আরশি পর্ব-১৫

0
2167

#আরশি
#Part_15
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— আচ্ছা তুমি কি মেরিড? নাকে যে ফুল পড়ে আছো?

সাথে সাথে আমি চমকে উঠি। ডান হাতটা নিজ শক্তিতে উপরে উঠে আসে আর নাকের ডগায় এসে স্থির হয়। হাত বুলাতেই ছোট সাদা পাথরযুক্ত নাকফুলটার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। সাথে সাথে মনটা বিষিয়ে যায়। মনের মধ্যে চলতে থাকে হাজারো প্রশ্নের ছুটাছুটি খেলা। এরই মধ্যে জেসমিনের ডাক পড়তেই সে উঠে সেইদিকে চলে যায়। যাওয়ার আগে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে যায়,

— পরে কথা বলি কেমন। আপাতত ওইদিকে একটু যেতে হবে। বায়!

আমি একবার ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুরিয়ে নেই। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন কর‍তে থাকি,

— আমি এখনো নাকফুলটা পড়ে আছি কেন? হাতের চুড়ি ও গলার চেইন তো ফাহাদের বাসা থেকে আসার সময় খুলে রেখে এসেছিলাম তাহলে এইটা কিভাবে রয়ে গেল? আর এতদিনে আমি এইটা খেয়াল ও করলাম না? যদি জেসমিন না বলতো তাহলে হয়তো খেয়ালই করতাম না। আচ্ছা এই নাকফুলটার জন্যই কি বার বার আমায় ফাহাদের স্মৃতিগুলো তাড়া করে? এই নাকফুলটা কি এখনো আমাকে ওই সম্পর্কে বেঁধে রেখেছে?

প্রশ্নের কিছুটা উত্তর মিললো তো কিছুটা না। অস্থির হয়ে পড়লাম। বিষিয়ে যাওয়া মনটি আরও বিষে যায়। অসহ্য লাগতে শুরু করে সবকিছু। দোটানায় পড়ে যাই, নাকফুলটা কি খুলবো নাকি না? অতঃপর মামার একটা কথা টনক নারে,

“যতক্ষণ না তুই অতীতকে ভুলে যাচ্ছিস, যতক্ষণ না তুই ক্ষমা করতে পারছিস, যতক্ষণ না তুই মেনে নিচ্ছিস অতীত চলে গেছে – ততক্ষণ তুই নিজের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে পারবি না।”

কথাটা স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে আমি নাকফুলটা খুলে ফেলি। নাকফুলটা খুলে একটা টিস্যু পেপারে মুরিয়ে ব্যাগের এক কোনে রেখে দিলাম। সাথে সাথে বুক চিরে একরাশ দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। হঠাৎ মনে হতে থাকে নিজেকে আজ বড্ড হাল্কা লাগছে। মনে হচ্ছে কোন এক অদৃশ্য বোঝা যেন ঘাড় থেকে নেমেছে। বিষিয়ে যাও মনটি তার প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে জানি না শুধু এতটুকু জানি আমি আজ মুক্ত। পুরোপুরি ভাবেই মুক্ত।

______________________________________________

সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। পশ্চিম আকাশের বুকে হেলে পড়েছে রক্তিম সূর্যটি। নিজের রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিয়ে আকাশ জুড়ে চলছে লাল হলুদ মেঘের ছিনিমিনি খেলা। পাখিরা খুবই ব্যস্ত ভঙ্গিতে এইদিক সেইদিক ছুটাছুটি করছে। দেখে মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে কোথাও যাওয়ার তাড়া লেগে আছে। রাস্তার পাশের এক দেয়ালে বসে একঝাঁক কাক অতি কর্কশ কন্ঠে ডেকেই চলেছে। মাগরিবের আযান প্রতিধ্বনিত হতেই কাকের সেই দলটি তীব্রভাবে কলধ্বনি করে উঠে আর ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। প্রাকৃতিক আলোর আঁধারে বুকে লুকিয়ে পড়তেই শুরু হয় কৃত্রিম আলোর মাখামাখি।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনবরত বেল টিপছে ফাহাদ। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। গায়ের শার্টটি ঘামের কারণে শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের দানা। চোখে থাকা চিকন ফ্রেমের চশমাটি বার বার নাকের ডগায় এসে ঝুলে পড়ছে। ফাহাদ তা অতি সাবধানে বা হাতে আঙ্গুল দিয়ে ঠেলে পিছে গুচিয়ে দিচ্ছে। বেশকিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর জুঁই এসে দরজা খুলে দেয়। এতক্ষণ অপেক্ষা করানোর জন্য ফাহাদ রেগে জুঁইকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই জুঁই এর আটাতে মাখা চেহেরা দেখে ‘থ’ হয়ে যায়। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে জুঁই এর মুখ পানে৷ অস্ফুটে স্বরে বলে উঠে,

— তোমার এই অবস্থা কেন?

জুঁই এনিয়ে বিনিয়ে বলে,

— ওই আরকি ইয়ে মানে.. তোমার জন্য আলুর পরোটা করতে গিয়েছিলাম। তো ডোহ বানাতে গিয়ে চেহেরায় আটা লেগে যায়।

কথাটা শুনে ফাহাদ উচ্চস্বরে হেসে উঠে। জুঁই তা দেখে মুখ ফুলিয়ে বলে,

— এই একদম হাসবা না বলে দিচ্ছি। তোমার জন্যই আমার এই অবস্থা হয়েছে।

ফাহাদ ঘরের ভিতর ঢুকতে ঢুকতে বলে,

— তো করতে কি আমি বলেছি নাকি?

জুঁই দরজা দিয়ে ফাহাদের উদ্দেশ্যে বলে,

— বাহ রে! এখন কি আমি তোমার জন্য কিছু করতেও পারবো না?

ফাহাদ সোফায় বসে নিজের গলার টাইটা ঢিলে করে বলে,

— তা কখন বললাম? আর তুমি এইসব করতে গিয়েছ বাই কেন? তোমাকে না বলেছি এই অবস্থায় কোন ধরনের কাজ না করতে। আর বুয়া আসে নি আজ?

জুঁই ফাহাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

— এসেছিল তো৷ রাতের খাবার রেঁধে গিয়েছে। আর আলু পরোটা তুমি পছন্দ করো বলেই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না৷ জানোই তো আমি আটার দলাটা ঠিকমত করতে পারি না। বাকি সব পারলেও এই একটা জিনিসই আমার দ্বারা হয় না।

ফাহাদ জুঁই এর হাত ধরে ওকে নিজের পাশে বসায় তারপর বলে,

— তুমি আমার জন্য এতটুকুই করতে চেয়েছ এইটাই অনেক। বাট ফার্দার মোর তুমি এইসব করতে যাবে না। তোমার প্রেগন্যান্সির ফোর্থ মান্থ চলতাসে জানো না তুমি? এইসময়ে কতটা সাবধান থাকা লাগে জানা আছে তোমার?

জুঁই ফাহাদের হাতে হাত রেখে বলে,

— কিছু হবে না চিন্তা করো না তো। তুমি সবসময় একটু বেশি চিন্তা করো।

— তোমাকে নিয়ে ভয়ে থাকি বলেই চিন্তা করি। নিজের যত্ন নিলে এতটা ভাবতে হতো না আমায়।

— নেই তো।

— হ্যাঁ জানা আছে কতটুকু যত্ন নাও।

— যত্ন নিলেও কি না নিলেও কি? অন্যের সংসার ভেঙ্গে যেখানে আমি আমার সংসার সাজিয়েছি সেখানে কি আদৌ মনের শান্তি মিলে? ভয় তো আমার হয় যদি ওর অভিশাপ আমাদের লেগে যায়? আমাদের বাচ্চার কিছু…

জুঁইকে পুরো কথা শেষ করার আগেই ফাহাদ ওকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়৷

— চুপ! ঠাডিয়ে দিব এক। অনেক বাজে বকা শিখেছ তুমি। তুমি কারো সংসার নষ্ট করো নি। বরং সে মাঝে এসেছিল এখন সরে গিয়েছে। নিজের স্থানে ফেরত চলে গিয়েছে। ব্যাস! এতে অভিশাপ কেন লাগবে? আর এমনেও আমার সাথে আরশি যা ছিল তা আমি আরও দুই মাস আগেই শেষ করে দিয়ে এসেছি। যদি না সম্পর্ক থাকতো তাহলে কোন এক কথা ছিল। বাট নাও আই ইজ নান টু আস। তার কোন অস্তিত্ব নেই আমাদের জীবনে। সো ডোন্ট থিং এবাউট হার এন্ড অলসো ডোন্ট ফিল গিল্টি ওকে?

— হুম!

ফাহাদ মুচকি হেসে বলে,

— যাও মুখ ধুঁয়ে আসো৷ চেহেরার কি অবস্থা হয়ে আছে।

জুঁই তখন মাথা দুলিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। সাথেই ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে নিয়ে যায় এক রহস্যময় হাসি।

____________________________________________

ব্যস্ত শহরের কোলাহল বেড়েই চলেছে। পথেঘাটে জ্যামের সংখ্যা যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অহেতুক হর্ণের শব্দে পরিবেশ হয়ে উঠেছে গরম। সোডিয়াম লাইটের আলোয় রাস্তা ঝলমল করে উঠছে। রাস্তার পাশের রেস্তোরাঁ গুলোতে হাল্কা পাতলা ভীড় দেখা দিচ্ছে। সন্ধ্যার নাস্তা কিনছে সবাই। টং ঘরের সামনে এসে ঝাঁক দিয়ে এক রাশ তরুণদের দল। ধোঁয়া উঠা এককাপ চা হাতে নিয়ে মেতে উঠেছে নিজের আড্ডায়। রাস্তায় ঘুরে বেরাচ্ছে দুই-তিনটে কুকুর। হয়তো খাবারের সন্ধান করছে। ফুচকা,ঝালমুড়ি ও ভেরপুড়ির স্টলে জমেছে মেয়েদের ভীর। হৈচৈ এর শব্দ ভেসে আসছে কোথ থেকে যেন। বেশ জমে উঠেছে রাতের ঢাকা শহর।

আমি বাসের সিটে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। এমন সময় রাস্তার পাশে ফুচকার স্টলের সামনে এক যুগলদের দেখে চোখ আটকে যায়। ছেলেটির গায়ে হলুদ পাঞ্জাবি আর মেয়েটির গায়ে নীল জামদানী শাড়ি৷ মেয়েটি ফুচকা খাচ্ছে আর ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। তাদের দেখে হঠাৎ হুমায়ূন আহমেদের লিখা সেই বিশ্ব পরিচিত যুগলবন্দীর কথা মনে পড়ে যায়। হিমু আর রুপার কথা। রুপার চরিত্র আমার কাছে ঠিক কেমন ছিল জানি কিন্তু হিমুর চরিত্রটা ছিল অতি অসাধারণ। বলতে গেলে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ। হ্যাঁ একটু পাগলাটে টাইপ ছিল কিন্তু তাও তার মধ্যেই যেন ছিল এক রাশ মুগ্ধতা। অবশ্য এইটা ঠিক হিমুরা বাস্তবে হয় না। হয় শুধু কল্পনাতে। ভেবেই মুচকি হাসলাম। আবার তাকালাম সেই যুগলদের দিকে। তাদের দেখতে দেখতেই সিগন্যালের জ্যাম ছেড়ে। ধীরে ধীরে তারা আমার দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়।

বাসায় আসতে আসতে আজ একটু দেরি হয়ে যায়। আসলে কাজ বুঝতে আমার একটু সময় লেগে যায়। তার উপর জ্যামে প্রায় আধা ঘন্টার উপর বসেছিলাম যার জন্য বেশ দেরি হয়ে যায়। অফিসে থাকাকালীন জেসমিনের সাথে আর দেখ হয় নি। হয়তো কোন কাজে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে বাসার চাবি থাকায় আমি লক খুলে বাসার ভিতর ঢুকে পড়ি। সোজা চলে যাই নিজের রুমে। গিয়ে দেখি অহনা ঘুমাচ্ছে। সাথে সাথে আমার ভ্রু কুঁচকে আসে। এইসময় তো অহনার ঘুমানোর সময় না তাহলে? আমি ওর পাশে গিয়ে ওর মাথায় হাত দিয়ে ওর শরীরের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। না শরীরের তাপমাত্রা ঠিক আছে। আমি স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে বোরকা আর নিকাব খুলে ওয়াশরুমে চলে যাই ফ্রেশ হওয়ার জন্য। বেশ ক্লান্ত লাগছে।

ফ্রেশ হয়ে এসে আমি চলে যাই মামার রুমে। দেখার জন্য তিনি কি করছেন। তার রুমের সামনে এসে দেখি পুরো রুমটি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘেরা। দরজা ভেজানো। সাথে সাথে আমার খটকা লাগে। আমি আস্তে করে দরজা খুলে ভিতরে যাই। লাইট বোর্ডের কাছে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দেই। চারদিকে চোখ বুলাতেই নজর পড়ে ইজি চেয়ারের দিকে। মামা তাতে চোখ বুজে শুয়ে আছে। হাতে তার একটা বাসন্তী রঙের জামদানী শাড়ি। সেই সাথে কয়েকটা হলুদ রঙের চুড়ি। আরও কি যেন আছে। সেইগুলা দেখে আমি খানিকের জন্য চমকে উঠি। গোল গোল চোখে তাকিয়ে রই সেই জিনিসগুলোর দিকে। অতঃপর চোখ তুলে তাকাই মামার দিকে। ইতি মধ্যে মামা চোখ খুলেছে। হয়তো লাইটের আলো তার চোখে বিঁধছে। আমি মামার দিকে ভালো করে তাকাতেই দেখি চোখ তার কেমন লালচে হয়ে আছে। তা দেখে আমি অবাক হলাম তা কিন্তু না। বরং স্বাভাবিক ভাবেই নিলাম বিষয়টা। কেন না মামার হাতে শাড়িটা দেখেই আমি বাকি কাহিনী বুঝে গিয়েছিলাম। আমি স্বাভাবিক কন্ঠেই বলি,

— শাড়িটা মিহি আন্টির না? আজ হঠাৎ এতদিন পর বের করলে যে?

#চলবে

যুগল মানে কাপল/couple। অনেকে হয়তো শব্দটি নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন তাই জানিয়ে দেওয়া হলো।