
– জি চাচা। কেমন আছেন?
– ভালা আছি বাজান। বহুত ভালা আছি। তোমরা কেমন আছো? শুনলাম বইনেরে নাকি ভালো জায়গায় বিয়া দিছো?
– জি চাচা।
– ভালা একখানা কাম করছো বাপ। এমন সোনার টুকরা মাইয়াডার বিয়া কার লগে দিছিলো। একটা প্রবাদ শুনছিলাম বান্দরের গলায় মুক্তার মালা। ওইরকম হইছে ব্যাপারটা। তা তোমার বইনের জামাই কি করে?
– পুলিশে আছে।
– বাহ! পুরান কথা মনে হইলে কি যে আফসোস হয়। ক্যান যে তোমারে তহন ঠিকানাটা দিলাম না। দিলে মাইয়াডার জীবন আরো আগেই ঠিক হইয়া যাইতো। বড় ভুল হইয়া গেছে বুঝলা? তোমাগো সত মায়ের পাল্লায় পইড়া হুস জ্ঞান সব হারাইয়া বসছিলাম। শুনলাম তুমিও নাকি বিয়া করছো? পরীর মতন একটা মাইয়া আছে?
– জি চাচা। দোয়া কইরেন আমার মাইয়াটার জন্য।
– হ বাপ দোয়া করি। ভালা থাকো তোমরা।
– চাচিরা কেমন আছে চাচা?
– তোমার চাচিরা ভালোই থাকে খালি মাঝে মধ্যে একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া লাইগ্যা যায়। কি মুসিবত কও তো। দুই বউয়ের জালায় আর পারা যায়না।
– খুব বেশি ঝগড়া করে মনে হয়?
– না তেমন ঝগড়া করেনা। দুইজনে মিলা মিশাই কাজ কাম করে তয় মাঝে মাঝেই দুইটা একটু বিগড়ায় যায়।
– আপনে দুই বিয়া করছিলেন ক্যান চাচা? না মানে জানতে ইচ্ছা হইলো আরকি! কিছু মনে কইরেন না।
– আরে না না। তোমার বড় চাচির লগে বিয়া হওনের পাঁচ বছর পরেও বাচ্চাকাচ্চা হইলো না দেইখাই তোমার ছোট চাচিরে বিয়া করছিলাম।
– বড় চাচি আপত্তি করে নাই?
– না করে নাই। বিয়ার এত বছরেও সন্তানের মুখ দেহাইতে পারে নাই আমারে সে আবার ক্যামনে আপত্তি করবো।
– কিন্তু চাচা আমি যতদুর জানি ছোট চাচিরও বাচ্চা হয় নাই।
– দুইটা বিয়া করছিলাম, দুইটাই আটখুইড়া! কপাল খারাপ আমার। কি আর করমু কও।
হামিদের ভ্রু কুচকে গেলে। এই লোক এখনো ভেবে যাচ্ছে তার দুই বউয়ের সমস্যা কিন্তু সমস্যা যে তার মাঝেও হতে পারে এ নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
– তয় দুই বিয়ার সুবিধা আছে বুঝলা? এক বউয়ের সাথে ঝগড়া লাগলে আরেক বউয়ের আছে গিয়া থাকন যায়। দুই বউয়ের সেবা যত্ন পাওয়া যায়। আরামেই আরাম। দুই বউয়ের রান্নার হাত ভালো। কম জিনিস দিয়াও মজার খাওন রান্না করতে পারে। একেবারে মুখে লাইগ্যা থাকনের মতো। একদিন বাসায় আইসো সবাইরে নিয়া। চাচির হাতের রান্না খাইয়া যাইয়ো। দেখবা আর জীবনে সেই স্বাদ ভুলবা না।
– জি চাচা যামু। আপনেও দুই চাচিরে নিয়া ঘুইরা আইসেন।
কাদের মিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হামিদ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। এই ঠান্ডা আবহাওয়ায়ও গরমে ঘেমে গেছে সে। ফাতেমা তাড়াহুড়ো করে বাজারের ব্যাগগুলো হাত থেকে নিয়ে একগ্লাস শরবত করে দিলো হামিদকে। তবে শরবতে চিনি কম। হামিদ প্রচন্ড রেগে ফাতেমাকে এই সেই কথা শুনিয়ে দিলো। এমনকি কথা শুনিয়েও শান্ত হলোনা, দ্বিতীয় বিয়ে করার হুমকিও দিলো। ফাতেমাও কাঠকাঠ কণ্ঠে জবাব দিলো,
– অন্য মাইয়ার কথা মাথায় আনলে আপনের মাথা ব্যাথা হইবো দেইখেন। অভিশাপ দিলাম আপনেরে। তখন শুধু আমারে বইলেন মালিশ করতে, আমিও বুঝায়া দিমু কত ধানে কই চাল।
ফাতেমার প্রতিউত্তরে হামিদ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলো। এই মেয়ে তো ওর চেয়েও বেশি পাগল।

★★★

একটি মেয়ের সর্বোচ্চ সুখ তার স্বামীর ভালোবাসা। এই ভালোবাসা পেতে কতই না মুখিয়ে থাকে তারা কিন্তু স্বামীদের এত সময় কোথায় তারা স্ত্রীকে ভালোবাসে? সম্পর্ক যতটা পুরোনো হয় মেয়েরা ততটাই মায়ায় বাধিত হয় আর ছেলেদের মায়া কাটতে থাকে খুবই দ্রুত। সংসার টিকে যায় কেবল দায়িত্বের খাতিরে। ফাতেমার সাথেও বোধহয় এইটাই হচ্ছে। তবুও নিজের সবটা দিয়ে সে ভালোবেসে যায় হামিদকে। কিভাবে যেনো এই মানুষটার মায়ায় জড়িয়ে যায় সে। ঘরে বিদুৎ নেই, ফাতেমা কুপি জালিয়ে দিয়েছে। মেয়ে ঘুমিয়েছে অনেকক্ষণ। চারিদিকে ভয়ানক নিস্তব্ধতা। এই নিস্তব্ধতাকে প্রচন্ড ভয় পায় ফাতেমা। কে জানে হামিদ কোথায় আছে। হামিদের কথা ভাবতে না ভাবতেই হামিদ ছাতা নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো,
– এই ঝড় বৃষ্টির রাইতে কই গেছিলেন আপনে?
– আরে আর বইলো না, মাইয়া মানুষ মানেই পাগল। আর চারুর বান্ধবী সবচেয়ে বেশি পাগল। সারাদিন রাস্তায় মনে হয় শুধু আমারেই খোজে। দেখলেই জালানো শুরু। তখনই হঠাৎ ঝড় শুরু হইলো, সে বায়না ধরছে আমি না দিয়া আসলে বাসায় যাইবো না। এহন এত রাইতে একটা মাইয়ারে রাস্তায় ফালায়া আসতে বিবেকে বাধা দিলো তাই তারে বাসায় পৌছায়া দিয়া আমার আসতে দেরি হইয়া গেছে।
– আপনে এতক্ষণ ওই মাইয়ার সাথে ছিলেন? এক ছাতার নীচে?
ফাতেমার কণ্ঠস্বরে তীব্রভাবে প্রকাশ পাচ্ছে কষ্ট। হামিদ বিব্রত হলো,
– এক ছাতার নীচে ছিলাম না। পাশেই আমার এক বন্ধুর বাড়ি ছিলো ওইখান থেইকাই একটা ছাতা ধার নিছিলাম।
– ওই মাইয়া আপনের পিছু ঘুরে ক্যান?
– আমি ক্যামনে বলমু?
– ইদানীং আপনের হাবভাবও কিন্তু খুব একটা ভালো লাগতাছেনা আমার। আপনে এহন দ্বিতীয় বিয়ার কথা বলেন। কই আগে তো কোনোদিন বলতেন না।
– বাজে কথা বইলো না তো। কুপি বন্ধ কইরা ঘুমাইতে আসো। এই ঠান্ডার মধ্যে এমন পাতলা শাড়ি পইড়া আছো ক্যান? ঠান্ডা লাগাইবা? কম্বল মুড়ি দিয়া ঘুমাও আর কুপি বন্ধ করো।
– কুপি বন্ধ না করি? আমার অন্ধকারে খুব ভয় লাগে। মনে হয় দেয়াল গুলা আমার দিকে আগায়া আসে। খুব ভয় লাগে অন্ধকারে।
– এত বড় হইলা এখনো ছেলেমানুষী গেলোনা। অন্ধকারে ভয় পাও, গ্রামের মাইয়া হইয়া পানিরে ভয় পাও এইগুলা কোন ধরনের পাগলামি?
– আমি কি ইচ্ছা কইরা ভয় পাই নাকি?
হামিদ উত্তর না দিয়ে চুপচাপ কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে। যেকেউ শীতকাল বলে ভুল করতে বাধ্য।
– একটা প্রশ্ন করি আপনেরে?
– কি প্রশ্ন?
– আমি সাজলে আপনে আমার দিকে তাকান না ক্যান?
– তুমি আবার সাজো নাকি?
– হুম। আজকেও সাজছিলাম কিন্তু আপনে তাকান নাই। আপনে না তাকাইলে আমি কার জন্য সাজমু? আমারে কি সাজলেও ভালো লাগেনা?
– কোনোদিন খেয়াল করি নাই তবে লাইট কার্লার দিয়া সাজবা না। যেমন গোলাপি, সাদা, কালো গায়ের রঙে একবারে ক্যাটক্যাট করে এইসব রঙ। তুমি একটু অনুজ্জ্বল রঙ দিয়া সাজতে পারো।
– আজকে অনুজ্জ্বল রঙ দিয়াই চারু সাজায়া দিছিলো তাও আপনে দেখেন নাই। তবে আমার কি মনে হইছে জানেন? ফুল দিয়া সাজলে বেশি সুন্দর লাগে। আচ্ছা আপনের পছন্দের ফুল কি?
– আমার?
– হুম।
– আমার পছন্দ জাইনা তুমি কি করবা? ওই ফুল দিয়া সাজবা নাকি? যাই হোক, ওই ফুল দিয়া সাজলে কিন্তু আমি সত্যিই তোমারে খেয়াল করতে বাধ্য। যেকোনো মাইয়ারেই রানীর মতো লাগে এই ফুল দিয়া সাজলে।
– সত্যি?
– অবশ্যই। আমি কি তোমারে মিথ্যা কইতাছি নাকি? ওই ফুল দিয়া যদি তুমি সাজো তাইলে আমি তোমার দিকে তাকামুও আবার তোমার সাথে ছবিও তুলমু।
– আমার প্রসংসা করবেন না?
ফাতেমা খানিক লজ্জা পেয়ে প্রশ্নটা করতেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো হামিদ।
– হুম, তোমার প্রসংশাও করমু।
– তাহলে বলেন ওইটা কোন ফুল?
– পদ্ম ফুল। তুমি আবার একা একা নিতে যাইয়ো না। আমারে বইলো আমি আইনা দিমু। তুমি তো আবার সাতার জানো না।
– একটা কথা কই?
– বলো।
– আমার না মাঝে মাঝে মনে হয় আপনে আমারে অনেক ভালোবাসেন আবার মাঝে মাঝে মনে হয় আপনে একদমই আমারে ভালোবাসেন না। আপনে সবসময় এমন থাকতে পারেন না?
– কেমন?
– এইযে এখন যেমন। আচ্ছা আপনে কি আমারে ভালোবাসেন?
– তোমার কি মনে হয়?
– আমার কিছুই মনে হয় না। আপনে বলেন।
ফাতেমার প্রশ্নে হামিদ নিজেও দ্বিধার স্বীকার হয়। আসলেই কি সে ভালোবাসে ফাতেমাকে? মাঝে মাঝে এক ধরনের তীক্ষ্ণ অনুভূতি সৃষ্টি হয় ফাতেমার জন্য। অন্য কারোর জন্য কখনো সেটা হয়নি তবে এই অনুভূতি সাময়িক। সময়ের সাথে সাথেই হারিয়ে যেতে থাকে সে অনুভূতি। আবার অনেক সময় পর ফিরে আসে সেটি। কোনোরকম শারিরীক আকর্ষণ ছাড়াই এই অনুভূতিটা কাজ করে। হামিদ নিজেও দ্বিধার মাঝে আছে সে কি আসলেই আটকে গেছে এই কালো মেয়েতে?
– কি হইলো? কথা বলেন না ক্যান?
– আমি তোমারে ভালোবাসি কি না জানি না তবে তুমি আমার জীবনে কালো পদ্ম। আবার কালো পদ্ম বলছি বইলা ভাইবো না অবহেলা করতাছি। এই কালো পদ্ম দুনিয়ায় একটাই আছে আর সেই মহামূল্যবান কালো পদ্মটা শুধুই আমার। একান্তই ব্যক্তিগত আমার!
ফাতেমার চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়। না এ জল কষ্টের না। একরাশা ভালোবাসা মিশে আছে এ অশ্রুজলে। এই প্রথমবার এত সুন্দর উপমা দিয়েছে হামিদ তাকে। নিজের প্রিয় ফুলের সাথে তুলনা করেছে। এইটাই কি বেশি নয়? আর কি চাওয়ার আছে এই দুনিয়ার কাছে? ফাতেমার আবারও মন খারাপ হয়, এইটা যেমন প্রথম উপমা ছিলো, এইটাই বোধহয় শেষ উপমাও হবে। হামিদ কি আদেও আর কোনোদিন তার প্রশংসা করবে?

★★★

পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে ঘুম ভাঙে ফাতেমার। হামিদকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছিলো এতক্ষণ। হামিদ নিশ্চয়ই টের পায়নি। ফাতেমা যেনো কাল রাতে আবারও নতুন করে আবিষ্কার করলো ভালোবাসায় পরিপূর্ণ এক হামিদকে। এই ছেলেটার বিভিন্ন রূপ। কতবার সে কতরকম আচরণ করে তা বোধহয় তার নিজেরও জানা নেই তবে ফাতেমা প্রতি রূপেই ভালোবাসে হামিদকে। হামিদকে যেমন সে ভালোবাসে তেমনি তার ভালোটাকেও সে ভালোবাসে আবার খারাপটাকেও ভালোবাসে। ভালো খারাপ মিলিয়েই তো মানুষ হয়। এলোমেলো হয়ে যাওয়া শাড়িটাকে সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নেয় সে। প্রতিবারই বিশেষ সময় কাটানোর পর হামিদের সামনে যেতে লজ্জাবোধ করে সে। এক সন্তানের মা হওয়ার পরেও সে লজ্জা এখনো অব্যাহত আছে। অপরদিকে হামিদের কোনো হেলদোলই নেই। ফাতেমা যে লজ্জা পাচ্ছে এইটাও সে বুঝতে পারেনা। ভালোই হয়েছে বুঝতে পারেনা। এই ছেলে যা জিনিস, বুঝলে নিশ্চয়ই ফাতেমাকে লজ্জা দিতে দিতে সে মেরে ফেলতো। ফাতেমা আলতো করে একটা চুমু দিলো হামিদের কপালে আর তারপর মেয়ের কপালে। প্রতিদিন সকালেই সে এইটা করে। তার নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন এইটা। ভালোবাসা প্রকাশের এক নিজস্ব ধরন এটি। এই ভালোবাসাটা বোধহয় চিরকাল অপ্রকাশিতই থাকবে। থাকুক না, অসুবিধা কি? সব ভালোবাসাই কি প্রকাশ পেতে হবে নাকি?
ফাতেমা ধুসর রঙের একটা শাড়ি বের করে নিলো। হামিদ বলেছে সে যদি পদ্মফুলে সাজে তবে হামিদ আর প্রসংসা করবে। হামিদের পছন্দসই আজ আবার সাজবে সে। কলঘর থেকে গোসল করে নিয়ে পায়ে গাড়ো করে আলতা পড়লো, মুখে সামান্য পাউডার লাগিয়ে হালকা রঙের লিপস্টিক পড়লো। হাতে কাচের চুড়ি। চারুর কাছ থেকে নিয়েছলো। চোখে গাড়ো করে আকা কাজল। নিজেকে দেখে মুগ্ধ হলো ফাতেমা, অবশ্য হামিদ কখনো হয়নি। এইবার ফাতেমা বেড়িয়ে পড়লো পদ্মফুল খোজার উদ্দেশ্যে। সোনাদীঘির পাড়ে পদ্মফুল দেখেছিলো সে। সোনাদীঘির রহস্য জানেনা ফাতেমা। জানলে নিশ্চয়ই এই কাকডাকা ভোরে সে সেখানে যেতে সাহস পেতো না। দীঘিতে অনেক ফুল ফুটেছে। এত ফুল কেনো? ফাতেমার জন্যই কি! তবে ফুলগুলো বেশ দূরে৷ আনতে ঝামেলা পোহাতে হবে। ফাতেমা কোথাও থেকে একটা গাছের ডাল যোগাড় করলো। যথাসম্ভব পানির থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করলো সে। পানিতে বেশ ভয় তার। চারু বলেছলো ফাতেমার নাকি পানিতে ফোবিয়া আছে। ফোবিয়া কি তা জানেনা ফাতেমা কিন্তু কাউকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে এই ফোবিয়ার কারণেই ছোটবেলায় ফাতেমার সাতার কাটা শেখা হয়নি।
নাহ! ফুলগুলো একটু বেশিই দূরে। ফাতেমা আরো দুই সিড়ি নেমে গেলো। আর নামা যাবেনা। এরপরই সিড়ি পানিতে নেমে গেছে এবং সে সিড়ি দারুণ পিচ্ছিল। একবার পা পিছলে গেলে সোজা উপরে। কিন্তু ফাতেমা হাজার চেষ্টা করেও একটা ফুল নিজের আয়ত্বে আনতে পারছেনা। তবে কি সে ফিরে যাবে?
ফাতেমা নিজ মনেই নিজেকে না বললো। মনে করলো হামিদের মুখ। হামিদ বলেছে পদ্মফুলে সাজলে হামিদ তার প্রসংসা করবে, তার সাথে ছবি তুলবে। হামিদের একটু প্রসংশা পাওয়ার লোভে ফাতেমা সব করতে পারে। সব! সাধারণ মানুষের কাছে বোধহয় এইটা পাগলামি মনে হবে কিন্তু ভালোবাসার মানুষটির কাছে প্রসংশা পাওয়া কতটা আনন্দের তা তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। ফাতেমার মনে হচ্ছে হামিদের জন্য সে সব করতে পারবে। সব! ফাতেমা মনে সাহস নিয়ে এক পা এগিয়ে দিলো সেই পিচ্ছিল সিড়িতে। এইবার কিছুটা ধরতে পারছে। আরেক সিড়ি নিচে নামলেই সহজেই সেটাকে হাতে পাওয়া যাবে। দুই তিনটা পদ্ম সহজেই হাতে চলে আসবে। ব্যাস! দুই তিনটা হলেই হয়ে যাবে ফাতেমার। আজও প্রচন্ড লজ্জা লাগবে তার হামিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। হামিদ যখন প্রসংশা করবে তখন বোধহয় সে খুশিতে পাগল হয়ে যাবে। উফফ কি লজ্জাজনক ঘটনা ঘটতে চলেছে! হামিদকে মনে করে আরেক পা এগিয়ে দিলো নিচের সিড়িতে। এইবার ফুলগুলো ধরা যাচ্ছে। লাঠির সাহায্যে ফুলগুলো সামনে এনে অতন্ত্য খুশি হলো ফাতেমা। কিন্তু অসাবধানতাবশত ঝুকে ফুলগুলো নেওয়ার সময় হঠাৎই পা পিছলে গেলো ফাতেমার।

হামিদের ঘুম ভাঙলো সকাল আটটায়। লতা এখনো ঘুমিয়ে আছে তবে ফাতেমাকে দেখা যাচ্ছেনা। ফাতেমা বোধহয় নাস্তা বানাচ্ছে তাই এমন কিছু ভাবলো না হামিদ। কলঘর থেকে হাতমুখ ধয়ে রান্নাঘরে যেতেই দেখা গেলো চারু একাই নাস্তা বানাচ্ছে,
– কি রে তোর ভাবি কই?
– ভাবি কই মানে? ঘরে নেই? আমি তো আরো ভাবলাম ভাবি ঘুমাচ্ছে তাই আর ডাকিনি।
– না ঘরে তো নাই।
– বোধহয় আছে আশেপাশে কোথাও। কেনো তোমার কি কিন্তু লাগবে?
– না এমনিই জিজ্ঞেস করতাছিলাম। নাস্তা হইছে?
– হুম বসো। আমি খেতে দেই। ভাবির সাথে কয়েকজন প্রতিবেশির বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। তাদের কোথাও আছে বোধহয়।
– মাইয়া মানুষ আড্ডা পাইলে আর ছাড়ার নাম নাই। কে জানে কার বাসায় গেছে, কহন আসবো।
– চিন্তা করোনা চলে আসবে।
চারু আসবে বললেও দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পরেও ফাতেমা এলোনা। হামিদের রাগ দুঃচিন্তায় রূপ নিতে লাগলো। এই গ্রামে তো মেয়েটা তেমন কিছু চেনেও না তবে কোথায় গেলো? চারু আর হামিদ ঠান্ডা মাথায় খুজতে বের হলো ফাতেমাকে। আশেপাশে সকল জায়গা দেখলেও ফাতেমাকে পাওয়া গেলো না। বিকেল হতেই সকলের মাঝে অস্থিরতা দেখা যেতে লাগলো। সকলেই জানে ফাতেমা খুব বোকা ধরনের একটা মেয়ে। সে কোথায় যেতে পারে? সকলে মিলে খোজাখুজি শুরু করলো তাকে। গ্রামবাসীরাও কোথাও তাকে দেখেনি। চারু প্রথমে ব্যাপারটা গুরুত্ব না দিলেও এখন বেশ চিন্তা হচ্ছে তার।
– ভাইয়া দীঘির পাড় গুলো দেখেছো?
– ও পানিতে ভয় পায়। দীঘিতে যাইবো ক্যান?
– আমার মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে আমি দীঘির পাড়ে গিয়ে বসে থাকি। হয়তো ভাবিও গেছে।
– কিন্তু,,,
– আরে কিসের কিন্তু? দেখে আসতে তো সমস্যা নেই?
গ্রামে তিনটা দীঘি। একটা পুরুষদের, একটা মহিলাদের আরেকটা সোনাদিঘি, ওইখানে কেউই যায়না। হামিদ এবং চারুও দুইটা দীঘি দেখে ফাতেমাকে পেলো না। সকলে যখন সোনাদীঘির পাড়ে পৌছায় তখন সন্ধ্যা। সূর্য প্রায় পশ্চিমে হেলে পড়েছে, সোনাদিঘি পদ্ম ফুলে পরিপূর্ণ। এরই মাঝে প্রস্ফুটিত আছে এক কালো পদ্ম। সেই নতুন পদ্মকে দেখে হামিদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এ কি দেখছে সে? দীঘির জলে কালো পদ্ম। হামিদের একান্ত ব্যক্তিগত কালো পদ্ম!

_______________________

To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া