আরশি পর্ব-১৪

0
2065

#আরশি
#Part_14
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

মিনিট দশেক ধরে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি বাসের জন্য। কিন্তু বাস আসার নাম গন্ধ নেই। আকাশের আজও মেঘ জমেছে৷ দুপুর কি বিকেলের দিকে বৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনা বেশি। দামকা হাওয়া বইছে। আমি মনে মনে ভাবছি, এই বুঝি ফাস্ট এট অফিস লেট হয় আমার। আরও পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পর বাস আসে। সাথে সাথে শুরু হয় মানুষের ধাক্কাধাক্কি। অনেক কষ্টে বাসে উঠি। উঠে দেখি সব সিট বুক। কোথাও কোন খালি সিট নেই। বেশিরভাগ মানুষই দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মনে পড়ে এখন অফিস টাইম। ভীড় হওয়া স্বাভাবিক। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে উপরের হ্যান্ডাল ধরে দাঁড়িয়ে রই। বেশ কিছুক্ষণ পর অনুভব করি কেউ আমার কোমরের নিচের দিকটা স্পর্শ করছে। একবার বা দুইবার নয় বার বার। সাথে সাথে আমি চমকে উঠি। একটু চেপে দাঁড়াই। সর্তক চোখে পিছে তাকাতেই দেখি এক মধ্যবয়স্ক লোক চোরাচোখে আমাকে দেখছে আবার এইদিক সেইদিক চোখ বুলাচ্ছে। আমি তার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকাই। বুঝার চেষ্টা করি স্পর্শটা কি তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে করেছেন নাকি ভুলবশত। কিন্তু বুঝতে পারলাম না। যার জন্য কিছু বলতেও পারলাম না। কেন না সে যদি ভুলবশত স্পর্শ করে থাকে তাহলে খামাখা তার উপর দোষ পড়বে। আর আমি চাই না আমার ভুল বুঝাবুঝির জন্য কেউ বিনা দোষে হেনেস্তা হোক। তাই আমি এইবারের মত বিষয়টা এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পেরুতেই আবার সেই একই ঘটনা ঘটলো। তখন আর আমার বুঝতে দেরি নি এই স্পর্শ ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত। সাথে সাথে রাগে আমার শরীর রি রি করে উঠে। আমি পিছে ঘুরে চেঁচিয়ে বলি,

— কি সমস্যা? আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?

লোকটা সাথে সাথে ঘাবড়ে যায়। আমার চেঁচানো শুনে সকলের নজর এসে আটকে আমার উপর। লোকটি তা দেখে অস্ফুট সুরে বলে উঠে,

— মানে কি? আপনার গায়ে আমি কখন হাত দিলাম?

— দেন নি বলছেন? বার বার ইচ্ছাকৃতভাবেই আমার উপর এসে পড়ছেন। গায়ে হাত দিচ্ছেন।

— আজব তো! চলতি বাস হাত বা ধাক্কা লাগতেই পারে। যদি এইসব সহ্য করতে না পারেন তাহলে বাসে উঠেন কেন?

তখন পাশ থেকে একজন বলে উঠে,

— আরেহ এতই যখন খুঁতখুঁত থাকে তাহলে লোকাল বাসে উঠে কেন এরা বুঝি না। উঠবেও আবার একটু হাত লাগলে বিষয়টাকে তিল থেকে তাল বানাবে।

কথাটা শুনে সেই লোকটা বিশ্রী হাসি দিয়ে বলে,

— ঠিক বলসেন ভাই। এইসব মেয়েরা বাসে উঠেই পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার জন্য।

তাদের কথা বার্তা শুনে আমি ‘থ’ হয়ে যাই। মাথা ঘুরে উঠে। আমি চারপাশ তাকিয়ে দেখি সকলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর ফিসফিসিয়ে কিছু যেন বলছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। আমি তখন বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে আমার এখন কি করা উচিৎ। প্রতিবাদ করা উচিৎ নাকি অন্য মেয়েদের মত চুপচাপ সব সহ্য করে নেওয়া উচিৎ। মধ্যবিত্ত মেয়েদের তো আবার প্রতিবাদ করতে নেই। সকল জায়গায় চুপ থেকে সব সহ্য করে নিতে হয়। হোক সেটা বাইরে বা ঘরে। এই শিক্ষায় তো তাদের ছোট থেকে দেওয়া হয়। তাই তো তাদের সহ্য করার ক্ষমতাটা অসীম। এইসব ভেবেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে নিলেই মামার একটা কথা টনক নাড়ে,

” হার মেনে নেয়া আমাদের বড় দূর্বলতা। সফল হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো হার মানার আগে অনেকবার চেষ্টা করা। ”

সাথে সাথে আমার মধ্যে সাহস ফিরে আসে। সিদ্ধান্ত নেই অনেক চুপ থেকেছি আর না। চুপ থেকে তো দেখলাম কিছুই হয় না বরং নিজেকেই সাফার করতে হয়। তাহলে এইবার না হয় প্রতিবাদী হয়েই দেখি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাই সেই লোকটির দিকে অতঃপর চেঁচিয়ে বলি,

— নিজে দোষ করে আমাকে কথা শুনানো হচ্ছে? দোষ তো আমি করি নি করেছেন আপনি। আর যদি আমি দোষ করে থাকি তাহলে বলুন আমার দোষ কথায়? আমাকে কেন হ্যারাসমেন্ট করা হচ্ছে?

অতঃপর ঘুরে সকলের উদ্দেশ্যে বলি,

— কি হলো কথা বলুন সবাই? আমি তো বোরকাই পড়া আছি সাথে নিকাবও। আপনাদের ভাষা সেফ পোশাক বা সুরক্ষিত পোশাক। তাহলে আমার সাথে এমন হওয়ার মানে নি? আমাকে কেন এইসব নোংরামির শিকার হতে হচ্ছে? আপনাদের সামনে সে আমাকে হেরাস করছে আর আপনারা সব বুঝেও চুপ আছেন। কেন? ছেলেদের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু মেয়েরা কেন চুপ? একজন মেয়ে অন্যের মেয়ের বিপদের সময় কেন পাশে দাঁড়াচ্ছেন না? বিবেকে বাঁধছে না? বলুন!

আমার কথা শুনে লোকটা ভরকে যায়। অস্ফুট সুরে বলে উঠে,

— আরেহ এত চিল্লা পাল্লা মানে কি বুঝলাম না। এই কন্ডাকটর একে নামান তো ভাই৷ পুরো পরিবেশই নষ্ট করে দিল সে।

আমি চেঁচিয়ে বলে উঠি,

— নামবো আমি না নামবেন আপনি। নামেন বলছি। ড্রাইভার সাহেব গাড়ি থামান বলছি। গাড়ি থামান৷

তৎক্ষনাৎ কি হলো বুঝলাম না বাসে উপস্থিত এক মেয়ে বলে উঠে, “গাড়ি থামান!” তার বলার সাথে সাথে আরও কয়েক কন্ঠ মিশ্রিত হয়। যার সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এক সময় সকলেই আমার পক্ষ হয়ে যায়। সকলের আওয়াজের কলধ্বনিতে ড্রাইভার বাধ্য হয় গাড়ি থামাতে। অতঃপর লোকটিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করার মত করে বাস থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাকে নামানোর পরই আমার মধ্যে আত্নবিশ্বাসটা গাঢ় হয়ে আসে। একটা জিনিস বুঝে যাই,
“তুমি যত চুপ থাকবে, যত সহ্য করবে ততই মানুষ তোমায় চেপে ধরবে। মাথার উপর উঠে নাচবে।”

___________________________________________________

একটু জন্য আজ আমার দেরি হয়নি। আল্লাহ এর রহমতে ঠিক সময়েই অফিস এসে পৌঁছেছি। অফিসে এসে জানতে পারি যে, কাজ বুঝার জন্য আমাকে সাদের কাছেই যেতে হবে। কথাটা শুনে আমার মধ্যে বিরক্তি নামক শব্দটি এসে উঁকি মারে। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারলাম না। চুপচাপ সাদের কেবিনের দিকে চলে যাই। কেবিনের সামনে এসে টোকা দিয়ে বলি,

— মে আই কাম ইন স্যার?

ভিতর থেকে শব্দ আসে,

— ইয়েস! কাম ইন।

আমি চুপচাপ ভিতরে চলে যাই। সাদ তখন একটা ফাইল চেক করছিল। ফাইল থেকে মাথা তুলে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে চওড়া হাসি দিয়ে বলে,

— আরেহ মিস দর্পণ যে! তা মিস দর্পণ কেমন আছ?

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলি,

— আলহামদুলিল্লাহ!

সাদ আমার কথা শুনে ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে বলে,

— তুমি কি দিন দিন ছোট হচ্ছ? নাকি আমার ঘাড়ে তোমাকে সব কাজ শিখানোর দায়িত্ব আছে বলে এখন সামাজিকতাও শিখাতে হবে?

সাদের কথা শুনে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। অস্ফুটে সুরে জিজ্ঞেস করে উঠলাম,

— মানে?

— না মানে আমাকে তো জিজ্ঞেস করলে না কেমন আছি? সামাজিকতা নামেও কিছু আছে রে ভাই।

আমি ছোট ছোট চোখ করে বলি,

— আপনি কেমন আছেন?

— ভালো মানুষরা সবসময় ভালোই থাকে বুঝলে।

আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। সাদ তা দেখে বলে,

— ভাই রে ভাই! সময়ের ব্যবধানে কত কিছু বদলে গেল কিন্তু তোমার এটিটিউড আর বদলানো না। এটিটিউডে পাওয়ার আছে বলতে হবে।

সাদের কথা শুনে আমি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। সে যে পিঞ্চ করে কথা বলছে তা বুঝতে দেরি নি। কিন্তু তাও আমি কিছু বললাম না। তা দেখে সাদ গলা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আমি ওর দিকে তাকাতেই দেখি ও আজ একটা সাদা কালো চেক শার্ট আর ব্ল্যাক ডেনিম প্ল্যান্ট পড়েছে। শার্টটা ইন করা। গলায় কালো টাই। কালো ঘন চুলগুলো ব্রাশ করা। ডান হাতে মেল ওয়াচ। মায়াভরা চোখ দুইটির নিচে হাল্কা কালো দাগ। সাধারণত শ্যাম বর্ণ ছেলেদের চোখে মায়া টুইটুম্বুর থাকে। সাদের বেলায়ও ঠিক তাই। ঠোঁট গুলো সিগারেটের আগুনে পুরে কালছে হয়ে গিয়েছে। তাও একটা মায়া মায়া ভাব আছে মুখখানিতে। লম্বায় হয়তো ৫ ফিট ৯ কি ১০ হবে। দেহের গঠন স্বাভাবিক। একবারে চিকনও না আবার মোটাও না। মিডিয়াম।

কখন যে আমি সাদকে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করি বুঝে উঠতে পারি নি। যখন বুঝতে পারলাম তখনই চোখ নামিয়ে নিতে নেই। কিন্তু তখনই এক জায়গায় আমার চোখ আটকে যায়। সাদ হাসলে ওর গালে গর্ত হয়। বেশ গভীর সেই গর্ত। সেটা চোখে পড়তেই আমার মস্তিষ্কে দুইজনের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। প্রথম অহনা দ্বিতীয় ফাহাদ। ফাহাদের কথা মাথায় আসতে আমি অস্বস্তিতে পড়ে যাই। হুট করে তিক্ত স্মৃতিগুলো তাড়া করে বেরায়। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। ঠিক এমন সময় সাদের ডাক শ্রবণ হতেই আমি চমকে উঠে। সর্তক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। সে বলছে,

— আর ইউ ওকে মিস দর্পণ?

আমি মাথা নারাই। লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে নেই। অতঃপর সাদ আমাকে কিছু বই ধরিয়ে দেয় পড়ার জন্য আর কিছু ফাইল বুঝিয়ে দেয়। সেগুলোই আপাতত দেখতে বলে। হয়তো সে বুঝতে পেরেছে আমার বেসিক কিছু নোলেজ আমার দরকার। হুট করে আমি সব সামলে উঠতে পারবো না।

কাজ বুঝা শেষে আমি বাইরে এসে পড়ি। সাদ আমাকে আগেরদিনই আমার ডেস্ক দেখিয়ে দিয়েছিল তাই আমি আজ সেখানে এসেই বসি। কাধের ব্যাগ নিচে রেখে বই আর ফাইলগুলো টেবিলের উপর রাখি। অতঃপর আমি ফাইলগুলো দেখতে থাকি। গরম লাগছিল বিধায় নিকাবটা খুলে নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর আমার পাশে বসে থাকা মেয়েটি বলে উঠে,

— হেই! তুমি কি নিউকামার? মানে যে আজ নতুন জয়েন করেছে?

আমি পাশে ফিরে দেখি একটা মেয়ে। সে হাস্যজ্জ্বল মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গায়ে লেডিস শার্ট আর জিন্স পড়া। গায়ের রঙ হলদে ফর্সা। চোখগুলো ছোট ছোট। একদম চাকমাদের মত। কালার করা চুলগুলো উঁচু করে ঝুটি করা আর ঠোঁটে নিউড কালারের লিপস্টিক। গাল গুলো একটু ফুলা আর তাতে হাল্কা ব্লাসন দেওয়া। গলার মাঝে ছোট একটি লোকেট আলা চেইন। দেখতে মাশাআল্লাহ। আমি তাকে দেখে হাসি দিয়ে বলি,

— হ্যাঁ সে আমি।

মেয়েটা খুশি হয়ে বলে,

— ওয়েলকাম টু আওয়ার অফিস। আমি জেসমিন তুমি?

— আমি আরশি।

— নাইস নেম।

— থ্যাংক। আপনার নামটাও বেশ সুন্দর।

— হেই আপনি বলছো কেন? আমরা কলিগ রাইট? সো তুমি বললেই হবে আর যদি ভালো ফ্রেন্ড হয়ে যাই তাহলে তুই।

আমি প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলাম। মেয়েটা যে বেশ সহজ সরল মনের মানুষ তা তার কথা বার্তা থেকেই বুঝা যায়। সাথে বেশ মিশুকও বটে। জেসমিন আমার সাথে এই সেই নিয়ে অনেক কথা বলতে থাকে। আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করেছে। আমিও তার উত্তর দিয়েছি। মেয়েটা কথা বলে বেশি। মানে বাচাল টাইপ। কিন্তু তাও বেশ মিষ্টি। কথায় কথায় জেসমিন বলে উঠে,

— আচ্ছা তুমি কি মেরিড? নাকে যে ফুল পড়ে আছো?

#চলবে